পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪

৯। তীর্থ মঙ্গল ৪ বিজয়রাম সেনবিশারদ


         সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                      ---- সুমনা দাম 

               (আগের পর্বের পরে)

গয়াতে অনেক যাত্রী এসে কর্তার সঙ্গী হলেন। এবার ঘোষাল মহাশয় কাশী যাবেন বলে মনস্থ করেছেন। ঘোষাল মহাশয়ের সঙ্গী হয় মহারাষ্ট্র, কুরুক্ষেত্র, উড়িষ্যা, ঢাকা আদি বঙ্গদেশের যাত্রীরা, আগে পিছে পাহারায় এভাবে টিকারী রাজ্যে এলেন। সেখানকার রাজা ছিলেন সুন্দর সা, যাঁকে মীরকাসীম হত্যা করেছিলেন। তাঁর বাড়িতে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হল। থাকার জন্যে দেওয়া হলো বড় বড় ঘর, গালিচা পাতা। কোচগ্রাম হয়ে, ধরারার অপূর্ব বাগিচা দর্শন করে, সামনে আদি গঙ্গা দেখে যাত্রীরা জলস্পর্শ করেন। শোন নদী পড়ল পথে। এবার এলো সরসরা (সাসারাম)। কবি বলেছেন এই জায়গাতে হরিশ্চন্দ্রের বাড়ি। পুরাণে হরিশ্চন্দ্রের পুত্র রোহিতাশ্বের নাম থেকে শোন নদীর ওপর রোহিতাশ্বগড় বা রোহতাসগড় নামক পর্বতের নাম হয়েছে বলে কবি এই স্থানকে হরিশ্চন্দ্রের বাড়ি বলেছেন। এছাড়া বলেছেন যে এখানে অরঙ্গ পাৎসার গোড় আছে মানে আওরঙ্গজেবের কবর আছে। আসলে দিল্লির সম্রাট শেরশাহের কবর এখানে আছে। তার অপূর্ব নির্মাণ দেখে যাত্রীরা মুগ্ধ হয়।


কাশী থেকে বিন্ধ্যাচল, চুনার হয়ে কাশী ফেরা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে, উল্লেখ্য যে সেই ভ্রমণটি হয়েছিল নদীপথে)


কর্মনাশা নদীতে যাত্রীরা দুই তিন পয়সা দিয়ে মানুষের কাঁধে চেপে পার হল কারণ প্রচলিত ধারণা ছিল যে জন্ম থেকে যত ধর্ম-কর্ম করা হয় সেই নদীর জল স্পর্শ করলে নাকি সব নষ্ট হয়ে যায়। এবার মোগলসরাই পার হলো। দূরে বেণী মাধবের ধ্বজা দেখতে পাওয়া গেল। দুলভীপুরের বাগিচায় রাত্রি বাস হল।


কাশীর উত্তরভাগে বরণা নদী আর দক্ষিণ ভাগে অসি নদী। কাশীর বসতি অর্ধচন্দ্রাকারে রয়েছে। নদীতে সবাই স্নান ও তর্পণ করল। নৌকা কাশীর বাঙ্গালীঘাটায় অর্থাৎ বাঙালিটোলায় রাখা হল। বিশ্বেশ্বর শিব, অন্নদা দেবীর পূজা করে ও দক্ষিণা দিয়ে, মনিকর্ণিকা ইত্যাদি পঞ্চতীর্থ স্থানে তর্পণ দিয়ে এল সবাই। 


এবার যাওয়া হবে প্রয়াগ। মোহনসরাই, মহারাজগঞ্জ, মাধব সরাই, গোপীগঞ্জ, জগদীশসরাই, কুচ, ঝু্চি (ঝুসী) হয়ে গৌতম আশ্রম ও যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞকুন্ড দেখে যাত্রীরা গঙ্গা পার হলেন। যমুনা গঙ্গাতে স্নান করে প্রয়াগ দর্শনে গেলেন। গঙ্গাতীরে পিণ্ডদান, ব্রাহ্মণ বিদায় করলেন। বেণীমাধব দর্শন ও পঞ্চতীর্থতে পুজো দিয়ে প্রয়াগের কেল্লা দর্শন করলেন। অক্ষয় বট দর্শন হলো। দশাশ্বমেধ ও ভরদ্বাজ আশ্রম দর্শন করলেন। এরপর কিছু সঙ্গী বৃন্দাবন গেল। ঘোষাল মহাশয় কাশী ফিরে চললেন।


