মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪

৪৯। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৩ ভোলানাথ চন্দ্র

   

     

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                   (আগের পর্বের পরে)

দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আগ্রার রাতের মায়াময় রূপের পরিবর্তে বাস্তব রূপ প্রকট হল। সবমিলিয়ে আগ্রার ক্ষয়িষ্ণু চেহারা লেখকের চোখে পড়ল। 


বাদশা আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল-এর জন্মস্থান এখানে। আকবরের নবরত্নের অন্যতম ফৈজির সমাধি এখানে কোন অজ্ঞাতস্থানে ছিল (ফৈজি প্রথমে মুসলমান যিনি হিন্দু শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন ও তাঁর নিজের গ্রন্থাগার ছিল) সেসব লেখক খুঁজতে থাকলেন। বাবরের বিখ্যাত উদ্যান যেখানে তিনি দোয়াব এর মত জায়গায় আনারস আর চন্দন গাছ লাগানোর প্রচেষ্টা করেছিলেন। লেখক আকবরের রামবাগ (যা সম্ভবত বাবরের চারবাগ) খুঁজছিলেন, যেখানে রাজপুরুষরা যমুনার তীরে শীতল ও শান্ত পরিবেশে থাকতে ভালোবাসতেন। 


লেখক এবার দেখলেন এতমাদ-উদ-দৌলার অপূর্ব সমাধি। এই সৌধের গা থেকে দামি পাথর আর মোজাইকের কাজ খুলে চুরি করে নেওয়া হয়েছে। (এটি নূরজাহানের তৈরি তাঁর বাবার সমাধি, ১৬২২ থেকে ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি)। 


শহরে ঢুকলেই আশি ফুট উঁচু মিনার যুক্ত আগ্রা দূর্গ চোখে পড়ে। দূর্গের প্রাঙ্গণে বাদশাহদের পশুর লড়াই দেখার ব্যবস্থা ছিল। ইংরেজ বণিক উইলিয়াম ফিঞ্চের লেখা থেকে জানা যায় যে এই দূর্গের প্রাঙ্গণে রবিবার ছাড়া রোজ দুপুরে বাদশা জাহাঙ্গীর এখান থেকে হাতি, সিংহ, মোষের লড়াই, চিতার হরিণ শিকার, এমনকি জন্তুর মানুষ মারা ইত্যাদি দেখতেন। বাদশা উপরের বারান্দা থেকে এই লড়াই দেখতেন। সেখানকার দরজার নাম দর্শন দরজা এই দরজার উপরে দুটো হাতির পিঠে চড়া, জয়মল ও পত্তের মূর্তি আছে, যা ওই দুই রাজপুত বীরের স্মৃতিতে আকবর তৈরি করিয়েছিলেন। ৩০০ বছর আগে তৈরি হলেও আগ্রা দূর্গের পরিস্থিতি বেশ ভালো। দূর্গের চারদিক বেষ্টন করা প্রাচীর ও পরিখা অন্তর্হিত হয়েছে। ভিতরে ৩০ ফুট চওড়া নুড়ি দিয়ে বাঁধানো পরিখা এখনো আছে। ভিতরের সুউচ্চ প্রাচীর কোনোভাবেই গোপনে পার হওয়া সম্ভব নয়। 


দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করার দুটি দরজা। একটি দরজার নাম বোখারা গেট, যার অপর নাম উমরা সিং কা ফটক (অমর সিং দরজা)। উমরা সিং মারোয়ারের যুবরাজ ছিলেন কিন্তু তাঁর পিতা তাঁকে সিংহাসনের দাবিদার মনোনীত না করায় তিনি শাহজাহানের সেনাবাহিনীর মনসবদারের পদে যোগ দেন। তিনি একবার একপক্ষ কাল বাদশাহের রাজসভায় উপস্থিত না থেকে শিকার খেলায় ব্যস্ত ছিলেন। বাদশাহ এই অনুপস্থিতির জন্য তাঁকে ভৎসনা করেন ও অর্থদণ্ড দেন। এই অর্থদণ্ড নাজিরকে দিতে উমরা অস্বীকার করেন। তখন তাঁকে সভায় ডেকে পাঠানো হয়। ভরা রাজসভায় ক্রুদ্ধ উমরা নাজিরের বুকে ছোরা বসানো ও তাঁর পরবর্তী লক্ষ্য ছিলেন বাদশাহ। বাদশাহ কোনোমতে অন্দরে আশ্রয় নেন। উমরা তাঁর হত্যালীলা চালিয়ে যান। অনেক মুঘল বীর, অভিজাত মারা যান। উমরা সিং পরে নিহত হলেও তাঁর অনুচরেরা হত্যালীলা চালায়। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যে বুখারা দরজা অর্থাৎ যেখান দিয়ে উমরা ও তাঁর অনুচরেরা রাজসভায় প্রবেশ করেছিল তার নাম হয় উমরা সিং দরজা। এই দরজা ১৭৫ বছর ধরে বন্ধ ছিল এবং এক বৃহৎ সর্প সেটি পাহারা দিত। অবশেষে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে এই দরজা আবার খোলা হয়, এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের দ্বারা। তিনি বলেন এই দরজা খোলার মুহূর্তে একটা বড় শঙ্খচূড় সাপ তাঁর পায়ের ফাঁক দিয়ে চলে যায়। 


দূর্গের ভিতরটা একটি শহরের মতো বড়। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ৫৮৪৫ জন ইংরাজ এই দূর্গের ভিতর আশ্রয় নিয়েছিল। দূর্গ থেকে নীচে শহরের দৃশ্য খুব সুন্দর দেখায়। জঙ্গল, মাঠ, শস্য ক্ষেত্র, ঘরবাড়ি, আর সবথেকে আকর্ষণীয় তাজমহল। 


দেওয়ানি খাস যা আকবরের মন্ত্রিসভা, তার চত্বর থেকে যমুনা নদীর শোভা দেখার মত। দেওয়ানি খাস গঠনের দিক থেকে উৎকর্ষের ছাপ বহন করে। শ্বেত পাথরের স্তম্ভ, খিলান নানারকম খোদাইয়ের কাজ করা, শ্বেত পাথরের মেঝে, (স্তম্ভে সোনার গিল্টির এখনো কিছু কিছু দেখতে পাওয়া যায়) নিয়ে অসাধারণ স্থাপত্য। এখানেই আকবর তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখানেই আবুল ফজল আইন প্রণয়ন করেছেন। খোলা চত্বরে কালো পাথরের বারো ফুট চওড়া, দুই ফুট উঁচু তখৎ বা সিংহাসন রয়েছে, যেখানে বসে বাদশাহ নদীর শীতল বায়ু সেবন করতেন, তানসেনের গান শুনতেন, ধর্মীয় আলোচনা করতেন বা বীরবলের চাতুর্য উপভোগ করতেন। 


মোগল অন্তঃপুরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গৃহটি হলো সীসা মহল বা আয়না ঘর, যার দেওয়াল আয়নায় মোড়া ছিল। কৃত্রিম উপায়ে স্থাপত্যের সাহায্যে ঘর ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা ছিল। শ্বেত পাথরের জালির কাজের মধ্যে দিয়ে হারেমের মহিলারা যমুনা দর্শন করতেন। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনার আক্রমণের সময় এই ঝরোখার একটি অংশ কামানের গোলায় ফেটে নষ্ট হয়ে গেছে, আয়নার ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে গেছে, কিছু কাচ ভেঙ্গে গেছে, ফোয়ারাগুলি শুধুমাত্র দর্শক এলে চালু করা হয়। বাদশা আকবরের সময় পাঁচ হাজার রমণী ছিল হারেমে। কিন্তু হারেমের আকার এত বড় নয় যে প্রত্যেককে আলাদা ঘর দেওয়া সম্ভব হত। 


জেনানা থেকে বেরিয়ে একটি বড় চত্বরে এলেন লেখক। সেখান থেকে কিছু সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে একটি দরজা, দরজার ওপারে অন্ধকার সিঁড়ি পৌঁছায় তাইখানা বা সুড়ঙ্গ পথে। এই সুড়ঙ্গগুলি নদী পর্যন্ত গেছে। টর্চের আলোর সাহায্যে তার ভিতরে যান লেখক। দেখেন সরু আঁকাবাঁকা পথ, বাদুড় আর পাখির ডানা ঝাপটানো শব্দ শোনেন, ফাঁসি ঘর দেখেন। সেখানে হারেমের অবাধ্য নারীদের হয়তো এই তাইখানার পথে মেরে যমুনায় ফেলে দেওয়া হতো বলে লেখক বলেন। 


জনসাধারণের জন্য খোলা দরবার দেওয়ানি আম, যেখানে মোগল বাদশাহরা আম আদমীর সঙ্গে দেখা করতেন। এটি ভারতের একটা অন্যতম বৃহত্তম হল, যা ১৮০ ফুট লম্বা ও ৬০ ফুট চওড়া। যথেষ্ট আলো হাওয়াযুক্ত এই সরল অথচ অভিজাত গঠনের হলটি সুন্দর শ্বেত পাথরের স্তম্ভ, পিলার দিয়ে সজ্জিত। এখানে এখনো বাদশাহের সিংহাসন রয়েছে। যে শ্বেতপাথরের খন্ডের উপর দাঁড়িয়ে মন্ত্রীরা ভাষণ দিতেন সেটিও রয়েছে। টমাস রো ও টেরি (ইংল্যান্ডের দূত) রাজসভার স্বর্ণরৌপ্য খচিত যে রকম সাজসজ্জা কথা বলেছেন, সেই রাজকীয় সাজসজ্জা এখন আর নেই। হলের এক কোণে ১১ ফুট লম্বা, ৯ ফুট চওড়া সোমনাথ দরজা রাখা আছে। এই দরজা সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন করে গজনীর সুলতান মামুদ গজনীতে নিয়ে যান। ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড এলেনবরো সেটি ভারতে আনান ও আগ্রা দূর্গে সেটি রাখা হয় (১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে কাবুল যুদ্ধের সময়)। 


দেওয়ানি আমের কাছে মিস্টার জন রাসেল কোলভিনের সমাধি আছে, যিনি উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের লেফট্যানেন্ট গভর্নর ছিলেন ও সিপাহী বিদ্রোহের সময় দূর্গের মধ্যে কলেরায় মারা যান। 


মতি মসজিদ পুরো শ্বেত পাথরে তৈরি বলে মুক্তা বা মোতির সঙ্গে তুলনীয়। এই অভিজাত সুন্দর মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। এর গায়ের লেখা থেকে জানা যায় ১৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহান হারেমের মহিলাদের উপাসনা করার জন্য এটি তৈরি করে দিয়েছিলেন ৬০ লাখ টাকা খরচ করে। মসজিদের সামনে আছে অযু করার জল, মাঝে ফোয়ারা। সেই ফোয়ারা এখন জল-শূন্য। 


শাহজাহানের একটি ৪০ ফুট ব্যাসের একটিমাত্র শ্বেত পাথরকে খোদাই করে তৈরি স্নানের চৌবাচ্চা ছিল, যেটি আর এখন নেই। লর্ড হেস্টিংস এটি ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন রাজার জন্য। কিন্তু ওজনের কারণে সম্ভব হয়নি। চৌবাচ্চাটির শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল জানা নেই। 


আগ্রা দূর্গ ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে আকবর কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। এই দূর্গের স্থানে পূর্বে কোন দূর্গ ছিল তা হিন্দুদের না পাঠানদের সেটা জানা নেই। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই দূর্গে একটি বিরাট কামান ছিল, সেটি যে কত পুরনো তা নিয়ে মতানৈক্য আছে। এটির গায়ে অনেক পুরনো দিনের লেখা ছিল। আকবরের নামও তার মধ্যে পরবর্তীকালে খোদিত হয়েছিল। ব্রিটিশরা এটিকে প্রথমে কলকাতা ও পরে ইংল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওজনের কারণে সম্ভব হয়নি। সেটি যমুনার পাড়ে কিছুদিন পড়ে থাকার পর গোলা দিয়ে সেটিকে টুকরো টুকরো করে বিক্রি করা হয়। যদি সেটি থাকতো তবে গবেষণা করে হয়তো জানা যেত তার গায়ে কোন যুগের লিপি ছিল। 


আগ্রা দূর্গ থেকে তাজমহল পর্যন্ত সুন্দর রাস্তা ও নদীতীর রয়েছে, যা ইংরেজরা তৈরি করেছে, ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ পীড়িত দরিদ্রদের শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগিয়ে। এই রাস্তা তৈরি সময় কিছু পুরনো ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। 


তাজমহলের অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা বিস্তারিতভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন। সেগুলি বিস্তারিত ভাবে না বলে নতুন তথ্য যা পাওয়া গেছে এই লেখা থেকে সেগুলি বিবৃত হল। 


মমতাজ বেগমের কবরের উপর একটি শ্বেত পাথরের ফলকে একটি ১০০ রকম পাথরের কাজ করা ফুলের নকশা আছে। আরবিতে তাঁর নানা গুণের কথা লিখে তাতে নানারকম অতি দুর্মূল্য রত্ন খচিত করা আছে, যেগুলি কোন অপবিত্র হাত চুরি করতে পারেনি। (তাহলে কি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে এই মূল্যবান রত্ন গুলি যথাস্থানে ছিল?)। 


১৬৩১ এ মৃতা মমতাজের পাশের কবরে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহানের মৃত্যু হলে আওরঙ্গজেবের উদ্যোগে তাঁকে শায়িত করা হয়। 


একদিন মমতাজ শাহজাহানের সঙ্গে তাস খেলছিলেন মমতাজ সেদিন স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি মারা গেলে কি করা হবে। শাহজাহান বলেন এমন একটি সমাধি তৈরি করবেন চিরদিন সবাই তাঁকে মনে রাখবে। মমতাজের মৃত্যু হয় এক কন্যা সন্তানের জন্মের সময়, যে সন্তানের কান্না তিনি ও তাঁর কন্যারা শিশুটির জন্মের আগেই শুনতে পেতেন। এই ঘটনার জন্য তাঁর ধারণা ছিল যে তিনি শীঘ্র মারা যাবেন। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাদশা চিকিৎসক, ধাত্রী প্রভৃতির যথেষ্ট ব্যবস্থা করেছিলেন প্রসবের সময়। কিন্তু সন্তান জন্মের দুই ঘন্টা পরে মমতাজ মারা যান। মৃত্যুশয্যায় মমতাজ শাহজাহানকে তাঁর সমাধি সংক্রান্ত প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়েছিলেন। 


তেভারনিয়ের (ফরাসি পর্যটক) লিখেছেন তাজ তৈরি হতে কুড়ি হাজার কর্মীর বাইশ বছর লেগেছিল। জয়পুরের রাজা শ্বেতপাথর উপহার দেন, যা ১৪০ মাইল দূর থেকে আনতে হয়। বারনিয়ের (ফরাসি পর্যটক) বলেছেন মমতাজের মৃত্যুতে শাহজাহান অত্যন্ত মর্মাহত হন। 


ইউরোপীয়রা কোন ভারতীয়কে তাজমহল নির্মাণের কৃতিত্ব দিতে রাজি নন। তারা বিশ্বাস করেন ফরাসী স্থপতি অস্টিন ডি বরডিউক্স  তাজমহলের পরিকল্পনা ও নির্মাণ করেছিলেন। এই ব্যক্তি শাহজাহানের সভায় ছিলেন প্রধান স্থপতি হিসেবে ও প্রতি মাসে এক হাজার টাকা ও নানা  উপঢৌকন পেতেন। দেশীয়রা তাঁকে উস্টান ইসন নামে জানতো। শাহজাহানের সভায় অনেক ইউরোপীয় ছিলেন হকিংস (ব্রিটিশ দূত একজন মনসবদার), তেভার্নিয়ার (একজন রত্নকার), বারনিয়ার (একজন চিকিৎসক)। তাই অস্টিনের একজন স্থপতি হিসেবে থাকাটা আশ্চর্যের বিষয় নয়। (ওস্তাদ আহমেদ লাহোরী তাজের প্রধান স্থপতি ছিলেন বলে সভার ঘটনাপঞ্জি লেখক আব্দুল হামিদ লাহোরী তার বাদশাহানামা বইয়ে লিখে গেছেন)। তেভারনিয়ের তাজ তৈরি হতে দেখেছেন, কিন্তু তিনি অস্টিনের বিষয়ে কিছু লেখেন নি। 


