পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৩৭। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১ ভোলানাথ চন্দ্র


  সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



The travels of a Hindoo to various parts of Bengal and upper India by Bholanauth Chunder (দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু টু ভেরিয়াস পার্টস অফ বেঙ্গল এন্ড আপার ইন্ডিয়া বাই ভোলানাথ চন্দ্র) - এই বইটি ইংরেজি ভাষায় লেখা হলেও লেখক যেহেতু বাঙালি তাই এটিকে অবশ্যই 'সেকালের বাঙ্গালীদের ভ্রমণ' ব্লগের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। 


এই বইটি দুটি খন্ডে অর্থাৎ পার্ট ওয়ান এবং পার্ট টু- তে বিভক্ত। বইটি লন্ডনের N. Trubner and Company থেকে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির ভূমিকা লিখেছেন J. Talboys Wheeler, যিনি History of India বইয়ের লেখক। গ্রন্থের শুরুতে ভোলানাথ চন্দ্র বইটি উৎসর্গ করেছেন তৎকালীন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া স্যার জন লেয়ার্ড মেয়ার লরেন্সকে। উৎসর্গ করে তিনি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য ইংরাজ সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এবং ইংরাজ শাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রার্থনা করেছেন, কারণ এই শাসন জনগণের উন্নতি আর সুখ নিয়ে আসবে। এই লেখা ছাড়াও সমগ্র গ্রন্থ দুটির মধ্যে ছড়িয়ে আছে এই লেখকের অসম্ভব ইংরাজ প্রীতি এবং ভারতীয় প্রথা, ভারতীয় ধর্মবিশ্বাস-এর প্রতি কিছুটা অবজ্ঞার ভাব। ভূমিকায় জে. ট্যালবয়েজ হুইলার বলেছেন যে এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি কারণ এই প্রথম কোন ভারতীয় তথা হিন্দু যিনি তাঁর ধর্ম, তীর্থ সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ, এরকম একজন ভারতের প্রকৃত চিত্র অর্থাৎ ভারতীয়দের জীবন, স্বভাব, অনুভব, রীতিনীতি, চিন্তাধারা সব তুলে ধরেছেন, যা আগে কোন ইংরাজ লেখকের বই-এ পাওয়া সম্ভব না। তাই এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইংরাজীভাষী মানুষদের কাছে। তিনি ভোলানাথ চন্দ্র সম্পর্কে বলেন যে এই লেখক বাঙালি, হিন্দু, কলকাতাবাসি, বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁর পিতা মাতা বৈষ্ণব, যদিও ইয়ং বেঙ্গল হওয়ায়, বাবু ভোলানাথ চন্দ্র একজন ঈশ্বরবিশ্বাসী হলেও কোন প্রথা বা মূর্তি পূজাতে বিশ্বাসী নন, অন্য অনেক আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি হিন্দুর মত। ভোলানাথ চন্দ্র ইংরেজি ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ। তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজে ইংরাজি সাহিত্য পড়েছেন এবং তাঁর দেশের শিক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার সদস্য ছিলেন।


এই বইয়ের প্রথম খন্ডে লেখকের ১৮৪৫ থেকে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের ভ্রমণ কাহিনী লিখিত হয়েছে। বই পড়া কালীন জানা যায় যে লেখক ডায়েরি লিখতেন, পরে সেই তথ্য নিয়ে তিনি এই বই রচনা করেন। উল্লেখ্য যে স্থান ও পাত্রের নামের ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যবহৃত বানান এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।


তীর্থ ভ্রমণের লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর রচনার সঙ্গে ভোলানাথ চন্দ্রের রচনার অনেক অমিল আছে যদিও তাঁদের ভ্রমণ করা স্থানগুলি অনেকটাই এক এবং তাঁদের ভ্রমণের সময়কাল কাছাকাছি। এই অমিলগুলো হল - ভোলানাথ চন্দ্র ইংরেজিতে লিখেছেন আর সর্ব্বাধিকারী মহাশয় বাংলায় লিখেছেন। সর্ব্বাধিকারী মহাশয়ের ভাষা অত্যন্ত সহজ সরল, তিনি কোন রকম কাব্য বা অলংকারের ব্যবহার করে তাঁর ভাষাকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেননি। অন্যদিকে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ভোলানাথ চন্দ্র ইংরেজি ভাষায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিকের মতো তাঁর লেখার বাঁধুনি। যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী যে যে স্থান ভ্রমণ করেছেন তার সম্পর্কে অত্যন্ত গোছানো ভঙ্গিতে তথ্য দিয়েছেন। তাঁর বই পড়ে সেই সময়কার সেই সব জায়গার তৎকালীন ও তৎপূর্ববর্তী কালের ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি চিত্র অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে পাওয়া যায়। এখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে যেটুকু পরিবর্তন হয়েছে সেটুকু অনুসন্ধান করলেই যথেষ্ট। কিন্তু ভোলানাথ চন্দ্রের লেখা পড়ে কোন স্থান সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা যায় তা সম্পূর্ণ অনুধাবন করতে অনেক পড়াশোনা করতে হয় (মূলতঃ প্রথম খন্ডে), কারণ তিনি হয়তো অল্প কিছু সূত্র দিয়ে পরবর্তী প্রসঙ্গে চলে যান। দুজনের লেখার আর একটা পার্থক্য হল ভোলানাথ চন্দ্র উপনিবেশিক শাসকদের ইতিহাস নিয়ে বেশি লিখেছেন যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর তুলনায়। দুজনের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির খুব বিশেষ পার্থক্য নেই ইংরেজ শাসন সম্পর্কে। দুজনেই ইংরাজ শাসনে সন্তুষ্ট। তবে যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী ভারতীয় সংস্কৃতি, রীতিনীতিতে আস্থাশীল আর ভোলানাথ চন্দ্র সেসব নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেন। যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর লেখা কাউকে সন্তুষ্ট করা বা কারো প্রশস্তি করার জন্য লেখা নয়। তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন মতামত লিখেছেন। অন্যদিকে ভোলানাথ চন্দ্র সবসময় ইংরেজদের সন্তুষ্ট করার মানসিকতা নিয়ে বইটি লিখেছেন। বন্ধনীর () মধ্যে লিখিত অংশগুলি সেই প্রয়োজনীয় অনুসন্ধানের ফসল। ভারতীয় মানুষের ও স্থানের নামের ইংরেজি বানান তৎকালীন সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেক ভিন্ন ছিল, এই লেখায় লেখকের ব্যবহার করা বানান না লিখে, বর্তমানে ব্যবহৃত বানান লেখা হলো এই বইয়ের সব কটি পর্বে।


প্রথম খন্ডে লেখক-এর প্রথম যাত্রার তারিখ ১১ই ফেব্রুয়ারি ১৮৪৫। লেখক ও তাঁর কিছু সঙ্গী গঙ্গাবক্ষে নৌকায় রওনা দিলেন। কলকাতার তৎকালীন মিন্ট বা ট্যাঁকশাল (১৭৫৭ -তে প্রতিষ্ঠিত, স্ট্রান্ড রোডে অবস্থিত) ও মেটকাফ হল (১৮৪৪ -তে প্রতিষ্ঠিত) ছাড়িয়ে নৌকায় যেতে যেতে এলো চিতপুর, যার আসল নাম কালী চিত্রেশ্বরী (চিত্তেশ্বরী সর্বমঙ্গলা কালী মন্দির, চিতপুর)। কালী চিত্রেশ্বরী দেবীর কাছে আগে অনেক নরবলি হতো। শোনা যায় যে মাঝিরা গান গাইতে গাইতে নৌকা চালাচ্ছিল। সেই সুন্দর গান দেবীর কানে প্রবেশ করে। দেবীর মুখ আগে পূর্ব দিকে ঘুরানো ছিল। গান ভালো করে শোনার জন্য তিনি মুখ ঘোরান। সেই থেকে তাঁর মুখ গঙ্গার দিকে ঘোরানো রয়েছে।



