সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
এবার গঙ্গা নদীতে জলপথে প্রয়াগ থেকে কাশী যাত্রা। সারাদিন বজরা চলে। মাঝে মাঝে চড়াইয়ে বজরা নোঙর করে রান্নাখাওয়া হয়। এভাবে চলার পর চতুর্থ দিন এলো বিন্দুবাসিনী বা বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মন্দির। দেবী সিংহবাহিনী, চতুর্ভূজা। তাছাড়া আছেন মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী মূর্তি। গঙ্গাতীর থেকে এক ক্রোশ দূরে পাহাড়ের (বিন্ধ্য পর্বত) উপর যোগমায়া দেবীর অষ্টভূজা মূর্তি সম্বলিত মন্দির। এছাড়া বটুক ভৈরব সহ অন্য নানা দেবদেবীর মন্দির। বিন্দুবাসিনী মন্দিরের চারদিকে পাণ্ডাদের বসতি, অনেক দোকানও আছে। প্রতিদিন মহাকালীর সামনে অনেক বলিদান হয়। বিন্দুবাসিনী মন্দিরের ভিতর এক কক্ষ (কাঠরা) আছে, যার মধ্যে যাত্রীদের ঢুকিয়ে পান্ডারা দরজা বন্ধ করে দেয়। ভোগ ইত্যাদি বাবদ টাকা পয়সা যতক্ষণ না আদায় হয় সেই কক্ষের দরজা তারা খোলে না। সুন্দরী কুমারীরাও পয়সার জন্য মন্দিরে চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। অনেক সন্ন্যাসী এই স্থানে তপস্যা করেন।
দুই ক্রোশ দূরে মির্জাপুর (মৃজাপুর) একটি বড় শহর। অনেক বাঙালি এখানে ব্যবসা করে। গঙ্গার ঘাটগুলি পাথরে বাঁধানো ও সেখানে সুন্দর সুন্দর মন্দিরে শিব স্থাপিত আছে। শহরের মধ্যে ইঁট ও পাথরের তৈরি বাড়ি ও মন্দির সুগঠিত। শহরের রাস্তা পাথর দিয়ে তৈরি, নর্দমাও পাথরের। এখানে সরকারি নানা রকম কাছারি আছে।
এবার বজরা এলো চন্ডালগড় (চুনার)। পাহাড়ের উপর কেল্লা। এই কেল্লা পূর্বে চন্দ্ররাজার ছিল, পরে রামনগরের রাজা অধিকার করেছিলেন। এখন তা কোম্পানি অধিকার করেছে। এখানে বেশ কিছু সাহেবদের বাংলো আছে।
চন্ডালগড় থেকে তিন ক্রোশ দূরে ছোট কলকাতা, এখানে সাহেবদের বাংলো, কোম্পানির সেনা ছাউনি আছে বলে এই নাম হয়েছে। এরপর এলো রামনগর এখানে রাজার বাড়ি ও ব্যাসদেব স্থাপিত শিব এবং ব্যাসের মূর্তি আছে। তাই একে ব্যাস কাশীও বলে।
রামনগর থেকে কাশীধামের অসির ঘাট আধ ক্রোশ আর বরণা নদীর ঘাট তিন ক্রোশ। এবার দ্বিতীয়বার লেখক কাশীতে এলেন। পঞ্চক্রোশী কাশী অর্ধচন্দ্রাকৃতি। বিশ্বেশ্বরের মন্দির মহারাজ রঞ্জিত সিংহ সুবর্ণমণ্ডিত করে দিয়েছেন। মন্দিরের অমূল্য রত্ন ভান্ডার আছে। মন্দিরে চারটি দ্বার। পশ্চিম দ্বারের সামনে নাটমন্দির। তার মধ্যে রাজা হরিশচন্দ্রের স্থাপিত শিব। এছাড়া চতুর্দিকে পার্বতী, অন্নপূর্ণা, অবিমুক্তেশ্বর প্রভৃতি দেবদেবীর মন্দির আছে। উত্তরদিকে জ্ঞানবাপী নামে এক কূপ আছে। মুকুন্দ ব্রহ্মচারী (প্রয়াগ সংক্রান্ত পর্ব দর্শণীয়) যখন কাশীধামে আসেন, বিশ্বেশ্বররের পূজার জলের সন্ধানে মাটি নিজের হাতের মুঠির আঘাত করলে যোগবলে ভগবতী উঠে আসেন, এই সেই কূপ।
