পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

৭৮। ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত ৩ - রসিককৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

           
               (আগের পর্বের পরে)

পুরীতে অবস্থিত অজস্র মন্দিরের বর্ণনা দিতে হলে আরেকটি পৃথক বই লেখা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন লেখক। বিশেষ কিছু মন্দিরের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। পুরী মহর্ষি মার্কন্ডেয়ের অবস্থানস্থল ছিল। এখন সেখানে মার্কেন্ডেশ্বর নামে শিব ও মার্কন্ড পুষ্করিণী নামক সরোবর আছে। পুরীতে সাতশো মঠ আছে। দেবসেবা ও ভোগদানের যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সম্পন্ন ব্যক্তিরা এই মঠগুলি নির্মাণ করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। মঠাধ্যক্ষদের বিলাসিতায় সেই অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে বলে লেখক জানিয়েছেন। পুরীর পশ্চিমাংশে লোকনাথ নামে এক স্বয়ংভূ শিবের মন্দির আছে। এই মহাদেব মন্দিরের মধ্যে গহ্বরে অবস্থিত। এই গহ্বর প্রায়ই জলে পূর্ণ থাকে, কেবল শিবরাত্রির সময় পান্ডারা অনেক চেষ্টায় জল নিকাশ করে মূর্তি বার করে। পুরীর বাসিন্দারা এই শিবের ওপর অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। পুরীর মন্দিরের প্রাঙ্গণের মধ্যে বিমলা দেবীর মন্দির অবস্থিত। যদিও জগন্নাথ মন্দিরে বৈষ্ণব মতে নিরামিষ ভোগ হয়, তিথিবিশেষে বিমলা মাতার মন্দিরে আমিষ ভোগও হয়ে থাকে। আবার জগন্নাথকে বিমলার ভৈরব বলে উল্লেখ করাও হয়ে থাকে। বিমলাদেবী ও জগন্নাথদেবের সামঞ্জস্য স্থাপন অতীব দুরুহ ব্যাপার। হরচন্ডী সহিতে অর্থাৎ পল্লীতে হরচন্ডী নামে এক দেবী আছেন। তাঁর পূজা ও বলিদান খুব ধুমধাম করে হয়। পুরীর সমুদ্রতীরে যেখানে যাত্রীগণকে স্নান করান হয় সেটিকে স্বর্গদ্বার বলে। এর অদূরে অনেকগুলি মঠ আছে, তার মধ্যে কবীর নানকের মঠ আছে। কিছু পশ্চিমাংশে শ্রীচৈতন্যের সমাধিস্থান (সেটি কি সত্যিই তখন ছিল উক্ত স্থানে?)। সমুদ্রকুল বালুকাময় কিন্তু এই বালিতেই মঠধারীরা নানা বৃক্ষ লাগিয়েছেন। সমুদ্রতীরে নানক, কবীর, দত্তাত্রেয়, শঙ্করাচার্য, তুলসীদাস, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ সকলেই শেষকাল যাপন করেছেন (কিন্তু বাস্তবে একমাত্র শ্রীচৈতন্যদেবেরই পুরীতে ভবলীলা শেষ হয়েছিল। অন্যান্যরা পুরীতে কিছুকাল কাটিয়েছেন বলে জানা যায়)। মহর্ষি দত্তাত্রেয়র আসন পুরীর স্বর্গদ্বারের বাম দিকে। শংকর স্বামীর (শঙ্করাচার্যের) মঠ সমুদ্র তীরে। এই মঠে অনেক প্রাচীন পুস্তক সংরক্ষিত আছে। এখানকার অধ্যক্ষ দামোদর তীর্থ স্বামী গভীর শাস্ত্রজ্ঞ। অন্যদিকে পুরীর পান্ডারা ধনী কিন্তু অশিক্ষিত। পুরী শহরটি আয়তনে দীর্ঘ। সাতটি সাই বা পল্লীতে বিভক্ত। বিভিন্ন পল্লীগুলিতে একটি বা দুটি বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয়। দশমীতে পুরীর সিংহ দরজার সামনে সারা শহরের প্রতিমা একত্র করে প্রদর্শন করা হয়, একে ভেট বলে। 


পুরীতে গ্রীষ্মের শেষ থেকে হেমন্তের প্রথম পর্যন্ত কাটিয়ে পুরী ত্যাগ করে বঙ্গোপসাগরের তীর ধরে দক্ষিণ দিকে রওনা দিলেন লেখক। দশ মাইল অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে হরচন্ডী দেবীর মন্দির দর্শন করলেন। প্রবাদ রামচন্দ্র বনবাস কালে এই মূর্তি স্থাপন করে পূজা করেন। এরপর দুই মাইল গিয়ে কাঁটাকুরিতে রাত্রিবাস। এখান থেকে চিল্কা হ্রদ শুরু। স্থানটিতে অতি সামান্য তিনটি মুদীর দোকান আছে মাত্র। চিল্কায় যাত্রীদের যাতায়াতের নৌকা এখান থেকে পাওয়া যায়। লেখক পরদিন নৌকায় চিল্কাযাত্রা করলেন। চিল্কার জল লবণাক্ত। লেখক পিপাসার্ত হয়ে নাবিকের কাছে জল চাইতে পাড়ে এক জায়গায় দুই ফুট গর্ত হাত দিয়ে খুঁড়ে লেখককে খেতে বলল এক যাত্রী। সেই জল মিষ্টি। নৌকা থেকে ডান পাড়ে জল দেখা যায় আর বাঁ দিকে বালুস্তর। জেলেরা জাল দিয়ে মাছ ধরছে, কোথাও তীরে মাছ শুকাচ্ছে রোদে দিয়ে। এক চড়ে এলেন তাঁরা। এই চড়টি দৈর্ঘ্যে প্রায় তিন মাইল। এটি পারিকুদ রাজ্যের রাজধানী। চড়ের মধ্যে রাজার বাড়ি, চারপাশে প্রজাদের বাস ও কৃষি জমি। রাজবাড়িতে দুদিন থেকে রাজার সঙ্গে আলাপে লেখক সুখী হলেন। তারপর চিল্কায় নৌকায় আবার চললেন উৎকল ও মাদ্রাজ বিভাগের সঙ্গমস্থলে। (তখন অন্ধ্রপ্রদেশ ছিল না। মাদ্রাজ হল বর্তমান তামিলনাড়ু)। চিল্কার বুক থেকেই তীরে পাহাড়ের শ্রেণী দেখা যায়। কূলে উঠলে মাদ্রাজ যাওয়ার গিরি সংকুল পথ দেখা যায়। এই গিরি সংকটের মধ্যে খালিকোট (খাল্লিকোট) নামক রাজ্যের রাজধানী। রাজবাড়িটি তিন দিন পর্বতের মধ্যে যেন আত্মরক্ষার্থে লুকিয়ে আছে। এই রাজ্যে শাসনব্যবস্থা ভালো নয়, রাজা অত্যাচারী। 


