বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৪

৩৩। তীর্থ ভ্রমণ ১৮ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

এবার গঙ্গা নদীতে জলপথে প্রয়াগ থেকে কাশী যাত্রা। সারাদিন বজরা চলে। মাঝে মাঝে চড়াইয়ে বজরা নোঙর করে রান্নাখাওয়া হয়। এভাবে চলার পর চতুর্থ দিন এলো বিন্দুবাসিনী বা বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মন্দির। দেবী সিংহবাহিনী, চতুর্ভূজা। তাছাড়া আছেন মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী মূর্তি। গঙ্গাতীর থেকে এক ক্রোশ দূরে পাহাড়ের (বিন্ধ্য পর্বত) উপর যোগমায়া দেবীর অষ্টভূজা মূর্তি সম্বলিত মন্দির। এছাড়া বটুক ভৈরব সহ অন্য নানা দেবদেবীর মন্দির। বিন্দুবাসিনী মন্দিরের চারদিকে পাণ্ডাদের বসতি, অনেক দোকানও আছে। প্রতিদিন মহাকালীর সামনে অনেক বলিদান হয়। বিন্দুবাসিনী মন্দিরের ভিতর এক কক্ষ (কাঠরা) আছে, যার মধ্যে যাত্রীদের ঢুকিয়ে পান্ডারা দরজা বন্ধ করে দেয়। ভোগ ইত্যাদি বাবদ টাকা পয়সা যতক্ষণ না আদায় হয় সেই কক্ষের দরজা তারা খোলে না। সুন্দরী কুমারীরাও পয়সার জন্য মন্দিরে চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। অনেক সন্ন্যাসী এই স্থানে তপস্যা করেন। 


দুই ক্রোশ দূরে মির্জাপুর (মৃজাপুর) একটি বড় শহর। অনেক বাঙালি এখানে ব্যবসা করে। গঙ্গার ঘাটগুলি পাথরে বাঁধানো ও সেখানে সুন্দর সুন্দর মন্দিরে শিব স্থাপিত আছে। শহরের মধ্যে ইঁট ও পাথরের তৈরি বাড়ি ও মন্দির সুগঠিত। শহরের রাস্তা পাথর দিয়ে তৈরি, নর্দমাও পাথরের। এখানে সরকারি নানা রকম কাছারি আছে। 


এবার বজরা এলো চন্ডালগড় (চুনার)। পাহাড়ের উপর কেল্লা। এই কেল্লা পূর্বে চন্দ্ররাজার ছিল, পরে রামনগরের রাজা অধিকার করেছিলেন। এখন তা কোম্পানি অধিকার করেছে। এখানে বেশ কিছু সাহেবদের বাংলো আছে। 


চন্ডালগড় থেকে তিন ক্রোশ দূরে ছোট কলকাতা, এখানে সাহেবদের বাংলো, কোম্পানির সেনা ছাউনি আছে বলে এই নাম হয়েছে। এরপর এলো রামনগর এখানে রাজার বাড়ি ও ব্যাসদেব স্থাপিত শিব এবং ব্যাসের মূর্তি আছে। তাই একে ব্যাস কাশীও বলে। 


রামনগর থেকে কাশীধামের অসির ঘাট আধ ক্রোশ আর বরণা নদীর ঘাট তিন ক্রোশ। এবার দ্বিতীয়বার লেখক কাশীতে এলেন। পঞ্চক্রোশী কাশী অর্ধচন্দ্রাকৃতি।  বিশ্বেশ্বরের মন্দির মহারাজ রঞ্জিত সিংহ সুবর্ণমণ্ডিত করে দিয়েছেন। মন্দিরের অমূল্য রত্ন ভান্ডার আছে। মন্দিরে চারটি দ্বার। পশ্চিম দ্বারের সামনে নাটমন্দির। তার মধ্যে রাজা হরিশচন্দ্রের স্থাপিত শিব। এছাড়া চতুর্দিকে পার্বতী, অন্নপূর্ণা, অবিমুক্তেশ্বর প্রভৃতি দেবদেবীর মন্দির আছে। উত্তরদিকে জ্ঞানবাপী নামে এক কূপ আছে। মুকুন্দ ব্রহ্মচারী (প্রয়াগ সংক্রান্ত পর্ব দর্শণীয়) যখন কাশীধামে আসেন, বিশ্বেশ্বররের পূজার জলের সন্ধানে মাটি নিজের হাতের মুঠির আঘাত করলে যোগবলে ভগবতী উঠে আসেন, এই সেই কূপ। 


উত্তর দিকে বিশ্বেশ্বরের পুরনো মন্দির আছে। বিশ্বেশ্বর গুপ্ত হয়েছেন সেখানে কারণ আওরঙ্গজেব বাদশাহ ওই মন্দিরের প্রতি "অত্যাচার করে" মসজিদ ও বিশ্বেশ্বরের মন্দির ভেঙে তার উপরে আপন কবরস্থান নির্মাণ করেছেন (যদিও তাঁর কবর আওরঙ্গবাদ, মহারাষ্ট্রতে)। কাউকে সেখানে তারা ঢুকতে দেয় না। কেউ কেউ (হিন্দু) বহু স্তব স্তুতি করে ও রক্ষকদের পুরস্কার দিয়ে ওই স্থানে যোগ সাধনে যেতেন বলে শোনেন লেখক। 


এরপর লেখক কাশীধামের প্রধান তীর্থস্থানগুলি বর্ণনা করেন। যেমন অন্নপূর্ণা, কেদারঘাটে কেদারেশ্বর, শ্মশানেশ্বর, তিলভাণ্ডেশ্বর, লোলার্ক তীর্থ, দুর্গাকুণ্ড। কাশীধামের যাত্রাগুলির বিষয়েও তিনি বলেন। দক্ষিণ মানস যাত্রা, পশ্চিম মানস যাত্রা, উত্তর মানস যাত্রা, এ ছাড়া পাঁচ, সাত ও নয় দিনের পঞ্চক্রোশী যাত্রাও করেন পুণ্যার্থীরা। 


উত্তর মানসের একটি তীর্থস্থল হলো লাট ভৈরব। এখানে ভৈরবের দন্ড ও ভৈরবের যাতা আছে। কাশীতে পাপকর্ম করলে ভৈরবের দন্ড ও যাতাতে ছয় হাজার বছর ধরে পেষিত হতে হয় বলে প্রচলিত আছে। এই যাতা নিয়ে হিন্দু ও মুসলমানের বিবাদ হয়। ওই স্থানে মুসলমানেরা মসজিদ করতে শুরু করলে হিন্দুরা বাধা দেয় ও মুসলমানদের পরাভূত করে। পরে রাতে মুসলমানেরা যাতার চারদিকে আগুন দেয়, কিন্তু যাতার হানি হয় না। এবার গোরক্ত দিয়ে আগুন দেওয়া হলে যাতা ভেঙ্গে যায়। সকালে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা শুরু হয়। তখন কাশীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মাধ্যক্ষ জজ রেনলিক হিন্দুদের অনুমতি দেন মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার। হাজার হাজার মুসলমান হত হয়। যারা বেঁচে গেল তাদের মুখে শূকরের রক্ত, গোবর ইত্যাদি দিয়ে, কর্ণচ্ছেদ করে, মুসলমানদের দেবালয়ে শুকর ছেদন করে, তাদের স্ত্রীগণের দুরবস্থা করে হিন্দুরা অত্যাচার চালায়। অনেক মুসলমান দেশ ত্যাগ করে। পরে সাহেবরা এসে হিন্দুদের শান্ত করে তাদের তামার যাতা তৈরি করে দেন। এখন সেই যাতাই আছে। 


কাশী শহরের বাড়িগুলি পাথরের তৈরি। বড় বড় তিন থেকে পাঁচতলা উঁচু। দুপাশে বাড়ির মাঝে দেড় হাত প্রমাণ গলিপথ। শহরে পাঁচ হাজার ফটক আর এক এক ফটকের মধ্যে পাঁচ, ছয়, সাতটি গলি আছে। গলিতে ঢুকে পথ চেনা খুব শক্ত। কাশীতে অনেক চক ও বাজার আছে। তাছাড়া প্রতি মহল্লাতে অনেক দোকান ও পানের দোকান আছে। সাটিন, মখমল, বারাণসী তিল্লার কাজে নীলাম্বরী পীতাম্বরী শাড়ি পাওয়া যায়। 


কাশীতে তীর্থদর্শনের বর্ণনা প্রথমবার কাশী ভ্রমণপর্বে দেওয়া হয়েছে বলে এখানে আর পুনরাবৃত্তি করা হলো না। 


এবার লেখক বাড়ি ফেরার জন্য উদ্যোগী হলেন। নানারকম বাধাবিঘ্নের পর জ্যৈষ্ঠমাসে নৌকায় গমনের কথা হলে মাঝি বললো যে এখন ঝড়-বৃষ্টি সময়ে নৌকায় যাওয়া যাবে না। আষাঢ়মাসে যাওয়া যেতে পারে। সঙ্গীরা জলপথে না দিয়ে ডাকগাড়িতে (ঘোড়ার গাড়ি) যাওয়া কথা ঠিক করলেন। তখন খবর এলো মিরাট ও দিল্লিতে নানা অঘটন ঘটেছে। কলকাতা যাওয়ার রাস্তা শিগগির বন্ধ হয়ে যাবে। এবার শুরু হল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ। সিপাহী বিদ্রোহের বিশদ বিবরণ লেখক দিয়েছেন, কিন্তু এই ভ্রমণ সংক্রান্ত আলোচনায় তার প্রয়োজন নেই বলে সেটা উপস্থাপন করা হলো না। বিদ্রোহ চলাকালীন লেখক কাশীতেই থাকেন। কাশীতে বিদ্রোহের তেমন প্রভাব পড়ে নি।


লেখক কাশীর বিভিন্ন তীর্থস্থানে দর্শন, পূজন, তর্পণ করতে থাকেন। ভাদ্রমাসে গঙ্গার জল এত বৃদ্ধি পায় যে গত কুড়ি বছরে সেরূপ হয়নি। কাশীর পুষ্করভাস্কর তীর্থে গঙ্গার জল পৌঁছায়, মণিকর্ণিকা ঘাটের চক্রতীর্থের ইন্দ্রদুমনেশ্বর শিবের মস্তকের ওপর দিয়ে গঙ্গার জল প্রবাহিত হয়ে সেই সব তীর্থের মাহাত্ম্য বেড়ে যায়। ফলে সবাই ওই স্থানগুলোতে পুণ্যস্নান করে। এছাড়া তিনি এই সময় লক্ষ্মীকুণ্ড মেলা, তিলতৃতীয়া ব্রত, গণেশ চৌথ, বরণা যাত্রা ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান দর্শন করেন। 


৩ আশ্বিন ১২৬৪ সূর্য গ্রহণ হয়। সূর্যগ্রহণকালে নানা দেশের রাজা ও ধনী ব্যক্তিরা এবং সাধারন মানুষরা কাশীর গঙ্গায় স্নান করতে আসতো। কাশীর পাণ্ডাদের এই সময় বিশাল অর্থলাভ হতো। এক একজন রাজা সোনায় মোড়া হাতি, ঘোড়া দান করতেন। কিন্তু এই বছর কোম্পানি সরকারের কাছে খবর এলো যে এই উপলক্ষে ছদ্মবেশে বিদ্রোহীরা কুমার সিংহ (বিহারের ভোজপুরের কুনওয়ার সিং) ও কানপুরের নানা সাহেবের নেতৃত্বে কাশীতে প্রবেশ করবে। তাই সরকারের কর্মকর্তারা স্থানে স্থানে পথ বন্ধ করে বন্দুকসহ প্রস্তুত থাকলো আর সব আসা-যাওয়া, নৌকা পারাপার বন্ধ রাখল। অন্য কোন জায়গার মানুষকে কাশীতে ঢুকতে দিলো না। ফলে পাণ্ডাদের বিশেষ অর্থক্ষতি হলো। 


এরপর লেখক কাশীতে শারদীয়া দুর্গাপূজা দেখেন। কাশীর বাঙালিরা দুর্গাবাটিতে (পুরনো দুর্গাবাড়ি, বেনারস) দুর্গোৎসব করেন। নবরাত্রির মেলাও হতো সেখানে নয় দিনব্যাপী। কাশীতে বলিদান নিষিদ্ধ কিন্তু দুর্গাবাড়িতে শুধু বলিদান হতে পারতো।


