মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪

৪৭। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১১ ভোলানাথ চন্দ্র




সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                      (আগের পর্বের পরে)

সারারাত ধরে ডাকগাড়ি চলল। সকালবেলা গঙ্গার ওপারে দেখা গেল পান্ডবদের পূর্বপুরুষ পুরোরবার রাজধানী (যার নাম ছিল 'প্রতিষ্ঠান'), পুরানের প্রয়াগ আর আকবরের এলাহাবাদ। 


গঙ্গায় ভাসমান নৌকার পুল তখন মাঝখানে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাই নৌকায় গঙ্গা পার হলেন লেখক ও সঙ্গীরা। প্রথমেই প্রয়াগ অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমস্থল দেখতে গেলেন তাঁরা। সঙ্গমের দৃশ্য অতি সুন্দর। হিন্দুদের প্রয়াগে এলেই চুল দাড়ি এমনকি ভুরু পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়। এই ক্ষৌরকর্মে যতগুলি চুল বিসর্জন দেওয়া হবে তত বছর নাকি স্বর্গবাস হবে। নারীরাও কেশকর্তনে সমান উৎসাহী এখানে। 


এমনিতে প্রতিদিন এলাহাবাদের গঙ্গার ঘাটগুলি পূজা-তর্পণরত মানুষের ভিড়ে ভর্তি থাকে, তবে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের পূর্ণিমাতে মাঘী প্রয়াগী নামে এক মহামেলা বসে। সেই বিশাল জনসমাগমের মেলা প্রায় দু মাস ব্যাপী চলে। দূরদুরান্ত থেকে এসে তাঁবুতে থাকে, অস্থায়ী দোকান বসায়। পুণ্যার্থী, ভিক্ষুক, ব্যবসায়ী ভ্রমণার্থীতে স্থানটি ভরে যায়। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের সময় থেকে দূর্গের প্রাচীরের সংলগ্ন স্থানে এই মেলা হতে দেওয়া হচ্ছে না। আগে প্রায় ১৫০০ পান্ডার পরিবার এখানে ছিল। তারা কেউ কেউ এই বিদ্রোহে সাহেবদের তাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। বিদ্রোহের পর তারা হয় পালিয়ে গেছে অন্য শহরে বা জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়েছে। তীর্থযাত্রীদের অবশ্য এতে সুবিধা হয়েছে। 


বেনারসের পরে এলাহাবাদ দেখলে সবকিছু সামান্য ও দীনহীন মনে হয় এবং বোঝা যায় এলাহাবাদের ডাকনাম ফকিরাবাদ কেন হয়েছে। কিন্তু ক্রমে শহরটি ভালো লেগে যায়। এখানকার বাড়ির সংখ্যা কম ও সেগুলি অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। রাস্তা চওড়া আর পুরনো বড় বড় গাছের ছায়াযুক্ত। 


হিন্দু পুরাণ অনুসারে এই স্থানে ত্রিবেণী সঙ্গম অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গম হয়েছে। কিন্তু  সরস্বতী নদী দৃশ্যমান নয়। বলা হয় তিনি আসার পথে দানবদের হুঙ্কারে ভয় পেয়ে দিল্লির উত্তর পূর্বে বালির তলায় অন্তর্হিত হয়েছেন। তারপরের পথ তিনি অন্তঃসলিলা অর্থাৎ মাটির তলা দিয়ে বহমান হয়ে প্রয়াগ এসে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গে মিশেছেন। সম্ভবত সরস্বতী বা ঘাগ্গার নদী এক প্রচন্ড ভূমিকম্পের ফলে ভূগর্ভে চলে যায়। সেই ভূকম্পের শব্দকে দানবের হুংকার বলে বলা হয়েছে। 


এলাহাবাদের সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণীয় স্নান হল দূর্গ, যা গঙ্গা যমুনার জল থেকে উপরে উঠে গেছে। এই দুর্গ কবে তৈরি হয়েছিল তা জানা যায় না। তবে হিন্দু যুগের এই দুর্গ বহু শক্তির উত্থান পতনের সাক্ষী। বাদশাহ আকবর মুসলমান শাসনকালে এই দুর্গে সংস্কার করেন ও এই স্থানের নাম দেন এলাহাবাদ। হিন্দুরা একটি কাহিনীতে বিশ্বাস করে। আকবর আগের জন্মে হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিলেন তার নাম ছিল মুকুন্দ। মুকুন্দের বাসনা ছিল ভারতের সম্রাট হওয়ার। মুকুন্দ দেবতার কৃপায় বর লাভ করেন যে পরের জীবনে তাঁর এই স্বাদ পূর্ণ হবে। সেই জীবনে যা কিছু তিনি পরের জীবনে মনে রাখতে চান তা তাম্রলিপিতে লিখে একস্থানে তিনি পুঁতে রাখেন। মুকুন্দ প্রয়াগে সেই তাম্রলিপি মাটিতে পুঁতে আগুনে আত্মাহুতি দেন। এরপর তিনি আকবর হিসেবে জন্ম নিয়ে সেই স্থানটি খুঁজে তাম্রলিপিটি পাঠ করেন। মুসলমানদের থেকে এখন দূর্গটি ইংরেজদের অধীনস্থ হয়েছে। উন্নত অস্ত্র ও যুদ্ধনীতির কারণে এই সময় দূর্গ নতুন ভাবে সজ্জিত হয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় দূর্গটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটি সুন্দর ময়দান পেরিয়ে দূর্গে ঢোকার তোরণ দ্বার। সেখানে সিপাহীরা, কালো চামড়ার মানুষদের দুর্গে প্রবেশের কাগজ দেখাতে না পারলে আটকে দেয়। ভিতরে আকবর তৈরি ২৭২ ফুট লম্বা রাজকীয় হল রয়েছে। হিন্দু রাজাদের আমলে স্থাপত্য চারিদিকে বিদ্যমান। দূর্গের ঠিক নীচ দিয়ে যমুনা বয়ে চলেছে। একটা খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা পাথরের সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে, সেখান দিয়ে মোগল রাজপরিবারের মহিলারা যমুনার ঘাটে স্নান করতে যেত। 


দূর্গের মধ্যে একটা সুড়ঙ্গের মতো স্থান আছে মাটির নীচে, যেটিতে এখন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ব্রিটিশ সৈন্যরা সেটি গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছে। আগে যারা এখানে এসেছে তারা ভিতরে ঢুকেছে। ভেতরটা ভিজে, ঠান্ডা, অদ্ভুত গন্ধযুক্ত। সুড়ঙ্গের শেষে একটা চাতাল আছে। তার উপর একটা ৭ ফুট উঁচু মন্দির আছে। মন্দিরে শিবলিঙ্গ আছে, শিবের চারপাশে আরও দেব দেবীর মূর্তি আছে। একটি মৃত গাছের গুঁড়ি আছে, যেটি কয়েকশো বছরের পুরনো। একে অক্ষয় বট বলে, এর নাকি মৃত্যু নেই। আরো বহু আগে নাকি এই সুড়ঙ্গ পথের অন্যদিক সঙ্গম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। লেখক বলেন গুহা মন্দির তৈরিতে যেহেতু বৌদ্ধরা পারদর্শী ছিল হয়তো এই গুহা মন্দির একসময় বৌদ্ধদের ছিল। পরবর্তীকালে হিন্দুরা তার দখল নেয়। হয়তো এককালে এই মন্দিরটি মাটির উপরে ছিল গঙ্গা-যমুনার পলি সঞ্চারের ফলে কোনভাবে এটি এখন পাতালপুরীতে পরিণত হয়েছে। দূর্গে সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হলো ভীমের গদা বা লাট বা দন্ড। এটি এক পাথরে তৈরি মাটি থেকে ৩৫ ফুট উঁচু বহু প্রাচীন একটি স্তম্ভ। বস্তুতঃ এটি সম্রাট অশোকের অনুশাসনের প্রচারের স্তম্ভ (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে তৈরি)। এই স্তম্ভটিতে পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে সমুদ্রগুপ্তের কীর্তি খোদিত হয়। শেষে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে এই স্তম্ভে জাহাঙ্গীরের নাম বংশ পরিচয় ইত্যাদি খোদিত হয়েছে। 


এলাহাবাদ শহর ঘুরে দেখার সময় লেখক যমুনা নদীর দরিয়া ঘাট দেখলেন। এটি একটি পুণ্যস্থান। শোনা যায় বনবাসে যাওয়ার সময় সীতা ও লক্ষণসহ রাম এখানে নদী পার হয়ে বন্ধু গুহক চন্ডালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এর নিকটে বেনারসের রাজার প্রাসাদ আছে। যমুনার ওপর ব্রিজ তৈরির কাজ চলছে দুই বছর ধরে। জলের তলায় ডুবে কাজ করতে গিয়ে তিন চারজন প্রাণ হারিয়েছে (১৮৬৬ তে এই ব্রিজ সম্পন্ন হয়)। লেখক জুম্মা মসজিদ, ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম, বরাহ মন্দির (লক্ষীবরাহ মন্দির) দেখলেন। 


এবার লেখক এলেন মোগলদের তৈরি বাগান খসরু বাগে রয়েছে খুব সুন্দর ফুল-ফল-সবজি বাগান আর গাছপালা দিয়ে তৈরি ছোট ছোট গোলক ধাঁধা। বাগানের মধ্যস্থলে খসরু, পারভেজ ও জাহাঙ্গীরের মারোয়ারি বেগমের সুন্দর কারুকার্য করার সমাধি দেখলেন। (খসরু জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে, পারভেজ জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র ও জাহাঙ্গীরের মারওয়ারি বেগমের নাম শাহ বেগম)। বাগানের সংলগ্ন অংশে একটি বড় সরাই আছে, যা মোগলদের জনস্বার্থমূলক কাজের একটা উদাহরণ। সরাইতে একটা সুগভীর কূপ আছে, যার মধ্যে নামার জন্য সিঁড়ি আছে। 


এলাহাবাদ স্টেশন হাওড়া স্টেশনের অর্ধেকের থেকেও ছোট। এখানে ট্রেন চালাতে কয়লার বদলে কাঠ ব্যবহার করা হয়। এই জ্বলন্ত কাঠের টুকরো হাওয়ায় উড়ে কামরায় ঢুকে কখনো কখনো অগ্নিকাণ্ড ঘটায়। গাড়ির হিন্দু যাত্রীরা অনেকে রঙিন পাগড়ী পড়ে থাকায় গাড়ির ভেতরটা বেশ উজ্জ্বল দেখতে লাগে। ট্রেনে এলাহাবাদ থেকে কানপুর যাওয়ার পথে ট্রেনে জানালা দিয়ে ঐতিহাসিক ও সুন্দর দোয়াব উপত্যকা দেখতে দেখতে যান লেখক। বেরহামপুর (এখানে এই নামে কোন স্টেশন এখন নেই), ফতেপুর স্টেশন হয়ে ট্রেন এসে পৌঁছায় কানপুর

                       
                         (চলছে)

বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪

৪৬। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১০ ভোলানাথ চন্দ্র

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


               (আগের পর্বের পরে)


২৫ শে অক্টোবর, ১৮৬০ হাওড়া থেকে রওনা হওয়ার সপ্তম দিনে লেখক ও তাঁর সঙ্গীদের ডাকগাড়ি ভোরে বেনারস (কাশী) এসে পৌঁছল। শিবের ত্রিশূলের ওপর অবস্থিত হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ বেনারস, ভোরের আলোয় গঙ্গার পাড়ে আবছা ভাবে দেখা গেল। কোন কোন মন্দির থেকে ভেসে আসা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। দিনের আলো প্রকট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মন্দির, প্রাসাদ, মিনার, গম্বুজ, ঘাট স্পষ্ট হয়ে দৃষ্টিগোচর হল। হিন্দু ধর্মের পবিত্রতম তীর্থস্থান শিবের শহর, বহুদিনের শোনা, পড়া, স্বপ্নের শহর এখন তাঁদের চোখের সামনে রয়েছে। প্রথম দৃষ্টিতে আশাপূরণ হল। 

অর্ধচন্দ্রাকৃতি সমগ্র শহরটি অপর পাড় থেকে দেখা যায়। অপর পাড়েও একটি সুন্দর শহর রয়ে, যার নাম ব্যাসকাশী। লেখক বলেছেন শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যেই শৈবদের কাশীর অন্য পাড়ে বৈষ্ণবরা ব্যাসকাশী তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের এই প্রতিযোগিতা সফল হয়নি। ব্যাসকাশী কাশীর মর্যাদা পায় নি। ব্যাসকাশীতে বেনারসের রাজার ভবন আছে। কাশী ও ব্যাশকাশীর মধ্যে যে নৌকার পুল আছে তার অন্যতম কারণ কাশীতে মৃত্যু হলে স্বর্গলাভ হয় আর ব্যাসকাশীতে মৃত্যু হলে গাধা হয়ে জন্ম লাভ হয় বলে কথিত আছে। নৌকার পুল ছাড়া নৌকায় গঙ্গা পারাপার করা যায়। বেনারসের গঙ্গা প্রস্থে ভাগীরথীর দুই তৃতীয়াংশের বেশি হবে না কিন্তু এর গভীরতা ও স্রোতের বেগ বেশি। 

রাজঘাটে নৌকা থেকে নেমে অতি উৎসাহে পায়ে হেঁটে শহর দেখতে বেরোলেন লেখক। কিন্তু অপর পাড় থেকে শহরটি যত সুন্দর লাগছিল এখন আর সেরকম লাগলো না নোংরার কারণে। 

বেনারসের তুলনা পূর্ব-পশ্চিমে কোথাও পাওয়া যাবে না। এটি মন্দির, মঠ, টোল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খাদ্যদ্রব্য সবকিছু নিয়ে সম্পূর্ণরূপে হিন্দু ধর্মের স্থান। একজন বিদেশি সত্যিকার হিন্দু শহর দেখতে চাইলে বেনারসে সে সব কিছু পাবে। বেনারস পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর, যার অস্তিত্ব এখনো আছে। এই শহর সুপ্রাচীন ও বর্তমান কালের মধ্যে মেল বন্ধন ঘটাচ্ছে। কিন্তু বেনারসে খুব প্রাচীন কোন স্থাপত্য নেই। আকবরের সময়কার স্থাপত্যই বোধ করি প্রাচীনতম। 


বেনারসের প্রাচীন নাম কাশী। কাশীখন্ডতে (স্কন্দপুরাণের অংশ) প্রাচীন বেনারসের বর্ণনা সামান্য আছে, তবে মূলত শিব বিষয়ক পুরাণ এটি। কাশীর অপর নাম বারাণসী শহরটির বরনা ও অসি নামক নদীর মধ্যে অবস্থানের কারণে হয়েছে। বেনারস নাম বারাণসী থেকে এসেছে। লেখক-এর মতে আগে কাশী নাম ছিল পরবর্তীকালে বারাণসী নাম হয়। ফা হিয়েনের ৪০৫ খ্রিস্টাব্দ আগমনের পরে বারাণসী নাম হয়েছে। হয়ত পুরনো কাশী বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে তার স্থান মাহাত্ম্য হারিয়ে ক্রমে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। পরে শৈবরা বরনা ও অসির সঙ্গমস্থলে তীর্থস্থান স্থাপন করেন ও নাম দেন বারাণসী, এটি লেখকের নিজস্ব মতবাদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের পরিবর্তন হয়েছে বারবার। বর্তমান শহর লেখকের মনে হয় তিনশ বছরের বেশি পুরনো নয়। এই শহর হারানো গৌরব ফিরে পেয়েছে ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বুন্দির রাজপুত রাজা রাও সুজন সিং-এর সময় থেকে। সুজন সিং আকবরের অধীনে বেনারসের শাসক ছিলেন। তাঁর আমলে প্রদেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ ও শহরের সৌন্দর্যবর্ধন ভালোভাবে হয়। 


