পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৪

৩০। তীর্থ ভ্রমণ ১৫ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


  সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ            ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                  (আগের পর্বের পরে)

মণিকরণ কুলুর রাজা জগৎসিংহের প্রতিষ্ঠিত দেবালয়। মণিকরণে দুটি কুণ্ড আছে। নীচে যে কুন্ড আছে তাতে দুই হাত মতো জল আছে, জলে সামান্য স্রোত আছে। উপরে যে কুণ্ড আছে তাতে এক হাত জল। দুটি কুন্ডেই জল খুব উষ্ণ। স্পর্শ মাত্র হাত পুড়ে যাবে। সর্বদা ধোঁয়া উঠে অন্ধকার হয়ে আছে। কুন্ডের মধ্যে রান্নার কাঁচা দ্রব্য দিলে তা সুসিদ্ধ হয়ে যায়। এই কুন্ডের মধ্যে ভাত, খিচুড়ি, পায়েস, রুটি, ডাল প্রভৃতি রান্না করে অনেকে খায়। 


এই স্থান পূর্বে হরপার্বতিসহ বিভিন্ন দেবদেবীর বিহারের স্থান ছিল। বিহারকালে পার্বতীর কানের কুণ্ডল সহ মণি এখানে পড়ে যায়। শিব তখন ডাকিনী যোগিনীদের সেই মনি উদ্ধারে পাঠান। এক যোগিনী পাতালপুরীতে গিয়ে দেখেন নাগরাজের মাথায় রয়েছে সেই মণি। নাগরাজ তাকে দেখে রাগান্বিত হয়ে বলেন যে তিনি ধ্যান করছেন এই সময় স্ত্রীজাতির আগমন নিষিদ্ধ তাহলে এই যোগিনী কেন এখানে এসেছে। যোগীনির মুখে তারপর সব কথা শুনে নাগরাজ মণি নাসার অগ্রভাগে রেখে এক ফুৎকারে সেই মণি উপরে পাঠান। সেই ফুৎকারের পথে দুই উত্তপ্ত ধারা উঠে এসেছে আর এই স্থানের নাম হয়েছে মণিকরণ। 


এর পূর্ব সীমানায় ব্রহ্মনালে ব্রহ্মা তপস্যা করেছিলেন। ব্রহ্মনাল দর্শন করে উপরে উঠে ঈশান দিকে তাকালে কৈলাস পর্বত ধবলগিরি দেখা যায়। ওই পর্বতে চূড়ায় এক সুন্দর মন্দির আছে। ব্রহ্মনাল থেকে উপরে ১২ ক্রোশ গিয়ে মানতালাব বা মানসরোবর। বরফ সর্বদা পড়ে পথ অতি দুর্গম। এত সুন্দর মন্দির সেখানে আছে যা মনে হয় মানুষের তৈরি নয়। এখানে লেখক কৈলাস মানস সরোবরের কথা বলেছেন কিন্তু এখান থেকে কৈলাস বা মানসরোবর কোনটিই দেখা সম্ভব নয়। এই স্থান থেকে হরিন্দর পর্বত দেখা সম্ভব। এখানে লেখকের তথ্যে কোন ভুল হয়েছে। 


মণিকরণে তীর্থস্থান হল ব্রহ্মনাল, ত্রিধারা, লক্ষ্মীকুন্ড, রামচন্দ্রজির মন্দির, রামকুন্ড। এই তীর্থে কুলু রাজার লক্ষ্মীনারায়ণ, রঘুনাথজি, নৃসিংহ, রামচন্দ্রজি ও মুরলিধর এই পাঁচটি দেবালয় আছে। ফেরার পথে দর্শন করা হলো বিজলীশ্বর মহাদেব। এই বিজলীশ্বর লিঙ্গ নাকি প্রতি বারো বছর অন্তর বজ্রাঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তারপর সেই টুকরো জুড়ে আবার নতুন লিঙ্গ তৈরি করা হয়।


বামনকোঠি থেকে চার ক্রোশ দূরে ব্যাসা নদী কাঠের পুলে পার হয়ে রাজা জ্ঞানসিংহের রাজধানী কুলু শহরে এলেন তাঁরা। পাহাড়ের মধ্যে সুন্দর শহর, সব রকম জিনিস পাওয়া যায়। হিন্দু-মুসলমান সব জাতির বসবাস। কোম্পানির তহসিলদার ও পুলিশের কাছারি আছে কেল্লার মধ্যে। রাজবাড়ি আছে। রামসীতা ও নৃসিংহদেবের মন্দির আছে। এখানে পরশুরামের এক মন্দির আছে যার দুয়ার ১২ বছর অন্তর শ্রাবণ মাসে খোলা হয়। 