১৮১৪ তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাজমহলের সারানোর কাজে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করেন। 


তাজের বিপরীতে যমুনার অপর পাড়ে একটি অসমাপ্ত সৌধ আছে। যেটিতে শাহজাহান নিজের সমাধি হিসেবে তৈরি করছিলেন কিন্তু ঔরঙ্গজেবের কারণে (আওরঙ্গজেব শাহজাহানকে শেষ জীবনে বন্দি করে রাখেন) তা শেষ করতে পারেননি। 


উনবিংশ শতাব্দীর আগ্রা চার মাইল দৈর্ঘ্যে ও তিন মাইল প্রস্থের শহর। এর বাইরের প্রাচীর আর নেই। ভিতরের প্রাচীরের কিছু কিছু চিহ্ন পাওয়া যায়। পূর্বের জনসাধারণের স্নানাগার, কুস্তির আখড়া প্রভৃতি এখন আর নেই। রাজা মান, রাজা বীরবল প্রমুখ অভিজাতদের প্রাসাদের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। পুরনো স্থাপত্যের ইঁট দিয়ে এখনকার ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে। মোগলদের সময়কার ঘোড়ায় টানা এক্কাগাড়ি শুধুমাত্র এখনো আগ্রায় রয়ে গেছে।



এখানে বইটির প্রথম খণ্ড শেষ হল। এবার শুরু হবে 'দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু' বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড।
 
                         (চলছে)
  

শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৪

৪৮। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১২ ভোলানাথ চন্দ্র

 

  

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                     (আগের পর্বের পরে)

কানপুর সম্পর্কে আগ্রহ যে মানুষের মনে থাকে বাস্তবে কানপুর দেখলে তার আশা ভঙ্গ হওয়াটাই স্বাভাবিক, লিখেছে লেখক ভোলানাথ চন্দ্র। গঙ্গার ধারে অবস্থিত হলেও কানপুরের বালুকাময়, রুক্ষ সমতলভূমি, ধুলোবালি আর লু বা ধূলি ঝড় কানপুরকে আকর্ষণহীন করে তোলে। কানপুরে কোন পুরনো স্থাপত্য নেই। কানপুরের কোন ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই। হিন্দুদের কোন পৌরাণিক কাহিনী, বাবরের আত্মজীবনী, আইন-ই-আকবরী - কোথাও কানপুরের উল্লেখ নেই। কানপুর ইংরেজদের সৃষ্ট নগরী। যখন থেকে ইংরেজদের লক্ষ্ণৌয়ের নবাবদের উপর নজরদারি দরকার হয়ে পড়ে, তখন থেকে কানপুরের বিকাশ হয়। 


কানপুর এখন বাণিজ্য নগরী। এখানে সেখানে তুলোর গাঁঠরি, বিশাল বিশাল শস্যের স্তুপ চোখে পড়ে। সেগুলি গাড়িতে আসা-যাওয়া করে। হাজার হাজার ঘোড়া, উট, বলদ, গাধার পায়ের আঘাতে ধুলো উড়ে দমবন্ধ-কর অবস্থা তৈরি হয়েছে। 


ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় চিত্রটি অন্যরকম। প্রতিদিন সকালে, বিকালে রাস্তা জল দিয়ে ধোয়া হয়। ভারতের কোন রাস্তা এখানকার রাস্তার মতো চওড়া নয়। রাস্তার দু'ধারে গাছের সারি। খোলা ময়দানগুলি শহরে স্বাস্থ্য রক্ষা করছে। সাইনবোর্ড লাগানো ছোটখাটো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দোকান, সুন্দর বাংলো, সেনা ছাউনি, বাজার, বাগান ছিল; যখন কানপুরের সুদিন ছিল। ইউরোপীয়রা পিকনিক, ডিনার পার্টি, বলডান্স প্রভৃতিতে আনন্দে দিন কাটাতো। কিন্তু সে সব দিন চলে গেছে। রয়ে গেছে শুধু রাস্তাগুলি। এখন শুধু পরিত্যক্ত বাড়ি দরজা-জানলা কি ছাদহীন ইউরোপীয় বাংলো চোখে পড়ে। সব কিছু সিপাহী বিদ্রোহে ধ্বংস হয়ে গেছে। 


শাহ বিহারীলাল ঘাটে যেখানে একগুচ্ছ সুন্দর মন্দির আর পঞ্চাশ সিঁড়িযুক্ত ঘাট ছিল। এখন সেগুলি আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়েছে। নৌকার পুল উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে বন্দুকগুলি ব্যবহার করার জন্য সিপাইরা এনেছিল সেগুলি ওই মন্দিরগুলিতে লুকানো ছিল। তাই স্যার কলিং-কে সেই গুলি বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিতে হয়েছিল। নৌকার ব্রিজের নিরাপত্তার স্বার্থে এই মন্দিরগুলিকে ধ্বংস করা হয়। (স্যার কলিং ক্যাম্বেল সিপাহী বিদ্রোহের সময় কমান্ডার ইন ইন্ডিয়া ছিলেন)। 


সিপাহী বিদ্রোহে যে ঝড় উঠেছিল তার মধ্যে কানপুর সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল নানা সাহেবের জন্য। লেখক এবার সিপাহী বিদ্রোহের নানা কথা ও কানপুরের নানা ধ্বংসলীলা বর্ণনা করেন। কিন্তু ভ্রমণ বিষয়ক লেখাতে সেগুলি অপ্রয়োজনীয় বলে বর্জন করা হলো। 


লেখক সতীচৌরা ঘাট দেখলেন, যেখানে সতীদাহ হত ও সিপাহী বিদ্রোহে ইংরেজদের হত্যা করা হয়েছিল।


কানপুর শহরে ঘুরতে ঘুরতে এক বাঙালি বাবুর প্রতিষ্ঠিত দুর্গামূর্তি দেখলেন লেখক। এ ছাড়া আর কোন মূর্তি দেখতে পাননি শহরে। লেখকের ধারণা হিন্দুস্তানিদের থেকে বাঙালিরা মূর্তি পূজায় অনেক বেশি আগ্রহী। বাঙালি বাবুটি নিশ্চয়ই বাংলা থেকে কারিগর এনে দুর্গা মূর্তি বানিয়েছেন কারণ হিন্দুস্তানিরা সিংহের পিঠে বসা দশ হাতের এই দেবী মূর্তি তৈরি করতে পারবে না। 


এবার তাঁরা কানপুর থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন ডাক গাড়িতে। দোয়াব অঞ্চল বাংলার মতো সমতল আর দোআঁশ মাটির জায়গা, কিন্তু দোয়াবের মাটি বাংলার মাটির মতো উর্বর নয়। এখানকার জলবায়ু শুষ্ক, বাংলার মতো স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ এখানে নেই। জলবায়ুর কারণে বাংলায় রোগের প্রকোপ বেশি। এখানকার মানুষকে কষ্ট করে জীবনযাত্রা চালাতে হয় বলে এরা খুব পরিশ্রমী, বাংলার মানুষের মতো কর্মবিমুখ নয়। 


চৌবেপুর হয়ে মীরা কা সরাই (মীরা সরাই) এলেন। মীরা কা সরাই এক মুসলমান ব্যক্তির নিজস্ব দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এখানে অভিজাত পরিবেশে হিন্দু ও মুসলমান পথিক ও ব্যবসায়ীরা থাকতে পারে। 


এরপর তিন মাইল পথ পেরিয়ে এল কনৌজ। (একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর) রাঠোর সাম্রাজ্যের প্রাসাদ, মিনার সমন্বিত স্থান এখন আগের গৌরব হারিয়েছে। মনুসংহিতায় প্রথম কনৌজের উল্লেখ পাওয়া যায় কাণ্যকুব্জ নামে, যা পাঞ্চাল রাজ্যের রাজধানী ছিল। ভগবান বুদ্ধ এখানে এসেছিলেন ও বাণী প্রচার করেছিলেন। সেই স্মৃতিকে অক্ষয় করে রাখতে সম্রাট অশোক এখানে ২০০ ফুট উঁচু স্তূপ স্থাপন করেছিলেন। টলেমি তাঁর বইতে এই স্থানের উল্লেখ করেছেন। ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাং এই স্থান দর্শন করেছেন যথাক্রমে পঞ্চম ও সপ্তম শতাব্দীতে। হিউয়েন সাং-এর সময় এখানকার রাজা ছিলেন হর্ষবর্ধন। আবু জাইদ (নবম শতাব্দীর পারস্যের পর্যটক) এই শহরকে প্রশংসা করেছেন তাঁর লেখায়। ৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মাসৌদি (আরবের পর্যটক আল মাসুদি) এই স্থানের উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখায়। মোহাম্মদ ঘোরীর আক্রমণে কানৌজে হিন্দু রাজত্বের অবসান হয়। ক্রমে শ্রী হারিয়ে ইবন বতুতার সময় এটি একটি ছোট শহরে পরিণত হয়। 


ব্রিটিশ প্রত্নতাত্বিক আলেকজান্ডার কানিংহাম সম্রাট অশোকের নির্মিত বৌদ্ধস্তূপ, হিন্দু রাজাদের প্রাসাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। মাটির নীচ থেকে খনন করে সেসব উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। কনৌজের জুম্মা মসজিদে প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের অংশ পাওয়া যায়। মাটির তলা থেকে প্রাচীন মুদ্রা, হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তিও পাওয়া গেছে। 


কনৌজ থেকে বাংলায় পাঁচ জন ব্রাহ্মণকে সেন রাজা এনেছিলেন যাদের বংশধরেরা বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি কুলিন ব্রাহ্মণ ও তাদের সঙ্গে আসা পাঁচ শূদ্রদের বংশ থেকে ঘোষ,বসু প্রভৃতি কুলীন কায়স্থর উদ্ভব হয়েছিল। এই কৌলিন্য প্রথায় বৃদ্ধ বয়সে ও মৃত্যু শয্যাতেও কুলীন ব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মণ কন্যাদের বিবাহ করত। 


কনৌজ থেকে আবার যাত্রা শুরু হল। নানা অখ্যাত গ্রাম, আমবাগান পেরিয়ে পথ। এখানে লেখক বলদে টানা ট্রেন দেখলেন। ৫০-৬০ টি ওয়াগন নিয়ে তৈরি ট্রেন জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যায়। ট্রেনের সামনে তিনটি বলদ থাকে, তারা ট্রেনটি টানে। পিছনে আর একটি বলদ থাকে, বদলি হিসাবে। কয়েকশো মাইল এই বলদের ট্রেন যায়। রাতে কোথাও বিশ্রাম নেয়, সারাদিন চলে। কখনো কখনো উটের সারি, গাধার দলও মাল বয়ে নিয়ে চলে পাশ দিয়ে রাস্তার ধুলো উড়িয়ে। 


বৃষ্টি খুব কম হচ্ছে। চার পাশে খরা শুরু হয়েছে। কুয়োর জল ষাট সত্তর ফুট নীচে নেমে গেছে। খাদ্যশস্যের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। চিরদিনই মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষ হয়ে আসছে। এখন সরকার দয়ালু, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ইত্যাদি কারণে কিছুকাল দুর্ভিক্ষ হয়নি। কিন্তু শুধু খাল ও কূপের জল সেচ দিয়ে অনাবৃষ্টির মোকাবিলা করা যায় না। 


রাস্তায় মাঝে মাঝে সিপাহী বিদ্রোহের ফলে ঘরবাড়ি, বাংলোর ধ্বংসাবশেষ, এমন কি জনশূন্য গ্রামও চোখে পড়ে। তবে সাধারণভাবে গ্রামজীবনে শান্তি ও স্বাভাবিকত্ব ফিরে এসেছে। 


চার পাশে শুধু জোয়ারের ক্ষেত আমবাগান ছাড়া বেশিরভাগ সময় কিছুই চোখে পড়ে না। ভোগাওনের কাছে রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে প্রধান রাস্তা দিল্লির দিকে ও অপর রাস্তা আগ্রার দিকে গেছে। 


এবার এলো মাইনপুর। এখানে এখনো একটি পুরনো হিন্দু রাজার দূর্গ রয়েছে। এখানে মূলত রাজপুরদের বাস। দীর্ঘকাল থেকে চলে আসা শিশুকন্যা হত্যা এখন ইংরেজ শাসনে বন্ধ করা হয়েছে। 


পরদিন সকালে লেখকের ডাকগাড়ি এসে পৌঁছালো শিকোহাবাদে, এটি মুসলমান প্রধান এলাকা। বড় শহর থেকে শিকোহাবাদ এখন এক সামান্য গ্রামে পরিণত হয়েছে। 


দোয়াব অঞ্চলে এখন এমন কোন জমি নেই যেখানে চাষ হয় না। বাংলায় শহর গড়ে উঠেছে একমাত্র ভাগীরথী নদীর তীরে, কিন্তু দোয়াবে মাঝে মাঝে ফতেপুর, কানপুর, মাইনপুরের মতো শহর আছে। বাংলার গ্রামের তুলনায় দোয়াবের গ্রামের দোকানে অনেক বেশি রকম জিনিসপত্র কিনতে পাওয়া যায়। বাংলার গ্রামের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দোয়াবের গ্রামে না থাকলেও রোগের প্রাদুর্ভাব এখানে অনেক কম বাংলার থেকে। বাংলার গরিবদের থেকে দোয়াবের গরিবরা ভালো খাবার খায়, ভালো পোষাক পরে। বলদ ছাড়াও উট, মোষ, গাধা, ঘোড়াকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শ্রম কমায় এখনকার মানুষ কিন্তু বাংলার মানুষ শুধু বলদের ওপর নির্ভরশীল। লেখক এমনকি মেয়েদের সাজের ব্যাপারেও বাংলা ও দোয়াবের তুলনা করে দোয়াবের নারীদের রুচি শ্রেষ্ঠতর এ কথা বলেন। পঞ্চাশ বছর আগে দোয়াাবের মানুষ ঢাল, তরোয়াল, গাদা বন্দুক নিয়ে পথ চলত। এখন আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির ফলে সেই রীতি আর নেই। মুঘল আমলের তামার পয়সা এখনো দোয়াব অঞ্চলে প্রচলিত, যেমন বাংলায় কড়ির ব্যবহার রয়ে গেছে। মূর্তি পূজার চল বাংলার থেকে এই অঞ্চলে কম। বাংলার প্রতিটি গ্রামের মতো এখানকার গ্রামে শিব বা ষষ্ঠীর মন্দির নেই। 


রাস্তায় একটি ইউরোপীয় ডাকগাড়িতে দুজন ইউরোপীয়কে তাঁদের ছাড়িয়ে সামনে চলে যেতে দেখলেন লেখক। সাহেবদের গাড়ির গতি আবার দেশীয়দের সব কিছুতে পিছিয়ে পড়া প্রমাণ করলো। 


ফিরোজাবাদে ঢোকার সময় বোর্ডে 'আগ্রা পুলিশ থানা' লেখা রয়েছে লেখক দেখলেন। দ্বাদশ শতাব্দীর চান্দওয়ার এখন ফিরোজাবাদ। এখানেই চান্দেলা বীর অলহা ও উদল পৃথ্বীরাজ চৌহান-এর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোরীর কাছে জয়চাঁদের পরাজয়ের ফলে এখানেই দেশ থেকে হিন্দু রাজত্বের অবসান হয়েছিল। জয়চাঁদ পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাস্ত করে, তাঁর  কন্যা হরণের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মহম্মদ ঘোরীর সাহায্য নিয়েছিলেন, তাই জয়চাঁদকে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়। এখন ফিরোজাবাদের কোন গুরুত্ব নেই। শহরের চারপাশে যে প্রাচীর ছিল তারও কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষজন ছোট কুঁড়ে ঘরে থাকে। 


ফিরোজাবাদের পর থেকে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের দুই দিকে নিম গাছ রয়েছে ছায়া বিছিয়ে। পথে এক ঝাঁক হরিণ দেখা গেল রাস্তার পাশে। 


