পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪

৪৬। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১০ ভোলানাথ চন্দ্র

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


               (আগের পর্বের পরে)


২৫ শে অক্টোবর, ১৮৬০ হাওড়া থেকে রওনা হওয়ার সপ্তম দিনে লেখক ও তাঁর সঙ্গীদের ডাকগাড়ি ভোরে বেনারস (কাশী) এসে পৌঁছল। শিবের ত্রিশূলের ওপর অবস্থিত হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ বেনারস, ভোরের আলোয় গঙ্গার পাড়ে আবছা ভাবে দেখা গেল। কোন কোন মন্দির থেকে ভেসে আসা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। দিনের আলো প্রকট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মন্দির, প্রাসাদ, মিনার, গম্বুজ, ঘাট স্পষ্ট হয়ে দৃষ্টিগোচর হল। হিন্দু ধর্মের পবিত্রতম তীর্থস্থান শিবের শহর, বহুদিনের শোনা, পড়া, স্বপ্নের শহর এখন তাঁদের চোখের সামনে রয়েছে। প্রথম দৃষ্টিতে আশাপূরণ হল। 

অর্ধচন্দ্রাকৃতি সমগ্র শহরটি অপর পাড় থেকে দেখা যায়। অপর পাড়েও একটি সুন্দর শহর রয়ে, যার নাম ব্যাসকাশী। লেখক বলেছেন শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যেই শৈবদের কাশীর অন্য পাড়ে বৈষ্ণবরা ব্যাসকাশী তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের এই প্রতিযোগিতা সফল হয়নি। ব্যাসকাশী কাশীর মর্যাদা পায় নি। ব্যাসকাশীতে বেনারসের রাজার ভবন আছে। কাশী ও ব্যাশকাশীর মধ্যে যে নৌকার পুল আছে তার অন্যতম কারণ কাশীতে মৃত্যু হলে স্বর্গলাভ হয় আর ব্যাসকাশীতে মৃত্যু হলে গাধা হয়ে জন্ম লাভ হয় বলে কথিত আছে। নৌকার পুল ছাড়া নৌকায় গঙ্গা পারাপার করা যায়। বেনারসের গঙ্গা প্রস্থে ভাগীরথীর দুই তৃতীয়াংশের বেশি হবে না কিন্তু এর গভীরতা ও স্রোতের বেগ বেশি। 

রাজঘাটে নৌকা থেকে নেমে অতি উৎসাহে পায়ে হেঁটে শহর দেখতে বেরোলেন লেখক। কিন্তু অপর পাড় থেকে শহরটি যত সুন্দর লাগছিল এখন আর সেরকম লাগলো না নোংরার কারণে। 

বেনারসের তুলনা পূর্ব-পশ্চিমে কোথাও পাওয়া যাবে না। এটি মন্দির, মঠ, টোল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খাদ্যদ্রব্য সবকিছু নিয়ে সম্পূর্ণরূপে হিন্দু ধর্মের স্থান। একজন বিদেশি সত্যিকার হিন্দু শহর দেখতে চাইলে বেনারসে সে সব কিছু পাবে। বেনারস পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর, যার অস্তিত্ব এখনো আছে। এই শহর সুপ্রাচীন ও বর্তমান কালের মধ্যে মেল বন্ধন ঘটাচ্ছে। কিন্তু বেনারসে খুব প্রাচীন কোন স্থাপত্য নেই। আকবরের সময়কার স্থাপত্যই বোধ করি প্রাচীনতম। 


বেনারসের প্রাচীন নাম কাশী। কাশীখন্ডতে (স্কন্দপুরাণের অংশ) প্রাচীন বেনারসের বর্ণনা সামান্য আছে, তবে মূলত শিব বিষয়ক পুরাণ এটি। কাশীর অপর নাম বারাণসী শহরটির বরনা ও অসি নামক নদীর মধ্যে অবস্থানের কারণে হয়েছে। বেনারস নাম বারাণসী থেকে এসেছে। লেখক-এর মতে আগে কাশী নাম ছিল পরবর্তীকালে বারাণসী নাম হয়। ফা হিয়েনের ৪০৫ খ্রিস্টাব্দ আগমনের পরে বারাণসী নাম হয়েছে। হয়ত পুরনো কাশী বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে তার স্থান মাহাত্ম্য হারিয়ে ক্রমে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। পরে শৈবরা বরনা ও অসির সঙ্গমস্থলে তীর্থস্থান স্থাপন করেন ও নাম দেন বারাণসী, এটি লেখকের নিজস্ব মতবাদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের পরিবর্তন হয়েছে বারবার। বর্তমান শহর লেখকের মনে হয় তিনশ বছরের বেশি পুরনো নয়। এই শহর হারানো গৌরব ফিরে পেয়েছে ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বুন্দির রাজপুত রাজা রাও সুজন সিং-এর সময় থেকে। সুজন সিং আকবরের অধীনে বেনারসের শাসক ছিলেন। তাঁর আমলে প্রদেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ ও শহরের সৌন্দর্যবর্ধন ভালোভাবে হয়। 