এবার কুলু থেকে বেজওর ,(বাজৌরা), কুমান্দ, জরু প্রভৃতি হিমাচল প্রদেশের বিভিন্ন স্থান দিয়ে পথ চলা। এখানে জলের খুব অভাব। ছয় ক্রোশ পার্বত্য পথ চলেছেন সম্পূর্ণ জল ছাড়া। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রসদ সংগ্রহ হয় তো কাঠ পাওয়া যায় না। কাঠ জোগাড় হয় তো ঝড়, শিলাবৃষ্টিতে সামান্য আশ্রয়ের পাথরের ছাদের ফাটল দিয়ে গলে গায়ে জল, শিলা পড়ে। এভাবে অতি কষ্টে তিনি সঙ্গীদের নিয়ে চলতে থাকলেন। ফুটাখ, হীরাবাগ, ভাঙাহাল এই সব হিমাচল প্রদেশের গ্রাম হয়ে এলেন বৈদ্যনাথ বা বৈজনাথ। সেখানে পর্বতের উপরে শিব মন্দির, নীচে ক্ষীরগঙ্গা। মন্দির থেকে ক্ষীর গঙ্গা ১৫০ সিঁড়ির নীচে। বৈজনাথে আছেন বৈদ্যনাথ, সিদ্ধিনাথ, কেদারনাথ, ইন্দ্রেশ্বর, গণপতেশ্বর, কাশীর বিশ্বেশ্বর, রাবণেশ্বর, ভূতেশ্বর ও মহাকাল - এই নয় অনাদি শিব। এখানে নানা রকম দোকান বাজার আছে। 


বৈজনাথ থেকে ব্যাবারন্যা (ভাওরনা) গ্রাম, পরওল (পরৌর), ধরমসা (ধরমশালা)  হয়ে ভাগশু আসা হল। এখানে পাহাড়ের উপর ভাগশু শিব আছেন। ভাগশুতে কোম্পানির ছাউনি, কাছারি ইত্যাদি হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আগত হয়ে কাংড়া কেল্লায় যাওয়া যায় এই পথে, তাই কোম্পানি এখানে খুব সজাগ পাহারা রাখে। এখানে রাজপুরুষদের আগমনে বরফ  আচ্ছাদিত হলেও ভালো শহর গড়ে উঠেছে। 


এবার কাংড়া যাওয়ার পথে আশ্চর্য সাধুকে দেখলেন সর্ব্বাধিকারী মহাশয়। তাঁর নাম মস্তরাম বাবা, বয়স ১০০ বছরের বেশি। কিন্তু তাকে দেখে পঞ্চাশ বছরের বেশি মনে হয় না, এমন সবল। কুষ্ঠ রোগী, মৃগী রোগী স্পর্শ মাত্র সুস্থ করতে পারেন। এরপর এলো নগরোট (নগরোটা ভগবান)। তার চার ক্রোশ দূরে কাংড়ার দেবীর ভবন। দেবীর নাম ব্রজেশ্বরী। এখানে সতীর স্তন পতিত হয়েছিল। পূর্বে যে প্রাচীন মন্দির ছিল তার উপর পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিংহ কাংড়া অধিকার করার পরে নতুন মন্দির তৈরি করে দিয়েছেন। প্রস্তর নির্মিত স্বর্ণমণ্ডিত এই মন্দিরে রুপার সিংহাসনে, রুপার পত্রে দেবীর প্রতিমূর্তি গঠিত করে দিয়েছেন। আসল মূর্তি গোলাকার পাথরের, তা পুষ্প চন্দন বস্ত্র দ্বারা শোভিত। দেবীর মন্দিরের পান্ডাদের দেবীরূপা কন্যারা যাত্রীদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সরল মনে। মহাদেবের মন্দির থেকে দুই ক্রোশ চড়াইয়ে কাংড়া রাজার কেল্লা। কেল্লার মধ্যে অম্বিকাদেবী ও কালভৈরব রক্ষক। কেল্লার পশ্চিমে পাতালগঙ্গা ও তারপর জয়ন্তী পর্বত। পর্বতের মাথায় জয়ন্তী দেবী ও তালেশ্বর শিবের মন্দির। এই স্থানকে কপাল পীঠ বলে। কাংড়া শহরের শ্রীহ্রাস হয়েছে কারণ ভাগশুতে কোম্পানীর সব দপ্তর, বাজার চলে গেছে। কেল্লায় এখন কিছু ইংরাজ সৈন্য আছে। রাজা সংসারচন্দ্র সপরিবারে  ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নেনডোর পাহাড়ে বন্দী আছেন। কেল্লা থেকে এক ক্রোশ দূরে বাণগঙ্গা ও পাতাল গঙ্গার সঙ্গমস্থল। সেখানে ৩৬০ টি তীর্থস্থান আছে। 