এরপর এলো কাশিপুর। সুন্দর বাড়িঘর, জংলি গোলাপ ও নানা ফুলের শোভা আর জলের ওপর সেসবের শান্ত ছায়া দেখতে থাকলেন লেখক। এর পরের এলাকা অর্থাৎ কাশিপুর থেকে বরানগর ২০০ বছর আগে ডাচদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে সারাদেশের 'খারাপ নারীরা' (বারবনিতা) এখানে এসে থাকত। তারপর পরবর্তীকালে ইংরেজরা এই স্থানকে খুব সুন্দর স্থান হিসেবে দেখেছে। এখন এই স্থান শহরের ক্লান্তি দূর করতে, শান্ত সুন্দর প্রকৃতির মধ্যে নিরিবিলিতে ছুটি কাটাতে ব্যবহার করে ধনী ব্যক্তিরা। (বাংলায় ১৬১৫ থেকে ১৮২৫ পর্যন্ত ডাচ উপনিবেশ ছিল বরাহনগর বা বরানগর। সেখানে সেই সময় ডাচদের বাড়ি, কুঠি, বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। কুটিঘাট নামটি এখনো সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে।) 


এরপর এলো দক্ষিণেশ্বর। আগে এখানে এক মুসলমান রাজকুমার থাকতেন বলে শোনা যায়। এখন আছে বিস্তীর্ণ নানা ফুলে ভরা বাগান, সবুজ ঘাস জমি যা গঙ্গার জল পর্যন্ত ঢালু হয়ে নেমে গেছে। (তখনও দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির স্থাপিত হয়নি। যেটি আঠারোশো পঞ্চান্ন খ্রিস্টাব্দে রানি রাসমণি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়।)


দক্ষিণেশ্বরের বিপরীত পাড়ে বালি গ্রাম। এটি খুব পুরনো আর সনাতন স্থান। কবিকঙ্কনের (কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের)  লেখায় এখানকার উল্লেখ আছে। যদিও লেখক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যের শ্রীমন্ত কিভাবে এখানে আসলেন, যদি সেই সময় গঙ্গা সাতগাঁর নীচ দিয়ে প্রবাহিত হতো। বালির মাটির ঘর আর দুঃস্থ চেহারা এই স্থানের প্রাচীনত্বকে অবিশ্বাস করায়। যে খালের নামে এই জায়গার নাম হয়েছে সেই বালিখালের চারপাশে গ্রাম বাংলার সুন্দর ছবি চোখে পড়ে। এই বালিতে পরবর্তীকালে বাংলার একটি বড় ও মজবুত ব্রিজ হয়েছে। (এই ব্রিজ কিন্তু বালি ব্রিজ নয়। বালি ব্রিজ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বালিখালের উপরের ব্রিজ যা বালি ও উত্তরপাড়াকে সংযুক্ত করেছে। সেটি ১৮৪৬ এ অর্থাৎ লেখক যে বছর ভ্রমণ করছেন তার পরের বছর তৈরি হয়।) 


হুগলি নদীর দুপাড়ে অপূর্ব দৃশ্য সুন্দর। সুন্দর বাগান, বাগান বাড়ি চোখে পড়ে। অল্প দূরে দূরে অনেক সিঁড়ি সম্পন্ন ঘাট রয়েছে গঙ্গায় নামার জন্য। হুগলি নদীর উপত্যকার মতো জনবহুল সমৃদ্ধ লোকবসতি বাংলায় আর নেই। লেখকেরা নৌকায় পানিহাটি পেরোলেন। এটি রাঘব পন্ডিতের সমাজ (রাঘব পন্ডিতের ভবন, পানিহাটি)। শ্রীচৈতন্যদেবের শিষ্য রাঘব পন্ডিতের বাড়ি এই পানিহাটিতে। মাধবী গাছের নীচে রাঘব পন্ডিতের সমাধির কথাও লিখেছেন লেখক। 


