মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪
৪৭। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১১ ভোলানাথ চন্দ্র
বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪
৪৬। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১০ ভোলানাথ চন্দ্র
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
৪৫। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৯ ভোলানাথ চন্দ্র
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
পরবর্তী দর্শনীয় স্থান ডুমরি (বর্তমান ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত)। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জায়গাটির মত বন্য ও উঁচু নীচু কোন জায়গা লেখক আগে দেখেননি। পাহাড়, উপত্যকা, গিরিখাত, গুহার যেন শেষ নেই এখানে। চতুর্দিকে কত সহস্র ধরনের গাছপালা, যার প্রতিটি অচেনা। যদিও এখন জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা কমে গেছে তবুও পথের প্রতিটি বাঁকেই আশঙ্কা হয় যে তাদের সঙ্গে দেখা হবে। কিছুদিন আগেও এই পথে বাঘের হাতে মারা গেছে মানুষ। সরকার ২ বা ৩ মাইল অন্তর অন্তর চৌকি আর সরাই তৈরি করে দিয়েছেন ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তার জন্য। এই রাস্তায় মাচানের উপর থেকে রাতে পাহারাদারের পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ভ্রমণকারীর নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত করতে ভারতের পক্ষে সে এক দারুন দিন হবে, যেদিন শেষ বাঘটিকে মেরে তার দেহ আগামী পুরুষদের কৌতুহল মেটানোর জন্য সংরক্ষণ করা হবে। (বর্তমান ব্যাঘ্র তথা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকারী মানুষেরা লেখকের এই বক্তব্য শুনলে যে কঠিন প্রতিক্রিয়া জানাবেন লেখকের সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না বোঝা যায়)।
কুড়ি মাইল ব্যাপী একটানা পাহাড়ের পরে এল এক উপত্যকা। এক সারি কুঁড়েঘর নিয়ে তৈরি এক সরাই (সরাইখানা) এল। সেখানে লেখকেরা স্নান ও প্রাতরাশ করলেন। তারপর আবার চলা শুরু। আবার পাহাড়ের দেখা পাওয়া গেল। সঙ্গের একটি ডাকগাড়ি একটি মারাত্মক দুর্ঘটনার হাত থেকে কোনক্রমে বাঁচল। গাড়িটি পাহাড়ের রাস্তায় বাঁক নেওয়ার সময় গড়িয়ে খাদে পড়ে যাচ্ছিল। দিন শেষ হয়ে আসছে। পাহাড়ের সূর্যাস্ত অনন্য। পাহাড়ের আড়ালে সূর্য ডুবে যেতেই মাটিতে লম্বা ছায়া পড়ে যায়। হঠাৎ সবকিছু অন্ধকারে ডুবে যায়।
রাতে তাঁরা বেলকুপি পৌছালেন (বেলকাপি, ঝাড়খন্ড)। এখানে রাস্তার ধারে কয়েকটা উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। এক ব্যক্তি তাঁদের সেগুলি দেখাতে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু এক সহযাত্রী বললেন এই রাতে সেগুলি দেখতে যাওয়া মানে বাঘের মুখে পা দেওয়া। (সূরযকুন্ড, রামকুন্ড, সীতাকুন্ড, লক্ষণকুন্ড, ব্রহ্মকুন্ড - এই উষ্ণ প্রস্রবণগুলি বেলকাপি, বারহী মহকুমায় রয়েছে)।
এবার এলো বুড়াকাট্টা (বোড়হাকাটা, ঝাড়খন্ড) নামের স্থান, যেটি সম্ভবত প্রাচীনকালে বৌদ্ধ বা জৈনদের ধর্মস্থান ছিল। এখন সেখানে আম, বট, অশ্বত্থের ভালো ভালো গাছ আছে আর ক্ষীণধারা নদী আছে।
বারহি (ঝাড়খন্ড) গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড-এর উপর অবস্থিত একটি প্রধান শৈল শহর। কিন্তু লেখকেরা অনেক রাতে সেখানে পৌঁছানোতে কিছু দেখতে পেলেন না।