কাংড়া থেকে গণেশঘাঁটীর পাহাড়ের সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে যাওয়া হলো। কোম্পানি বারুদের দ্বারা পর্বত উড়িয়ে (ডিনামাইট দিয়ে) সুরঙ্গ তৈরি করেছে। এভাবে রাণীতলাব, রামপুরা হয়ে জ্বালামুখীতে আবার আসা হলো। আবার দর্শন, পূজন করে ডেরাগ্রাম (ডহরা গোপীপুর) হয়ে চিন্তাপূর্ণী দেবীর (চিন্তাপূর্ণী মন্দির, হিমাচল প্রদেশ) দর্শনের উদ্দেশ্যে যাওয়া হল। এটি ভগবতী ছিন্নমস্তা দেবীর মন্দির। সেখান থেকে হুশিয়ারপুর (হোসিয়ারপুর)  হয়ে গেলেন রাজেশ্বরী মন্দির। 


সেখান থেকে জেজো, সন্তকগড়, বরমপুর, কোটগ্রাম হয়ে পার্বত্য পথে লেখকেরা পৌঁছলে নয়না দেবী মন্দিরে (হিমাচল প্রদেশের)। নবরাত্রীর মেলায় এখানে অনেক মানুষ একত্র হয়। পান্ডাদের ঘর থেকে ৪০৬ ধাপ সিঁড়ি উঠে নয়না দেবীর মন্দির। সেখানে ধর্মশালা আছে। প্রথমে দেবীর পদচিহ্ন ও দুটি বাঘের মূর্তি দেখা যায়। তারপর দেবীর মন্দির। এ ছাড়া শিবকালী, লক্ষ্মীনারায়ণ, বটুক ভৈরবের মূর্তি আছে। এখানে সতীর নয়ন পড়েছিল তাই নয়নাদেবী বলে। দেবী অষ্টভুজা, সামনে বাঘের মূর্তি আছে। ওই ভবনের আধ ক্রোশ নীচে একটি সুড়ঙ্গে বটুক ভৈরব গুপ্তভাবে আছেন। ওই সুড়ঙ্গ পথে পূজা দিতে হয়। এখানে পান্ডাদের কন্যারা যাত্রীদের থেকে অর্থ ভিক্ষা করে দেবীরূপা হয়ে। তাছাড়া পান্ডাদের বালকেরাও অর্থ চায়। 


কোটগ্রাম (কোট), বরমপুর হয়ে সন্তোকগড় এল। এটি রাজা রামসিংহ জায়গীরদারের কেল্লা। এরপর জেজো, মানপুর হয়ে হিমাচল প্রদেশের হুশিয়ারপুর এলো। এখানে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি, সেনা ছাউনি, ডাকঘর, গির্জা, সাহেবদের বাংলো আছে। এখানে গুরু নানকের মেলা হয়।


লেখক এবার হরেনা (হরিয়ানা, পাঞ্জাব), ফাগুড়া (ফাগওয়াড়া, পাঞ্জাব) হয়ে সতলেজ (শতদ্রু) নদীতে নৌকার পুল পার করে লুধিয়ানা পৌঁছলেন। সেখানে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টরদের কাছারি আছে। এবার তিনি যান অম্বালা (আম্বালা)। এটি একটি বড় শহর, বিরাট সেনা ছাউনি আছে। অনেক রকম দোকান বাজার আছে আর অনেক বাঙালি আছে।  সেখান থেকে হরিয়ানার সাহাবাদ, পিপলি, কর্ণাল, পানিপথ, সামহান হয়ে দিল্লির কাবুলি দরজাতে এসে পৌঁছালেন।


                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৫ চৈত্র ১২৬২ (১৯ মার্চ ১৮৫৬) থেকে ১৫ বৈশাখ ১২৬৩ (২৮ এপ্রিল ১৮৫৬)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২টি মন্তব্য:

  1. মনিকরণ নামকরণের ইতিহাস টা জানতে পারলাম এই পর্বে। মনিকরণের উত্তপ্ত জলের ধারায় আজও একই ভাবে খাবার পরিপাক হয় আর তা গুরুদুয়ারা তে ভক্ত দের পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এই পর্বের বেশিরভাগ দর্শনীয় স্থান গুলো দেখার সৌভাগ্য হেতু আমার পরিচিত তাই আবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সবটা। খুব ভালো লাগল পর্ব টা।শিউলি

    উত্তরমুছুন
  2. বর্তমানের ভ্রমণ সংবাদ পরিবেশনের জন্য অনেক ধন্যবাদ 🙏

    উত্তরমুছুন