রাজঘাটের উপরে রয়েছে বেনারসের পুরনো দূর্গ। মনুর আমলে বেনারস গঙ্গা তীরবর্তী দুটি স্বাধীন জনপদের অন্যতম ছিল। পশ্চিমে পাঞ্চাল, পূর্বে মগধের আক্রমণ আটকাতে এই দূর্গের অবস্থান হয়তো জরুরী ছিল। শেষ হিন্দু রাজা জয়চন্দ্র পর্যন্ত এই শহরের গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। পূজারীদের শহর মোহাম্মদ ঘোরীর দুর্ধর্ষ সেনাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। কেল্লায় জমা থাকা সমস্ত সম্পদ তাদের হাতে চলে যায়। কেল্লার মধ্যে অনেক মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির, বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। মাটির নীচে অনেক পুরনো স্থাপত্য চাপা পড়ে আছে। রাজঘাট থেকে প্রধান রাস্তা জনবহুল শহরের মধ্যে চলে গেছে। এখানে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের বাড়ি থেকে ছাত্রদের বেদ পাঠের আওয়াজ ভেসে আসতো। ক্ষমতাবান বৈশ্যদের দোকান আর প্রাসাদ চোখে পড়তো। বেশ কিছু শতাব্দী ধরে বৌদ্ধমঠ ও মন্দির ছিল এখানে। শঙ্করাচার্য এখানে বৌদ্ধ ধর্মের নাস্তিকতাকে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন হিন্দু ধর্ম দিয়ে। 


শহর ঘুরে দেখার হিন্দু রীতি আছে আছে তাকে নগর পরিক্রমণ বলে। যেখানে নির্দিষ্ট পথে ঘুরে তীর্থস্থান দর্শন করা হয়। সরু গলিতে পূর্ণ শহরের উঁচু উঁচু বাড়িগুলি সূর্যের আলো আর হাওয়া ঢুকতে দেয় না। সব বাড়ির বৈশিষ্ট্য একই। ঝুল বারান্দা, ঘুলঘুলি, কাজ করা দেওয়াল আর গোলাকার স্তম্ভ। বেশিরভাগ বাড়ি ছয় বা সাত তলা, প্রতিটি তলা ১০ বা ১২ ফুট উঁচু। ছোট উঠোন আর খুব ছোট ছোট অন্ধকার ঘর। নীচু দরজা যা দিয়ে ঢুকতে বেরোতে মাথা নীচু করতে হয়, জানলা ছোট আর কম সংখ্যক। অন্তঃপুর সাধারণত বাড়ির উপরের দিকে তলায় হয়। শহরটি অনেকগুলো মহল্লায় বিভক্ত, প্রতিটি মহল্লার দরজা রাতে বন্ধ থাকে। শহরে হাজার হাজার মন্দির আছে। হাজারের বেশি মন্দির মুসলমান আক্রমণকারীদের হাতে ধ্বংস হয়েছে কিন্তু আবার হাজার হাজার মন্দির তৈরি হয়েছে। আওরঙ্গজেবের সময় আবার অনেক মন্দির ধ্বংস হয় এবং তারপর আবার গড়ে ওঠে। বেনারস শুধু শৈবদের শহর নয়, এখানে বৌদ্ধ, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, জৈন সব ধর্ম মতের মানুষই আছে। বেনারসের ঘাটগুলি দেখবার মতো। ঘাটে মানুষ দিনের আনন্দময় সময়গুলি কাটায়। সকালে বেশিরভাগ হিন্দু ঘাটে স্নান, পোষাক পরিবর্তন, প্রার্থনা করে। সন্ধ্যায় গঙ্গায় নির্মল বায়ু সেবন করে, সন্ন্যাসীদের কঠোর তপস্যা দেখে, নানারকম পাঠ শোনে। হিন্দু মহিলাদের বাইরের খোলা জগত এই ঘাটগুলি। সেখানে তারা গল্প করে, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করে, এমন কি প্রেম পরিণয়ের সূত্রপাতও হয় এই ঘাটে। 


বেনারসে স্থানীয় দর্শনীয় স্থান দেখতে প্রথমে লেখক গেলেন ভেলুপুরের তিলভান্ডেশ্বর মন্দিরে। এক তরুণ ব্রাহ্মণ এক মদ-বিক্রেতার সুন্দরী পত্নীর প্রতি আকৃষ্ট হন। মদ-বিক্রেতাকে একদিনের জন্য ব্যবসার কাজে অন্যত্র যেতে হয়। তার স্ত্রী ওই ব্রাহ্মণকে তার সঙ্গে রাত কাটাতে আহ্বান করে। কিন্তু অযাচিতভাবে গভীর রাতে স্বামীটি বাড়ি ফেরে। স্ত্রী তখন আর কোন পথ না পেয়ে ব্রাহ্মণকে একটি বড় ভান্ডের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। ঘরে ঢুকে ওই মদ-বিক্রেতা সেই ভান্ডে মদ রাখতে শুরু করে। কোন উপায় না থাকায় ব্রাহ্মণ ওই ভান্ডে মদে ডুবে মারা যায় নিঃশব্দে। সকালে বিক্রেতা হতবাক হয়ে দেখেন ভান্ডটি সমগ্র মদ ও ব্রাহ্মণ সহ পাথরে পরিণত হয়েছে। সেটি তিল ভান্ডেশ্বর নামে পরিচিত হয়। সকলের বিষ্ময় জন্মায় যে এত ছোট পাত্রে কিভাবে কিভাবে ব্রাহ্মণ আশ্রয় নিয়েছিল। তিল ভান্ডেশ্বর বস্তুত একটি গোলাকার বড় পাথর যা নাকি প্রতিদিন তিল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে কিন্তু এই কাহিনী লোপ পেয়েছে। এই শিব মূর্তি তিল তিল করে বৃদ্ধি পায় বলে এর নাম তিল ভাণ্ডেশ্বর। 

মণিকর্নিকা ঘাট সম্পর্কে লেখক যে কাহিনী লিখেছেন সেটি হল - বিষ্ণু নানারকম সাধনায় শিবকে সন্তুষ্ট করেন। শিব বিষ্ণুর আচরণে সম্মতি সূচক মাথা নাড়তে গিয়ে তাঁর কর্ণকুণ্ডল থেকে একটি মণি পড়ে যায় এখানে, সেই থেকে নাম হয় মণিকর্ণিকা। এটি হিন্দুদের মৃতদেহ সৎকারের পূণ্যতম স্থান। 

লেখক এরপর ভৈরবনাথের মন্দির (বটুক ভৈরবের মন্দির), কবি তুলসী দাসের বাড়ি (তুলসী মানস মন্দির, যেখানে তুলসীদাস আন্দাজ ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে হিন্দি রামায়ণ রচনা করেছিলেন) এবং চৈতন্যদেবের শিষ্যদের আবাসস্থল দেখলেন।

গঙ্গার ধারে যে মন্দির ও প্রাসাদগুলি দেখা গেল তার বেশিরভাগই মারাঠা রাজারানীদের সৃষ্টি। বাজিরাও অহল্যা বাঈ প্রমুখের দান বর্তমান বেনারসের গঠনে সর্বাধিক ভূমিকা। হিন্দু বিজ্ঞানের মন্দির, যার নাম মান মন্ডল (মান মন্দির) বেনারসে তা অবস্থিত। রাজা মানসিংহ, যে রাজার ব্যাপারে ইতিহাস স্পষ্ট নয়, তাঁর বেনারসের প্রাসাদে, তাঁর মৃত্যুর বহু পরে অম্বরের রাজা জয় সিংহ এই মানমণ্ডল (মান মন্দির) তৈরি করেন বলে শোনা যায়। কিন্তু রাজা মানসিংহের সঙ্গে মান মন্দিরের সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। মান শব্দের অর্থ পরিমাপ, মন্ডল শব্দের অর্থ গোলক বা পৃথিবী। অর্থাৎ যে স্থানে পৃথিবীর পরিমাপ করা হয়। পাথরের তৈরি বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের সাহায্যে প্রাচীন হিন্দুরা পৃথিবীর বিভিন্ন পরিমাপ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা করতেন। সপ্তদশ শতকের ফরাসি পর্যটক জয়পুরের রাজকুমারদের জ্যোতির্বিদ্যা অভ্যাস করতে দেখেছিলেন। দুঃখের বিষয় যে এই মান মন্দিরের ব্যবহার এখন আর কোন ভারতীয় করেনা। যদিও হিন্দু পঞ্জিকা বেনারস থেকেই তৈরি হয় প্রতিবছর। (অন্তর্জাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে অম্বরের রাজা মানসিংহ এই প্রাসাদ ও ঘাট তৈরি করেন। মান মন্দির সপ্তদশ শতকে তৈরি করেন এই প্রাসাদে রাজা সওয়াই জয় সিং। 


