পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৫

৭৯। আ ভিজিট টু ইউরোপ ১ - ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

 
"আ ভিজিট টু ইউরোপ"  ত্রৈলোক্যনাথ মুখার্জির (১৮৪৭-১৯১৯) ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এই বাঙালি সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কৌতুক রসের স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত। তাঁর লেখা বই "কঙ্কাবতী", "ভূত ও মানুষ", "ফোকলা দিগম্বর", "ডমরুচরিত" উল্লেখযোগ্য। তিনি শিক্ষকতা, পুলিশের চাকরি, বেঙ্গল গেজেটিয়ারে কেরানীর চাকরী, রাজস্ব বিভাগে চাকরী করেছেন। ১৮৮৬ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা তিনি এই বইটিতে লেখেন। ফিরে এসে তিনি কলকাতা মিউজিয়ামের সহকারী কিউরেটর হন। 

"আ ভিজিট টু ইউরোপ"-র প্রথম প্রকাশ ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে। বই হিসেবে প্রকাশের আগে "ইন্ডিয়ান নেশান" পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে তাঁর লেখা ধারাবাহিকভাবে দেড় বছর ধরে প্রকাশিত হয়েছিল। 

১৮৮৬ এর ১২ ই মার্চ "নেপাল" নামক জাহাজে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন লেখক। জাহাজ ছাড়ার পর ডেকে উপস্থিত থেকে সবাই দেখতে লাগল ভারত মহাসাগরের জল কেমন করে ধীরে ধীরে সবুজ রং হারিয়ে নীলে রূপান্তরিত হয়েছে। সূর্যের আলো মুছে গেল, দূরে লাইট হাউসের আলো আর দেখা গেল না। গাঢ় অন্ধকারে সমুদ্রের ফসফরাসের সাদা ফেনা ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। ক্রমে অপরিচিত ভারতীয়রা পরস্পরের মধ্যে আস্তে আস্তে পরিচিত হতে লাগল। যাত্রীবাহী জাহাজকে একটা প্রকাণ্ড ধনী গৃহের সঙ্গে তুলনা করেছেন লেখক। ডেকে যাত্রীরা ভ্রমণ, ব্যায়াম, দাবা খেলা প্রভৃতি করতে পারে। ধূমপান করার পৃথক ঘর আছে। সমুদ্রের দৃশ্য, উড়ন্ত মাছ প্রভৃতি দৃশ্য যখন একঘেয়ে হয়ে যায় তখন মানুষ এইভাবে সময় কাটায়। কখনো ডেকে পিয়ানো বাজিয়ে গান করা হয়। নীচে দুটি দীর্ঘ সারিতে কেবিন, প্রতি কেবিনে ২,৩ বা ৪ জন শোয়ার ব্যবস্থা আছে। ডাইনিং আছে খাওয়ায় জন্য আর সেলুন আছে অন্যান্য সময় বসা, লেখাপড়া করার জন্য। খাওয়ার সময় নির্দিষ্ট। আহার পুষ্টিকর। নিরামিষ, আমিষ দুই আছে। ইচ্ছা করলেই হিন্দু জাত বাঁচিয়ে আলাদা রান্না করে খেতে পারে। উনুন ও পাত্রের ব্যবস্থা জাহাজের কর্মীরা করে দেয়।
জাহাজে লাইব্রেরী থাকে। কখনো কখনো লেডিস রুমও থাকে। 