                        (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১১ পৌষ ১২৬৩ (২৬ ডিসেম্বর ১৮৫৬) থেকে ১৬ আশ্বিন ১২৬৪ (১ অক্টোবর ১৮৫৭)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৪

৩২। তীর্থ ভ্রমণ ১৭ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

       

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                     (আগের পর্বের পরে)


দেড় মাস দিল্লি থাকার পর লেখক প্রয়াগের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। পথে বদরপুর গ্রাম পড়ল। সেখানে বুলকট্রেনের বয়েল বদল করা হয়। মানে সেখানে গরুর গাড়ির গরু পাল্টানো হয়। পঞ্চম দিনে বৃন্দাবনে পৌঁছানো হলো। সেখানে দেব দর্শন, পূজা ও বন্ধুদের কাছে শেষবারের মতো বিদায় নিয়ে আবার পথ চলা শুরু। সেকেন্দরাবাগ অর্থাৎ সুলতান সিকান্দার শাহ লোদীর প্রতিষ্ঠিত সিকান্দ্রাবাদ হয়ে তিনদিনে সবাই আগরায় (আগ্রা) পৌঁছালেন। 

উত্তর দক্ষিণে আগ্রা শহর দুই ক্রোশ দীর্ঘ ও পূর্ব পশ্চিমে এক ক্রোশ প্রস্থ। এখানে খুব ভালো বাজার আছে। হালওয়াই-এর পট্টি, ভুনাওয়ালাদের পট্টি, গান্ধির দোকান (ফুলেল আতর, গোলাপ জল প্রভৃতি বিক্রির), জরির আর তিল্লার কাজের দোকান, গুড়গুড়ি-আলবোলার দোকান, ভালো গালিচা, সতরঞ্চির দোকান প্রভৃতি অনেক আছে। আগ্রা শহরে প্রায় ৫০০ বাঙালি আছে। অনেক সাহেবও আছে। এখানে নানা রকম কাছারি, ট্রেজারি, ব্যাংক, আদালত আছে। 


আগ্রা অতি প্রাচীন শহর। যখন হিন্দুদের রাজ্য ছিল তখন এর নাম ছিল অগ্রবন। মুসলমান রাজ্য হওয়াতে আকবর বাদশাহ এখানে কেল্লা তৈরি করে নাম দেন আকবরাবাদ। পরে মহারাষ্ট্রীয়গন দখল করাতে নাম হয়ে যায় আগ্রা। 


আগ্রার কেল্লা যমুনার উপরে অবস্থিত। প্রস্তর নির্মিত মজবুত উঁচু প্রাচীর যুক্ত এই কেল্লার মধ্যে মতি মসজিদ আছে। তার মধ্যে আছে শ্বেত পাথরের তৈরি প্রশস্ত ঘর যেখানে ১৫০০ মানুষ এক সঙ্গে বসে উপাসনা করতে পারে। যেখানে বাদশাহদের কাছারি হতো সেটি দেওয়ান দেওয়ান-ই-আম-খাস। বসার তখ্ত আছে নানা বর্ণের প্রস্তরে খচিত। সিংহাসনের সামনে সোমনাথ মন্দিরের চন্দনের গেট। দেওয়ান-ই-আমের হাওয়াখানায় বাদশাহের কষ্টিপাথরের আরবি লিপি খোদিত তখতের সামনে উজিরের শ্বেত পাথরের তখত। এর দক্ষিণে শিশমহল যেখানে বেগমেরা থাকতেন। শ্বেতপাথরে তৈরি সুবর্ণ খচিত নানা বর্ণের প্রস্তরে চিত্র বিচিত্র। এখানে অতি সৌখিন স্নানাগার আছে। নানা জাতীয় পুষ্পের উদ্যান আছে আছে। আছে  সোনার ছাতা লাগানো  সম্বল বুরুজ (সামান বুর্জ?)। 


আগ্রার কেল্লা থেকে দেড় ক্রোশ দক্ষিণে যমুনার উপরে তাজবিবির রোজা যাতে শাজাহান বাদশাহের ও তাজবিবির কবর আছে। লেখক তাজমহলের কথা বলছেন। মহলটি পুরো মর্মর বা মার্বেল বা শ্বেতপাথরে তৈরি। তার উপর দামী দামী পাথরের ঝাড়, ফুল, ফল, পাতা যার যেমন রং সেই রংয়ের পাথর বসিয়ে খুব ভালো করে পালিশ করে তৈরি। সোনার কাজ অনেক আছে। ভবনটি চার তলা। নীচে দুটি কবর আছে, তার উপর তলায় ওই দুটি কবরের আকৃতি আছে। যে ব্যক্তি এই ভাস্কর্য শিল্প করেছেন তিনি সামান্য মানুষ নন, বিশ্বকর্মার ন্যায় তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি। পালিশ এমন সুন্দর যে সাপ উঠতে পারেনা, মশা মাছি বসলে পড়ে যায়। চার তলার ওপর হাওয়াখানা বুরুজ আছে, সেটি থেকে বহু দূরে দেখা যায়। এছাড়া অনেক ঝাঝরি, স্তম্ভ ইত্যাদি আছে। সামনে যে পুষ্পের উদ্যান আছে তার শোভা অপূর্ব। সেই সুগন্ধযুক্ত উদ্যানের চারপাশে পাথরের বাঁধানো পথ। তার দুই ধারে জলের খাল চারপাশকে সুশীতল রাখে। শ্বেতপাথরের বসার সুন্দর জায়গা আছে। বাগানে অসংখ্য রকমের ফুল ও ফলের গাছ আছে। এমন কি সবজির গাছ, পাহাড়ি ফুলের গাছ, মেওয়ার গাছও আছে। 


পরবর্তী দর্শনীয় স্থান বর্তমান উত্তরপ্রদেশের বটেশ্বর। এবার তাঁরা পদব্রজে না গিয়ে যমুনায় বজরা করে চললেন। নাগরিয়া, চীনবাস হয়ে এলো বটেশ্বর। এই পথে ডাকাতের উপদ্রব খুব বেশি। বটেশ্বর শিব, চতুর্ভুজ নারায়ণ, গৌরীশংকর মন্দির দর্শন ও পূজা করে, তাঁরা শহর দেখলেন। এটি ভাদরিয়া রাজার রাজ্য (চম্বল নদী উপত্যকার রাজত্ব করা রাজপুত রাজবংশ ভাদরিয়া)। যমুনার ধারে শহর। আগের রাজা ও ধনীরা, যমুনার ঘাট বাঁধিয়ে তার উপর শিব মন্দির স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু দেখে মনে হল পূজা তেমন হয় না এখন। চল্লিশ হাজার ঘর, সব জাতির বাস। ধনী ব্যক্তি অনেক আছে । এখানে ২০০ টি শিব মন্দির আছে। শহরে গোঁসাই, সন্ন্যাসী, মোহান্তদের আখড়া আছে। এখানে কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে মেলা হয়। অনেক দেশ থেকে মানুষ এখানে আসে। হাতি, ঘোড়া, উট, গরু, গাধা প্রভৃতি পশু হাজার হাজার বিক্রি হয়। এই মেলা দুই মাস ব্যাপী চলে। জয়পুর, কড়রি, বিকানীর, হাতরাস, ভরতপুর , গোয়ালিয়রের রাজারা এই মেলায় আসেন। 


পরদিন জলপথে ভাদোরিয়ার রাজার এলাকা পান্নায় (?) এলেন। এখানে রাজার বাড়ি, কেল্লা আছে। রাজবাড়ীতে লক্ষীনারায়ণ মূর্তি দর্শন করা হলো। সেদিন রাতে যমুনার ঘাটের কাছে থাকার সময় তাঁরা আশ্চর্য এক দৃশ্য দেখলেন। জলের মধ্যে কখনো মানুষের আকৃতি, কখনো গাছের মতো হয়ে, জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে উঠে, আবার জল মন্থন করে, জল কল্লোলের মতো শব্দ করে, জল দুই তিন হাত উপরে ওঠে, আবার ডিঙ্গির মতো ভেসে কিছুদূর চলে যায়। তারপর ধোপা যেমন কাপড় কাছে সেরকম শব্দ ও জলোচ্ছ্বাস হতে থাকলো। এরকম অনেক রাত পর্যন্ত চলল। সকালে পরীক্ষা করে কিন্তু যমুনার জলে কিছু দেখতে পাওয়া গেল না (মনে হয় শুশুক বা সেরকম কোনো জলচর প্রাণীরা ঝাঁক বেঁধে এসেছিল)। 


এরপর জলপথে ঘাটকো নামক স্থানে ভাদোরিয়া রাজার ভবনে বিহারিজি দর্শন করে ইটওয়া (এটয়া) তে পৌঁছলেন। এটয়া বড় শহর। অনেক বাঙালি বাবু থাকেন। ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টরের কাছারি, ডাকঘর, ছাউনি সব আছে। এরপর জলপথে আদোনি (আন্দায়া), ভরে (ভরেহ্) হয়ে যমুনা ও চম্বল নদীর সঙ্গমস্থলে পৌঁছলেন তাঁরা। এরপর জলপথে যেতে যেতে উল্লেখ্য স্থান এল অরুয়া, কালপী (কালপি)। কালপিতে শহর দেখা ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হল। এখানে কেল্লা, শিব ও নারায়ণের মন্দির, বাঙালি বাবুদের স্থাপিত কালীবাড়ি, সাহেবদের বাংলা ও গোরস্থান দেখা হল। জলপথে পরবর্তী স্থান যেখানে তাঁরা শহর দেখলেন, হল হামিরপুর (হামিরপুর)। এখানে কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট-এর কাছারি ডাকঘর, শিবমন্দির আছে। তারপর কোরনি (?), প্রদনগ্রাম (?) হয়ে প্রয়াগ যাত্রা। 


যমুনার এই জলপথে ডাকাতের খুব ভয় আছে। বজরার ছাদ থেকে এক ক্রোশ পর্যন্ত দেখা যায়। সেখানে চারজন সিপাহী বন্দুক, তলোয়ার নিয়ে পাহারা দেয়। বারো জন মাঝির যমদূতের মতো স্বাস্থ্য। একটি পাহাড়ি কুকুর আছে, তার সিংহের মতো তেজ। তবু একবার ডাকাতির চেষ্টা হয় লেখকদের বজরায়। লেখক ভাবেন যে কোম্পানি বাহাদুরের রাজ্যে এখনো এত সাহসী দস্যু আছে। 


যমুনার স্থানে স্থানে সারস, মানিকজোড়, শামুকখোল, বালিহাঁস, খড়হাঁস, চক্রবাক, বক, চিল, গাংচিল, পানকৌড়ি, সরাল ইত্যাদি নানা জাতীয় শত সহস্র পাখি জলে বিচরণ করে। মকর (অধুনা বিলুপ্তপ্রায় ডুগং বা মেলেটি কি ?), হরেল (ঘড়িয়াল,),  কুমির, কচ্ছপ প্রভৃতি জলজন্তুকে চড়ায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়। গঙ্গায় যত শুশুক, হাঙ্গর আছে যমুনাতে তত জল জন্তু নেই। 


চলার পথে একে একে তাঁরা পার হলেন চিল্লাতারা (চিল্লা ও তারা), লভেটা (?), ডাকাতির জন্য বিখ্যাত চরখা মারখা গ্রাম, কৃষ্ণগড় (?), রাজাপুর (রাজাপুর), প্রতাপপুর (?) এসব হয়ে বজরা এল এলাহাবাদের ঘাটে। শেষের দিকে যমুনার জলের তলায় অনেক ডুবো পাহাড় বা পাথর ছিল। খুব সাবধানে বজরা চালাতে হলো। 