এরপর এল ডানওয়া পাস (pass)। এবার পাহাড় বেয়ে উঠতে কুলিদের গাড়ি ঠেলে তুলতে হলো। এই পাসটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫২৫ ফুট উঁচু। এরপর পাহাড়ি পথ শেষ হল, এল সমতল ভূমি।
তাঁরা বরাক পৌঁছালেন। সেখানে একটি বাংলো ও আরেকটি সরাই আছে। এখানে জলের খুব অভাব। চাষবাস প্রায় নেই। মানুষদের চুল ও চেহারা অপরিচ্ছন্ন। মেয়েরা মাথায় কলসি নিয়ে সারাদিন জল সংগ্রহের যায় আর আসে। তাদের কপালে সিঁদুর আর সারি দিয়ে পয়সা ও পুথির মালা সাজানো। লেখকদের প্রাতরাশের জন্য অনেকগুলি মুরগি জবাই হয়েছিল। সেদিন দুর্গাপূজার নবমী, দূরে বাংলায় তাঁদের আত্মীয় বন্ধুরা সেদিন ছাগল-মোষ বলি দিয়ে দুর্গা পূজা করছে আর এখানে লেখকেরা মুরগি বলি দিলেন। (এটি অবশ্যই লেখক বঙ্গাত্মকভাবে বলেছেন)। সঙ্গের ডাক্তারটি এখানে একটি শিশুর চিকিৎসা করলেন। এখানে ২০০ দোকান আর কুঁড়েঘর আছে রাস্তার দু'পাশে মুখোমুখি দুটি সারি। মোট ৩০০ কি ৪০০ মানুষের বাস এখানে। লীলাজন নদী দেখলেন, তাতে জল নেই বললেই চলে। এই নদীর অপর নাম ফল্গু ও নিরাজনা। ফল্গু নদী হিন্দু ধর্মের পবিত্র নদী, আর নিরাজনা বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র নদী।
এবারে রাস্তার দু'ধারে গাছের সারির মধ্যে দিয়ে এল শেরঘাঁটি (বিহার), অর্থাৎ বাঘের আস্তানা। ৫০ বছর আগে এই রাস্তায় যেতে গেলে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে বাঘ তাড়ানোর লোক সঙ্গে রাখতে হতো পথযাত্রীদের। এই প্রাচীন স্থান হয়তো অজাতশত্রু, অশোক, বুদ্ধের সময়ও ছিল। কিন্তু কি নাম তার ছিল এখন তা জানা দুষ্কর। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধি মীর জুমলা এই স্থান হয়ে শাহ সুজাকে আক্রমণ করতে রাজমহলে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। পুরনো কিছু কবর আর মসজিদ আছে শুধু পুরনো দিনের সাক্ষ্য হিসেবে।
এখান থেকে গয়া কুড়ি মাইল। ফাহিয়েন (চৈনিক পর্যটক) -এর ভাষায় গয়া হল কিয়া ইয়ে। হিন্দুদের বিষ্ণুপদের জন্য গয়া বিখ্যাত। গয়াসুর আসলে বৌদ্ধশক্তির উত্থানের প্রতীক, যাকে দমন করতে হিন্দুধর্মে দৈবশক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এটি বৈষ্ণবধর্মের কাছে বৌদ্ধধর্মের পরাজয়ের রূপক কাহিনী। গয়া ও বৌদ্ধ গয়ার বিষ্ণুপদচিহ্ন ও বৌদ্ধ পদচিহ্নের এই নৈকট্য দুটি ধর্ম গোষ্ঠীর বিরোধকে প্রকট করে। ফা হিয়েনের আগমনের আগে বিষ্ণুপদ চিহ্ন ছিল গয়ায়। গয়াতে বিপত্নীকদের বিবাহ নিষিদ্ধ। এটি হিন্দু পুরুষদের পক্ষে স্বাভাবিক নয়। এর কারণ সম্ভবত বৌদ্ধধর্মের প্রভাব। গয়ার মানুষেরা জন্মগতভাবে হিন্দু হলেও তাদের স্বভাব ও আচরণে কিছু বৌদ্ধ রীতি আছে বলে লেখক মনে করেন।
শেরঘাঁটিতে অনেক গয়ালী থাকে তীর্থযাত্রীদের নিজের কবলে আনার জন্য। তারা অত্যন্ত ঝামেলা বাধায় যাত্রীদের সঙ্গে। এছাড়া সেখানে কুষ্ঠ রোগী, অন্ধ, খোঁড়াদের গোষ্ঠী রয়েছে, তারা ভিক্ষা করে জীবন কাটায়। পুণ্য অর্জনের জন্য যে যাত্রীরা যায় তারা সবাই দান করে কারণ দান করলে স্বর্গ লাভের পথ সুগম হবে বলে তারা বিশ্বাস করে।
এরপর উমগা, মদনপুর হয়ে পথ গেছে। মদনপুর এলাকায় বাংলার পাল রাজাদের রাজত্ব ছিল কিন্তু, এখন ধ্বংসাবশেষ। সেখানে ৪০০ বছরের প্রাচীন এক ৬০ ফুট জগন্নাথ দেবের মন্দির আছে চন্দ্র বংশীয় রাজা ভৈরব ইন্দ্র প্রতিষ্ঠিত (গুগল ম্যাপ অনুসারী এটি সূর্য মন্দির, জগন্নাথ মন্দির নয়)।
