সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
সুপ্রাচীন শহর পাটনা, সংস্কৃতে পাটলিপুত্র, গ্রীক পর্যটকদের ভাষায় পালিবোথরা আর চীনা পর্যটকদের ভাষায় পোতোলিতসে (পালিনফু উইকিপিডিয়া অনুসারে) নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অজাতশত্রু পাটলীপুত্র প্রতিষ্ঠা করেন। নন্দ বংশ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক এঁদের রাজধানী ছিল এই পাটলিপুত্র। এখানে সেলুকাসের দুত হয়ে মেগাস্থিনিস এসেছিলেন। চাণক্যের কূটনীতি এখানেই প্রযুক্ত হতো। এখান থেকে অশোকের ধর্মদূতেরা মিশর, সিরিয়া, গ্রীস, শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন। মৌর্য ও গুপ্ত যুগের অবসানের পর হর্ষবর্ধনের আমলে পাটলীপুত্র আবার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়। হিউয়েন সাং-এর রচনায় সেই ইতিহাস জানা যায়। মুসলমান যুগে পাটনা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ পর্যটক রালফ ফিচ (১৫৫০-১৬১১) পাটনাকে এভাবে বর্ণনা করেছেন - বড় শহর কিন্তু শুধু ঘরের চাল দেওয়া মাটির বাড়ি রয়েছে। ডাকাতের ভয়ানক উৎপাত। অর্থাৎ তখন পাটনা শ্রী হারিয়েছিল। বর্তমান পাটনা শহর সরু গলিপথ, নোংরা অসুন্দর, দেওয়ালে ঘুঁটে দেওয়া ঘরবাড়ি, নোংরা নালা ম্যালেরিয়ার মশায় ভর্তি। জমি নিচু তাই বন্যায় ভেসে যায়। মেগাস্থিনিসের বর্ণনার তোরণ দ্বার, মিনার, বিশাখদত্তর লেখা নাটক মুদ্রারাক্ষসের বর্ণনার প্রাসাদ কিছুই অবশিষ্ট নেই। ২০০ বছরের পুরনো কোন ঘরবাড়ি পাটনায় নেই । হিউয়েন সাং-এর বর্ণনার কোন বৌদ্ধ-মঠ মন্দির আর নেই। আছে শুধু পাটনা দেবী, গোপাল, শিব মন্দির, শিখ গুরুদ্বার আর মুসলমান মসজিদ। পাটনায় এখন মুসলমান ও শিখের আধিক্য দেখা যায়। মুসলমান শাসক পাটনার নাম আজিমাবাদ দিতে চেয়েছিলেন। পাটনায় একটি দ্রষ্টব্য স্থান আছে। ১৫০ জন ব্রিটিশকে মীর কাসেমের আদেশে সমরু (মীর কাসেমের জার্মান সেনানায়ক ওয়াল্টার রাইনহার্ট সোমব্রু) হত্যা করেছিলেন। তাঁদের স্মৃতিতে একটি কালো ও হলুদ পাথরের ত্রিশ ফুট উঁচু সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে (সৌধটি অধুনালুপ্ত)।
পাটনার বাণিজ্য ঘাঁটি শহরের বাইরে মারুগঞ্জে (মারুফগঞ্জ) রয়েছে। পাটনায় টেবিল ক্লথ খুব ভালো তৈরি হয়। পাটনার দুটি আশ্চর্য ব্যাপার - এক, পাটনায় শুধু জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাসেই বিয়ে হয়। দুই, যারা এখানে মারা যায়, তাদের গঙ্গার অপর পাড়ে দাহ করা হয়।