রাজঘাটের উপরে রয়েছে বেনারসের পুরনো দূর্গ। মনুর আমলে বেনারস গঙ্গা তীরবর্তী দুটি স্বাধীন জনপদের অন্যতম ছিল। পশ্চিমে পাঞ্চাল, পূর্বে মগধের আক্রমণ আটকাতে এই দূর্গের অবস্থান হয়তো জরুরী ছিল। শেষ হিন্দু রাজা জয়চন্দ্র পর্যন্ত এই শহরের গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। পূজারীদের শহর মোহাম্মদ ঘোরীর দুর্ধর্ষ সেনাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। কেল্লায় জমা থাকা সমস্ত সম্পদ তাদের হাতে চলে যায়। কেল্লার মধ্যে অনেক মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির, বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। মাটির নীচে অনেক পুরনো স্থাপত্য চাপা পড়ে আছে। রাজঘাট থেকে প্রধান রাস্তা জনবহুল শহরের মধ্যে চলে গেছে। এখানে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের বাড়ি থেকে ছাত্রদের বেদ পাঠের আওয়াজ ভেসে আসতো। ক্ষমতাবান বৈশ্যদের দোকান আর প্রাসাদ চোখে পড়তো। বেশ কিছু শতাব্দী ধরে বৌদ্ধমঠ ও মন্দির ছিল এখানে। শঙ্করাচার্য এখানে বৌদ্ধ ধর্মের নাস্তিকতাকে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন হিন্দু ধর্ম দিয়ে। 


শহর ঘুরে দেখার হিন্দু রীতি আছে আছে তাকে নগর পরিক্রমণ বলে। যেখানে নির্দিষ্ট পথে ঘুরে তীর্থস্থান দর্শন করা হয়। সরু গলিতে পূর্ণ শহরের উঁচু উঁচু বাড়িগুলি সূর্যের আলো আর হাওয়া ঢুকতে দেয় না। সব বাড়ির বৈশিষ্ট্য একই। ঝুল বারান্দা, ঘুলঘুলি, কাজ করা দেওয়াল আর গোলাকার স্তম্ভ। বেশিরভাগ বাড়ি ছয় বা সাত তলা, প্রতিটি তলা ১০ বা ১২ ফুট উঁচু। ছোট উঠোন আর খুব ছোট ছোট অন্ধকার ঘর। নীচু দরজা যা দিয়ে ঢুকতে বেরোতে মাথা নীচু করতে হয়, জানলা ছোট আর কম সংখ্যক। অন্তঃপুর সাধারণত বাড়ির উপরের দিকে তলায় হয়। শহরটি অনেকগুলো মহল্লায় বিভক্ত, প্রতিটি মহল্লার দরজা রাতে বন্ধ থাকে। শহরে হাজার হাজার মন্দির আছে। হাজারের বেশি মন্দির মুসলমান আক্রমণকারীদের হাতে ধ্বংস হয়েছে কিন্তু আবার হাজার হাজার মন্দির তৈরি হয়েছে। আওরঙ্গজেবের সময় আবার অনেক মন্দির ধ্বংস হয় এবং তারপর আবার গড়ে ওঠে। বেনারস শুধু শৈবদের শহর নয়, এখানে বৌদ্ধ, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, জৈন সব ধর্ম মতের মানুষই আছে। বেনারসের ঘাটগুলি দেখবার মতো। ঘাটে মানুষ দিনের আনন্দময় সময়গুলি কাটায়। সকালে বেশিরভাগ হিন্দু ঘাটে স্নান, পোষাক পরিবর্তন, প্রার্থনা করে। সন্ধ্যায় গঙ্গায় নির্মল বায়ু সেবন করে, সন্ন্যাসীদের কঠোর তপস্যা দেখে, নানারকম পাঠ শোনে। হিন্দু মহিলাদের বাইরের খোলা জগত এই ঘাটগুলি। সেখানে তারা গল্প করে, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করে, এমন কি প্রেম পরিণয়ের সূত্রপাতও হয় এই ঘাটে। 


বেনারসে স্থানীয় দর্শনীয় স্থান দেখতে প্রথমে লেখক গেলেন ভেলুপুরের তিলভান্ডেশ্বর মন্দিরে। এক তরুণ ব্রাহ্মণ এক মদ-বিক্রেতার সুন্দরী পত্নীর প্রতি আকৃষ্ট হন। মদ-বিক্রেতাকে একদিনের জন্য ব্যবসার কাজে অন্যত্র যেতে হয়। তার স্ত্রী ওই ব্রাহ্মণকে তার সঙ্গে রাত কাটাতে আহ্বান করে। কিন্তু অযাচিতভাবে গভীর রাতে স্বামীটি বাড়ি ফেরে। স্ত্রী তখন আর কোন পথ না পেয়ে ব্রাহ্মণকে একটি বড় ভান্ডের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। ঘরে ঢুকে ওই মদ-বিক্রেতা সেই ভান্ডে মদ রাখতে শুরু করে। কোন উপায় না থাকায় ব্রাহ্মণ ওই ভান্ডে মদে ডুবে মারা যায় নিঃশব্দে। সকালে বিক্রেতা হতবাক হয়ে দেখেন ভান্ডটি সমগ্র মদ ও ব্রাহ্মণ সহ পাথরে পরিণত হয়েছে। সেটি তিল ভান্ডেশ্বর নামে পরিচিত হয়। সকলের বিষ্ময় জন্মায় যে এত ছোট পাত্রে কিভাবে কিভাবে ব্রাহ্মণ আশ্রয় নিয়েছিল। তিল ভান্ডেশ্বর বস্তুত একটি গোলাকার বড় পাথর যা নাকি প্রতিদিন তিল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে কিন্তু এই কাহিনী লোপ পেয়েছে। এই শিব মূর্তি তিল তিল করে বৃদ্ধি পায় বলে এর নাম তিল ভাণ্ডেশ্বর। 

মণিকর্নিকা ঘাট সম্পর্কে লেখক যে কাহিনী লিখেছেন সেটি হল - বিষ্ণু নানারকম সাধনায় শিবকে সন্তুষ্ট করেন। শিব বিষ্ণুর আচরণে সম্মতি সূচক মাথা নাড়তে গিয়ে তাঁর কর্ণকুণ্ডল থেকে একটি মণি পড়ে যায় এখানে, সেই থেকে নাম হয় মণিকর্ণিকা। এটি হিন্দুদের মৃতদেহ সৎকারের পূণ্যতম স্থান। 

লেখক এরপর ভৈরবনাথের মন্দির (বটুক ভৈরবের মন্দির), কবি তুলসী দাসের বাড়ি (তুলসী মানস মন্দির, যেখানে তুলসীদাস আন্দাজ ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে হিন্দি রামায়ণ রচনা করেছিলেন) এবং চৈতন্যদেবের শিষ্যদের আবাসস্থল দেখলেন।

গঙ্গার ধারে যে মন্দির ও প্রাসাদগুলি দেখা গেল তার বেশিরভাগই মারাঠা রাজারানীদের সৃষ্টি। বাজিরাও অহল্যা বাঈ প্রমুখের দান বর্তমান বেনারসের গঠনে সর্বাধিক ভূমিকা। হিন্দু বিজ্ঞানের মন্দির, যার নাম মান মন্ডল (মান মন্দির) বেনারসে তা অবস্থিত। রাজা মানসিংহ, যে রাজার ব্যাপারে ইতিহাস স্পষ্ট নয়, তাঁর বেনারসের প্রাসাদে, তাঁর মৃত্যুর বহু পরে অম্বরের রাজা জয় সিংহ এই মানমণ্ডল (মান মন্দির) তৈরি করেন বলে শোনা যায়। কিন্তু রাজা মানসিংহের সঙ্গে মান মন্দিরের সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। মান শব্দের অর্থ পরিমাপ, মন্ডল শব্দের অর্থ গোলক বা পৃথিবী। অর্থাৎ যে স্থানে পৃথিবীর পরিমাপ করা হয়। পাথরের তৈরি বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের সাহায্যে প্রাচীন হিন্দুরা পৃথিবীর বিভিন্ন পরিমাপ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা করতেন। সপ্তদশ শতকের ফরাসি পর্যটক জয়পুরের রাজকুমারদের জ্যোতির্বিদ্যা অভ্যাস করতে দেখেছিলেন। দুঃখের বিষয় যে এই মান মন্দিরের ব্যবহার এখন আর কোন ভারতীয় করেনা। যদিও হিন্দু পঞ্জিকা বেনারস থেকেই তৈরি হয় প্রতিবছর। (অন্তর্জাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে অম্বরের রাজা মানসিংহ এই প্রাসাদ ও ঘাট তৈরি করেন। মান মন্দির সপ্তদশ শতকে তৈরি করেন এই প্রাসাদে রাজা সওয়াই জয় সিং। 


এবার তাঁরা গেলেন মাধো রায় কে ধারারাতে, যেটি ছিল বিন্দু মাধবের মন্দির (একটি বিষ্ণুমন্দির)। ঔরঙ্গজেব এই মন্দির ধ্বংস করান ও মসজিদ তৈরি করান। এটি বেনারসের সবচেয়ে উঁচু মসজিদ। মসজিদের ২২৫ ফুট মিনার থেকে নীচে শহরটি সুন্দর দেখা যায়। পরিষ্কার আকাশ থাকলে এখান থেকে নাকি হিমালয় পর্বত দেখা যায়। মিনার থেকে গঙ্গার অপর পাড়ে চৈত সিং-এর দূর্গ দেখা যায়। (বেনারসের রাজা চৈত সিং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে শত্রুতামূলক আচরণ করায় তাঁকে দূর্গে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। তিনি তাঁর মাথার পাগড়িকে দড়ি হিসেবে ব্যবহার করে একটি ছোট জানালা দিয়ে গঙ্গায় নেমে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে দুর্গ থেকে ও কাশী থেকে পলায়ন করেন। সেই থেকে দূর্গটি চৈত সিং দূর্গ নামে খ্যাত। এখন পঞ্চগঙ্গা ঘাটে একটি বিন্দু মাধব মন্দির রয়েছে যেটি পরবর্তীকালে তৈরি হয়েছিল। মসজিদটির নাম আলমগীর মসজিদ। যে দীর্ঘ মিনারের কথা বলা হয়েছে সেটি উনবিংশ শতাব্দীতে ভগ্নপ্রায় হলে জেমস প্রিন্সেপ সেটি সংস্কার করেন। কিন্তু ১৯৪৮-এ সেটি বন্যার সময় ভেঙে পড়ে ও দুর্ঘটনায় কজন মারা যায়। তারপর মিনারের বাকি অংশ নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার ভাঙ্গার নির্দেশ দেন। তাই বর্তমানে সেই মিনার নেই)। 


কাশী বিশ্বেশ্বরের মন্দির দেখে লেখক কিছুটা হতাশ হলেন। যদিও মন্দিরের চূড়া, পাঞ্জাব কেশরী রঞ্জিত সিংহের দ্বারা সোনায় বাঁধানো, কিন্তু মন্দিরের বিশালত্বের অভাব আছে বলে তাঁর মনে হল। মন্দির তেমন প্রাচীন নয়, অহল্যা বাই দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরে ভক্তের আনাগোনা প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। প্রতিদিন সকাল বিকেলে দেবতাকে গঙ্গার জলে স্নান করানো হয়। মন্দিরের ভেতর লেখক যে ঐশ্বর্যের প্রকাশ আশা করেছিলেন তা পাননি। ফুলের মালা দিয়ে শিবলিঙ্গ সজ্জিত, ধূপধুনার গন্ধে আমোদিত, মন্ত্রে ও নানা বাদ্যযন্ত্রের শব্দে মুখরিত। এরপর দেবতাকে প্রসাদ দেওয়া হয় এবং তাঁর নিদ্রার ব্যবস্থা করা হয়, শীতে শাল ও গরমে কিংখাবে আচ্ছাদিত করে। 


জ্ঞানবাপী হল পবিত্রতম জলের কূপ। এই কূপের অভ্যন্তরে আদি বিশ্বেশ্বর শিবলিঙ্গ আছেন, যিনি মুসলমান যুগে বেনারসের পতনের সময় অন্তর্হিত হন। বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত লেখক ও সঙ্গীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন এবং তাঁদের গলায় মালা পরিয়ে দেন। মন্দিরের আশেপাশে বহু প্রাচীনকাল থেকে বসবাসকারী পরিবারেরা রয়েছে। গলি পথগুলি খুব সরু। প্রায়ই ধর্মের ষাঢ় সেই পথটুকুও আটকে দেয়। এদের কোন আঘাত করা যায় না (কারণ শিবের বাহন)। বোঝা যায় যে বেনারসে পুরোহিত ও ষাঢ়রাই সর্বোচ্চ সম্মান পায়। সব তীর্থস্থানের মত ভিখারিরা এখানে ভালো উপার্জন করে। 


বিশ্বেশ্বরের মন্দির থেকে কুড়ি তিরিশ পা গেলে অন্নপূর্ণার মন্দির। মন্দিরের গঠন সুন্দর। দেবী এখানে হিন্দু রমণীদের মত পর্দানশীন। পর্দা সরালে চতুর্ভূজা দেবী মূর্তি দেখা গেল। দেবী মূর্তি শ্বেতপাথরের তৈরি কিন্তু মুখে সোনা ও রুপা দু'রকম ছাঁচ ব্যবহার করে দেবীর রূপের পরিবর্তন আনা হয়। দেবীর হাতে বাসন আছে যাতে বোঝা যায় যে তিনি অন্নদান করছেন। লেখক মন্দিরে এক ব্রাহ্মণকে দেখলেন যিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে বেদ পাঠ করে যাচ্ছেন। 


বেনারসে যাঁরা ইতিহাস, প্রাচীনতা খুঁজতে আসেন তাঁরা কিছুটা হতাশ হতে পারেন কারণ প্রাচীন স্থাপত্য তেমন নেই এখানে, প্রাচীন দ্রব্যের জাদুঘর বা প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও নেই বেনারসে। দেখার জিনিসের মধ্যে আছে এক চক, যেখানে অভিজাত রেশম বস্ত্র সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিশেষ দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয় হয়। 


সবথেকে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য স্থান হল এখানকার কলেজ (সম্পূর্ণানন্দ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে এর নাম)। রঙিন কাচ, ফোয়ারা দিয়ে সাজানো জাকজমকপূর্ণ কলেজটির পাঠাগারে অনেক প্রাচীন পুঁথি রয়েছে। দশম একাদশ শতাব্দীর ভারতীয় মাটির বাসন রয়েছে। হিন্দুধর্ম, দর্শন, ন্যায়ের বিশিষ্ট পীঠস্থান বেনারসে নেওয়া সিদ্ধান্ত প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু সমাজের পক্ষে চরম আদেশ।  বেনারস কলেজ স্থাপন করা হয়েছে যাতে আলোকপ্রাপ্ত নতুন হিন্দু জাতি, নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে। (১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জোনাথন ডানকানের উদ্যোগে গভর্নর জেনারেল কর্ণওয়ালিসের আদেশে এটি স্থাপিত হয়)। আওরঙ্গজেবের মসজিদের পাশে নদীর ধারে একটি স্তম্ভ ছিল। অতি প্রাচীনকাল থেকে সেটি শিবের দণ্ড বলে খ্যাত ছিল। এখন সেটি এই কলেজের উত্তর দিকে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এটি এক পাথরের তৈরি। এতে লিপি ও কারুকার্য আছে। (পরে জানা গেছে এটি অশোকের সময়ের একটি শীলাস্তম্ভ। 


বেনারস থেকে সাড়ে তিন মাইল উত্তরে সারনাথ অবস্থিত। সারঙ্গনাথ অর্থাৎ মৃগদের প্রভু কথাটি থেকে সারনাথ নাম এসেছে। এখানে একটি মৃগদাব ছিল। জাতকের কাহিনী অনুসারে বোধিসত্ত্ব মৃগ রূপে অবতরণ করেছিলেন। এখানে পাথরের তৈরি ধামেক (স্তূপ) রয়েছে, যা ৯৩ ফুট ব্যাস ও ১২৮ ফুট দৈর্ঘ্য সম্পন্ন। রয়েছে পাথরের তৈরী ধর্মচক্র। হিউয়েন সাং লিখেছেন যে তিনি দেখেছেন তামার তৈরি একটি বুদ্ধমূর্তি এই ধর্মচক্রকে ঘোরাচ্ছেন। এছাড়া আরও স্তূপ, বুদ্ধমূর্তি এখানে পাওয়া গেছে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে। গুপ্ত ও বাংলার পাল যুগে বৌদ্ধ রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সারনাথের সমৃদ্ধ স্থান ছিল। হিউয়েন সাং সেখানে তিরিশটি বৌদ্ধ মঠ ও তিন হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দেখেছেন। সময়ের পরিবর্তনে, বৌদ্ধ ধর্মের হিন্দু ধর্মের কাছে পরাজিত হওয়ার ফলে, সারনাথ ক্রমে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

