সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
কাশ্মীরের পশ্চিমভাগ : নৌকায় শ্রীনগর থেকে যাত্রা করলে সাফা কদল সেতু পার হলে বাঁদিকে দুধ গঙ্গা প্রবাহিত। কিছুদূর এগোলে বাঁদিকে ফাঁসি কাঠ দেখা যায়। এখানে আগে প্রায়ই দু-একজনের ফাঁসি হতো। বর্তমানে রাজা ফাঁসির আদেশ প্রায় করেন না। এরপর পর্যটকদের জন্য সুন্দর একটি কাঠের বাড়ি আছে।
তার পর ক্ষীর ভবানী দর্শন। সকালে কুণ্ডের জল সবুজ ছিল যখন লেখক দর্শন করেছিলেন বেলা দশটায় হল গোলাপি। এরপর নদীপথে দু'পাশে গ্রামগুলি, চীনার বন, গালিচার মতো সবুজ ঘাস জমির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলা।
এ পথের প্রথম হ্রদ হল মানস বল। এই হ্রদের জল অতি গভীর, স্বচ্ছ। নিকটে বাদশা জাহাঙ্গীরের তৈরি বাদশাহবাদের ভগ্নাংশ আছে। এই হ্রদ নীচে অবস্থিত অসংখ্য কুন্ডের জলে পুষ্ট। জলে সাদা ও লাল রঙের পদ্ম বন আছে, যা হ্রদের শোভা দ্বিগুণ করে তুলেছে। সামনের এক অত্যুচ্চ পর্বত থেকে একটি সুন্দর জলপ্রপাত সপ্তধারায় পড়ছে। হ্রদ ও প্রপাতের কাছে রয়েছে একটি প্রাচীন মন্দির। লেখক এই স্থানে ঘাসের উপর রাত কাটাতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না কারণ তিনি শুনলেন রাতে ভাল্লুক প্রকৃতি হিংস্র পশু এখানে জল পান করতে আসে।
পরবর্তী গন্তব্য উলার হ্রদ। এই হ্রদ এখানকার সর্বাপেক্ষা বৃহৎ হ্রদ। বিতস্তা নদী এর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। অগভীর জলে জলজ লতা, পদ্ম বন আর অনেক মাছ রয়েছে। উলার হ্রদ নৌকায় পার হওয়ার সময় হাওয়ার প্রকোপে নৌকা উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা হয়েছিল।
এরপর নুরুখালের দিকে উলার হ্রদে প্রবেশ করে লঙ্কাদ্বীপ দর্শন। চারশ বছর আগে মুসলমান নরপতি জালালুর উদ্দীন একটি নির্মাণ করেন। এটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০০ এবং প্রস্থের প্রায় ১৫০ হাত। বড় বড় গাছ বিশেষত তুঁত গাছের নিবিড় অরণ্য এত ঘন যে এখানে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে না। আঙ্গুর ভর্তি লতা গাছগুলির গা বেয়ে উঠেছে। সর্বত্র প্রাসাদ, স্তম্ভের ভগ্নাবশেষ রয়েছে। একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে যেটি হয়তো কোন হিন্দু রাজা পরে স্থাপন করেছিলেন। কাশ্মীরের সুলতান জয়নাল আবেদীন ১৪০৪ -এ হ্রদের মধ্যে জয়নাললঙ্কের কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করিয়েছিলেন।
এরপর লঙ্কা দ্বীপের বিপরীত দিকে হ্রদের পশ্চিম পাড়ে শকর উদ্দিন পাহাড়। দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে উঠতে হয়। চূড়ায় শকর উদ্দীন নামক বিখ্যাত ফকিরের জেয়ারত অর্থাৎ মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। নীচে উলার হ্রদের দৃশ্য ও হ্রদের পাশের গ্রামগুলির দৃশ্য এখান থেকে সুন্দর দেখায়।
