বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

৫৭। ইউরোপে তিন বছর ৩ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ইটালি।


লেখক রমেশ চন্দ্র দত্ত তিন সপ্তাহের একটি ঝটিতি সফরে ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও ইতালির বিভিন্ন জায়গা দর্শন করলেন। ১৪ই আগস্ট ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডন ত্যাগ করে পরদিন ফ্রান্সের প্যারিস পৌঁছলেন তিনি ও তাঁর বন্ধুরা। প্যারিস বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহর কিন্তু তখন তা হতশ্রী হয়ে পড়েছে। বিশেষত কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানে অনেক স্থাপত্য নষ্ট হয়েছে। প্যালেই রয়াল, ভঁডোম স্তম্ভ, টুইলারি (ফ্রান্সের রাজপ্রাসাদ) ধ্বংস করা হয়েছে। যদিও সুন্দর আলোকোজ্জ্বল পথ দেখে মনে হবে প্যারিস সবসময় আনন্দ উৎসবের মধ্যে আছে। কী ঝড় এই শহরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে তা একমাত্র ধ্বংসস্তূপগুলি দেখলে বোঝা যায়। (ফ্রান্স-প্রুশিয়া যুদ্ধের কারণে ও প্যারিস গণঅভ্যুত্থানের জন্য ১৮৭১ এ প্যারিসে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল)। প্যারিসে লুভর মিউজিয়াম একটি রাজকীয় প্রাসাদ যা টুইলারির সংলগ্ন। কিন্তু ভাগ্যবশত লুভর এই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। লেখক লুভরে স্ট্যাচু ও ছবির অমূল্য সংগ্রহ দেখলেন। প্রথম নেপোলিয়নের আর্ক দ্য ট্রিঅঁফ অক্ষত আছে। সেখানে সুন্দর শিল্পকলার সঙ্গে নেপোলিয়নের জয়লাভের বর্ণনা লেখা আছে। তাঁরা স্তম্ভের উপর উঠে প্যারিস ও স্যেন নদীর শোভা দেখলেন। স্যেন নদীতে স্টিমারে চড়ে তাঁরা অনন্য সুন্দর নোত্র ডাম চার্চ দেখতে গেলেন। নেপোলিয়নের মরদেহ সেন্ট হেলেনা দ্বীপ থেকে এনে এখানে সমাধি দেওয়া হয়েছে। সমাধির কাছে লেখা আছে নেপোলিয়নের শেষ ইচ্ছা যে মৃত্যুর পর তাঁর অবশেষ যেন স্যেন নদীর ধারে তাঁর প্রিয় ফরাসি জনগণের মধ্যে সমাহিত করা হয়। সমাধি চার-পাশ ঘিরে শ্বেত পাথরের স্তম্ভ, মূর্তি রয়েছে ও সমাধির উপর একটি সুন্দর ডোম আছে। 

প্যারিস থেকে তাঁরা সেন্ট ক্লাউড নামে ফ্রান্সের রাজাদের প্রিয় অবসরস্থলে গেলেন। এখানকার প্রাসাদ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সুন্দর উদ্যান ও রাস্তাঘাট রয়েছে। এবার তাঁরা গেলেন ভার্সেই, যা ফ্রান্সের সব থেকে শক্তিশালী রাজা চতুর্দশ লুইয়ের কীর্তি। যদিও এখন সেখানে বিভিন্ন অফিস বসেছে তবু তাঁরা দেখার অনুমতি পেলেন। তাঁরা বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে দেখলেন। সেখানকার বিভিন্ন ছবি ও মূর্তিগুলি ফ্রান্সের উজ্জ্বল দিনের গৌরব প্রকাশ করছে। ভার্সেইয়ের উদ্যান, ছায়াচ্ছন্ন পথ, ফোয়ারা, নিকুঞ্জ, বসার আসন প্রভৃতি কেন রূপকথার জগতের মত সুন্দর। 

এরপর প্যারিস হয়ে তাঁরা রাইন নদীর ধারে অবস্থিত জার্মানির কোলন শহরের দিকে যাত্রা করলেন। অডি কোলনের জন্য বিখ্যাত শহর কোলন কিন্তু অত্যন্ত নোংরা। পরদিন স্টিমারে তাঁরা মায়েন্স শহরে চললেন। রাইন নদীর দু'পাশে পাহাড় আর অনেক দুর্গ দেখা যায়। বন (Bohn) পেরোনোর পর তাঁরা সেভেন হিলস ও তার উপর ড্রাচেনফেলস দুর্গ দেখলেন। রাইন নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কিছু দু'পাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সুউচ্চ শৃঙ্গ কুয়াশা ভেদ করে ওপরে উঠে আছে। 

এবার এল সুইজারল্যান্ড। ফ্লুলেন ও  লুসার্ন লেক দেখলেন, যা পৃথিবীর সুন্দরতম স্থান। শান্ত সরোবর সুউচ্চ পর্বত বেষ্টিত হয়ে এক অপূর্ব দৃশ্যপট রচনা করেছে। লুসার্ন থেকে স্টিমার ও ঘোড়ার গাড়িতে ইন্টারলাকেন গেলেন, যেটি ব্রেঞ্জ ও থুন হ্রদের মধ্যে অবস্থিত। ইন্টারলাকেনে তাঁরা সাদা তুষারাবৃত জুং ফ্রাউ (আল্পসের একটি সুউচ্চ শৃঙ্গ) দেখলেন চাঁদের আলোয়। এরপর স্টিমারে হ্রদ পার হয়ে তাঁরা ট্রেনে বার্ন গেলেন। বার্নে সুন্দর সুন্দর গির্জা, বাড়ি, রাস্তাঘাট আছে। বার্ন থেকে বরফে ঢাকা আল্পসের দৃশ্য অসাধারণ। এবার তাঁরা জেনেভা লেকের ওপর অবস্থিত লুসার্ন গেলেন। এখানে ঐতিহাসিক গীবন তাঁর 'হিস্ট্রি অফ রোম' লেখা শেষ করেন। সেখান থেকে এলেন শিলন ক্যাসেলে। গভীর জলে ঘেরা মূল ভূখণ্ড থেকে একটি মাত্র ব্রিজ দিয়ে যুক্ত এই দুর্গের অন্ধকার মাটির নীচের ঘরে গ্যালান্ট বনিভার্ড (সুইস স্বাধীনতা সংগ্রামী) ছয় বছরের জন্য শিকল দিয়ে স্তম্ভে বাঁধা ছিলেন। সেই ঘর, স্তম্ভ, শিকল লেখক দেখলেন। আর দেখলেন ঘরের একটি স্তম্ভে কবি বায়রণ তাঁর নাম খোদাই করে রেখে গেছেন। শিলন থেকে তাঁরা লেকের অন্য পাড়ে জেনেভা শহরে গেলেন। স্টিমারে চলতে চলতে লেকের একধারে জুরা পর্বতমালা ও অন্য পারে সুউচ্চ আল্পস পর্বত মালা দেখতে পেলেন। জেনেভা রুশো (দার্শনিক) ও সিসমন্ডির (ঐতিহাসিক) জন্মস্থান। এখান থেকে তুষারাবৃত মণ্ট ব্ল্যাঙ্ক (৪৮০৮ মিটার) দেখা যায়। 


সুইজারল্যান্ড ভ্রমণকালে লেখক লক্ষ্য করলেন যে অত্যন্ত দরিদ্ররাও এখানে ভালো আছে। তাদের ছোট কাঠের কুটির তারা সুন্দরভাবে রং করে সাজিয়েছে। ঘরের লাগোয়া জমি তারা চাষ করেছে। সবকিছু খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তাদের ব্যবহার খুব ভদ্র এবং তারা ইউরোপের বিশেষ করে ইংল্যান্ডের দরিদ্র কৃষকদের থেকে খুব স্বতন্ত্র। 

সেখান থেকে লুসার্ন ফিরে তাঁরা ডিজিলেন্স নামে ঘোড়ার ডাকগাড়ি করে সেন্ট গথার্ড নামক ইউরোপের অত্যন্ত সুন্দর একটি গিরিপথ হয়ে ইতালি গেলেন। এই গিরিপথ টি সমুদ্রতল থেকে ৭০০০ ফুট উঁচু। এবার এলো ইতালির কোমো। সেন্ট গথার্ড অতিক্রম করার সারা দিনের ক্লান্তি কোমো লেকে স্নান করে দূর হল। কোমো থেকে তাঁরা গেলেন মিলানে। মিলানে শ্বেত পাথরে তৈরি ক্যাথিড্রোলের গঠনশৈলী ইউরোপের অন্য সব স্থানের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। মিলানের পর ভেনিস। 

ভেনিস এক আশ্চর্য শহর। যেখানে এবিং সমুদ্রের জল শহরের রাস্তায় বয়ে চলেছে। তার মধ্যেই রয়েছে অপূর্ব সুন্দর গির্জা, ক্যাথিড্রাল, প্রাচীন প্রাসাদ, গম্বুজ প্রভৃতি। সেন্ট মার্কস প্লেস শহরের কেন্দ্রস্থল। এছাড়া ডগেস প্যালেস, প্রিন্সলি প্যালেস দেখলেন। আর দেখলেন প্রাসাদের অন্ধকারময়, অস্বাস্থ্যকর নির্মম কারাগার। সেন্ট মার্কস চার্চে ভেনিসিয়দের পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান জয় করে নিয়ে আসা (মিশর, কনস্টান্টিনোপল, জেরুজালেম প্রভৃতি স্থান থেকে নিয়ে আসা) মূর্তি, স্থাপত্য দেখলেন। তাছাড়া ভেনিসের প্রসিদ্ধ স্বর্ণ সিংহ (শহরের প্রতীক) রয়েছে এখানে। আরো কিছু চার্চ এখানে রয়েছে যেগুলি ইতালিয় শিল্পকলার অপূর্ব নিদর্শন। তারপর তাঁরা  ভেনিস থেকে স্টিমারে ব্রিন্দিসি হয়ে বোম্বের (ভারত) উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন, প্রায় তিন সপ্তাহ পথে। 


এর আঠেরো বছর পরে ১৫ ই এপ্রিল ১৮৮৬ লেখক কলকাতা থেকে আবার একই পথে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। এবার তাঁর সঙ্গী তাঁর স্ত্রী, এক ভাই ও চার ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। জলপথে একই স্থানের বর্ণনার পুনরাবৃত্তি না করে শুধু মাত্র যেসব নতুন সংযোজন লেখক এবারের বর্ণনায় করেছেন সেটুকুই এখানে রাখা হল। ভারত মহাসাগরে লেখক এবার অনেক তিমি দেখলেন, যদিও সেগুলি তেমন বড় নয়। লন্ডন শহরে তাঁরা কেনসিংটন গার্ডেন, কেনসিংটন প্যালেস দেখলেন। এই প্রাসাদে থাকাকালীন রানী ভিক্টোরিয়া প্রথম তাঁর রানী হওয়ার সংবাদ পান। এর কাছেই আলবার্ট মেমোরিয়াল ও অ্যালবার্ট হল অবস্থিত। হাইড পার্ক, গ্রীন পার্ক হয়ে সেন্ট জেমস পার্কে পৌঁছলেই আসে মহারানীর প্রাসাদ বাকিংহাম প্যালেস। ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবের কাছে রয়েছে পার্লামেন্ট হাউস। লন্ডনের উত্তর দিকে রিজেন্ট পার্কে আছে লন্ডনের চিড়িয়াখানা। 

এবার লেখক শিক্ষা জগতের পীঠস্থান অক্সফোর্ড দর্শন করলেন। পরিবারকে ইংল্যান্ডের সমুদ্র উপকূল দেখানোর জন্য তিনি লিটল হ্যাম্পস্টনে নিয়ে গেলেন কারন এটি শান্ত নির্জন স্থান এবং এ অরুনডেলের কাছে অবস্থিত। সেখান থেকে তাঁরা ব্রাইটনের একুরিয়াম দেখলেন, যেখানে অক্টোপাস সহ অনেক অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণী আছে। সমুদ্রতীরের বালিতে হাঁটতে আর সমুদ্রের ঠান্ডা জলে স্নান করতে লেখক ও তাঁর পরিবারের খুবই ভালো লাগত। আশেপাশের গ্রাম্যপথে হেঁটে বেড়ানো একটা আনন্দের কাজ ছিল। বাচ্চারা ঝোপঝাড় থেকে ব্ল্যাকবেরি সংগ্রহ করতে খুব মজা পেত। 

এরপর লেখক ব্রিস্টলে গেছিলেন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে। ব্রিস্টলের সেন্ট মেরি র‍্যাডক্লিফ চার্চের প্রাঙ্গণে একটি সৌধ রয়েছে বালক কবি চ্যাটারটানের নামে, যিনি বলতেন তাঁর লেখা কবিতাগুলি আসলে তিনি ওই গির্জায় পেয়েছিলেন। ব্রিস্টলের সব থেকে সুন্দর অংশ ক্লিফটন। এখানে অ্যাভন নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু রয়েছে। বাথ ইংল্যান্ডের একটি সুন্দরতম শহর, যার চারপাশ সবুজ পাহাড় ঘেরা। অতি প্রাচীনকাল থেকে এটি স্বাস্থ্য নিবাস ছিল। প্রাচীন রোমান যুগের স্নানাগার এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানকার অ্যাবে চার্চকে সুন্দর অজস্র জালনার জন্য 'পশ্চিম ইউরোপের লণ্ঠন' বলা হয়। ওয়েলস্ একটি ছোট শহর কিন্তু এটি কাথিড্রালের জন্য বিখ্যাত। এখানে প্রাচীন বিশপের দুর্গ দেখলেন তিনি। তারপর প্রাচীন গ্লাসনবেরি অ্যাবে দেখলেন। এরপর ওয়ে নদী, যা ইংল্যান্ডের রাইন নামে খ্যাত, দেখে তিনি লিটল হ্যাম্পস্টনে পরিবারের কাছে ফিরে গেলেন। 

লিটল হ্যাম্পস্টন থেকে লেখক ২৫ শে এপ্রিল ১৮৮৬ ফ্রান্সের প্যারিসে পৌঁছান। আগে প্যারিসের অনেক দ্রষ্টব্য লেখকের চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে। এবার বাকি স্থানগুলির পালা। 

স্যেন নদীর উত্তর ও দক্ষিণে বর্তমান প্যারিস ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু আগে নদীর উত্তর, দক্ষিণের এই অংশ দুটিকে প্যারিস বলা হত না। স্যেন নদীর বুকে দুটি দ্বীপ-ই প্যারিস ছিল। এখন এই অংশকে সিটি বা পুরনো প্যারিস বলা হয়।  সিটিতে নোত্র-ডাম (ক্যাথিড্রাল), প্যালেই দ্য জুস্টিস (বিচারালয়), লা সাঁত চ্যাপেল দেখে তিনি স্যেনের উত্তর পাড়ে গেলেন। সেখানে লুভর আর্ট মিউজিয়াম, টুইলারি, প্যালেই দি লা কনকর্ড (ইউরোপের সব থেকে বড় ও সুন্দর স্কোয়ার বা প্রাঙ্গণ), শঁপস এলিজে (দুদিকে উদ্যানে সাজানো রাস্তা) আর আর্ক দ্য ট্রিঅঁফ (নেপোলিয়নের বিজয় সূচক সৌধ), বোয় দ্য বুলগন (এটি রাজাদের শিকারের জঙ্গল ছিল, এখন বিশাল বড় পার্ক ও চিড়িয়াখানা), ভঁডোম স্তম্ভ (নেপোলিয়নের জয়সূচক স্তম্ভ), জোয়ান অফ আর্কের মূর্তি (ফ্রান্সের সাহসী যোদ্ধা যিনি ১৪৩১ এ শহীদ হন), পালই রয়াল (ঐতিহাসিক প্রাসাদ), সেন্ট-উস্তাচ চার্চ, ওটেলদ্য ভিল (১৮৭১ এর বিদ্রোহীরা এটি পুড়িয়ে দেয়, এটি প্যারিসের একটি সুন্দর টাউন হল), সেন্ট্রাল মার্কেট, বাস্তিল দুর্গ দেখলেন। পালই দিলা কনকর্ড থেকে বাস্তিল রু দ্য রিভোলি নামক রাস্তা ধরে সোজা এসে দেখলেন। 

এরপর থেকে বুলেভার্ড নামক প্যারিসের বিখ্যাত ও আকর্ষণীয়, দুপাশে গাছের ছায়াযুক্ত দোকান, ক্যাফে, চওড়া ফুটপাত দেওয়ার পথ ধরে চলতে শুরু করা হল। এখানকার দ্রষ্টব্য স্থান মেডেলীন চার্চ, অপেরা হাউস (সংস্কৃতির পিঠস্থান প্যারিসে অপেরা গানের হল), বুরস (প্যারিসের স্টক এক্সচেঞ্জ), ব্যাঙ্ক অফ ফ্রান্স (১৮০৩ এ প্রতিষ্ঠিত), চতুর্দশ লুই-এর বিজয় সূচক আর্চ, মন্টমার্ত্র (প্যারিসের উত্তরতম ও উচ্চতম স্থান), শোমঁ (প্যারিসের উত্তর-পূর্ব অংশের একটি ছোট টিলা, যার পাদদেশে সুন্দর লেক উদ্যান রয়েছে)- এই সব দেখলেন। এই পাহাড়ের নীচে প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র পের লাশেজ রয়েছে (অনেক বিখ্যাত ফরাসি মানুষের সমাধিস্থল এটি)। 