                       (চলছে)

প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪৫। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৯ ভোলানাথ চন্দ্র


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                    (আগের পর্বের পরে)

পরবর্তী দর্শনীয় স্থান ডুমরি (বর্তমান ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত)। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জায়গাটির মত বন্য ও উঁচু নীচু কোন জায়গা লেখক আগে দেখেননি। পাহাড়, উপত্যকা, গিরিখাত, গুহার যেন শেষ নেই এখানে। চতুর্দিকে কত সহস্র ধরনের গাছপালা, যার প্রতিটি অচেনা। যদিও এখন জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা কমে গেছে তবুও পথের প্রতিটি বাঁকেই আশঙ্কা হয় যে তাদের সঙ্গে দেখা হবে। কিছুদিন আগেও এই পথে বাঘের হাতে মারা গেছে মানুষ। সরকার ২ বা ৩ মাইল অন্তর অন্তর চৌকি আর সরাই তৈরি করে দিয়েছেন ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তার জন্য। এই রাস্তায় মাচানের উপর থেকে রাতে পাহারাদারের পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ভ্রমণকারীর নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত করতে ভারতের পক্ষে সে এক দারুন দিন হবে, যেদিন শেষ বাঘটিকে মেরে তার দেহ আগামী পুরুষদের কৌতুহল মেটানোর জন্য সংরক্ষণ করা হবে। (বর্তমান ব্যাঘ্র তথা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকারী মানুষেরা লেখকের এই বক্তব্য শুনলে যে কঠিন প্রতিক্রিয়া জানাবেন লেখকের সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না বোঝা যায়)।

 


কুড়ি মাইল ব্যাপী একটানা পাহাড়ের পরে এল এক উপত্যকা। এক সারি কুঁড়েঘর নিয়ে তৈরি এক সরাই (সরাইখানা) এল। সেখানে লেখকেরা স্নান ও প্রাতরাশ করলেন। তারপর আবার চলা শুরু। আবার পাহাড়ের দেখা পাওয়া গেল। সঙ্গের একটি ডাকগাড়ি একটি মারাত্মক দুর্ঘটনার হাত থেকে কোনক্রমে বাঁচল। গাড়িটি পাহাড়ের রাস্তায় বাঁক নেওয়ার সময় গড়িয়ে খাদে পড়ে যাচ্ছিল। দিন শেষ হয়ে আসছে। পাহাড়ের সূর্যাস্ত অনন্য। পাহাড়ের আড়ালে সূর্য ডুবে যেতেই মাটিতে লম্বা ছায়া পড়ে যায়। হঠাৎ সবকিছু অন্ধকারে ডুবে যায়। 



রাতে তাঁরা বেলকুপি পৌছালেন (বেলকাপি, ঝাড়খন্ড)। এখানে রাস্তার ধারে কয়েকটা উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। এক ব্যক্তি তাঁদের সেগুলি দেখাতে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু এক সহযাত্রী বললেন এই রাতে সেগুলি দেখতে যাওয়া মানে বাঘের মুখে পা দেওয়া। (সূরযকুন্ড, রামকুন্ড, সীতাকুন্ড, লক্ষণকুন্ড, ব্রহ্মকুন্ড - এই উষ্ণ প্রস্রবণগুলি বেলকাপি, বারহী মহকুমায়  রয়েছে)। 



এবার এলো বুড়াকাট্টা (বোড়হাকাটা, ঝাড়খন্ড) নামের স্থান, যেটি সম্ভবত প্রাচীনকালে বৌদ্ধ বা জৈনদের ধর্মস্থান ছিল। এখন সেখানে আম, বট, অশ্বত্থের ভালো ভালো গাছ আছে আর ক্ষীণধারা নদী আছে। 



বারহি (ঝাড়খন্ড) গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড-এর উপর অবস্থিত একটি প্রধান শৈল শহর। কিন্তু লেখকেরা অনেক রাতে সেখানে পৌঁছানোতে কিছু দেখতে পেলেন না। 



এরপর এল ডানওয়া পাস (pass)। এবার পাহাড় বেয়ে উঠতে কুলিদের গাড়ি ঠেলে তুলতে হলো। এই পাসটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫২৫ ফুট উঁচু। এরপর পাহাড়ি পথ শেষ হল, এল সমতল ভূমি। 



তাঁরা বরাক পৌঁছালেন। সেখানে একটি বাংলো ও আরেকটি সরাই আছে। এখানে জলের খুব অভাব। চাষবাস প্রায় নেই। মানুষদের চুল ও চেহারা অপরিচ্ছন্ন। মেয়েরা মাথায় কলসি নিয়ে সারাদিন জল সংগ্রহের যায় আর আসে। তাদের কপালে সিঁদুর আর সারি দিয়ে পয়সা ও পুথির মালা সাজানো। লেখকদের প্রাতরাশের জন্য অনেকগুলি মুরগি জবাই হয়েছিল। সেদিন দুর্গাপূজার নবমী, দূরে বাংলায় তাঁদের আত্মীয় বন্ধুরা সেদিন ছাগল-মোষ বলি দিয়ে দুর্গা পূজা করছে আর এখানে লেখকেরা মুরগি বলি দিলেন। (এটি অবশ্যই লেখক বঙ্গাত্মকভাবে বলেছেন)। সঙ্গের ডাক্তারটি এখানে একটি শিশুর চিকিৎসা করলেন। এখানে ২০০ দোকান আর কুঁড়েঘর আছে রাস্তার দু'পাশে মুখোমুখি দুটি সারি। মোট ৩০০ কি ৪০০ মানুষের বাস এখানে। লীলাজন নদী দেখলেন, তাতে জল নেই বললেই চলে। এই নদীর অপর নাম ফল্গুনিরাজনা। ফল্গু নদী হিন্দু ধর্মের পবিত্র নদী, আর নিরাজনা বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র নদী। 



এবারে রাস্তার দু'ধারে গাছের সারির মধ্যে দিয়ে এল  শেরঘাঁটি (বিহার), অর্থাৎ বাঘের আস্তানা। ৫০ বছর আগে এই রাস্তায় যেতে গেলে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে বাঘ তাড়ানোর লোক সঙ্গে রাখতে হতো পথযাত্রীদের। এই প্রাচীন স্থান হয়তো অজাতশত্রু, অশোক, বুদ্ধের সময়ও ছিল। কিন্তু কি নাম তার ছিল এখন তা জানা দুষ্কর। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধি মীর জুমলা এই স্থান হয়ে শাহ সুজাকে আক্রমণ করতে রাজমহলে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। পুরনো কিছু কবর আর মসজিদ আছে শুধু পুরনো দিনের সাক্ষ্য হিসেবে। 



এখান থেকে গয়া কুড়ি মাইল। ফাহিয়েন (চৈনিক পর্যটক) -এর ভাষায় গয়া হল কিয়া ইয়ে। হিন্দুদের বিষ্ণুপদের জন্য গয়া বিখ্যাত। গয়াসুর আসলে বৌদ্ধশক্তির উত্থানের প্রতীক, যাকে দমন করতে হিন্দুধর্মে দৈবশক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এটি বৈষ্ণবধর্মের কাছে বৌদ্ধধর্মের পরাজয়ের রূপক কাহিনী। গয়া ও বৌদ্ধ গয়ার বিষ্ণুপদচিহ্ন ও বৌদ্ধ পদচিহ্নের এই নৈকট্য দুটি ধর্ম গোষ্ঠীর বিরোধকে প্রকট করে। ফা হিয়েনের আগমনের আগে বিষ্ণুপদ চিহ্ন ছিল গয়ায়। গয়াতে বিপত্নীকদের বিবাহ নিষিদ্ধ। এটি হিন্দু পুরুষদের পক্ষে স্বাভাবিক নয়। এর কারণ সম্ভবত বৌদ্ধধর্মের প্রভাব। গয়ার মানুষেরা জন্মগতভাবে হিন্দু হলেও তাদের স্বভাব ও আচরণে কিছু বৌদ্ধ রীতি আছে বলে লেখক মনে করেন। 



শেরঘাঁটিতে অনেক গয়ালী থাকে তীর্থযাত্রীদের নিজের কবলে আনার জন্য। তারা অত্যন্ত ঝামেলা বাধায় যাত্রীদের সঙ্গে। এছাড়া সেখানে কুষ্ঠ রোগী, অন্ধ, খোঁড়াদের গোষ্ঠী রয়েছে, তারা ভিক্ষা করে জীবন কাটায়।  পুণ্য অর্জনের জন্য যে যাত্রীরা যায় তারা সবাই দান করে কারণ দান করলে স্বর্গ লাভের পথ সুগম হবে বলে তারা বিশ্বাস করে। 



এরপর উমগা, মদনপুর হয়ে পথ গেছে। মদনপুর এলাকায় বাংলার পাল রাজাদের রাজত্ব ছিল কিন্তু, এখন ধ্বংসাবশেষ। সেখানে ৪০০ বছরের প্রাচীন এক ৬০ ফুট জগন্নাথ দেবের মন্দির আছে চন্দ্র বংশীয় রাজা ভৈরব ইন্দ্র প্রতিষ্ঠিত (গুগল ম্যাপ অনুসারী এটি সূর্য মন্দির, জগন্নাথ মন্দির নয়)। 



এবার লেখকের দ্রষ্টব্য স্থান সোন নদী, যার প্রাচীন নাম হিরণ্যবাহ, (অর্থাৎ যা সোনা বহন করে। কথিত আছে সোন নদীর বালিতে সোনার কণা আছে)। গ্রীক পর্যটক আরিয়ান ও প্লিনী একে এরানোবোয়াস বলেছেন। নদীর অর্ধেক অংশে জল নেই। কুলিরা গাড়ি ঠেলে পার করালো। রোটাস পাহাড় দূরে দেখা যায় পটভূমিতে। এখানে লেখকের একটি পৌরাণিক কাহিনী শোনান। নরবুদা আর সোনের বিবাহ ঠিক হয়েছিল। তাঁরা হিন্দু বরকনের মত পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। নরবুদার মনে কৌতুহল হয় তাঁর স্বামী হতে চলেছে যে সোন, তাঁর সম্পর্কে খবরাখবর পাওয়ার জন্য। তাই তিনি সখি ঝোলাকে সোনের কাছে পাঠান। তখন বিবাহ করার উদ্দেশ্যে সোন আসছিলেন। ঝোলা কে দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হন সোন। নরবুদা এরপর নিজে খোঁজ নিতে গিয়ে সেই দৃশ্য দেখে ঘৃণায় পদাঘাতে সোনকে পূর্ব দিকে অর্থাৎ তিনি যেদিক থেকে আসছিলেন সেদিকে ও ঝোলাকে তাঁর দিকে পাঠিয়ে নিজে পশ্চিমে চলে যান ও সর্বদা কুমারী থাকেন। এই কাহিনী অমরকন্টক পাহাড় থেকে নির্গত হয়ে নর্মদার পশ্চিমমুখী বয়ে যাওয়া, সোনের প্রথমে কিছুটা পশ্চিমমুখী হয়ে তারপর পূর্বমুখী হয়ে বয়ে যাওয়া ও ছোট নদী ঝোলার (জোহিলা নদী) সোন নদীতে মিশে যাওয়াকে রুপক হিসেবে দেখিয়েছে। 



সোন নদীর ধারে ডেহরি অবস্থিত। সোনের বাম তীরে শাহবাগ। এখানে লেখক মগধের আরো প্রাচীন নাম 'কিকাতা' ব্যবহার করেছেন। 


ডেহরি থেকে রোটাস কুড়ি মাইল। কথিত আছে হরিশচন্দ্রের পুত্র রোহতাস (রোহিতাশ্ব) এই দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু বস্তুত দুর্গ এত প্রাচীন নয়। শেরশাহের তৈরি এই দুর্গে রাজা মান সিংহ সংস্কার করেছিলেন। এই দুর্গ কুনয়ার সিং আর অমর সিং কিছুদিন ধরে সিপাহী বিদ্রোহের সময় দখল করে রেখেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে লেখক আবার সিপাহী বিদ্রোহের অসারতা প্রমাণ করে দেন। 



এবার এল সাসারাম। প্রায় ৩০০০ কুঁড়ে ঘর, দোকান নিয়ে বসতি। দোতলা কাঁচা বাড়ি এই প্রথম চোখে পড়ল। সাসারাম থেকে দূরে নীল পাহাড় আর ফসলে ভরা উপত্যকা দেখা যায়। শের শাহের জন্মস্থান সাসারাম দ্বিতীয় দিল্লি তো হতে পারেইনি বরং দুর্গন্ধময় সরু গলিতে, দরিদ্র মানুষের বসবাসস্থল হয়ে উঠেছে। শের শাহের পিতা হাসান খান-এর সমাধি একমাত্র এর ব্যতিক্রম। খুব সুন্দর এই সমাধি একটি উত্তম ভাস্কর্য যা এখনো প্রায় অক্ষত আছে। এই সমাধিস্থলের উপর থেকে নীচে শহরটি ভালো করে দেখা যায়। উত্তর দিকে শেরশাহের সমাধি একটি কৃত্রিম হ্রদের ধারে অবস্থিত। পিতা ও পুত্রের সমাধি দুটি একই রকম, শুধু শের শাহের সমাধিটি আরো বড় ও আরো সুন্দর। শেরশাহ নিজে তাঁর সমাধি তৈরি করে রেখেছিলেন। সমাধি ছাড়া আর কোন প্রাসাদ বা সৌধ তিনি তৈরি করে যান নি। কিন্তু চার মাস ব্যাপী পায়ে হেঁটে চলার যে পথ তৈরি করে গেছেন, তা পূর্বে বাংলার সোনারগাঁও থেকে পশ্চিমে ঝিলাম নদীর তীরে রোটাস পর্যন্ত বিস্তৃত। এখনো তাঁর তৈরি করা পাথর আর ইঁটের সরাইখানার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় জাহানাবাদে। তবে রাস্তার ব্যাপারে শেরশাহের পূর্বসূরী অবশ্যই সম্রাট অশোক, যিনি রাজপথ তৈরি করে তার পাশে আম গাছ বসিয়ে, কূপ, ধর্মশালা, হাসপাতাল তৈরি করে পথিকদের চলার সুব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। 



এবার লেখক ও সঙ্গীরা বেনারসের উদ্দেশ্যে চললেন। বহুদূর থেকে পথ চলতে শেরশাহের সমাধি দেখতে পাওয়া যায়, রাস্তা সমতল হওয়ার কারণে এরকম দেখা যায়। পথে পড়ল কর্মনাশা নদী। কর্মনাশা নদী ৩০০ ফুট চওড়া, বর্ষাকালে জল ৩০ ফুট বেড়ে যায়, পাড়ের বালি ২০ ফুট গভীর। হিন্দুদের কাছে কর্মনাশা নদী হল গঙ্গার সম্পূর্ণ বিপরীত সংস্করণ। এই নদীর জল স্পর্শ করলে সমস্ত অর্জিত পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। কিছুদিন আগেও মাঝিরা এই নদীতে নৌকা চালানোর সময় সতর্ক থাকতো যাতে এক ফোঁটা জলও শরীরে না লাগে। যারা নৌকায় চড়তে পারতো না পয়সার অভাবে, তারা অন্য মানুষের কাঁধে চড়ে নদী পার হত। এখন আর সেসব করার দরকার হয় না। বেনারসের ধনী হিন্দু রাজা পাটনি মলের দানশীলতায় নদীর উপর পাথরের সেতু তৈরি হয়েছে। লেখক এবার কর্মনাশা নদী সৃষ্টির পৌরাণিক কাহিনী বলেন। রাজা ত্রিশঙ্কু পূজা ও তপস্যার বলে দেবতাদের মধ্যে খুব মর্যাদা লাভ করেন। কিন্তু শিব তাঁকে স্বর্গ থেকে নিক্ষেপ করেন এবং মাঝপথে আটকে দেন। একদিকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টান, অন্যদিকে তপস্যার বলে স্বর্গের দিকে আকর্ষণের প্রভাবে তিনি মাঝখানে ঝুলে থাকেন, মাথা নিচু অবস্থায়। এই পরিস্থিতিতে তাঁর মুখ থেকে ক্ষরিত লালারস থেকে এই কর্মনাশা নদীর সৃষ্টি হয়। 


