পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪০। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৪ ভোলানাথ চন্দ্র


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                  (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বটি লেখকের বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভ্রমণের কাহিনী। লেখক এলেন জাম্মো কান্দি অর্থাৎ জেমো কান্দিতে। জেমো হলো কান্দির কাছে অবস্থিত একটি গ্রাম। ওয়ারেন হেস্টিংস এর দেওয়ান গঙ্গা গোবিন্দ সিং-এর গ্রাম এটি। তিনি পাইকপাড়া রাজার পিতামহ। ১৭৫০ থেকে ১৭৯৫ বাংলার দেওয়ান পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি চাকরি সূত্রে প্রচুর অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন। কান্দিতে ও পাইকপাড়ায় প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। তিনি দ্বৈত শাসনের (ইংরাজ ও বাংলার নবাবের শাসনের) অবসানে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পতনেও তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসকে সাহায্য করেছিলেন। তিনি এত অর্থশালী ছিলেন যে তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধে কুড়ি লাখ টাকা ব্যয় করেছিলেন। নিমন্ত্রণপত্র সোনার পাতায় লেখা হয়েছিল। নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন প্রদেশের অর্ধেক রাজা, জমিদারেরা, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র শিবচন্দ্র সহ। একইভাবে নাতি লালা বাবুর অন্নপ্রাশনেও তিনি অঢেল ব্যয় করেন। সেই অনুষ্ঠানে সোনামুখীর গদাধর শিরোমনি প্রথম কথকথা করেন ও গঙ্গা গোবিন্দ তাঁকে এক লাখ টাকা দেন খুশি হয়ে। তিনি অনেক কৃষ্ণ মন্দির স্থাপন করেন। 

কান্দির মন্দিরের দেবতা মুঘল বাদশাহের মতো যার জাঁকজমকে থাকেন। সেরা মখমলের কারুকার্যময় মসনদে আসীন, সোনা রুপোর অলংকার, তৈজসপত্রে সাজানো। প্রসাদ সারাদিনে যা হয় তা সম্পূর্ণ রাজকীয়। প্রতিদিন মন্দিরের ৫০০ টাকা খরচ হয়। পঞ্চাশ রকম ব্যঞ্জন, দশ রকম মিষ্টান্ন দিয়ে প্রসাদ হয়। 

কান্দির রাসযাত্রা অতুলনীয়। আলো, বাজি, গান, বাজনা, নাচে জমজমাট। রাসমন্ডল হল সব দেবতার মন্দিরের ছোট সংস্করণ, সেখানে রামায়ণ মহাভারতের প্রধান চরিত্রদের প্রমাণ মাপের মূর্তি সাজানো হয়। যেমন রামের হরধনুভঙ্গ, অর্জুনের মাছের চোখ বিদ্ধ করা ইত্যাদি মূর্তি সেখানে প্রদর্শিত হয়। ২৫ হাজার মানুষ এই মেলায় আসে। এই মেলায় রাজা দশ হাজার টাকা খরচা করেন। 


কান্দি থেকে ষোলো মাইল দূরে বহরমপুর। সমতল ভূমির এই পথে জনবসতি খুব কম। ডাকাতি, খুন খারাপির ভয় আছে। ইংরেজ আমলে বহরমপুরের উন্নতি হয়েছে। এখানকার সেনা ছাউনি, প্যারাড গ্রাউন্ড দর্শনীয়। 

বহরমপুরে জর্জ টমাসের সমাধি আছে। জর্জ টমাস আয়ারল্যান্ডের এক বণিক, যিনি হরিয়ানাকে কেন্দ্র করে একটি ছোট রাজ্যের রাজা হয়েছিলেন ১৭৯৮ থেকে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। জলপথে কলকাতা যাওয়ার সময় বহরমপুরে তাঁর মৃত্যু হয় ১৮০২ সালে। বহরমপুরের বুলবুলবোনাতে তাঁর সমাধি আছে। 