স্যেন নদীর দক্ষিণ পাড়ের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু করে শঁপ দ্য মার্স  (এটি একটি বড় পার্ক যেটি আগে সামরিক প্যারেডে ব্যবহৃত হতো), নেপোলিয়নের সমাধি, পার্লামেন্ট হাউস, পন্থেওঁ (২৭২ ফুট উঁচু ডোম বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ভবন, এখানে ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি ভিক্টর হুগো প্রমুখকে সমাহিত করা হয়েছে), জারদাঁ দে প্লাঁত (ঐতিহাসিক উদ্যান যেখানে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের মিউজিয়াম আছে), ক্যাটাকম্ব (প্যারিসের বিশাল ভূগর্ভস্থ সমাধিস্থল যেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীতে শহরের অতিরিক্ত অবস্থান থেকে মৃতদেহ স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। পরিত্যক্ত খনিগুলি কবর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আগে এগুলি জনসাধারণ দেখতে পারত, ২০০৯ থেকে তা বন্ধ করা হয়েছে), ভূগর্ভস্থ প্রণালী (তৃতীয় নেপোলিয়ানের তৈরি এই প্রণালীগুলি মানুষ দেখতে পারে পায়ে হেঁটে বা নৌকা করে)। এই সমস্ত দেখে লেখক আবার ইংল্যান্ডের লিটল হ্যাম্পস্টনে ফিরে যান।

                        (চলছে)

শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪

৫৬। ইউরোপে তিন বছর ২ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

   সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ।
 
লেখক রমেশ চন্দ্র দত্তের এবারের ভ্রমণ স্থান কেমব্রিজ। এখানকার ক্রাইস্ট কলেজে কবি মিল্টনের নিজের হাতে লাগানো মালবেরি গাছটি এখনো সযত্নে রাখা আছে। কিংস কলেজ চ্যাপেল, সেন্ট জোন্স চ্যাপেল খুব সুন্দর ভাবে সাজানো। ট্রিনিটি কলেজের লাইব্রেরী দেখার মত। বেকন, নিউটন, বায়রন, টেনিসন প্রমুখেরা যেখানে পড়েছেন সেইসব স্থান দেখার সৌভাগ্য কেমব্রিজে এলে হয়। ক্যাম নদীর ধারে সুন্দর ছোট শহর অবশ্যই দ্রষ্টব্য স্থান। তাঁরা অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজের মধ্যে টেমস নদীতে অনুষ্ঠিত নৌকার প্রতিযোগিতা দেখলেন। নয় বছর পর কেমব্রিজ সেবার প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করল। 

ব্রাইটনে তাঁরা ২৬ হাজার জন স্বেচ্ছাসেবকের মার্চ পাষ্ট ও কৃত্রিম যুদ্ধ দেখলেন। সমুদ্র তীরে সুসজ্জিত বিলাসবহুল শহর ব্রাইটন থেকে তাঁরা ওয়ারথিং-এ গিয়ে ইংল্যান্ডের প্রাচীনতম দুর্গ অরুনডেল দেখলেন। এরপর তাঁরা গেলেন উইন্ডসর সেখানে রানীর বাসভবন, কলেজ, উইন্ডসর ফরেস্ট দেখলেন। দেখলেন কবি গ্রের সমাধিস্থল। 

লেখক ও সঙ্গীরা এবার বিখ্যাত ডার্বি রেস দেখতে ডার্বি। এই রেসে ইংরেজরা তাদের স্বভাবসুলভ চাপা, সংযত ব্যবহার ছেড়ে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে দেখলেন লেখক। 

ইংল্যান্ডের গ্রাম্য জীবন না দেখলে এই দেশ দেখা অসম্পূর্ণ থাকে। গ্রামের বাড়িগুলি পরিষ্কার ও সুন্দরভাবে তৈরি। বাড়িগুলিতে বড় উঠান, সুন্দর বাগান ও লন থাকে। রাস্তাগুলি লম্বা ও সুন্দর, অনেক পার্ক থাকে যেখানে অনেক হরিণ চড়ে বেড়ায়। নানারকম বুনো ফুল এদিকে ওদিকে ফুটে থাকে। গ্রামে একটি চার্চ অবশ্যই থাকে। ইংল্যান্ডের গ্রামের মানুষ অনেক বেশি মিশুকে শহরের তুলনায়। 

একদিন তাঁরা টাওয়ার অফ লন্ডন (ইংল্যান্ডের রাজার দুর্গ ও প্রাসাদ, প্রাচীন কারাগার এবং রাজ মুকুট প্রদর্শনের স্থান) দেখতে গেলেন। তাঁরা লাইওনস্ গেট দিয়ে ঢুকে বেল টাওয়ার দিয়ে বেরোলেন। এখানে নিষ্ঠুর মেরি (ষোড়শ শতকের ইংল্যান্ডের রানী) তাঁর বোন এলিজাবেথকে বন্দী করে রেখেছিলেন। এখানে অনেক রাজকীয় তথা নারকীয় হত্যাকান্ড হয়েছে। হর্স আরমারিতে রাজাদের ব্যবহৃত অনেক অস্ত্র দেখলেন। জুয়েল রুমের রাজা রানীদের ব্যবহৃত নানান মুকুট দেখলেন। সব থেকে আকর্ষণীয় হলো পৃথিবীর বৃহত্তম হীরা, ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া কোহ ই নূরের মডেল। লন্ডন টাওয়ারের বাইরে টাওয়ার হিল দেখা হল, যেখানে বিশ্বাসঘাতকদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হতো। সেন্ট পিটার্স চার্চ-এর প্রাঙ্গণটিতে প্রাণদন্ডিতদের সমাধিও দেখলেন। এবার তাঁরা বিশাল সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চার্চ দেখলেন। 

এবার সমুদ্রতীরের ডেভনশায়ারে কিছু আনন্দে দিন যাপন। সবুজ পাহাড় উপত্যকায় ভরা এই স্থানে টটনেস, ডার্টমাউথ প্রভৃতি জায়গা ঘুরে প্রকৃতি উপভোগ করলেন। 

এবপর দ্রষ্টব্য ইংল্যান্ডের অতি প্রাচীন কেনিল ওয়ার্থ ক্যাসেল আর স্ট্রাটফোর্ড অন অ্যাভনে শেক্সপিয়ারের বাড়ি। যে ঘরে কবি জন্মেছিলেন, তার দেওয়ালে অজস্র দর্শকের শ্রদ্ধাঞ্জলি লেখা আছে। রমেশ চন্দ্র দত্ত তার মধ্যে থেকে ওয়াল্টার স্কট ও চার্লস ডিকেন্সের নাম খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন। বাড়িটি ভালোভাবে সংরক্ষিত হয়েছে এবং একটি মিউজিয়াম হয়েছে। এখানকার চার্চে কবি ও কবি-পত্নীর সমাধি দেখলেন তাঁরা। এখানে লেখকের ইংল্যান্ড ভ্রমণ তথা দর্শন শেষ হল। 



এবার পরবর্তী গন্তব্য স্কটল্যান্ড, যে যাত্রা শুরু হল একুশে জুলাই ১৮৬৯। টেমস নদীতে স্টিমারে যেতে যেতে লেখক দেখলেন নদীটির জল অনেক দূর পর্যন্ত লন্ডনের মতোই অপরিষ্কার। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর দৃশ্য পরিবর্তিত হল। কল কারখানার জায়গায় নদীর দু'ধারে শস্যক্ষেত, পশুচারণ ভূমি, ঘাসে ঢাকা জমি, গাছপালা দেখা গেল। নদীর জল স্বচ্ছ হয়ে উঠল। ক্রমে টেমস নদী ছেড়ে স্টিমার জার্মান সাগর (নর্থ সি) এল। ইয়ারমাউথ শহর দেখা গেল। এরপর আর কূল চোখে পরলো না। পরদিন সকালে ফ্ল্যামবরো পাহাড় চোখে পড়ল। এরপর স্ক্যারবরো ও হুইটবি শহর পেরিয়ে তাঁরা চললেন। বিকেলে স্কটল্যান্ডের উপকূল দৃশ্যমান হল। বাস রক নামে একটি ছবির মত সুন্দর পাহাড় পেরোলেন, যাতে অসংখ্য সামুদ্রিক পাখির বাসস্থান। ২২ জুলাই সন্ধ্যায় স্কটল্যান্ডের গ্রান্টনে নেমে তাঁরা এডিনবরাতে গেলেন। 

লন্ডনের থেকে এডিনবরা আয়তনে ও জনসংখ্যায় অনেক কম। অসংখ্য সুন্দর বাড়ি, চুড়াওয়ালা গির্জা আর পাহাড় শহরটিকে অপূর্ব সৌন্দর্য দিয়েছে। কালটন হিল আর ক্যাসেল পাহাড় শহরের মধ্যে রয়েছে আর আর্থার সিট ও সালিশবারি ক্র্যাগস শহরের খুব কাছে। স্যার ওয়াল্টার স্কট-এর (স্কটল্যান্ডের প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক) স্মৃতিতে একটি সৌধ আছে এখানে, যার ওপর থেকে শহরের শোভা দেখা যায়। কালটন হিলের ওপর থেকে দৃশ্য আরো সুন্দর, এখানে রবার্ট বার্নস (স্কটিশ কবি ও গীতিকার) -এর স্মরণে একটি মিউজিয়াম আছে। এরপর তাঁরা হলিরুড প্যালেস ও চ্যাপেল দেখলেন। দেখলেন এডিনবরা ক্যাসেল। হ্রদের ধারে অবস্থিত এই দুর্গে স্কটল্যান্ডের রাজমুকুট সংরক্ষিত আছে। 

লিনলিথগো একটি ছোট শহর, যা পাহাড় আর গোচরণ ভূমিতে ঘেরা। সেখানকার মুখ্য আকর্ষণ প্রাচীন, ভগ্নপ্রায় স্কটিশ রাজাদের রাজপ্রাসাদ। এরপর স্টিরলিং নামক ছোট শহরে পাহাড়ের উপরে উইলিয়াম ওয়ালেসের স্মৃতিসৌধ দেখে সেখানকার দুর্গ দেখলেন লেখকেরা। এরপর তাঁরা গেলেন ক্যালেন্ডার নামে স্থানে, যা সুউচ্চ ও বরফে ঢাকা পর্বতের মধ্যে অবস্থিত। এখানে তাঁরা প্রথম অনুভব করলেন স্কটল্যান্ড কী রকম অনন্ত পর্বত ও জঙ্গলময় স্থান। 


সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়িতে ট্রোসোক্স যাওয়ার পথে অসংখ্য পাহাড়, হ্রদ, উপত্যকা, গিরিখাত পার হতে হলো। মনে হল বিশাল পর্বতশ্রেণী এই দেশকে পাহারা দিচ্ছে। কাটরিনলোমন্ড লেক নিঃসন্দেহে স্কটল্যান্ডের তথা পৃথিবীর একটি সুন্দরতম স্থান। চারদিকে সুউচ্চ পর্বতমালা। বৃক্ষের ছায়া পড়ে হ্রদের সৌন্দর্য অপরিসীম হয়েছে। নিস্তব্ধতা সেই সৌন্দর্যের মাত্রাকে আরো বাড়িয়েছে। লেক লোমন্ডে একটি সুন্দর জলপ্রপাত আছে। 

এবার বালেখ হয়ে লেখা গ্লাসগো গেলেন রেলপথে। গ্লাসগো এডিনবরার থেকে বড় শহর এবং এটি স্কটল্যান্ডের বাণিজ্যকেন্দ্র। শহরের মধ্যে রয়েছে জর্জ স্কোয়ার, যেখানে রানী ভিক্টোরিয়া ও তাঁর স্বামীর মূর্তি রয়েছে। আর রয়েছে স্যার ওয়াল্টার স্কটের স্মৃতিসৌধ। 

এরপর তাঁরা স্টিমারে ওবান শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ফার্থ অফ ক্লাইড ছাড়িয়ে কান  টায়ার উপদ্বীপ বাঁয়ে রেখে তাঁরা সমুদ্রে পৌঁছলেন এবং সেখান থেকে ওবান এলেন। এখানে ডুনল্লী ক্যাসেলের ভগ্নাবশেষ দেখলেন। স্কটল্যান্ডের পশ্চিমকুল বন্ধুর, অনুর্বর আর পর্বতময়। সমুদ্র থেকে উঁচু পর্বতময় শহরটি অতি সুন্দর দেখায়। 

পরদিন স্টিমারে করে আইওনা দ্বীপে গেলেন। সেখানে অতি প্রাচীন সেন্ট মেরিস চার্চ দেখলেন। তারপর স্টাফা দ্বীপে কিছু অদ্ভুত প্রাকৃতিক গুহা দেখলেন। ফিঙ্গাল গুহায় সমুদ্র থেকে নৌকায় করে প্রবেশ করলেন। সেখানে ব্যাসল্টের প্রাকৃতিক ভাবে তৈরী অসংখ্য স্তম্ভ রয়েছে। এখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ পাথরে প্রতিফলিত হয়ে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়ে অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করে। 


এরপর স্টিমারে গ্লেনকো নামক স্থানে গেলেন যেখানে তৃতীয় উইলিয়ামের সময় এক ভয়ংকর নরহত্যাকাণ্ড হয়েছিল। পরদিন স্কটল্যান্ডের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বেন নেভিস (৪৪০০ ফিট) দর্শন করলেন। এরপর তাঁরা ক্যালিডোলিয়ান ক্যানেল-এর মধ্যে দিয়ে চললেন। এই খালের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে লোচি লেক, ওইচ লেক, নেস লেক -এই তিনটি লেককে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

তারপর ইনভারনেস হয়ে অ্যাবারডিন গেলেন তাঁরা। এই শহর গ্রানাইট শহর নামে খ্যাত। কারণ প্রায় সব বাড়ি এখানকার গ্রানাইটে তৈরি। সেখান থেকে এডিনবরা হয়ে গেলেন লেভেন লেক। স্কটল্যান্ডের রানী মেরি এই দ্বীপে নির্বাসিত ছিলেন। 

এরপর কিনরস, হথর্নডেন, মেলরোজ, রোজলিন হয়ে অ্যাবটস্ ফোর্ড গেলেন। ওয়ালটার স্কটের বাড়ি এখানে রয়েছে। তার পড়ার ঘর, লাইব্রেরী, তাঁর ব্যবহার করা জিনিসপত্র প্রভৃতি দেখলেন তাঁরা। স্কটের সমাধি দেখতে তাঁরা ড্রাইবরা  অ্যাবেতে গেলেন। এবার তাঁরা কার্লাইল পেনরিথ হয়ে কেসুইক গেলেন ইংল্যান্ডের হ্রদ দেখার উদ্দেশ্যে। সুইজারল্যান্ডের মতো কাম্বারল্যান্ড ইংল্যান্ডের লেক আর পর্বতের স্থান (লেক ডিস্ট্রিক্ট)। কেসুইক সেখানকার একটি শহর, যা ডারওয়েস্ট ওয়াটার লেক-এর ধারে অবস্থিত। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা এই লেকগুলি স্কটল্যান্ডে উচ্চভূমির থেকে সৌন্দর্যে কম নয়। লেক-এর ওপর পারে লডোর নামক প্রদেশের বিখ্যাত জলপ্রপাত দর্শন করে তাঁরা মুগ্ধ হলেন। সব দেখা শেষ হলে তাঁরা আবার লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করলেন। 


১৫ জুন ১৮৭০ -এ লেখক আয়ারল্যান্ড-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। আইরিশ চ্যানেল পেরিয়ে ডাবলিনে পৌঁছে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়, পার্ক দেখলেন। শহরের কাছেই সমুদ্র তীরে কিংস্ টাউন ডাবলিনবাসীর অবসর যাপন ও প্রেম করার জায়গা। 

তারপর সুউচ্চ পাহাড়ের মধ্যে আভোকা নদীর উপত্যকা দর্শন করে তিনি গ্লেডেনলোতে এলেন। সেখানে ষষ্ঠ শতাব্দীর সাতটি গির্জার ভগ্নাবশেষ রয়েছে। ক্রমে ব্রে, বয়নি, ড্রঘেডা ও বেলফাস্ট হয়ে তাঁরা বিখ্যাত জায়ান্টস কজওয়েতে গেলেন (এটি উত্তর আয়ারল্যান্ডের একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান, যেখানে হাজার হাজার ব্যাসল্ট ষড়ভূজ স্তম্ভ প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে আগ্নেয়গিরির উদগিরণের ফলে), যা অনেকটা স্কটল্যান্ডের ফিংগালস কেভের মত। তারপর তাঁরা ডানলাস ক্যাসেল দেখলেন সমুদ্রের মধ্যে পাহাড়ের ওপর। 