দ্বিতীয়বার এলাহাবাদ এসে লেখক আরো বিস্তৃত ভাবে এলাহাবাদের বর্ণনা দিয়েছেন। শহরটি পাঁচ ক্রোশ বিস্তৃত। এখানে পাঁচটি প্রধান বাজার আছে - দারাগঞ্জ, কিটগঞ্জ (কিট সাহেবের বাজার), মুঠিগঞ্জ, কটরা বাজার, বড়বাজার চক। প্রয়াগী পান্ডার বসতি প্রায় ষোলোশ। তারা সবাই ধনবান। রাজারাজড়ারা এই স্থানে এসে এক লক্ষ মুদ্রা পর্যন্ত দান করেন। যুক্তবেনী অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা ও অন্তঃসলিলা সরস্বতীর সঙ্গমস্থল প্রয়াগ। দেবতা আছেন বেণীমাধব, ভরদ্বাজ ও সোমেশ্বর। আকবর বাদশাহের সময় প্রয়াগের নাম এলাহাবাদ হয়েছে (উল্লেখ্য যে ২০১৮ থেকে আবার এলাহাবাদের নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ)। বাদশাহ আকবর কাম্যকূপের উপরে যমুনার তীরে ত্রিবেণী সঙ্গমে কেল্লা স্থাপন করেছেন। অক্ষয়বট কেল্লার ভিতরে রয়েছে। এলাহাবাদ কেল্লার মতো সুগঠিত কেল্লা প্রায় দেখা যায় না। এর মধ্যে বাদশাহের শিশমহল, আয়নামহল, লালমহল, দেওয়ান খাস ও সমস্ত কাছারি ছিল। লেখকের দর্শনকালে কোম্পানি অন্যান্য দেশে রাজ্য জয় করে পরাজিত রাজাদের এখানে এনে বন্দী করে রাখতো। কোম্পানির ম্যাগাজিন, তোপখানা, শেলেখানা হয়েছে কেল্লায়। এই শহরে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর, মুন্সেফ, আবগারি প্রভৃতির কাছারি, সেনা ছাউনি, হাসপাতাল আছে। অনেক বাঙালি এখানে বাস করে। রাস্তাঘাট খুব ভালো। রাস্তার দুই পাশে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সাজানো সুন্দর সুন্দর দোকান ও পাকা বাড়ি। শহরে কম বেশি এক লক্ষ হিন্দু ও মুসলিমের বাস। 


প্রয়াগের কাম্যকূপে যে যা কামনা করে প্রাণ ত্যাগ করবে তার সেই মনোবাসনা সিদ্ধ হবে ও সেই ব্যক্তি জাতিস্মর হবে বলে প্রবাদ ছিল। এরপর লেখক এক অদ্ভুত গল্প বলেছেন। মুকুন্দ ব্রহ্মচারী নামক এক সাধক সোমেশ্বর শিবের তপস্যায় দেবাদেশ পান যে তাঁকে পুণর্জন্ম নিয়ে ঐশ্বর্য ভোগ করতে হবে এবং তাঁর শিষ্য বীরভদ্রেরও একই পরিণাম হবে। শিষ্য গুরুকে না ছেঁকে দুগ্ধ দিতেন পানের জন্য। যোগবলে তা জানতে পারেন গুরু। সেই কাজ যবন তুল্য ছিল। তাই তিনি বুঝতে পারেন পুণর্জন্মকালে তাঁকে যবন রূপে অর্থাৎ বিধর্মী হিসাবে জন্ম নিতে হবে। গুরুশিষ্য তখন কাম্যকূপে প্রাণত্যাগ করে নিজ নিজ কামনা অনুসারে আকবর ও বীরবল রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। তাঁদের পূর্বজন্মের স্মৃতি স্মরণ হলো। তখন আকবর ও বীরবল পূর্বের তপস্যাক্ষেত্র প্রয়াগে এলেন এবং  বিবেচনা করলেন এরূপ কূপ কলিযুগে রাখা উচিত নয় যেখানে প্রাণ ত্যাগ করলে যে কোন মানুষ যেকোনো রূপ ধারণ করে জন্ম নিতে পারবে। তাই সিসা গলিয়ে কূপ বন্ধ করিয়ে তার ওপর কেল্লা তৈরি করালেন। অক্ষয় বট কিন্তু রৌদ্র বাতাস বৃষ্টি না পেয়েও কেল্লার মধ্যে জীবিত থেকে গেল। সেই ব্রহ্মচারীর তপোবন কেল্লার অপর পারে আরইন গ্রামে সোমেশ্বর শিবমন্দিরের কাছে ছিল লেখক বলেছেন। এই গ্রামের দক্ষিণে ঝুশীগ্রাম, সেখানে গৌতম মুনির আশ্রম ছিল। 


প্রয়াগে মাঘ মাসে মাঘমেলা হয়। নানা দেশ থেকে মানুষ, রাজা, সাধুসন্ত, আখড়াধারী গোঁসাইরা আসেন। নানাদেশ থেকে মহাজন ও দোকানদারেরা এসে ক্রয়-বিক্রয়ের দোকান করে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পদাতিকদের নিয়ে নিজে সর্বদা তদারক করেন মেলার। যেসব জমিতে যাত্রীরা থাকার অস্থায়ী ঘর করে ও দোকানদারেরা অস্থায়ী দোকান তৈরি করে তার উপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চড়া হারে কর ধার্য করে।

                     (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১২৬৩ (২৭ মে ১৮৫৬) থেকে ১০ পৌষ ১২৬৩ (২৫ ডিসেম্বর ১৮৫৬)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৪

৩১। তীর্থ ভ্রমণ ১৬ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


  সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

এবার শুরু হল লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর দ্বিতীয় বার এবং আরো বিশদভাবে দিল্লি দর্শন। সেই সময় দিল্লির সিংহাসনে রয়েছেন শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে তাঁর ক্ষমতা শুধু দিল্লির কেল্লার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর তাঁর বাদশা উপাধি নামমাত্রই হয়ে উঠেছিল। লেখকের বর্ণনায় ইন্দ্রপ্রস্থ বা দিল্লী শহরের আকৃতি ডিমের মতো। এই শহরে প্রকাশিত দ্বার বারটি আর গোপন দ্বার পাঁচটি। প্রকাশিত দ্বারকে দরওয়াজা বলে আর গোপন দ্বার কে খিড়কি বলে। প্রধান দ্বার হল দিল্লি, আজমিরি, কাশ্মিরি, কলিকাতা দরজা প্রভৃতি। এইসব দরজায় অস্ত্রধারী দ্বারপাল ও পদাতিক সৈন্য ছিল। গোপন দরজা যেমন বাহাদুর আলী খান খিড়কি, নিগমবোধ খিড়কি, খাজানা খিড়কি প্রভৃতি। দিল্লি শহর পাঁচ ক্রোশ বিস্তৃত। শহরের স্থানে স্থানে নানা দ্রব্যের ক্রয় বিক্রয়ের সওদাগর, সব দেশের মানুষজন, রাজপুরুষ ও বেশ্যারা থাকে। লাহোর থেকে দিল্লি পর্যন্ত রয়েছে প্রশস্ত রাজপথ। শহরের মধ্যে দিয়ে যমুনা বয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে সেতু আছে তাই দিয়ে লোক চলাচল করে। হীরা, জহরত, চুনি, পান্না, কালাবর্ত অর্থাৎ সোনা রুপার তারের খচিত বস্ত্রের ব্যবহার এখানকার ধনীরা খুব করেন। মাঝে মাঝে এরকম স্থানও আছে যেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অল্প আয়ে জীবন যাপন করে। প্রধান পথের দুই পাশে দোকানগুলি নানা দ্রব্য দিয়ে শোভিত। মাঝেমাঝে কাঠের স্তম্ভে কাচের দীপাধার আছে, রাতে এখানে দীপ জ্বলে নগর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শহরের মধ্যস্থলে জুম্মা মসজিদে অপরাহ্নে মৌলবী, মুন্সি, ফকিররা একসাথে সাধন ভজন করে। ওইখানে চকের মত উত্তম দ্রব্য বিক্রয় হয়। দিল্লির নতুন কেল্লার (লাল কেল্লা) তিনটি দরজা। দিল্লির দ্বারের কাছে লালদীঘি নামে পুষ্করণী আছে যা যমুনার জলে পূর্ণ। তাতে মাছ আছে। 


রাজধানীর ব্যক্তিগণ সুসভ্য, সুবেশ, সুআবাস, সুভাষ, সচ্চরিত্র ও স্বধর্মে সুপবিত্র। অপরাহ্ণে সবাই ঘোড়া, হাতি, উট, বিমান(?), রথ, মানুষের টানা গাড়ি, গরুর গাড়ি, মৃগযান(?), চেরেট (চ্যারিয়ট), বগী(?), পালকি, সেজগাড়ি, তানজাম, মেছনি(?), বোচা(?), মহাপা(?)-তে বস্ত্র অলংকারে সুসজ্জিত হয়ে ভ্রমণ করে। যাদের এসব নেই তারাও ভালো বস্ত্র পরে, সুগন্ধি ফুলের মালা বা আতরে মন প্রফুল্ল রাখে। নর্তকী ও বেশ্যারা আপন আপন নায়কের সঙ্গে ভ্রমণ করে। 


দিল্লিদ্বার দক্ষিণ দিকে, লাহোরদ্বার পশ্চিম দিকে। কলকাতা দরজা পূর্বে ছিল না। গভর্নর জেনারেলের আদেশে কলকাতা দরজা হয়েছে। কাশ্মীর দরজার দুই মাইল পরে সেনা ছাউনি। দিল্লির কলেজে ইংরেজি, পার্সি, আরবি, উর্দু ও দেবনাগর এই পাঁচ ভাষায় পড়ানো হয়। লেখক এরপর দিল্লির ৩৩ টি বাজারের নাম জানিয়েছেন। এছাড়াও দিল্লিতে গলিতে গলিতে আরো বাজার আছে।  নিগমবোধ খিরড়ির কাছে অনেক হিন্দু দেবালয় আছে। 


বাদশাহী তক্ত অর্থাৎ পূর্বের রাজসিংহাসন বহু মহামূল্য পাথরের লতাপাতা, পুষ্প খোদিত ছিল, সেসব খুলে লুট করে নিয়ে গেছে (নাদির শাহ নাকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, কার কথা বলছেন লেখক?)। দেওয়ান ই আমে বাদশাহ আগে বসতেন। ২২ টি থামে ২২ জন সুবা দাঁড়াতেন। সামনে ফুলের বাগান আছে। তারপরে মহাতাব বাগ, আরাম গৃহ, আঁধিয়ারি বাগ আছে। আঁধিয়ারিবাগে অনেক জাতের মেওয়া, ঔষধি গাছপালা আছে। যমুনার জল থেকে ফোয়ারা তৈরি করে রাখা আছে। মাঝে মাঝে আছে চৌবাচ্চায় পদ্ম ফুলের শোভা। একটি ঘর আছে যেখানে শতধারায় ফোয়ারা বসিয়ে জল ছাড়া হতো আর শ্রাবণভাদ্রের মতো বৃষ্টি হতো। নৌকা ভ্রমণের জন্য ব্যবস্থা ছিল বাদশাদের। এরপর মতি মসজিদ বা বাদশাহের ভজনের স্থান। আগে বহু মূল্য পাথরে খচিত ছিল। এখন শুধু শ্বেতপাথর আছে। যে কক্ষে বাদশাহ রাজকার্যে বসেন, দেওয়ানী খাস, তার শোভা অতুলনীয়। দৈর্ঘ্য প্রস্থে বিরাট ঘর। কিন্তু কড়ি বর্গা নেই, পাথরের চাদরের খিলান। তাতে নানা রঙের প্রস্তর খচিত ও চিত্রবিচিত্র আছে। ঘরের মধ্যস্থলে শ্বেত পাথরের রাজসিংহাসন এক হাত উঁচু বেদির ওপর বসানো। ওই তখত ঘরের মধ্যে বন্ধ করা থাকে। যখন বাদশাহ বসেন তার আগে সুসজ্জিত করে বের করা হয়। ওই তখতের চারপাশে মছলন্দের (কারুকার্য করা নরম বসার আসন) বিছানায় বসে রাজপুরুষরা আপন আপন কাজ করতেন। ওই ভবনের উত্তর দ্বারে স্ফটিকের এক চৌকি আছে সেখানে বসে যমুনা দেখা ও শীতল বায়ু সেবন করতেন বাদশাহ। 