এবার তাঁরা গেলেন মাধো রায় কে ধারারাতে, যেটি ছিল বিন্দু মাধবের মন্দির (একটি বিষ্ণুমন্দির)। ঔরঙ্গজেব এই মন্দির ধ্বংস করান ও মসজিদ তৈরি করান। এটি বেনারসের সবচেয়ে উঁচু মসজিদ। মসজিদের ২২৫ ফুট মিনার থেকে নীচে শহরটি সুন্দর দেখা যায়। পরিষ্কার আকাশ থাকলে এখান থেকে নাকি হিমালয় পর্বত দেখা যায়। মিনার থেকে গঙ্গার অপর পাড়ে চৈত সিং-এর দূর্গ দেখা যায়। (বেনারসের রাজা চৈত সিং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে শত্রুতামূলক আচরণ করায় তাঁকে দূর্গে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। তিনি তাঁর মাথার পাগড়িকে দড়ি হিসেবে ব্যবহার করে একটি ছোট জানালা দিয়ে গঙ্গায় নেমে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে দুর্গ থেকে ও কাশী থেকে পলায়ন করেন। সেই থেকে দূর্গটি চৈত সিং দূর্গ নামে খ্যাত। এখন পঞ্চগঙ্গা ঘাটে একটি বিন্দু মাধব মন্দির রয়েছে যেটি পরবর্তীকালে তৈরি হয়েছিল। মসজিদটির নাম আলমগীর মসজিদ। যে দীর্ঘ মিনারের কথা বলা হয়েছে সেটি উনবিংশ শতাব্দীতে ভগ্নপ্রায় হলে জেমস প্রিন্সেপ সেটি সংস্কার করেন। কিন্তু ১৯৪৮-এ সেটি বন্যার সময় ভেঙে পড়ে ও দুর্ঘটনায় কজন মারা যায়। তারপর মিনারের বাকি অংশ নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার ভাঙ্গার নির্দেশ দেন। তাই বর্তমানে সেই মিনার নেই)। 


কাশী বিশ্বেশ্বরের মন্দির দেখে লেখক কিছুটা হতাশ হলেন। যদিও মন্দিরের চূড়া, পাঞ্জাব কেশরী রঞ্জিত সিংহের দ্বারা সোনায় বাঁধানো, কিন্তু মন্দিরের বিশালত্বের অভাব আছে বলে তাঁর মনে হল। মন্দির তেমন প্রাচীন নয়, অহল্যা বাই দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরে ভক্তের আনাগোনা প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। প্রতিদিন সকাল বিকেলে দেবতাকে গঙ্গার জলে স্নান করানো হয়। মন্দিরের ভেতর লেখক যে ঐশ্বর্যের প্রকাশ আশা করেছিলেন তা পাননি। ফুলের মালা দিয়ে শিবলিঙ্গ সজ্জিত, ধূপধুনার গন্ধে আমোদিত, মন্ত্রে ও নানা বাদ্যযন্ত্রের শব্দে মুখরিত। এরপর দেবতাকে প্রসাদ দেওয়া হয় এবং তাঁর নিদ্রার ব্যবস্থা করা হয়, শীতে শাল ও গরমে কিংখাবে আচ্ছাদিত করে। 


জ্ঞানবাপী হল পবিত্রতম জলের কূপ। এই কূপের অভ্যন্তরে আদি বিশ্বেশ্বর শিবলিঙ্গ আছেন, যিনি মুসলমান যুগে বেনারসের পতনের সময় অন্তর্হিত হন। বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত লেখক ও সঙ্গীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন এবং তাঁদের গলায় মালা পরিয়ে দেন। মন্দিরের আশেপাশে বহু প্রাচীনকাল থেকে বসবাসকারী পরিবারেরা রয়েছে। গলি পথগুলি খুব সরু। প্রায়ই ধর্মের ষাঢ় সেই পথটুকুও আটকে দেয়। এদের কোন আঘাত করা যায় না (কারণ শিবের বাহন)। বোঝা যায় যে বেনারসে পুরোহিত ও ষাঢ়রাই সর্বোচ্চ সম্মান পায়। সব তীর্থস্থানের মত ভিখারিরা এখানে ভালো উপার্জন করে। 