তারপর লন্ডনডেরি দেখলেন, যেখানে ওয়াকারের নামে সৌধ আছে (ওয়াকার প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মযাজক ১৬৮৯ তে  লন্ডনডেরি অবরোধে শহর রক্ষার জন্য লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন)। এরপর তাঁরা আর্ন নামক লেকের জলে নৌকায় ভ্রমণ করলেন। তাঁরা লিমেরিক নামক ব্যস্ত শহর থেকে শ্যানন ঝরনা দেখতে গেলেন আর আয়ারল্যান্ডের গর্ব কিলার্নি লেক দেখলেন। এটি স্কটল্যান্ড-এর লেকগুলির তুল্য। আয়ারল্যান্ডের সর্বত্র নিবিড় শ্যামল জঙ্গল, শস্যক্ষেত্র, বৃক্ষ লতা চোখে পড়েছে। তাই একে পান্না দ্বীপ (এমারেল্ড আইল্যান্ড) বলে। এই শোভা অনেক খুঁজেও ইংল্যান্ডে পাওয়া যাবে না। 

আয়ারল্যান্ডের গরীব মানুষের আলু একমাত্র ভরসা। তারা কখনো মাংস খেতে পায় না। এখানে আলুর ক্ষেত নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখা যায়। এখানকার গ্রামবাসী দুঃখী, তাদের রৌদ্র জলে ক্ষেতে কাজ করতে হয় আর রাতে নোংরা কুটিরে শুয়োর হাঁস মুরগির সঙ্গে শয়ন করতে হয়। উর্বর দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষকরা অন্য আরো কিছু দেশের মতো (ভারতের মতো) এখানে অত্যন্ত দরিদ্র। 

ব্রিস্টলে তাঁরা রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি দেখলেন। এটি ভারতীয় স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। এরপর ওয়েলস্ প্রদেশে মিলফোর্ড হ্যাভেন, অ্যাবেরস্টিথ, কার্মারথেন, ডেভিলস ব্রিজ, কার্নারভন, ল্যানবেরিস ও কনওয়ে নামক স্থানগুলির দর্শনীয় স্থান দেখে লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করলেন ১৪ জুলাই ১৮৭০ -এ।


                       (চলছে)



মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৪

৫৫। ইউরোপে তিন বছর ১ রমেশ চন্দ্র দত্ত

  

 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - শ্রীলঙ্কা, ইয়েমেন, মালটা, ইংল্যান্ড ।

Romesh Chunder Dutt এর "Three years in Europe 1868-1871 with an account of subsequent visit to Europe in 1886 and 1893" বই-এর প্রথম সংস্করণ ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে S. K. Lahiri and Co. থেকে প্রকাশিত হয়। এই বইটির একটি বাংলা অনুবাদও আছে। "ইউরোপে তিন বছর" - রমেশ চন্দ্র দত্ত। কিন্তু দুটি বই একেবারে হুবহু এক নয় সেই কারণে এখানে এই ব্লগে মূলত ইংরেজি বইটিকে অনুসরণ করে লেখা হলো। ইংরেজি বইটির দ্বিতীয় সংস্করণটিতে (১৮৯০ -এ প্রকাশিত) কিছু পরিমার্জন ছাড়াও এটিতে লেখকের ১৮৭২ -এর পরবর্তী সময়ের (১৮৮৬ -র ভ্রমণকাহিনী)  ভ্রমণের কথা যুক্ত হয়েছে। ১৮৯৬ -এ প্রকাশিত তৃতীয় সংস্করণে তাঁর ১৮৯৩ -এর রাইনল্যান্ড ভ্রমণের কাহিনী যুক্ত হয়েছে। তাই ইংরেজি বইটির তৃতীয় সংস্করণের অনুসরণে ব্লগটি লিখিত হল।

রমেশ চন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯) একজন ভারতীয় সিভিল সার্ভিস অফিসার, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক এবং অনুবাদক। চাকরি থেকে অবসরের পরে তিনি ইউনিভার্সিটির কলেজ, লন্ডনে অধ্যাপনা করেছেন; ইকোনমিক ন্যাশনালিজমের উপর গবেষণা করেছেন ও বরদা রাজ্যে দেওয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সভাপতি ছিলেন, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন (১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে) সহ-সভাপতি। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। 

এই বইটি ইউরোপীয় আচার ব্যবহার সম্বন্ধে ও নানা দেশের বর্ণনা বিষয়ে কতগুলি পত্রের সারাংশ, যেগুলি লেখক বিভিন্ন সময় লিখেছিলেন। রমেশ চন্দ্র দত্ত স্টিমারে করে ৩ মার্চ ১৮৬৮ তে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন, সঙ্গী ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিবিহারীলাল গুপ্ত (দুজনেই সিভিল সার্ভিসের সদস্য ও রাজনীতিবিদ)। জলপথে কলকাতা থেকে গঙ্গা নদী হয়ে ডায়মন্ড হারবার গিয়ে মুলতান নামক স্টিমারে তাঁরা রওনা দিলেন। গঙ্গাসাগরে এসে স্টিমার নোঙর করল ও পরদিন সকালে সমুদ্রে প্রবেশ করল। গঙ্গার জল ও সমুদ্রের জল স্পষ্ট মিশে যেতে দেখা গেল। চতুর্দিকে শুধু নিবিড় নীল জল আর নীল আকাশ ছাড়া কিছু দেখা যায় না। চন্দ্রালোকিত রাতে সাদা ফেনাময় তরঙ্গ আর নক্ষত্র মালার মতো সমুদ্রকীট (বিভিন্ন সমুদ্রে কিছু জীবাণু, শৈবাল, সামুদ্রিক প্রাণী প্রভৃতির শরীর থেকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে আলো নির্গত হতে দেখা যায়) যখন সেই ফেনার উপর দেখা দেয়, তার রূপ বর্ণনাতীত। 


চার দিন পরে জাহাজ মাদ্রাজ শহরে উপস্থিত হল। লেখক মাদ্রাজের দুর্গ, পিপিলস্ পার্ক ও চিড়িয়াখানা দর্শন করলেন। জাহাজ মাদ্রাজ ছাড়ার তিন দিন পর শ্রীলংকার উপকূল দেখা গেল। শ্রীলংকার পর্বত দূর থেকে মেঘের মতো লাগছিল। লেখক সেই প্রথম পর্বত দেখলেন। 


পরের দিন সকালে জাহাজ থেকে একটি ছোট নৌকায় উঠে তাঁরা সিংহলে অবতরণ করলেন। নারকেল, বাঁশ প্রভৃতি বৃক্ষের ছায়ায় সাধারণ কিন্তু পরিচ্ছন্ন কুটির শোভা পাচ্ছে। লেখকের মনে হল বাল্মিকী যে এই দেশকে স্বর্ণলঙ্কা বলেছেন তা অত্যুক্তি নয়। তাঁরা ওয়াকওয়ালেতে (ওয়াকওয়েল্লা) গেলেন। এই স্থানের সৌন্দর্য অপরিসীম। বহুদূরে ধূসর পর্বত শ্রেণী দেখা যায়। সেখানে অ্যাডামস পিক দেখা যায়। উঁচু ও নীচু বৃক্ষশ্রেণী ঢেউ খেলিয়ে বিরাজ করছে। কাছে অনেক পরিষ্কার পথ, কৃষি ক্ষেত্র, খাল ও একটি ক্ষুদ্র একটি নদী রয়েছে। এ দেশের মানুষ বিদেশীদের কাছে বিক্রয়ের জন্য দারচিনি, হীরা, সোনা, আংটি প্রভৃতি নিয়ে এসেছে। তবে জিনিসপত্র কেনার সময় দরদাম না করলে ঠকতে হয়। তাঁরা একটি দারচিনি বাগানে ও একটি বৌদ্ধ মন্দির দর্শন করলেন। মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের অষ্টাদশ হাত মূর্তি রয়েছে। লেখক জেনে অবাক হলেন যে মন্দিরের পুরোহিত রাম-রাবণের বিষয়ে কিছু জানেন না। মন্দিরের ছায়ায় বসে লেখক অতি সুমিষ্ট নারকেলের জল পান করলেন এবং রাতে হোটেলে ইলিশ মাছ সহ অনেক সুখাদ্য উপভোগ করলেন। 

আরো দিন সাতেক চলার পরে আফ্রিকার উঁচু পর্বত শ্রেণী দৃশ্যমান হল। আরো দুইদিন পরে আফ্রিকার অ্যাডেন (ইয়েমেনে অবস্থিত) শহর দেখতে বেরোলেন লেখক ও সঙ্গীরা। নগর সৌন্দর্যবিহীন, অনুর্বর পাহাড়ে ঘেরা, গাছপালা প্রায় নেই। এখানকার কৃষ্ণকায় মানুষরা সূর্যের উত্তাপকে ভয় করে না। বালক বালিকারা লেখকের গাড়ির সঙ্গে আধঘন্টা পর্যন্ত এই রোদে দৌড়তে লাগলো। এরা সাঁতারেও পারদর্শী। লেখকদের স্টিমারের চারপাশে সাঁতার কেটে তারা ভিক্ষা চাইছিল। অ্যাডেন শহরের দুর্গ খুব সুরক্ষিত কারণ প্রস্তরময় স্থানে একটি অবস্থিত। এখানে জলাশয় দেখার মত। জল এখানে দুষ্প্রাপ্য বলে পর্বত দ্বারা ঘেরা স্থান বা প্রাচীর দ্বারা ঘেরা স্থানে বর্ষার জল এরা ধরে রাখে, সেই জল সারা বছর ব্যবহার করে। 


পরদিন অ্যাডেন ছেড়ে বাব-এল-মানডেব প্রণালীতে পৌঁছলেন। একদিকে আরব দেশীয় পাহাড়, অন্যদিকে পেরিম (ইয়েমেনের দ্বীপ) নামক ক্ষুদ্র দ্বীপ। লোহিত সাগরের জলের তলায় অনেক ক্ষুদ্র পাহাড় আছে, তাই  এই পথে সমুদ্রে জাহাজের চলাচল বিপদজনক। তারপর তাঁরা সুয়েজ উপসাগরে প্রবেশ করলেন। এখন দুই ধারে ভুমি, সমুদ্রের জল স্থির। সেই রাতে তাঁরা সুয়েজ পৌঁছলেন। বন্দরটি জাহাজ, স্টিমারের অজস্র আলোয় খুব সুন্দর লাগছিল। এবার তাঁরা মুলতান স্টিমার ত্যাগ করলেন। 

এরপর মিশর দেশের রেলগাড়িতে তাঁরা আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে চললেন। মিশরের রেলগাড়ির চলাচলে সময়ের ঠিক-ঠিকানা নেই। আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছে শহর দেখতে বেরোলেন লেখক ঘোড়ার গাড়ি করে। রাস্তাঘাট প্রশস্ত, ঘরবাড়ি বড় ও সুন্দর। একটি সুন্দর উদ্যানে পম্পির স্তম্ভ দেখলেন, ৬৫ হাত উঁচু। এই স্তম্ভের চারপাশে সুপ্রাচীন দেব-দেবীর মূর্তির ভগ্নাবশেষ রয়েছে। ৫০ হাত উঁচু ক্লিওপেট্রার স্তম্ভ দেখলেন। 


এবার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে স্টিমারে করে তাঁরা মালটা দ্বীপে পৌঁছলেন। এই স্থানের পরিষ্কার পাথরে বাঁধানো পথ, সুন্দর বাড়িঘর, সুসজ্জিত দোকান দেখলেন। এই প্রথম তিনি কোন ইউরোপীয় নগর দেখলেন। একটি উদ্যানে গেলেন, যা ফোয়ারা, সাইপ্রাস গাছ, কমলা লেবু গাছ দিয়ে সুসজ্জিত। এখানকার কমলালেবুর ভিতরটা রক্তবর্ণ এবং সেগুলি অতি সুস্বাদু। মালটার গভর্নরের প্রাসাদ, সেন্ট জন চার্চ, বীরপুরুষের সমাধিস্থান, কিছু প্রস্তর নির্মিত মূর্তি প্রভৃতি দেখে লেখকেরা আবার স্টিমারে ফিরে এলেন। 


স্টিমার মালটা দ্বীপ পরিত্যাগ করে লণ্ডন অভিমুখে যাত্রা করল। চলার পথের দূর থেকে জিব্রাল্টার পাহাড় ও জেবেল-আলতারিক (আরবী ভাষায় আল তারিখ নামক বীরের শহর) নগর দেখা গেল। ছবির মত জেবেল আল তারিখ বা তারিখের পাহাড় (জিব্রাল্টার পাহাড়) ও দুর্গ দর্শন করে তাঁরা সন্ধ্যায় স্টিমারে ফিরে এলেন। পরদিন সেন্ট ভিন্সেন্ট অন্তরীপের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে অনেক বড় পাহাড় ও একটি বাতিঘর দেখলেন। রাতে ফিনিস্টেয়ার অন্তরীপ অতিক্রম করা হলো। পরদিন ফ্রান্সের ব্রেস্ট শহরের কাছে উসান্ট অন্তরীপ দেখা গেল। দুদিন পর আইল অফ ওয়াইট নামক সুন্দর দ্বীপের কাছ দিয়ে তাঁদের স্টিমার চলল। সেখানে ভারতের মতো সুন্দর সবুজ বন, উদ্যান, শস্য ক্ষেত্র চোখে পড়ল। 


সেদিন সন্ধ্যায় (১১ ই এপ্রিল, ১৯৬৮) সাউদাম্পটন হয়ে তাঁরা লন্ডনে পৌঁছলেন। লন্ডন এক বিশাল শহর সেখানে প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষ বাস করে। বাড়িগুলি চার-পাঁচ তলা। নীচের তলাটি প্রায়শ মাটির নীচে অবস্থিত। বাড়ির বাইরের দেওয়াল ইঁটের আর ভিতরের দেওয়াল কাঠের উপরে কাগজে মোড়া। এখানে খুব বড় বড় উদ্যান আছে, সেখানে সবাই প্রবেশ করতে পারে। এগুলি আছে বলেই লন্ডন শহরের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর আছে। বাড়িগুলি শ্রেণীবদ্ধ ও খুব কাছাকাছি অবস্থিত। ঘর গুলি ছোট ছোট কারণ বাড়িগুলি শীতকালের উপযোগী করে তৈরি। গ্রীষ্মকাল স্বল্প স্থায়ী ও অস্বাস্থ্যকর। আকাশ এই সময় মেঘে ঢাকা থাকে। সব সময় বৃষ্টি হয়। কুয়াশায় চারদিক ভোরে থাকে, সূর্য প্রায় দেখাই যায় না। 


লেখক লন্ডনের নিকটে সিডেনহ্যামের ক্রিস্টাল প্যালেস দেখতে গেলেন। বিশাল কাচের তৈরি অট্টালিকা, সূর্যালোকে ঝকমক করতে থাকে। বাইরের অংশে সুন্দর উদ্যান, ফোয়ারা, লেক, মূর্তি প্রভৃতি দিয়ে সাজানো। ভিতরের চিত্রশালার ছবিগুলি বিক্রয়ের জন্য রাখা আছে।


রমেশ চন্দ্র দত্ত সেন্ট জেমস হলে বিশিষ্ট লেখক চার্লস ডিকেন্সের নিজের লেখার পাঠ শুনতে গেলেন। তাঁর পাঠের পদ্ধতি এতই চমৎকার যে সবাই মুগ্ধ হল। 


নভেম্বরে লন্ডনের পথঘাট, বাড়িঘর, উদ্যান, গাছপালা সব বরফে ঢেকে গেল। মনে হল সব যেন রুপো দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। শীতকালে লন্ডনে সূর্য দেখতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। মাঝে মাঝে বরফ পড়ে, পরিবেশ খুব শীতল ও আর্দ্র থাকে। 


সেই মাসেই লন্ডনের লেখক ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নির্বাচন দেখলেন। তিনি দেখে চমৎকৃত হলেন যে ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রের মূল স্থানে নাগরিকরা এত স্বাধীনতা সুখ ভোগ করে, যা একমাত্র আমেরিকা ছাড়া কোন দেশ করে না। 


এরপর ডিসেম্বরে এলো বড়দিন। সকালে উচ্চমাত্রায় ঘন্টার ধ্বনি শোনা ছাড়া রাস্তায় কোন উৎসবের চিহ্ন বা শব্দ পাওয়া যায় না। যা কিছু উৎসব এখানে যার যার বাড়ির মধ্যে হয়। 


এক বছর ধরে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করে লেখক পরীক্ষায় বসলেন ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজ তিনি এই পরীক্ষার প্রস্তুতি জন্য পড়েছেন এবং ওই কলেজের অধ্যাপকদের কাছে ব্যক্তিগতভাবেও পড়েছেন। অধ্যাপকরা খুব দয়ালু ছিলেন এবং তাঁরা বন্ধুর মতো লেখকের সঙ্গে মিশেছেন। বিশেষ করে ইংরাজীর অধ্যাপক মিস্টার হেনরি মর্লে, সংস্কৃতের অধ্যাপক ডক্টর থিওডোর গোল্ডস্টুকারের কথা তিনি স্মরণ করেছেন। পরীক্ষায় তিনশোর বেশি ইংরাজ ছাত্র বসেছে, যার মধ্যে শুধু পঞ্চাশ জন মনোনীত হবে। পৃথিবীর অন্যতম কঠিনতম পরীক্ষাটি এক মাসের বেশি সময় ধরে চলল। লেখকের বিষয় ছিল ইংরেজি, অংক, দর্শন ও সংস্কৃত। প্রতিটি বিষয়ে মৌখিক পরীক্ষাও দিতে হলো। এক মাস অত্যন্ত উৎকণ্ঠা সঙ্গে অপেক্ষা করার পর ফল প্রকাশ হলে দেখা গেল লেখক শুধু পাসই করেননি, তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন। তাঁর সঙ্গীরাও উত্তীর্ণ হয়েছেন এই পরীক্ষায়। 


