পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৪

২৬। তীর্থ ভ্রমণ ১১ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ            ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                   (আগের পর্বের পরে)


ভীমগড়া থেকে গৌরীকুন্ড, ঝিলমিল চটি হয়ে অসিমঠ (ঊষামঠ বা উখীমঠ) এলো। এটি কেদারনাথের শীতকালীন গদি, ছয় মাস এখানে পূজা হয়। এখানে বাজার আছে। এখানকার কেদারনাথের মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির দর্শন করা হলো। এরপর পুথিবাসা, বামনীচটি, ক্ষেত্রপাল-এর চটি, গরুড়গঙ্গা, কুমারচটি এবং বিষ্ণুপ্রয়াগ হয়ে যোশীমঠ এলেন অষ্টম দিনে। যোশীমঠ বদ্রীনারায়ণের শীতকালীন গদি। এখানে ছয় মাস তাঁর পূজা হয়। এখানে লক্ষ্মীনারায়ণ ও হরগৌরী দর্শন করা হল। এখানে বদ্রীনারায়ণের ধর্মশালা আছে। যোশীমঠ থেকে আট ক্রোশ দূরে পান্ডুকেশ্বর। সেখানে পাণ্ডবদের স্থাপিত শিব আছেন। এছাড়া চতুর্ভুজ নারায়ণও দর্শন করলেন। এবার মউজ চটি হয়ে আট ক্রোশ চড়াই গিয়ে তৃতীয় দিনে (কেদারনাথ থেকে দ্বাদশ দিনে) বদ্রীনারায়ণের পাহাড়। শেষ চার ক্রোশ বরফের মধ্যে দিয়ে চলতে হল। অলকানন্দার ওপর কাঠের পুল পেরিয়ে এক বৈরাগীর বাড়িতে থাকা হল। সেখানে অসহ্য শীত। 


তপ্তকুন্ডে স্নান করে বদ্রীনারায়ণের দর্শনে যাওয়া হল। তপ্তকুন্ডের পরিসর কুড়ি হাত দীর্ঘ, ষোলো হাত প্রস্থ। কুন্ড প্রস্তর নির্মিত ঘরে আচ্ছাদিত। ঝর্ণা থেকে গরম জল এসে ঘরে পূর্ণ হচ্ছে। গরু, সিংহ, হাতি ও বাঘের মুখ দিয়ে জল কুণ্ডে পড়ছে। বদ্রীনারায়ণ দ্বিভুজ, অতি চমৎকার দর্শন। এই মূর্তি কেউ স্পর্শ করতে পারেনা। চার স্তরে তৈরি মন্দিরের দ্বিতীয় স্তর থেকে বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হলে তৃতীয় স্তর থেকে দেবদর্শন করতে হয়। মন্দিরের মধ্যে অনেক অন্য দেবদেবী, মুনি ঋষির মূর্তি আছে। 


বদ্রীনাথের মহাপ্রসাদ (অন্নভোগ) বাজারে কিনে গ্রহণ করা যায়। ব্রহ্মকপাল নামক স্থানে পিণ্ডদান করা হলো। সেই দিন এক প্রহরের সময় সূর্য গ্রহণ হয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তপ্তকুণ্ড, সূর্যকুন্ড, নাগরাজকুন্ড, ঊর্ধ্বরেতকুন্ড, বিষ্ণুকুন্ড ও সঙ্গমস্থল এইসব স্থানে স্নান করা হল। নাগরাজকুন্ডে স্নান করা অত্যন্ত কঠিন। দুটি পাথরের মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গের মতো স্থান দিয়ে নামতে গিয়ে অলকানন্দার জলে পড়ে দেহত্যাগের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। বদ্রীনাথের মন্দির থেকে তিন ক্রোশ দূরে সহস্রধারা ঝর্ণা। বদ্রীনাথ বাজারে বেশ কিছু দোকান ও মানুষের থাকার জায়গা আছে। জিনিসপত্র বহুদূর থেকে আসে তাই দুর্মূল্য। 


এখানে লেখক ভোট রাজ্যের কথা বলেন। এখান থেকে ভোট রাজ্য নয় দিনের পথ। উত্তর-পশ্চিম দেশ। ভোটে যাওয়া আসা করা যায় তবে সহজে যাওয়া যায় না। অত্যন্ত বরফময় সেই পথে পশমের জামা, ভোটের জুতো পরে তবে যাওয়া যায়।সেখানে নারী-পুরুষ সবাই মদ ও মাংস খায়। ভোটে কুকুর, ঘোড়া, চমরী গাই ভালো পাওয়া যায়। স্ত্রী লোকেরা সেখানে অত্যন্ত বলবান ও পরিশ্রমী হয়। এই ভোটে তিনি যাননি, হয়তো বদ্রীনাথে এদেশের কথা শুনেছিলেন। কিন্তু এটি কোন দেশ? খুব সম্ভবতঃ তিব্বতের কথা বলেছেন লেখক। 