বোম্বাই ছাড়া ৬ দিন পর এডেন বন্দরের রুক্ষ পাহাড় দৃশ্যমান হল। কৃষ্ণকায় বালকরা সাঁতার কেটে পয়সা ভিক্ষা করতে এল। বণিকরা উট পাখির পালক আর ডিম বিক্রি করতে এল। এডেন শহরে নেমে লেখক দেখলেন এখানে ছোট কাটা গাছ ছাড়া কোন গাছই নেই। দুই মাইল দূরে অবস্থিত আরবের শহরে ছোটখাটো বাগান আছে কিন্তু সেখানেও বড় গাছ একটিও নেই। এখানে বৃষ্টি হয় বছরে মাত্র তিন চার ইঞ্চি। বহু পূর্বকাল থেকেই জল ধরে রাখার জন্য এখানে বাঁধ নির্মিত হয়েছে। আড়াই হাজার বছর পূর্বে মারেব বাঁধ সহ আরো পঞ্চাশটি জলাধার আছে, যার মধ্যে ১৩ টি তখন ব্যবহারযোগ্য ছিল। এই জলাধারগুলি থেকে জল লোকেদের কাছে প্রতি ১০০ গ্যালন এক টাকা হিসেবে বিক্রি করা হয়। ব্রিটিশ এখানে আসার পর বাণিজ্য, শান্তি ও সমৃদ্ধি বেড়েছে। এখানে অনেক কফি হাউস আছে, সেখানে আরব ও সোমালীয়রা দিন রাত কফি পান করছে। কফি এদেরই আবিষ্কার। ইয়েমেনের পাহাড়ে কফির জন্ম। পবিত্র কোরানে সুরা পান নিষিদ্ধ  হওয়ায় আরবরা কফিকে উত্তেজক পানীয় হিসেবে গ্রহণ করেছে। 


ভারতের রামায়ণের কাহিনী এডেন এক আশ্চর্য রূপে প্রচলিত। মোজাহির নামে এক ঐতিহাসিক লিখেছেন দশশির নামে দানবরাজ (রাবণ) যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দন্ড দিয়ে অপরাধীদের এডেনে পাঠাতেন। এখানে পাহাড়ের মধ্যে একটি কূপ আছে, তার ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষের সঙ্গে যোগাযোগের সুড়ঙ্গ আছে। দশশির দানব অযোধ্যা থেকে রাম হায়দারের স্ত্রীকে খাট সমেত চুরি করে আকাশপথে চলার সময় জেবেলসিয়া পাহাড়ের মাথায় বিশ্রাম করার জন্য বসেছিল। তখন সে রাম হায়দারের স্ত্রীকে বলে যে তাঁকে জিনে পরিণত করবে। এই নিয়ে তাঁদের বচসা হয় এবং এই সময় বানর-বেশী হনবীত নামক এক এফরীত তা শুনে এক রাতের মধ্যে উজ্জাইন বিক্রম নামক নগর থেকে সমুদ্রের নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করে জেবেলসিয়া পাহাড়ের মাথায় এসে দেখল একটা কাঁটা গাছের নীচে রাম হায়দারের স্ত্রী ঘুমাচ্ছেন। সে তাঁকে পিঠে তুলে সুড়ঙ্গ দিয়ে উজ্জায়িন বিক্রমে এসে রাম হায়দারের কাছে তাঁকে সমর্পণ করল। পরে রাম হায়দারের দুটি সন্তান হল লথ ও কুশ। লেখক বলেন প্রাচীনকালে ভারতবাসী ও আরবদের মধ্যে বাণিজ্যিক সংযোগ ছিল। ক্রমে রামায়ণ ও বিক্রমাদিত্যের গল্প মিলেমিশে একাকার হয়ে ভিন্ন রূপ নিয়েছে। তবে সেই সুড়ঙ্গ নাকি আজও বিদ্যমান আছে। 


এডেন ত্যাগ করে লেখক বাবেল মান্দেব প্রণালী ও লোহিত সাগরে সেভেন আপোসলস নামক সাতটি দ্বীপ পেরোলেন। অনেক শুশুকের (ডলফিন) আনন্দের খেলা প্রত্যক্ষ করলেন। অবশেষে তাঁরা সুয়েজ বন্দরে এলেন। ভারতীয় ডাক জাহাজ থেকে নেমে রেলে আলেকজান্দ্রিয়া চলে গেল। লেখকের জাহাজ সুয়েজ খালে প্রবেশ করল। এই খাল এশিয়া আর আফ্রিকাকে যুক্ত করেছে, লোহিত সাগর আর ভূমধ্যসাগরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আগে জাহাজকে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে যেতে হত, সুয়েজ খাল হওয়ায় কলকাতা ও লন্ডনের দূরত্ব সাড়ে তিন হাজার মাইল কমে গেছে। সুয়েজ খাল পেরোতে তাঁদের দুই দিন লাগল। পোর্ট সৈয়দ হয়ে তাঁরা ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করলেন। এরপর জাহাজ বৃটিশ অধিকারভুক্ত মাল্টা দ্বীপপুঞ্জের প্রধান শহর ভালেট্টা বন্দরে প্রবেশ করল। এখান থেকে সিসিলি দ্বীপের এটনার চূড়া দূর থেকে দেখা যায়। মাল্টা পাথরের দ্বীপ, এখানে চাষের যেটুকু জমি আছে তার মাটি নাকি সিসিলি দ্বীপ থেকে আনতে হয়েছে। এখানকার কমলালেবু খুব বিখ্যাত। 