এরপর লেখক সঙ্গীদের সঙ্গে কিছুদিনের জন্য সমুদ্রে বেড়াতে গেলেন। ইস্টবোর্ন নামক সমুদ্র শহরে সমুদ্রের শোভা উপভোগ করে লেখক পেভেন্সি ক্যাসেল দেখতে গেলেন। দুর্গটি এখন ভগ্নপ্রায়। সমুদ্রপথে আসা-যাওয়া করার সময় ফিরতি পথে তাঁরা মার্টিলো টাওয়ার দেখলেন, যেটি ইংরেজরা নেপোলিয়নের আক্রমণের ভয়ে ১৮০৪-এ তৈরি করেছিল। কেন্ট ও সাসেক্স উপকূল বরাবর এরকম দুর্গ বেশ কিছু আছে। লেখক হার্স্টমন্সকো দুর্গ নামক মধ্যযুগীয় ইংরাজ দুর্গ দেখতে গেছিলেন। তারপর সেন্ট লিওনার্ড ও হেস্টিংস শহর দেখলেন সমুদ্র তীরে। সেন্ট লিওনার্ডের 'লাভার্স সিট' একটি রোমান্টিক জায়গা, যেখানে একটি মেয়ে তার প্রেমিকের মৃত্যুতে শোকে আচ্ছন্ন হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল বলে শোনা যায়। ফেয়ারলাইট গ্লেন আরেকটি মায়াময় স্থান যা একটি লম্বা ছায়াচ্ছন্ন পথ। হেস্টিংস দুর্গ একটি ত্রিকোণ ছোট পাহাড়ের উপর সমুদ্রের ধারে অবস্থিত দুর্গ। লন্ডনে ফেরার পথে উইলিয়াম, দ্য কংকারারের তৈরি অ্যাবে দেখলেন তাঁরা। 


পরবর্তী দ্রষ্টব্য স্থান মাদাম তুসোর মিউজিয়াম, যেখানে একেবারে জীবন্ত রূপের মোমের মূর্তি রাখা আছে। অনেকবার লেখক মূর্তিকে সত্যি মানুষ ভেবে ভুল করলেন। যন্ত্রের সাহায্যে মূর্তিগুলোর মাথা, অঙ্গ নাড়ানো যায়। 'চেম্বার অফ হররে' বীভৎস খুনি ও অপরাধীদের মূর্তি দেখে শিহরিত হলেন। 


এরপর একদিন লেখক গেলেন ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে। সেখানে ইংল্যান্ডের সম্রাট, যোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, কবি, লেখকদের সমাধিস্থল ও প্রস্তর নির্মিত প্রতিমূর্তি দেখে আনন্দিত হলেন। যাঁরা ইংল্যান্ডের ইতিহাস, কাব্য, সাহিত্য পড়েছেন তাঁরা এই স্থান দেখে মুগ্ধ হবে। 


এরপর একদিন লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা লন্ডন থেকে ট্রেনে রিচমন্ড এসে টেমস নদীতে নৌকায় আলেকজান্ডার পোপের (ইংরেজ কবি) টুইকেনহ্যাম দেখে টেডিংটন পর্যন্ত গেলেন। এই স্থানে টেমস নদী অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। দুপাশের গাছে বসন্তের প্রভাবে পরম রমণীয় রূপ। 


ইংল্যান্ডে বসন্ত খুব সুন্দর আবহাওয়া, সূর্যালোকিত দিন, গাছে নতুন পাতা, ফুল, ও পাখির ডাকে ভরা। ভারতের থেকে ইংল্যান্ডে শীতের পরে বসন্তের আগমন অনেক বেশি নজর কাড়ে কারণ ভারতের শীত অনেক বেশি আকর্ষণীয়। টেমস নদীর দুধারে সবুজ ঘাস জমি, চেস্টনাট গাছ, সুন্দর ঝোপঝাড় সহ অপূর্ব রূপ নিয়েছে। টেডিংটন থেকে এক সুন্দর রাস্তায় পায়ে হেঁটে ঘন্টাখানেকে এল হাম্পটন কোর্ট (রাজা অষ্টম হেনরির প্রাসাদ)। তাঁরা প্রাসাদের রাজকীয় কক্ষগুলি, সভাঘর দেখলেন, অনেক সুন্দর পেইন্টিং দেখলেন প্রতিটি ঘরে। লন্ডনে টেম্পল বার, যা এখন কেশচর্চার স্থান, একসময় সেটিও রাজা অষ্টম হেনরির প্রাসাদ ছিল।

                      (চলছে)

মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৪

৫৪। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৮ ভোলানাথ চন্দ্র

 

   

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                     (আগের পর্বের পরে)

মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেব শিল্প, সাহিত্য, গান, বাজনা, স্থাপত্য সবকিছুর প্রতি বিরূপ ছিলেন। এমনকি নিজের সমাধি তৈরিতেও তিনি অর্থ ব্যয় করতে চাননি। একমাত্র দিল্লি দুর্গের মতি মসজিদ তিনি তৈরি করেছিলেন। 


আওরঙ্গজেবের এক অবিবাহিতা কন্যা জিনাতউন্নেসা, জিনাত মসজিদ বা কুমারী মসজিদ তৈরি করিয়েছিলেন, যা দরিয়াগঞ্জের কাছে যমুনার তীরে অবস্থিত (এটি ঘাটা মসজিদ নামেও বর্তমানে খ্যাত)। শাহজাহানের কন্যা রোশেনারার তৈরি উদ্যান (রোশনারা উদ্যান) আরেকটি মুঘল রাজকন্যার তৈরি দর্শনীয় স্থান। শাহজাহানের পুত্র দারার প্রাসাদ দেখার মত ছিল। সেই প্রাসাদে পরে দিল্লির কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। 

দিল্লির রাজপুরুষ বা অভিজাতদের অনেকের সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ ছিল দিল্লিতে। জয়পুরের রাজা জয় সিং যন্তর মন্তর তৈরি করেছিলেন দিল্লিতে, যা জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার স্থান, যেরকম বেনারসের মান মন্দির আর লখনৌ-এর তারা কোঠি। দিল্লি আর আগ্রার মাঝামাঝি স্থানে, তাজমহলের ধাঁচে যে বিশাল সৌধটি রয়েছে সেটি সফদরজঙের মাজার বা সমাধি (সফদরজং ছিলেন অযোধ্যার নবাব)। শ্বেত পাথর ও লাল ও গোলাপি বেলে পাথরের তৈরি সৌধটি তাঁর পুত্র অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার তৈরি। এর পাশেই এক মুঘল অভিজাত ব্যক্তি গাজী উদ্দীন খানের সমাধি রয়েছে। গাজী উদ্দিন খানের নামাঙ্কিত একটি মাদ্রাসা আজমিরি গেটের কাছে বহু বছর ছিল। 


এর পরবর্তীকালে নাদির শাহের ভারত আক্রমণের ঘটনা ঘটে। সেই লুণ্ঠন, ধ্বংসলীলা চলে ৫৮ দিন ধরে, ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে, যা কয়েক'শ বছরের সৃষ্টিকে তছনছ করে দিল। তারপর আহমদ শাহ দুরানি ১৭৪৮ থেকে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট আটবার ভারত আক্রমণ করেন। তারপর আফগান নেতা গোলাম কাদির ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাদশা শাহ আলমকে পদচ্যুত করে ও অন্ধ করে আড়াই মাস যাবত দিল্লি দখল করে রাখেন ও লুণ্ঠন চালান। ফলে মুঘল স্থাপত্য আর নতুন করে সৃষ্টিও হয় না, পুরনো কিছু স্থাপত্যও অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়। 


এবার লেখক দিল্লি ইনস্টিটিউট (এই বাড়িটির বর্তমান নাম জানতে পারা যায় না বা আদৌ এটির অস্তিত্ব আছে কিনা তাও জানা যায়নি) দেখতে গেলেন। ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই বাড়িতে বহির্গাত্র লাল পাথরের গুঁড়ো দিয়ে সজ্জিত, যাতে পাথরের মতো দেখতে লাগে। দিল্লি ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গনে স্টেশন-লাইব্রেরি, গভর্নমেন্ট কলেজ ও মিউজিয়াম অবস্থিত। লাইব্রেরী রয়েছে বাড়িটির এক তলার পশ্চিম কোণে। সিপাহী বিদ্রোহের আগে এই লাইব্রেরীতে নয় হাজার বই ছিল। 


লেখকেরা এবার মিউজিয়ামে গেলেন, যেটি পাশের একটি হলে রয়েছে। হলে ঢোকার পথে দুটি লাল পাথরের ভাঙ্গা মূর্তি চোখে পড়ে। মূর্তি দুটির কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত রয়েছে। তার মধ্যে একটি মাথা নেই, অপরটির নাক ভাঙ্গা। লেখকের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এই দুটি সেই জয়মল ও পুত্তের মূর্তি। জিজ্ঞাসা করে গাইডের কাছে জানলেন মূর্তি দুটি হাতির পিঠে বসানো ছিল। হিন্দু পোশাক ও রাজপুত পাগড়ী দেখেও মূর্তি দুটি কাদের অনুমান করা যাচ্ছিল। যে মূর্তির মাথা রয়েছে সেটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের। তাই লেখক বুঝতে পারেন সেটি জয়মলের। কারণ চিতোর দুর্গ অবরোধের সময় পুত্তের বয়স ছিল মাত্র ষোলো। (উইকিমিডিয়া থেকে পাওয়া যায় একটি ছবি যেটি এখানে দেওয়া হল। সেটি উনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে জোসেফ ডেভিড বেগলারের তোলা। ছবিটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কালেকশন থেকে পাওয়া। একটি অজ্ঞাত পরিচয় বাড়ির দরজার সামনে পাথরের মূর্তি দুটি রয়েছে। অর্থাৎ এই সেই দুটি মূর্তি যা লেখক দেখেছিলেন। লেখক যখন দেখেছিলেন তখন একটি মূর্তির মাথা শরীরে ছিল না। উইকিমিডিয়ায় পাওয়া ছবিটি দেখে মনে হচ্ছে একটি মূর্তির মাথা পরবর্তীকালে লাগানো হয়, যেটি পুত্তের মূর্তি। তারপরে ওই দুটি মূর্তি কোথায় গেছে তা জানা যায়নি। হাতির মূর্তি দুটি লালকেল্লার দিল্লি দরওয়াজাতে লর্ড কার্জন বসিয়েছিলেন, সে দুটি সেখানেই আছে)। 



মিউজিয়ামের ভিতরের গ্যালারিতে ব্রিটিশ ভারতের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির ছবি রয়েছে। একজন হিন্দু রাজার ছবি ছিল যিনি সিপাহী বিদ্রোহের জন্য বিখ্যাত। সেই কালো মারাঠা রাজার মনি মুক্ত খচিত সাজ পোশাকে সজ্জিত ছবি রয়েছে গ্যালারিতে (এটি নিঃসন্দেহে নানা সাহেবের ছবি)। মিউজিয়ামে কৃষি, প্রাণিবিদ্যা, প্রত্নবিদ্যা, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিভাগ আছে। বিভিন্ন সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ আছে। অনেক আরবি ফারসি পাণ্ডুলিপিও দেখলেন। দু-একটি পান্ডুলিপিতে সোনার হরফ ব্যবহার করা হয়েছে। দিল্লি ইনস্টিটিউটের পূর্ব দিকে সরকারি কলেজ অবস্থিত। লেখক এবার তাঁর অভিমত দেন যে বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে, জনমত গঠনের দিক থেকে, জনসভা-বক্তৃতা-সংবাদপত্রে সামাজিক সংস্কারের যে প্রভাব কলকাতায় পড়েছে, তার থেকে দিল্লি অনেক পিছিয়ে আছে। এমনকি দিল্লির কলেজের অঙ্ক বিভাগের বাঙালি অধ্যাপককেই আগামী দরবারে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। 



ইনস্টিটিউট সংলগ্ন অংশে রয়েছে রানীর (ইংল্যান্ডের রানীর) উদ্যান। উদ্যান খুব বড় না হলেও তা ইউরোপীয় রুচি ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় দেয়। উদ্যানে মোগল যুগের একটি লম্বাটে শ্বেত পাথরের স্নানে চৌবাচ্চা দেখলেন যেখানে হাঁসের বাচ্চারা খেলা করে। এখানকার দরজার কাছে, জয়মলের হাতিটি রাখা আছে (যেটি পরবর্তী কালে দিল্লি গেটে বসানো হয় আর একটি সঙ্গে)। বাগানের মধ্যে দিয়ে আলীমর্দানের (এক মুঘল প্রাদেশিক শাসক) তৈরী খাল বয়ে গেছে। এই খাল থেকে দিল্লী বাসীরা, পানীয় ও বাগানে দেওয়ার জল পায়।


উইকিমিডিয়া থেকে নেওয়া জোসেফ ডেভিড বেগলারের তোলা ছবি



লেখকেরা ভালো সময় দিল্লি এসেছিলেন কারণ সামনে ছিল দেওয়ালি। ঝকমকে দোকানবাজার, লাল-নীল-সবুজ লন্ঠন, প্রদীপ, কাঁচের বাতিদান, মোম ইত্যাদির আলোতে সাজানো শহরে, নতুন পোশাকে সজ্জিত মানুষজন সবাই নাচে, গানে, আমোদে মেতে উঠল। দিল্লি শহরে দিল্লিকা লাড্ডু ছাড়াও নানা রকম মিষ্টি বিক্রি হতে থাকলো। মিষ্টির দোকানে মন্দির, মসজিদ এমনকি মিষ্টির তৈরি দুর্গ বিক্রি হচ্ছে দেখলেন লেখক। নানা রকম পুতুল আর খেলনাও বিক্রি হচ্ছিল। মুসলমানেরা হিন্দুদের উৎসব পুরো দমে উপভোগ করছিল। এখানকার হিন্দুরা লক্ষ্মী পূজা করে সেদিন বাংলার মতো। মহিলারা নিগমবোধ ঘাটে গঙ্গাস্থানে যায়। চাঁদনী চকের বাড়ির বারান্দায় উজ্জ্বল ভাবে সজ্জিত বাইজিদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তাঁরা। 


এরপর এল তৎকালীন ভাইসরয়ের আগ্রা দরবার অনুষ্ঠান, যেটি আগ্রা দুর্গে অনুষ্ঠিত হবে। লেখক আগ্রাতে গিয়ে সেটি দর্শন করেন। মুঘল দরবারের অনুকরণে এটি সংঘটিত হবে। দরবার কক্ষ সাজানো হয়েছে দামি কানাত, পর্দা, চাকচিক্যময় সামিয়ানা, সাজসজ্জা, নরম পারস্যের গালিচা দিয়ে। লেখক ভাইসরয়ের দরবারের সঙ্গে প্রাচীন হিন্দু রাজাদের রাজসূয় যজ্ঞের তুলনা করেছেন। এখানে দেশীয় রাজারা, নবাবরা, প্রাদেশিক ইংরাজ শাসনকর্তারা, সামরিক ও অসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা সাংবাদিকরা এবং জ্ঞানীগুণী মানুষজন নিমন্ত্রিত হয়েছেন। জয়পুরের রাজা, সিন্ধিয়ারাজ, ভরতপুরের রাজা, ভূপালের বেগম উপস্থিত ছিলেন। বৃত্তাকার জমিতে হাজার হাজার মানুষ, হাতি, ঘোড়া, উট, মহিষ, গাড়ি, এক্কা জমা হয়েছে। অস্থায়ী খাবারের দোকান হয়েছে প্রচুর। কুড়ি টাকা মাসিক ভাড়ার ঘরের এখন ভাড়া হয়েছে ৩০০ টাকা। একদিনে একটি ঘরের ভাড়া লাগছে পাঁচ টাকা করে। গাড়ি পাওয়াও দুষ্কর হয়েছে। 



ভাইসরয় লর্ড জন লরেন্সের আগমন দেখার মত। রাস্তার দু'পাশের বাড়িগুলির জানলা, বারান্দা, ছাদ দর্শকে ভরে গেছে। পুলিশ ভিড় সামলাচ্ছে। সেনাবাহিনী নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। গভর্নর জেনারেল ট্রেনে এসে দিল্লী পৌঁছলেন। সেখানে নৌকার পুল রাজকীয় ঘোড়ার গাড়িতে পার হয়ে, তিনি ঘোড়ার পিঠে আগ্রায় এলেন। লেডি লরেন্স নৌকায় আগ্রায় গেলেন। ভাইসরয়-কে আগ্রা দুর্গের প্রাচীর থেকে মিলিটারি কায়দায় স্যালুট দেওয়া হল। একপাশে একজন কমান্ডার-ইন-চিফ ও অন্য পাশে একজন মহারাজাকে নিয়ে তিনি দরবার প্রাঙ্গনে যান। 