দুই রাত বদ্রীনারায়ণে থেকে, পূজা, দর্শন, ব্রাহ্মণ ভোজন ইত্যাদি করে এবার সকলের ফেরার পালা। পান্ডুকেশ্বর, কুমাচটি, যোশীমঠ, গরুড়গঙ্গা, পিপড় কুঠি (পিপল কোট), ক্ষেত্রপাল, নন্দপ্রয়াগ হয়ে আদিবদ্রী দর্শন করা হলো। এরপর এলো গোবিন্দকুঠী। এখান থেকে দশ ক্রোশ পাহাড়ি পথে আলমোরা যাওয়া যায়। ওই পাহাড়ে কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি, ডাকঘর, সেনা ছাউনি আছে। পাহাড়ের মধ্যে শহরের মতো সব কিছু পাওয়া যায়। এরপর কর্ণপ্রয়াগ, সেখানে সঙ্গমে স্নান করে কর্ণ মুনির আশ্রম দেখলেন। এখানে বাজারে অনেক রকম জিনিস পাওয়া যায়। কাঠের একটা পুল হয়েছিল পারাপারের জন্য কিন্তু সেটা ভেঙে যাওয়ায় তখন ঝোলাপুলই ভরসা। এরপর শিমকুঠী হয়ে মেলচৌরী। এখানে পূর্বের ঝাপান ও কান্ডিওয়ালারা বিদায় নিল। তারা অনেক অনুরোধ সত্বেও আর নীচে নামতে রাজি হলো না কারণ তারা বরফের দেশের মানুষ, গরম তাদের সহ্য হয় না।


মেলচৌরী থেকে আবার নতুন ঝাপান ও কান্ডি নেওয়া হল। এরপর এলো লোহাগড় (লোহাঘাট)। এখানে পাহাড়ে লোহার আকর আছে ও লোহা গলানোর স্থান আছে। এবার তাঁরা এলেন বুড়া কেদারে। এখানে কেদারনাথ আছেন কৌশল্যা নদীর পূর্ব পাড়ে। এরপর কানাগির চটি হয়ে কৌশল্যা নদীর পাড় দিয়ে পথ, সাত বার নদী পার হতে হলো। নদীতে খুব স্রোত, জলের মধ্যে পিছল পাথর, পা পিছলে জলে পড়লে ভেসে যেতে হবে। সে রাতে পাহাড়ের উপর বনের ধারে আগুন জ্বালিয়ে থাকা হলো। তারপর ক্রমে ক্রমে এলো ঢিকলি, রামনগর, চিনখা, কাশীপুর। কাশীপুরে ভালো ভালো বাড়ি ঘর, বাজার আছে, আছে তহসিলদার ও কোতোয়ালের কাছারি। আগে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার, কালেক্টর-এর কাছারি ছিল। এখন সেসব আট ক্রোশ দূরে নৈনিতালের পাহাড়ে চলে গেছে। এই পাহাড়ে নৈনিতাল ( নৈনি দেবী) নামে দেবী আছেন। আর আছে এক কুণ্ড। সেই কুণ্ডে স্নান, দেবী দর্শন ও তালেশ্বর ভৈরব দর্শন করা হয়। ছাউনি থেকে দুই ক্রোশ উপরে অতি মনোরম স্থান দেবদেবী কুন্ড। এখানে বাঙালি বাবুলোকেরা আছেন। আগে বিকট পথ এবং হিংস্র পশুর  ভয়ে মানুষ যাতায়াত করতে পারত না। এখন কাছারি ও সৈন্যরা থাকাতে ভালো পথ হয়েছে বলে মানুষ অনায়াসে যাতায়াত করছে। 


এরপর কাশীপুর থেকে সম্বলমুরাদাবাদ চোদ্দ ক্রোশ (প্রায় ৪২ কিলোমিটার) একদিনে তাঁরা পাড়ি দিলেন। সম্বলমুরাদাবাদ থেকে গরমের জন্য রাতে হেঁটে যাত্রা করা শুরু হলো। এখানে রাতে যাতায়াতে কোন ভয় নেই। কেউ কাউকে হিংসা করে না। চলতে চলতে কারো ঘুম পেয়ে গেলে সে গাছের তলায় কাপড় পেতে ঘুমায়, পরে সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হয়। তাই কারো পথ চলতে ক্লান্তি হতো না। তারপর শিরসা থেকে গোমা চোদ্দ ক্রোশ। তারপর দানপুর হয়ে কোয়েল এল। কোয়েল শহরে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর, সদরআলা, সদর আমিন, মুন্সেফের কাছারি আছে। সৈন্যদের ছাউনিতে যুদ্ধের জন্য সর্বদা প্রশিক্ষণ চলেছে। বাজারে নানা রকম দ্রব্যের অনেক দোকান আছে। কালিবাড়ি আছে বাঙালি বাবুদের। কোয়েল থেকে বেশরা, মানসরোবর, মাঠগ্রাম হয়ে যমুনার কেশীঘাটে নৌকায় পার হয়ে বৃন্দাবন ফেরা হলো ২৪ জৈষ্ঠ্য, ১২৬২ তারিখে।