হ্রদের দক্ষিণ-পশ্চিম তীরে সোপুর নামের স্থান আছে পূর্বে এটি একসময় কাশ্মীরের রাজধানী ছিল। এর প্রাচীনতম নাম সুরাপুর। অবন্তিবর্মা নরপতির মন্ত্রী সুর এই শহরের পুনর্নির্মাণ করে করেন বলে এর নাম সুরাপুর। আরো আগে এই স্থানের নাম ছিল কাম্বুরা বা কামপুর। এখানে পর্যটকদের থাকার জন্য দুটি সুন্দর বাড়ি আছে। প্রাচীন দুর্গ, সুন্দর শিব মন্দির ও স্বর্ণচূড়া বিশিষ্ট একটি মসজিদ আছে। এখানকার জলবায়ু খুব স্বাস্থ্যকর তাই ইংরেজরা এখানে ভ্রমণে আসে। মাছ ধরা তাদের প্রধান আনন্দ।
এবার নৌকায় বিতস্তা নদী পথে বারামুলায় আসা হল। এখানে পিরান (ফিরান) এবং দীর্ঘ তিলকধারী পান্ডারা প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল লেখকদের তাদের যজমান করার জন্য। এখানেও মহারাজা পর্যটকদের জন্য একটি বাংলো করে দিয়েছেন। জানা গেল এক ইংরেজ এখানে গুপ্তধনের সন্ধানে খনন কার্য চালাচ্ছেন। কথিত আছে চীন সম্রাটেরা পরাজিত হয়ে এ দেশ পরিত্যাগ কালে বারামুলার কাছে কোন স্থানে বহুমূল্য রত্ন লুকিয়ে রেখে গেছেন। সেই স্থানে পৌঁছে একটি অতি উচ্চ শিবলিঙ্গ ও ভাঙ্গা মন্দির দেখলেন তাঁরা। শোনা যায় সেটি পাণ্ডবরা প্রতিষ্ঠা করেছিল। তার কাছে সেই গুপ্তধন খোঁজার জায়গা। একটি ছোট ঢিপি, যার সারা গায়ে জঙ্গল আর উপরে হিংস্র জন্তুর বাস, সেখানে খনন কার্য চলছে। সেখানে প্রাচীন ইঁটের গাঁথুনি খননের ফলে দেখা যাচ্ছে। (বারামুলার কাছে অবস্থিত এই স্থানটির নাম উস্কুর। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ১৮৬৯-'৭০ এ এখানে বৌদ্ধমঠ জয়েন্দ্র বিহারের অবশেষ উদ্ধার করেছে এখানে। বৌদ্ধ বিহারের অবশেষ থেকে পাওয়া গান্ধার রীতিতে তৈরি টেরাকোটার বুদ্ধমূর্তি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আছে। ১৮৬৯ ভ্রমণ কালে এই খননকার্য বা তার পূর্ববর্তী অনুসন্ধান নিশ্চয়ই দেখেছিলেন লেখক। কুশান রাজা হুবিষ্ক -র নামে এই জায়গার নাম ছিল হুসকাপুর, তার থেকে উস্কুর। হিউয়েন সাং তাঁর লেখায় এই মঠের কথা লিখেছেন।
লেখক বলেছেন কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক খনিজ সম্পদ আছে যেগুলি এখনো খনন কার্যের ফলে উদ্ধার করা যায়নি। যাতায়াতের পথে চন্দ্রভাগা নদীতে তিনি নিজেই সোনা এবং রুপো মেশানো পাথর পেয়েছিলেন অনেক পরিমাণে।
বারামুলা নাম হয়েছে বরাহমুলা থেকে কারণ প্রবাদ আছে যে এখানে বরাহ অবতার ছিলেন। এখানকার এক পর্বতগাত্রে বরাহের খুরের চিহ্ন আছে। আর আছে রামকুন্ড, সীতাকুণ্ড, সূর্যকুন্ড প্রভৃতি অনেক কুন্ড ও তীর্থ। বিতস্তা নদী বারামুলা অতিক্রম করে সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এখানে তার স্রোত তীব্র ও ভয়াবহ। এখানে আর নৌকা যেতে পারে না।
কাশ্মীরের অধিকতাকে মর্গ বা ক্ষেত্র বলে। নানা রকমের ফুল ফুটে মর্গগুলি অপরূপ শোভা ধারণ করে পর্যটকদের মুগ্ধ করে। গুলমর্গ সবথেকে বেশি সুন্দর। শ্রীনগর থেকে জল ও স্থলপথ মিশ্র করে এখানে যেতে হয়। মর্গের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে এবং পাশের গিরিশ্রেণীর অধিকাংশ অংশে ফুল ফুটে থাকে এই সময়। যত দূর দৃষ্টি যায় ফুল ছাড়া কিছু দেখা যায় না। এখানে পর্যটকদের কোন থাকার জায়গা নেই। ভ্রমণকারীরা নিজের নিজের শিবির স্থাপন করে বাস করে। এর কাছে অনেক গুজ্জর অর্থাৎ গোপালক এবং চোপান বা মেষপালকরা বাস করে। তাই দুধ, দই, ঘি, মাংসের অভাব এখানে হয় না। অন্য দ্রব্য বহু দূর থেকে নিয়ে আসতে হয়।