সাত দিন ধরে দরবার সংক্রান্ত মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে ভাইসরয় নাইটহুড প্রদান করেন। বিভিন্ন রাজাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করেন। এক সন্ধায় তাজে আলো দিয়ে সাজানো হয়। হাজার হাজার রঙবেরঙের লন্ঠনের আলোয় আর ফোয়ারায় সজ্জিত রাতের তাজ অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ তৈরি করে। পাঁচ হাজারের বেশি বিশিষ্ট মানুষ উজ্জ্বল, সুরচিকর পোশাকে সজ্জিত হয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যমুনা নদীর পাড় আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। দু-তিন মাইল ব্যাপী নদীর জলে আলোর প্রতিফলন পড়ে মনে হচ্ছিল সমুদ্রে তারার ছায়া পড়েছে। ২০ নভেম্বর, ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ভাইসরয়ের আগ্রা দরবার অনুষ্ঠিত হয়। 



এই ঐতিহাসিক দরবার দর্শনের সঙ্গেই শেষ হয় লেখক ভোলানাথচন্দ্রের ভ্রমণ এবং শেষ হয় তাঁর দুই খন্ডে লেখা বই "দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ইন ভেরিয়াস পার্টস অফ বেঙ্গল এন্ড আপার ইন্ডিয়া"।

বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৪

৫৩। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৭ ভোলানাথ চন্দ্র

 

  

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

কুতুবমিনার প্রাঙ্গণ থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে লেখক সিরি বা আলাই দুর্গ দেখলেন। সুলতান আলাউদ্দিন দুর্গটি তৈরি করেছিলেন। এখানে হাজার স্তম্ভের প্রাসাদ ছিল কিন্তু সিরি বর্তমানে ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে। শেরশাহ এই দুর্গের প্রাচীর ভাঙ্গিয়ে এখানকার পাথর ব্যবহার করে শের-ই-গড় বা শের মন্ডল তৈরি করান। সিরির কাছে রয়েছে রওশন চিরাগ যা ফিরোজ শাহ কর্তৃক নির্মিত রওশন চিরাগ নামক মুসাফিরের সমাধি। 


পরবর্তী গন্তব্য তুঘলকাবাদ। ভারতে মুসলমান আমলে তৈরি দুর্গগুলির মধ্যে তুঘলকাবাদ শ্রেষ্ঠ। এটি ১৩২১ থেকে ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়। লালকোট বা সিরি দুর্গের মত বিশালত্ব এখানে না থাকলেও এই দুর্গের নিরাপত্তার রক্ষার যে আয়োজন তা প্রশংসনীয়। এখানে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সমাধি রয়েছে, যা তাঁর পুত্র মোহম্মদ বিন তুঘলক তৈরি করিয়েছিলেন। তুঘলাকাবাদের কাছে অবস্থিত একটি ছোট দুর্গ মোহামুদাবাদ, যেটি মোঃ বিন তুঘলকের তৈরি সেটিও দেখলেন। 


তারপর তাঁরা দেখলেন জাহানপানাহ্, যা মুঘলদের ক্রমাগত আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য মোহম্মদ বিন তুঘলকের সৃষ্ট আরেকটি শহর। বর্তমানে ধ্বংসস্তুপে পরিণত এই শহরে একসময় সাতটি দুর্গ ও ৫২ টি দরজা ছিল। হুমায়ুনের সমাধির কাছে নীলাবুর্জ বা নীল সমাধি বলে একটি সুন্দর স্থাপত্য আছে। হয়ত কোন মুসলমান ধর্ম গুরুর সমাধি এটি। এর চকচকে নীল টালির কাজ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর দুই তিন মাইল পশ্চিমে রয়েছে তীর বুর্জ নামে তিনটি সমাধি। ছোটা খান, কালা খান ও বড়া খানের সমাধিগুলি লাল বেলে পাথরের তৈরি। লোদী স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই সমাধিগুলি এখন ধ্বংসের পথে। 


এরকম শয়ে শয়ে স্থাপত্য ছড়িয়ে রয়েছে অবহেলিত ভাবে দিল্লির এখানে ওখানে। লেখক নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধি দেখলেন। গুরু নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধির পাশে তাঁর শিষ্য ও মহান কবি আমীর খুসরুর সমাধি রয়েছে। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধি তথা দরগার কাছেই শাহজাহান কন্যা জাহানারা সমাধি। তাঁর সমাধিতে লেখা আছে শাহজাহানের কন্যা  ও পবিত্র মানব নিজামুদ্দিন চিস্তির শিষ্যা ফকিরা জাহানারা বেগমের সমাধি এটি। তাঁর শেষ ইচ্ছামত তাঁর সমাধির মাথা খোলা রাখা হয়েছে। তারপর দেখলেন জামাতখানা মসজিদ। এর মধ্যে উপরের ডোম থেকে ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দের একটি ঘন্টা ঝুলছে। তাঁরা নিজামুদ্দিনের কুয়ো দেখলেন, ১৩২১ খ্রিস্টাব্দে তৈরি। 


এরপর তাঁদের গন্তব্য ফিরোজাবাদ বা সুলতান ফিরোজ শাহের তৈরি শহর। ফিরোজ শাহের প্রাসাদ ও দুর্গকে ফিরোজ শাহ কোটলা বলা হয়। এখানের জামি মসজিদটি দিল্লির সবথেকে বড় মসজিদ ছিল কিন্তু এখন রয়েছে তার সামান্য ধ্বংসাবশেষ। বর্তমান মসজিদের পাশে একটি পাথরের স্তম্ভ আছে, যেটির সম্পর্কে নানা রকম কাহিনী প্রচলিত। কিন্তু ইউরোপীয় পণ্ডিত জেমস প্রিন্সেপ এর গায়ের লিপির পাঠ করেছেন ও এটিকে অশোকের স্তম্ভ লিপি বলে পরিচয় দিয়েছেন। এটি ফিরোজ শাহ খিজরাবাদ থেকে এখানে আনিয়ে স্থাপন করান। সিরাত-ই-ফিরোজশাহী নামে ফিরোজ শাহের জীবনী গ্রন্থে এই স্তম্ভকে মিনার-ই-জারিন বা স্বর্ণস্তম্ভ বলা হয়েছে। এই স্তম্ভের গায়ে সম্রাট অশোকের ধর্ম প্রচারের বাণী ছাড়াও অন্যান্য কিছু লিপি খোদিত আছে। দ্বিতীয় লিপিটিতে চৌহান রাজা বিশাল দেবের হিমাদ্রি থেকে বিন্ধ্য পর্যন্ত জয়ের কথা লেখা, ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দে। এছাড়া গুপ্ত প্রভৃতি যুগের কিছু লিপিও আছে স্তম্ভের গায়ে। শেষ লিপি আছে ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইব্রাহিম লোদীর নামে। ফিরোজ শাহ মিরাট থেকে আরেকটি অশোক স্তম্ভ আনিয়ে ছিলেন ও সেটি তার কুশক শিকার প্রাসাদ (এটি বর্তমান তিন মূর্তি ভবনের ভিতরে অবস্থিত) প্রাঙ্গনে স্থাপন করিয়েছিলেন। এটি ফারুকশিয়ার বাদশাহ থাকার সময় কামানের গোলায় ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে। কালাম মসজিদ তুর্কমান গেটের কাছে অবস্থিত ১৩৮৭ তে তৈরি  মসজিদ। কালান বা বড় মসজিদ নামে খ্যাত মসজিদটি ফিরোজ শাহ তুঘলকের আরেকটি স্থাপত্যের নিদর্শন। এই মসজিদে তাইমুর উপাসনা করতে এসেছিলেন দিল্লি আক্রমণ করে ফেরার দিন। ফিরোজ শাহের শাসনকালে খান-ই-জাহান (ফিরোজশাহের প্রধানমন্ত্রী) খিড়কি নামে মসজিদ, দুর্গ ও গ্রাম তৈরি করেছিলেন। মসজিদটি বিশালাকার জালির কাজ যুক্ত করা খিড়কি যুক্ত। এর নিকটে সাতটি খিলানযুক্ত সাতপুল্লা বাঁধ ফিরোজ শাহের নির্মিত (উইকিপিডিয়ায় বলা আছে এটি মোহাম্মদ বিন তুঘলকের আমলে তৈরি)। ফিরোজ শাহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে সবথেকে মহান কাজ হল যমুনা উপত্যকার কাটা সেচের খালগুলি। ফিরোজশাহ কোটলা এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত কিলা রাই পিথোরা বা তুঘলকাবাদেরই মত। কুতুব থেকে ৪-৫ মাইল দূরে হাউস খাস হলো ফিরোজ শাহের সমাধিস্থল। এই সুলতান এত পাঠান স্থাপত্য নিদর্শন রেখে গেছেন কিন্তু তাঁর সমাধি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে এখানে যে সমাধিটি রয়েছে তা হয়তো পরবর্তীকালে পুনর্গঠন করা হয়েছে সস্তা উপকরণ দিয়ে। 


ফিরোজ শাহের রাজত্বকালের পর (১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ) তেমন কোন স্থাপত্য হয়নি সুলতান তুঘলক সাম্রাজ্যকালে। এরপর তাইমুরের ভারত আক্রমণের ফলে দিল্লির বহু স্থাপত্য ধ্বংস হয়ে যায়। লোদী বংশের বহলুল লোদীর সমাধি, সিকান্দার লোদীর সমাধি (সফদরজাং -এ) ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। 


এরপর পরবর্তীতে দিল্লিতে স্থাপত্যের কাজ হয় মোগল বাদশাহ হুমায়ুনের আমলে। তিনি পুরানা কিল্লার সংস্করণ করে তার নাম রাখেন দীন-পানাহ্। শেরশাহ দীন-পানাহের নাম পরিবর্তন করে রাখেন শের-ই-গড়। তারপর শেরশাহের পুত্র সেলিম শাহ সেলিম গড় প্রতিষ্ঠা করেন। হুমায়ুন পুনরায় ক্ষমতায় এসে যার নাম দেন নূর গড়। সেলিম গড় ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। 


দিল্লিতে মোগল আমলের প্রথম কীর্তি আজও যা রয়েছে তা হুমায়ুনের সমাধি। এই সমাধি আকবরের মা হামিদা বানু বেগমের নির্দেশে তৈরি হয়েছে। সমাধিটির শ্বেত পাথরের ডোম দূর থেকে দেখা যায়। সমাধির চারদিকে ফুলে ভরা সুন্দর বাগানটি হেঁটে বেড়ানোর জন্য খুব মনোরম। এই সমাধির বাম পাশে তাঁর পত্নী হামিদা বানুর সমাধিও রয়েছে। সিপাহী যুদ্ধের শেষে ব্রিটিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাহাদুর শাহ জাফর (শেষ মুঘল বাদশাহ্) হুমায়ুনের সমাধিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ব্রিটিশদের কাছে ধরা পড়ার আগে। হুমায়ুনের সমাধি চত্বরে আরো কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। যেমন - মোবারক খান খানানের সমাধি (ইনি বাবরের জীবনী তুর্কি থেকে পারসিতে অনুবাদ করেন); ঈশা খানের মসজিদ (ইনি শেরশাহের এক অভিজাত সভাসদ ছিলেন); তাগাহ্ খানের সমাধি (আকবরের প্রধানমন্ত্রী)। মোগল স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন ৬৪ খাম্বা বা ৬৪ পিলার বিশিষ্ট হল। এটি তাগাহ খানের পুত্র খান-ই-আজিম তৈরি করিয়েছিলেন। পুরানা কিলার কাছে অবস্থিত লাল বাংলো ও কালা মহল দুটি মুঘল স্থাপত্যের নমুনা। 


আকবর রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার পরে শাহজাহান আবার রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লিতে আনেন। যে নগর শাহজাহান তৈরি করেন, তার নাম দেন শাহাজানাবাদ। বর্তমানে এটি পুরাতন দিল্লি নামে খ্যাত। প্রাচীরে ঘেরা এই নগরে ঢোকার অনেকগুলি দরজা (কাশ্মীরি দরওয়াজা, কাবুল দরজা, তুর্কমান দরওয়াজা, দিল্লী দরওয়াজা, ফরাসখানা দরওয়াজা, রাজঘাট দরওয়াজা আর কলকাতা দরওয়াজা) ছিল। কলকাতা দরওয়াজা থেকে রাজপথ ও রেল স্টেশন যেতে হয়। 


দিল্লি গেট দিয়ে শহরে ঢুকলে প্রথমে চাঁদনী চক আসে। রাস্তার দু'ধারে এখানে অসম্ভব জাঁকজমকপূর্ণ দোকান রয়েছে। এখানে যা পাওয়া যায় কলকাতায় তা পাওয়া যায় না। চাঁদনী চকের কাছেই রয়েছে অবশ্য দর্শনীয় জুম্মা মসজিদ। তাজমহলের পরেই ভারতের সবচেয়ে চমৎকার মহল এটি। এটি দিল্লির উচ্চতম মহল ও দিল্লির সব জায়গা থেকে এই মসজিদ দেখতে পাওয়া যায়। জুজুলা পাহাড় নামক ৩০ ফুট উঁচু ঢিপির ওপর অবস্থিত এই জুম্মা মসজিদ। পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ এখানে একসঙ্গে প্রার্থনা করতে প্রার্থনা করতে পারে। 


পরবর্তী গন্তব্য দিল্লি দুর্গ যা শাহজাহানের কীর্তি। উঁচু লাল রঙের প্রাচীরে ঘেরা (যমুনা নদীর দিকে প্রাচীর নেই) দুর্গের দরওয়াজা দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমে দেখলেন দেওয়ান-ই-আম বা জনসাধারণের সঙ্গে বাদশাহ্ -এর দেখা করার জায়গা। আগ্রা দুর্গের থেকে এই দুর্গের দেওয়ান-ই-আম আকারে বড়। লাল পাথরের পিলার ও কারুকার্যময় দেওয়ান-ই-আমের দেওয়াল এখন সাদা চুনকাম করা হয়েছে। এটি এখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আস্তানা। শ্বেত পাথরের যে সিংহাসনটি এখানে আছে বলে লেখক শুনেছিলেন, সেটি তাঁকে দেখতে দেওয়া হলো না। এরপর তাঁরা এলেন দেওয়ান-ই-খাসে। এটি ১৫০ ফুট লম্বা, ৪০ ফুট চওড়া, শ্বেত পাথরের স্তম্ভ বিশিষ্ট হল। এই ভবনের মূল্যবান যেসব কারুকার্য ছিল সেসব আর নেই। এখানে একসময় ছিল শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন। অপূর্ব কারুকার্য করা, অগণিত মনি মানিক্য খচিত ময়ূর সিংহাসন, বার্নিয়েরের বর্ণনায় যার হদিশ পাওয়া যায়, সেটি নাদির শাহ লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে। লেখক দেখলেন বেগমদের মহল - রংমহল, মতি মহল। কিন্তু তাঁর মনে হলো সেগুলি বিশেষ কিছু নয়। আসলে বার্নিয়ের প্রমুখের বর্ণনা অনুসারে জানতে পারা সমস্ত প্রাচুর্য বিনষ্ট বা লুণ্ঠিত হয়েছে, সোনা রুপা মূল্যবান পাথর চুরি হয়ে গেছে, শুকিয়ে গেছে ফোয়ারা, ভেলভেট মসলিন প্রভৃতির সাজ বিনষ্ট হয়েছে; পড়ে আছে শুধু পাথরের কাঠামোটুকু। এরপর লেখক বাদশাহের স্নানাগারে গেলেন, যেটি একটি শ্বেত পাথরের ডোম বিশিষ্ট বড় মহল, যেখানে রঙিন কাঁচের জালনা, ফোয়ারা, গরম জল-ঠান্ডা জল আসার নানা রকম ব্যবস্থা, বড় স্নানের চৌবাচ্চা প্রভৃতি রয়েছে। এবার দ্রষ্টব্য তসবীর মহল বা ছবির গ্যালারি। কিন্তু সেখানে কোন ছবি তখন ছিল না। দেওয়ালে সাদা চুল কাম করা হয়েছে। মতি মসজিদ, বাদশাহের উপাসনাগার, এখন অবহেলিত ও হতশ্রী অবস্থায় আছে। এটি বাদসাহ আওরঙ্গজেব তৈরি করিয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের কামানের গোলায় মসজিদের ক্ষতি হয়েছে, সারাইয়ের কাজ চলছে। শাহবাগ বা রাজকীয় উদ্যান যা একসময় অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী ছিল, তা এখন নোংরা, ভগ্ন প্রায় ও পরিত্যক্ত মনে হলো লেখকের। দিওয়ানখানা ও হারেমের কাঠামো ছাড়া আর কিছু এখানে চোখে পড়ে না।  ফোয়ারাগুলি শুকিয়ে গেছে। 