এর একটু পরে এলো খড়দা। যে যুগে ডাকাতেরা আগে চিঠি পাঠিয়ে ডাকাতি করতো আর ডাকাতি করতে এসে গৃহস্থকে পুড়িয়ে মারতো আর বাড়ির মহিলাদের গরম তেলে জীবন্ত ভাজতো সেই সব ভয়ানক ডাকাতির কথা এখানে এলে মনে পড়ে। (এই কথাটি লেখক কেন লিখেছেন সে বিষয়ে বিস্তৃত কিছু বলেননি। ইন্টারনেট এবং বইপত্র খুঁজে এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি)। শ্রীচৈতন্যদেবের অনুসারী সংস্কারক নিত্যানন্দের বসত ছিল এখানে। নীলাচল থেকে ফিরে তিনি খড়দায় এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিবাহ করেন। তাঁর বংশধররা গোঁসাই নামে পরিচিত হন, যাঁরা মানুষকে ভবসাগর পার করতে সাহায্য করেন। নিত্যানন্দ ও তাঁর বংশধরদের সম্পর্কে ইঙ্গ-বঙ্গ সুলভ মানসিকতায় শ্লেষাত্মক কিছু মন্তব্য করেছেন লেখক।


গঙ্গার অপর পাড়ে মাহেশ। জগন্নাথ ও বলরাম দুই ভাই সারাদিন না খেতে পেয়ে দোকানদারের কাছে খাবারের বিনিময়ে একটি বাজুবন্ধ বন্ধক রেখেছিলেন। পুরী যাওয়ার পথে পান্ডারা সেই বাজুবন্ধের কথা ভুলে যাওয়াতে তাঁদের আবার মাহেশে আসতে হয়েছিল বাজুবন্ধ দোকান থেকে ছাড়াতে। এই গল্পটি লেখক বলেছেন। তখন থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে ওয়ারেন হেস্টিংসের বাগান বাড়ি ছিল মাহেশে, (পরে এটি রিষড়ার হেস্টিংস জুট মিল হয়েছিল, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে)। 


এবার তাঁরা কেরি (উইলিয়াম কেরি), ওয়ার্ড (উইলিয়াম ওয়ার্ড), মার্শম্যান (জন ক্লার্ক মার্শম্যানের) - দের কীর্তিস্থলে এলেন (শ্রীরামপুর)। এই তিনজন ক্রিশ্চান মিশনারী শ্রীরামপুরকে কেন্দ্র করে বাংলায় কলেজ, ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। শ্রীরামপুর একটা ছোট শহর যা অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও অভিজাত বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল, এই যখন তিন মাসে ২২ টি জাহাজ এই তৎকালীন বন্দরে জিনিসপত্র আনা নেওয়া করতো। ডেনমার্কের ড্যানিসরা এখানে ৯০ বছর ছিল ও বাণিজ্য করেছিল (১৭৫৫ থেকে ১৮৪৫)। অর্ধ শতাব্দী আগে টিটাগড়ে একটি জাহাজ-ঘাটা বা ডক ইয়ার্ড ছিল। ১৮০০ সাল নাগাদ ডাচরা চুঁচুড়া পর্যন্ত জাহাজ নিয়ে যেত। তখনও গঙ্গানদী পলি জমে এত অগভীর হয়নি। 


গঙ্গার অপর পাড়ে ব্যারাকপুর সুন্দর পার্ক, গভর্নর জেনারেলের বাড়ি (গভর্নমেন্ট হাউস, ব্যারাকপুর) নিয়ে সুসজ্জিত। কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নক দেড়শ বছর আগে এই স্থানে আসতেন ব্যস্ত শহর থেকে দূরে মাঝে মাঝে শান্তিতে কাটাতে (তখনও এই বাড়ি তৈরী হয় নি অবশ্য)। এই বাড়িতে যে ছবির সংগ্রহ আছে তা দেখার মত। পার্কে সুন্দর গাছ, ফুল, ঘাসজমি ছাড়াও রয়েছে চিড়িয়াখানা। সেখানে বাঘ, গন্ডার, ভাল্লুক, জিরাফ আছে, ছুটির দিন আনন্দে কাটানোর জন্য। প্যারেড গ্রাউন্ডটি স্মরণীয়। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে যেসব সিপাই কালাপানি পেরিয়ে বার্মা যেতে অস্বীকার করেছিল তাদের এখানে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল বলে। এখানে মঙ্গল পান্ডে (১৮৫৭)  সিপাহী বিদ্রোহের নাটকে তাঁর ভূমিকা পালন করেছিলেন, যাঁর নাম ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজে একটা গালি হিসেবে রয়ে গেছে। এভাবে ছত্রে ছত্রে লেখকের দেশীয়দের প্রতি ঘৃণা ও ইংরেজদের চাটুকারিতা ফুটে বেরিয়েছে। 