লেখক একজন ইয়ং বেঙ্গলের অবস্থানের তুলনা করেছেন ত্রিশঙ্কুর সঙ্গে। বর্তমানে পূজা ও তপস্যা হলো শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন। স্বর্গের জন্য আকুতি হল বিজিত শক্তি যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করে তা পাওয়ার বাসনা। শিব এখানে উগ্র গোষ্ঠীর প্রতীক। শূন্যে ঝুলে থাকা হলো মধ্যবর্তী অবস্থান, যেখানে একজন শিক্ষিত হিন্দু ঝুলে আছে, যার একদিকে গোঁড়া দেশীয়রা ও অন্যদিকে বিজিত শক্তির মানুষেরা।

          

                      (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪৪। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৮ ভোলানাথ চন্দ্র

  

       

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                 (আগের পর্বের পরে)

দ্রুতগামী রেলের পর এবার শুরু হল ডাক গাড়ির তুলনামূলক মন্থর যাত্রা। এবার গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে চলা। এই রাস্তা গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কাঁকরে বাঁধিয়ে পাকা করে দিয়েছেন। উঁচু নীচু পাহাড়ি পথ, মূলত জঙ্গল এলাকা। মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় চাষবাস হয়েছে। গরুর গাড়ি মাল বোঝাই হয়ে যাচ্ছে - এই একমাত্র চলমান দৃশ্য দেখা যায়। প্রতি পাঁচ বা ছয় মাইল পরপর ডাকের আদান-প্রদান ও ঘোড়া পাল্টানো হয়। বিভিন্ন কোম্পানির ডাক গাড়ির বিভিন্ন রঙের গাড়ি, যাতে তাদের কর্মচারীরা দূর থেকে চিনতে পারে। গাড়ির চালক নানারকম শব্দ করে, কথা বলেও তার আগমন জানান দিতে থাকে অনেক দূর থেকে। একটি ঘোড়া খুব দূর্বল ছিল, তার এত ওজন বহন করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। কিছু পরে তাকে পরিবর্তন করা হলো। ঘোড়াগুলির থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ভালো নয়। 


নিয়ামতপুর থেকে পথ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে যায়। দূরে বড় বড় পাহাড় দৃশ্যমান হয়। তারপর অনেক জঙ্গলের পথ পেরিয়ে আসে বরাকর নদীর উপত্যকা। এই উপত্যকা পাহাড়, মাঠ, গ্রাম, ছোট নদী, জঙ্গল নিয়ে তৈরী। দিগন্তে অত্যন্ত সুন্দর ২০০০ ফুট উচ্চতার পাঞ্চেত পাহাড় দেখা যায়। কাছের একটি টিলার উপর সাঁওতালদের দেবীর মন্দির আছে। 


বরাকর পাহাড়ি নদী, শুধুমাত্র বর্ষাকালে  নদী জলে ভরে যায়। এই অক্টোবর মাসে নদীতে অল্প জল আছে। কুলিরা টেনে গাড়ি নদী পার করালো। এখানে একটি ব্রিজ তৈরি হচ্ছে। নদীর ধারে দুটি শিব মন্দির আছে। বরাকর নামে একটি ছোট দেশি সরাইখানা আছে এখানে থাকার জন্য। যদিও এটি সাঁওতালি গ্রাম নয় কিন্তু বহু সাঁওতাল নারী, পুরুষ, শিশু এখানে ব্রীজের কাজের জন্য রয়েছে। এখানকার দোকানদারেরা বাঙালি। তিরিশ বছর আগে এইসব জায়গার অস্তিত্বই টানা ছিল না। এগুলি হিংস্র জন্তু আর অসভ্য (!) আদিবাসীদের স্থান ছিল। এখন গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এইসব জায়গাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। আগে এখানে অনেক বাঘ ছিল। এখন বছরে একবার কি দুবার বাঘ দেখা যায়। যদিও আশেপাশের জঙ্গলে অনেক বাঘ আছে। সাঁওতালরা খুব দক্ষ শিকারি। তারা জংলি জানোয়ারদের সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করে। তাদের ধনুক অত্যন্ত কার্যকরী অস্ত্র। পাখী, খরগোশ, এমনকি ভাল্লুক পর্যন্ত তীর ধনুক দিয়ে সহজে তারা শিকার করে। কদিন আগে একজন সাঁওতাল একটা লুকিয়ে থাকা চিতাকেও এই অস্ত্রের সাহায্যে মেরেছে। সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় ১৮৫৫-৫৬ এখানে খুব ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। পাহারাদার নিয়োগ করতে হয়েছিল যাতে বন্যরা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের দক্ষিণে তাদের কার্যকলাপ করে সমস্ত আদিবাসীদের বিদ্রোহী করে না তুলতে পারে। সেই গন্ডগোলে আশেপাশের কিছু সর্দারের অলীক কল্পনায় চায়ের কাপে তুফান উঠেছিল আর সিপাই নামটা সারা পৃথিবীর কাছে ঘৃণ্য হয়ে গেছিল। (ভারতীয়দের কাছে যে বিদ্রোহ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ধাপ বলে বিবেচিত হয় ভোলানাথ চন্দ্রের ইংরেজের গোলামী করার মানসিকতায় তাই চায়ের কাপে তুফান)।


বরাকর বাজারে বড়জোর কুড়িটা দোকান আছে। শস্য এখানেই উৎপন্ন হয়। নুন আসে নীচের প্রদেশ থেকে। আজ বরাকরের যা অবস্থা ২৫ বছর আগে রাণীগঞ্জ সেরকমই ছিল। এই এলাকায় যেসব কাঁচামাল পাওয়া যায় তা হলো লাক্ষা, কাঠ, মৌচাকের মোম আর আছে খনিজ পদার্থ। ভবিষ্যতে ভারতীয়রা যদি নিজেদের বার্মিংহাম বা শেফিল্ড বানাতে চায় তাহলে এই জঙ্গল মহালের কথা তাদের ভাবতে হবে। এখন যেখানে জঙ্গল পতিত জমি রয়েছে ২০০ বছর পরে সেখানে উৎপাদনকারী গ্রাম, শহর থাকবে। হাজার হাজার বর্গমাইল জমি আজ যা শুধু ভালুক আর চিতার দখলে আছে, সেখানে সফল ফল ও সব্জি বাগান, ফসলের জমি, চা বাগান, আখ চাষ ইত্যাদি হবে। বিংশ শতকে ভ্রমণকারী এখানে এসে সুন্দর বাংলো, সুন্দর মফস্বল এলাকা, গুদাম-দোকান দেখবে। ইয়ং বেঙ্গল (এখানে লেখক) এভাবে ভবিষ্যতের উন্নত ভারতের ছবি দেখেছেন। 


সরাইখানাটি একটা পাহাড়ী ঝোরার পাশে জঙ্গলময় উপত্যকায় অবস্থিত। নিকটে ত্রিশ চল্লিশটি কুঁড়েঘর নিয়ে সাঁওতালদের গ্রাম। কুঁড়েঘরগুলি মুখোমুখি দুটি সারিতে রয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে শুয়োর, গরু, ছাগল পায়রা পোষা হয়। গ্রামের চারপাশে তারা চাষবাস করেছে। সাঁওতালদের পরিছন্নতার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে। 


লেখক বলেছেন সাঁওতালরা ভারতের প্রাচীনতম বাসিন্দা। পরে আর্যরা এসে তাদের সরিয়ে ভারতে বসবাস করছে। সাঁওতালরা ক্রমে পাহাড়ে জঙ্গলে চলে গেছে ও সেখানেই রয়েছে। তাদের চেহারা, ভাষা আর্যদের থেকে আলাদা। তাদের ভাষার অক্ষর নেই, তাদের অংক নেই, স্থাপত্য নেই, শিল্পও তেমন কিছু নেই। যদি এই জাতি আজ পৃথিবী থেকে মুছে যায়, তবে তারা কোন সৌধ, কোনো আইন-কানুন, কোনো সাহিত্য বা কোনো নথি ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাবে না। এই জাতি অবহেলিত এবং এদের কোথাও কোন স্বীকৃতি নেই। বরাকরে যে সাঁওতালরা বাস করে তাদের সঙ্গে এখানকার অন্য অধিবাসীদের আচরণে তেমন পার্থক্য নেই। এরা তাদের ভাষার সঙ্গে বাংলা ও হিন্দি মিশিয়ে লেখকের সঙ্গে কথা বলে। সাঁওতালদের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো যে তারা কখনো মিথ্যে কথা বলে না। 


এরপর আবার ডাক গাড়িতে যাত্রা শুরু হল। পথে তালডাঙ্গা (বর্তমানের ঝাড়খন্ড) বাংলোতে খাওয়া হলো। ডাকবাংলোর খিতমদগার ভাত আর মুরগির ঝোল বানিয়ে দিল। সেদিন রাতে সেই ব্রিটিশ বাংলোতে লেখক ও সঙ্গীরা প্রকৃতির মাঝে, ফুলের গন্ধ ভরা বাতাসে বাংলোর সাহেবী আরামে মুগ্ধ হলেন। সাহেবী আদব কায়দায় খাওয়া-দাওয়া করতে করতে তিনি দেশীয় সরাইখানার দুরবস্থার কথা স্মরণ করলেন। বাংলো থেকে বেরোনোর সময় ভাড়ার অতিরিক্ত বকশিশ খুশি মনে দিলেন তাঁরা। 


রাতে আবার ডাক গাড়িতে যাত্রা শুরু হল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ সারারাত চলার পরে প্রথম সূর্যের আলোতে তাঁরা দেখলেন পরেশনাথ পাহাড়ের নীচে পৌঁছে গেছেন। পাহাড়ের চূড়ায় প্রথম সূর্য কিরণ স্পর্শ করেছে। সামনে পিছনে আরো অনেক পাহাড় রয়েছে। সব সময় সমতল দেখে অভ্যস্ত ব্যক্তির প্রথম পাহাড় দেখলে যে রোমান্টিক অনুভূতি হয় তা বর্ণনাতীত। 


পরেশনাথ পাহাড়ের পদপ্রান্তে অবস্থিত স্থান তোপচাচী ( বর্তমান ঝাড়খন্ড)। এখানকার মানুষ কিছুটা সভ্য কিছুটা বন্য। ধান ক্ষেত আর সর্ষে ক্ষেত চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপর তোপচাচী সীমান্ত গ্রাম, যেখানে (তৎকালীন) বাংলা ও বিহার মিশেছে । এখানে লেখক বাংলা ছেড়ে প্রাচীন মগধে, জরাসন্ধের রাজত্বে, চন্দ্রগুপ্ত-অশোকের সাম্রাজ্যে, বৌদ্ধ ধর্মের জন্মস্থানে প্রবেশ করলেন। এখানে তিনি শ্লেষ করে লিখেছেন যে স্থান চীনে পূর্বে বৌদ্ধ ধর্ম প্রেরণ করেছিল, এখন সেখান থেকেই আফিম পাঠানো হচ্ছে চীনে - বিষ এবং বিষের ওষুধ দুইই। ইতিহাসে লেখা নেই কোথায় প্রাচীন গৌড়কে মগধের থেকে আলাদা করা হতো। মোগল আমলে তেলিয়াগড়ি পাস বাংলার পশ্চিম সীমা ছিল। 


কোচয়ানরা যখন ঘোড়া ও গাড়ির তদারকিতে ব্যস্ত, তখন লেখক ও সঙ্গীরা পায়ে হেঁটে তোপচাচী দেখতে বেরোলেন। যতদূর চোখ যায় চুড়ার পরে চুড়া দেখা যায়। চারপাশের গাছপালা সম্পূর্ণ বন্য। একটিও চেনা গাছ নেই। পাহাড়ের নীচের দিকে সম্পূর্ণ উচ্চতার গাছ দেখা যায়, মাঝারি উচ্চতায় সেই গাছগুলিকে বেঁটে ঝোপ মনে হয় আর পাহাড়ের চূড়ায় শুধু সবুজ রং দেখা যায়, গাছের কোন আকার সেখানে বোঝা যায় না। সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি এখান থেকে চার হাজার ফুট আর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ হাজার ফুট উঁচু। 



পরেশনাথ পাহাড়ের নাম জৈনদের তীর্থঙ্কর পরেশনাথের নামে হয়েছে। চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে সর্বশেষ তীর্থঙ্কর পরেশনাথ। এই পাহাড়ের পূর্ব চুড়ায় তিনি নির্বাণ লাভ করেছিলেন। সেই স্থানটি পবিত্রতম স্থান। সেখানে একটি শ্বেতপাথরের ছোট, সুন্দর মন্দির আছে যা নীচের উপত্যকা থেকেও দেখা যায়। পাহাড়ের চূড়ায় হেঁটে পৌঁছানোর পথ আছে। ওপর থেকে পাহাড় ও উপত্যকার অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। চূড়ায় পরেশনাথের বিশাল পদচিহ্ন দর্শনের জন্য রয়েছে। এখানে প্রতি বছর মার্চ মাসে বিশাল এক মেলা হয়। এক লাখ মানুষ দূরদুরান্ত থেকে এখানে আসে। পাহাড়ের নীচে কিছু ফাঁকা জায়গা আছে তাকে মধুবন বলে। সেখানে মেলা বসে। এখানে কিছু মন্দির আছে। মূল মন্দিরে পরেশনাথের কালো মূর্তি, তাঁর মাথার উপর একটি সাপ ছাতার মতো ফণা মেলে ধরে আছে। এছাড়া ক্ষেত্রপাল, চক্রেশ্বরী, পদ্মাবতী যাদের হিন্দু ধর্মের নৃসিংহ, দুর্গা ও লক্ষ্মীর প্রতিরূপ বলা যায় তাঁদের মন্দির রয়েছে। একটি বড় প্রাচীন বটগাছ আছে যা পবিত্র বলে গণ্য করা হয়। মূল মন্দিরটি মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ধনকুবের জগত শেঠ বানিয়ে দিয়েছিলেন। পরেশনাথ জীবহিংসার পরিপন্থী ছিলেন। লেখক ভাবলেন ডাক গাড়ীর চালকদের মেরে মেরে ঘোড়া চালানোর কথা। লেখক মন্তব্য করেন যে ভাগ্যিস ভগবান পরেশনাথ তাদের এই নৃশংসতা চোখ মেলে দেখছেন না।


                      (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪৩। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৭ ভোলানাথ চন্দ্র

 

      

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                  (আগের পর্বের পরে)

লেখকের পরবর্তী ভ্রমণ কাহিনী শুরু হচ্ছে উনিশে অক্টোবর, ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে।এবার হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে বসলেন লেখক ও তাঁর তিন সঙ্গী। 

লেখক এখানে ভারতের রেলপথের সূচনাকে ভগীরথের মর্তে গঙ্গা আনয়নের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভারতীয়রা রেলকে কি বিষ্ময়ের চোখে দেখে তা বলেছেন লেখক। এও বলেছেন যে রেল যেন ভারতবর্ষের পুনর্জাগরনের একটি নতুন রূপ। বাঙালিরা স্বভাবত ঘরকুনো। কলকাতার বাবুরা চিৎপুর রোডকে ভারতের শ্রেষ্ঠ পথ ভাবতে ভালোবাসেন। কিন্তু রেলের প্রসার তাঁদের বাইরের জগতে পা রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে। হাওড়া থেকে বালি এখন পাঁচ মিনিটে পৌঁছানো যায়, দশ মিনিটে সেখান থেকে শ্রীরামপুর। পরবর্তী স্টেশনগুলো চন্দননগর, চুঁচুড়া, হুগলি। বোঝাই যাচ্ছে মধ্যবর্তী বর্তমান অনেকগুলো স্টেশনের তখন অস্তিত্ব ছিল না। সারা রাস্তায় গ্রামবাসীরা অবোধ বিষ্ময়ে রেলগাড়ি দেখতে থাকে। 

