পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪৪। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৮ ভোলানাথ চন্দ্র

  

       

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                 (আগের পর্বের পরে)

দ্রুতগামী রেলের পর এবার শুরু হল ডাক গাড়ির তুলনামূলক মন্থর যাত্রা। এবার গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে চলা। এই রাস্তা গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কাঁকরে বাঁধিয়ে পাকা করে দিয়েছেন। উঁচু নীচু পাহাড়ি পথ, মূলত জঙ্গল এলাকা। মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় চাষবাস হয়েছে। গরুর গাড়ি মাল বোঝাই হয়ে যাচ্ছে - এই একমাত্র চলমান দৃশ্য দেখা যায়। প্রতি পাঁচ বা ছয় মাইল পরপর ডাকের আদান-প্রদান ও ঘোড়া পাল্টানো হয়। বিভিন্ন কোম্পানির ডাক গাড়ির বিভিন্ন রঙের গাড়ি, যাতে তাদের কর্মচারীরা দূর থেকে চিনতে পারে। গাড়ির চালক নানারকম শব্দ করে, কথা বলেও তার আগমন জানান দিতে থাকে অনেক দূর থেকে। একটি ঘোড়া খুব দূর্বল ছিল, তার এত ওজন বহন করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। কিছু পরে তাকে পরিবর্তন করা হলো। ঘোড়াগুলির থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ভালো নয়। 


নিয়ামতপুর থেকে পথ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে যায়। দূরে বড় বড় পাহাড় দৃশ্যমান হয়। তারপর অনেক জঙ্গলের পথ পেরিয়ে আসে বরাকর নদীর উপত্যকা। এই উপত্যকা পাহাড়, মাঠ, গ্রাম, ছোট নদী, জঙ্গল নিয়ে তৈরী। দিগন্তে অত্যন্ত সুন্দর ২০০০ ফুট উচ্চতার পাঞ্চেত পাহাড় দেখা যায়। কাছের একটি টিলার উপর সাঁওতালদের দেবীর মন্দির আছে। 


বরাকর পাহাড়ি নদী, শুধুমাত্র বর্ষাকালে  নদী জলে ভরে যায়। এই অক্টোবর মাসে নদীতে অল্প জল আছে। কুলিরা টেনে গাড়ি নদী পার করালো। এখানে একটি ব্রিজ তৈরি হচ্ছে। নদীর ধারে দুটি শিব মন্দির আছে। বরাকর নামে একটি ছোট দেশি সরাইখানা আছে এখানে থাকার জন্য। যদিও এটি সাঁওতালি গ্রাম নয় কিন্তু বহু সাঁওতাল নারী, পুরুষ, শিশু এখানে ব্রীজের কাজের জন্য রয়েছে। এখানকার দোকানদারেরা বাঙালি। তিরিশ বছর আগে এইসব জায়গার অস্তিত্বই টানা ছিল না। এগুলি হিংস্র জন্তু আর অসভ্য (!) আদিবাসীদের স্থান ছিল। এখন গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এইসব জায়গাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। আগে এখানে অনেক বাঘ ছিল। এখন বছরে একবার কি দুবার বাঘ দেখা যায়। যদিও আশেপাশের জঙ্গলে অনেক বাঘ আছে। সাঁওতালরা খুব দক্ষ শিকারি। তারা জংলি জানোয়ারদের সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করে। তাদের ধনুক অত্যন্ত কার্যকরী অস্ত্র। পাখী, খরগোশ, এমনকি ভাল্লুক পর্যন্ত তীর ধনুক দিয়ে সহজে তারা শিকার করে। কদিন আগে একজন সাঁওতাল একটা লুকিয়ে থাকা চিতাকেও এই অস্ত্রের সাহায্যে মেরেছে। সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় ১৮৫৫-৫৬ এখানে খুব ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। পাহারাদার নিয়োগ করতে হয়েছিল যাতে বন্যরা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের দক্ষিণে তাদের কার্যকলাপ করে সমস্ত আদিবাসীদের বিদ্রোহী করে না তুলতে পারে। সেই গন্ডগোলে আশেপাশের কিছু সর্দারের অলীক কল্পনায় চায়ের কাপে তুফান উঠেছিল আর সিপাই নামটা সারা পৃথিবীর কাছে ঘৃণ্য হয়ে গেছিল। (ভারতীয়দের কাছে যে বিদ্রোহ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ধাপ বলে বিবেচিত হয় ভোলানাথ চন্দ্রের ইংরেজের গোলামী করার মানসিকতায় তাই চায়ের কাপে তুফান)।