মহমেদাবাদের কাছে একটি সুন্দর কারুকার্যযুক্ত কিন্তু অচেনা সমাধি দেখলেন। এই কারুকার্য দেখে বোঝা গেল আগ্রা আর দূরে নেই। রাতে পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে চারদিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দূরের মানুষজন, বাজার দেখতে দেখতে তাঁরা একটা উঁচু নীচু জমির নির্জন উপত্যকায় এসে পৌঁছালেন, সেটা নেকড়ে থাকার জন্য আদর্শ স্থান। তার একটু পরেই যমুনা নদীর দেখা মিলল। নদীর ওপর আলোকোজ্জ্বল নৌকার পুল দেখা গেল। এই পুল পুলিশ পাহারা দেয়। প্রতিদিন মালবাহী নৌকা যাওয়ার সময় এই পুল খোলা ও তারপর লাগানো হয়। লেখকেরা যখন পৌঁছলেন তখন পুল খোলা ছিল। তাই সে রাতে তাঁরা নদী পেরিয়ে আগ্রায় পৌঁছতে পারলেন না। গাড়িতেই রাত্রি কাটাতে হলো। জ্যোৎস্নার আলোয় নদীর শোভা দেখতে দেখতে তাঁদের সময় কাটল।

                            (চলছে)

মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪

৪৭। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১১ ভোলানাথ চন্দ্র




সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                      (আগের পর্বের পরে)

সারারাত ধরে ডাকগাড়ি চলল। সকালবেলা গঙ্গার ওপারে দেখা গেল পান্ডবদের পূর্বপুরুষ পুরোরবার রাজধানী (যার নাম ছিল 'প্রতিষ্ঠান'), পুরানের প্রয়াগ আর আকবরের এলাহাবাদ। 


গঙ্গায় ভাসমান নৌকার পুল তখন মাঝখানে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাই নৌকায় গঙ্গা পার হলেন লেখক ও সঙ্গীরা। প্রথমেই প্রয়াগ অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমস্থল দেখতে গেলেন তাঁরা। সঙ্গমের দৃশ্য অতি সুন্দর। হিন্দুদের প্রয়াগে এলেই চুল দাড়ি এমনকি ভুরু পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়। এই ক্ষৌরকর্মে যতগুলি চুল বিসর্জন দেওয়া হবে তত বছর নাকি স্বর্গবাস হবে। নারীরাও কেশকর্তনে সমান উৎসাহী এখানে। 


এমনিতে প্রতিদিন এলাহাবাদের গঙ্গার ঘাটগুলি পূজা-তর্পণরত মানুষের ভিড়ে ভর্তি থাকে, তবে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের পূর্ণিমাতে মাঘী প্রয়াগী নামে এক মহামেলা বসে। সেই বিশাল জনসমাগমের মেলা প্রায় দু মাস ব্যাপী চলে। দূরদুরান্ত থেকে এসে তাঁবুতে থাকে, অস্থায়ী দোকান বসায়। পুণ্যার্থী, ভিক্ষুক, ব্যবসায়ী ভ্রমণার্থীতে স্থানটি ভরে যায়। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের সময় থেকে দূর্গের প্রাচীরের সংলগ্ন স্থানে এই মেলা হতে দেওয়া হচ্ছে না। আগে প্রায় ১৫০০ পান্ডার পরিবার এখানে ছিল। তারা কেউ কেউ এই বিদ্রোহে সাহেবদের তাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। বিদ্রোহের পর তারা হয় পালিয়ে গেছে অন্য শহরে বা জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়েছে। তীর্থযাত্রীদের অবশ্য এতে সুবিধা হয়েছে। 


বেনারসের পরে এলাহাবাদ দেখলে সবকিছু সামান্য ও দীনহীন মনে হয় এবং বোঝা যায় এলাহাবাদের ডাকনাম ফকিরাবাদ কেন হয়েছে। কিন্তু ক্রমে শহরটি ভালো লেগে যায়। এখানকার বাড়ির সংখ্যা কম ও সেগুলি অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। রাস্তা চওড়া আর পুরনো বড় বড় গাছের ছায়াযুক্ত। 


হিন্দু পুরাণ অনুসারে এই স্থানে ত্রিবেণী সঙ্গম অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গম হয়েছে। কিন্তু  সরস্বতী নদী দৃশ্যমান নয়। বলা হয় তিনি আসার পথে দানবদের হুঙ্কারে ভয় পেয়ে দিল্লির উত্তর পূর্বে বালির তলায় অন্তর্হিত হয়েছেন। তারপরের পথ তিনি অন্তঃসলিলা অর্থাৎ মাটির তলা দিয়ে বহমান হয়ে প্রয়াগ এসে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গে মিশেছেন। সম্ভবত সরস্বতী বা ঘাগ্গার নদী এক প্রচন্ড ভূমিকম্পের ফলে ভূগর্ভে চলে যায়। সেই ভূকম্পের শব্দকে দানবের হুংকার বলে বলা হয়েছে। 


এলাহাবাদের সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণীয় স্নান হল দূর্গ, যা গঙ্গা যমুনার জল থেকে উপরে উঠে গেছে। এই দুর্গ কবে তৈরি হয়েছিল তা জানা যায় না। তবে হিন্দু যুগের এই দুর্গ বহু শক্তির উত্থান পতনের সাক্ষী। বাদশাহ আকবর মুসলমান শাসনকালে এই দুর্গে সংস্কার করেন ও এই স্থানের নাম দেন এলাহাবাদ। হিন্দুরা একটি কাহিনীতে বিশ্বাস করে। আকবর আগের জন্মে হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিলেন তার নাম ছিল মুকুন্দ। মুকুন্দের বাসনা ছিল ভারতের সম্রাট হওয়ার। মুকুন্দ দেবতার কৃপায় বর লাভ করেন যে পরের জীবনে তাঁর এই স্বাদ পূর্ণ হবে। সেই জীবনে যা কিছু তিনি পরের জীবনে মনে রাখতে চান তা তাম্রলিপিতে লিখে একস্থানে তিনি পুঁতে রাখেন। মুকুন্দ প্রয়াগে সেই তাম্রলিপি মাটিতে পুঁতে আগুনে আত্মাহুতি দেন। এরপর তিনি আকবর হিসেবে জন্ম নিয়ে সেই স্থানটি খুঁজে তাম্রলিপিটি পাঠ করেন। মুসলমানদের থেকে এখন দূর্গটি ইংরেজদের অধীনস্থ হয়েছে। উন্নত অস্ত্র ও যুদ্ধনীতির কারণে এই সময় দূর্গ নতুন ভাবে সজ্জিত হয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় দূর্গটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটি সুন্দর ময়দান পেরিয়ে দূর্গে ঢোকার তোরণ দ্বার। সেখানে সিপাহীরা, কালো চামড়ার মানুষদের দুর্গে প্রবেশের কাগজ দেখাতে না পারলে আটকে দেয়। ভিতরে আকবর তৈরি ২৭২ ফুট লম্বা রাজকীয় হল রয়েছে। হিন্দু রাজাদের আমলে স্থাপত্য চারিদিকে বিদ্যমান। দূর্গের ঠিক নীচ দিয়ে যমুনা বয়ে চলেছে। একটা খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা পাথরের সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে, সেখান দিয়ে মোগল রাজপরিবারের মহিলারা যমুনার ঘাটে স্নান করতে যেত। 


দূর্গের মধ্যে একটা সুড়ঙ্গের মতো স্থান আছে মাটির নীচে, যেটিতে এখন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ব্রিটিশ সৈন্যরা সেটি গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছে। আগে যারা এখানে এসেছে তারা ভিতরে ঢুকেছে। ভেতরটা ভিজে, ঠান্ডা, অদ্ভুত গন্ধযুক্ত। সুড়ঙ্গের শেষে একটা চাতাল আছে। তার উপর একটা ৭ ফুট উঁচু মন্দির আছে। মন্দিরে শিবলিঙ্গ আছে, শিবের চারপাশে আরও দেব দেবীর মূর্তি আছে। একটি মৃত গাছের গুঁড়ি আছে, যেটি কয়েকশো বছরের পুরনো। একে অক্ষয় বট বলে, এর নাকি মৃত্যু নেই। আরো বহু আগে নাকি এই সুড়ঙ্গ পথের অন্যদিক সঙ্গম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। লেখক বলেন গুহা মন্দির তৈরিতে যেহেতু বৌদ্ধরা পারদর্শী ছিল হয়তো এই গুহা মন্দির একসময় বৌদ্ধদের ছিল। পরবর্তীকালে হিন্দুরা তার দখল নেয়। হয়তো এককালে এই মন্দিরটি মাটির উপরে ছিল গঙ্গা-যমুনার পলি সঞ্চারের ফলে কোনভাবে এটি এখন পাতালপুরীতে পরিণত হয়েছে। দূর্গে সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হলো ভীমের গদা বা লাট বা দন্ড। এটি এক পাথরে তৈরি মাটি থেকে ৩৫ ফুট উঁচু বহু প্রাচীন একটি স্তম্ভ। বস্তুতঃ এটি সম্রাট অশোকের অনুশাসনের প্রচারের স্তম্ভ (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে তৈরি)। এই স্তম্ভটিতে পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে সমুদ্রগুপ্তের কীর্তি খোদিত হয়। শেষে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে এই স্তম্ভে জাহাঙ্গীরের নাম বংশ পরিচয় ইত্যাদি খোদিত হয়েছে। 


এলাহাবাদ শহর ঘুরে দেখার সময় লেখক যমুনা নদীর দরিয়া ঘাট দেখলেন। এটি একটি পুণ্যস্থান। শোনা যায় বনবাসে যাওয়ার সময় সীতা ও লক্ষণসহ রাম এখানে নদী পার হয়ে বন্ধু গুহক চন্ডালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এর নিকটে বেনারসের রাজার প্রাসাদ আছে। যমুনার ওপর ব্রিজ তৈরির কাজ চলছে দুই বছর ধরে। জলের তলায় ডুবে কাজ করতে গিয়ে তিন চারজন প্রাণ হারিয়েছে (১৮৬৬ তে এই ব্রিজ সম্পন্ন হয়)। লেখক জুম্মা মসজিদ, ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম, বরাহ মন্দির (লক্ষীবরাহ মন্দির) দেখলেন। 


এবার লেখক এলেন মোগলদের তৈরি বাগান খসরু বাগে রয়েছে খুব সুন্দর ফুল-ফল-সবজি বাগান আর গাছপালা দিয়ে তৈরি ছোট ছোট গোলক ধাঁধা। বাগানের মধ্যস্থলে খসরু, পারভেজ ও জাহাঙ্গীরের মারোয়ারি বেগমের সুন্দর কারুকার্য করার সমাধি দেখলেন। (খসরু জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে, পারভেজ জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র ও জাহাঙ্গীরের মারওয়ারি বেগমের নাম শাহ বেগম)। বাগানের সংলগ্ন অংশে একটি বড় সরাই আছে, যা মোগলদের জনস্বার্থমূলক কাজের একটা উদাহরণ। সরাইতে একটা সুগভীর কূপ আছে, যার মধ্যে নামার জন্য সিঁড়ি আছে। 


এলাহাবাদ স্টেশন হাওড়া স্টেশনের অর্ধেকের থেকেও ছোট। এখানে ট্রেন চালাতে কয়লার বদলে কাঠ ব্যবহার করা হয়। এই জ্বলন্ত কাঠের টুকরো হাওয়ায় উড়ে কামরায় ঢুকে কখনো কখনো অগ্নিকাণ্ড ঘটায়। গাড়ির হিন্দু যাত্রীরা অনেকে রঙিন পাগড়ী পড়ে থাকায় গাড়ির ভেতরটা বেশ উজ্জ্বল দেখতে লাগে। ট্রেনে এলাহাবাদ থেকে কানপুর যাওয়ার পথে ট্রেনে জানালা দিয়ে ঐতিহাসিক ও সুন্দর দোয়াব উপত্যকা দেখতে দেখতে যান লেখক। বেরহামপুর (এখানে এই নামে কোন স্টেশন এখন নেই), ফতেপুর স্টেশন হয়ে ট্রেন এসে পৌঁছায় কানপুর

                       
                         (চলছে)

বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪

৪৬। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১০ ভোলানাথ চন্দ্র

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


               (আগের পর্বের পরে)


২৫ শে অক্টোবর, ১৮৬০ হাওড়া থেকে রওনা হওয়ার সপ্তম দিনে লেখক ও তাঁর সঙ্গীদের ডাকগাড়ি ভোরে বেনারস (কাশী) এসে পৌঁছল। শিবের ত্রিশূলের ওপর অবস্থিত হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ বেনারস, ভোরের আলোয় গঙ্গার পাড়ে আবছা ভাবে দেখা গেল। কোন কোন মন্দির থেকে ভেসে আসা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। দিনের আলো প্রকট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মন্দির, প্রাসাদ, মিনার, গম্বুজ, ঘাট স্পষ্ট হয়ে দৃষ্টিগোচর হল। হিন্দু ধর্মের পবিত্রতম তীর্থস্থান শিবের শহর, বহুদিনের শোনা, পড়া, স্বপ্নের শহর এখন তাঁদের চোখের সামনে রয়েছে। প্রথম দৃষ্টিতে আশাপূরণ হল। 

অর্ধচন্দ্রাকৃতি সমগ্র শহরটি অপর পাড় থেকে দেখা যায়। অপর পাড়েও একটি সুন্দর শহর রয়ে, যার নাম ব্যাসকাশী। লেখক বলেছেন শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যেই শৈবদের কাশীর অন্য পাড়ে বৈষ্ণবরা ব্যাসকাশী তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের এই প্রতিযোগিতা সফল হয়নি। ব্যাসকাশী কাশীর মর্যাদা পায় নি। ব্যাসকাশীতে বেনারসের রাজার ভবন আছে। কাশী ও ব্যাশকাশীর মধ্যে যে নৌকার পুল আছে তার অন্যতম কারণ কাশীতে মৃত্যু হলে স্বর্গলাভ হয় আর ব্যাসকাশীতে মৃত্যু হলে গাধা হয়ে জন্ম লাভ হয় বলে কথিত আছে। নৌকার পুল ছাড়া নৌকায় গঙ্গা পারাপার করা যায়। বেনারসের গঙ্গা প্রস্থে ভাগীরথীর দুই তৃতীয়াংশের বেশি হবে না কিন্তু এর গভীরতা ও স্রোতের বেগ বেশি। 

রাজঘাটে নৌকা থেকে নেমে অতি উৎসাহে পায়ে হেঁটে শহর দেখতে বেরোলেন লেখক। কিন্তু অপর পাড় থেকে শহরটি যত সুন্দর লাগছিল এখন আর সেরকম লাগলো না নোংরার কারণে। 

বেনারসের তুলনা পূর্ব-পশ্চিমে কোথাও পাওয়া যাবে না। এটি মন্দির, মঠ, টোল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খাদ্যদ্রব্য সবকিছু নিয়ে সম্পূর্ণরূপে হিন্দু ধর্মের স্থান। একজন বিদেশি সত্যিকার হিন্দু শহর দেখতে চাইলে বেনারসে সে সব কিছু পাবে। বেনারস পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর, যার অস্তিত্ব এখনো আছে। এই শহর সুপ্রাচীন ও বর্তমান কালের মধ্যে মেল বন্ধন ঘটাচ্ছে। কিন্তু বেনারসে খুব প্রাচীন কোন স্থাপত্য নেই। আকবরের সময়কার স্থাপত্যই বোধ করি প্রাচীনতম। 