সেখান থেকে নৌকা এলো নিমাই তীর্থ ঘাটে (বৈদ্যবাটি), যা শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতি রক্ষা করছে। যেখানে তিনি দেশ ভ্রমণ কালে এসেছিলেন ও স্নান করেছিলেন। তারপর এলো চাঁপদানি যা বিগতকালে ডাকাতি, খুনখারাপির জন্য কুখ্যাত ছিল। এরপর এলো ঘিরেট্টি অর্থাৎ গৌরহাটি, যা চন্দননগরের ফরাসি গভর্নরের গ্রামীণ শাসনকেন্দ্র। এখানকার দৃশ্য খুব চমৎকার। একসময় সুন্দর ঘাস জমিতে শয়ে শয়ে ঘোড়ার গাড়ি শোভা পেত। কিন্তু এখন তা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। গভর্নরের বাড়ি, যা এক সময় অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাড়ি ছিল ভারতের মধ্যে, যেখানকার আড়ম্বরপূর্ণ সভাগৃহে ক্লাইভ, হেস্টিংস, উইলিয়াম জোনস এসেছিলেন এখন তা মাটিতে মিশে গেছে। কিছুদিন আগেও তার কিছু ভগ্নাংশ গাছপালা দেখা যেত, এখন কিছু অবশিষ্ট নেই, বলেছেন লেখক।


চন্দননগরের ফরাসি পতাকা দূর থেকে দেখা যায়। এখানে ফরাসি উপনিবেশ ষোলশ তিয়াত্তর থেকে গড়ে উঠলেও স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ডুপ্লের সময় থেকে। তাঁর শাসনকালে দুই হাজারের বেশি ইঁটের বাড়ি তৈরি হয়। ১৫ টি ফরাসি বাণিজ্যতরী বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করছিল। কিন্তু এখন চন্দননগর তার সব গৌরব হারিয়ে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। পুরনো দুর্গ (এখন চন্দননগর কোর্ট) ভগ্নপ্রায় হয়ে গেছে। বাড়িগুলো জনহীন, রাস্তাঘাট, নির্জন ঘাটগুলি অবহেলিত ১৭৫৭ এ ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়ে। পরে লেখক সংযোজন করেছেন যে এখন ১৮৬৯ এ চন্দননগর রেলপথে যুক্ত হয়েছে (১৮৫৪), তাই চন্দননগরের উন্নতি হচ্ছে ও পুরনো শ্রী কিছুটা হলেও ফিরে পাচ্ছে। 


১২ ই ফেব্রুয়ারি ১৮৪৫  নৌকা চুঁচুড়া আসে। গঙ্গাধারের সুন্দর ভবনগুলি খুব সুন্দর লাগে দেখতে। সবচেয়ে ভালো বাড়িটা হলো কলেজ। এটি আগে Monsieur Perron- এর, যিনি দোয়াবের সিন্ধিয়ার ফরাসি জেনারেল আর ডেপুটি ছিলেন তাঁর বাড়ি। (তীর্থ ভ্রমণ গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি যে এরপরে সেটি বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদারের ছিল এবং তারপরে সেখানে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়)। চুঁচুড়া একটি ছোট শহর যা কলকাতার ধুলো, নোংরা, শব্দ থেকে মুক্ত, শান্তিপূর্ণ সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর উপযুক্ত জায়গা। জায়গাটি চন্দননগরের থেকে বেশি প্রাণচঞ্চল। চুঁচুড়া ১৬৭৫ থেকে ডাচ অধিকারে ছিল। যতদিন তারা এখান থেকে বাণিজ্য করেছে ততদিন জায়গাটা সমৃদ্ধ ছিল। তারপর জায়গাটা গুরুত্ব ও সমৃদ্ধি হারায়। চুঁচুড়াতে একজন ডাচ গভর্নর গত শতাব্দীর শেষে (অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ) প্রথম 'পাংখা' আবিষ্কার করেন। চুঁচুড়ার ডাচ শাসনের কিছুই অবশিষ্ট নেই শুধু গির্জার (অধুনালুপ্ত) দেওয়ালে রাখা ডাচ গভর্নরদের ঢাল ছাড়া। (চুঁচুড়ায় পর্তুগিজ শাসন ১৫৩৭ থেকে ১৬৩৫, ডাচ শাসন ১৬৩৫ থেকে ১৮২৫, ইংরাজ শাসন ১৮২৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ছিল)।