এই রাস্তার অনেকটা পর্যন্ত বর্ণনা আগেই দেওয়া হয়েছে বলে লেখক এবার পান্ডুয়া (বর্তমান হুগলি জেলার) থেকে বর্ণনা দিয়েছেন। অনেক পূর্বে পান্ডুয়া হিন্দু রাজাদের রাজধানী ছিল। শহরের পাঁচ মাইল পরিধি পরিখা ও প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। এখন পান্ডুয়া একটি সাধারণ গ্রাম। আগের দুর্গের সামান্য অবশিষ্ট উপলব্ধি করা যায় কোন কোন স্থানে। একটি ১২০ ফুট লম্বা মিনার চোখে পড়ে। এটি বাংলার প্রাচীনতম স্থাপত্যের নমুনা। ৫০০ বছর ধরে টিকে আছে এই ইঁটের তৈরি সৌধটি এই স্থানের রোদ জল সহ্য করে। হিন্দু রাজার তৈরি এই সৌধ আজও দাঁড়িয়ে আছে বেশ ভালো অবস্থায়। (উইকিপিডিয়া অনুসারে অবশ্য বলা হচ্ছে শাহ সুফিউদ্দিন পান্ডুয়া ও মহানদ এলাকার হিন্দু রাজাকে পরাজিত করে এই বিজয় স্তম্ভটি তৈরি করেছিলেন)। গোরু নিয়ে এখানে এক বিশাল অশান্তি হয়েছিল ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে। তৎকালীন হিন্দু রাজার বহু আকাঙ্ক্ষিত পুত্রের জন্ম উপলক্ষে এক উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। রাজার একজন পারসি সভাসদ (মুন্সি) ছিলেন। মুসলমানদের উৎসবে গো হত্যা অবশ্যই হতো। মুন্সি গোহত্যা করেন ও গরুর দেহাবশেষ গোপনে শহরের ফাঁকা জায়গায় পুঁতে ফেলেন। রাতে শেয়ালরা মাটি খুঁড়ে সেই অবশেষ বের করে খায়। সকালে তাদের ভুক্তাবশেষ এক ব্যক্তির চোখে পড়ে। হিন্দুরা ক্ষেপে উঠে ও হত্যার ফলে যে পাপ হয়েছে তা দূর করতে নবজাতক শিশুকে প্রথমে বলি দেওয়া হয়। তারপর মুন্সির ওপর সকলের রাগ পড়ে। মুন্সি পালিয়ে যান কিন্তু হিন্দু রাজার ক্ষতিসাধনের জন্য প্রচেষ্টা করতে থাকেন। এই ঘৃণা ও শত্রুতা বহু বছর ধরে চলে ও শেষে হিন্দু রাজত্বের পতন হয়। এরকম শোনা যায় যে একটি পবিত্র জলাশয়ের জল যতদিন রক্ষা করা যাবে ততদিন হিন্দুরা রক্ষা পাবে বলে কথিত ছিল। মুসলমানেরা মৃত গরুর দেহাংশ ফেলে জলাশয় অপবিত্র করে দেয়। ফলে হিন্দুরা সেই জলস্পর্শ করতে না পেরে দুর্বল হয়ে ক্রমে পরাজিত হয়। এই জলাশয়টি শহরের পশ্চিমদিকে এখনো আছে। যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল সেখানে রেলের কাজ করতে গিয়ে খনন কালে অনেক মানুষের হাড় ও খুলি পাওয়া গেছে। মিনারটি মুসলমান রাজার বিজয় ঘোষিত করে। এর মধ্যে দিয়ে চূড়া পর্যন্ত যে লোহার দণ্ড উঠে গেছে সেটি নাকি এই যুদ্ধের নায়ক শাহ সুফির ছড়ি। পান্ডুয়ার মসজিদটি সুন্দর। ২০০ ফুট লম্বা, ৬০ টি ডোমযুক্ত। 


পান্ডুয়ার পীরপুকুর ৫০০ বছরের পুরনো ৪০ ফুট গভীর বিরাট জলাশয়। এটি ইমামবাড়া ও কবরস্থানের পাশে অবস্থিত। এই পুকুরের বৈশিষ্ট্য হল যে এখানে ফটিক খান নামের এক পোষা কুমির থাকে। যাকে ফকির ডাকলেই সে জলের উপরে ভেসে ওঠে। 


এবার ট্রেন পেরোলো বৈঁচি স্টেশন, অনেক ঘর বাড়ি নিয়ে জনবহুল গ্রাম। পরের স্টেশন বাটকা (?), যেখান থেকে ছয় মাইল ডানে গেলে দেবীপুর (এখন দেবীপুরই স্টেশন)। এখানে সাত ফুট লম্বা ভয়াল দেবী মূর্তি স্থানীয় সিংহ পরিবারের মন্দিরে বিরাজমানা (কিন্তু মন্দিরে লক্ষী নারায়ণ মূর্তি বিদ্যমান)। মেমারি পেরোয় ট্রেন। অনেক পাকা বাড়ি ও একটি সুন্দর নবরত্ন মন্দির চোখে পড়ে (লেখক কি সাত দেউল মন্দিরের কথা বলেছেন? কিন্তু এটি তো নবরত্ন মন্দির নয়)। 


বর্ধমান জেলা সম্পদ উর্বরতা, স্বচ্ছলতা, সভ্যতায় বাংলার মধ্যে খুব বিশিষ্ট স্থানে আছে। বর্ধমান, বীরভূমকে সাধারণভাবে রাঢ় বলা হয়। বর্ধমান জেলা বাংলার মধ্যে সবথেকে বেশি রাজস্ব দেয় সরকারকে। এবার ট্রেন পৌঁছায় বর্ধমান। (হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ, বর্ধমান মেন লাইন হয়ে ট্রেন প্রথম যাত্রা শুরু করে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে)। রেলের কল্যাণে তিন দিনের পথ তিন ঘন্টায় পৌঁছলেন। 


শহরের মধ্যে দিয়ে ক্ষীণকায়া বাঁকা নদী বয়ে চলেছে। লেখক ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের বিদ্যাসুন্দর কাব্যে বর্ধমান স্থানের উল্লেখের কথা ও এখানে নুরজাহানের বসবাসের কথা স্মরণ করেছেন। বিদ্যাপত্যা নামক স্থানের নাম বিদ্যার সেখানে বসবাসের প্রমাণ বলেছেন লেখক। মৌন সরোবর নাকি বিদ্যা যে পুকুর ব্যবহার করতেন সেটি। বর্তমান দুর্লভা কালীমন্দিরই সেই মশান, লেখক বলেছেন, যেখানে সুন্দরকে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিদ্যাসুন্দর কাব্যে। 


পুরনো বর্ধমানকে এখন নবাবহাট বলা হয়। এখানে প্রাচীন হিন্দু রাজারা, মুসলমান শাসকরা, রাজা মানসিংহ প্রমুখ রাজকার্য চালিয়েছেন। এখানকার ১০৮ টি শিব মন্দির দুটি বৃহৎ চক্রাকারে (একটির মধ্যে অপরটি) অবস্থিত। এরকম শোনা যায় যে অনেক ধনরত্ন নাকি মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে এখানকার মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল। এক রাজা খননকার্য চালিয়েও কিছু পাননি। 


বর্ধমানে লেখক-এর সময়ও মহারাজা আছেন। তিনি বাংলার ধনীতম রাজা। তাঁর বিশাল প্রাসাদ আয়না, ঝাড়লন্ঠন দিয়ে চমৎকার ভাবে সাজানো। তাঁর গ্রীষ্মকালীন বাড়ি রাজকীয়ভাবে সজ্জিত। মহারাজের ভান্ডারে অনেক মণি মানিক্য, সোনা রুপার বাসন, দামি শাল, সোনা রুপার কাজ করা পোষাক ইত্যাদি রয়েছে। তাঁর ঐশ্বর্যের ছটা দেখা যায় জন্মদিন ইত্যাদি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। রাজার হাতিশালা, আস্তাবল, গবাদি পশুর আবাসস্থল ও পাখিরালয় আছে। বর্তমান রাজার প্রিয় শখ হল স্থাপত্য আর বাগান করা। তাঁর মাইনে করা স্থপতিরা সারা বছর বাড়ি গঠন ও পুনর্গঠনে ব্যস্ত থাকে। নতুন নতুন সাজে বাড়ি সাজানো হয়। সর্বদা তাঁর গায়ক, সুরকারেরা নতুন সুরসৃষ্টিতে ব্যাস্ত থাকে। খাদ্যের ব্যাপারেও এখানে নতুন নতুন পরীক্ষা চলে। শহরে অজস্র কৃত্রিম দিঘী পুকুর আছে বৃহত্তম দিঘী কৃষ্ণসায়র এর পাড় উঁচু করে বাঁধানো, তার উপরে দুটি কামান বসানো আছে। বিকালে সময় কাটানোর জন্য আছে মনোরম দিলখুশ বাগ। এখানে একটি ছোট চিড়িয়াখানা আছে, সেখানে একজোড়া সিংহ আছে। মহারাজা তাঁর আয়ের অর্ধেকের বেশি দেবসেবা ও তার মাধ্যমে দরিদ্রসেবায় নিয়োজিত করেন। 


পরদিন লেখক রেলপথে বর্ধমান থেকে রানীগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে মানকর পরে, যা তখন একটি সামান্য গ্রাম। বর্ধমান থেকে বীরভূম জেলায় প্রবেশ করেন। প্রথমে চারপাশে দৃশ্য একই রকম থাকলেও পানাগড়ের পর জঙ্গল শুরু হল। তার সঙ্গে ভূমিরূপ উঁচু নীচু হতে থাকে। আস্তে আস্তে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বাড়তে বাড়তে এই জঙ্গল রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এর মধ্যে শৈবদের এক তীর্থস্থান আছে, বৈজনাথ (বৈদ্যনাথ, দেওঘর)। রাবণ রাজা শিব ঠাকুরকে কৈলাস থেকে কাঁধে নিয়ে লঙ্কায় যাচ্ছিলেন। একটানা নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বরুন দেবতার ছলনায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে রাবন বর্তমান দেওঘরে শিবকে মাটিতে নামিয়ে রাখতে বাধ্য হন। ফলে শিব বৈদ্যনাথ বা বৈদ্যনাথেই থেকে যান। 


ট্রেন থেকে ছাতনা (শুশুনিয়া পাহাড়) ও বিহারীনাথ পাহাড় দেখা গেল। খয়রাশোল থেকে কয়লা খনি এলাকা শুরু হল। খনি, চিমনি, হাট বাজার, ঘর বাড়ি দেখা গেল। এসে গেল রানীগঞ্জ। লেখক আবার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে রেল প্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত মানুষ আর পণ্যদ্রব্যকে এত দূরে পাহাড়ের তলদেশে নিয়ে এলো। রানীগঞ্জে এবার রেলগাড়ি ধুয়ে মুছে আগামীকালের পুনর্যাত্রার জন্য তৈরি করা হবে। 


কলকাতার বাবুদের জন্য রানীগঞ্জে এখনো থাকার ভালো জায়গা তৈরি হয়নি। একটি রেলের হোটেল আছে। কিন্তু একজন দেশীয় যতই শেক্সপিয়ার, বেকন পড়ুক, ধর্মীয় কুসংস্কার বর্জন করুক, রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করুক আর আইন সভায় আসন পাওয়ার স্বপ্ন দেখুক না কেন, তিনি ইংরেজি হোটেলে থাকার কথা ভাবতে পারেন না কারণ তিনি অন্যান্য ব্যাপারে ইংরাজদের মতো হয়ে উঠলেও তার চিন্তা স্বভাব কাজকর্ম অনুভব দৃষ্টিভঙ্গিতকে ইংরাজ সুলভ করে তুলতে পারেন না। সৌভাগ্যক্রমে লেখকদের এক দেশীয় ব্যক্তি থাকার ব্যবস্থা করে দেন তাঁর বাড়িতে। 


রানীগঞ্জ সভ্য জগতের শেষ সীমায় অবস্থিত এর পরই জঙ্গল আর বর্বরতার শুরু। কিন্তু সুন্দর ছবির মত স্থান ও আছে এখানে। বাম দিকে বিন্ধ্য পর্বত দেখতে পাওয়া যায় আর ডান দিকে জঙ্গল একেবারে গঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত। গুদাম, দোকান, খনি নিয়ে ব্যস্তসমস্ত শহর। কিন্তু শহরের বাইরের এলাকার প্রকৃতি সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত। রানীগঞ্জ নতুন শহর। এই শহরের স্বাস্থ্য সচেতনতা মেনে গড়ে ওঠা দরকার। ভারতীয়দের সুন্দরভাবে শহর গড়ে তোলা শেখা উচিত। কিন্তু এই শহরের রাস্তা সরু, বাঁকাচোরা, নোংরা। দোকানগুলি এলোমেলো, ভিড়। কোন বাড়ির নাম নেই। ছোট দোকানদার, মজুর, কুলিরাই এলাকার বাসিন্দা। উচ্চতর সমাজের কেউ এখানে পাকাপাকিভাবে থাকে না। সাঁওতাল মেয়ে বউরা এখানে নুন, কাপড়, সাজের জিনিস কিনতে আসে। গ্রামের লোকেরা গাছের তলায় দোকান দিয়ে বসে। 



তবে ভালুক, চিতার আস্তানা জঙ্গল থেকে এখন যে বার্ষিক এক মিলিয়নের চতুর্থাংশ ভাগ আয় করা শিল্প নগরীতে পরিণত হয়েছে রানীগঞ্জ এই অনেক। রেলের সুবাদেই এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। ভারতে এখনো রানিগঞ্জ একমাত্র স্থান যেখান থেকে সারা ভারতে খনিজ দ্রব্য যাচ্ছে, কয়লা যাচ্ছে, যে কয়লা গঙ্গায় স্টিমার চলা, সমুদ্রের জাহাজ চলা সম্ভব করছে। এরকম আরো শহর ভারতের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠবে ভারতকে উন্নত করে তুলতে। ভারতের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি ঠিকই কিন্তু ভারতের বিপুল খনিজ ভান্ডার অবহেলা করা উচিত নয়। ভারতের প্রাচীন পূর্বজরা প্রথম কৃষিকাজে সূচনা করেছিলেন তাই নয়, তারা দ্রব্য উৎপাদন ও বাণিজ্যতেও পৃথিবীতে প্রথম ছিলেন। ভারতের রেশম, মসলিন একসময় রোমান সাম্রাজ্যকে রপ্তানি করতে হতো। ভারতের থেকে ইস্পাত রপ্তানির কথা পেরিপ্লাস ( প্রাচীন গ্রীক নৌযাত্রার রচনা) থেকে জানা যায়। যদিও এখন লোহা থেকে ভারতে ইস্পাত খুব কমই হয়, সবই ইংল্যান্ড থেকে আমদানি হয়। বর্ধমানের উত্তর-পশ্চিমে বনপাস গ্রামে ভালো কাঁটা-চামচ তৈরি হতো কিন্তু এখন কামাররা হয় মারা গেছে, নয় বাইরে চলে গেছে। আমাদের দেশের শিল্পের এই বিদেশের হাতে চলে যাওয়া উন্নততর বুদ্ধি আর সম্পদের সঙ্গে অসফল প্রতিযোগিতার ফল। ভারত ছিল বিশ্বের শস্য ভান্ডার। তখন বিশ্বের তিন চতুর্থাংশ অংশ জঙ্গল ছিল আর জমি ব্যবহার্য ছিল না, আফ্রিকার মত নানা স্থানে। পরবর্তী কালে পৃথিবীতে অনেক নতুন স্থানে কৃষিকাজ শুরু হয়েছে (আমেরিকা, আফ্রিকা, মরিশাস, ব্রাজিল, রাশিয়া)। ফলে ভারতের সেই দিক থেকে গুরুত্ব কমেছে। দুইশ বছর আগে ইংল্যান্ডের বয়ন শিল্প ভারতীয় বয়ন শিল্পের কাছে প্রতিযোগিতায় হেরে যেত। আর এখন ভারতীয় বয়ন শিল্পীদের বাজার থেকে উৎখাত করা হয়েছে। এখন দেশীয় ম্যানচেস্টারের বস্ত্র, বার্মিংহামের যন্ত্রাংশ ছাড়া অন্য কিছু কেনার কথা ভাবতে পারা যায় না। আমরা আশা করব যে আমাদের পুত্র, পৌত্ররা প্রতিটি ধুতি, শার্ট, পাগড়ি ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের থেকে ক্রয় করবে। বর্তমান ভারতীয়রা শুধু চাষবাস করছে কারণ তার কাছে পুঁজি নেই, নতুন কোন বুদ্ধি (প্রযুক্তি) নেই। কিন্তু ভারতীয়রা জ্ঞান, শক্তি, ধনবৃদ্ধি করে বিংশ বা একবিংশ শতকে কৃষি ও উৎপাদনশিল্পে উন্নতি করবে, খনি শিল্পে উন্নতি করবে এবং নিজেদের জাহাজে পণ্য পাঠাবে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় - এই আশা করেছেন লেখক। 