আগে দিল্লি দরওয়াজা-তে দুটি হাতির পিঠে যোদ্ধার মূর্তি ছিল। এই মূর্তি দুটি রাজপুত বীর জয়মল ও পুত্তের স্মৃতিতে আকবর তৈরি করিয়েছিলেন এবং আগ্রা দুর্গের দরজায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শাহজাহান এই দুটি মূর্তি আগ্রা থেকে এনে দিল্লী দুর্গে রাখেন। আওরঙ্গজেব এটিকে পৌত্তলিকতা ভেবে অন্যত্র সরিয়ে দেন। এখন মূর্তি দুটি অন্যত্র বসানো হবে বলে লেখক শোনেন। (পরে শুধু হাতির মূর্তি দুটি দিল্লি গেটে বসানো হয়। জয়মল ও পুত্তের মূর্তি-দুটি কোথায় আছে তা জানা যায় না)।


                      (চলছে)

৫২। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৬ ভোলানাথ চন্দ্র

 

   

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                     (আগের পর্বের পরে)


লেখক ভোলানাথ চন্দ্রের মতে খ্রীষ্টপূর্ব আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইন্দ্রপ্রস্থ রূপে জন্ম নিয়েছিল দিল্লি শহর। মহাভারতের যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যে পাঁচটি গ্রাম বা প্রস্থ বা পাট চেয়েছিলেন সেগুলি হল পানিপথ, ইন্দ্রপাট, তিলপাট বাঘপাট ও সোনপাট (সোনিপাট)। এর মধ্যে ইন্দ্রপ্রস্থ বা ইন্দ্রপাটে যুধিষ্ঠির তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। 


পুরানা কেল্লা বা লালকোট যুধিষ্ঠিরের তৈরি রাজধানী শহরের ধ্বংসস্তূপে বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠা ও ধ্বংস হওয়া প্রাসাদ, ঘরবাড়ির বর্তমান ধ্বংসাবশেষ। বর্তমানে পুরানা কেল্লায় মুসলমান যুগের স্থাপত্যই চোখে পড়ে, যুধিষ্ঠিরের আমলের কোন স্থাপত্যের চিহ্ন এখন নেই। (উইকিপিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে, খনন কার্যের ফলে পুরনো কেল্লাতে খ্রীষ্টপূর্ব এক হাজার বছর আগের বসবাসের চিহ্ন মাটির পাত্র পাওয়া গেছে। এখানে ক্রমান্বয়ে মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, রাজপুত, সুলতান, মুঘল যুগের বসবাসের চিহ্ন পাওয়া গেছে)। ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রথমে কেল্লাটিকে যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপ্রস্থ বলেছিলেন। যদিও তিনি বলেন বর্তমান প্রাসাদ মুসলমান শাসকদের তৈরি। 


বর্তমানে পুরানা কেল্লায় দর্শন দর্শনীয় স্থান এবার দেখলেন লেখক। প্রথমে কিলা কোনা মসজিদ যার নির্মাণ হুমায়ুন শুরু করেছিলেন আর শেরশাহ শেষ করেন। খিলান, নীল টালি, মার্বেল ইত্যাদি আফগান বৈশিষ্ট্য সম্বলিত মসজিদ এটি। কিন্তু মসজিদটি এখন ভগ্নপ্রায়। শের-ই-মন্ডল আরেকটি দর্শনীয় স্থান। এই তিনতলা, আটটি কোণা বিশিষ্ট, লাল পাথরের বিশাল প্রাসাদটি শেরশাহ তৈরি করেছিলেন। সিংহাসন পুনর্বার অধিকার করার পর হুমায়ুন এটি পাঠাগার হিসাবে ব্যবহার করতেন। এর ভিতরে সুন্দর কারুকার্য ছিল, যার সামান্যই এখন অবশিষ্ট আছে। এই ভবনেই হুমায়ুন সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে হুমায়ুন প্রাণ হারান। 


দিল্লি ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে মাইল পাঁচেক দূরে অবস্থিত। দিল্লির প্রাচীনতম স্থাপত্য অশোক স্তম্ভ। তারপর প্রাচীনতার দিক থেকে আসে লৌহ স্তম্ভ। মিশ্র ধাতুর তৈরি ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ও ৬০ ফুট উচ্চতার লৌহ স্তম্ভটির ২২ ফুট মাটির উপরে আছে আর বাকী অংশ মাটির তলায় অবস্থিত। এত প্রাচীনকালে এত বড় ধাতুর স্তম্ভটি ঢালাই এর কাজ বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তাছাড়া স্তম্ভে কোন মরচে ধরে নি এখনও। স্তম্ভটির গায়ে সংস্কৃত লিপিতে লেখা আছে। এটি রাজা ধবের (উইকিপিডিয়ার মতে রাজা চন্দ্র) কীর্তি স্তম্ভ, তিনি বিষ্ণুর উপাসক, যিনি সিন্ধুর বাহ্লিক দমন করেছেন ও সমগ্র পৃথিবী শাসন করেছেন। রাজা ধবের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। লিপির বৈশিষ্ট্য দেখে গুপ্ত যুগের লিপি বলে মনে হয়। হয়তো গুপ্ত পরবর্তী যুগে লেখা এটি। স্তম্ভের গায়ে আরেকটি লিপিতে লেখা আছে ১১০৯ সম্বত অর্থাৎ ১২৫২ খ্রিস্টাব্দে অনঙ্গ পাল দিল্লি শাসন করেছেন (তোমারা সাম্রাজ্যের বংশের প্রতিষ্ঠাতা অনঙ্গ পাল)। হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত আছে এই লৌহ স্তম্ভ পান্ডবদের তৈরি। স্তম্ভ মাটির তলায় এত গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত যে তা বাসুকি নাগের মাথায় বসানো আছে। এক তোমারা রাজা পরবর্তীকালে স্তম্ভটি তুলতে গেলে ভূগর্ভ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে এবং স্তম্ভটি আলগা বা ঢিল্লি হয়ে যায়। সেই ঘটনায় ঢিল্লি থেকে জায়গার নাম হয়েছে দিল্লি। অন্য মতে এক তোমারা রাজার জন্য ঋষি ব্যাস এই লোহার দণ্ডটি মাটিতে পুঁতে দেন। তিনি বলেন বাসুকির মাথায় এটি স্থাপিত হল। কিন্তু কৌতুহলী রাজা যখন এটি তোলার চেষ্টা করেন তিনি দেখেন দন্ড তোলার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বাসুকিনাগের রক্ত দেখা যায় রাজা আবার মাটিতে রোপন করতে চান কিন্তু পুরোটি পারেন না। ঋষি ব্যাস রাজাকে জানান যেমন তোমার জন্য দন্ড মাটিতে আলগা ভাবে বসে রইল তেমনি তোমার রাজত্ব ঢিলে বা অস্থায়ী হবে এবং ঊনবিংশ বংশ পরে প্রথমে চৌহান, পরে তুর্কিদের হাতে দিল্লি চলে যাবে। তৃতীয় মতে রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান ব্রাহ্মণদের সাহায্যে লোহার দন্ড সর্পরাজ শেষনাগের মাথায় রাখেন, যাতে তাঁর সাম্রাজ্য চিরজীবী হয়। কৌতূহলের বসে তিনি সত্যি শেষ নাগের মাথায় দন্ডটি বসানো হয়েছে কিনা দেখার জন্য সেটি তুলে ফেলেন। দন্ডের শেষে রক্ত দেখা যায় এবং রাজা জানতে পারেন তাঁর রাজত্বের মেয়াদ খুব স্বল্পকাল। তারপর থেকে হিন্দু রাজ্যেরও অবসান হবে। অনঙ্গ পাল ২ দিল্লিতে রাজত্ব স্থাপন করে লালকোট দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন লৌহ স্তম্ভটিকে কেন্দ্রে রেখে, ১১১৭ সম্বত বা ১৬০ খ্রিস্টাব্দে। 


লালকোট নাম থেকে অনুমান হয় যে দুর্গটি লাল পাথরের তৈরি। কিন্তু ধ্বংসাবশেষ থেকে মনে হয় এটি ধূসর পাথরে তৈরি। এটির পরিসীমা আড়াই মাইল। দুর্গের চারপাশের পরিখা আছে। দুর্গের তিনটি দরজার অবস্থান এখনো দেখা যায়, চতুর্থ দরজাটি বোঝা যায় না প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার কারণে। প্রাচীরের ভেতর যেসব ঘরবাড়ি বা মন্দির ছিল সেগুলির এখন পৃথক অস্তিত্ব নেই, শুধুই ভগ্নস্তূপ। এখান থেকে কিছু দূরে এখনো অনঙ্গ তাল নামে একটি সরোবর আছে। সেটি ১৯ ফুট লম্বা ও ১৫২ ফুট চওড়া ও ৪০ ফুট গভীর। নিশ্চয়ই দুর্গের লোকেদের জল সরবরাহ করার জন্য সরোবরটি খনন করা হয়েছিল। পৃথ্বীরাজ চৌহানের সময় লালকোট কেল্লার বাইরেও শহর বিস্তীর্ণ হয়েছিল। বৃহত্তর শহরের সুরক্ষার জন্য বাইরে চার মাইলের বেশি পরিসীমার প্রাচীর দেওয়া হয়েছিল লালকোট দুর্গকে কেন্দ্র করে। লালকোট কেল্লার নাম সেই সময় হয় কিলা রাই পিথোরা অর্থাৎ রাজা পৃথ্বীরাজের কেল্লা। এই প্রাচীরে নটি ফটক ছিল, যার মধ্যে চারটির চিহ্ন এখনো পাওয়া যায়। লাল কোটের উত্তর দিকে রঞ্জিত গেট দিয়ে মোহাম্মদ ঘোরীর বিধ্বংসী বাহিনী লালকোটে প্রবেশ করেছিল। 


ভারতের মাটিতে প্রথম মুসলমান মসজিদ কুতুবউদ্দিন-এর তৈরি মসজিদ হল মসজিদ-ই-কুতুব-উল-ইসলাম। কুতুব মিনার চত্বরে অবস্থিত এই মসজিদের ১৬৫ ফুট লম্বা ও ৩১ ফুট চওড়া। প্রার্থনা গৃহটি ৫ সারি সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত হিন্দুস্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটি একটি ১৪৫ ফুট লম্বা ও ৯৬ ফুট চওড়া প্রাঙ্গণের প্রান্তে অবস্থিত। প্রাঙ্গণের মাঝখানে রয়েছে সেই বিখ্যাত লৌহ স্তম্ভ। এই প্রাঙ্গণটিতে অন্তত ১২০০ হিন্দুস্তম্ভ ব্যবহার করা হয়েছে। হিন্দু মন্ভদিরের ভগ্নাংশ ব্যবহার করে তিন বছরের মধ্যে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল। 


কুতুব মিনার মানুষের তৈরি (লেখকের সময় পর্যন্ত) পৃথিবী সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভ। এটি ২৩৮ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা ভূমি পৃষ্ঠ থেকে। নীচের দিকে এই মিনারের চব্বিশটি পৃষ্ঠতল আছে ১৪৭ ফুট পরিধি যুক্ত। উপরের দিকে এটি বৃত্তাকার। এর মোট পাঁচ তলা আছে। প্রতিটিতে ঝুল বারান্দা আছে। তিন তলা পর্যন্ত মিনারটি লাল বেলে পাথরের ও তার উপরের শ্বেত পাথরের তৈরি। ভেতরের দিক ধূসর পাথরের তৈরি। মিনারের ভিতরে সিঁড়ি আছে, ভিতরে আলো হাওয়া পূর্ণ পরিবেশ। বারান্দা ও মিনারের বহির্গাত্রে কোরআনের বাণী আরবিতে লেখা আছে। মিনারের গায়ের লিপি থেকে জানা যায় সুলতান আলতামাস বা ইলতুৎমিস মিনারের কাজ শেষ করিয়েছিলেন। মিনারের গায়ে ফিরোজ শাহ তুঘলকের নামও আছে। বাজ পড়ে একবার মিনার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ফিরোজ শাহ তুঘলক সেটি সারাই করান ১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে মিনারে আবার সারাইয়ের কাজ করতে হয়। তৎকালীন সুলতান সিকান্দার লোদী সেই কাজ করান। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে এক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুতুবমিনার। ব্রিটিশ সরকার তখন মেরামত করেন। ১৮৪৭ এ আবার কিছু সংস্কার করান ব্রিটিশ সরকার। 


কুতুব মিনার হিন্দু রাজাদের কীর্তি কিনা তাই নিয়ে বিতর্ক আছে। হিন্দুরা বিশ্বাস করে হিন্দু এক রাজা তাঁর কন্যার সূর্যের উপাসনা ও যমুনা দর্শনের জন্য এই মিনার তৈরি করিয়েছিলেন। হিন্দুদের স্বপক্ষে আরো যুক্তি এই যে মিনারের প্রবেশপথ উত্তরমুখী, যা হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত। মুসলমানদের প্রচলিত প্রবেশপথ পূর্বমুখী। বারান্দাগুলিতে যে ঘন্টা সাজানো আছে তা হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত। অন্যদিকে মুঘল বাদশাহ আকবর শাহ ২ -এর মুন্সি সৈয়দ আহমেদ লিখে গেছে কুতুব মিনার আসলে মসজিদ-ই-কুতুব-উল-ইসলামের মজিনাহ্ বা আজান দেওয়ার স্থান। কুতুব মিনারের আরবি লিপিতে মোহম্মদ ঘোরীর প্রশস্তি ও কুতুবুদ্দিনের নাম পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে মিনার তৈরির কাজ শুরু করেন কুতুবউদ্দিন এবং আলতামস বা ইলতুৎমিস সেই কাজ শেষ করেন। কবি চাঁদ বরদোই, যিনি পৃথ্বীরাজ চৌহানের জীবনী লিখে গেছেন, তাঁর লেখায় এই মিনারের কোন উল্লেখ নেই। তাই এটি সুলতানি আমলে তৈরি হয়েছে এই যুক্তিটি বেশি গ্রহণযোগ্য। তবে হিন্দু স্থপতিদের দ্বারা কুতুব মিনার তৈরি বলে এই স্থাপত্যে কিছু কিছু হিন্দু প্রভাব পড়েছে। লেখক যখন কুতুব মিনারে গেছিলেন তখন তার চূড়া পর্যন্ত দর্শনার্থীদের যাওয়ার অধিকার ছিল। 


লেখক এবং সঙ্গীরা এবার কুতুব মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থিত অসমাপ্ত মিনারটি দেখলেন। এটি কুতুব মিনারের থেকে দ্বিগুণ বড় করে তৈরি করার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। হিন্দুদের মতে এই মিনার থেকে রাজকন্যার গঙ্গা দেখার ব্যবস্থা করার জন্য সেটি তৈরি হচ্ছিল কিন্তু মুসলমান আক্রমণের ফলে কাজটি শেষ হয়নি। অন্য মতে আলাউদ্দিন খিলজি এই মিনারটি তৈরি করেছিলেন কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও পরে মারা যাওয়ায় এই কাজ শেষ হয়নি। 


প্রাঙ্গণের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে সুলতান আলতামসের সমাধি। সমাধির ভিতর দিকে দেওয়াল খুব সুন্দর করে তৈরি। সমাধিটি ভালোভাবে সংরক্ষিত আছে। এর মাথার ওপর খোলা, যেন স্বর্গের সঙ্গে পৃথিবীর মধ্যে কোন বাধা রাখা হয়নি। 


এবার তাঁরা মেহেরৌলির প্রাচীন কুঁয়া দেখলেন, যেটি নাকি অনঙ্গপাল ২ -এর তৈরি (মেহেরৌলির বাউলি)। পরবর্তী দর্শনীয় স্থান আদম খানের সমাধি (আদম খান আকবরের একজন সেনাপতি ছিলেন)। 


সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী নির্মিত আলাই দরওয়াজার বিশালত্ব ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হয়। এর গায়ে আরবি অক্ষরে লেখা আছে ১৩১০ খ্রিষ্টাব্দে এর তৈরি কথা। দেখলেন হুমায়ুনের ধর্মগুরু ইমাম জামিনের সমাধি, আকবরের অন্যতম ভ্রাতৃসম মোহম্মদ কুলি খানের সমাধি, মোহম্মদ কুলি খানের সমাধির বাড়িটি এখন মেটকাফ হাউস নামে পরিচিত হয়েছে (চার্লস মেটকাফ তখন দিল্লির বাদশাহের দরবারে ব্রিটিশ প্রতিনিধি ছিলেন)।



                           (চলছে)


রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৪

৫১। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৫ ভোলানাথ চন্দ্র

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                       (আগের পর্বের পরে)

লেখক ভোলানাথ চন্দ্র এরপর বৃন্দাবনের বৈষ্ণব সাধকদের জন্য প্রসিদ্ধ কিছু স্থান দর্শন করলেন। বৈষ্ণব সাধক হরিদাস গোস্বামীর সমাধি বা সমাজ প্রথম দর্শনীয় স্থান। চৈতন্যদেব হিন্দু দাহ-প্রথার বদলে বৈষ্ণবদের মধ্যে সমাধি-প্রথা প্রচলন করেন। হরিদাস তখন শেষ জীবনে হরিনামগান করে দিনাতিপাত করছেন বৃন্দাবনে। বাদশাহ আকবর যমুনা নদীপথে যেতে যেতে একবার হরিদাস গোস্বামীর গান শোনেন এবং সেই গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন তাঁকে রাজসভায় গিয়ে প্রধান গায়কের আসন অলংকৃত করতে। হরিদাস গোস্বামী স্বাভাবিক কারণেই অসম্মত হন। বারংবার অনুরোধে তিনি তাঁর তরুন শিষ্য তানসেন-কে আকবরকে দেয়। তানসেন এরপর আকবরের সভা অলংকৃত করেন এবং কালক্রমে কিংবদন্তি গায়ক হন। বৃন্দাবনে হরিদাস গোস্বামীর অতি সাধারণ দেখতে সমাধি হিন্দুদের দর্শনীয় স্থান। 