লেখকেরা এবার হুগলি ঘাটে পৌঁছলেন। এখানে পর্তুগীজদের পুরনো দুর্গ ছিল যার সামান্য ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট আছে মাত্র। পর্তুগীজরা সম্ভবত ১৫৩৭ -তে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। পর্তুগীজরা ভারতীয় বাচ্চাদের অপহরণ করে বা কিনে তাদের দাস হিসেবে ভারতের নানা বাজারে বিক্রি করতো। দিল্লির বাদশাহ শাহজাহান একবার পর্তুগীজদের থেকে সৈন্য ও অস্ত্র সাহায্য চেয়েছিলেন। পর্তুগীজ শাসক তা অস্বীকার করেন ও বিদ্রোহ করেন। শাহজাহানের সৈন্য বাংলায় পর্তুগীজদের আক্রমণ করে সাড়ে তিন মাস হুগলির দুর্গ অবরোধ করে থাকে। হাজারের বেশি পর্তুগীজকে হত্যা করা হয়, চার হাজারের বেশি জনকে যুদ্ধবন্দি করা হয়। সুন্দর যুবকদের আগ্রায় নিয়ে গিয়ে খোঁজা ও মুসলমান করা হয়। মেয়েদের বাদশাহ ও অভিজাতদের হারেমে দিয়ে দেওয়া হয়। বাংলায় পর্তুগীজ বিলুপ্ত হয়ে যায়। রয়ে যায় শুধু পর্তুগীজ গির্জা আর পর্তুগীজ ধাঁচের কোট। 


হুগলির ইমামবাড়া বিখ্যাত। এর উঠান বিস্তৃত ও সুন্দর। মধ্যে ছোট পুকুর, দোতলা সুন্দর পরিচ্ছন্ন অভিজাত বাড়ি, রাজকীয় হলঘর, মুসলিম আদলে ঝাড় লন্ঠন, লন্ঠন রামধনুর রঙে রঙিন। দেওয়ালে নীল ও লাল রঙের কোরানের বাণী লেখা। দরজাগুলো অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ, তার ওপর সোনালী হরফে মসজিদের সালতারিখ, ইতিহাস লেখা। হুগলির সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হলো প্রেস বা ছাপাখানার প্রবর্তন। ১৭৭৮-এ মেসার্স হ্যালডেন ও উইলকিনস বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ছাপান। এরপর থেকে হিন্দু সাহিত্য ব্রাহ্মণদের কুক্ষিগত না থেকে সকলের আয়ত্তের জিনিস হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে এই ঘটনার রেল বা টেলিগ্রাফ এর পত্তনের থেকেও সভ্যতার পক্ষে বেশি মূল্যবান বলে লেখক মন্তব্য করেছেন।


ব্যান্ডেল চার্চ বাংলার সবচেয়ে পুরনো খ্রিস্টান চার্চ। চার্চের গায়ে প্রতিষ্ঠার তারিখ লেখা আছে ১৫৯৯। পর্তুগীজ জেসুইটদের ছবি ও মূর্তি উপাসনা মুঘল বাদশাহদের যথেষ্ট বিরক্তির কারণ হয়েছিল যা তাঁদের বাংলার পর্তুগীজ উপনিবেশ উৎখাতের অন্যতম কারণ।

                      (চলছে)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২টি মন্তব্য:

  1. পর্বটিতে ভোলানাথ চন্দ্র মহাশয়ের ইংরেজ প্রীতি ও ভারতীয় ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি অবজ্ঞা, পর্তুগীজ দের ভারতীয়দের বাচ্চাদের চুরি করে তাদের দাস হিসাবে বিক্রির গল্প মনকে বিচলিত করলো। বাকি যেটুকু ভ্রমণ বৃত্তান্তের আলোচনা সেটুকু ভালো লাগলো।শিউলি

    উত্তরমুছুন