পাটনা থেকে ছ'মাইল দূরে এখানকার প্রশাসনিক কেন্দ্র বাঁকিপুর। আফিমের গুদাম, আদালত আর ইউরোপীয় বসবাসের স্থান রয়েছে এখানে। ডোমের আদলে একটি বিশাল ঘর রয়েছে (গোলঘর) যার বাইরে থেকে দুটি সারি সিঁড়ি উঠে গেছে। উপরে একটি গোলাকার দরজা আছে ফসল রাখার আর নীচে একটা দরজা আছে ফসল বের করার। এটি ফসলের সরকারি গোলা। ১৭৮৩ দুর্ভিক্ষের পর সরকার এটি তৈরি করেছেন ফসল সংরক্ষণের জন্য। বাঁকিপুর স্টেশন থেকে গয়ার দিকে রাস্তা গেছে। গয়ার ছমাইল পরে বুদ্ধগয়া যেখানে গৌতম বা শাক্যমুনি বৌদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। এখানে দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো মন্দির আছে যার পাথরের খিলান প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যের ঐতিহ্যকে মনে করায়। এখানে চীন, বার্মা থেকে বহু যুগ ধরে তীর্থযাত্রীরা এসেছে। তার পরবর্তী যুগে হিন্দু গয়ার উত্থান হয়েছে। বৌদ্ধপদ থেকে বিষ্ণুপদ-এর গুরুত্ব বেড়েছে।
বাঁকিপুরের ফেরিঘাট থেকে নৌকা নিয়ে লেখক সোনপুরের হরিহরছত্রের মেলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। হিমালয়ের তুষার শৃঙ্গ থেকে আগত গণ্ডকী নদী এখানে গঙ্গায় মিশে যায়। এই গণ্ডকী নদীতে হিন্দুদের পবিত্র নারায়ণ শিলা বা শালিগ্রাম শিলা পাওয়া যায়। এই সঙ্গমস্থলে একটি সাদা মন্দির আছে। এটি হরিহরনাথের মন্দির। এখানে পৌরাণিক কাহিনী মতে গজ ও কচ্ছপের লড়াই হয়েছিল এবং গরুড় তাদের নৈমিষারণ্যে নিয়ে যান। মন্দিরটিতে সারা বছর তেমন ভিড় থাকে না কিন্তু কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় এখানে সম্ভবত ভারতের সবথেকে বড় মেলা হয়। এই মেলায় মূলত পশু কেনা বেচা হয়। কম করে দশ হাজার ঘোড়া, দুই হাজার হাতি এখানে কেনা বেচা হয়। তামা কাঁসার বাসন, দেশি বিদেশি জিনিস, খেলনা, গয়না, শখের নানারকম জিনিস, শস্য, মিষ্টি সবকিছুর দোকান সার দিয়ে বসে। পাঁচশ তাঁবু রাজা-মহারাজাদের জন্য তৈরি হয়। পুরো এলাকা তাঁবু ও অস্থায়ী ছাউনিতে ভরে যায়। নাচ গানে মেলা মুখর হয়ে থাকে। অনেক ইউরোপীয় আনন্দ করার জন্য এখানে আসেন। এক পক্ষ কাল ধরে মেলা চলে।
পাটনার সামরিক ঘাঁটি পাটনা থেকে ১৪ মাইল দূরে দানাপুর। সেখানে সেনা ছাউনি, বাংলো, ব্যারাক রয়েছে।
দানাপুর থেকে চার মাইল উত্তরে শোন ও গঙ্গার সঙ্গমস্থল। রেলপথের শোন নদীর সেতু পার হলে (কয়েল ওয়ার ব্রিজ, ১৮৬২) আসে আরা (আরা জংশন)। আগে ফ্রেন্চ ও ডাচ কারখানাও ছিল, এখন ইংল্যান্ডের সোরা তৈরির ফ্যাক্টরি কারখানা রয়েছে এখানে। এরপর ছাপড়া ও ছাপড়ার ছয় মাইল উজানে সরযু নদী গঙ্গায় এসে মিলেছে। এই সঙ্গমের দৃশ্য খুব মনোরম।
গঙ্গায় এরপর চরের কারণে স্টিমারের চলতে অসুবিধা হচ্ছিল। এবার এলো বক্সার। বক্সার যুদ্ধ ব্রিটিশ শক্তিকে বাংলা ছাড়িয়ে উত্তর ভারতের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ খুলে দিয়েছিল। এই যুদ্ধের ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় কর আদায় করার অধিকার পেল। শ্রীরামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে এখানে একটি ভবন তৈরি করা আছে। রাম নাকি এখানে এসেছিলেন এবং বিশ্বামিত্রের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছিলেন। ভোজ রাজার দেশ বলে এই স্থানের সবকিছুকে ভোজপুরিয়া বলে।
