পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪

৬। তীর্থ মঙ্গল ১ বিজয়রাম সেনবিশারদ

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                        ---- সুমনা দাম 

বাংলা সাহিত্যে আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্রন্থের মধ্যে প্রথম ভ্রমণ সাহিত্য হচ্ছে বিজয়রাম সেন বিশারদ-এর লেখা "তীর্থ মঙ্গল"। নগেন্দ্রনাথ বসুর সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ মন্দির থেকে ১৩১৫ সনে অর্থাৎ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কাব্যের প্রথম মুদ্রিত প্রকাশ হয়। ইছামতী নদীর তীরে নদীয়া জেলার নোনাগঞ্জের নিকটস্থ ভাজনঘাটে বাড়ি বিজয়রাম সেনের, বিশারদ তাঁর উপাধি। তিনি জাতিতে ও পেশায় বৈদ্য। সেই সময় ভাজনঘাট জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের জমিদারী ভুক্ত ছিল। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল যখন তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে কাশী যাত্রা করেছিলেন তখন পুঁটিমারিতে বিজয় রাম তাঁর সহযাত্রী হলেন চিকিৎসক হিসাবে। তবে কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়ি খিদিরপুর থেকে নদীয়ার পুঁটিমারি পর্যন্ত যাত্রার বিবরণ তিনি সঙ্গে না থাকলেও ঘোষাল মহাশয়ের মুখে শুনে লিখেছেন। তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের সুনজরে পড়েছিলেন এবং তাঁর আদেশে এই গ্রন্থ রচনা করেন। 


গ্রন্থে বর্ণিত আছে ১১৭৭ সন ভাদ্র মাসে অর্থাৎ ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ হয়। এই ভ্রমণ হয় সম্ভবত ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে যা আন্দাজ করা যায় এই গ্রন্থ থেকে পাওয়া অন্যান্য তথ্য থেকে । তখনকার প্রচলিত নিয়ম মতে এই গ্রন্থটি ছন্দোবদ্ধ কাব্য। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের পরিচয় এই গ্রন্থ ছাড়াও তাঁর পুত্র ভূকৈলাসের প্রথম মহারাজ জয়নারায়ণ ঘোষালের লেখা করুণা নিধানবিলাস গ্রন্থ থেকে। কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা কন্দর্প ঘোষালের সময় থেকে এই বংশের ধনলাভ হয়। তিনি গোবিন্দপুরে বাড়ি করেন,পরে ইংরাজদের ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা নির্মাণের কারণে সেই স্থান ছেড়ে প্রথমে গড়া বেহালা ও পরে খিদিরপুরে বাস উঠিয়ে নিয়ে যান। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। দ্বিতীয় পুত্র গোকুলচন্দ্র লর্ড ক্লাইভের পরবর্তী গভর্নর ভেরলস্ট-এর আমলে তাঁর দেওয়ান নিযুক্ত হন এবং কার্যত তিনি বাংলার সর্বময় কর্তা ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের স্বপার্ষদ কাশী তীর্থযাত্রা কালে এই গোকুল চন্দ্র সমস্ত খরচের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বিজয় রামের লেখা অনুসারে গোকুলচন্দ্র খরচা বাবদ এক লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। এই অর্থের পরিমাণ অতিশয়োক্তি আছে কিনা জানা যায় না। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের এই তীর্থযাত্রা যেন রাজাদের শোভাযাত্রা। আত্মীয়-স্বজন পরিচিত ছাড়াও তাঁর নৌকা যেখানে লেগেছে, সেই স্থান থেকে যারাই তীর্থযাত্রায় আগ্রহী হয়েছেন তাদেরই সঙ্গে নিয়েছেন।


কালীঘাট থেকে কালীগঞ্জ (পায়ে হেঁটে বর্তমান গুগল ম্যাপ অনুসারে, উল্লেখ্য যে সেই যাত্রাটি ছিল নদীপথে )