এরপর লেখক উৎকলের জঙ্গলমহল বা করদ রাজ্য ভ্রমণে গেলেন। পূর্বের গিরি সংকট থেকে যে রাজপথ উৎকলের জঙ্গলমহলের দিকে গেছে সেই পথে পূর্ব দিকে দশ মাইল গিয়ে বানপুর নামক স্থানে এলেন। এটি আগে রাজধানী ছিল, এখন শুধু পুরনো মন্দির দু-একটি আছে। সেখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে জঙ্গলের পথে ৬ মাইল গিয়ে একটি আউটপোস্ট পেলেন, যেটি নয়াগড়, খালিকোট ও খাস মহল এই তিন রাজ্যের সীমানা। এই পথে সন্ধ্যার পর কেউ চলাচল করে না, বাঘ ভাল্লুক এই পথে বিচরণ করে।। লেখক ওই আউটপোস্টে রাতে থাকলেন। হেড কনস্টেবল সতর্ক করলেন রাতে বাইরে যাওয়ার দরকার হলে কনস্টেবল ও পাইককে ডাকতে। তারা দুজন আগুন জ্বালান কাঠ সমেত সঙ্গে না গেলে বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়। পরদিন সকালে জঙ্গলের এক অধিবাসীর সঙ্গে জঙ্গলে প্রায় আট মাইল উত্তর-পশ্চিম দিকে গিয়ে রাতে একটি গ্রামে থেকে পরদিন দুই ক্রোশ যাওয়ার পর প্রায় দুই মাইল একটি পাহাড় পাড় হতে হল। সেই পাহাড় থেকে নামার পথ পিচ্ছিল ও বিপদজনক। তারপর পাঁচ মাইল পথ গিয়ে একটি গ্রামের ভগবত পাঠের ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করা হল। পরদিন যাত্রা করে দুপুরে নয়াগড়ের রাজধানীতে এলেন তাঁরা। সেখানকার তরুণ রাজার সঙ্গে আলাপ হল। রাজধানীর দুই পাশে দুই পর্বত। নয়াগড় থেকে এরপর লেখক গেলেন দশ মাইল দূরে খন্ডপাড়া।  এখানে একটি ক্ষুদ্র পর্বতের ওপর কন্টিলোতে নীলমাধবের মূর্তি রয়েছে। স্থানটি খুব মনোরম। মাঘী পূর্ণিমার দিন নীলমাধবের মন্দিরে একটি মেলা দেখলেন। প্রায় দশ হাজার যাত্রী সমাগমে মেলা বসে। মহানদীর অপর পাড়ে নৃসিংহপুর ও দশপালা রাজ্য। কন্টিলো থেকে লেখক দশপালা, রামচন্দ্রপুর, বোমরাজ্য, কন্দমাল প্রভৃতি রাজ্য দর্শন করলেন। কন্দমালে কন্দ বা খন্দ জাতির বাস। তারা কিছুদিন আগেও নরবলি দিত, ব্রিটিশ সেটি বন্ধ করেছে। এরপর হিন্দোল ও অঙ্গুল (আঙ্গুল) নামক রাজ্য ঘুরে এলেন। অঙ্গুলের কমলালেবু অত্যন্ত মিষ্টি। এই কমলালেবু কেউ চাষ করে না, বন্য প্রকৃতিতে এমনি জন্মায়, বন্য আদিবাসীরা এই ফল সংগ্রহ করে খায় ও বিক্রি করে। এরপর তাঁরা মহানদীতে নৌকা করে কন্টিলো থেকে কটকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন চার দিনের পথে। কটক থেকে স্টিমারে ভদ্রকে ও তারপর বালেশ্বর পৌঁছলেন। বালেশ্বর থেকে আবার তাঁরা ময়ূরভঞ্জে ফিরে যান প্রায় এক বছর পরে। 

লেখক এবার দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের অঙ্গীকার করে এই বইটি শেষ করেন কিন্তু আমরা জানতে পারি না সেইসব ভ্রমণ কাহিনী সত্যি লেখা হয়েছিল কিনা, প্রকাশিত হয়েছিল কিনা কারণ বইগুলো কোথাও পাওয়া যায়নি। অতএব যদিও লেখক বইয়ের সূচনায় বলেছিলেন যে এটি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামের বিভিন্ন জেলার বর্ণনা থাকবে কিন্তু শুধুমাত্র তৎকালীন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বর্ণনাতেই এই গ্রন্থটি শেষ হয়

২টি মন্তব্য: