পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

৭৬। ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত ১ - রসিককৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

         
          (আগের পর্বের পরে)

"ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত" বইটি ১২৯৪ বঙ্গাব্দে (১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে) প্রকাশিত হয়। বইটির শিরোনামে লেখা আছে - "ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত অর্থাৎ বাঙ্গালা, বেহার, উড়িষ্যা, আসাম প্রভৃতি প্রত্যেক জেলার সংক্ষেপ বিবরণ। রসিক কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সংগৃহীত, রচিত ও প্রকাশিত।" বইটির ভ্রমণকাল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ।

লেখক রসিককৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। উৎসর্গ পর্বে "উপহার" শিরোনামে তিনি শ্রীযুক্ত বনমালী রায়চৌধুরী তড়াসদি অধিপতি বাহাদুর সজ্জন প্রতিপালকেষু-কে "পরম কল্যাণীয়" সম্বোধনে লিখেছেন "বনমালী রায়চৌধুরী নবাবী আমলের পুরাতন জমিদার ও লেখকের কল্যাণকারী"। এই যাত্রাকালে তিনি বিভিন্ন জমিদার, রাজা ও রাজকর্মচারীদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। 

১২৯১ সালের হেমন্তের শুরুতে ছোটনাগপুর ও উৎকল ভ্রমণের উদ্দেশ্যে লেখক পথে বেরোলেন। লেখকের সঙ্গে কিছু সঙ্গী ছিল তা লেখা পড়ে বোঝা যায় কিন্তু লেখক কখনও তাদের নাম বা পরিচয় উল্লেখ করেন নি। কলকাতা থেকে বজবজ হয়ে হুগলি জেলার উলুবেড়িয়ার মহিষরেখায় আসেন। (তখন হাওড়ার নয়, হুগলি জেলার অন্তর্গত ছিল এই দুটি স্থান)। আলিপুর থেকে দশ মাইল বজবজ রোড এসে, বজবজ থেকে ৬ মাইল উলুবেড়িয়া রোড এবং উলুবেড়িয়া থেকে ক্রমাগত দক্ষিণ মুখে উড়িষ্যার কটক রোডে যাওয়া যায়। এই কটক রোড মেদিনীপুর ভেদ করে বালেশ্বর, কটক প্রভৃতি অতিক্রম করে পুরী পর্যন্ত গেছে। রূপনারায়ণের উত্তর পাড় হুগলি জেলার আর দক্ষিণ পাড় মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত। যে স্থানে রূপনারায়ণ পার হলেন, সেটিকে কোলার ঘাট (কোলাঘাট) বলে। কটক রোড ধরে তিনি হুগলি জেলা ছেড়ে নদী পার হয়ে মেদিনীপুর জেলায় এলেন। কোলার ঘাটে নদীর ওপর একটি চটি, আউটপোস্ট ও পোস্টঅফিস আছে। সেখান থেকে ১৬ মাইল পথ পেরিয়ে আসে কংসাবতী নদী। এই স্থানের নাম পাঁশকুড়া। এখানে বড় বাজার, পুলিশ স্টেশন, ক্যানাল জলকর আদায় অফিস, ইংরাজদের রেশম কুঠি আছে। এখানকার বাজারে দুধ, মাছ, সবজি খুব সস্তা। আরও ২৪ মাইল গেলে মেদিনীপুর, আবার কংসাবতী নদী পার হয়ে। এরপর আরও ১৮ মাইল পরে পাথরা নামক গ্রামে অনেকগুলি বাড়িঘর দেখা গেল। মেদিনীপুর জেলায় বিচারালয়, হাইস্কুল, মেদিনীপুর সংবাদপত্র ও প্রেস, মিশনারীদের প্রেস আছে। 

মেদিনীপুর থেকে কটক রোড যেমন পুরী গেছে, তেমন এই পথেরই শাখা সম্বলপুর ও মাদ্রাজ অবধি বিস্তৃত হয়েছে। এই রাস্তা জেলার সীমা পর্যন্ত গিয়ে সিংভূমের রাজপথের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আর রয়েছে উত্তর-পশ্চিমে রানীগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা, উত্তরে গড়বেতা, বগড়ী, রানীগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা। উত্তরে গড়বেতা হয়ে বাঁকুড়ার রাজপথে মিলিত হয়েছে আরেকটি রাস্তা। পাঁশকুড়ার পূর্ব দক্ষিণাংশে ১২ মাইল একটি শাখা গিয়ে তমলুকে পৌঁছেছে। আবার তমলুক থেকে আরেকটি শাখা ৩০ মাইল দক্ষিণে গিয়ে হিজলি কাঁথি উপবিভাগে পৌঁছেছে। সেই রাস্তাটি কাঁচা। পথে তেরপেকে ও কালিনগরের নদী নামের দুটি ছোট নদী পার হতে হয়। আবার মেদিনীপুর থেকে কটক রোডে কুড়ি মাইল গিয়ে বেলদা থেকে পূর্ব দক্ষিণে ২০ মাইল গেলে কাঁথি যাওয়া যায়। উত্তরে গড়বেতা ভেদ করে যে রাস্তা গেছে তাতে ১২ মাইল গেলে কেশপুর নামক স্থান আসে। সেখান থেকে পূর্বে যে শাখা বেরিয়েছে তাতে ৩২ মাইল গেলে ঘাটাল মহকুমা আসে। এই রাস্তা পুরনো কিন্তু বন্যার ভয়ে মজবুত করে তৈরি নয়। তারপর দক্ষিণে ২১ মাইল গেলে মেদিনীপুর জেলা শেষ হয়। সুবর্ণরেখা নদী মেদিনীপুর ও উড়িষ্যাকে পৃথক করেছে। এখানে সুবর্ণরেখার পারঘাটকে রাজঘাট বলে। বর্ষায় এই নদী ভয়াবহ রূপ নেয় তাই বাংলায় প্রবাদ আছে 'যদি গেলে সুবর্ণরেখা/ ঘুচল মা বাপের দেখা'। 