এবার লেখকের দ্রষ্টব্য স্থান সোন নদী, যার প্রাচীন নাম হিরণ্যবাহ, (অর্থাৎ যা সোনা বহন করে। কথিত আছে সোন নদীর বালিতে সোনার কণা আছে)। গ্রীক পর্যটক আরিয়ান ও প্লিনী একে এরানোবোয়াস বলেছেন। নদীর অর্ধেক অংশে জল নেই। কুলিরা গাড়ি ঠেলে পার করালো। রোটাস পাহাড় দূরে দেখা যায় পটভূমিতে। এখানে লেখকের একটি পৌরাণিক কাহিনী শোনান। নরবুদা আর সোনের বিবাহ ঠিক হয়েছিল। তাঁরা হিন্দু বরকনের মত পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। নরবুদার মনে কৌতুহল হয় তাঁর স্বামী হতে চলেছে যে সোন, তাঁর সম্পর্কে খবরাখবর পাওয়ার জন্য। তাই তিনি সখি ঝোলাকে সোনের কাছে পাঠান। তখন বিবাহ করার উদ্দেশ্যে সোন আসছিলেন। ঝোলা কে দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হন সোন। নরবুদা এরপর নিজে খোঁজ নিতে গিয়ে সেই দৃশ্য দেখে ঘৃণায় পদাঘাতে সোনকে পূর্ব দিকে অর্থাৎ তিনি যেদিক থেকে আসছিলেন সেদিকে ও ঝোলাকে তাঁর দিকে পাঠিয়ে নিজে পশ্চিমে চলে যান ও সর্বদা কুমারী থাকেন। এই কাহিনী অমরকন্টক পাহাড় থেকে নির্গত হয়ে নর্মদার পশ্চিমমুখী বয়ে যাওয়া, সোনের প্রথমে কিছুটা পশ্চিমমুখী হয়ে তারপর পূর্বমুখী হয়ে বয়ে যাওয়া ও ছোট নদী ঝোলার (জোহিলা নদী) সোন নদীতে মিশে যাওয়াকে রুপক হিসেবে দেখিয়েছে।
সোন নদীর ধারে ডেহরি অবস্থিত। সোনের বাম তীরে শাহবাগ। এখানে লেখক মগধের আরো প্রাচীন নাম 'কিকাতা' ব্যবহার করেছেন।
ডেহরি থেকে রোটাস কুড়ি মাইল। কথিত আছে হরিশচন্দ্রের পুত্র রোহতাস (রোহিতাশ্ব) এই দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু বস্তুত দুর্গ এত প্রাচীন নয়। শেরশাহের তৈরি এই দুর্গে রাজা মান সিংহ সংস্কার করেছিলেন। এই দুর্গ কুনয়ার সিং আর অমর সিং কিছুদিন ধরে সিপাহী বিদ্রোহের সময় দখল করে রেখেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে লেখক আবার সিপাহী বিদ্রোহের অসারতা প্রমাণ করে দেন।
এবার এল সাসারাম। প্রায় ৩০০০ কুঁড়ে ঘর, দোকান নিয়ে বসতি। দোতলা কাঁচা বাড়ি এই প্রথম চোখে পড়ল। সাসারাম থেকে দূরে নীল পাহাড় আর ফসলে ভরা উপত্যকা দেখা যায়। শের শাহের জন্মস্থান সাসারাম দ্বিতীয় দিল্লি তো হতে পারেইনি বরং দুর্গন্ধময় সরু গলিতে, দরিদ্র মানুষের বসবাসস্থল হয়ে উঠেছে। শের শাহের পিতা হাসান খান-এর সমাধি একমাত্র এর ব্যতিক্রম। খুব সুন্দর এই সমাধি একটি উত্তম ভাস্কর্য যা এখনো প্রায় অক্ষত আছে। এই সমাধিস্থলের উপর থেকে নীচে শহরটি ভালো করে দেখা যায়। উত্তর দিকে শেরশাহের সমাধি একটি কৃত্রিম হ্রদের ধারে অবস্থিত। পিতা ও পুত্রের সমাধি দুটি একই রকম, শুধু শের শাহের সমাধিটি আরো বড় ও আরো সুন্দর। শেরশাহ নিজে তাঁর সমাধি তৈরি করে রেখেছিলেন। সমাধি ছাড়া আর কোন প্রাসাদ বা সৌধ তিনি তৈরি করে যান নি। কিন্তু চার মাস ব্যাপী পায়ে হেঁটে চলার যে পথ তৈরি করে গেছেন, তা পূর্বে বাংলার সোনারগাঁও থেকে পশ্চিমে ঝিলাম নদীর তীরে রোটাস পর্যন্ত বিস্তৃত। এখনো তাঁর তৈরি করা পাথর আর ইঁটের সরাইখানার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় জাহানাবাদে। তবে রাস্তার ব্যাপারে শেরশাহের পূর্বসূরী অবশ্যই সম্রাট অশোক, যিনি রাজপথ তৈরি করে তার পাশে আম গাছ বসিয়ে, কূপ, ধর্মশালা, হাসপাতাল তৈরি করে পথিকদের চলার সুব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