উত্তর দিকে বিশ্বেশ্বরের পুরনো মন্দির আছে। বিশ্বেশ্বর গুপ্ত হয়েছেন সেখানে কারণ আওরঙ্গজেব বাদশাহ ওই মন্দিরের প্রতি "অত্যাচার করে" মসজিদ ও বিশ্বেশ্বরের মন্দির ভেঙে তার উপরে আপন কবরস্থান নির্মাণ করেছেন (যদিও তাঁর কবর আওরঙ্গবাদ, মহারাষ্ট্রতে)। কাউকে সেখানে তারা ঢুকতে দেয় না। কেউ কেউ (হিন্দু) বহু স্তব স্তুতি করে ও রক্ষকদের পুরস্কার দিয়ে ওই স্থানে যোগ সাধনে যেতেন বলে শোনেন লেখক।
এরপর লেখক কাশীধামের প্রধান তীর্থস্থানগুলি বর্ণনা করেন। যেমন অন্নপূর্ণা, কেদারঘাটে কেদারেশ্বর, শ্মশানেশ্বর, তিলভাণ্ডেশ্বর, লোলার্ক তীর্থ, দুর্গাকুণ্ড। কাশীধামের যাত্রাগুলির বিষয়েও তিনি বলেন। দক্ষিণ মানস যাত্রা, পশ্চিম মানস যাত্রা, উত্তর মানস যাত্রা, এ ছাড়া পাঁচ, সাত ও নয় দিনের পঞ্চক্রোশী যাত্রাও করেন পুণ্যার্থীরা।
উত্তর মানসের একটি তীর্থস্থল হলো লাট ভৈরব। এখানে ভৈরবের দন্ড ও ভৈরবের যাতা আছে। কাশীতে পাপকর্ম করলে ভৈরবের দন্ড ও যাতাতে ছয় হাজার বছর ধরে পেষিত হতে হয় বলে প্রচলিত আছে। এই যাতা নিয়ে হিন্দু ও মুসলমানের বিবাদ হয়। ওই স্থানে মুসলমানেরা মসজিদ করতে শুরু করলে হিন্দুরা বাধা দেয় ও মুসলমানদের পরাভূত করে। পরে রাতে মুসলমানেরা যাতার চারদিকে আগুন দেয়, কিন্তু যাতার হানি হয় না। এবার গোরক্ত দিয়ে আগুন দেওয়া হলে যাতা ভেঙ্গে যায়। সকালে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা শুরু হয়। তখন কাশীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মাধ্যক্ষ জজ রেনলিক হিন্দুদের অনুমতি দেন মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার। হাজার হাজার মুসলমান হত হয়। যারা বেঁচে গেল তাদের মুখে শূকরের রক্ত, গোবর ইত্যাদি দিয়ে, কর্ণচ্ছেদ করে, মুসলমানদের দেবালয়ে শুকর ছেদন করে, তাদের স্ত্রীগণের দুরবস্থা করে হিন্দুরা অত্যাচার চালায়। অনেক মুসলমান দেশ ত্যাগ করে। পরে সাহেবরা এসে হিন্দুদের শান্ত করে তাদের তামার যাতা তৈরি করে দেন। এখন সেই যাতাই আছে।
কাশী শহরের বাড়িগুলি পাথরের তৈরি। বড় বড় তিন থেকে পাঁচতলা উঁচু। দুপাশে বাড়ির মাঝে দেড় হাত প্রমাণ গলিপথ। শহরে পাঁচ হাজার ফটক আর এক এক ফটকের মধ্যে পাঁচ, ছয়, সাতটি গলি আছে। গলিতে ঢুকে পথ চেনা খুব শক্ত। কাশীতে অনেক চক ও বাজার আছে। তাছাড়া প্রতি মহল্লাতে অনেক দোকান ও পানের দোকান আছে। সাটিন, মখমল, বারাণসী তিল্লার কাজে নীলাম্বরী পীতাম্বরী শাড়ি পাওয়া যায়।
কাশীতে তীর্থদর্শনের বর্ণনা প্রথমবার কাশী ভ্রমণপর্বে দেওয়া হয়েছে বলে এখানে আর পুনরাবৃত্তি করা হলো না।