ভবনের চারদিকে সরদারদের দপ্তর আর খোজা রক্ষক আছে। আরও ভিতরে বাদশাহজাদাদের মহল্লা বা বাদশাহী অন্তঃপুর। বাদশাহের কুড়িজন বিবাহিতা ও বাকি অবিবাহিতা নিয়ে ২০০ বেগম। বাদশার বয়স তখন আশির বেশি, সর্বদা বাইরে আসেন না। অন্তঃপুরে এক মসজিদ আছে, সেখানে স্ত্রীলোকেরা ভজনা করে। দিল্লিশ্বরের ঘুড়ি আর শিকার খেলা খুব প্রিয়। দিল্লিশ্বরের মধ্যমপুত্র মির্জা খুব গুণী ও গান বাজনায় সুপন্ডিত। তিনি খুব সুপুরুষ। ঘোড়া ও কুকুর তাঁর খুব প্রিয়। তিনি গান বাজনা আর ভ্রমণ নিয়ে থাকেন। লাল পর্দা বলে একটি অন্তঃপুর আছে। সেখানে কোনো পুরুষ, খোজা, এমনকি ৫ বছরের বালকেরও প্রবেশাধিকার নেই। সেখানে নারী দোকানীর কাছে বেগমেরা হীরা মোতি ক্রয় করেন। কৌড়িয়া পুলের কাছে বেগমবাগ নামে এক বাগান আছে। অতি সুরম্য, সুশীতল স্থান। পাঞ্জাবি কাটরাতে পাঞ্জাবি সওদাগরদের বাস। এরা দীর্ঘকাল দিল্লিবাসী ও বাণিজ্য কর্ম করে ধনী হয়েছে। সব বাজারে জরি, পাল্লা, কালাবর্ত ও টুপির দোকান আছে। কুর্তা , আঙ্গিয়া, লেহেঙ্গা, দোপাট্টা বহু মূল্য ও উত্তম মানের পাওয়া যায়। 


নিগমবোধ ঘাটে প্রতি রবিবার গায়কদের মজলিস হয়। শহরের সব গায়ক সেখানে উপস্থিত হন। কাশ্মীর দরজার কাছে এক সাহেবের বাড়িতে এক জন্তু আছে, তার আকার উটের মতো, গলা লম্বা, মুখ ঘোড়ার মত, পেছনের পা ছোট, গায়ে বাঘের মতো ফোটা ফোটা দাগ, বয়স দুই বছর মাত্র কিন্তু বড় উটের মত লম্বা। যে জন্তুকে লেখক দেখেছেন তা জিরাফ অর্থাৎ এক ইংরেজ সাহেব দিল্লিতে নিজের বাড়িতে জিরাফ পুষেছিলেন। যমুনার নিগমবোধের ঘাটে তিনি নৃসিংহ চতুর্দশীর মেলা দেখেছিলেন। মেলায় প্রহ্লাদ চরিত্র পাঠ হয়। হিরণ্যপসিপুর এক কাগজের স্বরূপ (মডেল) বানিয়ে সন্ধ্যার সময় দৈত্য বিনাশ করা হয়। লেখক রাজা হিন্দুরায়ের এস্টেট নিলাম প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর শিকারের উত্তম উত্তম যন্ত্র ছিল। একটি বন্দুকের দাম ৭০০ টাকার কম না। একটি ঢাল ২,০০০ টাকায় বিক্রি হয়। গ্রাহক না থাকায় হিরা-চুনি-পান্না-মোতির কাজ করা দ্রব্যাদি বিক্রি হলো না। 


দিল্লি দরজা থেকে দুই ক্রোশ দূরে পুরনো দিল্লি। সেখানে বাদশাহের পুরনো কেল্লা। অন্য রাজাদের আপন আপন পুরনো কেল্লা, আরবের সরাই (পূর্বে আরব দেশে সওদাগরেরা এসে সেখানে থাকতো)। এর পর এল ভুলভুলড়ি মসজিদ। এই মসজিদে বহু মূল্যবান পাথর ছিল তা ইংরেজ বাহাদুর উঠিয়ে নিয়ে গেছে। (এটি বর্তমান জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া কেন্দ্রীয় মসজিদ)। এই মসজিদ থেকে দু ক্রোশ পথ পেরিয়ে পাহাড়ের উপর বাহাপুরের কালকাদেবীর মন্দির। দেবীর স্বরূপ গোলাকার পাথর আছে যা পুষ্প বস্ত্র অলংকারে আবৃত। মন্দিরের ধর্মশালায় পথিকেরা থাকতে পারে। নবরাত্রিতে এখানে বড় মেলা হয়। 


এবার লেখক পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিষয়ে বলেন কিন্তু তিনি তাঁকে পৃথুরাজা নামে বিবৃত করেছেন। পৃথুরাজার রাজধানী গড়ের মধ্যে চতুর্দিক বেষ্টিত আছে। তিনি যোগমায়া দেবীর উপাসক, তাঁর মূর্তি কেল্লার মধ্যে আছে (ছিল?)। কেল্লার মধ্যে যজ্ঞস্থান আছে। সেখানে মুনিগন এক রাজসিক যজ্ঞ করেন। এক স্তম্ভ (কুতুব মিনারের পাশে লৌহ মিনার) মুনিরা যজ্ঞ কুন্ডের মধ্যে স্থাপিত করে বলেন যে এই স্তম্ভের মধ্যস্থল নাগরাজের মাথার ওপর স্থাপিত হল। যতদিন স্তম্ভ থাকবে ততদিন তাঁর রাজ্য থাকবে। এই কথায় রাজার মনে সন্দেহ হওয়াতে তিনি ওই স্তম্ভ হেলানোর চেষ্টা করেন। ওই স্তম্ভের তলায় থেকে রক্তপাত হল। রাজার মনে সন্দেহ আসাতে মুনি দুঃখিত হন ও বলেন যে স্তম্ভ স্থাপনের উদ্দেশ্য সফল হবে না আর স্তম্ভটি সব সময় ঈষৎ দক্ষিণ-পশ্চিমে হেলে থাকবে। স্তম্ভের উপর দেবনাগরীতে এসব লেখা আছে। মুসলমান ও ইংরাজ রাজত্বে তারা ওই স্তম্ভ ওঠানোর জন্য অনেক খনন করেছে কিন্তু শেষ সীমা পায়নি। কামানের গোলা ছুড়েও স্তম্ভকে ফেলতে বা ভাঙতে পারেনি। স্তম্ভের গায়ে পার্সী অক্ষরে এসব লেখা আছে আর গোলার দাগও আছে। ওই স্তম্ভের কিছু দূরে একটি বৃহৎ ও উচ্চ স্তম্ভাকৃতি ছয় তলা উঁচু ঘর আছে, যাকে লাট বলে (কুতুবমিনার), যার ওপর বসে নাকি রাজকন্যা নয় ক্রোশ দূরে যমুনা দর্শন ও পূজা করবেন বলে রাজা এটি নির্মাণ করেছিলেন। এই স্তম্ভের আকারে পরে কলকাতার মনুমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল বলে লেখক বলেন। রাজার বাড়ি প্রস্তর নির্মিত ও উত্তম প্রস্তর দ্বারা খচিত ছিল এই স্তম্ভ গুলো বাড়ির ভিতরে ছিল। মুসলমানদের রাজ্য হওয়াতে ওই রাজবাড়িতে আর যজ্ঞভূমিতে যেসব দেবদেবীর মন্দির ও যজ্ঞকুন্ড ছিল সব ভেঙে ভালো ভালো যেসব পাথরের দরজা ছিল তা উঠিয়ে দিল্লিতে নিয়ে যায়। দেবালয়ের স্থানে মসজিদ তৈরি হয় এবং স্থানে স্থানে কবর দেওয়া হয়। এভাবে হিন্দুদের সব ধর্ম বিষয়ক স্থান ছিল সব ভেঙে ফেলা হয়। ধাতু ও পাথরের স্তম্ভ ভাঙ্গতে পারেনি, আজ পর্যন্ত বজায় আছে। 


লেখক এবার যান দিল্লি বা ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে গড় মুক্তেশ্বরে (গড়মুক্তেশ্বর, উত্তর প্রদেশ) যেখানে পাণ্ডবদের স্থাপিত মুক্তেশ্বর শিব আছে। সেখান থেকে ত্রিশ ক্রোশ দূরে হস্তিনাপুরি (হস্তিনাপুর, উত্তর প্রদেশ), যা কুরুকুলের আদি রাজ্য এখন নিবিড় জঙ্গলে পরিণত হয়ে আছে। সেখানে সন্ন্যাসীরা আছেন। কুরুকুলের ঘরবাড়ি বর্তমানে নেই, শুধু স্থানে স্থানে চিহ্ন আছে।

                      (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১৬ বৈশাখ ১২৬৩ (২৯ এপ্রিল ১৮৫৬) থেকে ১২ জ্যৈষ্ঠ ১২৬৩ (২৬ মে ১৮৫৬)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৪

৩০। তীর্থ ভ্রমণ ১৫ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


  সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ            ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                  (আগের পর্বের পরে)

মণিকরণ কুলুর রাজা জগৎসিংহের প্রতিষ্ঠিত দেবালয়। মণিকরণে দুটি কুণ্ড আছে। নীচে যে কুন্ড আছে তাতে দুই হাত মতো জল আছে, জলে সামান্য স্রোত আছে। উপরে যে কুণ্ড আছে তাতে এক হাত জল। দুটি কুন্ডেই জল খুব উষ্ণ। স্পর্শ মাত্র হাত পুড়ে যাবে। সর্বদা ধোঁয়া উঠে অন্ধকার হয়ে আছে। কুন্ডের মধ্যে রান্নার কাঁচা দ্রব্য দিলে তা সুসিদ্ধ হয়ে যায়। এই কুন্ডের মধ্যে ভাত, খিচুড়ি, পায়েস, রুটি, ডাল প্রভৃতি রান্না করে অনেকে খায়। 


এই স্থান পূর্বে হরপার্বতিসহ বিভিন্ন দেবদেবীর বিহারের স্থান ছিল। বিহারকালে পার্বতীর কানের কুণ্ডল সহ মণি এখানে পড়ে যায়। শিব তখন ডাকিনী যোগিনীদের সেই মনি উদ্ধারে পাঠান। এক যোগিনী পাতালপুরীতে গিয়ে দেখেন নাগরাজের মাথায় রয়েছে সেই মণি। নাগরাজ তাকে দেখে রাগান্বিত হয়ে বলেন যে তিনি ধ্যান করছেন এই সময় স্ত্রীজাতির আগমন নিষিদ্ধ তাহলে এই যোগিনী কেন এখানে এসেছে। যোগীনির মুখে তারপর সব কথা শুনে নাগরাজ মণি নাসার অগ্রভাগে রেখে এক ফুৎকারে সেই মণি উপরে পাঠান। সেই ফুৎকারের পথে দুই উত্তপ্ত ধারা উঠে এসেছে আর এই স্থানের নাম হয়েছে মণিকরণ। 


এর পূর্ব সীমানায় ব্রহ্মনালে ব্রহ্মা তপস্যা করেছিলেন। ব্রহ্মনাল দর্শন করে উপরে উঠে ঈশান দিকে তাকালে কৈলাস পর্বত ধবলগিরি দেখা যায়। ওই পর্বতে চূড়ায় এক সুন্দর মন্দির আছে। ব্রহ্মনাল থেকে উপরে ১২ ক্রোশ গিয়ে মানতালাব বা মানসরোবর। বরফ সর্বদা পড়ে পথ অতি দুর্গম। এত সুন্দর মন্দির সেখানে আছে যা মনে হয় মানুষের তৈরি নয়। এখানে লেখক কৈলাস মানস সরোবরের কথা বলেছেন কিন্তু এখান থেকে কৈলাস বা মানসরোবর কোনটিই দেখা সম্ভব নয়। এই স্থান থেকে হরিন্দর পর্বত দেখা সম্ভব। এখানে লেখকের তথ্যে কোন ভুল হয়েছে। 


মণিকরণে তীর্থস্থান হল ব্রহ্মনাল, ত্রিধারা, লক্ষ্মীকুন্ড, রামচন্দ্রজির মন্দির, রামকুন্ড। এই তীর্থে কুলু রাজার লক্ষ্মীনারায়ণ, রঘুনাথজি, নৃসিংহ, রামচন্দ্রজি ও মুরলিধর এই পাঁচটি দেবালয় আছে। ফেরার পথে দর্শন করা হলো বিজলীশ্বর মহাদেব। এই বিজলীশ্বর লিঙ্গ নাকি প্রতি বারো বছর অন্তর বজ্রাঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তারপর সেই টুকরো জুড়ে আবার নতুন লিঙ্গ তৈরি করা হয়।


বামনকোঠি থেকে চার ক্রোশ দূরে ব্যাসা নদী কাঠের পুলে পার হয়ে রাজা জ্ঞানসিংহের রাজধানী কুলু শহরে এলেন তাঁরা। পাহাড়ের মধ্যে সুন্দর শহর, সব রকম জিনিস পাওয়া যায়। হিন্দু-মুসলমান সব জাতির বসবাস। কোম্পানির তহসিলদার ও পুলিশের কাছারি আছে কেল্লার মধ্যে। রাজবাড়ি আছে। রামসীতা ও নৃসিংহদেবের মন্দির আছে। এখানে পরশুরামের এক মন্দির আছে যার দুয়ার ১২ বছর অন্তর শ্রাবণ মাসে খোলা হয়। 