এবার লেখক ও সঙ্গীরা বেনারসের উদ্দেশ্যে চললেন। বহুদূর থেকে পথ চলতে শেরশাহের সমাধি দেখতে পাওয়া যায়, রাস্তা সমতল হওয়ার কারণে এরকম দেখা যায়। পথে পড়ল কর্মনাশা নদী। কর্মনাশা নদী ৩০০ ফুট চওড়া, বর্ষাকালে জল ৩০ ফুট বেড়ে যায়, পাড়ের বালি ২০ ফুট গভীর। হিন্দুদের কাছে কর্মনাশা নদী হল গঙ্গার সম্পূর্ণ বিপরীত সংস্করণ। এই নদীর জল স্পর্শ করলে সমস্ত অর্জিত পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। কিছুদিন আগেও মাঝিরা এই নদীতে নৌকা চালানোর সময় সতর্ক থাকতো যাতে এক ফোঁটা জলও শরীরে না লাগে। যারা নৌকায় চড়তে পারতো না পয়সার অভাবে, তারা অন্য মানুষের কাঁধে চড়ে নদী পার হত। এখন আর সেসব করার দরকার হয় না। বেনারসের ধনী হিন্দু রাজা পাটনি মলের দানশীলতায় নদীর উপর পাথরের সেতু তৈরি হয়েছে। লেখক এবার কর্মনাশা নদী সৃষ্টির পৌরাণিক কাহিনী বলেন। রাজা ত্রিশঙ্কু পূজা ও তপস্যার বলে দেবতাদের মধ্যে খুব মর্যাদা লাভ করেন। কিন্তু শিব তাঁকে স্বর্গ থেকে নিক্ষেপ করেন এবং মাঝপথে আটকে দেন। একদিকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টান, অন্যদিকে তপস্যার বলে স্বর্গের দিকে আকর্ষণের প্রভাবে তিনি মাঝখানে ঝুলে থাকেন, মাথা নিচু অবস্থায়। এই পরিস্থিতিতে তাঁর মুখ থেকে ক্ষরিত লালারস থেকে এই কর্মনাশা নদীর সৃষ্টি হয়।
লেখক একজন ইয়ং বেঙ্গলের অবস্থানের তুলনা করেছেন ত্রিশঙ্কুর সঙ্গে। বর্তমানে পূজা ও তপস্যা হলো শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন। স্বর্গের জন্য আকুতি হল বিজিত শক্তি যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করে তা পাওয়ার বাসনা। শিব এখানে উগ্র গোষ্ঠীর প্রতীক। শূন্যে ঝুলে থাকা হলো মধ্যবর্তী অবস্থান, যেখানে একজন শিক্ষিত হিন্দু ঝুলে আছে, যার একদিকে গোঁড়া দেশীয়রা ও অন্যদিকে বিজিত শক্তির মানুষেরা।
(চলছে)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
৪৪। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৮ ভোলানাথ চন্দ্র
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
৪৩। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৭ ভোলানাথ চন্দ্র
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
৪২। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৬ ভোলানাথ চন্দ্র
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
৪১। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৫ ভোলানাথ চন্দ্র
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
৪০। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৪ ভোলানাথ চন্দ্র
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
এই পর্বটি লেখকের বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভ্রমণের কাহিনী। লেখক এলেন জাম্মো কান্দি অর্থাৎ জেমো কান্দিতে। জেমো হলো কান্দির কাছে অবস্থিত একটি গ্রাম। ওয়ারেন হেস্টিংস এর দেওয়ান গঙ্গা গোবিন্দ সিং-এর গ্রাম এটি। তিনি পাইকপাড়া রাজার পিতামহ। ১৭৫০ থেকে ১৭৯৫ বাংলার দেওয়ান পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি চাকরি সূত্রে প্রচুর অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন। কান্দিতে ও পাইকপাড়ায় প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। তিনি দ্বৈত শাসনের (ইংরাজ ও বাংলার নবাবের শাসনের) অবসানে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পতনেও তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসকে সাহায্য করেছিলেন। তিনি এত অর্থশালী ছিলেন যে তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধে কুড়ি লাখ টাকা ব্যয় করেছিলেন। নিমন্ত্রণপত্র সোনার পাতায় লেখা হয়েছিল। নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন প্রদেশের অর্ধেক রাজা, জমিদারেরা, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র শিবচন্দ্র সহ। একইভাবে নাতি লালা বাবুর অন্নপ্রাশনেও তিনি অঢেল ব্যয় করেন। সেই অনুষ্ঠানে সোনামুখীর গদাধর শিরোমনি প্রথম কথকথা করেন ও গঙ্গা গোবিন্দ তাঁকে এক লাখ টাকা দেন খুশি হয়ে। তিনি অনেক কৃষ্ণ মন্দির স্থাপন করেন।
কান্দির মন্দিরের দেবতা মুঘল বাদশাহের মতো যার জাঁকজমকে থাকেন। সেরা মখমলের কারুকার্যময় মসনদে আসীন, সোনা রুপোর অলংকার, তৈজসপত্রে সাজানো। প্রসাদ সারাদিনে যা হয় তা সম্পূর্ণ রাজকীয়। প্রতিদিন মন্দিরের ৫০০ টাকা খরচ হয়। পঞ্চাশ রকম ব্যঞ্জন, দশ রকম মিষ্টান্ন দিয়ে প্রসাদ হয়।
কান্দির রাসযাত্রা অতুলনীয়। আলো, বাজি, গান, বাজনা, নাচে জমজমাট। রাসমন্ডল হল সব দেবতার মন্দিরের ছোট সংস্করণ, সেখানে রামায়ণ মহাভারতের প্রধান চরিত্রদের প্রমাণ মাপের মূর্তি সাজানো হয়। যেমন রামের হরধনুভঙ্গ, অর্জুনের মাছের চোখ বিদ্ধ করা ইত্যাদি মূর্তি সেখানে প্রদর্শিত হয়। ২৫ হাজার মানুষ এই মেলায় আসে। এই মেলায় রাজা দশ হাজার টাকা খরচা করেন।
কান্দি থেকে ষোলো মাইল দূরে বহরমপুর। সমতল ভূমির এই পথে জনবসতি খুব কম। ডাকাতি, খুন খারাপির ভয় আছে। ইংরেজ আমলে বহরমপুরের উন্নতি হয়েছে। এখানকার সেনা ছাউনি, প্যারাড গ্রাউন্ড দর্শনীয়।
বহরমপুরে জর্জ টমাসের সমাধি আছে। জর্জ টমাস আয়ারল্যান্ডের এক বণিক, যিনি হরিয়ানাকে কেন্দ্র করে একটি ছোট রাজ্যের রাজা হয়েছিলেন ১৭৯৮ থেকে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। জলপথে কলকাতা যাওয়ার সময় বহরমপুরে তাঁর মৃত্যু হয় ১৮০২ সালে। বহরমপুরের বুলবুলবোনাতে তাঁর সমাধি আছে।
ব্রিটিশ শিশু সাহিত্যিক মেরি মার্থা শেরউডের (১৭৭৫ -১৮৫১) লেখা 'লিটল হেনরি এন্ড হিজ বিয়ারার' নামক বিখ্যাত শিশু সাহিত্যটির হেনরি নামক ব্রিটিশ শিশুটির সমাধি আছে বহরমপুরে। লেখিকা এক ব্রিটিশ সেনানায়কের সঙ্গে বিবাহ সূত্র ভারতে ১১ বছর ছিলেন। হেনরি তাঁর পুত্র যে মাত্র দুই বছর বয়সে মারা যায়।
তারপর ভোলানাথ চন্দ্র মহাশয় জেনারেল স্টুয়ার্ট (১৭৫৮-১৮২৮) -এর কথা লিখেছেন যিনি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বহরমপুরে থাকতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই সেনা অফিসার হিন্দু সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলেন। লেখক তাঁর সম্পর্কে বলেছেন যে তিনি মূর্তি পূজা ও গঙ্গা ভজনা করতেন দেশীয়দের মত। তাঁর কলকাতার চৌরঙ্গীর মিউজিয়াম সকলের জন্য অবারিত দ্বার ছিল। জীবনের শেষ দিকে তিনি শ'খানেক দরিদ্রকে রোজ খাওয়াতেন। জব চার্ণকের মতো তিনি হিন্দু মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন।
সিপাহী বিদ্রোহের বিপদের আঁচ প্রথম এই বহরমপুরেই অনুভব করা গেছিল। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ১৮৫৭ বহরমপুরের সিপাহীরা বিদ্রোহ শুরু করে। তখন গভর্নর জেনারেলের আদেশে এদের ব্যারাকপুরে পাঠানো হয়।