বরাকর বাজারে বড়জোর কুড়িটা দোকান আছে। শস্য এখানেই উৎপন্ন হয়। নুন আসে নীচের প্রদেশ থেকে। আজ বরাকরের যা অবস্থা ২৫ বছর আগে রাণীগঞ্জ সেরকমই ছিল। এই এলাকায় যেসব কাঁচামাল পাওয়া যায় তা হলো লাক্ষা, কাঠ, মৌচাকের মোম আর আছে খনিজ পদার্থ। ভবিষ্যতে ভারতীয়রা যদি নিজেদের বার্মিংহাম বা শেফিল্ড বানাতে চায় তাহলে এই জঙ্গল মহালের কথা তাদের ভাবতে হবে। এখন যেখানে জঙ্গল পতিত জমি রয়েছে ২০০ বছর পরে সেখানে উৎপাদনকারী গ্রাম, শহর থাকবে। হাজার হাজার বর্গমাইল জমি আজ যা শুধু ভালুক আর চিতার দখলে আছে, সেখানে সফল ফল ও সব্জি বাগান, ফসলের জমি, চা বাগান, আখ চাষ ইত্যাদি হবে। বিংশ শতকে ভ্রমণকারী এখানে এসে সুন্দর বাংলো, সুন্দর মফস্বল এলাকা, গুদাম-দোকান দেখবে। ইয়ং বেঙ্গল (এখানে লেখক) এভাবে ভবিষ্যতের উন্নত ভারতের ছবি দেখেছেন। 


সরাইখানাটি একটা পাহাড়ী ঝোরার পাশে জঙ্গলময় উপত্যকায় অবস্থিত। নিকটে ত্রিশ চল্লিশটি কুঁড়েঘর নিয়ে সাঁওতালদের গ্রাম। কুঁড়েঘরগুলি মুখোমুখি দুটি সারিতে রয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে শুয়োর, গরু, ছাগল পায়রা পোষা হয়। গ্রামের চারপাশে তারা চাষবাস করেছে। সাঁওতালদের পরিছন্নতার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে। 


লেখক বলেছেন সাঁওতালরা ভারতের প্রাচীনতম বাসিন্দা। পরে আর্যরা এসে তাদের সরিয়ে ভারতে বসবাস করছে। সাঁওতালরা ক্রমে পাহাড়ে জঙ্গলে চলে গেছে ও সেখানেই রয়েছে। তাদের চেহারা, ভাষা আর্যদের থেকে আলাদা। তাদের ভাষার অক্ষর নেই, তাদের অংক নেই, স্থাপত্য নেই, শিল্পও তেমন কিছু নেই। যদি এই জাতি আজ পৃথিবী থেকে মুছে যায়, তবে তারা কোন সৌধ, কোনো আইন-কানুন, কোনো সাহিত্য বা কোনো নথি ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাবে না। এই জাতি অবহেলিত এবং এদের কোথাও কোন স্বীকৃতি নেই। বরাকরে যে সাঁওতালরা বাস করে তাদের সঙ্গে এখানকার অন্য অধিবাসীদের আচরণে তেমন পার্থক্য নেই। এরা তাদের ভাষার সঙ্গে বাংলা ও হিন্দি মিশিয়ে লেখকের সঙ্গে কথা বলে। সাঁওতালদের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো যে তারা কখনো মিথ্যে কথা বলে না। 


এরপর আবার ডাক গাড়িতে যাত্রা শুরু হল। পথে তালডাঙ্গা (বর্তমানের ঝাড়খন্ড) বাংলোতে খাওয়া হলো। ডাকবাংলোর খিতমদগার ভাত আর মুরগির ঝোল বানিয়ে দিল। সেদিন রাতে সেই ব্রিটিশ বাংলোতে লেখক ও সঙ্গীরা প্রকৃতির মাঝে, ফুলের গন্ধ ভরা বাতাসে বাংলোর সাহেবী আরামে মুগ্ধ হলেন। সাহেবী আদব কায়দায় খাওয়া-দাওয়া করতে করতে তিনি দেশীয় সরাইখানার দুরবস্থার কথা স্মরণ করলেন। বাংলো থেকে বেরোনোর সময় ভাড়ার অতিরিক্ত বকশিশ খুশি মনে দিলেন তাঁরা। 


রাতে আবার ডাক গাড়িতে যাত্রা শুরু হল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ সারারাত চলার পরে প্রথম সূর্যের আলোতে তাঁরা দেখলেন পরেশনাথ পাহাড়ের নীচে পৌঁছে গেছেন। পাহাড়ের চূড়ায় প্রথম সূর্য কিরণ স্পর্শ করেছে। সামনে পিছনে আরো অনেক পাহাড় রয়েছে। সব সময় সমতল দেখে অভ্যস্ত ব্যক্তির প্রথম পাহাড় দেখলে যে রোমান্টিক অনুভূতি হয় তা বর্ণনাতীত। 