এবার কুলু থেকে বেজওর ,(বাজৌরা), কুমান্দ, জরু প্রভৃতি হিমাচল প্রদেশের বিভিন্ন স্থান দিয়ে পথ চলা। এখানে জলের খুব অভাব। ছয় ক্রোশ পার্বত্য পথ চলেছেন সম্পূর্ণ জল ছাড়া। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রসদ সংগ্রহ হয় তো কাঠ পাওয়া যায় না। কাঠ জোগাড় হয় তো ঝড়, শিলাবৃষ্টিতে সামান্য আশ্রয়ের পাথরের ছাদের ফাটল দিয়ে গলে গায়ে জল, শিলা পড়ে। এভাবে অতি কষ্টে তিনি সঙ্গীদের নিয়ে চলতে থাকলেন। ফুটাখ, হীরাবাগ, ভাঙাহাল এই সব হিমাচল প্রদেশের গ্রাম হয়ে এলেন বৈদ্যনাথ বা বৈজনাথ। সেখানে পর্বতের উপরে শিব মন্দির, নীচে ক্ষীরগঙ্গা। মন্দির থেকে ক্ষীর গঙ্গা ১৫০ সিঁড়ির নীচে। বৈজনাথে আছেন বৈদ্যনাথ, সিদ্ধিনাথ, কেদারনাথ, ইন্দ্রেশ্বর, গণপতেশ্বর, কাশীর বিশ্বেশ্বর, রাবণেশ্বর, ভূতেশ্বর ও মহাকাল - এই নয় অনাদি শিব। এখানে নানা রকম দোকান বাজার আছে। 


বৈজনাথ থেকে ব্যাবারন্যা (ভাওরনা) গ্রাম, পরওল (পরৌর), ধরমসা (ধরমশালা)  হয়ে ভাগশু আসা হল। এখানে পাহাড়ের উপর ভাগশু শিব আছেন। ভাগশুতে কোম্পানির ছাউনি, কাছারি ইত্যাদি হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আগত হয়ে কাংড়া কেল্লায় যাওয়া যায় এই পথে, তাই কোম্পানি এখানে খুব সজাগ পাহারা রাখে। এখানে রাজপুরুষদের আগমনে বরফ  আচ্ছাদিত হলেও ভালো শহর গড়ে উঠেছে। 


এবার কাংড়া যাওয়ার পথে আশ্চর্য সাধুকে দেখলেন সর্ব্বাধিকারী মহাশয়। তাঁর নাম মস্তরাম বাবা, বয়স ১০০ বছরের বেশি। কিন্তু তাকে দেখে পঞ্চাশ বছরের বেশি মনে হয় না, এমন সবল। কুষ্ঠ রোগী, মৃগী রোগী স্পর্শ মাত্র সুস্থ করতে পারেন। এরপর এলো নগরোট (নগরোটা ভগবান)। তার চার ক্রোশ দূরে কাংড়ার দেবীর ভবন। দেবীর নাম ব্রজেশ্বরী। এখানে সতীর স্তন পতিত হয়েছিল। পূর্বে যে প্রাচীন মন্দির ছিল তার উপর পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিংহ কাংড়া অধিকার করার পরে নতুন মন্দির তৈরি করে দিয়েছেন। প্রস্তর নির্মিত স্বর্ণমণ্ডিত এই মন্দিরে রুপার সিংহাসনে, রুপার পত্রে দেবীর প্রতিমূর্তি গঠিত করে দিয়েছেন। আসল মূর্তি গোলাকার পাথরের, তা পুষ্প চন্দন বস্ত্র দ্বারা শোভিত। দেবীর মন্দিরের পান্ডাদের দেবীরূপা কন্যারা যাত্রীদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সরল মনে। মহাদেবের মন্দির থেকে দুই ক্রোশ চড়াইয়ে কাংড়া রাজার কেল্লা। কেল্লার মধ্যে অম্বিকাদেবী ও কালভৈরব রক্ষক। কেল্লার পশ্চিমে পাতালগঙ্গা ও তারপর জয়ন্তী পর্বত। পর্বতের মাথায় জয়ন্তী দেবী ও তালেশ্বর শিবের মন্দির। এই স্থানকে কপাল পীঠ বলে। কাংড়া শহরের শ্রীহ্রাস হয়েছে কারণ ভাগশুতে কোম্পানীর সব দপ্তর, বাজার চলে গেছে। কেল্লায় এখন কিছু ইংরাজ সৈন্য আছে। রাজা সংসারচন্দ্র সপরিবারে  ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নেনডোর পাহাড়ে বন্দী আছেন। কেল্লা থেকে এক ক্রোশ দূরে বাণগঙ্গা ও পাতাল গঙ্গার সঙ্গমস্থল। সেখানে ৩৬০ টি তীর্থস্থান আছে। 


কাংড়া থেকে গণেশঘাঁটীর পাহাড়ের সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে যাওয়া হলো। কোম্পানি বারুদের দ্বারা পর্বত উড়িয়ে (ডিনামাইট দিয়ে) সুরঙ্গ তৈরি করেছে। এভাবে রাণীতলাব, রামপুরা হয়ে জ্বালামুখীতে আবার আসা হলো। আবার দর্শন, পূজন করে ডেরাগ্রাম (ডহরা গোপীপুর) হয়ে চিন্তাপূর্ণী দেবীর (চিন্তাপূর্ণী মন্দির, হিমাচল প্রদেশ) দর্শনের উদ্দেশ্যে যাওয়া হল। এটি ভগবতী ছিন্নমস্তা দেবীর মন্দির। সেখান থেকে হুশিয়ারপুর (হোসিয়ারপুর)  হয়ে গেলেন রাজেশ্বরী মন্দির। 


সেখান থেকে জেজো, সন্তকগড়, বরমপুর, কোটগ্রাম হয়ে পার্বত্য পথে লেখকেরা পৌঁছলে নয়না দেবী মন্দিরে (হিমাচল প্রদেশের)। নবরাত্রীর মেলায় এখানে অনেক মানুষ একত্র হয়। পান্ডাদের ঘর থেকে ৪০৬ ধাপ সিঁড়ি উঠে নয়না দেবীর মন্দির। সেখানে ধর্মশালা আছে। প্রথমে দেবীর পদচিহ্ন ও দুটি বাঘের মূর্তি দেখা যায়। তারপর দেবীর মন্দির। এ ছাড়া শিবকালী, লক্ষ্মীনারায়ণ, বটুক ভৈরবের মূর্তি আছে। এখানে সতীর নয়ন পড়েছিল তাই নয়নাদেবী বলে। দেবী অষ্টভুজা, সামনে বাঘের মূর্তি আছে। ওই ভবনের আধ ক্রোশ নীচে একটি সুড়ঙ্গে বটুক ভৈরব গুপ্তভাবে আছেন। ওই সুড়ঙ্গ পথে পূজা দিতে হয়। এখানে পান্ডাদের কন্যারা যাত্রীদের থেকে অর্থ ভিক্ষা করে দেবীরূপা হয়ে। তাছাড়া পান্ডাদের বালকেরাও অর্থ চায়। 


কোটগ্রাম (কোট), বরমপুর হয়ে সন্তোকগড় এল। এটি রাজা রামসিংহ জায়গীরদারের কেল্লা। এরপর জেজো, মানপুর হয়ে হিমাচল প্রদেশের হুশিয়ারপুর এলো। এখানে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি, সেনা ছাউনি, ডাকঘর, গির্জা, সাহেবদের বাংলো আছে। এখানে গুরু নানকের মেলা হয়।


লেখক এবার হরেনা (হরিয়ানা, পাঞ্জাব), ফাগুড়া (ফাগওয়াড়া, পাঞ্জাব) হয়ে সতলেজ (শতদ্রু) নদীতে নৌকার পুল পার করে লুধিয়ানা পৌঁছলেন। সেখানে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টরদের কাছারি আছে। এবার তিনি যান অম্বালা (আম্বালা)। এটি একটি বড় শহর, বিরাট সেনা ছাউনি আছে। অনেক রকম দোকান বাজার আছে আর অনেক বাঙালি আছে।  সেখান থেকে হরিয়ানার সাহাবাদ, পিপলি, কর্ণাল, পানিপথ, সামহান হয়ে দিল্লির কাবুলি দরজাতে এসে পৌঁছালেন।


                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৫ চৈত্র ১২৬২ (১৯ মার্চ ১৮৫৬) থেকে ১৫ বৈশাখ ১২৬৩ (২৮ এপ্রিল ১৮৫৬)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০২৪

২৯। তীর্থ ভ্রমণ ১৪ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ            ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

                   (আগের পর্বের পরে)

হুশিয়ারপুর থেকে ভাঙা নদী (ভাঙ্গি নদী) পার হয়ে পাহাড়ের শুরু। ক্রমে ক্রমে বর্তমান হিমাচল প্রদেশের বোটা, আমবাগ, (আম্ব), রাজপুরা, চম্পা হয়ে জ্বালামুখী পৌঁছানো হল। 
সেখানে ধাপে ধাপে রাস্তা উপরে উঠেছে। রাস্তার দুপাশে দোকান। মন্দিরের চারদিকে পান্ডাদের বসতি। ভগবতীর জিহ্বা এখানে পতিত হয়েছিল। একে জালন্ধর পীঠও বলে ( কিন্তু এটি জালন্ধর বা জলন্ধর না । কেন লেখক এরকম লিখলেন?) চারদিকে পাহাড়ের মধ্যে মন্দির। রাজা রণজিৎ সিংহ প্রতিষ্ঠিত সোনার কলস চারদিকে, তার উপরে সোনার ছাতা, সামনে দুটি সোনার বাঘ আছে। মন্দিরের মধ্যে একটি জ্যোতি প্রজ্জ্বলিত আছে। রূপার সিংহাসনে জোয়ালাদেবী উপবিষ্ট আছেন। প্রসাদী দ্রব্য এই জ্যোতির কাছে আনলে অগ্নিদগ্ধ হয়। এই মন্দিরের উত্তরে গোরক্ষনাথের গদি। গোরক্ষনাথ এক যোগী ছিলেন, তিনি সাধনার দ্বারা মহাদেবীর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। এই গদির কাছে দুটি জ্যোতি আছে এবং তার নিকটস্থ কূপের জলে অগ্নির খেলা দেখা যায়। 


এর উত্তরে পাহাড়ের মধ্যে বিল্বকেশ্বর শিব আছেন। তার নিকটও দুটি জ্যোতি প্রজ্জ্বলিত আছে। পর্বতের উপর নর্মদেশ্বর নামে শিবলিঙ্গ স্থাপিত আছে। আরো উপরে আছে উন্মত্তেশ্বরের মন্দির। এই পীঠের পরিক্রমা ৪৮ ক্রোশ। কালেশ্বর, চতুর্ভুজ নারায়ণ, কাশ্যপনাথ শিব, ত্রৈলোক্যনাথ শিব, অম্বিকা দেবী, শীতলা মাতা, কালভৈরব প্রভৃতি বহু তীর্থ পরিক্রমা করতে প্রায় তিন মাস সময় লাগে। 


জোয়ালজির পান্ডারা পর্বতের উপরে বাস করে। পাণ্ডাদের কন্যারা অতি সুন্দরী। এক থেকে কুড়ি বছর পর্যন্ত বয়সী সব কন্যা মহাদেবীর মন্দিরে এসে যাত্রীদের কাছে অর্থ চায়। তাদের মনে কোন বিকার নেই। অল্প পেলেই সন্তুষ্ট। তারা অবাধে সর্বত্র বিচরণ করে ,অল্প পেলেই সন্তুষ্ট। খাদ্যদ্রব্য দিলে নিঃসঙ্কোচে খেয়ে নেয়। জোয়ালা দেবী দর্শন, পূজা, হোম, ব্রাহ্মণ কুমারীদের ভোজন পর্ব সমাপ্ত করে এবার লেখক চললেন পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। 


