পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০২৪

১৮। তীর্থ ভ্রমণ ৩ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                  -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

কাশী ছাড়ার পর প্রথম মেড়ুয়াডিহিতে (মারুয়াডিহ, উত্তর প্রদেশ) রাত্রি বাস। তারপর তামেচাবাদ (তামাচাবাদ) হয়ে মহারাজগঞ্জ (মহারাজগঞ্জ), পরদিন গোপীগঞ্জে (গোপিগঞ্জ) স্থিতি। তারপর ক্রমে হাড়িয়া (হরিয়া), ঝুসীগ্রাম (ঝুসী) হয়ে  নৌকার পুলে গঙ্গা পার হয়ে এক ক্রোশ গিয়ে ত্রিধারা অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর নদীর ঘাট বেনীঘাটে রাত্রি বাস। এখানে যাত্রীদের প্রয়াগে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়াগীরা (প্রযাগের পান্ডা) উপস্থিত। প্রয়াগীরা অত্যন্ত লোভী, নির্দয়, নিষ্ঠুর। প্রথমে যাত্রী নেওয়ার সময় ভদ্র ব্যবহার করে কিন্ত পরে দুর্ব্যবহার করে। তাদের সৈন্য আছে (!) যাত্রীরা প্রয়াগতীর্থে পৌঁছে মুন্ডন ও উপবাস করলেন। 


পরদিন ত্রিধারাতে স্নান তর্পণ, তীর্থশ্রাদ্ধ, ব্রাহ্মণ ভোজন, প্রয়াগ মাহাত্ম্য শ্রবণ করলেন। তারপরের দিন আবার ত্রিধারায় স্নান করে পঞ্চক্রোশী পরিক্রমণ, বেণীমাধব দর্শন, কেল্লার ভিতরে অক্ষয়বট দর্শন, সরস্বতী নদীর গুপ্ত ভাব দর্শন প্রভৃতি করলেন। সরস্বতী নদীর উপরে যমুনার পশ্চিম ধারে পাথরের তৈরি কেল্লা। কেল্লার মধ্যে বাড়িঘর। বড় বড় কামান বন্দুক তরবারিতে কেল্লা সুরক্ষিত। কেল্লায় এক ক্রোশ অন্তর  পদাতিকদের ছাউনি। শহরে বাজার, কাছারি, ডাক্তারখানা, ডাকঘর সব আছে। উত্তরে স্টিমার অফিস। এই প্রয়াগকে এলাহাবাদ বলে। শহরে ৫০ হাজার ঘর আছে। জল বাতাস খুব ভালো, শরীর ভালো থাকে।


এরপর লেখক তিতু বাগদি আর মহেন্দ্রনাথ মিত্র সহ বৃন্দাবন যাত্রা করলেন। বাকিরা দেশে ফিরে গেলেন। এরপর দুর্গাগঞ্জ , ইমামগঞ্জ, গোলামীপুর (গুলামীপুর), ভূধরের সরাই (?), চৌধুরী সরাই (চৌধুরী সরাই), কুঙরপুর (কুনওয়ারপুর), খাজুয়া (খাজুয়া) হয়ে ছয় দিনে কানপুর পৌঁছলেন। এখানে ইংরাজ সরকারের পদাতিক সৈন্যদের শিক্ষার স্থান রয়েছে। দুর্গ নির্মিত নেই, মাঠের মধ্যে ছাউনি। এখানে অনেক গোলাগুলি, বারুদের সংগ্রহ আছে। প্রহরীরা সতর্কভাবে পাহারা দেয়। বাদশাহী আমলের বড় বড় মজবুত সরাই আছে পথিকদের জন্য। প্রায় ৩০০ বাঙালি আছেন। এক কালীবাড়ি আছে, সেখানে অতিথিরা থাকতে পারেন। জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টরের কাছারি, দেওয়ানি ও ফৌজদারির কাছারি আছে।




কানপুর থেকে সেকেন্দা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


কানপুরের উত্তর পূর্বে আট ক্রোশ দূরে বিঠোর (বিঠুর)। এটি বাল্মিকী মুনির তপোবন। সীতার বসবাস স্থান, লব কুশের জন্মস্থান। পুনা সেতারার বাজিরাও এর বাড়ি ও সৈন্য কিছু এখানে আছে। তার দত্তক পুত্রের পুত্র নানা সাহেব ওই পদাতিক সৈন্য নিয়ে এখানে থাকেন। 


এবার এলেন কান্যকুব্জ   (কনৌজ)। এখানে কনৌজের ব্রাহ্মণদের বাস স্থান। এখন থেকে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা গৌড়ে এসে কৌলিন্য প্রথার সূচনা করেছিল। এখানে অনেক প্রাচীন দেবালয়, প্রাচীন অট্টালিকা আছে ও অনেক পন্ডিত বেদজ্ঞ বসবাস করেন। 