নৌকা পথে বিন্ধ্যাচলের বিন্ধ্যবাসিনীর কাছে এসে দেড় ক্রোশ পথ পেরিয়ে পাহাড়ের ওপর বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর পূজা দিলেন বলিদান সহ। মৃজাপুর মানে মির্জাপুর, চন্ডাল গড় বা চুনার হয়ে কাশীতে এলেন। মহা ধুমধাম-এর সঙ্গে পূর্বপুরুষ (পিতা) কন্দর্প ঘোষালের নামে শিব প্রতিষ্ঠা করলেন ঘোষাল মহাশয়। কন্দর্পেশ্বর নাম হলো সেই শিবের। এরপর বিশ্বনাথ, অন্নপূর্ণা, কালভৈরব, কেদারেশ্বর, বিশ্বেশ্বর, তিলভাণ্ডেশ্বর প্রমুখ সকল দেবদেবীর পূজা করলেন। দুর্গাকুণ্ড সহ যত কুণ্ড আছে সব কুন্ডে স্নান করলেন। কাশীর ব্রাহ্মণ যেন দেবতার মত, অপূর্ব বস্ত্র পরিহিত, কপালে চন্দন, মধ্যে রুলির দাগ। উজ্জ্বল মূর্তির নারীরা যেন বিদ্যাধরী, গজেন্দ্র গামিনী , তাদের লজ্জা ভয় নেই। কাশীতে রানী ভবানী যে কীর্তি রেখে গেছেন সেরকম কেউ করেননি বলে কবি মন্তব্য করেছেন। কত বড় বড় বাড়ি করে, বছরের খরচ দিয়ে বিতরণ করেছেন, কত দেবালয় করেছেন, যে যা চায় তাই পায় এমন ব্যবস্থা। মাধবের ধ্বজা আছে গঙ্গার ধারে, ২০০ হাত উঁচু। সুন্দর পাকে পাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। এক পয়সা করে দিয়ে যাত্রীরা উঠে বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পায়। 


এবার কিছু যাত্রীকে কর্তা টাকা দিয়ে বিদায় দিলেন। তারা নিজের নিজের বাড়ি চলে গেল। কর্তা সহ অনেকের মসূরিকা অর্থাৎ বসন্ত রোগ হতে থাকলো, দেখে কর্তা দেশে ফিরতে উদ্যোগ নিলেন। সঙ্গের বৈদ্য, বিজয়রাম সেনবিশারদ (তীর্থ মঙ্গলের লেখক) কর্তাকে সুস্থ করে তুললেন। অতঃপর ঘোষাল মহাশয় কাশীর রাজা বলবন্ত সিংহের সঙ্গে তাঁর রাজবাড়ী, কাশীর অপর পাড়ে শ্রীরামনগরে দেখা করতে চললেন, অসী খাল পথে দশটি নৌকা করে। অপূর্ব রাজবাড়ী দেখে সবাই খুশি। কর্তা রাজার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করলেন।

                     (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

৬টি মন্তব্য:

  1. ঘোষাল মহাশয়ের কাশি ভ্রমণের বিবরণের মাধ্যমে অনেক স্থানের প্রসঙ্গে অবগত হলাম। কর্মনাশা নদীর প্রচলিত কুসংস্কারের ব্যাখ্যাটা অদ্ভুত। সত্যিই মানুষ কতভাবে superstitious হতে পারে ভাবতেই কোন আদিম যুগে পিছিয়ে যাই।আজও এমনটাই কত কুসংস্কারে ডুবে আছে কতো মন।
    যাই হোক প্রতিটা পর্ব আমার খুব ভালো লাগছে এবং পরের পর্বের আগ্রহ তৈরী করছে মনে।

    উত্তরমুছুন
  2. লেখিকার এই সুস্থ উদ্যোগের জন্য অনেক ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা জানাই 🙏
    শিউলি

    উত্তরমুছুন
  3. আপনার আগ্রহ আর অনুসন্ধিৎসা প্রশংসনীয়। অনেক ধন্যবাদ 🙏

    উত্তরমুছুন
  4. প্রত্যেক টা পর্ব পরে খুব ভালো লাগছে পড়বর্তী পর্ব পড়ার আগেহ বাড়ছে

    উত্তরমুছুন
  5. ধন্যবাদ 🙏
    ভালো লাগলে পরিচিতদের সঙ্গে share করতে পারেন।

    উত্তরমুছুন