সারারাত গঙ্গায় স্টিমার চলে ভোরে এলো গাজীপুর। গাজীপুর বিখ্যাত গোলাপ বাগানের জন্য। শয়ে শয়ে একর জমিতে এখানে গোলাপ চাষ হয়। বহু মানুষ গোলাপ জল, গোলাপের আতর, সুগন্ধি বিক্রয় করে। এখানকার শহর পরিচ্ছন্ন, চওড়া রাস্তা, সুসজ্জিত বাজার। ইউরোপীয়রা আলাদাভাবে বাস করে তাদের বাংলোতে। শহরের পশ্চিম প্রান্তে সেনা ছাউনি। ষোড়শ শতাব্দীতে আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরীতে গাজীপুরের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু এখন কোন প্রাচীন স্থাপত্য দেখা যায় না। এটি মুসলমান প্রধান জায়গা। গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস এখানে মারা গেছিলেন এবং এখানেই তাঁর সমাধি রয়েছে।
এরপর এলো চুনার। লেখক চুনারের দুর্গ দেখতে গেলেন। শোনা যায় বাংলার পাল রাজারা এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। অন্য মত অনুসারে বুন্দেলখন্ডের চন্ডাল রাজা এই দুর্গ নির্মাণ করেন বলে এর নাম হয় চন্ডালগড়, তার থেকে চুনার। গঙ্গার ঘাট থেকে সুউচ্চ দুর্গ উপরে উঠে গেছে। দুর্গ দেখার পর তিনি চুনার শহর দেখেন। এখানকার বাড়িঘর সব পাথরের তৈরি, দোতলা, বারান্দা দেওয়া। দোকানে লাল আর কালো চিনামাটির বিখ্যাত বাসন পাওয়া যায়। এখানকার তামাক খুব ভালো।
চুনার থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত রেলপথ জঙ্গল আর উঁচু উঁচু পাহাড়ি জমির উপর দিয়ে গেছে। এখানে বাঘ, হাতি না থাকলেও নেকড়ে, ভালুক আছে। মির্জাপুর শহর অনেকগুলি পাথরে বাঁধানো ঘাট, প্রচুর নৌকা, অনেক সুন্দর মন্দির, মনোরম উদ্যান, সুন্দর ঘরবাড়ি নিয়ে উপস্থিত। মির্জাপুরের কোন প্রাচীন ঐতিহ্য নেই রাজমহল, ভাগলপুর বা মুঙ্গেরের মত। কিন্তু বর্তমানে এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে সুতী আর ধাতুর দ্রব্যের গুদাম আছে। কার্পেট সহ বহু জিনিস এখানে তৈরি হয়। মির্জাপুরে অত্যন্ত সুন্দর একটি চক আছে।
মির্জাপুর থেকে চার মাইল দূরে বিন্ধ্যাচল মন্দির। এই দেবী ডাকাতদের আরাধ্যা। পাহাড়ের উপর দেবীর মন্দির। এই ডাকাত বা ঠগেরা তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে নদীতে বেনারস থেকে কলকাতা যাতায়াত করত এবং ডাকাতি করত। মির্জাপুর থেকে এলাহাবাদ ভ্রমণের কাহিনী লেখক কয়েকটি পর্ব পরে বর্ণনা করবেন বলে বলেন এখানে।
( চলছে)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
এই পর্বে পাটনা শহরের বহু অজানা ইতিহাস জানতে পারলাম। ধন্যবাদ লেখিকাকে। শিউলি
উত্তরমুছুনধন্যবাদ 🙏
উত্তরমুছুন