এবার জাহাজ আফ্রিকার উপকূল হয়ে চলল একজন নিয়মিত যাত্রী তাঁকে ট্রিপোলি, টিউনিস, মরক্কো উপকূলের বিশেষ বিশেষ স্থান চিনিয়ে দিল। এরপর তাঁদের জাহাজ স্পেনের উপকূল বরাবর চলতে থাকল। স্পেনের পর্বত শ্রেণীর চূড়া দেখা গেল। এবার তাঁরা এলেন জিব্রাল্টার প্রণালী। এই প্রণালী ভূমধ্যসাগর আটলান্টিক সাগরকে সংযুক্ত করেছে। এই প্রণালীর দুপাশে দুটো পাহাড় যাদের প্রাচীনকালে পিলার্স সব হারকিউলিস বলা হত। রোমে জিব্রাল্টার প্রণালী পেরিয়ে আটলান্টিকে প্রবেশ করল। "নেপাল" জাহাজে আবহাওয়া ভালো থাকলেও পশ্চিম দিক থেকে বড় বড় ঢেউ এসে লাগাতে জাহাজ এক দিকে কাত হয়ে যাচ্ছিল, ডেকে হাঁটা অসম্ভব হয়েছিল, বিছানায় শুয়েও পড়ে যাওয়ার ভয় হচ্ছিল। পরে লেখক দেখলেন একটা তিমি  নাক দিয়ে ফোয়ারা ওড়াচ্ছিল। কয়েকটি হাঙর জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে অনেক দূর চলল। জাহাজ ইংল্যান্ডের দক্ষিণের প্লিমাথ বন্দরে পৌঁছাল। লন্ডন আর ২৪ ঘন্টার পথ। অবশেষে লেখক লন্ডনের নিকটস্থ আলবার্ট ডকে এসে পৌঁছলেন। আশৈশব লালিত স্বপ্নের ইংল্যান্ডে এসে লেখক ভাবাবেগে পূর্ণ হলেন। 

রেলে লন্ডন অভিমুখে রওনা হয়ে লিভারপুল স্ট্রীট স্টেশনে আসতে আধঘণ্টা লাগল। ব্লুমসবেরিতে "মিউজিয়াম" হোটেলে ঘোড়ার গাড়িতে যেতে যেতে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে পথ, বাড়ি, দোকান দেখে লেখক মুগ্ধ হলেন এবং ভারতীয়দের পরিছন্নতা বোধের অভাবের কথা ভেবে আফসোস করলেন। পরদিন থেকে তিনি প্রদর্শনীর কাজে যেতে থাকেন। ফাঁকে ফাঁকে ওয়েস্ট-মিনিস্টার ব্রিজ, হোয়াইট হল প্যালেস, অক্সফোর্ড স্ট্রীট দেখলেন। প্রিন্স অফ ওয়ালেস একদিন প্রদর্শনী দেখতে এলেন। লেখক তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেলেন। 