বেনারসের প্রাচীন নাম কাশী। কাশীখন্ডতে (স্কন্দপুরাণের অংশ) প্রাচীন বেনারসের বর্ণনা সামান্য আছে, তবে মূলত শিব বিষয়ক পুরাণ এটি। কাশীর অপর নাম বারাণসী শহরটির বরনা ও অসি নামক নদীর মধ্যে অবস্থানের কারণে হয়েছে। বেনারস নাম বারাণসী থেকে এসেছে। লেখক-এর মতে আগে কাশী নাম ছিল পরবর্তীকালে বারাণসী নাম হয়। ফা হিয়েনের ৪০৫ খ্রিস্টাব্দ আগমনের পরে বারাণসী নাম হয়েছে। হয়ত পুরনো কাশী বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে তার স্থান মাহাত্ম্য হারিয়ে ক্রমে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। পরে শৈবরা বরনা ও অসির সঙ্গমস্থলে তীর্থস্থান স্থাপন করেন ও নাম দেন বারাণসী, এটি লেখকের নিজস্ব মতবাদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের পরিবর্তন হয়েছে বারবার। বর্তমান শহর লেখকের মনে হয় তিনশ বছরের বেশি পুরনো নয়। এই শহর হারানো গৌরব ফিরে পেয়েছে ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বুন্দির রাজপুত রাজা রাও সুজন সিং-এর সময় থেকে। সুজন সিং আকবরের অধীনে বেনারসের শাসক ছিলেন। তাঁর আমলে প্রদেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ ও শহরের সৌন্দর্যবর্ধন ভালোভাবে হয়। 


রাজঘাটের উপরে রয়েছে বেনারসের পুরনো দূর্গ। মনুর আমলে বেনারস গঙ্গা তীরবর্তী দুটি স্বাধীন জনপদের অন্যতম ছিল। পশ্চিমে পাঞ্চাল, পূর্বে মগধের আক্রমণ আটকাতে এই দূর্গের অবস্থান হয়তো জরুরী ছিল। শেষ হিন্দু রাজা জয়চন্দ্র পর্যন্ত এই শহরের গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। পূজারীদের শহর মোহাম্মদ ঘোরীর দুর্ধর্ষ সেনাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। কেল্লায় জমা থাকা সমস্ত সম্পদ তাদের হাতে চলে যায়। কেল্লার মধ্যে অনেক মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির, বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। মাটির নীচে অনেক পুরনো স্থাপত্য চাপা পড়ে আছে। রাজঘাট থেকে প্রধান রাস্তা জনবহুল শহরের মধ্যে চলে গেছে। এখানে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের বাড়ি থেকে ছাত্রদের বেদ পাঠের আওয়াজ ভেসে আসতো। ক্ষমতাবান বৈশ্যদের দোকান আর প্রাসাদ চোখে পড়তো। বেশ কিছু শতাব্দী ধরে বৌদ্ধমঠ ও মন্দির ছিল এখানে। শঙ্করাচার্য এখানে বৌদ্ধ ধর্মের নাস্তিকতাকে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন হিন্দু ধর্ম দিয়ে। 


শহর ঘুরে দেখার হিন্দু রীতি আছে আছে তাকে নগর পরিক্রমণ বলে। যেখানে নির্দিষ্ট পথে ঘুরে তীর্থস্থান দর্শন করা হয়। সরু গলিতে পূর্ণ শহরের উঁচু উঁচু বাড়িগুলি সূর্যের আলো আর হাওয়া ঢুকতে দেয় না। সব বাড়ির বৈশিষ্ট্য একই। ঝুল বারান্দা, ঘুলঘুলি, কাজ করা দেওয়াল আর গোলাকার স্তম্ভ। বেশিরভাগ বাড়ি ছয় বা সাত তলা, প্রতিটি তলা ১০ বা ১২ ফুট উঁচু। ছোট উঠোন আর খুব ছোট ছোট অন্ধকার ঘর। নীচু দরজা যা দিয়ে ঢুকতে বেরোতে মাথা নীচু করতে হয়, জানলা ছোট আর কম সংখ্যক। অন্তঃপুর সাধারণত বাড়ির উপরের দিকে তলায় হয়। শহরটি অনেকগুলো মহল্লায় বিভক্ত, প্রতিটি মহল্লার দরজা রাতে বন্ধ থাকে। শহরে হাজার হাজার মন্দির আছে। হাজারের বেশি মন্দির মুসলমান আক্রমণকারীদের হাতে ধ্বংস হয়েছে কিন্তু আবার হাজার হাজার মন্দির তৈরি হয়েছে। আওরঙ্গজেবের সময় আবার অনেক মন্দির ধ্বংস হয় এবং তারপর আবার গড়ে ওঠে। বেনারস শুধু শৈবদের শহর নয়, এখানে বৌদ্ধ, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, জৈন সব ধর্ম মতের মানুষই আছে। বেনারসের ঘাটগুলি দেখবার মতো। ঘাটে মানুষ দিনের আনন্দময় সময়গুলি কাটায়। সকালে বেশিরভাগ হিন্দু ঘাটে স্নান, পোষাক পরিবর্তন, প্রার্থনা করে। সন্ধ্যায় গঙ্গায় নির্মল বায়ু সেবন করে, সন্ন্যাসীদের কঠোর তপস্যা দেখে, নানারকম পাঠ শোনে। হিন্দু মহিলাদের বাইরের খোলা জগত এই ঘাটগুলি। সেখানে তারা গল্প করে, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করে, এমন কি প্রেম পরিণয়ের সূত্রপাতও হয় এই ঘাটে। 


বেনারসে স্থানীয় দর্শনীয় স্থান দেখতে প্রথমে লেখক গেলেন ভেলুপুরের তিলভান্ডেশ্বর মন্দিরে। এক তরুণ ব্রাহ্মণ এক মদ-বিক্রেতার সুন্দরী পত্নীর প্রতি আকৃষ্ট হন। মদ-বিক্রেতাকে একদিনের জন্য ব্যবসার কাজে অন্যত্র যেতে হয়। তার স্ত্রী ওই ব্রাহ্মণকে তার সঙ্গে রাত কাটাতে আহ্বান করে। কিন্তু অযাচিতভাবে গভীর রাতে স্বামীটি বাড়ি ফেরে। স্ত্রী তখন আর কোন পথ না পেয়ে ব্রাহ্মণকে একটি বড় ভান্ডের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। ঘরে ঢুকে ওই মদ-বিক্রেতা সেই ভান্ডে মদ রাখতে শুরু করে। কোন উপায় না থাকায় ব্রাহ্মণ ওই ভান্ডে মদে ডুবে মারা যায় নিঃশব্দে। সকালে বিক্রেতা হতবাক হয়ে দেখেন ভান্ডটি সমগ্র মদ ও ব্রাহ্মণ সহ পাথরে পরিণত হয়েছে। সেটি তিল ভান্ডেশ্বর নামে পরিচিত হয়। সকলের বিষ্ময় জন্মায় যে এত ছোট পাত্রে কিভাবে কিভাবে ব্রাহ্মণ আশ্রয় নিয়েছিল। তিল ভান্ডেশ্বর বস্তুত একটি গোলাকার বড় পাথর যা নাকি প্রতিদিন তিল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে কিন্তু এই কাহিনী লোপ পেয়েছে। এই শিব মূর্তি তিল তিল করে বৃদ্ধি পায় বলে এর নাম তিল ভাণ্ডেশ্বর। 

মণিকর্নিকা ঘাট সম্পর্কে লেখক যে কাহিনী লিখেছেন সেটি হল - বিষ্ণু নানারকম সাধনায় শিবকে সন্তুষ্ট করেন। শিব বিষ্ণুর আচরণে সম্মতি সূচক মাথা নাড়তে গিয়ে তাঁর কর্ণকুণ্ডল থেকে একটি মণি পড়ে যায় এখানে, সেই থেকে নাম হয় মণিকর্ণিকা। এটি হিন্দুদের মৃতদেহ সৎকারের পূণ্যতম স্থান। 

লেখক এরপর ভৈরবনাথের মন্দির (বটুক ভৈরবের মন্দির), কবি তুলসী দাসের বাড়ি (তুলসী মানস মন্দির, যেখানে তুলসীদাস আন্দাজ ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে হিন্দি রামায়ণ রচনা করেছিলেন) এবং চৈতন্যদেবের শিষ্যদের আবাসস্থল দেখলেন।

গঙ্গার ধারে যে মন্দির ও প্রাসাদগুলি দেখা গেল তার বেশিরভাগই মারাঠা রাজারানীদের সৃষ্টি। বাজিরাও অহল্যা বাঈ প্রমুখের দান বর্তমান বেনারসের গঠনে সর্বাধিক ভূমিকা। হিন্দু বিজ্ঞানের মন্দির, যার নাম মান মন্ডল (মান মন্দির) বেনারসে তা অবস্থিত। রাজা মানসিংহ, যে রাজার ব্যাপারে ইতিহাস স্পষ্ট নয়, তাঁর বেনারসের প্রাসাদে, তাঁর মৃত্যুর বহু পরে অম্বরের রাজা জয় সিংহ এই মানমণ্ডল (মান মন্দির) তৈরি করেন বলে শোনা যায়। কিন্তু রাজা মানসিংহের সঙ্গে মান মন্দিরের সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। মান শব্দের অর্থ পরিমাপ, মন্ডল শব্দের অর্থ গোলক বা পৃথিবী। অর্থাৎ যে স্থানে পৃথিবীর পরিমাপ করা হয়। পাথরের তৈরি বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের সাহায্যে প্রাচীন হিন্দুরা পৃথিবীর বিভিন্ন পরিমাপ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা করতেন। সপ্তদশ শতকের ফরাসি পর্যটক জয়পুরের রাজকুমারদের জ্যোতির্বিদ্যা অভ্যাস করতে দেখেছিলেন। দুঃখের বিষয় যে এই মান মন্দিরের ব্যবহার এখন আর কোন ভারতীয় করেনা। যদিও হিন্দু পঞ্জিকা বেনারস থেকেই তৈরি হয় প্রতিবছর। (অন্তর্জাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে অম্বরের রাজা মানসিংহ এই প্রাসাদ ও ঘাট তৈরি করেন। মান মন্দির সপ্তদশ শতকে তৈরি করেন এই প্রাসাদে রাজা সওয়াই জয় সিং। 


এবার তাঁরা গেলেন মাধো রায় কে ধারারাতে, যেটি ছিল বিন্দু মাধবের মন্দির (একটি বিষ্ণুমন্দির)। ঔরঙ্গজেব এই মন্দির ধ্বংস করান ও মসজিদ তৈরি করান। এটি বেনারসের সবচেয়ে উঁচু মসজিদ। মসজিদের ২২৫ ফুট মিনার থেকে নীচে শহরটি সুন্দর দেখা যায়। পরিষ্কার আকাশ থাকলে এখান থেকে নাকি হিমালয় পর্বত দেখা যায়। মিনার থেকে গঙ্গার অপর পাড়ে চৈত সিং-এর দূর্গ দেখা যায়। (বেনারসের রাজা চৈত সিং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে শত্রুতামূলক আচরণ করায় তাঁকে দূর্গে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। তিনি তাঁর মাথার পাগড়িকে দড়ি হিসেবে ব্যবহার করে একটি ছোট জানালা দিয়ে গঙ্গায় নেমে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে দুর্গ থেকে ও কাশী থেকে পলায়ন করেন। সেই থেকে দূর্গটি চৈত সিং দূর্গ নামে খ্যাত। এখন পঞ্চগঙ্গা ঘাটে একটি বিন্দু মাধব মন্দির রয়েছে যেটি পরবর্তীকালে তৈরি হয়েছিল। মসজিদটির নাম আলমগীর মসজিদ। যে দীর্ঘ মিনারের কথা বলা হয়েছে সেটি উনবিংশ শতাব্দীতে ভগ্নপ্রায় হলে জেমস প্রিন্সেপ সেটি সংস্কার করেন। কিন্তু ১৯৪৮-এ সেটি বন্যার সময় ভেঙে পড়ে ও দুর্ঘটনায় কজন মারা যায়। তারপর মিনারের বাকি অংশ নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার ভাঙ্গার নির্দেশ দেন। তাই বর্তমানে সেই মিনার নেই)। 


কাশী বিশ্বেশ্বরের মন্দির দেখে লেখক কিছুটা হতাশ হলেন। যদিও মন্দিরের চূড়া, পাঞ্জাব কেশরী রঞ্জিত সিংহের দ্বারা সোনায় বাঁধানো, কিন্তু মন্দিরের বিশালত্বের অভাব আছে বলে তাঁর মনে হল। মন্দির তেমন প্রাচীন নয়, অহল্যা বাই দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরে ভক্তের আনাগোনা প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। প্রতিদিন সকাল বিকেলে দেবতাকে গঙ্গার জলে স্নান করানো হয়। মন্দিরের ভেতর লেখক যে ঐশ্বর্যের প্রকাশ আশা করেছিলেন তা পাননি। ফুলের মালা দিয়ে শিবলিঙ্গ সজ্জিত, ধূপধুনার গন্ধে আমোদিত, মন্ত্রে ও নানা বাদ্যযন্ত্রের শব্দে মুখরিত। এরপর দেবতাকে প্রসাদ দেওয়া হয় এবং তাঁর নিদ্রার ব্যবস্থা করা হয়, শীতে শাল ও গরমে কিংখাবে আচ্ছাদিত করে। 


জ্ঞানবাপী হল পবিত্রতম জলের কূপ। এই কূপের অভ্যন্তরে আদি বিশ্বেশ্বর শিবলিঙ্গ আছেন, যিনি মুসলমান যুগে বেনারসের পতনের সময় অন্তর্হিত হন। বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত লেখক ও সঙ্গীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন এবং তাঁদের গলায় মালা পরিয়ে দেন। মন্দিরের আশেপাশে বহু প্রাচীনকাল থেকে বসবাসকারী পরিবারেরা রয়েছে। গলি পথগুলি খুব সরু। প্রায়ই ধর্মের ষাঢ় সেই পথটুকুও আটকে দেয়। এদের কোন আঘাত করা যায় না (কারণ শিবের বাহন)। বোঝা যায় যে বেনারসে পুরোহিত ও ষাঢ়রাই সর্বোচ্চ সম্মান পায়। সব তীর্থস্থানের মত ভিখারিরা এখানে ভালো উপার্জন করে। 


বিশ্বেশ্বরের মন্দির থেকে কুড়ি তিরিশ পা গেলে অন্নপূর্ণার মন্দির। মন্দিরের গঠন সুন্দর। দেবী এখানে হিন্দু রমণীদের মত পর্দানশীন। পর্দা সরালে চতুর্ভূজা দেবী মূর্তি দেখা গেল। দেবী মূর্তি শ্বেতপাথরের তৈরি কিন্তু মুখে সোনা ও রুপা দু'রকম ছাঁচ ব্যবহার করে দেবীর রূপের পরিবর্তন আনা হয়। দেবীর হাতে বাসন আছে যাতে বোঝা যায় যে তিনি অন্নদান করছেন। লেখক মন্দিরে এক ব্রাহ্মণকে দেখলেন যিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে বেদ পাঠ করে যাচ্ছেন। 


বেনারসে যাঁরা ইতিহাস, প্রাচীনতা খুঁজতে আসেন তাঁরা কিছুটা হতাশ হতে পারেন কারণ প্রাচীন স্থাপত্য তেমন নেই এখানে, প্রাচীন দ্রব্যের জাদুঘর বা প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও নেই বেনারসে। দেখার জিনিসের মধ্যে আছে এক চক, যেখানে অভিজাত রেশম বস্ত্র সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিশেষ দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয় হয়। 


সবথেকে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য স্থান হল এখানকার কলেজ (সম্পূর্ণানন্দ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে এর নাম)। রঙিন কাচ, ফোয়ারা দিয়ে সাজানো জাকজমকপূর্ণ কলেজটির পাঠাগারে অনেক প্রাচীন পুঁথি রয়েছে। দশম একাদশ শতাব্দীর ভারতীয় মাটির বাসন রয়েছে। হিন্দুধর্ম, দর্শন, ন্যায়ের বিশিষ্ট পীঠস্থান বেনারসে নেওয়া সিদ্ধান্ত প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু সমাজের পক্ষে চরম আদেশ।  বেনারস কলেজ স্থাপন করা হয়েছে যাতে আলোকপ্রাপ্ত নতুন হিন্দু জাতি, নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে। (১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জোনাথন ডানকানের উদ্যোগে গভর্নর জেনারেল কর্ণওয়ালিসের আদেশে এটি স্থাপিত হয়)। আওরঙ্গজেবের মসজিদের পাশে নদীর ধারে একটি স্তম্ভ ছিল। অতি প্রাচীনকাল থেকে সেটি শিবের দণ্ড বলে খ্যাত ছিল। এখন সেটি এই কলেজের উত্তর দিকে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এটি এক পাথরের তৈরি। এতে লিপি ও কারুকার্য আছে। (পরে জানা গেছে এটি অশোকের সময়ের একটি শীলাস্তম্ভ। 