একটি ক্যানাল মেদিনীপুর পর্যন্ত কটক রোডের পাশে পাশে গেছে। এই জলপথে ছোট ছোট স্টিমার ও নৌকায় মানুষ ও পণ্যের আদান-প্রদান হয়। পথে দুই তিনটি নদী থাকা সত্ত্বেও এই খাল পথ উন্নত কৌশলে তৈরি হয়েছে বলে যাতায়াতে বাধা হয় না। নদীতে লকগেট তৈরি করে জল আটকানো ও জল ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করে এই মেদিনীপুর ক্যানালে নৌ চলাচল হয়। 

এরপর লেখক মেদিনীপুর জেলার প্রাকৃতিক অবস্থা, উৎপন্ন দ্রব্য, জাতিভিত্তিক জনগণ প্রভৃতি বিষয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন। মেদিনীপুর জেলায় অনেক প্রসিদ্ধ জমিদার আছেন, তাঁরা সকলে রাজা উপাধিধারী ও তাঁদের আবাসস্থলকে গড় বলা হয়। যেমন ময়না গড়, গড় পদুবাসান, মহিষাদলের গড়, নারায়নগড়, রামগড়, লালগড়। ময়নার গড়টি সুদৃশ্য পরিখা দ্বারা ঘেরা, স্থলভাগে বন আছে, তাতে ময়ূর হরিণ প্রভৃতি বিদ্যমান। তারপর একটি প্রশস্ত খাল পেরিয়ে রাজবাড়িতে যাওয়া যায়। নৌকায় চড়ে ছাড়া রাজবাড়ীতে যাওয়া যায় না। তমলুকের পূর্ব নাম তাম্রলিপ্ত ছিল। এই বন্দর দিয়ে পূর্বে বঙ্গদেশীয়রা সমুদ্র যাত্রা করত। এখন তমলুকের সেই সমৃদ্ধি নেই। তবে এখানে বর্গভীমা নামক মহাপীঠ ও শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মন্দির আছে। কাঁথির রাজার বাসস্থান নাজনা গড়। কাঁথির ৬ মাইল দূরত্বে গড় বাসুদেবপুর অবস্থিত। গোপগড়ে মহাভারত খ্যাত বিরাট রাজার গোশালা ছিল বলে প্রবাদ আছে। এখানে একটি স্বল্প উচ্চতার ধিপির ওপর একটি অট্টালিকা আছে। কিন্তু সেটি তত প্রাচীন নয়। বরং কাঁথির ৩ মাইল উত্তরে কাঁথির রাজাদের এলাকায় কয়েকটি প্রাচীন শিব মন্দির আছে, যেগুলি অতি প্রাচীন বলে মনে হয়। এরপর লেখক মেদিনীপুর জেলার শিক্ষার উন্নত অবস্থা ও বহুলাংশে মামলা করার প্রবণতা নিয়ে লিখেছেন। লেখক দেখেছেন যদিও মেদিনীপুর তখন বাংলার অন্তর্গত কিন্তু সেখানে উড়িষ্যার আমলের সন প্রচলিত। যেমন ভাদ্র মাসের শুক্ল দ্বাদশীর দিন থেকে সালের গণনা শুরু হয়। 