 

বদ্রীনাথ থেকে কুড়ি দিন লাগলো পদব্রজে বৃন্দাবন আর হরিদ্বার থেকে কেদার-বদ্রী হয়ে বৃন্দাবন পৌঁছাতে প্রায় সাত সপ্তাহ লাগল। সেদিন বৃন্দাবনের শ্রীজিউদের মন্দির দর্শন করে, পরিচিত বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাসায় এসে বহুদিন পর শান্তিতে সবাই নিদ্রা গেলেন। হিংস্র জন্তু অধ্যুষিত পাহাড় জঙ্গলে ভ্রমণকালে কারো বিশ্রাম হয়নি বললেই চলে। খাওয়া অনিয়মিত ও অনভ্যস্ত খাদ্যদ্রব্য। বালুকাময় পার্বত্য রুক্ষ পথ, কাঁটাযুক্ত বনে হাঁটায় পা ক্ষতবিক্ষত। দেহ অস্থিচর্ম-সার হয়েছে। গায়ের চামড়া রোদে পুড়ে গেছে। কিন্তু এত কষ্ট করার ফলে উত্তরাখণ্ডের শ্রেষ্ঠ তীর্থগুলো দেখা হয়েছে। নানা দেশ ঘোরায় নানা মানুষ দেখা ও তাদের ব্যবহার অনুভব করা যায়। পাহাড়ের মানুষ সত্যবাদী, কখনো মিথ্যা বলে না, চুরি, অপহরণ, বিশ্বাসঘাতকতা জানে না। সকলে পরিশ্রম করে দিনযাপন করে। স্ত্রী লোকেরা ক্ষেতিকর্ম করে, পুরুষ কেবল হাল করে জমি তৈরি করে দেয়। পর্বতে অকাল মৃত্যু নেই, তাই অল্প বয়স্কা কোন বিধবা নেই। মাছ মাংস সবাই খায়। পরিধেয়, কম্বল, আভরণ তারা আপন শ্রম দিয়ে সংগ্রহ করে। স্ত্রী লোকেরা ভ্রষ্টা নয়। তাদের কোন দ্বিধা সংকোচ নেই। তারা একা পাহাড়ে বনে ঘুরে বেড়াতে পারে। যাদের গায়ে দামি গয়না তারাও কাঠের বোঝা পিঠে বেঁধে বিক্রি করছে। বৈভব থাকা সত্ত্বেও তারা কেন এই কাজ করে জিজ্ঞেস করাতে তারা বলে যে এই গয়না তারা শ্রমের দ্বারাই করেছে, কাজ করেই তারা আহার করে, রাজস্ব দেয়, আভরনও পারলে কেনে। এছাড়া নারীরা ঝরনা, নদী বা কুয়ো থেকে জল আনা, আটা পেষাই, গবাদি পশু দেখাশোনা, সন্তান প্রতিপালন সবই করে। কেদারনাথ বদ্রীনাথ যাবার পথে চারদিকে কত ফুলের শোভা দেখেছেন - গোলাপ, কুন্দ, শেফালী, করবী, জবা এবং নানা রকম পার্বত্য ফুলের সুবাসে পাহাড় সব সময় কেমন সুরভিত থাকে - এসব স্মৃতি রোমন্থন করেন লেখক। আর মন্তব্য করেন যে পর্বতে ভ্রমণ করলে দুঃখ, ক্লেশ, মায়া, মোহ কিছু থাকে না।

                    (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৫ বৈশাখ ১২৬২ (৮ এপ্রিল ১৮৫৫) থেকে ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১২৬২ (৬ জুন ১৮৫৫)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

৬টি মন্তব্য:

  1. এই পর্বের শেষের লাইনটির সাথে মানে লেখকের সাথে আমিও একমত পর্বতে ভ্রমণ করলে দুঃখ, ক্লেশ, মায়া, মোহ কিছু থাকেনা ।

    উত্তরমুছুন
  2. তবে সেই সময়ের ভ্রমণ আর এখনকার ভ্রমণের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তখনকার ভ্রমণ যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ছিল এখন তো সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা অবলম্বন করেই ভ্রমণ শুরু করে যাত্রী

    উত্তরমুছুন
  3. সেই কবে বাবা মায়ের কাছে এই কেদারনাথ বদ্রীনাথ যাত্রার অনেক গল্প শুনেছিলাম ,তারপর এই পর্বে আরো অনেক কিছুই নতুন সংযোজন হলো জানার মধ্যে । পরের পর্বের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছে প্রতিটি পর্বেই।
    শিউলি

    উত্তরমুছুন
  4. Sei somoye, Kedarnath o Badrinath er bhromon koto ta onyorokom chilo. Khub valo laglo bornona ta pore. Mone holo jodi oi somoye ekar oi sob jayga te jaoa jeto, tahole hoyto beshi valo lagto.

    উত্তরমুছুন