রানীগঞ্জের খনিতে দেখার জিনিস অনেক আছে। খনিশিল্প ভারতীয়দের কাছে নতুন। ষোলশোর বেশি শ্রমিক এখানে খনিতে কাজ করে। মাটির ১৩৫ ফুট গভীর পর্যন্ত খনন করে কাজ হচ্ছে। খনির তিন মাইল গভীর পর্যন্ত টর্চ লাইট ব্যবহার করে একজন দর্শনার্থী দেখে আসতে পারেন। 


দামোদর নদ তার উদ্যাম গতিবেগে পাড় ভাসিয়ে শয়ে শয়ে গ্রাম শহরে বন্যা ঘটায়। তাই একে নদী না বলে নদ বলে। আর তাই এর নাম দামোদর অর্থাৎ অতৃপ্ত গ্রাসকারী, যদিও রানীগঞ্জে এই নদী শান্তভাবে বয়ে যাচ্ছে। 


এরপর লেখক দুটি ডাক গাড়ি ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করার জন্য ডাকওয়ালাদের কাছে গেলেন। কিন্তু অনেকে বেড়াতে বেরিয়েছে বলে গাড়ি পাওয়া গেল না। মুসলমানের বাদশাহরা পত্রবাহক রানারের জায়গায় ঘোড়ার ডাক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এখন সেটি মানুষকে বহন করে সুদুরে নিয়ে যাচ্ছে। পালকি ছেড়ে এখন ঘোড়ার গাড়ির উপর মানুষ নির্ভর করতে পারছে। কয়েক বছর পরে রেল এই যাতায়াতের প্রধান পথ হয়ে উঠবে। কলকাতার বাবুদের ভ্রমণ এর ফলে শতগুন বৃদ্ধি পাবে। স্রোতের মতো মানুষ একঘেয়েমি কাটাতে আর ছুটির সদ্ব্যবহার করার জন্য ছুটবে। ইতিহাসে, গাঁথায় শোনা স্থানগুলিতে পৌঁছানোর আগ্রহে, প্রকৃতিকে দেখার উৎসাহে মানুষ অনেক বেশি ভ্রমণ করবে। মানুষকে ভ্রমণমুখী করে তুলতে রেলের ভূমিকা অবশ্যই অপরিসীম।

                       (চলছে)

প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪২। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৬ ভোলানাথ চন্দ্র

  

  

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

সুপ্রাচীন শহর পাটনা, সংস্কৃতে পাটলিপুত্র, গ্রীক পর্যটকদের ভাষায় পালিবোথরা আর চীনা পর্যটকদের ভাষায় পোতোলিতসে (পালিনফু উইকিপিডিয়া অনুসারে) নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অজাতশত্রু পাটলীপুত্র প্রতিষ্ঠা করেন। নন্দ বংশ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক এঁদের রাজধানী ছিল এই পাটলিপুত্র। এখানে সেলুকাসের দুত হয়ে মেগাস্থিনিস এসেছিলেন। চাণক্যের কূটনীতি এখানেই প্রযুক্ত হতো। এখান থেকে অশোকের ধর্মদূতেরা মিশর, সিরিয়া, গ্রীস, শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন। মৌর্য ও গুপ্ত যুগের অবসানের পর হর্ষবর্ধনের আমলে পাটলীপুত্র আবার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়। হিউয়েন সাং-এর রচনায় সেই ইতিহাস জানা যায়। মুসলমান যুগে পাটনা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ পর্যটক রালফ ফিচ (১৫৫০-১৬১১) পাটনাকে এভাবে বর্ণনা করেছেন - বড় শহর কিন্তু শুধু ঘরের চাল দেওয়া মাটির বাড়ি রয়েছে। ডাকাতের ভয়ানক উৎপাত। অর্থাৎ তখন পাটনা শ্রী হারিয়েছিল। বর্তমান পাটনা শহর সরু গলিপথ, নোংরা অসুন্দর, দেওয়ালে ঘুঁটে দেওয়া ঘরবাড়ি, নোংরা নালা ম্যালেরিয়ার মশায় ভর্তি। জমি নিচু তাই বন্যায় ভেসে যায়। মেগাস্থিনিসের বর্ণনার তোরণ দ্বার, মিনার, বিশাখদত্তর লেখা নাটক মুদ্রারাক্ষসের বর্ণনার প্রাসাদ কিছুই অবশিষ্ট নেই। ২০০ বছরের পুরনো কোন ঘরবাড়ি পাটনায় নেই । হিউয়েন সাং-এর বর্ণনার কোন বৌদ্ধ-মঠ মন্দির আর নেই। আছে শুধু পাটনা দেবী, গোপাল, শিব মন্দির, শিখ গুরুদ্বার আর মুসলমান মসজিদ। পাটনায় এখন মুসলমান ও শিখের আধিক্য দেখা যায়। মুসলমান শাসক পাটনার নাম আজিমাবাদ দিতে চেয়েছিলেন। পাটনায় একটি দ্রষ্টব্য স্থান আছে। ১৫০ জন ব্রিটিশকে মীর কাসেমের আদেশে সমরু (মীর কাসেমের জার্মান সেনানায়ক ওয়াল্টার রাইনহার্ট সোমব্রু) হত্যা করেছিলেন। তাঁদের স্মৃতিতে একটি কালো ও হলুদ পাথরের ত্রিশ ফুট উঁচু সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে (সৌধটি অধুনালুপ্ত)। 

পাটনার বাণিজ্য ঘাঁটি শহরের বাইরে মারুগঞ্জে (মারুফগঞ্জ) রয়েছে। পাটনায় টেবিল ক্লথ খুব ভালো তৈরি হয়। পাটনার দুটি আশ্চর্য ব্যাপার - এক, পাটনায় শুধু জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাসেই বিয়ে হয়। দুই, যারা এখানে মারা যায়, তাদের গঙ্গার অপর পাড়ে দাহ করা হয়। 

পাটনা থেকে ছ'মাইল দূরে এখানকার প্রশাসনিক কেন্দ্র বাঁকিপুর। আফিমের গুদাম, আদালত আর ইউরোপীয় বসবাসের স্থান রয়েছে এখানে। ডোমের আদলে একটি বিশাল ঘর রয়েছে (গোলঘর) যার বাইরে থেকে দুটি সারি সিঁড়ি উঠে গেছে। উপরে একটি গোলাকার দরজা আছে ফসল রাখার আর নীচে একটা দরজা আছে ফসল বের করার। এটি ফসলের সরকারি গোলা। ১৭৮৩ দুর্ভিক্ষের পর সরকার এটি তৈরি করেছেন ফসল সংরক্ষণের জন্য। বাঁকিপুর স্টেশন থেকে গয়ার দিকে রাস্তা গেছে। গয়ার ছমাইল পরে বুদ্ধগয়া যেখানে গৌতম বা শাক্যমুনি বৌদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। এখানে দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো মন্দির আছে যার পাথরের খিলান প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যের ঐতিহ্যকে মনে করায়। এখানে চীন, বার্মা থেকে বহু যুগ ধরে তীর্থযাত্রীরা এসেছে। তার পরবর্তী যুগে হিন্দু গয়ার উত্থান হয়েছে। বৌদ্ধপদ থেকে বিষ্ণুপদ-এর গুরুত্ব বেড়েছে। 

বাঁকিপুরের ফেরিঘাট থেকে নৌকা নিয়ে লেখক সোনপুরের হরিহরছত্রের মেলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। হিমালয়ের তুষার শৃঙ্গ থেকে আগত গণ্ডকী নদী এখানে গঙ্গায় মিশে যায়। এই গণ্ডকী নদীতে হিন্দুদের পবিত্র নারায়ণ শিলা বা শালিগ্রাম শিলা পাওয়া যায়। এই সঙ্গমস্থলে একটি সাদা মন্দির আছে। এটি হরিহরনাথের মন্দির। এখানে পৌরাণিক কাহিনী মতে গজ ও কচ্ছপের লড়াই হয়েছিল এবং গরুড় তাদের নৈমিষারণ্যে নিয়ে যান। মন্দিরটিতে সারা বছর তেমন ভিড় থাকে না কিন্তু কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় এখানে সম্ভবত ভারতের সবথেকে বড় মেলা হয়। এই মেলায় মূলত পশু কেনা বেচা হয়। কম করে দশ হাজার ঘোড়া, দুই হাজার হাতি এখানে কেনা বেচা হয়। তামা কাঁসার বাসন, দেশি বিদেশি জিনিস, খেলনা, গয়না, শখের নানারকম জিনিস, শস্য, মিষ্টি সবকিছুর দোকান সার দিয়ে বসে। পাঁচশ তাঁবু রাজা-মহারাজাদের জন্য তৈরি হয়। পুরো এলাকা তাঁবু ও অস্থায়ী ছাউনিতে ভরে যায়। নাচ গানে মেলা মুখর হয়ে থাকে। অনেক ইউরোপীয় আনন্দ করার জন্য এখানে আসেন। এক পক্ষ কাল ধরে মেলা চলে। 

পাটনার সামরিক ঘাঁটি পাটনা থেকে ১৪ মাইল দূরে দানাপুর। সেখানে সেনা ছাউনি, বাংলো, ব্যারাক রয়েছে। 

দানাপুর থেকে চার মাইল উত্তরে শোন ও গঙ্গার সঙ্গমস্থল। রেলপথের শোন নদীর সেতু পার হলে (কয়েল ওয়ার ব্রিজ, ১৮৬২) আসে আরা (আরা জংশন)। আগে ফ্রেন্চ ও ডাচ কারখানাও ছিল, এখন ইংল্যান্ডের সোরা তৈরির ফ্যাক্টরি কারখানা রয়েছে এখানে। এরপর ছাপড়া ও ছাপড়ার ছয় মাইল উজানে সরযু নদী গঙ্গায় এসে মিলেছে। এই সঙ্গমের দৃশ্য খুব মনোরম। 

গঙ্গায় এরপর চরের কারণে স্টিমারের চলতে অসুবিধা হচ্ছিল। এবার এলো বক্সার। বক্সার যুদ্ধ ব্রিটিশ শক্তিকে বাংলা ছাড়িয়ে উত্তর ভারতের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ খুলে দিয়েছিল। এই যুদ্ধের ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় কর আদায় করার অধিকার পেল। শ্রীরামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে এখানে একটি ভবন তৈরি করা আছে। রাম নাকি এখানে এসেছিলেন এবং বিশ্বামিত্রের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছিলেন। ভোজ রাজার দেশ বলে এই স্থানের সবকিছুকে ভোজপুরিয়া বলে। 


সারারাত গঙ্গায় স্টিমার চলে ভোরে এলো গাজীপুর। গাজীপুর বিখ্যাত গোলাপ বাগানের জন্য। শয়ে শয়ে একর জমিতে এখানে গোলাপ চাষ হয়। বহু মানুষ গোলাপ জল, গোলাপের আতর, সুগন্ধি বিক্রয় করে। এখানকার শহর পরিচ্ছন্ন, চওড়া রাস্তা, সুসজ্জিত বাজার। ইউরোপীয়রা আলাদাভাবে বাস করে তাদের বাংলোতে। শহরের পশ্চিম প্রান্তে সেনা ছাউনি। ষোড়শ শতাব্দীতে আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরীতে গাজীপুরের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু এখন কোন প্রাচীন স্থাপত্য দেখা যায় না। এটি মুসলমান প্রধান জায়গা। গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস এখানে মারা গেছিলেন এবং এখানেই তাঁর সমাধি রয়েছে। 

এরপর এলো চুনার। লেখক চুনারের দুর্গ দেখতে গেলেন। শোনা যায় বাংলার পাল রাজারা এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। অন্য মত অনুসারে বুন্দেলখন্ডের চন্ডাল রাজা এই দুর্গ নির্মাণ করেন বলে এর নাম হয় চন্ডালগড়, তার থেকে চুনার। গঙ্গার ঘাট থেকে সুউচ্চ দুর্গ উপরে উঠে গেছে। দুর্গ দেখার পর তিনি চুনার শহর দেখেন। এখানকার বাড়িঘর সব পাথরের তৈরি, দোতলা, বারান্দা দেওয়া। দোকানে লাল আর কালো চিনামাটির বিখ্যাত বাসন পাওয়া যায়। এখানকার তামাক খুব ভালো। 

চুনার থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত রেলপথ জঙ্গল আর উঁচু উঁচু পাহাড়ি জমির উপর দিয়ে গেছে। এখানে বাঘ, হাতি না থাকলেও নেকড়ে, ভালুক আছে। মির্জাপুর শহর অনেকগুলি পাথরে বাঁধানো ঘাট, প্রচুর নৌকা, অনেক সুন্দর মন্দির, মনোরম উদ্যান, সুন্দর ঘরবাড়ি নিয়ে উপস্থিত। মির্জাপুরের কোন প্রাচীন ঐতিহ্য নেই রাজমহল, ভাগলপুর বা মুঙ্গেরের মত। কিন্তু বর্তমানে এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে সুতী আর ধাতুর দ্রব্যের গুদাম আছে। কার্পেট সহ বহু জিনিস এখানে তৈরি হয়। মির্জাপুরে অত্যন্ত সুন্দর একটি চক আছে। 


মির্জাপুর থেকে চার মাইল দূরে বিন্ধ্যাচল মন্দির। এই দেবী ডাকাতদের আরাধ্যা। পাহাড়ের উপর দেবীর মন্দির। এই ডাকাত বা ঠগেরা তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে নদীতে বেনারস থেকে কলকাতা যাতায়াত করত এবং ডাকাতি করত। মির্জাপুর থেকে এলাহাবাদ ভ্রমণের কাহিনী লেখক কয়েকটি পর্ব পরে বর্ণনা করবেন বলে বলেন এখানে।

                     ( চলছে)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪১। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৫ ভোলানাথ চন্দ্র

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                   (আগের পর্বের পরে)

সুতি (মালদা) পর্যন্ত নৌকায় এসে অপর পাড়ে অর্ধদিবস দূরত্বের গন্তব্য গৌড় (বর্তমান মালদা) দেখার লোভ কেউ ছাড়তে পারে না বলেছেন লেখক ভোলানাথ চন্দ্র। 

বাংলার ইতিহাসের সব থেকে উল্লেখযোগ্য স্থান গৌড়, পাল ও সেন রাজাদের এবং তৎপরবর্তী মুসলমান শাসকদের অনেক কীর্তিতে বর্ণময়। গৌড়ের সূচনা কিভাবে হলো তা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। জেমস রেনেলের (মানচিত্রকর ও ঐতিহাসিক) মতে গৌড়, যার অপর নাম লখনৌতি বা লক্ষণাবতী তা সুপ্রাচীন গ্রীক পর্যটক টলেমির বর্ণিত গঙ্গা রিডি। এটি খ্রিস্ট জন্মের ৭৩০ বছর আগেও ছিল বাংলার রাজধানী। হুমায়ুন এই স্থানটিকে পরবর্তীকালে সুন্দর করে গড়ে তোলেন এবং নাম দেন জান্নাতাবাদ। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ বছর আগে গৌড়ের অস্তিত্ব নিয়ে লেখক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন সে ক্ষেত্রে ভগবান বুদ্ধ এখানে আসতেন ও বৌদ্ধ সাহিত্যে তার উল্লেখ থাকতো। মহাভারতেও গৌড়ের কোন উল্লেখ নেই। পুরানে বাংলার নাম বঙ্গ, গৌড় নয়। কাজেই গঙ্গারিডি অন্য কোন স্থান, গৌড় নয়। ফা হিয়েন (চৈনিক পর্যটক) পঞ্চম শতাব্দীতে এবং হিউয়েন সাং (চৈনিক পর্যটক) সপ্তম শতাব্দীতে ভারতে এসেছিলেন। তাঁরা কিন্তু গৌড়ের কথা কিছু বলেননি। উইলফোর্ড (ভারতবিদ ফ্রান্সিস উইলফোর্ড) গৌড়ের প্রতিষ্ঠা ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে মগধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হয় বলেছেন। এই ধারণাটি সঠিক হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। বাঙালির সবথেকে গৌরবময় সময় ছিল যখন গৌড়ের রাজাদের বাণিজ্যতরী গঙ্গায় ভেসে চলত পূর্বে কামরূপ, পশ্চিমে কম্বোজ, দক্ষিণে কলিঙ্গের উদ্দেশ্যে। পাল যুগের অবসানে আসে সেন বংশ। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেন নিজের নাম অনুসারে গৌড়ের নাম দেন লখনৌতি বা লক্ষণাবতী। লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বখতিয়ার খিলজী গৌড়ের মুসলমান বা সুলতানি শাসনের পত্তন করেন। কিছু মূর্তি আর তাম্রলিপি ছাড়া হিন্দু যুগের তেমন কোন চিহ্ন গৌড়ে দেখতে পাওয়া যায় না। হিন্দু মন্দিরের ভগ্নাংশ ব্যবহার করে মুসলমান মসজিদ তৈরি হয়েছে। সোনা মসজিদ, কদম রসুল অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরী হওয়া মুসলমান স্থাপত্যের উদাহরণ। গৌড়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জাহাঙ্গীর এর নাম দিয়েছিলেন জান্নাতাবাদ বা স্বর্গ নগরী। ষষ্ঠদশ শতাব্দীর শেষ থেকে গৌড়ের পতন হয় এবং ক্রমে তা হিংস্র প্রাণী সঙ্কুল জঙ্গলে পরিণত হয়। ভগ্নস্তূপ থেকে মার্বেল নিয়ে মুর্শিদাবাদ, মালদা ইত্যাদি স্থানে বাড়ি তৈরির কাজে লাগানো হয়। 