বেনারস থেকে সাড়ে তিন মাইল উত্তরে সারনাথ অবস্থিত। সারঙ্গনাথ অর্থাৎ মৃগদের প্রভু কথাটি থেকে সারনাথ নাম এসেছে। এখানে একটি মৃগদাব ছিল। জাতকের কাহিনী অনুসারে বোধিসত্ত্ব মৃগ রূপে অবতরণ করেছিলেন। এখানে পাথরের তৈরি ধামেক (স্তূপ) রয়েছে, যা ৯৩ ফুট ব্যাস ও ১২৮ ফুট দৈর্ঘ্য সম্পন্ন। রয়েছে পাথরের তৈরী ধর্মচক্র। হিউয়েন সাং লিখেছেন যে তিনি দেখেছেন তামার তৈরি একটি বুদ্ধমূর্তি এই ধর্মচক্রকে ঘোরাচ্ছেন। এছাড়া আরও স্তূপ, বুদ্ধমূর্তি এখানে পাওয়া গেছে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে। গুপ্ত ও বাংলার পাল যুগে বৌদ্ধ রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সারনাথের সমৃদ্ধ স্থান ছিল। হিউয়েন সাং সেখানে তিরিশটি বৌদ্ধ মঠ ও তিন হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দেখেছেন। সময়ের পরিবর্তনে, বৌদ্ধ ধর্মের হিন্দু ধর্মের কাছে পরাজিত হওয়ার ফলে, সারনাথ ক্রমে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

                       (চলছে)

প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪৫। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৯ ভোলানাথ চন্দ্র


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                    (আগের পর্বের পরে)

পরবর্তী দর্শনীয় স্থান ডুমরি (বর্তমান ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত)। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জায়গাটির মত বন্য ও উঁচু নীচু কোন জায়গা লেখক আগে দেখেননি। পাহাড়, উপত্যকা, গিরিখাত, গুহার যেন শেষ নেই এখানে। চতুর্দিকে কত সহস্র ধরনের গাছপালা, যার প্রতিটি অচেনা। যদিও এখন জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা কমে গেছে তবুও পথের প্রতিটি বাঁকেই আশঙ্কা হয় যে তাদের সঙ্গে দেখা হবে। কিছুদিন আগেও এই পথে বাঘের হাতে মারা গেছে মানুষ। সরকার ২ বা ৩ মাইল অন্তর অন্তর চৌকি আর সরাই তৈরি করে দিয়েছেন ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তার জন্য। এই রাস্তায় মাচানের উপর থেকে রাতে পাহারাদারের পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ভ্রমণকারীর নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত করতে ভারতের পক্ষে সে এক দারুন দিন হবে, যেদিন শেষ বাঘটিকে মেরে তার দেহ আগামী পুরুষদের কৌতুহল মেটানোর জন্য সংরক্ষণ করা হবে। (বর্তমান ব্যাঘ্র তথা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকারী মানুষেরা লেখকের এই বক্তব্য শুনলে যে কঠিন প্রতিক্রিয়া জানাবেন লেখকের সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না বোঝা যায়)।

 


কুড়ি মাইল ব্যাপী একটানা পাহাড়ের পরে এল এক উপত্যকা। এক সারি কুঁড়েঘর নিয়ে তৈরি এক সরাই (সরাইখানা) এল। সেখানে লেখকেরা স্নান ও প্রাতরাশ করলেন। তারপর আবার চলা শুরু। আবার পাহাড়ের দেখা পাওয়া গেল। সঙ্গের একটি ডাকগাড়ি একটি মারাত্মক দুর্ঘটনার হাত থেকে কোনক্রমে বাঁচল। গাড়িটি পাহাড়ের রাস্তায় বাঁক নেওয়ার সময় গড়িয়ে খাদে পড়ে যাচ্ছিল। দিন শেষ হয়ে আসছে। পাহাড়ের সূর্যাস্ত অনন্য। পাহাড়ের আড়ালে সূর্য ডুবে যেতেই মাটিতে লম্বা ছায়া পড়ে যায়। হঠাৎ সবকিছু অন্ধকারে ডুবে যায়। 



রাতে তাঁরা বেলকুপি পৌছালেন (বেলকাপি, ঝাড়খন্ড)। এখানে রাস্তার ধারে কয়েকটা উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। এক ব্যক্তি তাঁদের সেগুলি দেখাতে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু এক সহযাত্রী বললেন এই রাতে সেগুলি দেখতে যাওয়া মানে বাঘের মুখে পা দেওয়া। (সূরযকুন্ড, রামকুন্ড, সীতাকুন্ড, লক্ষণকুন্ড, ব্রহ্মকুন্ড - এই উষ্ণ প্রস্রবণগুলি বেলকাপি, বারহী মহকুমায়  রয়েছে)। 



এবার এলো বুড়াকাট্টা (বোড়হাকাটা, ঝাড়খন্ড) নামের স্থান, যেটি সম্ভবত প্রাচীনকালে বৌদ্ধ বা জৈনদের ধর্মস্থান ছিল। এখন সেখানে আম, বট, অশ্বত্থের ভালো ভালো গাছ আছে আর ক্ষীণধারা নদী আছে। 



বারহি (ঝাড়খন্ড) গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড-এর উপর অবস্থিত একটি প্রধান শৈল শহর। কিন্তু লেখকেরা অনেক রাতে সেখানে পৌঁছানোতে কিছু দেখতে পেলেন না। 



এরপর এল ডানওয়া পাস (pass)। এবার পাহাড় বেয়ে উঠতে কুলিদের গাড়ি ঠেলে তুলতে হলো। এই পাসটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫২৫ ফুট উঁচু। এরপর পাহাড়ি পথ শেষ হল, এল সমতল ভূমি। 



তাঁরা বরাক পৌঁছালেন। সেখানে একটি বাংলো ও আরেকটি সরাই আছে। এখানে জলের খুব অভাব। চাষবাস প্রায় নেই। মানুষদের চুল ও চেহারা অপরিচ্ছন্ন। মেয়েরা মাথায় কলসি নিয়ে সারাদিন জল সংগ্রহের যায় আর আসে। তাদের কপালে সিঁদুর আর সারি দিয়ে পয়সা ও পুথির মালা সাজানো। লেখকদের প্রাতরাশের জন্য অনেকগুলি মুরগি জবাই হয়েছিল। সেদিন দুর্গাপূজার নবমী, দূরে বাংলায় তাঁদের আত্মীয় বন্ধুরা সেদিন ছাগল-মোষ বলি দিয়ে দুর্গা পূজা করছে আর এখানে লেখকেরা মুরগি বলি দিলেন। (এটি অবশ্যই লেখক বঙ্গাত্মকভাবে বলেছেন)। সঙ্গের ডাক্তারটি এখানে একটি শিশুর চিকিৎসা করলেন। এখানে ২০০ দোকান আর কুঁড়েঘর আছে রাস্তার দু'পাশে মুখোমুখি দুটি সারি। মোট ৩০০ কি ৪০০ মানুষের বাস এখানে। লীলাজন নদী দেখলেন, তাতে জল নেই বললেই চলে। এই নদীর অপর নাম ফল্গুনিরাজনা। ফল্গু নদী হিন্দু ধর্মের পবিত্র নদী, আর নিরাজনা বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র নদী। 



এবারে রাস্তার দু'ধারে গাছের সারির মধ্যে দিয়ে এল  শেরঘাঁটি (বিহার), অর্থাৎ বাঘের আস্তানা। ৫০ বছর আগে এই রাস্তায় যেতে গেলে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে বাঘ তাড়ানোর লোক সঙ্গে রাখতে হতো পথযাত্রীদের। এই প্রাচীন স্থান হয়তো অজাতশত্রু, অশোক, বুদ্ধের সময়ও ছিল। কিন্তু কি নাম তার ছিল এখন তা জানা দুষ্কর। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধি মীর জুমলা এই স্থান হয়ে শাহ সুজাকে আক্রমণ করতে রাজমহলে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। পুরনো কিছু কবর আর মসজিদ আছে শুধু পুরনো দিনের সাক্ষ্য হিসেবে। 



এখান থেকে গয়া কুড়ি মাইল। ফাহিয়েন (চৈনিক পর্যটক) -এর ভাষায় গয়া হল কিয়া ইয়ে। হিন্দুদের বিষ্ণুপদের জন্য গয়া বিখ্যাত। গয়াসুর আসলে বৌদ্ধশক্তির উত্থানের প্রতীক, যাকে দমন করতে হিন্দুধর্মে দৈবশক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এটি বৈষ্ণবধর্মের কাছে বৌদ্ধধর্মের পরাজয়ের রূপক কাহিনী। গয়া ও বৌদ্ধ গয়ার বিষ্ণুপদচিহ্ন ও বৌদ্ধ পদচিহ্নের এই নৈকট্য দুটি ধর্ম গোষ্ঠীর বিরোধকে প্রকট করে। ফা হিয়েনের আগমনের আগে বিষ্ণুপদ চিহ্ন ছিল গয়ায়। গয়াতে বিপত্নীকদের বিবাহ নিষিদ্ধ। এটি হিন্দু পুরুষদের পক্ষে স্বাভাবিক নয়। এর কারণ সম্ভবত বৌদ্ধধর্মের প্রভাব। গয়ার মানুষেরা জন্মগতভাবে হিন্দু হলেও তাদের স্বভাব ও আচরণে কিছু বৌদ্ধ রীতি আছে বলে লেখক মনে করেন। 



শেরঘাঁটিতে অনেক গয়ালী থাকে তীর্থযাত্রীদের নিজের কবলে আনার জন্য। তারা অত্যন্ত ঝামেলা বাধায় যাত্রীদের সঙ্গে। এছাড়া সেখানে কুষ্ঠ রোগী, অন্ধ, খোঁড়াদের গোষ্ঠী রয়েছে, তারা ভিক্ষা করে জীবন কাটায়।  পুণ্য অর্জনের জন্য যে যাত্রীরা যায় তারা সবাই দান করে কারণ দান করলে স্বর্গ লাভের পথ সুগম হবে বলে তারা বিশ্বাস করে। 



এরপর উমগা, মদনপুর হয়ে পথ গেছে। মদনপুর এলাকায় বাংলার পাল রাজাদের রাজত্ব ছিল কিন্তু, এখন ধ্বংসাবশেষ। সেখানে ৪০০ বছরের প্রাচীন এক ৬০ ফুট জগন্নাথ দেবের মন্দির আছে চন্দ্র বংশীয় রাজা ভৈরব ইন্দ্র প্রতিষ্ঠিত (গুগল ম্যাপ অনুসারী এটি সূর্য মন্দির, জগন্নাথ মন্দির নয়)। 



এবার লেখকের দ্রষ্টব্য স্থান সোন নদী, যার প্রাচীন নাম হিরণ্যবাহ, (অর্থাৎ যা সোনা বহন করে। কথিত আছে সোন নদীর বালিতে সোনার কণা আছে)। গ্রীক পর্যটক আরিয়ান ও প্লিনী একে এরানোবোয়াস বলেছেন। নদীর অর্ধেক অংশে জল নেই। কুলিরা গাড়ি ঠেলে পার করালো। রোটাস পাহাড় দূরে দেখা যায় পটভূমিতে। এখানে লেখকের একটি পৌরাণিক কাহিনী শোনান। নরবুদা আর সোনের বিবাহ ঠিক হয়েছিল। তাঁরা হিন্দু বরকনের মত পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। নরবুদার মনে কৌতুহল হয় তাঁর স্বামী হতে চলেছে যে সোন, তাঁর সম্পর্কে খবরাখবর পাওয়ার জন্য। তাই তিনি সখি ঝোলাকে সোনের কাছে পাঠান। তখন বিবাহ করার উদ্দেশ্যে সোন আসছিলেন। ঝোলা কে দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হন সোন। নরবুদা এরপর নিজে খোঁজ নিতে গিয়ে সেই দৃশ্য দেখে ঘৃণায় পদাঘাতে সোনকে পূর্ব দিকে অর্থাৎ তিনি যেদিক থেকে আসছিলেন সেদিকে ও ঝোলাকে তাঁর দিকে পাঠিয়ে নিজে পশ্চিমে চলে যান ও সর্বদা কুমারী থাকেন। এই কাহিনী অমরকন্টক পাহাড় থেকে নির্গত হয়ে নর্মদার পশ্চিমমুখী বয়ে যাওয়া, সোনের প্রথমে কিছুটা পশ্চিমমুখী হয়ে তারপর পূর্বমুখী হয়ে বয়ে যাওয়া ও ছোট নদী ঝোলার (জোহিলা নদী) সোন নদীতে মিশে যাওয়াকে রুপক হিসেবে দেখিয়েছে। 



সোন নদীর ধারে ডেহরি অবস্থিত। সোনের বাম তীরে শাহবাগ। এখানে লেখক মগধের আরো প্রাচীন নাম 'কিকাতা' ব্যবহার করেছেন। 


ডেহরি থেকে রোটাস কুড়ি মাইল। কথিত আছে হরিশচন্দ্রের পুত্র রোহতাস (রোহিতাশ্ব) এই দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু বস্তুত দুর্গ এত প্রাচীন নয়। শেরশাহের তৈরি এই দুর্গে রাজা মান সিংহ সংস্কার করেছিলেন। এই দুর্গ কুনয়ার সিং আর অমর সিং কিছুদিন ধরে সিপাহী বিদ্রোহের সময় দখল করে রেখেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে লেখক আবার সিপাহী বিদ্রোহের অসারতা প্রমাণ করে দেন। 



এবার এল সাসারাম। প্রায় ৩০০০ কুঁড়ে ঘর, দোকান নিয়ে বসতি। দোতলা কাঁচা বাড়ি এই প্রথম চোখে পড়ল। সাসারাম থেকে দূরে নীল পাহাড় আর ফসলে ভরা উপত্যকা দেখা যায়। শের শাহের জন্মস্থান সাসারাম দ্বিতীয় দিল্লি তো হতে পারেইনি বরং দুর্গন্ধময় সরু গলিতে, দরিদ্র মানুষের বসবাসস্থল হয়ে উঠেছে। শের শাহের পিতা হাসান খান-এর সমাধি একমাত্র এর ব্যতিক্রম। খুব সুন্দর এই সমাধি একটি উত্তম ভাস্কর্য যা এখনো প্রায় অক্ষত আছে। এই সমাধিস্থলের উপর থেকে নীচে শহরটি ভালো করে দেখা যায়। উত্তর দিকে শেরশাহের সমাধি একটি কৃত্রিম হ্রদের ধারে অবস্থিত। পিতা ও পুত্রের সমাধি দুটি একই রকম, শুধু শের শাহের সমাধিটি আরো বড় ও আরো সুন্দর। শেরশাহ নিজে তাঁর সমাধি তৈরি করে রেখেছিলেন। সমাধি ছাড়া আর কোন প্রাসাদ বা সৌধ তিনি তৈরি করে যান নি। কিন্তু চার মাস ব্যাপী পায়ে হেঁটে চলার যে পথ তৈরি করে গেছেন, তা পূর্বে বাংলার সোনারগাঁও থেকে পশ্চিমে ঝিলাম নদীর তীরে রোটাস পর্যন্ত বিস্তৃত। এখনো তাঁর তৈরি করা পাথর আর ইঁটের সরাইখানার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় জাহানাবাদে। তবে রাস্তার ব্যাপারে শেরশাহের পূর্বসূরী অবশ্যই সম্রাট অশোক, যিনি রাজপথ তৈরি করে তার পাশে আম গাছ বসিয়ে, কূপ, ধর্মশালা, হাসপাতাল তৈরি করে পথিকদের চলার সুব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। 



এবার লেখক ও সঙ্গীরা বেনারসের উদ্দেশ্যে চললেন। বহুদূর থেকে পথ চলতে শেরশাহের সমাধি দেখতে পাওয়া যায়, রাস্তা সমতল হওয়ার কারণে এরকম দেখা যায়। পথে পড়ল কর্মনাশা নদী। কর্মনাশা নদী ৩০০ ফুট চওড়া, বর্ষাকালে জল ৩০ ফুট বেড়ে যায়, পাড়ের বালি ২০ ফুট গভীর। হিন্দুদের কাছে কর্মনাশা নদী হল গঙ্গার সম্পূর্ণ বিপরীত সংস্করণ। এই নদীর জল স্পর্শ করলে সমস্ত অর্জিত পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। কিছুদিন আগেও মাঝিরা এই নদীতে নৌকা চালানোর সময় সতর্ক থাকতো যাতে এক ফোঁটা জলও শরীরে না লাগে। যারা নৌকায় চড়তে পারতো না পয়সার অভাবে, তারা অন্য মানুষের কাঁধে চড়ে নদী পার হত। এখন আর সেসব করার দরকার হয় না। বেনারসের ধনী হিন্দু রাজা পাটনি মলের দানশীলতায় নদীর উপর পাথরের সেতু তৈরি হয়েছে। লেখক এবার কর্মনাশা নদী সৃষ্টির পৌরাণিক কাহিনী বলেন। রাজা ত্রিশঙ্কু পূজা ও তপস্যার বলে দেবতাদের মধ্যে খুব মর্যাদা লাভ করেন। কিন্তু শিব তাঁকে স্বর্গ থেকে নিক্ষেপ করেন এবং মাঝপথে আটকে দেন। একদিকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টান, অন্যদিকে তপস্যার বলে স্বর্গের দিকে আকর্ষণের প্রভাবে তিনি মাঝখানে ঝুলে থাকেন, মাথা নিচু অবস্থায়। এই পরিস্থিতিতে তাঁর মুখ থেকে ক্ষরিত লালারস থেকে এই কর্মনাশা নদীর সৃষ্টি হয়। 


লেখক একজন ইয়ং বেঙ্গলের অবস্থানের তুলনা করেছেন ত্রিশঙ্কুর সঙ্গে। বর্তমানে পূজা ও তপস্যা হলো শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন। স্বর্গের জন্য আকুতি হল বিজিত শক্তি যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করে তা পাওয়ার বাসনা। শিব এখানে উগ্র গোষ্ঠীর প্রতীক। শূন্যে ঝুলে থাকা হলো মধ্যবর্তী অবস্থান, যেখানে একজন শিক্ষিত হিন্দু ঝুলে আছে, যার একদিকে গোঁড়া দেশীয়রা ও অন্যদিকে বিজিত শক্তির মানুষেরা।

          

                      (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪৪। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৮ ভোলানাথ চন্দ্র

  

       

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                 (আগের পর্বের পরে)

দ্রুতগামী রেলের পর এবার শুরু হল ডাক গাড়ির তুলনামূলক মন্থর যাত্রা। এবার গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে চলা। এই রাস্তা গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কাঁকরে বাঁধিয়ে পাকা করে দিয়েছেন। উঁচু নীচু পাহাড়ি পথ, মূলত জঙ্গল এলাকা। মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় চাষবাস হয়েছে। গরুর গাড়ি মাল বোঝাই হয়ে যাচ্ছে - এই একমাত্র চলমান দৃশ্য দেখা যায়। প্রতি পাঁচ বা ছয় মাইল পরপর ডাকের আদান-প্রদান ও ঘোড়া পাল্টানো হয়। বিভিন্ন কোম্পানির ডাক গাড়ির বিভিন্ন রঙের গাড়ি, যাতে তাদের কর্মচারীরা দূর থেকে চিনতে পারে। গাড়ির চালক নানারকম শব্দ করে, কথা বলেও তার আগমন জানান দিতে থাকে অনেক দূর থেকে। একটি ঘোড়া খুব দূর্বল ছিল, তার এত ওজন বহন করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। কিছু পরে তাকে পরিবর্তন করা হলো। ঘোড়াগুলির থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ভালো নয়। 


নিয়ামতপুর থেকে পথ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে যায়। দূরে বড় বড় পাহাড় দৃশ্যমান হয়। তারপর অনেক জঙ্গলের পথ পেরিয়ে আসে বরাকর নদীর উপত্যকা। এই উপত্যকা পাহাড়, মাঠ, গ্রাম, ছোট নদী, জঙ্গল নিয়ে তৈরী। দিগন্তে অত্যন্ত সুন্দর ২০০০ ফুট উচ্চতার পাঞ্চেত পাহাড় দেখা যায়। কাছের একটি টিলার উপর সাঁওতালদের দেবীর মন্দির আছে। 


বরাকর পাহাড়ি নদী, শুধুমাত্র বর্ষাকালে  নদী জলে ভরে যায়। এই অক্টোবর মাসে নদীতে অল্প জল আছে। কুলিরা টেনে গাড়ি নদী পার করালো। এখানে একটি ব্রিজ তৈরি হচ্ছে। নদীর ধারে দুটি শিব মন্দির আছে। বরাকর নামে একটি ছোট দেশি সরাইখানা আছে এখানে থাকার জন্য। যদিও এটি সাঁওতালি গ্রাম নয় কিন্তু বহু সাঁওতাল নারী, পুরুষ, শিশু এখানে ব্রীজের কাজের জন্য রয়েছে। এখানকার দোকানদারেরা বাঙালি। তিরিশ বছর আগে এইসব জায়গার অস্তিত্বই টানা ছিল না। এগুলি হিংস্র জন্তু আর অসভ্য (!) আদিবাসীদের স্থান ছিল। এখন গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এইসব জায়গাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। আগে এখানে অনেক বাঘ ছিল। এখন বছরে একবার কি দুবার বাঘ দেখা যায়। যদিও আশেপাশের জঙ্গলে অনেক বাঘ আছে। সাঁওতালরা খুব দক্ষ শিকারি। তারা জংলি জানোয়ারদের সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করে। তাদের ধনুক অত্যন্ত কার্যকরী অস্ত্র। পাখী, খরগোশ, এমনকি ভাল্লুক পর্যন্ত তীর ধনুক দিয়ে সহজে তারা শিকার করে। কদিন আগে একজন সাঁওতাল একটা লুকিয়ে থাকা চিতাকেও এই অস্ত্রের সাহায্যে মেরেছে। সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় ১৮৫৫-৫৬ এখানে খুব ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। পাহারাদার নিয়োগ করতে হয়েছিল যাতে বন্যরা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের দক্ষিণে তাদের কার্যকলাপ করে সমস্ত আদিবাসীদের বিদ্রোহী করে না তুলতে পারে। সেই গন্ডগোলে আশেপাশের কিছু সর্দারের অলীক কল্পনায় চায়ের কাপে তুফান উঠেছিল আর সিপাই নামটা সারা পৃথিবীর কাছে ঘৃণ্য হয়ে গেছিল। (ভারতীয়দের কাছে যে বিদ্রোহ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ধাপ বলে বিবেচিত হয় ভোলানাথ চন্দ্রের ইংরেজের গোলামী করার মানসিকতায় তাই চায়ের কাপে তুফান)।


বরাকর বাজারে বড়জোর কুড়িটা দোকান আছে। শস্য এখানেই উৎপন্ন হয়। নুন আসে নীচের প্রদেশ থেকে। আজ বরাকরের যা অবস্থা ২৫ বছর আগে রাণীগঞ্জ সেরকমই ছিল। এই এলাকায় যেসব কাঁচামাল পাওয়া যায় তা হলো লাক্ষা, কাঠ, মৌচাকের মোম আর আছে খনিজ পদার্থ। ভবিষ্যতে ভারতীয়রা যদি নিজেদের বার্মিংহাম বা শেফিল্ড বানাতে চায় তাহলে এই জঙ্গল মহালের কথা তাদের ভাবতে হবে। এখন যেখানে জঙ্গল পতিত জমি রয়েছে ২০০ বছর পরে সেখানে উৎপাদনকারী গ্রাম, শহর থাকবে। হাজার হাজার বর্গমাইল জমি আজ যা শুধু ভালুক আর চিতার দখলে আছে, সেখানে সফল ফল ও সব্জি বাগান, ফসলের জমি, চা বাগান, আখ চাষ ইত্যাদি হবে। বিংশ শতকে ভ্রমণকারী এখানে এসে সুন্দর বাংলো, সুন্দর মফস্বল এলাকা, গুদাম-দোকান দেখবে। ইয়ং বেঙ্গল (এখানে লেখক) এভাবে ভবিষ্যতের উন্নত ভারতের ছবি দেখেছেন। 


সরাইখানাটি একটা পাহাড়ী ঝোরার পাশে জঙ্গলময় উপত্যকায় অবস্থিত। নিকটে ত্রিশ চল্লিশটি কুঁড়েঘর নিয়ে সাঁওতালদের গ্রাম। কুঁড়েঘরগুলি মুখোমুখি দুটি সারিতে রয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে শুয়োর, গরু, ছাগল পায়রা পোষা হয়। গ্রামের চারপাশে তারা চাষবাস করেছে। সাঁওতালদের পরিছন্নতার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে। 


লেখক বলেছেন সাঁওতালরা ভারতের প্রাচীনতম বাসিন্দা। পরে আর্যরা এসে তাদের সরিয়ে ভারতে বসবাস করছে। সাঁওতালরা ক্রমে পাহাড়ে জঙ্গলে চলে গেছে ও সেখানেই রয়েছে। তাদের চেহারা, ভাষা আর্যদের থেকে আলাদা। তাদের ভাষার অক্ষর নেই, তাদের অংক নেই, স্থাপত্য নেই, শিল্পও তেমন কিছু নেই। যদি এই জাতি আজ পৃথিবী থেকে মুছে যায়, তবে তারা কোন সৌধ, কোনো আইন-কানুন, কোনো সাহিত্য বা কোনো নথি ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাবে না। এই জাতি অবহেলিত এবং এদের কোথাও কোন স্বীকৃতি নেই। বরাকরে যে সাঁওতালরা বাস করে তাদের সঙ্গে এখানকার অন্য অধিবাসীদের আচরণে তেমন পার্থক্য নেই। এরা তাদের ভাষার সঙ্গে বাংলা ও হিন্দি মিশিয়ে লেখকের সঙ্গে কথা বলে। সাঁওতালদের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো যে তারা কখনো মিথ্যে কথা বলে না। 


এরপর আবার ডাক গাড়িতে যাত্রা শুরু হল। পথে তালডাঙ্গা (বর্তমানের ঝাড়খন্ড) বাংলোতে খাওয়া হলো। ডাকবাংলোর খিতমদগার ভাত আর মুরগির ঝোল বানিয়ে দিল। সেদিন রাতে সেই ব্রিটিশ বাংলোতে লেখক ও সঙ্গীরা প্রকৃতির মাঝে, ফুলের গন্ধ ভরা বাতাসে বাংলোর সাহেবী আরামে মুগ্ধ হলেন। সাহেবী আদব কায়দায় খাওয়া-দাওয়া করতে করতে তিনি দেশীয় সরাইখানার দুরবস্থার কথা স্মরণ করলেন। বাংলো থেকে বেরোনোর সময় ভাড়ার অতিরিক্ত বকশিশ খুশি মনে দিলেন তাঁরা। 


রাতে আবার ডাক গাড়িতে যাত্রা শুরু হল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ সারারাত চলার পরে প্রথম সূর্যের আলোতে তাঁরা দেখলেন পরেশনাথ পাহাড়ের নীচে পৌঁছে গেছেন। পাহাড়ের চূড়ায় প্রথম সূর্য কিরণ স্পর্শ করেছে। সামনে পিছনে আরো অনেক পাহাড় রয়েছে। সব সময় সমতল দেখে অভ্যস্ত ব্যক্তির প্রথম পাহাড় দেখলে যে রোমান্টিক অনুভূতি হয় তা বর্ণনাতীত। 


পরেশনাথ পাহাড়ের পদপ্রান্তে অবস্থিত স্থান তোপচাচী ( বর্তমান ঝাড়খন্ড)। এখানকার মানুষ কিছুটা সভ্য কিছুটা বন্য। ধান ক্ষেত আর সর্ষে ক্ষেত চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপর তোপচাচী সীমান্ত গ্রাম, যেখানে (তৎকালীন) বাংলা ও বিহার মিশেছে । এখানে লেখক বাংলা ছেড়ে প্রাচীন মগধে, জরাসন্ধের রাজত্বে, চন্দ্রগুপ্ত-অশোকের সাম্রাজ্যে, বৌদ্ধ ধর্মের জন্মস্থানে প্রবেশ করলেন। এখানে তিনি শ্লেষ করে লিখেছেন যে স্থান চীনে পূর্বে বৌদ্ধ ধর্ম প্রেরণ করেছিল, এখন সেখান থেকেই আফিম পাঠানো হচ্ছে চীনে - বিষ এবং বিষের ওষুধ দুইই। ইতিহাসে লেখা নেই কোথায় প্রাচীন গৌড়কে মগধের থেকে আলাদা করা হতো। মোগল আমলে তেলিয়াগড়ি পাস বাংলার পশ্চিম সীমা ছিল। 


কোচয়ানরা যখন ঘোড়া ও গাড়ির তদারকিতে ব্যস্ত, তখন লেখক ও সঙ্গীরা পায়ে হেঁটে তোপচাচী দেখতে বেরোলেন। যতদূর চোখ যায় চুড়ার পরে চুড়া দেখা যায়। চারপাশের গাছপালা সম্পূর্ণ বন্য। একটিও চেনা গাছ নেই। পাহাড়ের নীচের দিকে সম্পূর্ণ উচ্চতার গাছ দেখা যায়, মাঝারি উচ্চতায় সেই গাছগুলিকে বেঁটে ঝোপ মনে হয় আর পাহাড়ের চূড়ায় শুধু সবুজ রং দেখা যায়, গাছের কোন আকার সেখানে বোঝা যায় না। সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি এখান থেকে চার হাজার ফুট আর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ হাজার ফুট উঁচু। 



পরেশনাথ পাহাড়ের নাম জৈনদের তীর্থঙ্কর পরেশনাথের নামে হয়েছে। চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে সর্বশেষ তীর্থঙ্কর পরেশনাথ। এই পাহাড়ের পূর্ব চুড়ায় তিনি নির্বাণ লাভ করেছিলেন। সেই স্থানটি পবিত্রতম স্থান। সেখানে একটি শ্বেতপাথরের ছোট, সুন্দর মন্দির আছে যা নীচের উপত্যকা থেকেও দেখা যায়। পাহাড়ের চূড়ায় হেঁটে পৌঁছানোর পথ আছে। ওপর থেকে পাহাড় ও উপত্যকার অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। চূড়ায় পরেশনাথের বিশাল পদচিহ্ন দর্শনের জন্য রয়েছে। এখানে প্রতি বছর মার্চ মাসে বিশাল এক মেলা হয়। এক লাখ মানুষ দূরদুরান্ত থেকে এখানে আসে। পাহাড়ের নীচে কিছু ফাঁকা জায়গা আছে তাকে মধুবন বলে। সেখানে মেলা বসে। এখানে কিছু মন্দির আছে। মূল মন্দিরে পরেশনাথের কালো মূর্তি, তাঁর মাথার উপর একটি সাপ ছাতার মতো ফণা মেলে ধরে আছে। এছাড়া ক্ষেত্রপাল, চক্রেশ্বরী, পদ্মাবতী যাদের হিন্দু ধর্মের নৃসিংহ, দুর্গা ও লক্ষ্মীর প্রতিরূপ বলা যায় তাঁদের মন্দির রয়েছে। একটি বড় প্রাচীন বটগাছ আছে যা পবিত্র বলে গণ্য করা হয়। মূল মন্দিরটি মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ধনকুবের জগত শেঠ বানিয়ে দিয়েছিলেন। পরেশনাথ জীবহিংসার পরিপন্থী ছিলেন। লেখক ভাবলেন ডাক গাড়ীর চালকদের মেরে মেরে ঘোড়া চালানোর কথা। লেখক মন্তব্য করেন যে ভাগ্যিস ভগবান পরেশনাথ তাদের এই নৃশংসতা চোখ মেলে দেখছেন না।


                      (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪৩। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৭ ভোলানাথ চন্দ্র