এরপর লেখক মেদিনীপুরের পশ্চিমে সিংভূম যাওয়ার রাস্তায় চললেন কংসাবতী পার হয়ে। শেষে একটি ক্ষুদ্র নদী (পলপলা?) পায়ে হেঁটে পার হয়ে সিংভূমের মধ্যে প্রবেশ করলেন। এখানে পাকা রাস্তা নেই। এক ফুট গভীর ধুলোর মধ্যে দিয়ে পথ চলা। ধুলোর জন্য হাঁটতে না পেরে শেষে গরুর গাড়িতে চললেন তাঁরা। ১২ মাইল যাওয়ার পর একটি হাট দেখলেন। সেই গ্রামে একটি গৃহস্থ বাড়িতে আশ্রয় নিলেন, এছাড়া থাকার জন্য সেখানে কোন চটি নেই। পরদিন গরুর গাড়িতে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকলেন। মাঝে মাঝে জঙ্গলের মধ্যে এক একটা বসতি। সেখানে আশ্রয় পাওয়ার আশা নেই। সারাদিনে ১২ মাইল অতিক্রম করে নৃসিংহ গড় নামক স্থানে পৌঁছালেন। এখানে একসময় ধলভূমের রাজার শাসন ছিল। সেখানে একটি দোকানে লেখক রাত কাটিয়ে পরদিন আবার রওনা হলেন ও ৬ মাইল অতিক্রম করে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এলেন। এই নদীর বালুতে অতি অল্প পরিমাণে স্বর্ণ রেণু থাকে। সেজন্য এর পাড়ের অধিবাসীরা বালি থেকে স্বর্ণরেণু বেছে বের করে। কিন্তু সেই স্বর্ণের পরিমাণ এত কম যে বহু পরিশ্রমে কোন শ্রমিক চার-পাঁচ আনার বেশি দৈনিক উপার্জন করতে পারেনা। কোথা থেকে এই সোনা আসে সেই অনুসন্ধান এখনো করা যায়নি। সুবর্ণরেখার কূল অত্যন্ত মনোরম প্রকৃতির শোভাময়। কোথাও বিশাল শালবন, কোথাও নানা রকম বৃক্ষলতায় পথিকের আশ্রয়স্থল রচনা করেছে। কোথাও আবার বিস্তীর্ণ গিরি মালা। এখানে সুবর্ণরেখার পারঘাটের বাঁপাশে ধলেশ্বরী দেবীর (যাঁর অপর নাম রঙ্কিনী দেবী) মন্দির। ধলভূমের রাজার প্রতিষ্ঠিত দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয় শারদীয় মহাষ্টমীর দিন। তীরবিদ্ধ করে মহিষ বধ করে বলি দেওয়া হয়। নিকটে রাজবাড়ি। লেখক রাজার সঙ্গে দেখা করলেন ও কয়েকদিন তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করলেন। 


ধলভূম থেকে ৪২ মাইল জঙ্গলময় পথ অতিক্রম করলে সিংভূম জেলায় পৌঁছানো যায়। সেখান থেকে শতাধিক মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে রাঁচি। রাঁচি যাওয়ার আরেকটি পথ আছে। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের কর্ড লাইনে সীতারামপুর স্টেশনে গিয়ে সেখান থেকে বরাকর পর্যন্ত শাখা লাইনে বরাকরে নেমে প্রথমে মানভূম বা পুরুলিয়া জেলা পৌঁছে সেখান থেকে সিংভূম হয়ে রাঁচি যাওয়া যায়। রাঁচি বিভাগটি পর্বত ও জঙ্গলময়। পূর্বে এই বিভাগ উৎকল সম্রাটের শাসনাধীন ছিল। ব্রিটিশের অধীন হয়ে এখন পর্যন্ত বেবন্দোবস্ত অবস্থায় আছে। 

অন্যদিকে রাজঘাটে সুবর্ণরেখা পার হয়ে ৩২ মাইল অতিক্রম করলে বালেশ্বর জেলা আসে। বুড় ভলং (বুড়ী বালাম) নামক নদীর ধারে বালেশ্বর বন্দর ও জেলা অবস্থিত। বর্ষায় এই নদীতে প্রবল স্রোত কিন্তু গ্রীষ্মে পায়ে হেটে পার হওয়া যায়। মেদিনীপুর থেকে বালেশ্বর আসার কটক রোডই প্রধান রাস্তা। তাছাড়া মেদিনীপুর থেকে ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের মধ্যে দিয়ে বালেশ্বর যাওয়ার একটি পথ আছে। সেটি মেদিনীপুরের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে মহাপাল পর্যন্ত ২২ মাইল গিয়ে সেখানে সুবর্ণরেখা নদী পায়ে হেঁটে পার হয়ে ৬ মাইল গিয়ে গোপীবল্লভপুর নামক স্থানে (এটি মেদিনীপুরের শেষ সীমা) আসা যায়। এখানে পুলিশ থানা, পোস্ট অফিস আছে। এক সঙ্গতিপূর্ণ বৈষ্ণব বাড়িতে গোপীনাথ নামে কৃষ্ণের পাথরের মূর্তি স্থাপনা হয়েছে। তাঁদের বংশ গোঁসাই উপাধিধারী। গোপীবল্লভপুর থেকে ২৪ দক্ষিণ পশ্চিম অভিমুখে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে লেখক ময়ূরভঞ্জের রাজধানী বারী পোদা (বারিপদা) পৌঁছলেন।

                        (চলছে)

২টি মন্তব্য:

  1. সুবর্ণরেখা নদীর বালিতে স্বর্নরেণু পাওয়ার কাহিনী বেশ অবাক করা ।লেখিকা অতি সুন্দর বর্ননায় বিস্তৃত করেছেন ভ্রমণ বৃত্তান্ত টি🙏

    উত্তরমুছুন
  2. আপনার মত পাঠকের জন্যই তো এই ব্লগ! 🙏

    উত্তরমুছুন