ব্রিটিশ শিশু সাহিত্যিক মেরি মার্থা শেরউডের (১৭৭৫ -১৮৫১) লেখা 'লিটল হেনরি এন্ড হিজ বিয়ারার' নামক বিখ্যাত শিশু সাহিত্যটির হেনরি নামক ব্রিটিশ শিশুটির সমাধি আছে বহরমপুরে। লেখিকা এক ব্রিটিশ সেনানায়কের সঙ্গে বিবাহ সূত্র ভারতে ১১ বছর ছিলেন। হেনরি তাঁর পুত্র যে মাত্র দুই বছর বয়সে মারা যায়। 

তারপর ভোলানাথ চন্দ্র মহাশয় জেনারেল স্টুয়ার্ট (১৭৫৮-১৮২৮) -এর কথা লিখেছেন যিনি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বহরমপুরে থাকতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই সেনা অফিসার হিন্দু সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলেন। লেখক তাঁর সম্পর্কে বলেছেন যে তিনি মূর্তি পূজা ও গঙ্গা ভজনা করতেন দেশীয়দের মত। তাঁর কলকাতার চৌরঙ্গীর মিউজিয়াম সকলের জন্য অবারিত দ্বার ছিল। জীবনের শেষ দিকে তিনি শ'খানেক দরিদ্রকে রোজ খাওয়াতেন। জব চার্ণকের মতো তিনি হিন্দু মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। 

সিপাহী বিদ্রোহের বিপদের আঁচ প্রথম এই বহরমপুরেই অনুভব করা গেছিল। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ১৮৫৭ বহরমপুরের সিপাহীরা বিদ্রোহ শুরু করে। তখন গভর্নর জেনারেলের আদেশে এদের ব্যারাকপুরে পাঠানো হয়।


বহরমপুর থেকে নদীপথে তিন মাইল গেলে আসে কাশিমবাজার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এখানের ডাচ, ফরাসি ও ইংরাজ এই তিন দেশীয় কারখানা ছিল। ইংরাজের কারখানায় কুড়ি লক্ষ টাকার যন্ত্রাদি ছিল সেই সময়। ১৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্শাল নামের ওই কারখানার এক কর্মচারী প্রথম সংস্কৃত শিখেছিলেন ও ভাগবত গীতার ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদের পান্ডুলিপি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এখানকার প্রধান ছিলেন জব চার্নক ১৬৮১-তে। স্যার এফ রাসেল এখানকার প্রধান থাকাকালীন মিস্টার হলওয়েল (যাঁর নামে হলওয়েল মনুমেন্ট হয়েছিল যেটি এখন শহীদ মিনার নামে পরিচিত)। ১৭৪২-এ এখানে একটি অবিস্মরণীয় সতীদাহ দেখেছিলেন। ভদ্রমহিলা এক সম্ভ্রান্ত মারাঠার বিধবা। তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা ও লেডি রাসেল প্রমুখ তাঁকে সতী হতে বিরত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি প্রথমে তাঁর একটি আঙ্গুল আগুনে বহুক্ষণ রাখেন। তারপর অন্য হাতের পাতা আগুনে দেন, তাতে ধুপধুনোও মেশান। এরপর মুর্শিদাবাদের ফৌজদার হুসেন শাহের কাছ থেকে সতী হওয়ার অনুমতি আসে এবং তিনি চিতায় প্রবেশ করেন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস আগে (১৭৫৩) কাশিম বাজারে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি পার্শি ও আর আরবি শিখিয়েছিলেন। 


মুর্শিদাবাদ যা আগে মুকসুদাবাদ নামে পরিচিত ছিল, সম্ভবত মুঘল বাদশাহ আকবরের প্রতিষ্ঠিত। মুর্শিদকুলি খান এই স্থান ১৭০৪ -এ অধিকার করার পর নাম দেন মুর্শিদাবাদ। ক্রমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এখানে প্রাসাদ, সরকারি দপ্তর তৈরি হওয়ায় সকলের দৃষ্টি এখানে পড়ে। মুর্শিদাবাদ ঢাকা বা রাজমহলের থেকেও বেশি প্রতিপত্তি সম্পন্ন স্থানে পরিণত হয়। 

রবার্ট ক্লাইভ লিখেছেন মুর্শিদাবাদ সমৃদ্ধ জনবহুল ও ধনী স্থান লন্ডনের মতই কিন্তু পুরো লন্ডনের সমগ্র সম্পদের থেকেও মুর্শিদাবাদের এক একজনের কাছে বেশি ধন রয়েছে। মুর্শিদাবাদের জনবসতি এত বেশি ছিল যে ক্লাইভ লিখেছেন যে যখন তিনি ২০০ ইউরোপীয় ও ২০০ দেশীয় সেপাই নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন তখন ইচ্ছা করলে মুর্শিদাবাদবাসীরা শুধু লাঠি আর পাথর দিয়েই তাঁদের ধ্বংস করতে পারত। তখন মুর্শিদাবাদের ঢোকার মুখে কামান সাজানো তোরণদ্বার ছিল। ১৭৭০-এ এক ইংরেজ লেখকের লেখা থেকে জানা যায় যে মুর্শিদাবাদে অনেক ইঁটের বাড়ি, প্রচুর প্রাসাদ, উদ্যান আছে, গঙ্গায় অনেক নৌকা দেখা যায়। কিন্তু ১৮০৮-এ অন্য এক লেখকের লেখায় মুর্শিদাবাদ ভীষণ জনবহুল, নোংরা, কিছু প্রাসাদ আর মসজিদ ছাড়া সব ছোট বাড়ি, কুঁড়েঘর আর গঙ্গায় সারিবদ্ধ জাহাজ দেখা যায় বলে লিখেছেন। মুর্শিদাবাদের অবক্ষয়ের প্রথম কারণ নবাবীর পতন। দ্বিতীয় কারণ, গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার জন্য বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মুর্শিদাবাদের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হওয়া। তৃতীয়ত, ১৭৭০-এর  মন্বন্তরে মুর্শিদাবাদের আরো সর্বনাশ হয়। চতুর্থ কারণ, ১৭৭২ মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী ও রাজস্ব বোর্ডকে কলকাতায় সরিয়ে আনা। পঞ্চম কারণ, পুণ্যাহ প্রথার বিলোপ। এই প্রথায় দেশের জমিদারেরা মুর্শিদাবাদে প্রতি বছর এপ্রিল মে- তে এসে দেয় খাজনার নিষ্পত্তি করতেন।১৭৭২ থেকে এই প্রথা বন্ধ হওয়াতে মুর্শিদাবাদ ও সেখানকার নবাবের গুরুত্ব কমলো। 