খিলানমার্গ আরেকটি রমনীয় মর্গ। যদিও এটি বৃহত্তর কিন্তু ফুলের দিক থেকে গুলমার্গের থেকে কম সৌন্দর্য এখানকার।
লোলাব একটি অতি উত্তম অঞ্চল। দৈর্ঘ্যে ১৫ মাইল, প্রস্থে কোন কোন স্থানে অতি সংকীর্ণ কোন কোন স্থানে তিন মাইল পর্যন্ত প্রসারিত। চারদিকে সুউচ্চ গিরিশ্রেণী। মধ্যে দিয়ে বড় একটি নদী (লাওল নদী) প্রবাহিত। এখানে ভূমি খুব উর্বর। তুঁত, বাদাম, আখরোট, চিনারের অনেক উদ্যান আছে। তিরিশটির মত গ্রাম নিয়ে এই অঞ্চল তৈরি। জলবায়ু শীতল ও স্বাস্থ্যকর। শিকারিদের স্থান খুব প্রিয় স্থান এটি। ভাল্লুকরা ফল পাকলে দলে দলে এখানে আসে। তাই এই স্থানকে অনেকে ঋক্ষ বন বলে।
কাশ্মীরের উত্তর অংশ লোলাব অঞ্চলের মতো শ্রীনগরের উত্তর-পূর্ব ভাগে লার নামে একটি অপূর্ব অঞ্চল আছে। এই উপত্যকা দিয়ে সিন্দ নদী (সিন্ধু নদী নয়) প্রবাহিত। দ্রাস, লাদখ, ইয়ারকন্দ যাওয়ার পথ এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে গেছে। আকাশ ছোঁয়া তুষার মন্ডিত পর্বত; চির, ভুর্জপত্রের অরণ্য, সুস্বাদু ফলের বাগান আর গালিচার মতো সবুজ দূর্বায় ঢাকা এই উপত্যকা অসম্ভব সুন্দর। আঙুর, পিচ, আখরোট, নাশপাতি, আপেল ফল চারদিকে ফলে থাকে। নদীর দুধারে ছোট ছোট গ্রাম আছে। তাদের চারপাশে শস্যের ক্ষেত। এই স্থান শিকারের জন্য ভালো। এখানকার জলবায়ু উত্তম। তাই সম্ভ্রান্ত কাশ্মীরীরা এবং পর্যটকেরা শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে এই স্থানে কিছুদিন কাটিয়ে যায়। এই উপত্যকার উত্তর পশ্চিম প্রান্তে কয়েকটি সুন্দর কিন্তু জীর্ণ মন্দির আছে। এখানে একটি পবিত্র ঝর্ণা বা বল আছে। পাথরের তৈরি কুন্ড বা চশমা আছে, তাকে নাগবল বলে। গঙ্গাবল একটি অতি সুন্দর পার্বত্য হ্রদ। এটি হরমুখ পর্বতের ১৬৯০০ ফুট উঁচু শিখরে অবস্থিত। এটি বিতস্তা নদীর উৎস স্থল ও হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ। কাশ্মীরি পন্ডিতের কাছে এই গঙ্গাবল গঙ্গার মতো পবিত্র। প্রতিবছর ভাদ্র মাসে এখানে হাজার হাজার যাত্রী সমাগম হয়।
সিন্দ উপত্যকার উত্তর পূর্ব প্রান্তে শ্রীনগর এবং শ্রীনগর থেকে ৫ আড্ডা অর্থাৎ ৫ দিন দূরে সোনামর্গ বা স্বর্ণময় ক্ষেত্র। সোনমার্গ পর্যটকদের কাছে গুলমার্গের সমান বা বেশি জনপ্রিয়। এখানে মহারাজা পর্যটকদের জন্য কয়েকটি বাসগৃহ তৈরি করে দিয়েছেন।
এখানে শেষ হল লেখকের কাশ্মীর ভ্রমণ।
এই সুন্দর পর্বটি পড়ে আবার যেন কাশ্মীর দর্শন করলাম। শিউলি
উত্তরমুছুনধন্যবাদ! এবার নতুন পেজ দেখবেন 😃
উত্তরমুছুনKashmir er byapare onek notun tothyo pelam lekha ti pore. Khub valo laglo. Onek dhonyobad.
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুন