পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০২৪

২১ | তীর্থ ভ্রমণ ৬ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

জয়পুর ত্যাগ করে বগড়ু (বগরু) নামের স্থানে পৌঁছলেন লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা। সেখানে রানীর এক বাগান আছে। তাতে রানী প্রতিষ্ঠিত শিব আছে, মিষ্টি জলের কুয়া আছে। সামনে রাজার সৈন্য ও ছটি কামান রয়েছে। সেখানে রাত্রি বাস। তারপর পাড়ু, বাঁদরিসুদরি (বান্দর সিন্দরি) পেরিয়ে এলো কৃষ্ণগড় (কিশানগড়)। এখানকার রাজা স্বাধীন। রাজধানী খুব সুন্দর। রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলার ব্যবস্থা খুব ভালো। সুন্দর বাগান, ধর্মশালা আছে। লেখকেরা রাজবাড়ী, কেল্লা ও শহরের সর্বত্র ঘুরে দেখলেন। পরবর্তী পথে পরল বাণ নদী (ওল্ড ক্যানাল?)। এই নদীতে সম্বর লবণ জন্মায়। তারপরে কাউড়ি পেরিয়ে বুড়া পুষ্কর এল। এটি একটি বড় কুণ্ড। কুণ্ডের চারপাশে পাকা ঘাট। পঞ্চম দিনে এলো ব্রহ্মপুষ্কর। 



  জয়পুর থেকে আজমীর (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


এখানে শিব মন্দির ও অতিথি শালা আছে। লেখক লিখেছেন যে পুষ্কর তীর্থ সকল তীর্থের গুরু। এখানে তিনটি পুষ্কর আছে। বুড়া পুষ্কর, মধ্য পুষ্কর ও কনিষ্ঠ পুষ্কর। এই তিন পুষ্কর শিব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা  এই ত্রিদেবের যজ্ঞস্থান। বুড়া পুষ্কর শিবের, মধ্য পুরস্কার বিষ্ণুর ও কনিষ্ঠ পুরস্কার ব্রহ্মার যজ্ঞভূমি। এই কুন্ডের পরিক্রমণ করতে পাঁচ ক্রোশ পথ হাঁটতে হয়। কুন্ডের চারদিকে মন্দির ও বসতি। কুন্ডের জল সুনির্মল, তাতে শ্বেতপদ্ম ফুটে কুণ্ডের শোভাবর্ধন করছে। জলজন্তুর মধ্যে নানারকম মাছ, মকর (শুশুক), কুমীর প্রভৃতি আছে। পুষ্করের পান্ডারা বেদজ্ঞ, সৌম্য, যা দেওয়া হয় তাতেই তাঁরা সন্তুষ্ট। 


এখানে সাবিত্রী পাহাড় নামে তিন ক্রোশ উঁচু এক পাহাড় আছে। সাবিত্রী দেবীর মন্দির তার চূড়ায় অবস্থিত। মন্দিরে সরস্বতী মূর্তি আছে। এক ব্রাহ্মণ বাঙালি কন্যা বিধবা হয়ে প্রায় চল্লিশ বছর ওই সম্পূর্ণ নির্জন পাহাড়ে থেকে সাবিত্রীর তপস্যা করেন। রাতে পূজারীরাও পাহাড় থেকে নেমে আসেন, কিন্তু ওই তপস্বিনী একা থাকেন। পর্বতে নানা হিংস্র জন্তু আছে। পাহাড়ের উপরে পথের মধ্যভাগে এক উদাসীন (তাঁর বয়স একশ বছরের বেশি হবে) একা থেকে তপস্যা করেন।


পুষ্করে ১৫ টি ঘাট আছে। যথা চন্দ্রঘাট, বরাহঘাট (এখানে বরাহদেবের মূর্তি আছে), সাবিত্রীঘাট, রাজঘাট, ব্রহ্মাঘাট, সপ্তর্ষিঘাট প্রভৃতি। কুণ্ডের পশ্চিম দিকে ব্রহ্মার মন্দির, যে স্থানে তিনি যজ্ঞ করেছিলেন। মূর্তির বাম দিকে গায়ত্রী দেবীর মূর্তি। মন্দিরের দালানে নারদের একটি প্রতিমূর্তি আছে। ঘাটের কাছে অটমটেশ্বর শিব আছেন। সমভূমি থেকে আট হাত নীচে শিবের স্থান। পুষ্কর তীর্থের আদি দেব অটমটেশ্বর। প্রথমে এই শিব পূজা করে সকল দেব দর্শন ও পূজা করতে হয়। এইসব দুর্গম নির্জন তীর্থের কোন কোন স্থানে একাকী কিছু সন্ন্যাসী বা তপস্বী বাস করেন। পুষ্কর তীর্থের পরিক্রমা পঞ্চক্রোশী, পর্বতের ভিতর দিয়ে পথ। এর মধ্যে অনেক তীর্থ আছে। মরীচী, অঙ্গিরা, অত্রি, পুলস্ত প্রভৃতি মুনিদের কুটির আছে। আছে নাগ কুণ্ড, বামদেব কুণ্ড, ভৃগু কুণ্ড, কপিল কুণ্ড প্রভৃতি তীর্থস্থান। কপিল আশ্রম হয়ে পর্বতের গুহায় ঢুকে চারশ হাত ভিতরে গিয়ে কপিলেশ্বর শিব আছেন। অন্য এক গুহার মধ্যে বেশ কিছুটা সুড়ঙ্গে গমন করে নীলেশ্বর শিবের দর্শন করতে হয়। কিছুদিন পুষ্করে থেকে লেখক এবং তাঁর সহযাত্রীরা সমস্ত দেবদেবী, তীর্থস্থান দর্শন করে আজমীরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।


পুষ্কর থেকে আজমীর আট ক্রোশ পাহাড়ি পথ। আজমীর শহরে অনেক ধনী ব্যক্তি বসবাস করেন। সুন্দর সুন্দর শ্বেত পাথরের ভবন, খোদিত মূর্তি দ্বারা সজ্জিত। কিন্তু জল নিকাশি ব্যবস্থা নেই। যোধপুরের রাজা শাসন করেন এই স্থান। রাজার কেল্লা পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। শহরে নানা রকম জিনিসের দোকান আছে, তার মধ্যে শ্বেত পাথরের বাসন, দেবদেবীর মূর্তি, সিংহাসন, কৌচ, কেদারা ইত্যাদি খুব ভালো পাওয়া যায়। 


আজমীরে খাজা সাহেব বলে এক পীর আছেন, তাঁর বড়ই মাহাত্ম্য। হিন্দু মুসলমান সবাই তাঁর  দর্শনে যায়। এখানে লেখক তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। পূর্বে এখানে চন্দ্রনাথ নামে শিবের স্থান ছিল। একজন মুসলমান ভিস্তি জলসমেত তাঁর ভিস্তি একটি গাছের ওপর রেখে খাচ্ছিলেন। ফোঁটা ফোঁটা জল শিবের মাথায় পড়ছিল। সেই জল পেয়ে শিব সন্তুষ্ট হয়ে ভিস্তিকে বলেন যে তিনি তৃপ্ত হয়ে ভিস্তিকে বর দিতে চান। ভিস্তি তখন শিবের কাছে বর চান যে এই স্থানে শিবের যে নাম আছে তা অপ্রকাশিত হয়ে যেন তাঁর নাম প্রকাশিত হয়। শিব তাই বর দান করেন। শিবের স্থানের উপর মসজিদ, কবর হয় এবং তিনি খাজা সাহেব নামে খ্যাত হন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধরেরা বজায় রেখেছেন সেই ঐতিহ্য। ফকির প্রতিদিন শিবের পুজো ও খাজা সাহেবের শিরনি দুই দেন এখানে একসঙ্গে। এখানে মানত করলে তা পূর্ণ হয় বলে প্রচলিত আছে। দিল্লির বাদশা এই মসজিদ নানা রকম প্রস্তরে খোচিত করে স্তম্ভাদি নির্মাণ করিয়ে দিয়েছেন। সামনের নাটমন্দিরে নর্তকীরা, সর্বদা নৃত্য-গীত-বাদ্য করে। অতিথিশালায় অনেক ফকির বাস করেন।