প্রাচীন মুর্শিদাবাদের অল্প কিছু নিদর্শনই লেখকের ভ্রমণ কালে দেখতে পাওয়া যেত। সুন্দর মতিঝিল শুকিয়ে গেছে। গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে আনা কালো মার্বেল পাথরে তৈরি সিরাজ-উদ-দৌলার প্রাসাদের সামান্য কিছু চিহ্ন আছে মাত্র। এখানে রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফরকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব পদে আসীন করেছিলেন। উপচে পড়া সোনারুপোর ধনভান্ডার আর হীরা চুনী বসানো রাজমুকুট যা ক্লাইভ প্রথমে এখানে এসে দেখেছিলেন এবং ১০০ নৌকো করে ৭০০ সিন্দুকে ভরে তার একাংশ প্রথম কিস্তি স্বরূপ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গতে নিয়ে যান। কাটরা মসজিদ (মীরজাফর স্থাপিত) ও তার সংলগ্ন ছাত্রদের পড়াশোনার স্থান এখন ধ্বংসস্তূপ। তোপখানা, নবাবের অস্ত্রাগার এর কাছেই ছিল। অতীতে ভাগীরথীর পশ্চিম পারে মুর্শিদাবাদ শহরের একটি অংশ ছিল। সেখানে নবাবী কবরস্থান ছিল। আলীবর্দী খান, সিরাজদৌল্লা প্রভৃতির কবর সেখানেই ছিল। লেখক এখানে সিরাজদৌলার অত্যন্ত অত্যাচারী ও উৎশৃংখল মানসিকতার কিছু কিছু পরিচয় দিয়েছেন। (তৎকালীন অন্যান্য লেখক, এমনকি পুরনো দেশীয় লেখকদের লেখায় এর প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। সিরাজউদ্দৌলাকে নায়ক কল্পনা করা মনে হয় বিংশ শতাব্দীতে প্রথম শুরু হয়েছিল)। ভাগীরথীর ডানপাড়ে মীরজাফরের বিশাল প্রাসাদ ছিল দুর্গের আকারে ও কামানে সজ্জিত। এই শেঠেরা, যাদের এক সময় ক্ষমতা ছিল শুধু মুদ্রা ফেলে ভাগীরথীর স্রোতকে বন্ধ করে দেওয়ার তাদের বংশধরেরা এখন দরিদ্র। পুরনো ভগ্ন প্রায় বাড়ি আগলে আর অবশিষ্ট ধনরত্ন বেঁচে কোন রকমে জীবন ধারণ করছে। 

মুর্শিদাবাদের এখন দেখার জিনিস একটি - হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। সেই নতুন প্রাসাদ কর্নেল ম্যাকলোয়েড এর পরিকল্পনায় তৈরি হয়েছে ১৮৩৭-এ। ৪২৫ ফুট লম্বা, ২০০ ফুট চওড়া ও ৩৮০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই প্রাসাদ বানাতে খরচ হয়েছে কুড়ি লক্ষ টাকা। মার্বেলের মেঝে যুক্ত এই প্রাসাদের সিঁড়ি, ২৯০ ফুট লম্বা হল, আয়না বসানো দরজা, বিভিন্ন রূপে সাজানো ঘরগুলি, নবাবের হাতির দাঁতের কাজ করা সিংহাসন, নবাবদের পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি আঁকা ছবি - সবই দেখার মত। এই প্রাসাদের একটি বারান্দা থেকে লেখক জেনানা অর্থাৎ অন্তঃপুরের এক ঝলক দেখতে পান। জেনানা এলাকায় কোন পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তিনি শোনেন ৩০ জন বেগম বা উপপত্নী সেখানে আছে নবাবের, ৫০ জন আবিসিনিয় খোজার প্রহরায়। আগে নবাবদের হারেমের আকার বড় ছিল। এক নবাবের হারেমে দেড় হাজার মহিলা ছিল। আলীবর্দী খানের অবশ্য একটি মাত্র স্ত্রী ছিল। সিরাজউদ্দৌলার জেনানায় মহিলার সংখ্যা গোনা মুশকিল। মীরজাফর সিরাজের হারেমের অধিকাংশ মেয়েদের ক্লাইভকে দান করেছিলেন। 

এরপর দেখা হল ইমামবাড়া। এটি হুগলির ইমামবাড়ার থেকে বড়। আয়না, লন্ঠন, ঝাড়লণ্ঠন দিয়ে সাজানো এই ইমামবাড়ার শোভা অতুলনীয়। নদীতে নবাবের ময়ূরপঙ্খী, বিলাসবহুল নৌকা দেখা যায়। তবে আগে গঙ্গায় যেতে যেতে মুর্শিদাবাদের যে আলোকোজ্জ্বল রূপকথার দেশের মতো ঝলমলে রূপ দেখা যেত তা এখন আর নেই। 

এখানকার বেরা উৎসব সম্ভবতঃ সিরাজদৌল্লা চালু করেছিলেন। জলযাত্রা শুভ করতে আর বন্যার রোধে পীর পয়গম্বরের দোয়া চাওয়ার জন্য এই উৎসব করা হয়। ফুল, নারকেল, আলোতে ভরা ছোট ছোট ভেলা ভেসে চলে নদীতে। হাজার মানুষের আশা আর আনন্দ নিয়ে এই উৎসবে যোগ দেয়। ভাদ্র মাসে আজও বেরার মেলা বসে মুর্শিদাবাদে। 

নবাবী আস্তাবল, হাতিশালা, অস্ত্রাগার সবই এখনও (লেখকের সময়ে) আছে আগের মত। নবাব নাজিম প্রতিদিন নতুন রাজপোষাক পরেন যা পরদিন ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু নবাবীয়ানা থাকলেও নবাবের ক্ষমতা এই প্রাসাদ বা চারপাশের আধ মাইল গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। এই নামমাত্র নবাবী নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে লুপ্ত হবে বলে লেখক আশা করেছেন। নবাব নাজিম প্রথা ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে লুপ্ত হয় মুর্শিদাবাদে। 


বর্তমান ভগবানগোলা থেকে ১২ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল পুরনো ভগবানগোলা, যা আলীবর্দী খানের সময় মুর্শিদাবাদের অন্যতম বন্দর ছিল। নদী গতিপরিবর্তন করেছে, পুরনো ভগবানগোলা জঙ্গলাকীর্ণ হয়েছে। নতুন ভগবানগোলা সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রাম। ফসল ক্ষেত, সবুজ মাঠ, আমবাগান, খেজুর-কলা-তালগাছ দিয়ে সাজানো আনন্দময় গ্রাম জীবনের ছবি। 


মুর্শিদাবাদ থেকে চল্লিশ মাইল উত্তরে জঙ্গিপুর যা জাহাঙ্গীরের নামে নামাঙ্কিত। এটি পূর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশমের বৃহত্তম কেন্দ্র ছিল। ১৮৩৩-এর চার্টারের ফলে বাংলায় অন্যান্য রেশম ও সুতির সমস্ত বন্দরের মতোই জঙ্গিপুরেরও বাণিজ্য ধ্বংস হয়। 


জঙ্গিপুর থেকে ২১ মাইল গেলে সুতি। এখানে ভাগীরথী গঙ্গা থেকে ভাগ হয়ে শাখা তৈরি করেছে। এখানে ১৭৪০- এ বাঙলার নবাব সরফরাজ খানের সঙ্গে বাঙলার নবাবের অধীন পাটনা বা আজিমাবাদের নাজিম আলিবর্দী খানের মধ্যে গিরিয়ার যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে আলিবর্দী খান জয়লাভ করে বাংলার নবাব হন। ১৭৬৩-তে মীর কাসেম ও ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ এখানেই হয়েছিল। এখানে গঙ্গায় চর পড়ার কারণে নৌযাত্রা খুব কম করা যায়। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী পর্যটক তেভার্নিয়ার চরের কারণে নৌযাত্রা ছেড়ে রাজমহল থেকে হুগলি পর্যন্ত স্থলপথে গিয়েছিলেন বলে তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন। তারপর থেকে নৌকা ভাগীরথী ছাড়িয়ে মূল গঙ্গার স্রোতে পড়ে। রাজমহল থেকে নদীয়া এই ১০০ মাইলে, যেখানে পদ্মা নদীর গঠনের আগে ভাগীরথীর গতিপথ ছিল, তা এখন এক জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে।

                           (চলছে)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২টি মন্তব্য:

  1. মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর, কান্দি, হুগলির কিছু দর্শনীয় স্থান এবং তার সাথে জড়িত কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা পড়ে খুবই ভালো লাগল পর্ব টি। ইতিহাসের কিছু ঘটনা কয়েক বছর পর এই পর্বটি পড়ে আবার যেন রোমন্থন করলাম।
    ধন্যবাদ লেখিকাকে।
    শিউলি

    উত্তরমুছুন