পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২১ জুলাই, ২০২৪

৭। তীর্থ মঙ্গল ২ বিজয়রাম সেনবিশারদ


                      

       সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                      ---- সুমনা দাম 

          
             (আগের পর্বের পরে)


এর পরবর্তী অংশে এল রাজমহল পাহাড়। রাজমহলের পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ি চোরের উপদ্রব খুব বেশি ছিল। তাই সকলে সতর্ক হয়ে যান এবং নৌকা খুব দ্রুত বেগে চলতে লাগল। বাঁদিকে উদানালা বা উদয়নালার (এখন ঝাড়খণ্ডের উধরা) যুদ্ধস্থল, যেখানে মীর কাসিমের সঙ্গে ইংরেজ সেনাপতি মেজর অ্যাডামসের যুদ্ধ হয়েছিল। তা বামে রেখে নৌকা অতি বেগে ঝাড়খন্ডের রাজমহলে এসে পৌঁছায়। রাজমহল নগর দেখে সবাই অভিভূত হল। কত শত অট্টালিকা, হাট, বাজার, দোকান। পাঁচ ক্রোশব্যাপী শহরে ঘন ঘন ঘর, স্থানে স্থানে ঘড়ি খানা, তাতে সর্বদা নহবত বাজে (সময় নির্দেশক)। ফৌজদার পালকি চড়ে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে এসে ১০০ টাকা নজরানা দিলেন। তবে কৃষ্ণচন্দ্র সেই টাকা নিলেন না। বসিয়ে অনেক আলাপ কথন করলেন। বিভিন্ন যাত্রীরা বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ঘোষাল মহাশয় ঘুরে ঘুরে তাদের সকলের খোঁজ নেন। দুদিন রাজমহলে থেকে আবার যাত্রা শুরু হয়। মেঘের মতো উঁচু পর্বত দেখা যায়। আর পর্বতের ওপর চোহাড় বা চুয়ারদের বাড়ি। তারা সাঁওতাল পরগনার আদিবাসী জাতি। তাদের গলায় হাঁসুলি, কানে কুন্ডল, হাতে বালা, পায়ে মল, হাতে লাঠি। তাদের দেখে যাত্রীরা ভয় পেয়েছিল। এক চৌহার তাদের প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষাল মহাশয় কে প্রণাম করে কলা উপহার দেয়। ঘোষাল মহাশয় তাকে এক টঙ্কা ইনাম দিয়ে মিষ্টি কথাবার্তা বলেন।


রাজমহল থেকে পাটনা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে, উল্লেখ্য যে সেই ভ্রমণটি হয়েছিল নদীপথে )


এরপর নৌকা এলো সকরীগলি। সেখানে একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে গঙ্গা। পরদিন তেল্যাগাড়ি বা তেলিয়াগড়ি বামে রেখে নৌকা চলল। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সিরাজদৌলা নৌকা করে পলায়ন করার সময় রাজমহলের থেকে কিছু দূরে এক গ্রামে এক ফকিরের আশ্রয়ে আসেন। ফকির গোপনে সিরাজের শত্রুপক্ষের কাছে খবর পাঠান। মীরজাফরের ভ্রাতা মীর দাউদ সিরাজ ও তাঁর পরিবারের সকলকে এখানে বন্দী করে। সেই স্থান পেরিয়ে নৌকা চলল। লক্ষ্মীপুর, শ্রামপুর বামে রেখে নৌকা এগোলো, সামনে দেখা গেল বটেশ্বর পর্বত, যা বিহারে অবস্থিত। পাহাড়ের ওপর নানা মন্দির আছে। ঘোষাল মহাশয় সেখানে পূজা দিলেন। মুনির কুটিরে গিয়েও প্রণাম করলেন। তারপর নৌকা এলো পাথরে বাঁধানো ঘাট পাথরঘাটায়। সেখানে রাত্রি বাস। পরদিন পাহাড়িয়া রাজার বাটি কাহলগ্রাম (যা অতি প্রাচীন নগর। এখনো অনেক প্রাচীন নিদর্শন আছে, এখানে বিক্রমশীলা মহাবিহার পরবর্তীতে খনন কার্যে বেরিয়ে এসেছে) তা পেরিয়ে খাগড়ায় রাত্রি বাস করলেন। পরদিন চপকালী, ডহরগড়, ধীরনগর ডানে রেখে ভাগলপুর, সুজাগঞ্জ বামে রেখে শিবগঞ্জে নৌকা থামল। জলপান ও স্নান পূজা সেরে নৌকা আবার যাত্রা শুরু করল। গোপালপুরে (বিহারের) রাত্রি বাস হল। পরদিন নৌকা জাহাঙ্গীরায় অর্থাৎ জাঙ্গীরায় উপস্থিত হল। বামে এক সুন্দর পাহাড় বর্তমান।  ডানদিকে নদীর মধ্যে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে নানা রকম মূর্তি খোদাই করা আছে। পাহাড়ের উপরে গৌরীশংকরের মন্দির আর অনেক সুন্দর অট্টালিকা আছে। নানা উপাচারে কর্তা ও অন্যরা শিবের পূজা করেন। এই স্থানের জল নিয়ে নৌকা চলল বৈদ্যনাথ ধামে পুজো দেওয়ার জন্য। এই স্থান থেকে গঙ্গা উত্তর বাহিনী হল, তাই এখানকার জল পুণ্যজ্ঞানে কর্তা পান করলেন। তারপর বাম দিকের জাঙ্গীরা বা জাহাঙ্গিরা ও ঘোড়াঘাট এবং ডানে কাশীপাড়ার হাট হয়ে নৌকা চলতে থাকলো। দূরে মুঙ্গেরের পাহাড় দেখা গেল। রাতে কোদালিঘাটে থাকা হল। সকালে সাছোঁধন পীরের বাড়ি বামে রেখে নৌকা চলল। সেখানে গুরগুনী সাহেবের ছাউনি ছিল। গুরগুনী সাহেব তথা গুরগিন খাঁ, তথা গ্রেগরি ছিলেন আর্মেনিয়ান। তিনি ও তাঁর ভাই পিদ্রু বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি মীর কাসিমের সেনাপতির পদ পেয়েছিলেন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এই স্থানের পশ্চিমে উষ্ণপ্রস্রবণ সীতাকুণ্ড আছে যা হিন্দুদের তীর্থস্থান। 


শারীগান গেয়ে মাঝিরা নৌকো এগিয়ে নিয়ে চলে। নৌকো মুঙ্গেরের পশ্চিমভাগে উপস্থিত হলে মনোহর মুখার্জি নামক এক ব্যক্তি এসে সকলকে সাদরে তাঁর বাড়ি নিয়ে গিয়ে সে রাতে রাখলেন। পরদিন সবাই মুঙ্গেরের কেল্লা দেখতে গেল। দুই ক্রোশ ব্যাপী পাথরের কেল্লা অত্যন্ত সুন্দর। কেল্লার মধ্যে কত মসজিদ আছে। বহু সেপাই ও তাদের দলপতি পাহারায় রয়েছে। কেল্লার মধ্যে আছে অঙ্গরাজ কর্ণ রাজার স্থান। তিনি নাকি প্রতিদিন সোয়া মণ সোনা দান করতেন। একদিন ত্রিশ মন ঘিতে কড়াই পূর্ণ করে আপন শরীর তাতে ভেজে তিনি নাকি মা কালিকে নিবেদন করেন। মা তাঁর এই প্রসাদ গ্রহণ করেন কিন্তু তাঁকে পুনরায় জীবন দান করেন আশীর্বাদ সহ। কর্ণরাজা এরপর ব্রাহ্মণদের অকাতরে স্বর্ণ বিতরণ করতে থাকেন। রাজা বিক্রমাদিত্য চিন্তিত হন যে এত সোনা কর্ণ কোথায় পান এই ভেবে। তিনি শূদ্র রূপ ধরে আসেন ও বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে কথা বলেন। কর্ণ রাজা তাঁকে একশত টংকা মাহিনা দিয়ে চাকরি দিলেন। কর্ণ রাজার নিদ্রা কালে একদিন বিক্রমাদিত্য একইভাবে কালির পূজা করেন। মা কালী একই রকম ভাবে তাঁকে জীবনদান করেন ও অলৌকিক ক্ষমতা দেন। কর্ণ রাজা ঘুম ভেঙে বুঝলেন যে মা কালী এবার তাঁকে ছেড়ে গেছেন। বিক্রমাদিত্য দুঃখিত কর্ণ রাজাকে বলেন চিন্তা না করতে কারণ তিনি দান করার জন্য যত চান তত স্বর্ণ দেবেন। কর্ণ রাজা বিশ্বাস করলেন না যে বিক্রমাদিত্য কালীর কৃপায় যত খুশি সোনা পাওয়ার ক্ষমতা পেয়েছেন। তারপর বিক্রমাদিত্য তাঁকে সব বলেন ও  তাঁর আসল পরিচয় দেন। কর্ণ রাজা তখন বিক্রমাদিত্যের কাছে ক্ষমা চান। এটি একটি প্রচলিত গল্প। 


পরদিন সফরাবাজ বামে রেখে সিংহনালা, চৌকিঘাটা, সূর্যনালা ছাড়িয়ে নৌকা সূর্য গড় পৌঁছায়। এইবার প্রচন্ড ঝড় ওঠে। যাত্রীরা নৌকা ডুবে যাওয়ার ভয়ে ইষ্ট দেবতার স্মরণ করতে থাকে। কাশীনাথ যেন ভক্ত কৃষ্ণচন্দ্রের আকুল প্রার্থনা শুনতে পান এবং ঝড় থেমে যায়। শঙ্কর মজুমদারের বাড়িতে সেদিন রাতে থেকে পরদিন দরিয়াপুরের বালির চরে রাত কাটানো হল। নৌকা এলো বাড় নামক স্থানে সেখানে ভোলা বরকন্দাজ নামক নৌযাত্রীর বিরোধ হল। কিন্তু সেপাইরা কর্তাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। তারা কর্তার স্তুতি করে ক্ষমা লাভ করল। রাতে সেখানে থাকাকালীন রামানন্দ সরকার এলেন। তিনি বিরোধের কথা শুনে সমুচিত বিচার হবে বললেন। পরের রাতে নৌকা দেবীপুরে আশ্রয় নেয়।


পরদিন বৈকুণ্ঠপুর-এর কাছে গৌরীশঙ্কর দেবতার দর্শন ও পূজা হল। তারপর নৌকা এলো ফতুয়া শহরে বা ফতোয়াতে। এটি গঙ্গা ও পুনপুন নদীর সঙ্গমস্থল ও তীর্থ স্থল। এখানে যাত্রা শ্রাদ্ধ করে গয়া যেতে হত। সেখানকার বাজারে নানা রঙের বস্ত্র বিক্রয় হয়। সেই শহরে রাত্রিবাস হলো। পরদিন নৌপথে রাজা রামনারায়ণ (যিনি নবাব আলীবর্দী খাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু ও পাটনার নায়েব নাজিম ছিলেন। সিরাজদৌলার সময়ও নবাবী সেনার অধিনায়ক ও মীরজাফরের সময়ও তিনি পাটনার নায়েক-নবাব ছিলেন। মীর কাশেমের সময় পাটনায় বন্দী ও নিহত হন।) আর জাফর খাঁর (বাংলার নবাব মুর্শিদ মুর্শিদকুলি খাঁর অপর নাম) -এর বাগান পড়ল। লোনগোলা, রেকাবগঞ্জ, মারুগঞ্জ, আদামট ছাড়িয়ে নৌকা এসে ফরাসের কুটিঘাটে থামল। সবাই পাটনায় উপস্থিত হলো। সেদিন বিষ্ণু সিংহের বাড়িতে সবাই আশ্রয় নিল। অপূর্ব সুন্দর পাকা বাড়ি, বড় বড় ঘর। চার শত যাত্রী সেই কোঠাবাড়িতে রইল। অন্য যাত্রীরা অন্যান্য বাড়িতে রইল। পাটনা বড় বড় বাড়ি হাটবাজার নিয়ে বড় শহর কিন্তু ছোট ছোট নোংরা গলিও ছিল সেই শহরে। কর্তা পাটনার সুবাদার সেতাব রায়ের কাছে ভেট পাঠালেন। সঙ্গে গেল পার্সি-নবীস মুন্সী বিশ্বনাথ। কর্তা অন্যদিন নিজেও সুবেদারের সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন। কর্তাকে সেতাব রায় ঘোড়া,শাল প্রভৃতি উপহার দিলেন। সেতাব রায় ছিলেন আজিমাবাদের সুবেদার বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা। এরপর ঘোষাল মহাশয় কিছুদিন পাটনায় বসবাস করেন। তখন সেখানকার ইংরেজদের অধীনস্থ দেওয়ান শান্তিরাম নানাপ্রকার তত্ত্ব দেন ঘোষাল মহাশয়কে। এবার তাদের সঙ্গী হলেন মনসা রাম যিনি ছিলেন পাটনার প্রধান কুঠিয়াল। তিনি নবাব মীরকাসিমের দ্বারা উৎপীড়িত ও লুন্ঠিত হন।

                                         

                                (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২টি মন্তব্য:

  1. কত অজানা স্থানের সম্পর্কে জ্ঞাত হলাম। কৃষ্ণচন্দ্রের ভ্রমণ বর্ননা আমাকে আরো ভ্রমণ পিপাসু করে তুলছে। খুব সুন্দর বর্ণন ।
    শিউলি

    উত্তরমুছুন