এবার লেখকের গন্তব্য অধুনা ঝাড়খণ্ডের রাজমহল। রাজা মানসিংহের (সম্রাট আকবরের সুবেদার) প্রতিষ্ঠিত ও সুলতান সুজার (শাহজাহানের পুত্র) প্রিয় শহর এই রাজমহল একসময় জাঁকজমকে দিল্লির সমকক্ষ ছিল কিন্তু এখন শ্রীহীন সামান্য নগর। কিছুদিন আগেই রাজা মানসিংহের কিছু কীর্তির অবশেষ ছিল রাজমহলে। ছিল শাহ সুজার সুন্দর প্রাসাদ, মসজিদ, তোরণ দ্বার। অনেক চিহ্নই রেলওয়ের রাস্তা বানানোর জন্য নষ্ট করে ফেলতে হয়েছে। পর্যটনগত দিক থেকেও রাজমহল গুরুত্ব হারিয়েছে। সুন্দর সবুজ পাহাড়, গঙ্গা এই স্থানের সৌন্দর্যকে অবশ্য আজও রক্ষা করে চলেছে। রাজমহলের গঙ্গার অপর পারে সিরাজ দৌল্লা পলাশীর যুদ্ধের পরে ধৃত হয়েছিলেন। 


এবার লেখক ইন্ডিয়া জেনারেল স্টীম নেভিগেশন কোম্পানির স্টীমার ধরে চললেন। কারাগোলা হয়ে চলার পথে উল্টোদিকে দেখলেন মতিঝর্ণা, যা পাহাড় থেকে সুন্দর ভাবে নেমে আসছে। এবার এলো সকড়ি গলি। এখানে পাহাড়ের উপর পীরের দরগা দেখলেন। এরপর তেলিয়াগড়ি ফোর্ট-এর নীচ দিয়ে তেলিয়াগড়ি পাস দিয়ে স্টীমার চলল। তেলিয়াগড়ি দুর্গ সম্ভবত তৈরি করেছিলেন শেরশাহ এবং সুলতান সুজা পরে তার সংস্কার করেন, যখন তারা যথাক্রমে হুমায়ুনের ও মীরজুমলার আক্রমণ প্রতিহত করছিলেন। এই অংশটিকে অঙ্গ বলা হতো আগে। এখানকার ভূপ্রকৃতি, মানুষ, পশু সবই প্রকৃতিগতভাবে বঙ্গের থেকে পৃথক। 

ক্রমে দেখা গেল পাহাড়ের সারি, যার উপর রয়েছে বর্তমান বিহারের পীর পৈতি। পীর পৈতি নামে কোন এক সাধক গঙ্গার তীরে পাহাড়ে চূড়ায় তাঁর সাধনস্থান নির্বাচন করেছিলেন। নির্মাণ হয়েছিল উপাসনার স্থল, বেদী যা বর্তমান পর্যটকদের কাছে কৌতূহলের বিষয়। মুসলমান সাধক যাঁর নামে পীর পৈতি নাম হয়েছে তাঁর সমাধি রয়েছে এখানে। 
এখানকার পাথরঘাটা গুহা তার স্থাপত্যের জন্য একটি দ্রষ্টব্য স্থল। বহু পূর্বে এক রাজা নাকি গুহার মধ্যে প্রবেশ করতে গেছিলেন এক লক্ষ মশাল বাহক ও একলক্ষ মাপের তেল নিয়ে। কিন্তু কোনদিন তিনি আর ফিরে আসেননি বলে কথিত আছে। স্থানীয় মানুষের ধারণা সেই গুহাটির কোন শেষ নেই। পরে অবশ্য সেই গুহায় অভিযান চালিয়ে জানা গেছে গুহাটি ১৩৬ ফুট লম্বা আর ২৪ ফুট চওড়া। এর মধ্যে কোন স্তম্ভ নেই ছাদ ধরে রাখার জন্য। 
এরপরের গন্তব্য কাহলগাঁও। একটি সুন্দর চড়ুইভাতির জায়গা। নদীর ধারে সুন্দর সুন্দর ঢিপি দেখা যায়। প্রচলিত কথায় এগুলোকে ভীমের তৈরি পান্ডবদের রান্নার উনুন বলা হয়। 


আঠার মাইল উত্তরে ভাগলপুর, যা প্রাচীন অঙ্গরাজ্যের রাজধানী, প্রাচীনকালের চম্পা। এই স্থান একাদশ শতাব্দীর আগে বৌদ্ধদের এলাকা ছিল। হিউয়েন সাং এখানে কিছু বৌদ্ধ মঠের কথা লিখেছেন। 
প্রচুর গাছপালা আর অস্বাস্থ্যকর নোনা মাটির কারণে মশা আর ম্যালেরিয়ায় পূর্ণ ভাগলপুরে দুটি প্রায় ৭০ ফুট লম্বা প্রাচীন মিনার আছে। কারো এখন জানা নেই মিনার দুটি কত পুরনো, কি উদ্দেশ্যে স্থাপিত ইত্যাদি বিষয়। 
এরপর লেখক ভাগলপুরের ক্লিভল্যান্ড মনুমেন্ট দ্বয়ের কথা লিখেছেন। আগস্টাস ক্লিভল্যান্ড (১৭৫৪- ১৭৮৪) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল প্রভিন্স-এর একজন এডমিনিস্ট্রেটর, রেভিনিউ কালেক্টর ও দেওয়ানী আদালতের জজ ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁর স্মৃতিতে একটি মিনার তৈরি করে দেয়। তাঁর দেশ বিরোধী মনোভাবের জন্য তাঁকে বিদ্রোহীরা হত্যা করেছিল। এটি উইকিপিডিয়া অনুসারে পাওয়া তথ্য। অপরদিকে লেখক বলেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৈরি এই মিনারটি ছাড়াও ক্লিভল্যান্ড পাহাড়ি মানুষদের শিক্ষার জন্য সেখানে স্কুল স্থাপন করেছিলেন বলে দ্বিতীয় মিনারটি সেখানকার হিন্দুরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে তৈরি করেছিল। এটির আকার ছিল প্যাগোডার মতো। (লেখক ও উইকিপিডিয়া থেকে পাওয়া তথ্যে ক্লিভল্যান্ড সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী তথ্য পাওয়া গেছে)। 
পুরাণের মন্দার পর্বত যা সমুদ্রমন্থনের দন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল তা ভাগলপুরের দক্ষিণে অবস্থিত। আশেপাশের অন্য পাহাড়গুলি চুনা পাথরে তৈরি হলেও মন্দার গ্রানাইট পাথরে তৈরি। আগে এখানে একটি বৌদ্ধ তীর্থস্থান ছিল, পরে এই স্থানটির অধিকার পান হিন্দু শৈবরা। লেখক এবার একটি অদ্ভুত তত্ত্ব দিয়েছেন - সমুদ্র মন্থন আসলে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের মধ্যে দ্বন্দ্বকে মূর্ত করেছে, যেখানে হিন্দু ব্রাহ্মণরা সুর এবং বৌদ্ধরা অসুর আর বাসুকি নাগ হল নাগা নামে সর্প উপাসক সম্প্রদায়। 


ভাগলপুর থেকে গঙ্গার উজানে নৌকা যেতে যেতে প্রথম দর্শনীয় স্থান হলো গঙ্গার পাড়ে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা একশ ফুট উঁচু গ্রানাইটের একটি টিলা। টিলাটির নাম জাঙ্গীরা ডিরোজিও (ইয়ং ইন্ডিয়া নামক প্রগতিশীল দলের প্রতিষ্ঠাতা, যুক্তিবাদী, চিন্তাবিদ) তাঁর লেখা একটি কবিতায় দি ফকির অফ জাঙ্গীরায় এই স্থানের কথা পাওয়া যায়। টিলার চূড়ায় একটা পাথরের মন্দির আছে যা বহুদূর থেকে দেখা যায়। এই মন্দির শিবের নাম গৈবিনাথ। 

জাঙ্গীরা থেকে ৮ মাইল দূরে সুলতানগঞ্জ। রেলপথ তৈরির কাজ করতে গিয়ে এখানে মাটি খুঁড়ে, অনেক পুরনো বাড়ির ভগ্নাবশেষ পাওয়া গেছে। সম্ভবত এখানে প্রাচীন বৌদ্ধবিহার ছিল। তার স্বপক্ষে অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। (বর্তমান ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করে এখানে কোন বৌদ্ধবিহার উদ্ধার করা হয়েছে বলে পাওয়া গেল না। অর্থাৎ আর কোন খননকার্য এখানে হয়নি।) এইসব ভগ্নাবশেষ-এ যে বড় বড় আকারের ইঁট ব্যবহার করা হয়েছে তা পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতাব্দীতে ব্যবহার হতো। হয়তো আরো পুরনো সময় হতে পারে। বুদ্ধের সাত ফুট উঁচু মূর্তি এখানে পাওয়া গেছে (বর্তমানে যেটি বার্মিংহাম মিউজিয়ামে রাখা আছে)। 
সুলতানগঞ্জ থেকে জামালপুরের রেলপথে এক ঘন্টা লাগে যেতে আধা মাইল লম্বা টানেল পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। 
লেখক নদীপথে মুঙ্গের পর্যন্ত গেলেন কুরুকপুর হিলস (?) হয়ে। এই কুরুকপুর পাহাড়ে নাকি ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রম ছিল যেখানে তাঁর স্মৃতিতে প্রতিবছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। গঙ্গার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট এক পাহাড়ে সীতাকুণ্ড নামে উষ্ণ কুণ্ড আছে। যেখানে সীতা তাঁর সতীত্ব প্রমাণ দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। 


গঙ্গা মুঙ্গের শহরের দুই দিক ঘেঁষে বয়ে চলেছে, পটভূমিকায় আছে পাহাড়, তার মধ্যে সবুজ উপত্যকা শহর মুঙ্গের। মুঙ্গের প্রাচীন শহর, এর পুরনো নাম মৌদগলপুর। 
যেদিন লেখক মুঙ্গেরে গেলেন সেদিন লর্ড ক্যানিংয়ের উত্তর প্রভিন্স যাত্রাকালীন আগমনে মুঙ্গের শহর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঘাটে লাল চাদর বিছানো হয়েছিল ভাইসরয় নামবেন বলে। সরকারি ও রেলওয়ের অফিসাররা ঘাটে অপেক্ষা করছেন। ভাইসরয় তাঁর বজরা থেকে নামতে সালাম, অভিবাদনে তাঁকে স্বাগত জানানো হলো। 
মুঙ্গেরে প্রাচীন বাড়ি বা ভগ্নস্তুপ কিছু নেই কেল্লাটি ছাড়া। উঁচু জমির ওপর চার হাজার ফুট লম্বা সাড়ে তিন হাজার ফুট চওড়া দুর্গটি দাঁড়িয়ে আছে। তার তিনদিক প্রাচীর বেষ্টিত, পরিখা দিয়ে ঘেরা, চতুর্থ দিকে রয়েছে গঙ্গা। কেল্লার চারটি দরজা, প্রধান দরজার নাম লাল দরজা। পূর্ব দিকে দরজার পাশে স্তম্ভে কিছু ছোট ছোট বৌদ্ধ কারুকাজ দেখে লেখক বুঝলেন যে এগুলি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের অংশ ছিল। কেল্লার মধ্যে কালো মার্বেল পাথরের একটি সুন্দর মসজিদ আছে। সুলতান সুজার (শাহজাহানের পুত্র) মসজিদটি সংস্কার করে টমাস অ্যান্ড কোং-এর দোকান হয়েছে। লেখক একটি পুরনো বিশাল কুয়ো এবং বেগমদের নদীতে যাওয়ার ভগ্ন সুড়ঙ্গপথ দেখলেন। 
মুঙ্গের শহরের রাস্তাঘাট ভালো, জনসংখ্যা মাঝারি। মিলিটারি অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগিরা এখানে অনেক আছে। এখানকার বাড়ি ছোট ছোট কিন্তু বাংলার মতো একতলা টালির ঢালু ছাদের বাড়ি নয়। এখানকার বাড়িগুলি দোতলা আর ছাদের গঠন সমতল। এখানে লোহার নানারকম দ্রব্য তৈরি ও বিক্রি হয়। মুঙ্গেরের এক জনশূন্য স্থানে চন্ডী মাতার মন্দির আছে (চন্ডিকা স্থান, এটি একটি শক্তিপীঠ)।


নদীপথে এরপর সুরজগড়, বার, ফতুয়া ইত্যাদি জায়গা আসে। এইসব স্থানে কৃষি কাজ খুব ভালো হয়। নানা রকম ফলের গাছে সাজানো এই জায়গাগুলি অত্যন্ত নয়নাভিরাম। এখানে মরা বটগাছের ফাঁপা গুড়ির মধ্যে তালগাছ লাগানোর এক অভিনব উপায় দেখলেন লেখক। বিকেলে যখন গঙ্গার জল অস্তমিত সূর্যের আলোতে লাল তখন তাঁরা পাটনা এসে পৌঁছালেন।

                         (চলছে)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!


মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪০। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৪ ভোলানাথ চন্দ্র


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                  (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বটি লেখকের বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভ্রমণের কাহিনী। লেখক এলেন জাম্মো কান্দি অর্থাৎ জেমো কান্দিতে। জেমো হলো কান্দির কাছে অবস্থিত একটি গ্রাম। ওয়ারেন হেস্টিংস এর দেওয়ান গঙ্গা গোবিন্দ সিং-এর গ্রাম এটি। তিনি পাইকপাড়া রাজার পিতামহ। ১৭৫০ থেকে ১৭৯৫ বাংলার দেওয়ান পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি চাকরি সূত্রে প্রচুর অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন। কান্দিতে ও পাইকপাড়ায় প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। তিনি দ্বৈত শাসনের (ইংরাজ ও বাংলার নবাবের শাসনের) অবসানে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পতনেও তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসকে সাহায্য করেছিলেন। তিনি এত অর্থশালী ছিলেন যে তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধে কুড়ি লাখ টাকা ব্যয় করেছিলেন। নিমন্ত্রণপত্র সোনার পাতায় লেখা হয়েছিল। নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন প্রদেশের অর্ধেক রাজা, জমিদারেরা, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র শিবচন্দ্র সহ। একইভাবে নাতি লালা বাবুর অন্নপ্রাশনেও তিনি অঢেল ব্যয় করেন। সেই অনুষ্ঠানে সোনামুখীর গদাধর শিরোমনি প্রথম কথকথা করেন ও গঙ্গা গোবিন্দ তাঁকে এক লাখ টাকা দেন খুশি হয়ে। তিনি অনেক কৃষ্ণ মন্দির স্থাপন করেন। 

কান্দির মন্দিরের দেবতা মুঘল বাদশাহের মতো যার জাঁকজমকে থাকেন। সেরা মখমলের কারুকার্যময় মসনদে আসীন, সোনা রুপোর অলংকার, তৈজসপত্রে সাজানো। প্রসাদ সারাদিনে যা হয় তা সম্পূর্ণ রাজকীয়। প্রতিদিন মন্দিরের ৫০০ টাকা খরচ হয়। পঞ্চাশ রকম ব্যঞ্জন, দশ রকম মিষ্টান্ন দিয়ে প্রসাদ হয়। 

কান্দির রাসযাত্রা অতুলনীয়। আলো, বাজি, গান, বাজনা, নাচে জমজমাট। রাসমন্ডল হল সব দেবতার মন্দিরের ছোট সংস্করণ, সেখানে রামায়ণ মহাভারতের প্রধান চরিত্রদের প্রমাণ মাপের মূর্তি সাজানো হয়। যেমন রামের হরধনুভঙ্গ, অর্জুনের মাছের চোখ বিদ্ধ করা ইত্যাদি মূর্তি সেখানে প্রদর্শিত হয়। ২৫ হাজার মানুষ এই মেলায় আসে। এই মেলায় রাজা দশ হাজার টাকা খরচা করেন। 


কান্দি থেকে ষোলো মাইল দূরে বহরমপুর। সমতল ভূমির এই পথে জনবসতি খুব কম। ডাকাতি, খুন খারাপির ভয় আছে। ইংরেজ আমলে বহরমপুরের উন্নতি হয়েছে। এখানকার সেনা ছাউনি, প্যারাড গ্রাউন্ড দর্শনীয়। 

বহরমপুরে জর্জ টমাসের সমাধি আছে। জর্জ টমাস আয়ারল্যান্ডের এক বণিক, যিনি হরিয়ানাকে কেন্দ্র করে একটি ছোট রাজ্যের রাজা হয়েছিলেন ১৭৯৮ থেকে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। জলপথে কলকাতা যাওয়ার সময় বহরমপুরে তাঁর মৃত্যু হয় ১৮০২ সালে। বহরমপুরের বুলবুলবোনাতে তাঁর সমাধি আছে। 

ব্রিটিশ শিশু সাহিত্যিক মেরি মার্থা শেরউডের (১৭৭৫ -১৮৫১) লেখা 'লিটল হেনরি এন্ড হিজ বিয়ারার' নামক বিখ্যাত শিশু সাহিত্যটির হেনরি নামক ব্রিটিশ শিশুটির সমাধি আছে বহরমপুরে। লেখিকা এক ব্রিটিশ সেনানায়কের সঙ্গে বিবাহ সূত্র ভারতে ১১ বছর ছিলেন। হেনরি তাঁর পুত্র যে মাত্র দুই বছর বয়সে মারা যায়। 

তারপর ভোলানাথ চন্দ্র মহাশয় জেনারেল স্টুয়ার্ট (১৭৫৮-১৮২৮) -এর কথা লিখেছেন যিনি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বহরমপুরে থাকতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই সেনা অফিসার হিন্দু সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলেন। লেখক তাঁর সম্পর্কে বলেছেন যে তিনি মূর্তি পূজা ও গঙ্গা ভজনা করতেন দেশীয়দের মত। তাঁর কলকাতার চৌরঙ্গীর মিউজিয়াম সকলের জন্য অবারিত দ্বার ছিল। জীবনের শেষ দিকে তিনি শ'খানেক দরিদ্রকে রোজ খাওয়াতেন। জব চার্ণকের মতো তিনি হিন্দু মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। 

সিপাহী বিদ্রোহের বিপদের আঁচ প্রথম এই বহরমপুরেই অনুভব করা গেছিল। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ১৮৫৭ বহরমপুরের সিপাহীরা বিদ্রোহ শুরু করে। তখন গভর্নর জেনারেলের আদেশে এদের ব্যারাকপুরে পাঠানো হয়।


বহরমপুর থেকে নদীপথে তিন মাইল গেলে আসে কাশিমবাজার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এখানের ডাচ, ফরাসি ও ইংরাজ এই তিন দেশীয় কারখানা ছিল। ইংরাজের কারখানায় কুড়ি লক্ষ টাকার যন্ত্রাদি ছিল সেই সময়। ১৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্শাল নামের ওই কারখানার এক কর্মচারী প্রথম সংস্কৃত শিখেছিলেন ও ভাগবত গীতার ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদের পান্ডুলিপি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এখানকার প্রধান ছিলেন জব চার্নক ১৬৮১-তে। স্যার এফ রাসেল এখানকার প্রধান থাকাকালীন মিস্টার হলওয়েল (যাঁর নামে হলওয়েল মনুমেন্ট হয়েছিল যেটি এখন শহীদ মিনার নামে পরিচিত)। ১৭৪২-এ এখানে একটি অবিস্মরণীয় সতীদাহ দেখেছিলেন। ভদ্রমহিলা এক সম্ভ্রান্ত মারাঠার বিধবা। তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা ও লেডি রাসেল প্রমুখ তাঁকে সতী হতে বিরত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি প্রথমে তাঁর একটি আঙ্গুল আগুনে বহুক্ষণ রাখেন। তারপর অন্য হাতের পাতা আগুনে দেন, তাতে ধুপধুনোও মেশান। এরপর মুর্শিদাবাদের ফৌজদার হুসেন শাহের কাছ থেকে সতী হওয়ার অনুমতি আসে এবং তিনি চিতায় প্রবেশ করেন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস আগে (১৭৫৩) কাশিম বাজারে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি পার্শি ও আর আরবি শিখিয়েছিলেন। 


মুর্শিদাবাদ যা আগে মুকসুদাবাদ নামে পরিচিত ছিল, সম্ভবত মুঘল বাদশাহ আকবরের প্রতিষ্ঠিত। মুর্শিদকুলি খান এই স্থান ১৭০৪ -এ অধিকার করার পর নাম দেন মুর্শিদাবাদ। ক্রমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এখানে প্রাসাদ, সরকারি দপ্তর তৈরি হওয়ায় সকলের দৃষ্টি এখানে পড়ে। মুর্শিদাবাদ ঢাকা বা রাজমহলের থেকেও বেশি প্রতিপত্তি সম্পন্ন স্থানে পরিণত হয়। 

রবার্ট ক্লাইভ লিখেছেন মুর্শিদাবাদ সমৃদ্ধ জনবহুল ও ধনী স্থান লন্ডনের মতই কিন্তু পুরো লন্ডনের সমগ্র সম্পদের থেকেও মুর্শিদাবাদের এক একজনের কাছে বেশি ধন রয়েছে। মুর্শিদাবাদের জনবসতি এত বেশি ছিল যে ক্লাইভ লিখেছেন যে যখন তিনি ২০০ ইউরোপীয় ও ২০০ দেশীয় সেপাই নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন তখন ইচ্ছা করলে মুর্শিদাবাদবাসীরা শুধু লাঠি আর পাথর দিয়েই তাঁদের ধ্বংস করতে পারত। তখন মুর্শিদাবাদের ঢোকার মুখে কামান সাজানো তোরণদ্বার ছিল। ১৭৭০-এ এক ইংরেজ লেখকের লেখা থেকে জানা যায় যে মুর্শিদাবাদে অনেক ইঁটের বাড়ি, প্রচুর প্রাসাদ, উদ্যান আছে, গঙ্গায় অনেক নৌকা দেখা যায়। কিন্তু ১৮০৮-এ অন্য এক লেখকের লেখায় মুর্শিদাবাদ ভীষণ জনবহুল, নোংরা, কিছু প্রাসাদ আর মসজিদ ছাড়া সব ছোট বাড়ি, কুঁড়েঘর আর গঙ্গায় সারিবদ্ধ জাহাজ দেখা যায় বলে লিখেছেন। মুর্শিদাবাদের অবক্ষয়ের প্রথম কারণ নবাবীর পতন। দ্বিতীয় কারণ, গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার জন্য বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মুর্শিদাবাদের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হওয়া। তৃতীয়ত, ১৭৭০-এর  মন্বন্তরে মুর্শিদাবাদের আরো সর্বনাশ হয়। চতুর্থ কারণ, ১৭৭২ মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী ও রাজস্ব বোর্ডকে কলকাতায় সরিয়ে আনা। পঞ্চম কারণ, পুণ্যাহ প্রথার বিলোপ। এই প্রথায় দেশের জমিদারেরা মুর্শিদাবাদে প্রতি বছর এপ্রিল মে- তে এসে দেয় খাজনার নিষ্পত্তি করতেন।১৭৭২ থেকে এই প্রথা বন্ধ হওয়াতে মুর্শিদাবাদ ও সেখানকার নবাবের গুরুত্ব কমলো। 

প্রাচীন মুর্শিদাবাদের অল্প কিছু নিদর্শনই লেখকের ভ্রমণ কালে দেখতে পাওয়া যেত। সুন্দর মতিঝিল শুকিয়ে গেছে। গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে আনা কালো মার্বেল পাথরে তৈরি সিরাজ-উদ-দৌলার প্রাসাদের সামান্য কিছু চিহ্ন আছে মাত্র। এখানে রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফরকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব পদে আসীন করেছিলেন। উপচে পড়া সোনারুপোর ধনভান্ডার আর হীরা চুনী বসানো রাজমুকুট যা ক্লাইভ প্রথমে এখানে এসে দেখেছিলেন এবং ১০০ নৌকো করে ৭০০ সিন্দুকে ভরে তার একাংশ প্রথম কিস্তি স্বরূপ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গতে নিয়ে যান। কাটরা মসজিদ (মীরজাফর স্থাপিত) ও তার সংলগ্ন ছাত্রদের পড়াশোনার স্থান এখন ধ্বংসস্তূপ। তোপখানা, নবাবের অস্ত্রাগার এর কাছেই ছিল। অতীতে ভাগীরথীর পশ্চিম পারে মুর্শিদাবাদ শহরের একটি অংশ ছিল। সেখানে নবাবী কবরস্থান ছিল। আলীবর্দী খান, সিরাজদৌল্লা প্রভৃতির কবর সেখানেই ছিল। লেখক এখানে সিরাজদৌলার অত্যন্ত অত্যাচারী ও উৎশৃংখল মানসিকতার কিছু কিছু পরিচয় দিয়েছেন। (তৎকালীন অন্যান্য লেখক, এমনকি পুরনো দেশীয় লেখকদের লেখায় এর প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। সিরাজউদ্দৌলাকে নায়ক কল্পনা করা মনে হয় বিংশ শতাব্দীতে প্রথম শুরু হয়েছিল)। ভাগীরথীর ডানপাড়ে মীরজাফরের বিশাল প্রাসাদ ছিল দুর্গের আকারে ও কামানে সজ্জিত। এই শেঠেরা, যাদের এক সময় ক্ষমতা ছিল শুধু মুদ্রা ফেলে ভাগীরথীর স্রোতকে বন্ধ করে দেওয়ার তাদের বংশধরেরা এখন দরিদ্র। পুরনো ভগ্ন প্রায় বাড়ি আগলে আর অবশিষ্ট ধনরত্ন বেঁচে কোন রকমে জীবন ধারণ করছে। 

মুর্শিদাবাদের এখন দেখার জিনিস একটি - হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। সেই নতুন প্রাসাদ কর্নেল ম্যাকলোয়েড এর পরিকল্পনায় তৈরি হয়েছে ১৮৩৭-এ। ৪২৫ ফুট লম্বা, ২০০ ফুট চওড়া ও ৩৮০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই প্রাসাদ বানাতে খরচ হয়েছে কুড়ি লক্ষ টাকা। মার্বেলের মেঝে যুক্ত এই প্রাসাদের সিঁড়ি, ২৯০ ফুট লম্বা হল, আয়না বসানো দরজা, বিভিন্ন রূপে সাজানো ঘরগুলি, নবাবের হাতির দাঁতের কাজ করা সিংহাসন, নবাবদের পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি আঁকা ছবি - সবই দেখার মত। এই প্রাসাদের একটি বারান্দা থেকে লেখক জেনানা অর্থাৎ অন্তঃপুরের এক ঝলক দেখতে পান। জেনানা এলাকায় কোন পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তিনি শোনেন ৩০ জন বেগম বা উপপত্নী সেখানে আছে নবাবের, ৫০ জন আবিসিনিয় খোজার প্রহরায়। আগে নবাবদের হারেমের আকার বড় ছিল। এক নবাবের হারেমে দেড় হাজার মহিলা ছিল। আলীবর্দী খানের অবশ্য একটি মাত্র স্ত্রী ছিল। সিরাজউদ্দৌলার জেনানায় মহিলার সংখ্যা গোনা মুশকিল। মীরজাফর সিরাজের হারেমের অধিকাংশ মেয়েদের ক্লাইভকে দান করেছিলেন। 

এরপর দেখা হল ইমামবাড়া। এটি হুগলির ইমামবাড়ার থেকে বড়। আয়না, লন্ঠন, ঝাড়লণ্ঠন দিয়ে সাজানো এই ইমামবাড়ার শোভা অতুলনীয়। নদীতে নবাবের ময়ূরপঙ্খী, বিলাসবহুল নৌকা দেখা যায়। তবে আগে গঙ্গায় যেতে যেতে মুর্শিদাবাদের যে আলোকোজ্জ্বল রূপকথার দেশের মতো ঝলমলে রূপ দেখা যেত তা এখন আর নেই। 

এখানকার বেরা উৎসব সম্ভবতঃ সিরাজদৌল্লা চালু করেছিলেন। জলযাত্রা শুভ করতে আর বন্যার রোধে পীর পয়গম্বরের দোয়া চাওয়ার জন্য এই উৎসব করা হয়। ফুল, নারকেল, আলোতে ভরা ছোট ছোট ভেলা ভেসে চলে নদীতে। হাজার মানুষের আশা আর আনন্দ নিয়ে এই উৎসবে যোগ দেয়। ভাদ্র মাসে আজও বেরার মেলা বসে মুর্শিদাবাদে। 

নবাবী আস্তাবল, হাতিশালা, অস্ত্রাগার সবই এখনও (লেখকের সময়ে) আছে আগের মত। নবাব নাজিম প্রতিদিন নতুন রাজপোষাক পরেন যা পরদিন ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু নবাবীয়ানা থাকলেও নবাবের ক্ষমতা এই প্রাসাদ বা চারপাশের আধ মাইল গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। এই নামমাত্র নবাবী নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে লুপ্ত হবে বলে লেখক আশা করেছেন। নবাব নাজিম প্রথা ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে লুপ্ত হয় মুর্শিদাবাদে। 


বর্তমান ভগবানগোলা থেকে ১২ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল পুরনো ভগবানগোলা, যা আলীবর্দী খানের সময় মুর্শিদাবাদের অন্যতম বন্দর ছিল। নদী গতিপরিবর্তন করেছে, পুরনো ভগবানগোলা জঙ্গলাকীর্ণ হয়েছে। নতুন ভগবানগোলা সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রাম। ফসল ক্ষেত, সবুজ মাঠ, আমবাগান, খেজুর-কলা-তালগাছ দিয়ে সাজানো আনন্দময় গ্রাম জীবনের ছবি। 


মুর্শিদাবাদ থেকে চল্লিশ মাইল উত্তরে জঙ্গিপুর যা জাহাঙ্গীরের নামে নামাঙ্কিত। এটি পূর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশমের বৃহত্তম কেন্দ্র ছিল। ১৮৩৩-এর চার্টারের ফলে বাংলায় অন্যান্য রেশম ও সুতির সমস্ত বন্দরের মতোই জঙ্গিপুরেরও বাণিজ্য ধ্বংস হয়। 


জঙ্গিপুর থেকে ২১ মাইল গেলে সুতি। এখানে ভাগীরথী গঙ্গা থেকে ভাগ হয়ে শাখা তৈরি করেছে। এখানে ১৭৪০- এ বাঙলার নবাব সরফরাজ খানের সঙ্গে বাঙলার নবাবের অধীন পাটনা বা আজিমাবাদের নাজিম আলিবর্দী খানের মধ্যে গিরিয়ার যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে আলিবর্দী খান জয়লাভ করে বাংলার নবাব হন। ১৭৬৩-তে মীর কাসেম ও ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ এখানেই হয়েছিল। এখানে গঙ্গায় চর পড়ার কারণে নৌযাত্রা খুব কম করা যায়। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী পর্যটক তেভার্নিয়ার চরের কারণে নৌযাত্রা ছেড়ে রাজমহল থেকে হুগলি পর্যন্ত স্থলপথে গিয়েছিলেন বলে তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন। তারপর থেকে নৌকা ভাগীরথী ছাড়িয়ে মূল গঙ্গার স্রোতে পড়ে। রাজমহল থেকে নদীয়া এই ১০০ মাইলে, যেখানে পদ্মা নদীর গঠনের আগে ভাগীরথীর গতিপথ ছিল, তা এখন এক জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে।

                           (চলছে)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...