বহরমপুর থেকে নদীপথে তিন মাইল গেলে আসে কাশিমবাজার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এখানের ডাচ, ফরাসি ও ইংরাজ এই তিন দেশীয় কারখানা ছিল। ইংরাজের কারখানায় কুড়ি লক্ষ টাকার যন্ত্রাদি ছিল সেই সময়। ১৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্শাল নামের ওই কারখানার এক কর্মচারী প্রথম সংস্কৃত শিখেছিলেন ও ভাগবত গীতার ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদের পান্ডুলিপি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এখানকার প্রধান ছিলেন জব চার্নক ১৬৮১-তে। স্যার এফ রাসেল এখানকার প্রধান থাকাকালীন মিস্টার হলওয়েল (যাঁর নামে হলওয়েল মনুমেন্ট হয়েছিল যেটি এখন শহীদ মিনার নামে পরিচিত)। ১৭৪২-এ এখানে একটি অবিস্মরণীয় সতীদাহ দেখেছিলেন। ভদ্রমহিলা এক সম্ভ্রান্ত মারাঠার বিধবা। তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা ও লেডি রাসেল প্রমুখ তাঁকে সতী হতে বিরত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি প্রথমে তাঁর একটি আঙ্গুল আগুনে বহুক্ষণ রাখেন। তারপর অন্য হাতের পাতা আগুনে দেন, তাতে ধুপধুনোও মেশান। এরপর মুর্শিদাবাদের ফৌজদার হুসেন শাহের কাছ থেকে সতী হওয়ার অনুমতি আসে এবং তিনি চিতায় প্রবেশ করেন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস আগে (১৭৫৩) কাশিম বাজারে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি পার্শি ও আর আরবি শিখিয়েছিলেন।
মুর্শিদাবাদ যা আগে মুকসুদাবাদ নামে পরিচিত ছিল, সম্ভবত মুঘল বাদশাহ আকবরের প্রতিষ্ঠিত। মুর্শিদকুলি খান এই স্থান ১৭০৪ -এ অধিকার করার পর নাম দেন মুর্শিদাবাদ। ক্রমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এখানে প্রাসাদ, সরকারি দপ্তর তৈরি হওয়ায় সকলের দৃষ্টি এখানে পড়ে। মুর্শিদাবাদ ঢাকা বা রাজমহলের থেকেও বেশি প্রতিপত্তি সম্পন্ন স্থানে পরিণত হয়।
রবার্ট ক্লাইভ লিখেছেন মুর্শিদাবাদ সমৃদ্ধ জনবহুল ও ধনী স্থান লন্ডনের মতই কিন্তু পুরো লন্ডনের সমগ্র সম্পদের থেকেও মুর্শিদাবাদের এক একজনের কাছে বেশি ধন রয়েছে। মুর্শিদাবাদের জনবসতি এত বেশি ছিল যে ক্লাইভ লিখেছেন যে যখন তিনি ২০০ ইউরোপীয় ও ২০০ দেশীয় সেপাই নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন তখন ইচ্ছা করলে মুর্শিদাবাদবাসীরা শুধু লাঠি আর পাথর দিয়েই তাঁদের ধ্বংস করতে পারত। তখন মুর্শিদাবাদের ঢোকার মুখে কামান সাজানো তোরণদ্বার ছিল। ১৭৭০-এ এক ইংরেজ লেখকের লেখা থেকে জানা যায় যে মুর্শিদাবাদে অনেক ইঁটের বাড়ি, প্রচুর প্রাসাদ, উদ্যান আছে, গঙ্গায় অনেক নৌকা দেখা যায়। কিন্তু ১৮০৮-এ অন্য এক লেখকের লেখায় মুর্শিদাবাদ ভীষণ জনবহুল, নোংরা, কিছু প্রাসাদ আর মসজিদ ছাড়া সব ছোট বাড়ি, কুঁড়েঘর আর গঙ্গায় সারিবদ্ধ জাহাজ দেখা যায় বলে লিখেছেন। মুর্শিদাবাদের অবক্ষয়ের প্রথম কারণ নবাবীর পতন। দ্বিতীয় কারণ, গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার জন্য বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মুর্শিদাবাদের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হওয়া। তৃতীয়ত, ১৭৭০-এর মন্বন্তরে মুর্শিদাবাদের আরো সর্বনাশ হয়। চতুর্থ কারণ, ১৭৭২ মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী ও রাজস্ব বোর্ডকে কলকাতায় সরিয়ে আনা। পঞ্চম কারণ, পুণ্যাহ প্রথার বিলোপ। এই প্রথায় দেশের জমিদারেরা মুর্শিদাবাদে প্রতি বছর এপ্রিল মে- তে এসে দেয় খাজনার নিষ্পত্তি করতেন।১৭৭২ থেকে এই প্রথা বন্ধ হওয়াতে মুর্শিদাবাদ ও সেখানকার নবাবের গুরুত্ব কমলো।