১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা প্রথম ইংরেজের অধিকারে আসে। তার অল্প কিছুদিন পরে সাধারণ জনগণের অবস্থা, চিন্তাধারা, ভৌগোলিক অবস্থান (এবং সাধারণ জনগণ ছাড়াও কিছু কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের সাক্ষাৎকার হয় ) -এই সমস্ত ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় এই গ্রন্থ থেকে। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল যাত্রা শুরু করলেন নৌকায়। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল অনেক বজরা, ময়ূরপঙ্খী, পালতোলা নৌকা, সরু নৌকা নিয়ে রওনা দিলেন। সঙ্গে চলল তাঁবু কানাত পালকি বহুমূল্য দ্রব্যাদি আর চলল নানা কর্মচারী - মুনসি, বকশি, সেপাই, বরকন্দাজ, হরকরা, পত্রবাহক, মশালচি। চললেন অনেক ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ, বৈরাগী, বৈষ্ণব, বৈষ্ণবী। কালীঘাটে কালী পুজো করে গঙ্গায় যাত্রা শুরু হল। কৃষ্ণচন্দ্রকে বিদায় দিতে এসেছিলেন গোকুলচন্দ্র ও কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র জয়নারায়ণ ঘোষাল। এরপর নৌবহর এলো শিবপুর, যেখানে কৃষ্ণচন্দ্রের নিজ বসত বাটি। তারপর চাঁদপালের ঘাট, বনমালী সরকারের ঘাট পেরিয়ে কুমারটুলির মিত্র বংশের রঘুনাথ মিত্র এবং শোভা বাজারের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা নবকৃষ্ণ মিত্র সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের সাক্ষাৎ হল। বাগবাজারের ঘাটে সেই রাতে বিশ্রাম নেওয়া হল। পরদিন ডান হাতে চিৎপুর ও বরানগর রেখে বালির ঘাটে পৌঁছে সেখানে সে রাতে থাকা হলো। পরদিন সুখচরে স্নান পূজা সেরে নৌযাত্রা শুরু হল। ফরাসডাঙ্গায় অর্থাৎ চন্দননগরে রাত্রিবাস। পরদিন হুগলিতে হুগলির দেওয়ান রাজকিশোর রায় এসে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করেন। অপর পাড়ে কুমারহট্ট হালিশহর ও কাঁচরাপাড়া ছাড়িয়ে বলাগড় এসে দামামা বাজিয়ে সে রাতে থাকা হলো। পরদিন সোমরাবাজার রেখে গুপ্তিপাড়া ছাড়িয়ে নৌকা গোকুল ঘোষের প্রতিষ্ঠিত গোকুলগঞ্জে এলো। সেখানে দশমহাবিদ্যা ও রাম লক্ষণ সীতা মন্দির ছিল সেই সময়, যা এখন আর নেই। গুপ্তিপাড়ায় রাম মন্দিরে বিদ্বান ব্রাহ্মণদের ঘোষাল কর্তা দানকার্য করলেন। পরদিন অম্বিকা, হরিনদী (নদিয়া জেলার এক সমৃদ্ধ গ্রাম গঙ্গা গর্ভে বিলুপ্ত হয়েছে), কালনা পেরিয়ে নৌকা নবদ্বীপ পৌঁছালো । এখানে তেমুয়নি (তেমোহানা) দিয়ে নৌকা খড়িয়া বা জলঙ্গি নদীতে পড়ল । বিজয়রাম নবদ্বীপকে কাশীর সমান পুণ্যস্থান বলেছেন। নবদ্বীপের বুড়াশিব আর নিত্যানন্দের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে নৌকা আবার চলল। কৃষ্ণনগরের পরবর্তী গ্রাম গোয়ারীতে রাত্রি বাস হল। তারপর দিন হ্যাঁড়রা বা হাটড়াতে রাত্রি যাপন হল। পরদিন বিজয় রাম নৌকায় কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রয়ে এলেন, পুঁটিমারী নামক নদীয়ার গ্রামে। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে কবিরাজ হিসাবে নিয়োগ করলেন।

বিজয়রাম টুঙ্গিবালি নামক এক সমৃদ্ধ জনপদের কথা লিখেছেন। এই টুঙ্গিবালি বর্তমান মুর্শিদাবাদের বালিটুঙ্গী। এখানে রাত্রি বাস করা হয় এবং সহযাত্রী নিয়ে এক কপর্দক শূন্য বাঙাল বুড়ির এখানে মৃত্যু হয়, কৃষ্ণচন্দ্র নিজ খরচে তাঁর সৎকার করালেন। পরদিন মধুপুর ছাড়িয়ে রাতে কুশবেরিয়াতে বিশ্রাম নেওয়া হয়। পরদিন জলঙ্গীর মোহানা উপস্থিত হল। এখানে পদ্মা দেবী অর্থাৎ পদ্মা নদীর স্রোত খুব প্রবল জলের ঢেউয়ে যাত্রীরা ভয় পেয়ে গেল। নৌকার সঙ্গে জলজন্তুরা পালাতে লাগলো। অবশেষে নিরাপদে নৌকা জলঙ্গী অর্থাৎ পদ্মার থেকে জলঙ্গী নদীর উৎসস্থলে অবস্থিত প্রাচীন নগরে এলো। সেই সমৃদ্ধ নগর এখন পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। জলঙ্গীতে জনৈক হাওলাদার চারজন সেপাই পাঠিয়ে দিলেন। আলাদা এক নৌকায় সেপাইরা সঙ্গে চলল। জলঙ্গীর অনেক বিশিষ্ট মানুষ এসে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করলেন। হিন্দুরা এসে প্রণাম ও মুসলমানেরা সেলাম করলেন। কৃষ্ণচন্দ্র প্রচুর দান করে, ধন্য ধন্য প্রশংসা শুনে, এখানে দুইদিন থেকে, নৌকাযাত্রা আবার শুরু করলেন রাতে কোদালিমারিতে বিশ্রাম নিল নৌকা। পথে রানী ভবানীর প্রসিদ্ধ নগর তারাগণ্যা দেখতে পান তাঁরা। নৌকা এরপর ভগবানগোলা হাটে এলো। এই নগরের হাটবাজারে সমৃদ্ধি দেখে সবাই মুগ্ধ হল। দুদিন এখানে থেকে নৌকা চলল। পথে এলো কালীগঞ্জ, সেখানে উত্তর বাহিনী মহানন্দা নদীর দেখা পেল যাত্রীরা। নানা রকম তৈজসপত্র কেনা হলো কাঁসার তৈরি। ধুলাউড়ি, তত্তিপুর বাঁয়ে রেখে শিবনারায়ণের প্রতিষ্ঠিত শিবগঞ্জে এসে রাত্রিবাস হল। শিবনারায়ণ ছিলেন মুর্শিদাবাদ নবাবের কানুনগো দর্পনারায়ণের পুত্র। কালীগঞ্জ, শিবগঞ্জ স্থানগুলিকে কবি বন্দর বলেছেন, অর্থাৎ এখানে নদীপথে বাণিজ্য হত সেই সময়। 


                         (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!



২টি মন্তব্য:

  1. জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের নৌকায় ভ্রমণ বৃত্তান্ত বেশ মনোরম লাগলো । লেখিকাকে অনেক শুভেচ্ছা।

    উত্তরমুছুন
  2. ধন্যবাদ! আগামী চারটি পর্বে কৃষ্ণচন্দ্রের ভ্রমণ সম্পন্ন হবে। সঙ্গে থাকুন।

    উত্তরমুছুন