বিশ্বেশ্বরের মন্দির থেকে কুড়ি তিরিশ পা গেলে অন্নপূর্ণার মন্দির। মন্দিরের গঠন সুন্দর। দেবী এখানে হিন্দু রমণীদের মত পর্দানশীন। পর্দা সরালে চতুর্ভূজা দেবী মূর্তি দেখা গেল। দেবী মূর্তি শ্বেতপাথরের তৈরি কিন্তু মুখে সোনা ও রুপা দু'রকম ছাঁচ ব্যবহার করে দেবীর রূপের পরিবর্তন আনা হয়। দেবীর হাতে বাসন আছে যাতে বোঝা যায় যে তিনি অন্নদান করছেন। লেখক মন্দিরে এক ব্রাহ্মণকে দেখলেন যিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে বেদ পাঠ করে যাচ্ছেন। 


বেনারসে যাঁরা ইতিহাস, প্রাচীনতা খুঁজতে আসেন তাঁরা কিছুটা হতাশ হতে পারেন কারণ প্রাচীন স্থাপত্য তেমন নেই এখানে, প্রাচীন দ্রব্যের জাদুঘর বা প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও নেই বেনারসে। দেখার জিনিসের মধ্যে আছে এক চক, যেখানে অভিজাত রেশম বস্ত্র সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিশেষ দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয় হয়। 


সবথেকে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য স্থান হল এখানকার কলেজ (সম্পূর্ণানন্দ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে এর নাম)। রঙিন কাচ, ফোয়ারা দিয়ে সাজানো জাকজমকপূর্ণ কলেজটির পাঠাগারে অনেক প্রাচীন পুঁথি রয়েছে। দশম একাদশ শতাব্দীর ভারতীয় মাটির বাসন রয়েছে। হিন্দুধর্ম, দর্শন, ন্যায়ের বিশিষ্ট পীঠস্থান বেনারসে নেওয়া সিদ্ধান্ত প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু সমাজের পক্ষে চরম আদেশ।  বেনারস কলেজ স্থাপন করা হয়েছে যাতে আলোকপ্রাপ্ত নতুন হিন্দু জাতি, নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে। (১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জোনাথন ডানকানের উদ্যোগে গভর্নর জেনারেল কর্ণওয়ালিসের আদেশে এটি স্থাপিত হয়)। আওরঙ্গজেবের মসজিদের পাশে নদীর ধারে একটি স্তম্ভ ছিল। অতি প্রাচীনকাল থেকে সেটি শিবের দণ্ড বলে খ্যাত ছিল। এখন সেটি এই কলেজের উত্তর দিকে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এটি এক পাথরের তৈরি। এতে লিপি ও কারুকার্য আছে। (পরে জানা গেছে এটি অশোকের সময়ের একটি শীলাস্তম্ভ। 


বেনারস থেকে সাড়ে তিন মাইল উত্তরে সারনাথ অবস্থিত। সারঙ্গনাথ অর্থাৎ মৃগদের প্রভু কথাটি থেকে সারনাথ নাম এসেছে। এখানে একটি মৃগদাব ছিল। জাতকের কাহিনী অনুসারে বোধিসত্ত্ব মৃগ রূপে অবতরণ করেছিলেন। এখানে পাথরের তৈরি ধামেক (স্তূপ) রয়েছে, যা ৯৩ ফুট ব্যাস ও ১২৮ ফুট দৈর্ঘ্য সম্পন্ন। রয়েছে পাথরের তৈরী ধর্মচক্র। হিউয়েন সাং লিখেছেন যে তিনি দেখেছেন তামার তৈরি একটি বুদ্ধমূর্তি এই ধর্মচক্রকে ঘোরাচ্ছেন। এছাড়া আরও স্তূপ, বুদ্ধমূর্তি এখানে পাওয়া গেছে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে। গুপ্ত ও বাংলার পাল যুগে বৌদ্ধ রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সারনাথের সমৃদ্ধ স্থান ছিল। হিউয়েন সাং সেখানে তিরিশটি বৌদ্ধ মঠ ও তিন হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দেখেছেন। সময়ের পরিবর্তনে, বৌদ্ধ ধর্মের হিন্দু ধর্মের কাছে পরাজিত হওয়ার ফলে, সারনাথ ক্রমে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

                       (চলছে)

প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২টি মন্তব্য:

  1. পর্ব টিতে বেনারসের কিছু প্রসিদ্ধ স্থানের উল্লেখ আছে যেগুলোর অবস্থান আজও অক্ষত আর সেটা আমার বেনারস ভ্রমণের ফলে অবগত হয়েছি। বেশ সহজ সাবলীল উপস্থাপনা ।
    শিউলি

    উত্তরমুছুন