কার্তিক মাসে বৃন্দাবনে রাস উৎসব পালিত হয়। রাস মন্ডল একটি অঙ্গন যেখানে শ্রীকৃষ্ণের নাম কীর্তন নাচ হয়। সারা শহর জুড়ে রাসমণ্ডল হয় এই সময়। 


বৃন্দাবনে লালাবাবুর মতো খ্যাতি আর কারো নেই।ওয়ারেন হেস্টিংস এর দেওয়ান গঙ্গা গোবিন্দ সিংহের নাতি ছিলেন লালা বাবু (লালাবাবুর প্রকৃত নাম কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ)। এই বিশাল ঐশ্বর্যবান মানুষটি যৌবনে সংসার ত্যাগ করে কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর হয়ে বৃন্দাবনে চলে আসে। এখানে একটি অসাধারণ মন্দির তৈরি করান এবং সেই মন্দিরের দরিদ্র সেবায় প্রতিদিন ১০০ টাকা করে খরচ করতেন। প্রতিদিন ৫০০ মানুষ এখানে ঠাকুরের প্রসাদ পেত। মন্দিরের চত্বর প্রতিদিন লালাবাবু নিজে হাতে পরিষ্কার করতেন এবং নিজে ভিক্ষা করে আনা রুটি মাত্র খেতেন। এই সর্বত্যাগী মানুষটি পরে বৃন্দাবন ছেড়ে গিরি গোবর্ধনের গুহায় ধ্যান করার জন্য চলে যান। 


পরবর্তী গন্তব্য রূপ গোস্বামীর আশ্রম স্থল। এই আশ্রম এখন আর জঙ্গলের মধ্যে নির্জনে নেই। এটি এখন পাকা রাস্তায় অবস্থিত। সেখানে ভরতপুরের রাজার তৈরি একটি উৎকৃষ্ট মানের মন্দির আছে। 


তাঁরা এবার গেলেন নিধুবন, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ রোজ বাঁশি বাজাতেন আর গোপিনীদের সঙ্গে লীলা খেলা করতেন। এটি বর্তমানে শহরের মধ্যে অবস্থিত নীচু প্রাচীর দেওয়া এক স্থান, যেখানে জঙ্গল ঝোপঝাড় আছে। ললিতা কুন্ড বলে একটি জলাশয় আছে এখানে। 


তারপর তাঁরা গেলেন মদনমোহনজি দর্শনে। এই মন্দির রানী কুব্জার প্রতিষ্ঠিত। মথুরার পতনের সময় মদনমোহনজি অদৃশ্য হয়েছিলেন। কয়েক শতাব্দী অদৃশ্য থাকার পর তিনি এক চৌবে মহিলার বাড়িতে প্রকট হন, যিনি তাঁকে তাঁর শিশু পুত্রের সঙ্গী হিসেবে রাখেন। পরে মদনমোহন সনাতন গোস্বামীর কাছে আসেন। সনাতন গোস্বামীর দেওয়া অতি সাধারণ প্রসাদে অরুচি হওয়ায় মদনমোহন রাজকীয় খাদ্য অভিলাষ করেন কিন্তু তা সনাতনের সাধ্যাতীত ছিল। তখন এক বণিকের মালবাহী নৌকা বালির চড়ায় আটকা পড়ে। সওদাগর সাহায্যের আশায় ঘুরতে ঘুরতে মদনমোহনের মন্দিরে আসেন ও মানত করেন যদি এই যাত্রা তাঁর নৌকার জিনিসপত্র বেঁচে যায় তবে মদনমোহনের সেবায় সেই অর্থ ব্যায়িত করবেন। অলৌকিকভাবে নৌকা উদ্ধার হয় ও বণিকের আশাতীত লাভ হয়। তিনি দেবতার জন্য মন্দির তৈরি করে দেন। সেই মন্দিরের দেবতা বৃন্দাবনের প্রধান তিন দেবতার একজন হন। সনাতন গোস্বামী প্রতিষ্ঠিত সেই মূর্তি এখন জয়পুরে আর প্রাচীন মন্দিরটি পরিতক্ত ও ভগ্নপ্রায়। সনাতনের সমাজ বা সমাধি সেখানে আছে। এখানে চৈতন্যদেব এসেছিলেন। তাঁর পায়ের ছাপ, খড়ম আর যে তেঁতুল গাছের যে ছায়ায় তিনি বসেছিলেন তা রয়েছে। যদিও গাছটি এত পুরনো বলে লেখকের মনে হয় নি আর চরণচিহ্ন খুব ছোট মাপের বলে লেখকের সন্দেহ হয়। 


নিকুঞ্জবন যা রাধা কৃষ্ণের অভিসারের উদ্যান সেটি লেখকের পরবর্তী দর্শনীয় স্থান। কথিত আছে নিকুঞ্জ বনে কোন মানুষ রাত কাটাতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে এই বন একটি নীচু পাঁচিল ঘেরা, ঝোপ ঝাড় ঘাসে ঢাকা জমি, যেখানে অনেক হনুমানের বাস। এরমধ্যে লেখক বৃন্দাবন শহর ও তার চারপাশে হনুমানের অত্যাচারের কাহিনী বলেছেন। একটিমাত্র গাছ রয়েছে নিকুঞ্জবনে, যেটি তার প্রাচীনত্ব প্রদর্শন করছে। 


বাঁকাবিহারী বৃন্দাবনের সবচেয়ে বড় শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি। তাঁর পাশে কোন রাধা মূর্তি নেই। রাধারমন হলেন গোপাল ভট্ট গোঁসাই-এর প্রতিষ্ঠা একটি শিলা থেকে উদ্গত মূর্তি। 


বৃন্দাবনে লেখক নাটক দেখলেন। একটি বড় মন্দিরের উঠানে বা প্রাঙ্গনে সামিয়ানা টাঙিয়ে শয়ে শ়য়ে বাতির আলোতে উজ্জ্বল মঞ্চে নাটক অনুষ্ঠিত হল। রঙিন পাগড়ী শোভিত ব্রজবাসীরা পা মুড়ে মাটিতে বসে সেই নাটক দেখল। ব্রজনারীরা রঙিন পোশাক পড়ে, ঘেরা জায়গায় বসে দেখল। প্রাঙ্গণের মাঝখানে উঁচু মঞ্চের প্রতি প্রান্তে ২টি ছেলে দুটি করে মশাল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। নাটকের বিষয়বস্তু ছিল নিধুবনে রাধা কৃষ্ণ। একটি সুন্দর অল্পবয়সী ছেলে মাথায় মুকুট ও নারীদের সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হয়ে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করল। ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণকে কথা বলতে শুনে খুব ভালো লাগছিল লেখকের। 


বৃন্দাবনে তীর্থযাত্রীরা আরও বেশ কিছু স্থানে তীর্থ ভ্রমণ করেন। যেমন - মধুবন বা তাল বন, যেখানে কৃষ্ণ বলরামের বাল্যলীলা হয়েছিল। রাধাকুন্ড, শ্যামকুন্ড, ললিতাকুন্ড (লালাবাবু রাধাকুন্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন, শ্যাম কুন্ডের জলের রং নীলাভ আর ললিতা কুন্ডের জল দুধের মতো সাদা। শ্যাম কুন্ডের পাশে বসে কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর চৈতন্য চরিতামৃত কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন)। 


রাধাকুণ্ড থেকে চার মাইল দূরে গোবর্ধন পর্বত যা বৈষ্ণবদের কাছে কৈলাস পর্বতের মতো পবিত্র। এই পর্বত কৃষ্ণ তাঁর কনিষ্ঠ আঙ্গুলে তুলে ধরে ছাতার মতো ব্যবহার করে অতিবৃষ্টিতে সমগ্র বৃন্দাবনকে রক্ষা করেছিলেন। লেখক গিরি গোবর্ধনকে নিয়ে আরো একটি কাহিনী লিখেছেন। লঙ্কায় যুদ্ধকালে লক্ষণ রাবণের বানে আহত হলে চিকিৎসক (সুষেণ) বলেছিলেন হিমালয়ের একটি নির্দিষ্ট পাহাড় থেকে (গন্ধমাদন) নির্দিষ্ট একটি গাছ (বিশল্যকরনী) আনতে পারলেই তাঁকে সুস্থ করা যাবে। হনুমান সেই গাছ আনতে যান কিন্তু কার্যকালে গাছের নাম ভুলে যাওয়াতে সম্পূর্ণ পাহাড়টি পিঠে তুলে লঙ্কা যাত্রা করেন। বর্তমানে যেখানে গোবর্ধন পর্বত রয়েছে সেই স্থানের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় রামের ভাই ভরত সেখানে ছিলেন। তিনি হনুমানকে ভাবেন লঙ্কার রাক্ষস। তাই তিনি তীর ছোঁড়েন হনুমানের পায়ে তীর লাগায় তিনি রাম রাম বলে ওঠেন এবং তাঁর পিঠ থেকে গন্ধমাদন পর্বতের একটি ছোট অংশ পড়ে যায় মাটিতে। ভরত রাম নাম শুনে তাঁর ভুল বোঝেন। তারপর হনুমানের কাছে সব শুনে তাঁকে বলেন তাঁর তীরের ডগায় গন্ধমাদন-সহ বসতে যাতে তীর ছুঁড়ে ভরত তাঁকে আরও তাড়াতাড়ি লঙ্কায় পৌঁছে দিতে পারেন অসুস্থ ভাই লক্ষণের ঔষধ নিয়ে। হনুমান অবশ্য নিজের অলৌকিক শক্তি বলেই লঙ্কায় পৌঁছান। গন্ধমাদনের যে টুকরো ওই স্থানে পড়েছিল তা গোবর্ধন পর্বত নামে খ্যাত হয়। 


গোবর্ধন পর্বতে এখন অনেক মন্দির আছে, যার মধ্যে প্রধান মন্দিরে কৃষ্ণের শিশুরূপ গোপাল হিসেবে পূজা হয়। বল্লভাচার্য গোপাল রূপে কৃষ্ণের পূজার প্রথম প্রচলন করে। পঞ্চদশ শতাব্দীর ব্রজ অঞ্চলের বৈষ্ণব ধর্মের সাধক ও দার্শনিক ছিলেন বল্লভাচার্য। প্রতিবছর কার্তিক মাসে অন্নকূট উৎসব বল্লভাচার্য শুরু করেছিলেন, এখনো সেটি এখানে পালিত হয়। 


বৃন্দাবন শহরের মাঝখানে রঞ্জিত সিংহের (ভরতপুরের মহারাজা) সুন্দর সমাধি অবস্থিত। এই সমাধির একদিকে একটি জলপূর্ণ পুকুর ও অপরদিকে একটি জলশূন্য পুকুর রয়েছে। এর কারণ শ্রীকৃষ্ণ নাকি একবার তৃষ্ণার্ত হয়ে একটি পুকুরের সমস্ত জল নিঃশেষে পান করে নিয়েছিলেন। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া যখন ভরতপুর আক্রমণ করেছিলেন তখন তিন মাস যাবত দূর্গ অবরোধ করে রেখেছিলেন। সেই সময় রঞ্জিত সিংহ  সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করেছিলেন। শূন্য পুকুর সেই অবরোধকে প্রতীকী ভাবে দেখায়। 


চরণ পাহাড়ি নামক স্থানে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর গরুর পালের পায়ের চিহ্ন দেখা যায়। এই পাহাড়ের লুকালুকি নামক স্থান ছিল তাঁর লুকোচুরি খেলার স্থান গোপিনীদের সঙ্গে। 


কাম্যবন নামক স্থানে পাণ্ডবদের বনপর্বে থাকার সময় শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এখানে তাঁদের মূর্তি, যজ্ঞশালা প্রভৃতি যাত্রীদের দেখানো হয়। 


বারসানার রাজা বৃষভানুর কন্যা রাধার জন্মস্থল; নন্দগাঁও যা কৃষ্ণের শৈশবের লীলাভূমি; বস্ত্রহরণ ঘাট, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের বস্ত্রহরণ করেন প্রভৃতি দর্শন করেন। 


লেখক এরপর দেখেন মহাবন যেখানকার প্রধান দেবতা বলদেও বা বলদেব, যিনি কৃষ্ণের দাদা বলরাম। 


গোকূল, যমুনার মধ্যে একটি দ্বীপের মতো স্থানে অবস্থিত। এটি বৃন্দাবনের সুন্দরতম স্থান বলা যায়। এই স্থান এখনও অনেকটা কৃষ্ণের সময়ের গোকূলের মত পরিবেশ বজায় রেখেছে। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এখানকার মূল বিগ্রহ গোকূলনাথ জঙ্গলে লুকানো ছিলেন মুসলমান আক্রমণের কারণে। বল্লভাচার্য তাঁকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেন। আওরঙ্গজেবের সময় আবার মূল মূর্তি অন্যত্র (জয়পুরে) পাঠানো হয়। এখানে আছেন প্রতিমূর্তি। গোকূলে পুতনা-খাল দেখলেন লেখক, যেখানে কংস-প্রেরিত রাক্ষসী পুতনাকে মেরে যমুনায় ভাসিয়ে দেন কৃষ্ণ।  

এভাবে শেষ হল লেখক ও তাঁর সঙ্গীদের বৃন্দাবন দর্শন। 


লেখকের এর পরবর্তী ভ্রমণকাহিনী এর চার বছর পরে অর্থাৎ ১৮৬৬, ৫ নভেম্বর শুরু হল। এবার কাহিনী শুরু হলো টুন্ডলা জংশন থেকে। এই সময়ের মধ্যে দিল্লি পর্যন্ত রাজপথ নতুন করে তৈরি হয়েছে। ফলে ঘোড়ার গাড়ির গতি অনেক বেড়ে গেছে। 


প্রথম উল্লেখযোগ্য স্থান যেটি পথে পড়ল সেটি হলো হাতরাস। ডাকাত, ঠগীর আস্তানা থেকে এখন এটি ব্যস্ত তুলো আর নীলের বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। 


তারপর এলো আলিগড়, এর প্রাচীন নাম কোল বা কোয়েল। লেখক স্থানটিকে কোয়েল আলিগড় লিখেছেন। এই কোল অতি প্রাচীনকাল থেকে ছিল বলেছেন লেখক। কৃষ্ণ কংসকে বধ করার পর জরাসন্ধ, যিনি কংসের জামাই ছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে আক্রমণ করতে যাওয়ার সময় এখানে বিশ্রাম করেছিলেন। সিন্ধিয়ার সেনানায়ক মসিয়ে পেরোন-এর মাটির দূর্গের জন্য আলিগড় স্মরণীয়। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে (দ্বিতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধে, ১৮০৩ থেকে ১৮০৫) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি লর্ড লেক এই দূর্গটি আক্রমণ করে ধ্বংস করেন, এক প্রবল প্রতিরোধ প্রতিহত করে। এখন শুধু দূর্গটির ধ্বংসাবশেষ আছে জঙ্গলময় পরিবেশে। সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব আলিগড়ে ভালোই পড়েছিল। এখন ধীরে ধীরে জায়গাটি শ্রী ফিরে পাচ্ছে। 


আলিগড় থেকে দিল্লি যাওয়ার ট্রেনে করে লেখক রওনা দিলেন পরদিন। খুরজা, বুলন্দশহর, সিকান্দ্রাবাদ, দাদরি, গাজিয়াবাদ হয়ে এল দিল্লি। দূর থেকে চোখে পড়ল কুতুব। ক্রমে ক্রমে হুমায়ুনের সমাধি, যমুনা, আর নানা রকম মিনার-স্তম্ভ-প্রাসাদ-মসজিদ সম্বলিত, বহু প্রতীক্ষিত দিল্লি শহর চোখের সামনে উন্মোচিত হলো।


                              (চলছে)

শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪

৫০। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৪ ভোলানাথ চন্দ্র

 


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                      (আগের পর্বের পরে)

দি ট্রাভেলস অফ হিন্দু, ভলিউম টু'র শুরুতে লেখক ভোলানাথ চন্দ্র ঘোড়ার গাড়ির পরিবর্তে এবার উটের গাড়িতে পয়লা নভেম্বর, ১৮৬০ আগ্রা থেকে ফতেপুর সিক্রির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। 


পথে তিনি আকবরের বেগম যোধাবাইয়ের সমাধি দেখলেন। কিন্তু সমাধির সুন্দর দরজা, দেওয়াল সরকার ভেঙে বিক্রি করে দিয়েছে। সমাধির মাটি খুঁড়ে খনি বিদ্যার হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ফলে সমাধিটি আর নেই। 