এবার যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয়ের লক্ষ্য মণিকরণ ও রেওয়াড়েশ্বর দর্শন। জ্বালামুখী থেকে ব্যাসা নদীর (বিয়াস নদী) নাদওনের ঘাটে এসে নৌকা পার হয়ে নাওদন শহরে এলেন। এটি কাংড়ার রাজা উমেদ চন্দ্রের রাজধানী। সেখান থেকে ফতেপুর, লম্বুডু, গোপালপুর হয়ে চার ক্রোশ চড়াই উঠে রাজার তলাও নামক পুষ্কারিণী ও শিব মন্দির। আরো দুর্গম চড়াই উতরাই পথে চার ক্রোশ পেরিয়ে রেওয়াড়েশ্বর কুণ্ডে পৌঁছানো হলো। বর্তমান হিমাচল প্রদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ এবং শিখ ধর্মস্থান রেওয়ালসার হলো এই স্থানের বর্তমান নাম। উতরাই পথে পান্ডারা এসে যাত্রীকে নিয়ে যায়। পাহাড়ের নীচে এসে কুন্ড। এই কুন্ডের তীরে মান্ডির রাজরানীর শিব মন্দির। সেখানে নর্মদেশ্বর শিব আছেন। সামনে কাল পাথরের নন্দী মূর্তি। কুন্ডের জল খুব গভীর। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে  দুই ক্রোশ পরিমাণ। কুন্ডের জলে সাতটি বেড়া আছে। বেড়া অর্থাৎ ভাসমান প্রস্তর, ওপরে মাটি, তার উপরে গাছপালা সহ এক একটি ভাসমান ছোট দ্বীপ। তার নাম বেড়া। এরকম ব্রহ্মা-বিষ্ণু -শিব-হনুমান-দুর্গা-গণেশ-ধর্মধারী অর্থাৎ লোমশ মুনির নামে সাতটি বেড়া। এর মধ্যে ছয়টি বেড়া সারা বছর ভেসে বেড়ায়। দুর্গার বেড়া শ্রাবণ ভাদ্র এই দুই মাসে ভেসে বেড়ায়। লেখক যখন কুঞ্জের কাছে গেলেন তখন বিষ্ণুর বেড়া ভেসে এলো। দর্শন ও পূজা করে তাঁর মনে হলো এত শ্রম করে আসা সার্থক। কীভাবে এই বেড়াগুলি জলে ভাসছে তা নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা পরীক্ষা হলেও তখনও পর্যন্ত তার কোন ব্যাখ্যা মেলেনি। 


এই তীর্থে ভোট দেশ (তিব্বত) এবং মহা চীন দেশের অনেক মানুষ আসেন। তাঁরা খুব ধনী। তাঁরা ব্রহ্মার বেড়ার খুব মান্য করেন ও দান করেন,পাথরে নাম খোদিত করে যান। এখানে লেখক তিব্বত ও চীন থেকে আগত তীর্থযাত্রীদের কথা বলেছেন কারণ প্রবাদ আছে রিম্পোচি বা বৌদ্ধ ধর্মগুরু পদ্মসম্ভব তিব্বত থেকে রেওয়ালসারে উড়ে এসেছিলেন তপোবলে এবং এখানে দীর্ঘদিন তপস্যা করেছিলেন।


পরেরদিন লেখক পার্বত্য চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছালেন ব্যাসানদীর (বিয়াস নদীর) তীরে রাজা বনবীর সেনের রাজধানী মন্ডি (মান্ডি)। বনবীর সেনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর দশ বছরের পুত্র বিজয় সেন তখন রাজা। শহরের মধ্যে অতি প্রাচীন ভুতেশ্বর শিবের মন্দির ও পাহাড়ের ওপর শ্যামা কালী মন্দির আছে। মান্ডি নগরে একটি দেব মেলা হয়। রাজ্যে যত স্থানে যত দেব-দেবী আছেন শিব চতুর্দশীতে মাণ্ডিতে এসে উপস্থিত হন। সঙ্গে সকল পাহাড়ীরা। এই দেবদেবীদের সোনা-রুপার মুখ ও নানা রকম বস্ত্র দিয়ে সিঙ্গার (শৃঙ্গার) করানো হয়। দেবদেবীকে চতুর্দোলায় করে নৃত্য করায় মানুষেরা। রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতি হাতি, ঘোড়া, উটে চড়ে সোনা রূপায় সেজে, তুরী, ভেরী, নিশান, ছত্র, বল্লমসহ সুসজ্জিত হয়ে ভুতেশ্বর মন্দিরে যান। সেখানে সারাদিন ধরে ভারী চমৎকার নৃত্য চলে। এখানকার রাজার সোনা ও লবণের আকর (খনি) আছে তাই তিনি সমৃদ্ধশালী। 


মান্ডি থেকে বিয়াস নদী নৌকায় পার হয়ে অতি ভয়ানক চড়াই উৎরাই পার হয়ে তারপর গৌরী নদী (উহল নদী) পার হয়ে কুমাদের হট্টি (কুমান্দ), বাউড়ি প্রভৃতি হয়ে যাত্রা। বাউড়িতে একপ্রকার মাছি আছে, কামড়ালে রক্ত পড়ে ও ক্ষতস্থান ফুলে ওঠে। ক্ষতের যন্ত্রণা সহজে সারে না। সেখানে অতি কষ্টে রাত্রি বাস। এইভাবে অত্যন্ত কষ্টকর পথে চড়াই উতরাই পথ চলতে চলতে বেজওর (বাজৌরি) এল। এটি কুলু রাজধানী। এখানে রাজার ভগ্নপ্রায় কেল্লা আছে। এখান থেকে আট ক্রোশ পূর্বে পান্ডবদের স্থাপিত এক শিবমন্দির আছে। আর আছে মহিষমর্দিনী, চতুর্ভুজ নারায়ণ, গনেশ মন্দির। 


এরপর মশকে অর্থাৎ বড় বড় চামড়ার থলিতে হাওয়া ভরে তৈরি এক ধরনের বয়ার মতো বস্তুতে চড়ে বিয়াস নদী পার হতে হলো। এল পার্বতীয় নদী (পার্বতী নদী) ও ব্যাসানদীর( বিয়াস নদী) সঙ্গম। দুর্গম পথ পেরিয়ে বামুনকোঠী (সম্ভবত ভুনটার) আসা হলো। এখানে পাহাড়ি নারী-পুরুষ সকলের কম্বলের বস্ত্র পরিহিত, তারা সবাই মাছ-মাংস খায়। বৃষ্টি বরফপাতের মধ্যে অনেক বাদানুবাদ করে একটি ঘরে লেখকেরা আশ্রয় নিলেন। পরদিন আবার নদী পার হয়ে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে জরিগ্রাম (জরি) হয়ে এবারে তাঁরা পৌঁছলেন মণিকর্ণ তীর্থ (মণিকরণ)।
                      
                      ( চলছে )

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২১ ফাল্গুন ১২৬২ (৫ মার্চ ১৮৫৬) থেকে ৫ চৈত্র ১২৬২ (১৯ মার্চ ১৮৫৬ )



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০২৪

২৮। তীর্থ ভ্রমণ ১৩ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

     

   সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ            ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

আবার নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী। বৃন্দাবন থেকে প্রথমে এলেন চৌমুয়া (চৌমুহান)। সেখানে রাস্তার পূর্বদিকে কোম্পানির শাসন আর পশ্চিম দিকে ভরতপুর, জয়পুর প্রভৃতি রাজাদের শাসন। যেসব রাজারা স্বাধীনতা রেখেছেন তাঁদের নুন, আফিম, ভাঙ, চরস, গুড় ইত্যাদি নিজ রাজ্যে আনার জন্য কোম্পানিকে মাশুল দিতে হয়। বিনা মাশুলে যাতে কোন দ্রব্য যেতে না পারে তা দেখার জন্য কোম্পানি এখানে চৌকি ঘর বানিয়েছে। সাওয়া গ্রাম (?), কুশী (কোশী), হোড়েল গ্রাম (হোদল), পরওল গ্রাম (পলওয়াল) হয়ে বল্লভগড় পৌঁছলেন তিনি। বল্লভগড় ভরতপুর রাজার রাজ্য। এখানে কেল্লা, রাজবাড়ি আছে। এই শহর থেকে রাজা দিল্লি যাওয়ার নতুন রাস্তা তৈরি করছেন। সেখান থেকে ফরিদাবাদ গিয়ে বাদশাহী সরাইয়ে রাত্রিবাস করা হলো। ফরিদাবাদ (হরিয়ানায় অবস্থিত) থেকে পাঁচ ক্রোশ গিয়ে দিল্লি এলো।


কাবুলি দরজা দিয়ে পুরনো কেল্লার মধ্যে প্রবেশ করে লালদীঘি ও আরো কিছু কিছু দ্রষ্টব্য স্থান দেখলেন কিন্তু লাহোর দরজা ও দিল্লী দরজায় দুই পল্টন কোম্পানি সিপাই আছে দেখে এখানকার নিয়ম কানুন না জানায় ভীত হয়ে লেখক ভিতরে যাবেন কিনা এই বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হলেন। অবশেষে দিল্লি দরজার প্রহরীকে বাংলা থেকে দেশ ভ্রমণের জন্য এসেছেন ও দিল্লি শহর দেখার অত্যন্ত বাসনা এই কথা জানানোয়  প্রহরী তাঁকে প্রবেশের অনুমতি দেয়। তারপর তিনি নহবত খানা, বাজার প্রকৃতি দেখলেন। দেওয়ানী আমের দরজায় খোজা দ্বারপালেরা ছিল। তাদের অনেক অনুরোধ করে একজনকে সঙ্গে নিয়ে তখত ও আরো কিছু স্থান দেখলেন। কেল্লা থেকে বের হয়ে জুম্মা মসজিদ, অন্যান্য মসজিদ, বাজার, বিশেষত বত্রিশ বাজার দেখে লাহোর দরজার রাস্তায় দেখলেন হিন্দু-মুসলমান, ধনীরা গাড়ী ,পালকি, ঘোড়া, হাতি, দুলি, দোলা চড়ে ভ্রমন করছে। কোথাও নাচ গান বাজনা হচ্ছে। 


পরদিন আবার পরবর্তী গন্তব্যের পথে বেরোলেন। বর্তমান হরিয়ানার পানিপথ, করনাল হয়ে থানেশ্বর (থানেসার) পৌঁছলেন চার দিনে। এখানে কুরুক্ষেত্র তীর্থ, কুরুপান্ডবের যুদ্ধস্থান। কুরুক্ষেত্রের পরিক্রম করলে আশি ক্রোশ পথ পরিক্রম বা আট চল্লিশ তীর্থ দর্শন করতে হয়। 


লেখক থানেশ্বর শিব, জ্যোতিশ্বর শিব দর্শন, লক্ষ্মীকুণ্ডে স্নান করলেন। চার ক্রোশ দূরে চক্রব্যূহে, যেখানে অভিমন্যুকে সপ্তরথী বধ করেন, সেই ব্যুহের ইঁট এখনো আছে বলে লেখক লিখেছেন। যেখানে ভীষ্মের শরশয্যা হয়েছিল সেখানে এক কুণ্ড আছে। সেটিকে ভীষ্মকুণ্ড বলে। অর্জুন ভীষ্মকে শরশয্যায় শায়িত অবস্থায় বান ছুঁড়ে মাটির তলা থেকে গঙ্গার জল তুলে ভীষ্মকে খাইয়েছিলেন। সেই স্থানে একটি কূপ তৈরী হয়ে গেছিল, যাকে বানগঙ্গা বলা হয়। কর্ণখেড়া নামক স্থানে কর্ণ প্রতিদিন স্নান ও স্বর্ণদান করতেন। লক্ষীকুন্ড হলো সেই স্থান যেখানে কুরুপান্ডবের যুদ্ধের সময় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের রথের ঘোড়াদের জল পান করানোর জন্য সরোবর সৃষ্টি করেছিলেন। এখানে লক্ষ্মী, নারায়ণ, শিব ও কালীর মন্দির আছে। এই কুণ্ড হিন্দুদের মহাতীর্থ। আওরঙ্গজেব বাদশা এই তীর্থ লোপ করার জন্য নানারকম চেষ্টা করে শেষে ওই কুন্ডের ওপর সেতু বেঁধে দ্বীপের মধ্যে এক কেল্লা ও মসজিদ তৈরি করে দেন। কেল্লাতে সৈন্যরা নিযুক্ত ছিল এবং তাদের দায়িত্ব ছিল হিন্দুরা যাতে জলস্পর্শ করতে না পারে তার জন্য পাহারা দেওয়া। কিছুদিন হল দাক্ষিণাত্যের পুণা-সেতারার রাজা অমৃতরায় এসে বাদশাহের সঙ্গে যুদ্ধ করে এই তীর্থ মুক্ত করেছেন। পরে ওই রাজ্য শিখদের অর্পণ করে তিনি স্বদেশে চলে যান। তখন থেকে রঞ্জিত সিংহের সময় পর্যন্ত হিন্দু রাজ্য অথবা শিখরাজ্য ছিল। পরে ইংরাজের অধিকারে যায়। এখন আর তীর্থলোপের সম্ভাবনা নেই বরং ক্রমে তীর্থ উদ্ধারের বিশেষ ব্যবস্থা হচ্ছে। কুরুক্ষেত্রের মৃত্তিকার রক্ত বর্ণ বৃষ্টি হলে মনে হয় রক্ত। অস্থিপুরা নামে যে তীর্থ আছে তাতে যুদ্ধে হতদের সৎকার হয় এবং কুরুকূল বধূরা সেখানে সহমৃতা হন। চক্রতীর্থ সেই স্থান যেখানে যুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেন না বলে শ্রীকৃষ্ণ সুদর্শন চক্র রেখে দেন। দুর্যোধনটিলার কাছে দুর্যোধনের শিবির ছিল। এই সব তীর্থস্থান দর্শন করা ছাড়াও লেখক থানেশ্বর শহর ভ্রমণ করলেন। শহরের রাস্তা, নর্দমা সব ইঁট বাঁধানো। সেকাচিল্লির কেল্লা দেখলেন, তাতে পাথরের ভালো কাজ ছিল কিন্তু এখন ভগ্ন প্রায়। ওই মিনারে উঠলে কুরুক্ষেত্রের সকল অংশ দেখা যায়। 