প্রাচীন মুর্শিদাবাদের অল্প কিছু নিদর্শনই লেখকের ভ্রমণ কালে দেখতে পাওয়া যেত। সুন্দর মতিঝিল শুকিয়ে গেছে। গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে আনা কালো মার্বেল পাথরে তৈরি সিরাজ-উদ-দৌলার প্রাসাদের সামান্য কিছু চিহ্ন আছে মাত্র। এখানে রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফরকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব পদে আসীন করেছিলেন। উপচে পড়া সোনারুপোর ধনভান্ডার আর হীরা চুনী বসানো রাজমুকুট যা ক্লাইভ প্রথমে এখানে এসে দেখেছিলেন এবং ১০০ নৌকো করে ৭০০ সিন্দুকে ভরে তার একাংশ প্রথম কিস্তি স্বরূপ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গতে নিয়ে যান। কাটরা মসজিদ (মীরজাফর স্থাপিত) ও তার সংলগ্ন ছাত্রদের পড়াশোনার স্থান এখন ধ্বংসস্তূপ। তোপখানা, নবাবের অস্ত্রাগার এর কাছেই ছিল। অতীতে ভাগীরথীর পশ্চিম পারে মুর্শিদাবাদ শহরের একটি অংশ ছিল। সেখানে নবাবী কবরস্থান ছিল। আলীবর্দী খান, সিরাজদৌল্লা প্রভৃতির কবর সেখানেই ছিল। লেখক এখানে সিরাজদৌলার অত্যন্ত অত্যাচারী ও উৎশৃংখল মানসিকতার কিছু কিছু পরিচয় দিয়েছেন। (তৎকালীন অন্যান্য লেখক, এমনকি পুরনো দেশীয় লেখকদের লেখায় এর প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। সিরাজউদ্দৌলাকে নায়ক কল্পনা করা মনে হয় বিংশ শতাব্দীতে প্রথম শুরু হয়েছিল)। ভাগীরথীর ডানপাড়ে মীরজাফরের বিশাল প্রাসাদ ছিল দুর্গের আকারে ও কামানে সজ্জিত। এই শেঠেরা, যাদের এক সময় ক্ষমতা ছিল শুধু মুদ্রা ফেলে ভাগীরথীর স্রোতকে বন্ধ করে দেওয়ার তাদের বংশধরেরা এখন দরিদ্র। পুরনো ভগ্ন প্রায় বাড়ি আগলে আর অবশিষ্ট ধনরত্ন বেঁচে কোন রকমে জীবন ধারণ করছে।
মুর্শিদাবাদের এখন দেখার জিনিস একটি - হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। সেই নতুন প্রাসাদ কর্নেল ম্যাকলোয়েড এর পরিকল্পনায় তৈরি হয়েছে ১৮৩৭-এ। ৪২৫ ফুট লম্বা, ২০০ ফুট চওড়া ও ৩৮০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই প্রাসাদ বানাতে খরচ হয়েছে কুড়ি লক্ষ টাকা। মার্বেলের মেঝে যুক্ত এই প্রাসাদের সিঁড়ি, ২৯০ ফুট লম্বা হল, আয়না বসানো দরজা, বিভিন্ন রূপে সাজানো ঘরগুলি, নবাবের হাতির দাঁতের কাজ করা সিংহাসন, নবাবদের পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি আঁকা ছবি - সবই দেখার মত। এই প্রাসাদের একটি বারান্দা থেকে লেখক জেনানা অর্থাৎ অন্তঃপুরের এক ঝলক দেখতে পান। জেনানা এলাকায় কোন পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তিনি শোনেন ৩০ জন বেগম বা উপপত্নী সেখানে আছে নবাবের, ৫০ জন আবিসিনিয় খোজার প্রহরায়। আগে নবাবদের হারেমের আকার বড় ছিল। এক নবাবের হারেমে দেড় হাজার মহিলা ছিল। আলীবর্দী খানের অবশ্য একটি মাত্র স্ত্রী ছিল। সিরাজউদ্দৌলার জেনানায় মহিলার সংখ্যা গোনা মুশকিল। মীরজাফর সিরাজের হারেমের অধিকাংশ মেয়েদের ক্লাইভকে দান করেছিলেন।
এরপর দেখা হল ইমামবাড়া। এটি হুগলির ইমামবাড়ার থেকে বড়। আয়না, লন্ঠন, ঝাড়লণ্ঠন দিয়ে সাজানো এই ইমামবাড়ার শোভা অতুলনীয়। নদীতে নবাবের ময়ূরপঙ্খী, বিলাসবহুল নৌকা দেখা যায়। তবে আগে গঙ্গায় যেতে যেতে মুর্শিদাবাদের যে আলোকোজ্জ্বল রূপকথার দেশের মতো ঝলমলে রূপ দেখা যেত তা এখন আর নেই।