পরেশনাথ পাহাড়ের পদপ্রান্তে অবস্থিত স্থান তোপচাচী ( বর্তমান ঝাড়খন্ড)। এখানকার মানুষ কিছুটা সভ্য কিছুটা বন্য। ধান ক্ষেত আর সর্ষে ক্ষেত চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপর তোপচাচী সীমান্ত গ্রাম, যেখানে (তৎকালীন) বাংলা ও বিহার মিশেছে । এখানে লেখক বাংলা ছেড়ে প্রাচীন মগধে, জরাসন্ধের রাজত্বে, চন্দ্রগুপ্ত-অশোকের সাম্রাজ্যে, বৌদ্ধ ধর্মের জন্মস্থানে প্রবেশ করলেন। এখানে তিনি শ্লেষ করে লিখেছেন যে স্থান চীনে পূর্বে বৌদ্ধ ধর্ম প্রেরণ করেছিল, এখন সেখান থেকেই আফিম পাঠানো হচ্ছে চীনে - বিষ এবং বিষের ওষুধ দুইই। ইতিহাসে লেখা নেই কোথায় প্রাচীন গৌড়কে মগধের থেকে আলাদা করা হতো। মোগল আমলে তেলিয়াগড়ি পাস বাংলার পশ্চিম সীমা ছিল। 


কোচয়ানরা যখন ঘোড়া ও গাড়ির তদারকিতে ব্যস্ত, তখন লেখক ও সঙ্গীরা পায়ে হেঁটে তোপচাচী দেখতে বেরোলেন। যতদূর চোখ যায় চুড়ার পরে চুড়া দেখা যায়। চারপাশের গাছপালা সম্পূর্ণ বন্য। একটিও চেনা গাছ নেই। পাহাড়ের নীচের দিকে সম্পূর্ণ উচ্চতার গাছ দেখা যায়, মাঝারি উচ্চতায় সেই গাছগুলিকে বেঁটে ঝোপ মনে হয় আর পাহাড়ের চূড়ায় শুধু সবুজ রং দেখা যায়, গাছের কোন আকার সেখানে বোঝা যায় না। সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি এখান থেকে চার হাজার ফুট আর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ হাজার ফুট উঁচু। 



পরেশনাথ পাহাড়ের নাম জৈনদের তীর্থঙ্কর পরেশনাথের নামে হয়েছে। চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে সর্বশেষ তীর্থঙ্কর পরেশনাথ। এই পাহাড়ের পূর্ব চুড়ায় তিনি নির্বাণ লাভ করেছিলেন। সেই স্থানটি পবিত্রতম স্থান। সেখানে একটি শ্বেতপাথরের ছোট, সুন্দর মন্দির আছে যা নীচের উপত্যকা থেকেও দেখা যায়। পাহাড়ের চূড়ায় হেঁটে পৌঁছানোর পথ আছে। ওপর থেকে পাহাড় ও উপত্যকার অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। চূড়ায় পরেশনাথের বিশাল পদচিহ্ন দর্শনের জন্য রয়েছে। এখানে প্রতি বছর মার্চ মাসে বিশাল এক মেলা হয়। এক লাখ মানুষ দূরদুরান্ত থেকে এখানে আসে। পাহাড়ের নীচে কিছু ফাঁকা জায়গা আছে তাকে মধুবন বলে। সেখানে মেলা বসে। এখানে কিছু মন্দির আছে। মূল মন্দিরে পরেশনাথের কালো মূর্তি, তাঁর মাথার উপর একটি সাপ ছাতার মতো ফণা মেলে ধরে আছে। এছাড়া ক্ষেত্রপাল, চক্রেশ্বরী, পদ্মাবতী যাদের হিন্দু ধর্মের নৃসিংহ, দুর্গা ও লক্ষ্মীর প্রতিরূপ বলা যায় তাঁদের মন্দির রয়েছে। একটি বড় প্রাচীন বটগাছ আছে যা পবিত্র বলে গণ্য করা হয়। মূল মন্দিরটি মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ধনকুবের জগত শেঠ বানিয়ে দিয়েছিলেন। পরেশনাথ জীবহিংসার পরিপন্থী ছিলেন। লেখক ভাবলেন ডাক গাড়ীর চালকদের মেরে মেরে ঘোড়া চালানোর কথা। লেখক মন্তব্য করেন যে ভাগ্যিস ভগবান পরেশনাথ তাদের এই নৃশংসতা চোখ মেলে দেখছেন না।


                      (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২টি মন্তব্য: