সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
হুশিয়ারপুর থেকে ভাঙা নদী (ভাঙ্গি নদী) পার হয়ে পাহাড়ের শুরু। ক্রমে ক্রমে বর্তমান হিমাচল প্রদেশের বোটা, আমবাগ, (আম্ব), রাজপুরা, চম্পা হয়ে জ্বালামুখী পৌঁছানো হল।
সেখানে ধাপে ধাপে রাস্তা উপরে উঠেছে। রাস্তার দুপাশে দোকান। মন্দিরের চারদিকে পান্ডাদের বসতি। ভগবতীর জিহ্বা এখানে পতিত হয়েছিল। একে জালন্ধর পীঠও বলে ( কিন্তু এটি জালন্ধর বা জলন্ধর না । কেন লেখক এরকম লিখলেন?) চারদিকে পাহাড়ের মধ্যে মন্দির। রাজা রণজিৎ সিংহ প্রতিষ্ঠিত সোনার কলস চারদিকে, তার উপরে সোনার ছাতা, সামনে দুটি সোনার বাঘ আছে। মন্দিরের মধ্যে একটি জ্যোতি প্রজ্জ্বলিত আছে। রূপার সিংহাসনে জোয়ালাদেবী উপবিষ্ট আছেন। প্রসাদী দ্রব্য এই জ্যোতির কাছে আনলে অগ্নিদগ্ধ হয়। এই মন্দিরের উত্তরে গোরক্ষনাথের গদি। গোরক্ষনাথ এক যোগী ছিলেন, তিনি সাধনার দ্বারা মহাদেবীর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। এই গদির কাছে দুটি জ্যোতি আছে এবং তার নিকটস্থ কূপের জলে অগ্নির খেলা দেখা যায়।
এর উত্তরে পাহাড়ের মধ্যে বিল্বকেশ্বর শিব আছেন। তার নিকটও দুটি জ্যোতি প্রজ্জ্বলিত আছে। পর্বতের উপর নর্মদেশ্বর নামে শিবলিঙ্গ স্থাপিত আছে। আরো উপরে আছে উন্মত্তেশ্বরের মন্দির। এই পীঠের পরিক্রমা ৪৮ ক্রোশ। কালেশ্বর, চতুর্ভুজ নারায়ণ, কাশ্যপনাথ শিব, ত্রৈলোক্যনাথ শিব, অম্বিকা দেবী, শীতলা মাতা, কালভৈরব প্রভৃতি বহু তীর্থ পরিক্রমা করতে প্রায় তিন মাস সময় লাগে।
জোয়ালজির পান্ডারা পর্বতের উপরে বাস করে। পাণ্ডাদের কন্যারা অতি সুন্দরী। এক থেকে কুড়ি বছর পর্যন্ত বয়সী সব কন্যা মহাদেবীর মন্দিরে এসে যাত্রীদের কাছে অর্থ চায়। তাদের মনে কোন বিকার নেই। অল্প পেলেই সন্তুষ্ট। তারা অবাধে সর্বত্র বিচরণ করে ,অল্প পেলেই সন্তুষ্ট। খাদ্যদ্রব্য দিলে নিঃসঙ্কোচে খেয়ে নেয়। জোয়ালা দেবী দর্শন, পূজা, হোম, ব্রাহ্মণ কুমারীদের ভোজন পর্ব সমাপ্ত করে এবার লেখক চললেন পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
এবার যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয়ের লক্ষ্য মণিকরণ ও রেওয়াড়েশ্বর দর্শন। জ্বালামুখী থেকে ব্যাসা নদীর (বিয়াস নদী) নাদওনের ঘাটে এসে নৌকা পার হয়ে নাওদন শহরে এলেন। এটি কাংড়ার রাজা উমেদ চন্দ্রের রাজধানী। সেখান থেকে ফতেপুর, লম্বুডু, গোপালপুর হয়ে চার ক্রোশ চড়াই উঠে রাজার তলাও নামক পুষ্কারিণী ও শিব মন্দির। আরো দুর্গম চড়াই উতরাই পথে চার ক্রোশ পেরিয়ে রেওয়াড়েশ্বর কুণ্ডে পৌঁছানো হলো। বর্তমান হিমাচল প্রদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ এবং শিখ ধর্মস্থান রেওয়ালসার হলো এই স্থানের বর্তমান নাম। উতরাই পথে পান্ডারা এসে যাত্রীকে নিয়ে যায়। পাহাড়ের নীচে এসে কুন্ড। এই কুন্ডের তীরে মান্ডির রাজরানীর শিব মন্দির। সেখানে নর্মদেশ্বর শিব আছেন। সামনে কাল পাথরের নন্দী মূর্তি। কুন্ডের জল খুব গভীর। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দুই ক্রোশ পরিমাণ। কুন্ডের জলে সাতটি বেড়া আছে। বেড়া অর্থাৎ ভাসমান প্রস্তর, ওপরে মাটি, তার উপরে গাছপালা সহ এক একটি ভাসমান ছোট দ্বীপ। তার নাম বেড়া। এরকম ব্রহ্মা-বিষ্ণু -শিব-হনুমান-দুর্গা-গণেশ-ধর্মধারী অর্থাৎ লোমশ মুনির নামে সাতটি বেড়া। এর মধ্যে ছয়টি বেড়া সারা বছর ভেসে বেড়ায়। দুর্গার বেড়া শ্রাবণ ভাদ্র এই দুই মাসে ভেসে বেড়ায়। লেখক যখন কুঞ্জের কাছে গেলেন তখন বিষ্ণুর বেড়া ভেসে এলো। দর্শন ও পূজা করে তাঁর মনে হলো এত শ্রম করে আসা সার্থক। কীভাবে এই বেড়াগুলি জলে ভাসছে তা নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা পরীক্ষা হলেও তখনও পর্যন্ত তার কোন ব্যাখ্যা মেলেনি।
এই তীর্থে ভোট দেশ (তিব্বত) এবং মহা চীন দেশের অনেক মানুষ আসেন। তাঁরা খুব ধনী। তাঁরা ব্রহ্মার বেড়ার খুব মান্য করেন ও দান করেন,পাথরে নাম খোদিত করে যান। এখানে লেখক তিব্বত ও চীন থেকে আগত তীর্থযাত্রীদের কথা বলেছেন কারণ প্রবাদ আছে রিম্পোচি বা বৌদ্ধ ধর্মগুরু পদ্মসম্ভব তিব্বত থেকে রেওয়ালসারে উড়ে এসেছিলেন তপোবলে এবং এখানে দীর্ঘদিন তপস্যা করেছিলেন।
পরেরদিন লেখক পার্বত্য চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছালেন ব্যাসানদীর (বিয়াস নদীর) তীরে রাজা বনবীর সেনের রাজধানী মন্ডি (মান্ডি)। বনবীর সেনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর দশ বছরের পুত্র বিজয় সেন তখন রাজা। শহরের মধ্যে অতি প্রাচীন ভুতেশ্বর শিবের মন্দির ও পাহাড়ের ওপর শ্যামা কালী মন্দির আছে। মান্ডি নগরে একটি দেব মেলা হয়। রাজ্যে যত স্থানে যত দেব-দেবী আছেন শিব চতুর্দশীতে মাণ্ডিতে এসে উপস্থিত হন। সঙ্গে সকল পাহাড়ীরা। এই দেবদেবীদের সোনা-রুপার মুখ ও নানা রকম বস্ত্র দিয়ে সিঙ্গার (শৃঙ্গার) করানো হয়। দেবদেবীকে চতুর্দোলায় করে নৃত্য করায় মানুষেরা। রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতি হাতি, ঘোড়া, উটে চড়ে সোনা রূপায় সেজে, তুরী, ভেরী, নিশান, ছত্র, বল্লমসহ সুসজ্জিত হয়ে ভুতেশ্বর মন্দিরে যান। সেখানে সারাদিন ধরে ভারী চমৎকার নৃত্য চলে। এখানকার রাজার সোনা ও লবণের আকর (খনি) আছে তাই তিনি সমৃদ্ধশালী।
মান্ডি থেকে বিয়াস নদী নৌকায় পার হয়ে অতি ভয়ানক চড়াই উৎরাই পার হয়ে তারপর গৌরী নদী (উহল নদী) পার হয়ে কুমাদের হট্টি (কুমান্দ), বাউড়ি প্রভৃতি হয়ে যাত্রা। বাউড়িতে একপ্রকার মাছি আছে, কামড়ালে রক্ত পড়ে ও ক্ষতস্থান ফুলে ওঠে। ক্ষতের যন্ত্রণা সহজে সারে না। সেখানে অতি কষ্টে রাত্রি বাস। এইভাবে অত্যন্ত কষ্টকর পথে চড়াই উতরাই পথ চলতে চলতে বেজওর (বাজৌরি) এল। এটি কুলু রাজধানী। এখানে রাজার ভগ্নপ্রায় কেল্লা আছে। এখান থেকে আট ক্রোশ পূর্বে পান্ডবদের স্থাপিত এক শিবমন্দির আছে। আর আছে মহিষমর্দিনী, চতুর্ভুজ নারায়ণ, গনেশ মন্দির।
এরপর মশকে অর্থাৎ বড় বড় চামড়ার থলিতে হাওয়া ভরে তৈরি এক ধরনের বয়ার মতো বস্তুতে চড়ে বিয়াস নদী পার হতে হলো। এল পার্বতীয় নদী (পার্বতী নদী) ও ব্যাসানদীর( বিয়াস নদী) সঙ্গম। দুর্গম পথ পেরিয়ে বামুনকোঠী (সম্ভবত ভুনটার) আসা হলো। এখানে পাহাড়ি নারী-পুরুষ সকলের কম্বলের বস্ত্র পরিহিত, তারা সবাই মাছ-মাংস খায়। বৃষ্টি বরফপাতের মধ্যে অনেক বাদানুবাদ করে একটি ঘরে লেখকেরা আশ্রয় নিলেন। পরদিন আবার নদী পার হয়ে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে জরিগ্রাম (জরি) হয়ে এবারে তাঁরা পৌঁছলেন মণিকর্ণ তীর্থ (মণিকরণ)।
( চলছে )
এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২১ ফাল্গুন ১২৬২ (৫ মার্চ ১৮৫৬) থেকে ৫ চৈত্র ১২৬২ (১৯ মার্চ ১৮৫৬ )
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
হিমাচলের ভ্রমণ স্থান গুলোর বিষয়ে অনেক কিছুই নতুন করে অবগত হলাম। শিউলি
উত্তরমুছুনরেওয়াড়েশ্বর বা রেওলসার এর ইতিহাস এখন বাঙালিদের কাছে বিস্মৃতপ্রায়।
উত্তরমুছুন