এবার গঙ্গা পার হয়ে লক্ষ্ণৌ শহর, যা তখন নবাবের অধিকারে ছিল।সেখানকার মানুষ ধনী, মহাবলশালী, উগ্র স্বভাব এবং অল্প কথায় বিবাদ হলেও তরবারি চলে। ইংরাজ সরকারের তরফ থেকে একজন রেসিডেন্ট ও দুই দল সৈন্য আছে। নবাবের রাজ্য অধিক দূর নহে অথচ ৫২ রাজার সিংহাসন _ এই মন্তব্য করেছেন লেখক সকলেরই সৈন্য সমাবেশ আছে। এক হাজারের কম বন্দুকধারী কারো না। দশ হাজার পর্যন্ত অনেকেরই আছে। শহর প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। শহরে প্রবেশের সময় নবাবের দ্বারপাল নাম ধাম জিজ্ঞেস করে। অস্ত্রধারী ভিন্ন রাজ্যবাসীকে প্রবেশ করতে দেয় না। কোনো বিদেশি এই রাজ্যে এলে স্থানে স্থানে বলপূর্বক তার থেকে টাকা-পয়সা নেওয়া হয়, এমন অরাজগতা বিদ্যমান। নবাব দুর্গের মধ্যে সাত মহলায় বাস করেন। গোমতী নদীর তীরে এই শহর। মচ্ছিভবন নামে একটা বড় বাড়ি আছে, তার মধ্যে ফুল ফলের বাগান পুকুর আর থাকার ভালো ভালো ঘর আছে। মাটির নীচে নবাবদের গোরস্থান আর মৃত নবাবদের ধন দৌলত কোষাগার করে রাখা আছে। অনেক প্রহরী ও কামান আছে সেসব পাহারা দেওয়ার। নবাবদের অজস্র ধন-সম্পদ আছে। একজন বাঙালি জহুরী লেখককে জানালেন প্রতি বছর ক্রোর টাকার জহরত্ নবাবরা ক্রয় করেন। তাদের জুতোর উপরেও হিরে বসানো থাকে।


পরবর্তী গন্তব্য অযোধ্যা, শ্রীরামচন্দ্রের রাজধানী বন জঙ্গল হয়েছে। মধ্যে মধ্যে বসতি ও রাম সীতার মূর্তি আছে। রামনবমীতে মেলা হয়। পাঁচ ছয় হাজার বৈষ্ণব শ্রীরামের জন্মভূমি ও হনুমান গড়িতে আছে, সর্বদা ভজন সাধনে উম্মত্ত। বড় বড় হনুমান আছে কিন্তু তারা কারো ক্ষতি করে না। বরং স্তবস্তুতি করলে পথিককে পথ দেখানোর জন্য আগে আগে যায়। যেখানে রামচন্দ্রের জন্মভূমি সেই দ্বারে এক বৃহৎ হনুমান আছে তাকে কিছু খাদ্য দ্রব্য না দিলে পথ ছাড়ে না। যে স্থানে রাজ সিংহাসন ছিল সেখানে উচ্চ দ্বীপের ন্যায় হয়ে আছে। রাজধানী প্রায় দশ ক্রোশ পর্যন্ত ছিল। বাড়িঘরের চিহ্ন ইঁট পাথর তখনও ছিল।


গঙ্গা পার হয়ে মিথিলায় (নাকি সীতাপুর, উত্তর প্রদেশ?)। এর মধ্যে নৈমিষারণ্যে যান, যেখানে ৬০ সহস্র ঋষির তপোবন ছিল। নানা ফুলে সুশোভিত বন, নির্জন স্থান দেখে খুব আনন্দলাভ করলেন। এবার সেকেন্দ্রা (সিকান্দ্রা) উপস্থিত হলেন। সেখানে জেলার কাছারি, ডাকঘর, ডাক্তার-খানা আছে । এখানে এমন কাছারি দেখেন যেখানে মুসলমান মুন্সেফ আর ব্রাহ্মণ দারোগা। দোকান ঘরে থাকার ব্যবস্থা আছে। দোকানে পুরি, কচুরি, মিঠাই, প্যাঁড়া পাওয়া যায়। সেকেন্দ্রা থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হলো।

                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৪ চৈত্র ১২৬০ (৭ এপ্রিল ১৮৫৪) থেকে ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১২৬২ (৩০ মে ১৮৫৪)




প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

৪টি মন্তব্য:

  1. প্রয়াগের পাণ্ডা দের উৎপাত কি আজও বিদ্যমান তীর্থ যাত্রীদের উপর? কিছু তীর্থ স্থানে তো পাণ্ডাদের উৎপাত এখনও সামলাতে হয় যাত্রীদের। যাক্ সেকথা তবে নবাবদের ধন দৌলতের কথাও বেশ আকর্ষণীয়।।রাম জন্মভূমি তে হনুমানের পথ দেখানোর কথা টা পড়ে বেশ লাগলো।
    লেখিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এতো সুন্দর ও সহজ করে ভ্রমণ কাহিনী পরিবেশন করে আমাদের জ্ঞান বর্ধনের জন্য 🙏
    শিউলি

    উত্তরমুছুন
  2. ওই সময় ইট পাথরের ঘর বাড়ি ছিল ভাবতেও অবাক লাগে

    উত্তরমুছুন
  3. ধন্যবাদ 🙏
    ভারতের প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সিন্ধুসভ্যতায়র বিভিন্ন স্থানেও কিন্তু ইঁটের ব্যবহার দেখা গেছে।

    উত্তরমুছুন