এবার লেখক বাড়ি ফেরার জন্য উদ্যোগী হলেন। নানারকম বাধাবিঘ্নের পর জ্যৈষ্ঠমাসে নৌকায় গমনের কথা হলে মাঝি বললো যে এখন ঝড়-বৃষ্টি সময়ে নৌকায় যাওয়া যাবে না। আষাঢ়মাসে যাওয়া যেতে পারে। সঙ্গীরা জলপথে না দিয়ে ডাকগাড়িতে (ঘোড়ার গাড়ি) যাওয়া কথা ঠিক করলেন। তখন খবর এলো মিরাট ও দিল্লিতে নানা অঘটন ঘটেছে। কলকাতা যাওয়ার রাস্তা শিগগির বন্ধ হয়ে যাবে। এবার শুরু হল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ। সিপাহী বিদ্রোহের বিশদ বিবরণ লেখক দিয়েছেন, কিন্তু এই ভ্রমণ সংক্রান্ত আলোচনায় তার প্রয়োজন নেই বলে সেটা উপস্থাপন করা হলো না। বিদ্রোহ চলাকালীন লেখক কাশীতেই থাকেন। কাশীতে বিদ্রোহের তেমন প্রভাব পড়ে নি।
লেখক কাশীর বিভিন্ন তীর্থস্থানে দর্শন, পূজন, তর্পণ করতে থাকেন। ভাদ্রমাসে গঙ্গার জল এত বৃদ্ধি পায় যে গত কুড়ি বছরে সেরূপ হয়নি। কাশীর পুষ্করভাস্কর তীর্থে গঙ্গার জল পৌঁছায়, মণিকর্ণিকা ঘাটের চক্রতীর্থের ইন্দ্রদুমনেশ্বর শিবের মস্তকের ওপর দিয়ে গঙ্গার জল প্রবাহিত হয়ে সেই সব তীর্থের মাহাত্ম্য বেড়ে যায়। ফলে সবাই ওই স্থানগুলোতে পুণ্যস্নান করে। এছাড়া তিনি এই সময় লক্ষ্মীকুণ্ড মেলা, তিলতৃতীয়া ব্রত, গণেশ চৌথ, বরণা যাত্রা ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান দর্শন করেন।
৩ আশ্বিন ১২৬৪ সূর্য গ্রহণ হয়। সূর্যগ্রহণকালে নানা দেশের রাজা ও ধনী ব্যক্তিরা এবং সাধারন মানুষরা কাশীর গঙ্গায় স্নান করতে আসতো। কাশীর পাণ্ডাদের এই সময় বিশাল অর্থলাভ হতো। এক একজন রাজা সোনায় মোড়া হাতি, ঘোড়া দান করতেন। কিন্তু এই বছর কোম্পানি সরকারের কাছে খবর এলো যে এই উপলক্ষে ছদ্মবেশে বিদ্রোহীরা কুমার সিংহ (বিহারের ভোজপুরের কুনওয়ার সিং) ও কানপুরের নানা সাহেবের নেতৃত্বে কাশীতে প্রবেশ করবে। তাই সরকারের কর্মকর্তারা স্থানে স্থানে পথ বন্ধ করে বন্দুকসহ প্রস্তুত থাকলো আর সব আসা-যাওয়া, নৌকা পারাপার বন্ধ রাখল। অন্য কোন জায়গার মানুষকে কাশীতে ঢুকতে দিলো না। ফলে পাণ্ডাদের বিশেষ অর্থক্ষতি হলো।
এরপর লেখক কাশীতে শারদীয়া দুর্গাপূজা দেখেন। কাশীর বাঙালিরা দুর্গাবাটিতে (পুরনো দুর্গাবাড়ি, বেনারস) দুর্গোৎসব করেন। নবরাত্রির মেলাও হতো সেখানে নয় দিনব্যাপী। কাশীতে বলিদান নিষিদ্ধ কিন্তু দুর্গাবাড়িতে শুধু বলিদান হতে পারতো।
(চলছে)
এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১১ পৌষ ১২৬৩ (২৬ ডিসেম্বর ১৮৫৬) থেকে ১৬ আশ্বিন ১২৬৪ (১ অক্টোবর ১৮৫৭)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
কাশী ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়ে অনেক অজানা জায়গার সম্পর্কে জানলাম আর কয়েকটি পরিচিত জায়গার বিবরণ আবার সামনে আসলো। শিউলি
উত্তরমুছুনভবিষ্যতে কাশী গেলে অজানা জায়গাগুলো নিশ্চয়ই দেখবেন। 😊
উত্তরমুছুনএই ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়ে অজানা স্থান গুলোর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করছি সেকারণেই অজানা স্থান গুলো ভ্রমণের বিশেষ আগ্রহ থাকলোই ।ধন্যবাদ 🙏
উত্তরমুছুনখুব ভালো কথা। ধন্যবাদ 🙏
উত্তরমুছুন