এখানকার বেরা উৎসব সম্ভবতঃ সিরাজদৌল্লা চালু করেছিলেন। জলযাত্রা শুভ করতে আর বন্যার রোধে পীর পয়গম্বরের দোয়া চাওয়ার জন্য এই উৎসব করা হয়। ফুল, নারকেল, আলোতে ভরা ছোট ছোট ভেলা ভেসে চলে নদীতে। হাজার মানুষের আশা আর আনন্দ নিয়ে এই উৎসবে যোগ দেয়। ভাদ্র মাসে আজও বেরার মেলা বসে মুর্শিদাবাদে।
নবাবী আস্তাবল, হাতিশালা, অস্ত্রাগার সবই এখনও (লেখকের সময়ে) আছে আগের মত। নবাব নাজিম প্রতিদিন নতুন রাজপোষাক পরেন যা পরদিন ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু নবাবীয়ানা থাকলেও নবাবের ক্ষমতা এই প্রাসাদ বা চারপাশের আধ মাইল গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। এই নামমাত্র নবাবী নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে লুপ্ত হবে বলে লেখক আশা করেছেন। নবাব নাজিম প্রথা ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে লুপ্ত হয় মুর্শিদাবাদে।
বর্তমান ভগবানগোলা থেকে ১২ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল পুরনো ভগবানগোলা, যা আলীবর্দী খানের সময় মুর্শিদাবাদের অন্যতম বন্দর ছিল। নদী গতিপরিবর্তন করেছে, পুরনো ভগবানগোলা জঙ্গলাকীর্ণ হয়েছে। নতুন ভগবানগোলা সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রাম। ফসল ক্ষেত, সবুজ মাঠ, আমবাগান, খেজুর-কলা-তালগাছ দিয়ে সাজানো আনন্দময় গ্রাম জীবনের ছবি।
মুর্শিদাবাদ থেকে চল্লিশ মাইল উত্তরে জঙ্গিপুর যা জাহাঙ্গীরের নামে নামাঙ্কিত। এটি পূর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশমের বৃহত্তম কেন্দ্র ছিল। ১৮৩৩-এর চার্টারের ফলে বাংলায় অন্যান্য রেশম ও সুতির সমস্ত বন্দরের মতোই জঙ্গিপুরেরও বাণিজ্য ধ্বংস হয়।
জঙ্গিপুর থেকে ২১ মাইল গেলে সুতি। এখানে ভাগীরথী গঙ্গা থেকে ভাগ হয়ে শাখা তৈরি করেছে। এখানে ১৭৪০- এ বাঙলার নবাব সরফরাজ খানের সঙ্গে বাঙলার নবাবের অধীন পাটনা বা আজিমাবাদের নাজিম আলিবর্দী খানের মধ্যে গিরিয়ার যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে আলিবর্দী খান জয়লাভ করে বাংলার নবাব হন। ১৭৬৩-তে মীর কাসেম ও ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ এখানেই হয়েছিল। এখানে গঙ্গায় চর পড়ার কারণে নৌযাত্রা খুব কম করা যায়। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী পর্যটক তেভার্নিয়ার চরের কারণে নৌযাত্রা ছেড়ে রাজমহল থেকে হুগলি পর্যন্ত স্থলপথে গিয়েছিলেন বলে তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন। তারপর থেকে নৌকা ভাগীরথী ছাড়িয়ে মূল গঙ্গার স্রোতে পড়ে। রাজমহল থেকে নদীয়া এই ১০০ মাইলে, যেখানে পদ্মা নদীর গঠনের আগে ভাগীরথীর গতিপথ ছিল, তা এখন এক জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে।
(চলছে)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
২। গোড়ার কথা
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ---- সুমনা দাম বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...
-
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ------- সুমনা দাম স্বর্ণকুমারী দেবী ( ১৮৫৫-১৯৩২ ) অন্যতম প্রথম বাঙা...
-
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ------- সুমনা দাম (আগের পর্বের পরে) আগস্...
-
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ------- সুমনা দাম "আ ভিজিট টু ইউরোপ" ত্রৈলোক্যনাথ মুখ...