আজমীর থেকে জয়পুর হয়ে মথুরা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)



আজমীর থেকে লেখকেরা আবার মথুরায় ফিরে চললেন। কৃষ্ণগড় (কিষানগড়), পরাসনি (পড়াসোলি গ্রাম), দুদুগ্রাম (দুদু), বগড়ু গ্রাম (বগরু), বড়েনা গ্রাম (?), বাউড়ি (?) হয়ে পঞ্চম দিনে তাঁরা জয়পুর পৌঁছলেন। আবার সব দেবদেবী দর্শন করে, নগর ভ্রমণ করে বেড়ালেন। রাজার বাগানে বাঘ, হরিণ, পুষ্করিণীতে জলচর পাখি দেখে আনন্দ পেলেন। এরপর ঘাট দরজা (ঘাট গেট, জয়পুর), মোহনপুরা (মোহনপুরা), দোশাগ্রাম (দোসা), সেকেন্দরা (সিকান্দ্রা), বেশোড়া (?), ছোকরাবার (?), গাগরাআনি (?), শোক (শোঙখ), সসা (শোনশা) হয়ে দশম দিনে মথুরা এলেন। 


এবার বৃন্দাবনে লেখক ঝুলন দর্শন করার সুযোগ পেলেন। বিভিন্ন মন্দির স্বর্ণ নির্মিত হিন্দোলা (দোলনা), ঝাড় লন্ঠন, বড় বড় আয়না, নানা রকম দ্রব্য দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা মেলাও হয়। ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনের ফুলদোলের সময় কুম্ভের মেলা হয় প্রতি বারো বছর অন্তর। ফুলদোলে বৃন্দাবন পরিক্রমার মেলা শেষে সবাই হরিদ্বারে যায়। এই সময় বৃন্দাবনে নানা দেশ থেকে বৈষ্ণব, সন্ন্যাসী, গোস্বামী, মোহন্ত, নাগা প্রমুখরা আসেন ও যমুনার চরে থাকেন। চতুর্দিক মুখরিত হয় পূজাপাঠ, গীতবাদ্যে।বৃন্দাবনে বারোটি আখড়া আছে। এই সময় আখড়াধারীরা আপন আপন গদি থেকে আসেন। তাঁদের সঙ্গে আসে হাতি, ঘোড়া, উট, নীলগাই, হরিণ, নীল বানর প্রভৃতি। আখড়ার মোহন্ত আখড়ার রুপার হাওদা দেওয়া, সোনা রুপার নিশান সম্বলিত হাতির উপরে চড়ে ঘোরেন। শ্বেত চামরের ব্যজন দিয়ে তাঁর সেবা করা হয়। সঙ্গে আসে সোনা রুপোর বল্লম হাতে তিন চার শত নাগারক্ষী। 

                      (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৪ আষাঢ় ১২৬১ (৮ জুন ১৮৫৪) থেকে ৪ চৈত্র ১২৬১ (১৮ মার্চ ১৮৫৪)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

৫টি মন্তব্য:

  1. এই ভ্রমণ বৃত্তান্তের কিছু স্থান আমার ঘোরার সৌভাগ্য হয়েছে তবে স্থান গুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত গল্প গুলো এই বৃত্তান্ত পড়েই জানতে পারলাম আর তাতে ভালো লাগা অনুভব করলাম।
    শিউলি

    উত্তরমুছুন
  2. যদি আবার কখনও জায়গাগুলো দেখার সুযোগ ঘটে তবে নিশ্চয়ই এই কাহিনীর সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন। ধন্যবাদ 🙏

    উত্তরমুছুন
  3. অনেক আগে পুস্কর দর্শন এর সৌভাগ্য হয়েছিল এই লেখা পরে স্মৃতি রোমন্থন করলাম
    মিঠু

    উত্তরমুছুন