লন্ডনের অন্যতম বিস্ময় ভূগর্ভস্থ রেলওয়ে দেখলেন লেখক। এই রেলওয়ে ইনার সার্কেল ও আউটার সার্কেলে বিভক্ত। প্রথমটি ঘন বসতিপূর্ণ মধ্য লন্ডনে খিলান করা ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে যায়। স্টেশনগুলো বাইরে অবস্থিত। দুটি সার্কেলে ৪৮ টি স্টেশন, প্রতি তিন মিনিট অন্তর ট্রেন। বহু যাত্রী চলাচল করে। কর্মব্যস্ততার ছাপ স্পষ্ট কিন্তু ভারতীয় যাত্রীদের মতো চেঁচামেচি নেই। এখানে সবাই প্রকাশ্য স্থানে এমনকি বাড়িতেও চাপা স্বরে কথা বলে। স্টেশনগুলিতে, গাড়ির ভেতর, পথে ঘাটে সর্বত্র বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। সুড়ঙ্গ পথের রেলওয়ে ছাড়াও বহু সাবার্বান ও প্রাদেশিক রেলওয়ে লন্ডনের চারদিকে বর্তমান। এইসব রেলপথে স্কটল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ডোভার, ক্যালে প্রভৃতি স্থানে যাতায়াত করা যায়। শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ওমনিবাস চলাচল করে। ওমনিবাসগুলি ঘোড়ায় টানা। এছাড়া টেমস নদীতে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর স্টিম বোট পারাপার করে। রাস্তায় ঘোড়ায় টানা চার চাকার ক্যাব, দুচাকার হ্যান্ডসম চলে। পথচারীরা পথে ডান ধার দিয়ে আর যানবাহন বাঁ ধার দিয়ে নিয়ম মেনে চলে। 


৪ঠা মে, ১৮৮৬ ব্রিটিশ কলোনি সমূহের ও ভারতের প্রদর্শনীর উন্মোচন হল। যুবরাজ, রাজকুমারীরা প্রদর্শনী দেখতে এলেন। সম্রাজ্ঞীর তরফ থেকে এরপর একদিন স্পেশাল ট্রেনে লেখকদের নিয়ে প্যাডিংটন স্টেশন থেকে উইন্ডসর গিয়ে রাজকীয় বাহনে উইন্ডসর প্যালেসে নিয়ে গিয়ে ভোজ খাওয়ান হল। সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে একে একে সকলকে পরিচয় করে দেওয়া হল। উইন্ডসর ক্যাসেলের নানা চেম্বার, বিখ্যাত চিত্রগুলি ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স আলবার্ট-এর মেমোরিয়াল, চ্যাপেল, লং ওয়াক নামে তিন মাইল দীর্ঘ শ্রেষ্ঠ এভিনিউ প্রভৃতি লেখক দেখলেন। 


প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারীদের জন্য রিজ্মন্টে এক খামার দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল। ট্রেনে যেতে যেতে দু'ধারে ইংল্যান্ডের আরামদায়ক গ্রীষ্মকালীন সবুজ দৃশ্য দেখতে থাকলেন। লেখক একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে কেমব্রিজ যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অনুষ্ঠান সেনেট হাউসে হল। সেনেট হাউসটি খুব সুন্দর। রোমের জুপিটার মন্দিরের অনুকরণে তৈরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার দেখলেন। এখানে ৪ লক্ষ ৬ হাজারের ওপর গ্রন্থ আছে। কিংস কলেজ ও আরো কয়েকটি কলেজ দেখলেন। এরপর গ্রেট ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর প্রদর্শনীর সদস্যদের (লেখক সহ) নিমন্ত্রণ করে আতিথেয়তা দেখানোর জন্য যেন প্রতিযোগিতা শুরু করল। ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, বার্কেনহেড, ব্রিস্টল, বাথ, ওয়েলস্ এভাবে লেখক দেখলেন। ব্রিস্টলে রামমোহন রায়ের সমাধির সামনে নতজানু হয়ে লেখক শ্রদ্ধা জানালেন। বাথে উষ্ণপ্রস্রবণগুলিকে কেন্দ্র করে জনপ্রিয় স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে উঠেছে। স্থানগুলি এক এক করে লেখক দর্শন করলেন।    

                          (চলছে)
    

২টি মন্তব্য:

  1. অতি রোমাঞ্চকর একটি ভ্রমণ বর্ননা পড়ে অভিভূত হলাম। এডেনে প্রচলিত মোজাহির লিখিত রামায়ণের কাহিনীর সাথেও পরিচিতি ঘটলো। জাহাজে করে সমুদ্রে ভ্রমণের অভিজ্ঞতার সাথে এর সাথে বিভিন্ন শহরের নানান গল্প বেশ উন্নত।

    উত্তরমুছুন