 

      

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                  (আগের পর্বের পরে)

লেখকের পরবর্তী ভ্রমণ কাহিনী শুরু হচ্ছে উনিশে অক্টোবর, ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে।এবার হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে বসলেন লেখক ও তাঁর তিন সঙ্গী। 

লেখক এখানে ভারতের রেলপথের সূচনাকে ভগীরথের মর্তে গঙ্গা আনয়নের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভারতীয়রা রেলকে কি বিষ্ময়ের চোখে দেখে তা বলেছেন লেখক। এও বলেছেন যে রেল যেন ভারতবর্ষের পুনর্জাগরনের একটি নতুন রূপ। বাঙালিরা স্বভাবত ঘরকুনো। কলকাতার বাবুরা চিৎপুর রোডকে ভারতের শ্রেষ্ঠ পথ ভাবতে ভালোবাসেন। কিন্তু রেলের প্রসার তাঁদের বাইরের জগতে পা রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে। হাওড়া থেকে বালি এখন পাঁচ মিনিটে পৌঁছানো যায়, দশ মিনিটে সেখান থেকে শ্রীরামপুর। পরবর্তী স্টেশনগুলো চন্দননগর, চুঁচুড়া, হুগলি। বোঝাই যাচ্ছে মধ্যবর্তী বর্তমান অনেকগুলো স্টেশনের তখন অস্তিত্ব ছিল না। সারা রাস্তায় গ্রামবাসীরা অবোধ বিষ্ময়ে রেলগাড়ি দেখতে থাকে। 

এই রাস্তার অনেকটা পর্যন্ত বর্ণনা আগেই দেওয়া হয়েছে বলে লেখক এবার পান্ডুয়া (বর্তমান হুগলি জেলার) থেকে বর্ণনা দিয়েছেন। অনেক পূর্বে পান্ডুয়া হিন্দু রাজাদের রাজধানী ছিল। শহরের পাঁচ মাইল পরিধি পরিখা ও প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। এখন পান্ডুয়া একটি সাধারণ গ্রাম। আগের দুর্গের সামান্য অবশিষ্ট উপলব্ধি করা যায় কোন কোন স্থানে। একটি ১২০ ফুট লম্বা মিনার চোখে পড়ে। এটি বাংলার প্রাচীনতম স্থাপত্যের নমুনা। ৫০০ বছর ধরে টিকে আছে এই ইঁটের তৈরি সৌধটি এই স্থানের রোদ জল সহ্য করে। হিন্দু রাজার তৈরি এই সৌধ আজও দাঁড়িয়ে আছে বেশ ভালো অবস্থায়। (উইকিপিডিয়া অনুসারে অবশ্য বলা হচ্ছে শাহ সুফিউদ্দিন পান্ডুয়া ও মহানদ এলাকার হিন্দু রাজাকে পরাজিত করে এই বিজয় স্তম্ভটি তৈরি করেছিলেন)। গোরু নিয়ে এখানে এক বিশাল অশান্তি হয়েছিল ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে। তৎকালীন হিন্দু রাজার বহু আকাঙ্ক্ষিত পুত্রের জন্ম উপলক্ষে এক উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। রাজার একজন পারসি সভাসদ (মুন্সি) ছিলেন। মুসলমানদের উৎসবে গো হত্যা অবশ্যই হতো। মুন্সি গোহত্যা করেন ও গরুর দেহাবশেষ গোপনে শহরের ফাঁকা জায়গায় পুঁতে ফেলেন। রাতে শেয়ালরা মাটি খুঁড়ে সেই অবশেষ বের করে খায়। সকালে তাদের ভুক্তাবশেষ এক ব্যক্তির চোখে পড়ে। হিন্দুরা ক্ষেপে উঠে ও হত্যার ফলে যে পাপ হয়েছে তা দূর করতে নবজাতক শিশুকে প্রথমে বলি দেওয়া হয়। তারপর মুন্সির ওপর সকলের রাগ পড়ে। মুন্সি পালিয়ে যান কিন্তু হিন্দু রাজার ক্ষতিসাধনের জন্য প্রচেষ্টা করতে থাকেন। এই ঘৃণা ও শত্রুতা বহু বছর ধরে চলে ও শেষে হিন্দু রাজত্বের পতন হয়। এরকম শোনা যায় যে একটি পবিত্র জলাশয়ের জল যতদিন রক্ষা করা যাবে ততদিন হিন্দুরা রক্ষা পাবে বলে কথিত ছিল। মুসলমানেরা মৃত গরুর দেহাংশ ফেলে জলাশয় অপবিত্র করে দেয়। ফলে হিন্দুরা সেই জলস্পর্শ করতে না পেরে দুর্বল হয়ে ক্রমে পরাজিত হয়। এই জলাশয়টি শহরের পশ্চিমদিকে এখনো আছে। যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল সেখানে রেলের কাজ করতে গিয়ে খনন কালে অনেক মানুষের হাড় ও খুলি পাওয়া গেছে। মিনারটি মুসলমান রাজার বিজয় ঘোষিত করে। এর মধ্যে দিয়ে চূড়া পর্যন্ত যে লোহার দণ্ড উঠে গেছে সেটি নাকি এই যুদ্ধের নায়ক শাহ সুফির ছড়ি। পান্ডুয়ার মসজিদটি সুন্দর। ২০০ ফুট লম্বা, ৬০ টি ডোমযুক্ত। 


পান্ডুয়ার পীরপুকুর ৫০০ বছরের পুরনো ৪০ ফুট গভীর বিরাট জলাশয়। এটি ইমামবাড়া ও কবরস্থানের পাশে অবস্থিত। এই পুকুরের বৈশিষ্ট্য হল যে এখানে ফটিক খান নামের এক পোষা কুমির থাকে। যাকে ফকির ডাকলেই সে জলের উপরে ভেসে ওঠে। 


এবার ট্রেন পেরোলো বৈঁচি স্টেশন, অনেক ঘর বাড়ি নিয়ে জনবহুল গ্রাম। পরের স্টেশন বাটকা (?), যেখান থেকে ছয় মাইল ডানে গেলে দেবীপুর (এখন দেবীপুরই স্টেশন)। এখানে সাত ফুট লম্বা ভয়াল দেবী মূর্তি স্থানীয় সিংহ পরিবারের মন্দিরে বিরাজমানা (কিন্তু মন্দিরে লক্ষী নারায়ণ মূর্তি বিদ্যমান)। মেমারি পেরোয় ট্রেন। অনেক পাকা বাড়ি ও একটি সুন্দর নবরত্ন মন্দির চোখে পড়ে (লেখক কি সাত দেউল মন্দিরের কথা বলেছেন? কিন্তু এটি তো নবরত্ন মন্দির নয়)। 


বর্ধমান জেলা সম্পদ উর্বরতা, স্বচ্ছলতা, সভ্যতায় বাংলার মধ্যে খুব বিশিষ্ট স্থানে আছে। বর্ধমান, বীরভূমকে সাধারণভাবে রাঢ় বলা হয়। বর্ধমান জেলা বাংলার মধ্যে সবথেকে বেশি রাজস্ব দেয় সরকারকে। এবার ট্রেন পৌঁছায় বর্ধমান। (হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ, বর্ধমান মেন লাইন হয়ে ট্রেন প্রথম যাত্রা শুরু করে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে)। রেলের কল্যাণে তিন দিনের পথ তিন ঘন্টায় পৌঁছলেন। 


শহরের মধ্যে দিয়ে ক্ষীণকায়া বাঁকা নদী বয়ে চলেছে। লেখক ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের বিদ্যাসুন্দর কাব্যে বর্ধমান স্থানের উল্লেখের কথা ও এখানে নুরজাহানের বসবাসের কথা স্মরণ করেছেন। বিদ্যাপত্যা নামক স্থানের নাম বিদ্যার সেখানে বসবাসের প্রমাণ বলেছেন লেখক। মৌন সরোবর নাকি বিদ্যা যে পুকুর ব্যবহার করতেন সেটি। বর্তমান দুর্লভা কালীমন্দিরই সেই মশান, লেখক বলেছেন, যেখানে সুন্দরকে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিদ্যাসুন্দর কাব্যে। 


পুরনো বর্ধমানকে এখন নবাবহাট বলা হয়। এখানে প্রাচীন হিন্দু রাজারা, মুসলমান শাসকরা, রাজা মানসিংহ প্রমুখ রাজকার্য চালিয়েছেন। এখানকার ১০৮ টি শিব মন্দির দুটি বৃহৎ চক্রাকারে (একটির মধ্যে অপরটি) অবস্থিত। এরকম শোনা যায় যে অনেক ধনরত্ন নাকি মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে এখানকার মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল। এক রাজা খননকার্য চালিয়েও কিছু পাননি। 


বর্ধমানে লেখক-এর সময়ও মহারাজা আছেন। তিনি বাংলার ধনীতম রাজা। তাঁর বিশাল প্রাসাদ আয়না, ঝাড়লন্ঠন দিয়ে চমৎকার ভাবে সাজানো। তাঁর গ্রীষ্মকালীন বাড়ি রাজকীয়ভাবে সজ্জিত। মহারাজের ভান্ডারে অনেক মণি মানিক্য, সোনা রুপার বাসন, দামি শাল, সোনা রুপার কাজ করা পোষাক ইত্যাদি রয়েছে। তাঁর ঐশ্বর্যের ছটা দেখা যায় জন্মদিন ইত্যাদি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। রাজার হাতিশালা, আস্তাবল, গবাদি পশুর আবাসস্থল ও পাখিরালয় আছে। বর্তমান রাজার প্রিয় শখ হল স্থাপত্য আর বাগান করা। তাঁর মাইনে করা স্থপতিরা সারা বছর বাড়ি গঠন ও পুনর্গঠনে ব্যস্ত থাকে। নতুন নতুন সাজে বাড়ি সাজানো হয়। সর্বদা তাঁর গায়ক, সুরকারেরা নতুন সুরসৃষ্টিতে ব্যাস্ত থাকে। খাদ্যের ব্যাপারেও এখানে নতুন নতুন পরীক্ষা চলে। শহরে অজস্র কৃত্রিম দিঘী পুকুর আছে বৃহত্তম দিঘী কৃষ্ণসায়র এর পাড় উঁচু করে বাঁধানো, তার উপরে দুটি কামান বসানো আছে। বিকালে সময় কাটানোর জন্য আছে মনোরম দিলখুশ বাগ। এখানে একটি ছোট চিড়িয়াখানা আছে, সেখানে একজোড়া সিংহ আছে। মহারাজা তাঁর আয়ের অর্ধেকের বেশি দেবসেবা ও তার মাধ্যমে দরিদ্রসেবায় নিয়োজিত করেন। 


পরদিন লেখক রেলপথে বর্ধমান থেকে রানীগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে মানকর পরে, যা তখন একটি সামান্য গ্রাম। বর্ধমান থেকে বীরভূম জেলায় প্রবেশ করেন। প্রথমে চারপাশে দৃশ্য একই রকম থাকলেও পানাগড়ের পর জঙ্গল শুরু হল। তার সঙ্গে ভূমিরূপ উঁচু নীচু হতে থাকে। আস্তে আস্তে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বাড়তে বাড়তে এই জঙ্গল রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এর মধ্যে শৈবদের এক তীর্থস্থান আছে, বৈজনাথ (বৈদ্যনাথ, দেওঘর)। রাবণ রাজা শিব ঠাকুরকে কৈলাস থেকে কাঁধে নিয়ে লঙ্কায় যাচ্ছিলেন। একটানা নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বরুন দেবতার ছলনায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে রাবন বর্তমান দেওঘরে শিবকে মাটিতে নামিয়ে রাখতে বাধ্য হন। ফলে শিব বৈদ্যনাথ বা বৈদ্যনাথেই থেকে যান। 


ট্রেন থেকে ছাতনা (শুশুনিয়া পাহাড়) ও বিহারীনাথ পাহাড় দেখা গেল। খয়রাশোল থেকে কয়লা খনি এলাকা শুরু হল। খনি, চিমনি, হাট বাজার, ঘর বাড়ি দেখা গেল। এসে গেল রানীগঞ্জ। লেখক আবার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে রেল প্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত মানুষ আর পণ্যদ্রব্যকে এত দূরে পাহাড়ের তলদেশে নিয়ে এলো। রানীগঞ্জে এবার রেলগাড়ি ধুয়ে মুছে আগামীকালের পুনর্যাত্রার জন্য তৈরি করা হবে। 


কলকাতার বাবুদের জন্য রানীগঞ্জে এখনো থাকার ভালো জায়গা তৈরি হয়নি। একটি রেলের হোটেল আছে। কিন্তু একজন দেশীয় যতই শেক্সপিয়ার, বেকন পড়ুক, ধর্মীয় কুসংস্কার বর্জন করুক, রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করুক আর আইন সভায় আসন পাওয়ার স্বপ্ন দেখুক না কেন, তিনি ইংরেজি হোটেলে থাকার কথা ভাবতে পারেন না কারণ তিনি অন্যান্য ব্যাপারে ইংরাজদের মতো হয়ে উঠলেও তার চিন্তা স্বভাব কাজকর্ম অনুভব দৃষ্টিভঙ্গিতকে ইংরাজ সুলভ করে তুলতে পারেন না। সৌভাগ্যক্রমে লেখকদের এক দেশীয় ব্যক্তি থাকার ব্যবস্থা করে দেন তাঁর বাড়িতে। 


রানীগঞ্জ সভ্য জগতের শেষ সীমায় অবস্থিত এর পরই জঙ্গল আর বর্বরতার শুরু। কিন্তু সুন্দর ছবির মত স্থান ও আছে এখানে। বাম দিকে বিন্ধ্য পর্বত দেখতে পাওয়া যায় আর ডান দিকে জঙ্গল একেবারে গঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত। গুদাম, দোকান, খনি নিয়ে ব্যস্তসমস্ত শহর। কিন্তু শহরের বাইরের এলাকার প্রকৃতি সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত। রানীগঞ্জ নতুন শহর। এই শহরের স্বাস্থ্য সচেতনতা মেনে গড়ে ওঠা দরকার। ভারতীয়দের সুন্দরভাবে শহর গড়ে তোলা শেখা উচিত। কিন্তু এই শহরের রাস্তা সরু, বাঁকাচোরা, নোংরা। দোকানগুলি এলোমেলো, ভিড়। কোন বাড়ির নাম নেই। ছোট দোকানদার, মজুর, কুলিরাই এলাকার বাসিন্দা। উচ্চতর সমাজের কেউ এখানে পাকাপাকিভাবে থাকে না। সাঁওতাল মেয়ে বউরা এখানে নুন, কাপড়, সাজের জিনিস কিনতে আসে। গ্রামের লোকেরা গাছের তলায় দোকান দিয়ে বসে। 