বেশ কিছুদিন কুরুক্ষেত্রে কাটিয়ে এবার তিনি পিপলি, সাহাবাদ হয়ে আম্বালায় এলেন। সেখানে তখন ইংরেজদের সেনা ছাউনি ছিল। প্যারেডের মাঠে সৈন্যদের যুদ্ধ শিক্ষা হচ্ছিল। এই চাউনিতে কালা অর্থাৎ দেশীয় সিপাই ছিল তিন পল্টন। তারপর রামপুরা (রামপুর, পাঞ্জাব), সরহিন্দ (সরেন্দা), লস্করের সরাই (সরাই বানজারা) হয়ে এলো লুধিয়ানা (লুধিয়ানা,পাঞ্জাব)। এখানে পশমের বস্ত্র তৈরি ও বিক্রি হয়। এটি বড় শহর। ম্যাজিস্ট্রেট, কাছারি, ডাকঘর, ডাক্তার-খানা আছে। লুধিয়ানা থেকে সাটলেজ(শতদ্রু নদী) নৌকার পুলে পার হয়ে রাজা রঞ্জিত সিংহের দুর্গ ফোলবের (ফিলোউর) আসেন। সাহেবদের সেনা ছাউনি আছে এখানে। এরপর ফাগুওয়াড়া শহর (ফাগওয়ারা), হরেলা (?), হুশিয়ারপুর (হোসিয়ারপুর) হয়ে বাহাদুরপুরে (?) এসে রাজা রনজিত সিংহের গুরু নানকের গদি দেখলেন। এবার লেখক জোয়ালজি অর্থাৎ জ্বালামুখী (বর্তমান হিমাচল প্রদেশে অবস্থিত তীর্থস্থান) গমনের উদ্যোগ নিলেন।

                    ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২০ মাঘ ১২৬২ (৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬ ) থেকে ২০ ফাল্গুন ১২৬২ (৪ মার্চ ১৮৫৬ )



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!


২৭। তীর্থ ভ্রমণ ১২ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


   সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ            ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                    (আগের পর্বের পরে)

মাসখানেক বৃন্দাবনে থেকে জন্মাষ্টমীর পরে লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী এবার দ্বাদশ বন পরিক্রমণ বা ৮৪ ক্রোশ পরিক্রমণে বের হলেন। প্রথমে দেখলেন ভোজনটিলা এখানে শ্রীকৃষ্ণ রাখালদের সঙ্গে মুনিদের কাছে অন্নভিক্ষা করে ভোজন করেছিলেন। টিলার উপরে একটি মন্দির, মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণ গোষ্ঠের বেশে বিরাজ করছেন। তারপর এলো অক্রূর ঘাট। শ্রীকৃষ্ণ-বলরামকে কংস রাজার কাছে মথুরায় নিয়ে যাওয়ার সময় যমুনার তীরে রথ রেখে অক্রূর এখানে যমুনা নদীতে স্নান তর্পণ করেছিলেন। এখানে মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণ, বলদেব ও অক্রূরের মূর্তি আছে। এরপর এলো ভূতেশ্বর শিব এবং পাতালদেবী বা মাহেশ্বরী দেবীর মন্দির। 


তারপর এলো মধুবন। এই বনে কৃষ্ণকুণ্ড নামক পুষ্করিণীতে স্নান তর্পণ করে মধুবিহারী ঠাকুরের দর্শন করে দুই ক্রোশ দূরে তালবনে যাওয়া হল। তারপর কুমুদবনে কুমুদবিহারী ঠাকুর, কুমুদকুন্ড, কপিলমুনির মন্দির দেখে মধুবনে এসে থাকা হল। পরদিন শান্তনুকুন্ডে স্নান করে শান্তনুবিহারী ঠাকুর দর্শন করে বেহুলা বনের বেহুলাকুন্ড ও বেহুলা গাভী দর্শন এবং রাধা কৃষ্ণ মন্দির দর্শন করে ওই বনে রাত্রিবাস। তারপর দিন অষ্টসখী কুন্দ দর্শন এবং শ্যামকুণ্ড ও রাধা কুণ্ড আর তমাল বৃক্ষের নীচে রাধাকৃষ্ণের চরণচিহ্ন সম্বলিত বেদী দর্শন করলেন। এখানে ভক্তদের থাকার অতিথিশালা আছে। কুন্ডে অনেক মাছ ও কচ্ছপ আছে, কেউ তাদের মারে না। বনে ময়ূর ও বানর আছে অনেক। 


এরপর গোবর্ধন পর্বত পরিক্রমে যাত্রা করলেন লেখক। গোবর্ধন পর্বত বৃহৎ কিন্তু তেমন উঁচু নয়। ঘাস, বৃক্ষলতায় ঢাকা। পাহাড়ের উপর গোপালের মূর্তি আছে। ভরতপুরের রাজা গোবর্ধন পর্বতে অনেক দেবতার সম্পত্তি দান করেছেন। গোবর্ধন পর্বতে কুসুম সরোবর টিলা ও কুণ্ড নারদ কুন্ড, ভানু কুণ্ড, মানসী গঙ্গা, চক্র তীর্থের ঘাট, রূপ সনাতন গোস্বামীর ভজন কুটির (এখানে শ্রীচৈতন্যদেব এসেছিলেন), ব্রহ্ম কুণ্ড, পাপ মোচন ইত্যাদি অজস্র তীর্থস্থল আছে, লেখক সব একে একে দর্শন করলেন। 


এবার গোবর্ধন থেকে দীগ গ্রাম বা লাঠাবনে এলেন। এখানে ভরতপুরের রাজার বাড়ি রয়েছে। সেই রাজবাড়ী অত্যন্ত সুসজ্জিত। রাজবাড়ীর অতিথিশালায় যাত্রীদের বসবাসের বন্দোবস্ত আছে। 


দীগবন থেকে কাম্যবনে এলেন। সেখানে বিমল কুন্ড ও বিমলা দেবী দর্শন করলেন। পরদিন কাম্যবনের যশোদা কুন্ড, সূর্যকুন্ড, লুকলুক কুন্ড, চরণ পাহাড়, কৃষ্ণকুণ্ড দেখলেন। শ্রী গোবিন্দজি, গোপীনাথজি ও মদন মোহনজির মন্দির দেখলেন। গোবিন্দজির মন্দিরের দুপাশে বৃন্দাদেবী ও জগন্নাথ দেবের মন্দির। যুধিষ্ঠিরের বনবাসের যজ্ঞস্থান চৌরাশি স্তম্ভের গৃহ এবং পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদীর মূর্তি দেখলেন। ঔরঙ্গজেব বাদশাহের দৌরাত্বের সময় বৃন্দাবনের সকল দেব-দেবীর মূর্তি কাম্যবনে রাখা হয়েছিল। 


কাম্যবন থেকে আসা হলো বরসান। সেখানে দেহকুণ্ড, বৃষভানু কুন্ড, নারায়ণীজি মন্দির, অষ্ট সখীর কুন্ড প্রভৃতি দর্শন করা হলো। বরসান থেকে নন্দগ্রাম যাওয়ার পথে সংকেত বট ও যোগমায়া দেবীর মূর্তি দেখে নন্দ গ্রামে পৌঁছে নন্দ ঘোষের বাসস্থান, পাহাড়ের উপরে নন্দ, যশোদা, কৃষ্ণ, বলরাম মূর্তি, ঐরাবত কুণ্ড, কেলি কদম্ব বৃক্ষ, পবন সরোবর দেখা হল। 


নন্দ গ্রাম থেকে শ্বাসকুন্ড, কদম্বখন্ডি, সূর্য কুন্ড, কিশোরী কুণ্ড, জাবট, রাসস্থলী, খদির বন দেখে কোকিল বনে আসা হলো। কোকিল বনে কোকিল বিহারী ঠাকুর আছেন। 


তারপর শেরশায়ীতে বিষ্ণুর অনন্ত শয়নে মূর্তি ও ক্ষীরোদ সাগর নামক পুষ্করিণী দেখলেন। এরপর এলেন সে। সেখানে গোবিন্দজি, গোপীনাথজি, মদনমোহনজির দেবালয় দর্শন করলেন।

 

এর পরের গন্তব্য নন্দঘাট। সেখানে শ্রীজীব গোস্বামীর ভজন কুটির আছে। প্রথমে ভদ্রবন ও পরে ভাণ্ডীর বট দেখলেন, এটি গোপালের গোচারণ ক্ষেত্র। 


এরপর বেলবন, পানিঘাট, আন্দি নান্দি বন হয়ে বলদেব এলো। এই স্থানের পান্ডারা অতি চতুর, প্রতারক, ছলেবলে যাত্রীদের সর্বনাশ করে। 


পরের গন্তব্য মহাবন বা গোকুল, যা নন্দ ঘোষের বাড়ি। নন্দ ঘোষের বাড়ি একটি উঁচু টিলার উপর অবস্থিত। তখন ওই বাড়িতে তহশিলদারের কাছারি। সেই বাড়িতে লেখক গোপালের স্মৃতি বিজড়িত সব স্থান দেখলেন। 


এই স্থানের তিন ক্রোশ উত্তরে রাওল গ্রাম যা বৃষভানু রাজার বাস অর্থাৎ রাধারানীর জন্মস্থান। 


এইসব দর্শন করে কোগ্রামের কাছে যমুনা পার হয়ে নওরঙ্গবাদে উঠে মথুরায় এলেন। 


এই পরিক্রমণের সময় লেগেছিল প্রায় ১৫ দিন এবং ৮৪ ক্রোশ অর্থাৎ প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পরিক্রমণ করেছিলেন লেখক। বৃন্দাবন পরিক্রমণ আজও বহাল থাকলেও এই স্থানগুলির বেশিরভাগই অধুনালুপ্ত।

                      (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১২৬২ (৭ জুন ১৮৫৫ ) থেকে ১৯ মাঘ ১২৬২ (২ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬ )



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৪

২৬। তীর্থ ভ্রমণ ১১ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ            ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                   (আগের পর্বের পরে)