আগ্রা থেকে ফতেপুর সিক্রি ২৪ মাইল। গাড়িতে ছয় ঘন্টা লাগে যেতে। পথে সমাধি, মসজিদ, ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। ফতেপুর সিক্রিতে আকবরের প্রাসাদ তৈরির আগে সেটি এক জনশূন্য পাহাড়ি জায়গা ছিল। এক মুসলমান পীর (যাঁর বয়স ৯৬ বছর) শেখ সেলিম সেখানে নির্জনে বসবাস করতেন। বাদশাহ আকবর নিঃসন্তান ছিলেন পুত্রের আকাঙ্খায় তিনি ও তাঁর পত্নী যোধাবাই পায়ে হেঁটে আজমিরের মইনুদ্দিন চিশতির দরগায় যান। রাতে স্বপ্নে মইনুদ্দিন চিশতী আকবরকে আদেশ দেন ফতেপুর সিক্রিতে বৃদ্ধ সেলিম এর কাছে যেতে। শেখ সেলিমের কৃপায় আকবরের পুত্র সেলিম বা জাহাঙ্গীরের জন্ম হয়। আকবর তাঁর রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে নিয়ে আসেন, এখানে একটি অপূর্ব নগরী তৈরি করে। 


ফতেপুর সিক্রির সবথেকে নজরকাড়া জিনিসটি হল ১২০ ফুট উঁচু, ১২০ ফুট চওড়া রাজকীয় দরজা (বুলন্দ দরওয়াজা)। শেখ সেলিমের শ্বেত পাথরের ছোট সুন্দর সমাধি, শ্বেত পাথরের ডোম বিশিষ্ট বড় মসজিদ-ও দর্শনীয়। আকবরের প্রাসাদ ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। বিশাল বড় হাতি দরজার সামনে দুটি প্রমাণ মাপের পাথরের হাতির মূর্তি দেখা যায়। বিস্ময়কর একটি বিষয় হল ফতেপুর সিক্রিতে সাদা কালো মার্বেল পাথরের দাবার ছকের মেছে। সেই দাবার ছকে জেনানার ৩২ জন মহিলা দাবার গুটির বদলে বসত। বাদশাহ ছিলেন নির্ণায়ক, অভিজাতরা দর্শক এবং দুজন মনসবদার সাদা ও কালোর পক্ষে দাবা খেলতেন। যে জয়ী হত সে ওই ৩২ জন রমণীকে পেত। ফতেপুর সিক্রিতে বীরবলের ছোট কিন্তু কারুকার্যযুক্ত বাড়ি দেখা যায়। 


পরদিন লেখকের ও তাঁর সঙ্গীরা সিকান্দ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পথে কিছু বাদশাহী ক্রোশ মিনার বা মাইলফলক দেখা গেল যেগুলি বৃত্তাকার এবং এখানকার মাইলফলক থেকে আকারে বড়। এগুলি মোগল আমলে ভারতের রাজপথে দুই মাইল অন্তর লাগানো ছিল। কোশ মিনার বা ক্রোশ মিনার-এর কাছে একটি করে নজর বুরুজ থাকত পথিকদের সুবিধার জন্য। রাজপথের দু'ধারে ছাওয়া দেওয়া গাছ লাগানো ছিল। 


সিকান্দ্রা নাম সম্ভবত সিকান্দার লোদীর নামে হয়েছিল। সিকান্দ্রায় আকবরের সমাধি রয়েছে, ফুল ফলের বাগিচায় ঘেরা। আকবরের সমাধির বাইরের বারান্দায় দুটি ছোট সমাধি আছে, আকবরের শৈশবে মৃত দুই নাতির। বাইরে রয়েছে তাঁর অনুগত কিছু আমির ওমরাহের কবর। 


মুনী বেগম নামে আকবরের এক ইউরোপীয় বেগম ছিলেন, যিনি সম্ভবত গোয়া থেকে এসেছিলেন তিনি খ্রিস্টান ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর আকবর সিকান্দ্রায় একটি সুন্দর সমাধি তৈরি করেছিলেন। পরে অনেক বছর ধরে চার্চ মিশন সোসাইটি সেখানে ছাপাখানা চালায় এবং দুর্ভিক্ষের সময় ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ৩০০ জন অনাথকে সেখানে রাখে। (উইকিপিডিয়া আকবরের খ্রিস্টান ও ইউরোপীয় বেগমের বিষয়টি অস্বীকার করছে। সেখানকার মতে, যোধাবাই এর অপর নাম ছিল মারিয়াম উজ জামানি। তাঁকে খ্রিস্টান বলে ভুল করা হয়। কিন্তু লেখকের লেখা পড়ে ধারণা হয় যে তিনি ঠিক তথ্যই দিয়েছেন কারণ লেখক যোধাবাই  ও মুনী বেগম দুজনেরই সমাধি প্রত্যক্ষ করেছেন)। 


লেখকের পরবর্তী গন্তব্য মথুরা। পথে একদল মথুরার চৌবে পান্ডা লেখকদের গাড়ির পাশে পাশে ছুটতে থাকল তাঁদের তীর্থযাত্রী হিসেবে নেওয়ার জন্য। লেখকেরা নিজেদের খ্রিস্টান বলে পরিচয় দিয়ে শেষে ছাড়া পেলেন। এবার তাঁরা মোগল প্রাচীনত্ব থেকে হিন্দু প্রাচীনত্বে প্রবেশ করলেন। 


মথুরা হল বাল্মিকী আর মনুর সুরসেনা, স্ট্রাবো আর আরিয়ানের (প্রাচীন গ্রীক লেখক ও ঐতিহাসিক) মেথোরা, হিউয়েন সাং-এর মো-থৌ-লো। সুপ্রাচীন কালে এখানে সুর নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন, যিনি কুন্তি ও বাসুদেবের পিতা। তাঁর নামে রাজ্যের নাম হয় সুরসেনা বা সুরসেনী। মথুরার পরবর্তী খ্যাতি কৃষ্ণ ও কংসের কাহিনী ঘিরে। একসময় মথুরা সম্পূর্ণভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে এসেছিল। ফাহিয়েন এখানে সাতটি বৌদ্ধস্তূপ ও তিন হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সম্বলিত কুড়িটি বৌদ্ধ-মঠ দেখেছেন। ফা হিয়েন মথুরায় একমাস ব্যাপী ছিলেন ও বৌদ্ধধর্ম মহাসম্মেলনে অংশ নেন। হিউয়েন সাং-এর সময় এখানে বছরে তিনটি ধর্মানুষ্ঠান পালিত হতো। লেখক বলেন বর্তমানে কংস টিলা নামে খ্যাত ধিবিটি সম্ভবত কোন বৌদ্ধস্তূপ যা কালের প্রভাবে মাটি চাপা পড়েছে। 


যমুনা নদীর ধারে কৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরায় বিশ্রাম ঘাট দর্শনীয়, যেখানে কৃষ্ণ ও বলরাম কংসকে বধ করার পর স্নান ও বিশ্রাম করেছিলেন। এই ঘাটের জলে অনেক কচ্ছপ আছে। ঘাটের উপর বেশ কিছু সুন্দর মন্দির আছে। প্রতিদিন সকালে  যমুনার আরতি হয়। এই ঘাটে প্রতিবছর মহাস্নান মেলা হয়, যার নাম যমনা কা বুরকী। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে লাখের উপর মানুষ আসেন এই মেলাতে। নভেম্বর মাসের কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয় দিন এই মেলা হয়। ভিড়ের ফলে কোন দুর্ঘটনা এড়াতে পুলিশের বন্দোবস্ত করা হয়। 


মথুরা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কাটরা বা বাজার অবস্থিত। এর মাঝখানে আওরঙ্গজেবের নির্মিত জুম্মা মসজিদ রয়েছে। এই মসজিদটি একটি ত্রিশ ফুট উঁচু ঢিবির ওপর রয়েছে। স্তম্ভ, মূর্তি, লিপি ইত্যাদি যা যা ওই অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে, তা থেকে অনুমান করা যায় যে এটি সম্রাট অশোকের সময় সন্ন্যাসী উপগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধমঠ ছিল। পরবর্তীকালে হিন্দুরা ক্ষমতায় এসে বৌদ্ধমঠের উপকরণ ব্যবহার করে মন্দির তৈরি করেছিল। গজনীর সুলতান মাহমুদ অনেক মন্দির লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেছিলেন। আওরঙ্গজেব মথুরায় হিন্দু মন্দিরের উপরে মসজিদ গঠন করেছিলেন। মসজিদটিতে অনেক ফাটল দেখা দেওয়ায় এটি এখন ব্যবহার করা হয় না। 


রাজা জয়সিং নির্মিত দূর্গের সামান্য ধ্বংসাশেষ ছাড়া কিছুই এখন পাওয়া যায় না। মানমন্দিরটিও ভগ্নপ্রায়। আহমদ শাহ দূরানীর (আফগানিস্থানের শাসক, ১৭৪৮ থেকে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বারবার ভারত আক্রমণ করেন) ধ্বংসলীলার ফলে দূর্গ ও মানমন্দির সম্ভবত নষ্ট হয়েছে। 


মথুরায় চৌবে সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা একচেটিয়াভাবে পান্ডার কাজ করে। লেখকেরা অত্যন্ত ধৈর্য ও চালাকির সঙ্গে তাদের উৎপাতের মোকাবিলা করেন। চৌবে মহিলাদের সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছেন লেখক। মথুরায় মাড়োয়ারি, মারাঠা, চৌবেদের বাজার বেশ জমজমাট। রাস্তার দু'পাশে অবস্থিত সুসজ্জিত দোকানে সব রকম জিনিস কিনতে পাওয়া যায়। উৎসবের মরশুম ছিল সেটি। লেখকের দুজন বন্ধু নাচ দেখার জন্য মথুরায় রয়ে গেলেন। 


লেখক বাকি সঙ্গীদের সঙ্গে চললেন বৃন্দাবন। এবার তাঁদের যাত্রার বাহন রথ। নামে রথ হলেও এই রথ শ্রীকৃষ্ণের আমলের রথ নয়। এই রথটি লাল পর্দার ঘেরাটোপে সাজানো, দুই চাকাযুক্ত যান যা টেনে নিয়ে যায় দুটি বলদ। মথুরা থেকে বৃন্দাবন তিন গো ক্রোশ। গো ক্রোশ সেই দূরত্ব যতদূর একটি গরুর আওয়াজ পৌঁছতে পারে। সেই প্রাচীন মাপ যুক্ত রাস্তায়, প্রাচীনকালের রথে, পৌরাণিক যমুনার কুল হয়ে লেখকেরা বৃন্দাবন যেতে যেতে অনেক ময়ূর দেখতে পেলেন, যে ময়ূরের পাখা মাথায় পরেন শ্রীকৃষ্ণ। পরদিন তাঁরা বৃন্দাবন পৌঁছলেন। 


লেখকের পিতামহ, প্রপিতামহরা তাঁদের পরম আকাঙ্ক্ষিত তীর্থস্থানে বেরোনোর আগে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করে যেতেন। কারণ স্থলপথে হিংস্র পশু, ডাকাত, ঠগী, মারাঠা দস্যুর ভয় ছিল। জলপথে ঝড়, জলদস্যু, জল পুলিশের ভয় ছিল। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই তীর্থ ভ্রমণের। বৃন্দাবনে লেখক একজন পান্ডা নিলেন ও তার খাতায় পূর্বপুরুষদের নাম খুঁজতে গিয়ে এক কাকা-দাদু ১৮২৫ তে এসেছিলেন সেই প্রমাণ পেলেন। 


মথুরাকে কেন্দ্র করে ৮৪ মাইল ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট চক্রাকার পথে ভ্রমণ করে তীর্থস্থান দর্শন করলে প্রাচীন ব্রজভূমি বা ব্রিজ দেখা যায়। ব্রজভূমির সর্বোত্তম স্থান হলো বৃন্দাবন। বৈদেশিক মুসলমান আক্রমণে বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিপত্তি বৃন্দাবন থেকে লোপ পায়। চৈতন্যদেবের মথুরা, বৃন্দাবন আগমনের সময় থেকে সেখানে বৈষ্ণব ধর্মের পুনর্জাগরণ হয় বলা যায়। 


বৃন্দাবনে পৌঁছেই গোঁড়া হিন্দুরা ধুলোপায়ে গোবিন্দজিকে দর্শন করতে যান। কাশীর বিশ্বের মন্দির দেখে লেখক যেমন হতাশ হয়েছিলেন বৃন্দাবনের গোবিন্দজির মন্দির দেখেও সে রকম অনুভূতি হল তাঁর। মন্দিরের গঠন সাধারণ, সাজসজ্জা তেমন নেই। সজ্জার মধ্যে আছে কিছু লাল পর্দা আর বড় পেতলের দীপাধার। কিন্তু একপাশে রাধা ও অন্যপাশে ললিতাকে নিয়ে গোবিন্দজি-কে খুব খুশি দেখাচ্ছিল। তার পরণে সকালের পোশাক। মাথায় পাগড়ি বাঁধা হিন্দু রাজবেশ। অন্য সময় অন্যান্য পোশাকে পোশাকে তাঁকে সজ্জিত করা হয়। তিনি সর্বদা বাঁশি নিয়ে থাকেন। শুধুমাত্র বাঁশি ছাড়েন যখন কংস বধ করার জন্য তীর ধনুক হাতে যোদ্ধার বেশে থাকেন। এই মূর্তিটি প্রতিমূর্তি। আসল মূর্তি আওরঙ্গজেবের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মেবারের রানা রাজ সিং রাজপুতানায় নিয়ে যান। মূর্তিটি নাথদোয়ারায় বিদ্যমান (শ্রীনাথজি রূপে)। (প্রকৃত পক্ষে, গোবিন্দজির মূর্তি রাজা সওয়াই জয় সিং জয়পুরে তাঁর রাজপ্রাসাদে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অন্যদিকে মেবারের রানা রাজ সিং গোবর্ধনজির মূর্তি বৃন্দাবন থেকে নিয়ে গিয়ে নাথদোয়ারায় শ্রীনাথজি নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন)।


বৃন্দাবনে মন্দিরের সংখ্যা অগণিত। প্রতিটি মন্দিরে  রাধা, কৃষ্ণ ও সখি ললিতা বিরাজিত (এখন কিন্তু প্রায় সব মন্দিরে ললিতা অনুপস্থিত)। জয়পুরের রাজা, ভরতপুরের রাজা, সিন্ধীয়ার রানী, হোলকরের রানী, দিনাজপুরের রাজা, বর্ধমানের রাজা প্রমুখ বহু রাজা-রানী প্রতিষ্ঠিত মন্দির এখানে আছে। মন্দির গুলির দৈনন্দিন খরচা এক একটিতে ১০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। 


গোবিন্দজির পরেই দ্রষ্টব্য গোপীনাথজি। এই মূর্তিটিও প্রতিমূর্তি আওরঙ্গজেবের আক্রমণের কারণে। সিপাহী বিদ্রোহের জন্য তিন বছর যাবত যাত্রী সমাগম খুব কমে যাওয়ার ফলে গোবিন্দজির মন্দির দেনায় ডুবে গেছে ও বন্ধক রাখতে হয়েছে। 


কাশীঘাট অন্যতম বিখ্যাত ঘাট কারণ এখানে শিশু কৃষ্ণ কংসের প্রেরিত কাশী দৈত্যকে বধ করেছিলেন। বস্ত্রহরণ বৃক্ষ হল সেই গাছ যেখানে যমুনায় স্নানরত গোপিনীদের বস্ত্র হরণ করে কৃষ্ণ কৌতুক ছলে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। রয়েছে অক্রুরঘাট যেখানে কৃষ্ণ-বলরামকে মথুরায় আনার সময় অক্রুর রথ থামিয়েছিলেন। কালিয়াদহ আরেকটি বিখ্যাত ঘাট যেখানে কৃষ্ণ কালীয় নাগকে দমন করেছিলেন। কৃষ্ণর এই বিজয়কে স্মরণ করতে কালিয়াদহতে প্রতিবছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ব্রহ্মকুন্ড হল সেই পবিত্র কুন্ড যেখানে ব্রহ্মাকে বিষ্ণু পরাজিত করেছিলেন। 


বেনারসে বিষ্ণু শিবের উপাসনা করেন আর এখানে তার বিপরীত। শৈব ও বৈষ্ণবদের নিজ নিজ বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রয়াস এটি। যমুনার ধারে একটি বটগাছকে অক্ষয় বট বলে দেখানো হয়। বলা হয় এর একটি শেকড় এখানে, অপর দুটি এলাহাবাদে ও পুরীতে আছে। এখানে গোপেশ্বর নামে এক শিব মন্দির আছে। কথায় বলে, গোপিনী পরিবেষ্টিত কৃষ্ণকে দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে শিব ব্রজতে এসেছিলেন আনন্দে কাটাতে। কেউ যাতে তাঁকে চিনতে না পারে তাই তিনি সুন্দরী তরুণীর ছদ্মরূপে এসেছিলেন। কৃষ্ণ তাঁকে দেখে চিনে ফেলেন। কিন্তু কৃষ্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে শিবকে অভ্যর্থনা করে এবং শিব আনন্দোৎসবে কৃষ্ণ ও গোপিনীদের সঙ্গে যোগ দেন।


                                    

                        (চলছে)

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...