তবে ভালুক, চিতার আস্তানা জঙ্গল থেকে এখন যে বার্ষিক এক মিলিয়নের চতুর্থাংশ ভাগ আয় করা শিল্প নগরীতে পরিণত হয়েছে রানীগঞ্জ এই অনেক। রেলের সুবাদেই এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। ভারতে এখনো রানিগঞ্জ একমাত্র স্থান যেখান থেকে সারা ভারতে খনিজ দ্রব্য যাচ্ছে, কয়লা যাচ্ছে, যে কয়লা গঙ্গায় স্টিমার চলা, সমুদ্রের জাহাজ চলা সম্ভব করছে। এরকম আরো শহর ভারতের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠবে ভারতকে উন্নত করে তুলতে। ভারতের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি ঠিকই কিন্তু ভারতের বিপুল খনিজ ভান্ডার অবহেলা করা উচিত নয়। ভারতের প্রাচীন পূর্বজরা প্রথম কৃষিকাজে সূচনা করেছিলেন তাই নয়, তারা দ্রব্য উৎপাদন ও বাণিজ্যতেও পৃথিবীতে প্রথম ছিলেন। ভারতের রেশম, মসলিন একসময় রোমান সাম্রাজ্যকে রপ্তানি করতে হতো। ভারতের থেকে ইস্পাত রপ্তানির কথা পেরিপ্লাস ( প্রাচীন গ্রীক নৌযাত্রার রচনা) থেকে জানা যায়। যদিও এখন লোহা থেকে ভারতে ইস্পাত খুব কমই হয়, সবই ইংল্যান্ড থেকে আমদানি হয়। বর্ধমানের উত্তর-পশ্চিমে বনপাস গ্রামে ভালো কাঁটা-চামচ তৈরি হতো কিন্তু এখন কামাররা হয় মারা গেছে, নয় বাইরে চলে গেছে। আমাদের দেশের শিল্পের এই বিদেশের হাতে চলে যাওয়া উন্নততর বুদ্ধি আর সম্পদের সঙ্গে অসফল প্রতিযোগিতার ফল। ভারত ছিল বিশ্বের শস্য ভান্ডার। তখন বিশ্বের তিন চতুর্থাংশ অংশ জঙ্গল ছিল আর জমি ব্যবহার্য ছিল না, আফ্রিকার মত নানা স্থানে। পরবর্তী কালে পৃথিবীতে অনেক নতুন স্থানে কৃষিকাজ শুরু হয়েছে (আমেরিকা, আফ্রিকা, মরিশাস, ব্রাজিল, রাশিয়া)। ফলে ভারতের সেই দিক থেকে গুরুত্ব কমেছে। দুইশ বছর আগে ইংল্যান্ডের বয়ন শিল্প ভারতীয় বয়ন শিল্পের কাছে প্রতিযোগিতায় হেরে যেত। আর এখন ভারতীয় বয়ন শিল্পীদের বাজার থেকে উৎখাত করা হয়েছে। এখন দেশীয় ম্যানচেস্টারের বস্ত্র, বার্মিংহামের যন্ত্রাংশ ছাড়া অন্য কিছু কেনার কথা ভাবতে পারা যায় না। আমরা আশা করব যে আমাদের পুত্র, পৌত্ররা প্রতিটি ধুতি, শার্ট, পাগড়ি ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের থেকে ক্রয় করবে। বর্তমান ভারতীয়রা শুধু চাষবাস করছে কারণ তার কাছে পুঁজি নেই, নতুন কোন বুদ্ধি (প্রযুক্তি) নেই। কিন্তু ভারতীয়রা জ্ঞান, শক্তি, ধনবৃদ্ধি করে বিংশ বা একবিংশ শতকে কৃষি ও উৎপাদনশিল্পে উন্নতি করবে, খনি শিল্পে উন্নতি করবে এবং নিজেদের জাহাজে পণ্য পাঠাবে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় - এই আশা করেছেন লেখক। 


রানীগঞ্জের খনিতে দেখার জিনিস অনেক আছে। খনিশিল্প ভারতীয়দের কাছে নতুন। ষোলশোর বেশি শ্রমিক এখানে খনিতে কাজ করে। মাটির ১৩৫ ফুট গভীর পর্যন্ত খনন করে কাজ হচ্ছে। খনির তিন মাইল গভীর পর্যন্ত টর্চ লাইট ব্যবহার করে একজন দর্শনার্থী দেখে আসতে পারেন। 


দামোদর নদ তার উদ্যাম গতিবেগে পাড় ভাসিয়ে শয়ে শয়ে গ্রাম শহরে বন্যা ঘটায়। তাই একে নদী না বলে নদ বলে। আর তাই এর নাম দামোদর অর্থাৎ অতৃপ্ত গ্রাসকারী, যদিও রানীগঞ্জে এই নদী শান্তভাবে বয়ে যাচ্ছে। 


এরপর লেখক দুটি ডাক গাড়ি ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করার জন্য ডাকওয়ালাদের কাছে গেলেন। কিন্তু অনেকে বেড়াতে বেরিয়েছে বলে গাড়ি পাওয়া গেল না। মুসলমানের বাদশাহরা পত্রবাহক রানারের জায়গায় ঘোড়ার ডাক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এখন সেটি মানুষকে বহন করে সুদুরে নিয়ে যাচ্ছে। পালকি ছেড়ে এখন ঘোড়ার গাড়ির উপর মানুষ নির্ভর করতে পারছে। কয়েক বছর পরে রেল এই যাতায়াতের প্রধান পথ হয়ে উঠবে। কলকাতার বাবুদের ভ্রমণ এর ফলে শতগুন বৃদ্ধি পাবে। স্রোতের মতো মানুষ একঘেয়েমি কাটাতে আর ছুটির সদ্ব্যবহার করার জন্য ছুটবে। ইতিহাসে, গাঁথায় শোনা স্থানগুলিতে পৌঁছানোর আগ্রহে, প্রকৃতিকে দেখার উৎসাহে মানুষ অনেক বেশি ভ্রমণ করবে। মানুষকে ভ্রমণমুখী করে তুলতে রেলের ভূমিকা অবশ্যই অপরিসীম।

                       (চলছে)

প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪২। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৬ ভোলানাথ চন্দ্র

  

  

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

সুপ্রাচীন শহর পাটনা, সংস্কৃতে পাটলিপুত্র, গ্রীক পর্যটকদের ভাষায় পালিবোথরা আর চীনা পর্যটকদের ভাষায় পোতোলিতসে (পালিনফু উইকিপিডিয়া অনুসারে) নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অজাতশত্রু পাটলীপুত্র প্রতিষ্ঠা করেন। নন্দ বংশ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক এঁদের রাজধানী ছিল এই পাটলিপুত্র। এখানে সেলুকাসের দুত হয়ে মেগাস্থিনিস এসেছিলেন। চাণক্যের কূটনীতি এখানেই প্রযুক্ত হতো। এখান থেকে অশোকের ধর্মদূতেরা মিশর, সিরিয়া, গ্রীস, শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন। মৌর্য ও গুপ্ত যুগের অবসানের পর হর্ষবর্ধনের আমলে পাটলীপুত্র আবার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়। হিউয়েন সাং-এর রচনায় সেই ইতিহাস জানা যায়। মুসলমান যুগে পাটনা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ পর্যটক রালফ ফিচ (১৫৫০-১৬১১) পাটনাকে এভাবে বর্ণনা করেছেন - বড় শহর কিন্তু শুধু ঘরের চাল দেওয়া মাটির বাড়ি রয়েছে। ডাকাতের ভয়ানক উৎপাত। অর্থাৎ তখন পাটনা শ্রী হারিয়েছিল। বর্তমান পাটনা শহর সরু গলিপথ, নোংরা অসুন্দর, দেওয়ালে ঘুঁটে দেওয়া ঘরবাড়ি, নোংরা নালা ম্যালেরিয়ার মশায় ভর্তি। জমি নিচু তাই বন্যায় ভেসে যায়। মেগাস্থিনিসের বর্ণনার তোরণ দ্বার, মিনার, বিশাখদত্তর লেখা নাটক মুদ্রারাক্ষসের বর্ণনার প্রাসাদ কিছুই অবশিষ্ট নেই। ২০০ বছরের পুরনো কোন ঘরবাড়ি পাটনায় নেই । হিউয়েন সাং-এর বর্ণনার কোন বৌদ্ধ-মঠ মন্দির আর নেই। আছে শুধু পাটনা দেবী, গোপাল, শিব মন্দির, শিখ গুরুদ্বার আর মুসলমান মসজিদ। পাটনায় এখন মুসলমান ও শিখের আধিক্য দেখা যায়। মুসলমান শাসক পাটনার নাম আজিমাবাদ দিতে চেয়েছিলেন। পাটনায় একটি দ্রষ্টব্য স্থান আছে। ১৫০ জন ব্রিটিশকে মীর কাসেমের আদেশে সমরু (মীর কাসেমের জার্মান সেনানায়ক ওয়াল্টার রাইনহার্ট সোমব্রু) হত্যা করেছিলেন। তাঁদের স্মৃতিতে একটি কালো ও হলুদ পাথরের ত্রিশ ফুট উঁচু সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে (সৌধটি অধুনালুপ্ত)। 

পাটনার বাণিজ্য ঘাঁটি শহরের বাইরে মারুগঞ্জে (মারুফগঞ্জ) রয়েছে। পাটনায় টেবিল ক্লথ খুব ভালো তৈরি হয়। পাটনার দুটি আশ্চর্য ব্যাপার - এক, পাটনায় শুধু জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাসেই বিয়ে হয়। দুই, যারা এখানে মারা যায়, তাদের গঙ্গার অপর পাড়ে দাহ করা হয়। 

পাটনা থেকে ছ'মাইল দূরে এখানকার প্রশাসনিক কেন্দ্র বাঁকিপুর। আফিমের গুদাম, আদালত আর ইউরোপীয় বসবাসের স্থান রয়েছে এখানে। ডোমের আদলে একটি বিশাল ঘর রয়েছে (গোলঘর) যার বাইরে থেকে দুটি সারি সিঁড়ি উঠে গেছে। উপরে একটি গোলাকার দরজা আছে ফসল রাখার আর নীচে একটা দরজা আছে ফসল বের করার। এটি ফসলের সরকারি গোলা। ১৭৮৩ দুর্ভিক্ষের পর সরকার এটি তৈরি করেছেন ফসল সংরক্ষণের জন্য। বাঁকিপুর স্টেশন থেকে গয়ার দিকে রাস্তা গেছে। গয়ার ছমাইল পরে বুদ্ধগয়া যেখানে গৌতম বা শাক্যমুনি বৌদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। এখানে দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো মন্দির আছে যার পাথরের খিলান প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যের ঐতিহ্যকে মনে করায়। এখানে চীন, বার্মা থেকে বহু যুগ ধরে তীর্থযাত্রীরা এসেছে। তার পরবর্তী যুগে হিন্দু গয়ার উত্থান হয়েছে। বৌদ্ধপদ থেকে বিষ্ণুপদ-এর গুরুত্ব বেড়েছে। 

বাঁকিপুরের ফেরিঘাট থেকে নৌকা নিয়ে লেখক সোনপুরের হরিহরছত্রের মেলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। হিমালয়ের তুষার শৃঙ্গ থেকে আগত গণ্ডকী নদী এখানে গঙ্গায় মিশে যায়। এই গণ্ডকী নদীতে হিন্দুদের পবিত্র নারায়ণ শিলা বা শালিগ্রাম শিলা পাওয়া যায়। এই সঙ্গমস্থলে একটি সাদা মন্দির আছে। এটি হরিহরনাথের মন্দির। এখানে পৌরাণিক কাহিনী মতে গজ ও কচ্ছপের লড়াই হয়েছিল এবং গরুড় তাদের নৈমিষারণ্যে নিয়ে যান। মন্দিরটিতে সারা বছর তেমন ভিড় থাকে না কিন্তু কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় এখানে সম্ভবত ভারতের সবথেকে বড় মেলা হয়। এই মেলায় মূলত পশু কেনা বেচা হয়। কম করে দশ হাজার ঘোড়া, দুই হাজার হাতি এখানে কেনা বেচা হয়। তামা কাঁসার বাসন, দেশি বিদেশি জিনিস, খেলনা, গয়না, শখের নানারকম জিনিস, শস্য, মিষ্টি সবকিছুর দোকান সার দিয়ে বসে। পাঁচশ তাঁবু রাজা-মহারাজাদের জন্য তৈরি হয়। পুরো এলাকা তাঁবু ও অস্থায়ী ছাউনিতে ভরে যায়। নাচ গানে মেলা মুখর হয়ে থাকে। অনেক ইউরোপীয় আনন্দ করার জন্য এখানে আসেন। এক পক্ষ কাল ধরে মেলা চলে। 

পাটনার সামরিক ঘাঁটি পাটনা থেকে ১৪ মাইল দূরে দানাপুর। সেখানে সেনা ছাউনি, বাংলো, ব্যারাক রয়েছে। 

দানাপুর থেকে চার মাইল উত্তরে শোন ও গঙ্গার সঙ্গমস্থল। রেলপথের শোন নদীর সেতু পার হলে (কয়েল ওয়ার ব্রিজ, ১৮৬২) আসে আরা (আরা জংশন)। আগে ফ্রেন্চ ও ডাচ কারখানাও ছিল, এখন ইংল্যান্ডের সোরা তৈরির ফ্যাক্টরি কারখানা রয়েছে এখানে। এরপর ছাপড়া ও ছাপড়ার ছয় মাইল উজানে সরযু নদী গঙ্গায় এসে মিলেছে। এই সঙ্গমের দৃশ্য খুব মনোরম। 

গঙ্গায় এরপর চরের কারণে স্টিমারের চলতে অসুবিধা হচ্ছিল। এবার এলো বক্সার। বক্সার যুদ্ধ ব্রিটিশ শক্তিকে বাংলা ছাড়িয়ে উত্তর ভারতের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ খুলে দিয়েছিল। এই যুদ্ধের ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় কর আদায় করার অধিকার পেল। শ্রীরামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে এখানে একটি ভবন তৈরি করা আছে। রাম নাকি এখানে এসেছিলেন এবং বিশ্বামিত্রের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছিলেন। ভোজ রাজার দেশ বলে এই স্থানের সবকিছুকে ভোজপুরিয়া বলে। 


সারারাত গঙ্গায় স্টিমার চলে ভোরে এলো গাজীপুর। গাজীপুর বিখ্যাত গোলাপ বাগানের জন্য। শয়ে শয়ে একর জমিতে এখানে গোলাপ চাষ হয়। বহু মানুষ গোলাপ জল, গোলাপের আতর, সুগন্ধি বিক্রয় করে। এখানকার শহর পরিচ্ছন্ন, চওড়া রাস্তা, সুসজ্জিত বাজার। ইউরোপীয়রা আলাদাভাবে বাস করে তাদের বাংলোতে। শহরের পশ্চিম প্রান্তে সেনা ছাউনি। ষোড়শ শতাব্দীতে আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরীতে গাজীপুরের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু এখন কোন প্রাচীন স্থাপত্য দেখা যায় না। এটি মুসলমান প্রধান জায়গা। গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস এখানে মারা গেছিলেন এবং এখানেই তাঁর সমাধি রয়েছে। 

এরপর এলো চুনার। লেখক চুনারের দুর্গ দেখতে গেলেন। শোনা যায় বাংলার পাল রাজারা এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। অন্য মত অনুসারে বুন্দেলখন্ডের চন্ডাল রাজা এই দুর্গ নির্মাণ করেন বলে এর নাম হয় চন্ডালগড়, তার থেকে চুনার। গঙ্গার ঘাট থেকে সুউচ্চ দুর্গ উপরে উঠে গেছে। দুর্গ দেখার পর তিনি চুনার শহর দেখেন। এখানকার বাড়িঘর সব পাথরের তৈরি, দোতলা, বারান্দা দেওয়া। দোকানে লাল আর কালো চিনামাটির বিখ্যাত বাসন পাওয়া যায়। এখানকার তামাক খুব ভালো। 

চুনার থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত রেলপথ জঙ্গল আর উঁচু উঁচু পাহাড়ি জমির উপর দিয়ে গেছে। এখানে বাঘ, হাতি না থাকলেও নেকড়ে, ভালুক আছে। মির্জাপুর শহর অনেকগুলি পাথরে বাঁধানো ঘাট, প্রচুর নৌকা, অনেক সুন্দর মন্দির, মনোরম উদ্যান, সুন্দর ঘরবাড়ি নিয়ে উপস্থিত। মির্জাপুরের কোন প্রাচীন ঐতিহ্য নেই রাজমহল, ভাগলপুর বা মুঙ্গেরের মত। কিন্তু বর্তমানে এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে সুতী আর ধাতুর দ্রব্যের গুদাম আছে। কার্পেট সহ বহু জিনিস এখানে তৈরি হয়। মির্জাপুরে অত্যন্ত সুন্দর একটি চক আছে। 


মির্জাপুর থেকে চার মাইল দূরে বিন্ধ্যাচল মন্দির। এই দেবী ডাকাতদের আরাধ্যা। পাহাড়ের উপর দেবীর মন্দির। এই ডাকাত বা ঠগেরা তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে নদীতে বেনারস থেকে কলকাতা যাতায়াত করত এবং ডাকাতি করত। মির্জাপুর থেকে এলাহাবাদ ভ্রমণের কাহিনী লেখক কয়েকটি পর্ব পরে বর্ণনা করবেন বলে বলেন এখানে।

                     ( চলছে)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...