ভীমগড়া থেকে গৌরীকুন্ড, ঝিলমিল চটি হয়ে অসিমঠ (ঊষামঠ বা উখীমঠ) এলো। এটি কেদারনাথের শীতকালীন গদি, ছয় মাস এখানে পূজা হয়। এখানে বাজার আছে। এখানকার কেদারনাথের মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির দর্শন করা হলো। এরপর পুথিবাসা, বামনীচটি, ক্ষেত্রপাল-এর চটি, গরুড়গঙ্গা, কুমারচটি এবং বিষ্ণুপ্রয়াগ হয়ে যোশীমঠ এলেন অষ্টম দিনে। যোশীমঠ বদ্রীনারায়ণের শীতকালীন গদি। এখানে ছয় মাস তাঁর পূজা হয়। এখানে লক্ষ্মীনারায়ণ ও হরগৌরী দর্শন করা হল। এখানে বদ্রীনারায়ণের ধর্মশালা আছে। যোশীমঠ থেকে আট ক্রোশ দূরে পান্ডুকেশ্বর। সেখানে পাণ্ডবদের স্থাপিত শিব আছেন। এছাড়া চতুর্ভুজ নারায়ণও দর্শন করলেন। এবার মউজ চটি হয়ে আট ক্রোশ চড়াই গিয়ে তৃতীয় দিনে (কেদারনাথ থেকে দ্বাদশ দিনে) বদ্রীনারায়ণের পাহাড়। শেষ চার ক্রোশ বরফের মধ্যে দিয়ে চলতে হল। অলকানন্দার ওপর কাঠের পুল পেরিয়ে এক বৈরাগীর বাড়িতে থাকা হল। সেখানে অসহ্য শীত। 


তপ্তকুন্ডে স্নান করে বদ্রীনারায়ণের দর্শনে যাওয়া হল। তপ্তকুন্ডের পরিসর কুড়ি হাত দীর্ঘ, ষোলো হাত প্রস্থ। কুন্ড প্রস্তর নির্মিত ঘরে আচ্ছাদিত। ঝর্ণা থেকে গরম জল এসে ঘরে পূর্ণ হচ্ছে। গরু, সিংহ, হাতি ও বাঘের মুখ দিয়ে জল কুণ্ডে পড়ছে। বদ্রীনারায়ণ দ্বিভুজ, অতি চমৎকার দর্শন। এই মূর্তি কেউ স্পর্শ করতে পারেনা। চার স্তরে তৈরি মন্দিরের দ্বিতীয় স্তর থেকে বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হলে তৃতীয় স্তর থেকে দেবদর্শন করতে হয়। মন্দিরের মধ্যে অনেক অন্য দেবদেবী, মুনি ঋষির মূর্তি আছে। 


বদ্রীনাথের মহাপ্রসাদ (অন্নভোগ) বাজারে কিনে গ্রহণ করা যায়। ব্রহ্মকপাল নামক স্থানে পিণ্ডদান করা হলো। সেই দিন এক প্রহরের সময় সূর্য গ্রহণ হয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তপ্তকুণ্ড, সূর্যকুন্ড, নাগরাজকুন্ড, ঊর্ধ্বরেতকুন্ড, বিষ্ণুকুন্ড ও সঙ্গমস্থল এইসব স্থানে স্নান করা হল। নাগরাজকুন্ডে স্নান করা অত্যন্ত কঠিন। দুটি পাথরের মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গের মতো স্থান দিয়ে নামতে গিয়ে অলকানন্দার জলে পড়ে দেহত্যাগের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। বদ্রীনাথের মন্দির থেকে তিন ক্রোশ দূরে সহস্রধারা ঝর্ণা। বদ্রীনাথ বাজারে বেশ কিছু দোকান ও মানুষের থাকার জায়গা আছে। জিনিসপত্র বহুদূর থেকে আসে তাই দুর্মূল্য। 


এখানে লেখক ভোট রাজ্যের কথা বলেন। এখান থেকে ভোট রাজ্য নয় দিনের পথ। উত্তর-পশ্চিম দেশ। ভোটে যাওয়া আসা করা যায় তবে সহজে যাওয়া যায় না। অত্যন্ত বরফময় সেই পথে পশমের জামা, ভোটের জুতো পরে তবে যাওয়া যায়।সেখানে নারী-পুরুষ সবাই মদ ও মাংস খায়। ভোটে কুকুর, ঘোড়া, চমরী গাই ভালো পাওয়া যায়। স্ত্রী লোকেরা সেখানে অত্যন্ত বলবান ও পরিশ্রমী হয়। এই ভোটে তিনি যাননি, হয়তো বদ্রীনাথে এদেশের কথা শুনেছিলেন। কিন্তু এটি কোন দেশ? খুব সম্ভবতঃ তিব্বতের কথা বলেছেন লেখক। 


দুই রাত বদ্রীনারায়ণে থেকে, পূজা, দর্শন, ব্রাহ্মণ ভোজন ইত্যাদি করে এবার সকলের ফেরার পালা। পান্ডুকেশ্বর, কুমাচটি, যোশীমঠ, গরুড়গঙ্গা, পিপড় কুঠি (পিপল কোট), ক্ষেত্রপাল, নন্দপ্রয়াগ হয়ে আদিবদ্রী দর্শন করা হলো। এরপর এলো গোবিন্দকুঠী। এখান থেকে দশ ক্রোশ পাহাড়ি পথে আলমোরা যাওয়া যায়। ওই পাহাড়ে কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি, ডাকঘর, সেনা ছাউনি আছে। পাহাড়ের মধ্যে শহরের মতো সব কিছু পাওয়া যায়। এরপর কর্ণপ্রয়াগ, সেখানে সঙ্গমে স্নান করে কর্ণ মুনির আশ্রম দেখলেন। এখানে বাজারে অনেক রকম জিনিস পাওয়া যায়। কাঠের একটা পুল হয়েছিল পারাপারের জন্য কিন্তু সেটা ভেঙে যাওয়ায় তখন ঝোলাপুলই ভরসা। এরপর শিমকুঠী হয়ে মেলচৌরী। এখানে পূর্বের ঝাপান ও কান্ডিওয়ালারা বিদায় নিল। তারা অনেক অনুরোধ সত্বেও আর নীচে নামতে রাজি হলো না কারণ তারা বরফের দেশের মানুষ, গরম তাদের সহ্য হয় না।


মেলচৌরী থেকে আবার নতুন ঝাপান ও কান্ডি নেওয়া হল। এরপর এলো লোহাগড় (লোহাঘাট)। এখানে পাহাড়ে লোহার আকর আছে ও লোহা গলানোর স্থান আছে। এবার তাঁরা এলেন বুড়া কেদারে। এখানে কেদারনাথ আছেন কৌশল্যা নদীর পূর্ব পাড়ে। এরপর কানাগির চটি হয়ে কৌশল্যা নদীর পাড় দিয়ে পথ, সাত বার নদী পার হতে হলো। নদীতে খুব স্রোত, জলের মধ্যে পিছল পাথর, পা পিছলে জলে পড়লে ভেসে যেতে হবে। সে রাতে পাহাড়ের উপর বনের ধারে আগুন জ্বালিয়ে থাকা হলো। তারপর ক্রমে ক্রমে এলো ঢিকলি, রামনগর, চিনখা, কাশীপুর। কাশীপুরে ভালো ভালো বাড়ি ঘর, বাজার আছে, আছে তহসিলদার ও কোতোয়ালের কাছারি। আগে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার, কালেক্টর-এর কাছারি ছিল। এখন সেসব আট ক্রোশ দূরে নৈনিতালের পাহাড়ে চলে গেছে। এই পাহাড়ে নৈনিতাল ( নৈনি দেবী) নামে দেবী আছেন। আর আছে এক কুণ্ড। সেই কুণ্ডে স্নান, দেবী দর্শন ও তালেশ্বর ভৈরব দর্শন করা হয়। ছাউনি থেকে দুই ক্রোশ উপরে অতি মনোরম স্থান দেবদেবী কুন্ড। এখানে বাঙালি বাবুলোকেরা আছেন। আগে বিকট পথ এবং হিংস্র পশুর  ভয়ে মানুষ যাতায়াত করতে পারত না। এখন কাছারি ও সৈন্যরা থাকাতে ভালো পথ হয়েছে বলে মানুষ অনায়াসে যাতায়াত করছে। 


এরপর কাশীপুর থেকে সম্বলমুরাদাবাদ চোদ্দ ক্রোশ (প্রায় ৪২ কিলোমিটার) একদিনে তাঁরা পাড়ি দিলেন। সম্বলমুরাদাবাদ থেকে গরমের জন্য রাতে হেঁটে যাত্রা করা শুরু হলো। এখানে রাতে যাতায়াতে কোন ভয় নেই। কেউ কাউকে হিংসা করে না। চলতে চলতে কারো ঘুম পেয়ে গেলে সে গাছের তলায় কাপড় পেতে ঘুমায়, পরে সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হয়। তাই কারো পথ চলতে ক্লান্তি হতো না। তারপর শিরসা থেকে গোমা চোদ্দ ক্রোশ। তারপর দানপুর হয়ে কোয়েল এল। কোয়েল শহরে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর, সদরআলা, সদর আমিন, মুন্সেফের কাছারি আছে। সৈন্যদের ছাউনিতে যুদ্ধের জন্য সর্বদা প্রশিক্ষণ চলেছে। বাজারে নানা রকম দ্রব্যের অনেক দোকান আছে। কালিবাড়ি আছে বাঙালি বাবুদের। কোয়েল থেকে বেশরা, মানসরোবর, মাঠগ্রাম হয়ে যমুনার কেশীঘাটে নৌকায় পার হয়ে বৃন্দাবন ফেরা হলো ২৪ জৈষ্ঠ্য, ১২৬২ তারিখে।

 

বদ্রীনাথ থেকে কুড়ি দিন লাগলো পদব্রজে বৃন্দাবন আর হরিদ্বার থেকে কেদার-বদ্রী হয়ে বৃন্দাবন পৌঁছাতে প্রায় সাত সপ্তাহ লাগল। সেদিন বৃন্দাবনের শ্রীজিউদের মন্দির দর্শন করে, পরিচিত বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাসায় এসে বহুদিন পর শান্তিতে সবাই নিদ্রা গেলেন। হিংস্র জন্তু অধ্যুষিত পাহাড় জঙ্গলে ভ্রমণকালে কারো বিশ্রাম হয়নি বললেই চলে। খাওয়া অনিয়মিত ও অনভ্যস্ত খাদ্যদ্রব্য। বালুকাময় পার্বত্য রুক্ষ পথ, কাঁটাযুক্ত বনে হাঁটায় পা ক্ষতবিক্ষত। দেহ অস্থিচর্ম-সার হয়েছে। গায়ের চামড়া রোদে পুড়ে গেছে। কিন্তু এত কষ্ট করার ফলে উত্তরাখণ্ডের শ্রেষ্ঠ তীর্থগুলো দেখা হয়েছে। নানা দেশ ঘোরায় নানা মানুষ দেখা ও তাদের ব্যবহার অনুভব করা যায়। পাহাড়ের মানুষ সত্যবাদী, কখনো মিথ্যা বলে না, চুরি, অপহরণ, বিশ্বাসঘাতকতা জানে না। সকলে পরিশ্রম করে দিনযাপন করে। স্ত্রী লোকেরা ক্ষেতিকর্ম করে, পুরুষ কেবল হাল করে জমি তৈরি করে দেয়। পর্বতে অকাল মৃত্যু নেই, তাই অল্প বয়স্কা কোন বিধবা নেই। মাছ মাংস সবাই খায়। পরিধেয়, কম্বল, আভরণ তারা আপন শ্রম দিয়ে সংগ্রহ করে। স্ত্রী লোকেরা ভ্রষ্টা নয়। তাদের কোন দ্বিধা সংকোচ নেই। তারা একা পাহাড়ে বনে ঘুরে বেড়াতে পারে। যাদের গায়ে দামি গয়না তারাও কাঠের বোঝা পিঠে বেঁধে বিক্রি করছে। বৈভব থাকা সত্ত্বেও তারা কেন এই কাজ করে জিজ্ঞেস করাতে তারা বলে যে এই গয়না তারা শ্রমের দ্বারাই করেছে, কাজ করেই তারা আহার করে, রাজস্ব দেয়, আভরনও পারলে কেনে। এছাড়া নারীরা ঝরনা, নদী বা কুয়ো থেকে জল আনা, আটা পেষাই, গবাদি পশু দেখাশোনা, সন্তান প্রতিপালন সবই করে। কেদারনাথ বদ্রীনাথ যাবার পথে চারদিকে কত ফুলের শোভা দেখেছেন - গোলাপ, কুন্দ, শেফালী, করবী, জবা এবং নানা রকম পার্বত্য ফুলের সুবাসে পাহাড় সব সময় কেমন সুরভিত থাকে - এসব স্মৃতি রোমন্থন করেন লেখক। আর মন্তব্য করেন যে পর্বতে ভ্রমণ করলে দুঃখ, ক্লেশ, মায়া, মোহ কিছু থাকে না।

                    (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৫ বৈশাখ ১২৬২ (৮ এপ্রিল ১৮৫৫) থেকে ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১২৬২ (৬ জুন ১৮৫৫)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...