পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৪

৩৪। তীর্থ ভ্রমণ ১৯ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                   (আগের পর্বের পরে)

অবশেষে ১৭ আশ্বিন ১২৬৪ সালে দেশে ফেরার জন্য কাশী থেকে নৌকায় যাত্রা করা হলো। 


প্রথমে কিছুদিন বিহারের গাজিপুরে থাকা হল। গাজিপুর ভালো শহর। ৫০০০ ঘর আছে। প্রধানত মুসলমানদের বাস। নানা রকম দোকান বাজার আছে। গাজিপুরে নানা রকম উত্তম মানের কাপড় তৈরি হয়। তাছাড়া গোলাপের আতর তৈরি ও বিক্রি হয় প্রচুর। গাজিপুরের পূর্বের নাম গাধিপুর। গঙ্গাতীরে লর্ড কর্নওয়ালিসের সমাধি আছে। 


নদীপথে তারপর এলো বগসর বা বক্সার। এখানে কোম্পানির সিপাহীদের প্রয়োজনীয় ঘোড়ার প্রজনন ও প্রতিপালন করা হয়। ক্রমে ক্রমে বিহারের ত্রিভবানী (তরিয়ানি ছাপরা?), সারন-ছাপরা (ছাপরা), দানাপুর ( দানাপুর), বাঁকিপুর (বাঁকিপুর) হয়ে নৌকা চলতে থাকলো। এইসব স্থান কুমার সিংহ বা কুনওয়ার সিং-এর এলাকা, তাই কোম্পানি খুব সতর্ক। এবার তাঁরা পাটনা এলেন। 


পাটনা খুব প্রাচীন শহর। পাঁচ ক্রোশ বিস্তৃত এই শহরে এক লক্ষের বেশি হিন্দু ও মুসলমানের বসবাস। চকের বাজার খুব বড় ও সুসজ্জিত। জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর, কমিশনারদের কাছারি, ডাকঘর, আফিমের কুঠি, সেনা ছাউনি, সাহেবদের বাংলো সব নিয়ে জমজমাট শহর। পাটনায় পাটনদেবী আছেন। আগে পাটনার নাম ছিল পাটন। সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাবে পাটনায় অন্য জায়গার লোকেদের রাত দশটার পরে রাস্তায় চলাচল শক্ত। তিনবার জিজ্ঞাসা করে উত্তর না পেলে গুলি করার হুকুম আছে। শহরের দোকানদারের বিক্রি ভালো হয় না। লুটের ভয়ে তারা দোকানে বেশি জিনিস রাখে না। 


এই অস্থির পরিস্থিতিতে লেখক দুজন সঙ্গীর সঙ্গে পালকি করে চললেন গয়ার উদ্দেশ্যে। বর্ষার জন্য রাস্তার অবস্থা খারাপ। কোন কোন নদীর কাঠের পুল ভেঙ্গে গেছে, একটা তাল গাছের কাণ্ডের উপর দিয়ে নদী পার হতে হল। পুনপুনা তীর্থে স্নান তর্পণ করে মশৌরী গ্রাম (মাসুরী), জাহানা (জাহানা), মকদমপুর (মকদমপুর) হয়ে গয়া এসে পৌঁছানো হলো। সেখানে বাঙালি এবং গয়ালীরা শ্যামাপূজা করেছে দেখলেন। গয়ার দোকান বাজারের আগের মত সুসজ্জিত অবস্থা নেই। ব্যবসায়ীরা খুব কষ্টে আছে। সাহেবদের থাকার বাংলো, কাছারি, ডাক্তারখানা, জেলখানার অংশ পুড়ে গেছে এই বিদ্রোহে। বাঙালিরা অনেকে স্ত্রী-পুত্র-পরিবারকে দেশে পাঠিয়েছে। মন্দির রাতে বন্ধ হয়ে যায়। চারদিকে ত্রাসের পরিবেশে ডাকাতি সন্ত্রাস চলছে। মানুষ টাকা পয়সা দামি জিনিস মাটির তলায় পুঁতে রেখে মলিন পোশাকে ছদ্মবেশে আছে। এর মধ্যে গয়ায় পূজা, স্নান, পিণ্ডদান করে লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা আবার পাটনা ফিরে এলেন। 


এবার পাটনার গঙ্গার ঘাটে লেখক ছট বা ষষ্ঠী ব্রত দেখলেন। শহরের সমস্ত স্ত্রীলোক উত্তম বস্ত্রালঙ্কারে সেজে; পালকি, ডুলি, পদব্রজে; রওশান চৌকি, টিকারা, তাসা, কাড়া বাদ্য সমবিহারে; নানা জাতীয় ফল, পাঁচকলাই-এর অঙ্কুর, নানা রকম পুরি, কচুরি জাতীয় খাদ্যদ্রব্য আর কাঁদি কাঁদি পাকা কলা; নতুন প্রদীপ, আলতা, হরতকি, বয়রা, পান সুপারি নিয়ে গঙ্গার ঘাটে উপস্থিত। সূর্যোদয়ে সকলে গঙ্গাস্নান ও সূর্য পূজা করে ঘরে ফেরে। সেদিন কারো বাড়িতে রান্না হয় না, আগের দিনে তৈরি খাবার খায় সবাই। এই উপলক্ষে আগের দিন থেকে মোট তিন দিন মেলা হয়। 


১১ কার্তিক ১২৬৪ সালে পাটনা থেকে গঙ্গায় নৌকা যোগে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন সবাই। মারুগঞ্জ (মারুফগঞ্জ), বৈকন্ঠপুর (বৈকুন্ঠপুর), রূপসগ্রাম (রূপসপুর) হয়ে নৌকা চলল। রূপসের কাছে দস্যু জালেম-জোলম-এর ঘর। এই দস্যুরা নৌকা লুট করতো, মহাজনকে চিঠি দিয়ে আক্রমণ করতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই দস্যুদের দমন করে প্রাণদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু এখন সিপাহী বিদ্রোহের রাজদ্রোহীদের লুঠতরাজ সেইসব ডাকাতের থেকেও বেশি ভয়ানক হয়েছে। এরপর বাড়গ্রাম (বাড়ধ), দরিয়াপুর হয়ে মুঙ্গের এলো। 


গঙ্গা তীরের বাজারে সব রকম জিনিসের সুসজ্জিত দোকান রয়েছে। ব্যাধেরা পাখি ধরে বাজারে বিক্রি করছে। পাথরের ভালো ভালো থালা বাটিও বিক্রি হচ্ছে। মুঙ্গের থেকে জলপথে দুই ক্রোশ গিয়ে পাহাড়ের কাছে সীতাকুন্ড। প্রাচীরে ঘেরা এই কুন্ডতে জলে গরম ধোঁয়া উঠছে, জল এত গরম যে স্নান করা যায় না এছাড়া রামকুন্ড, লক্ষণকুন্ড, ভরতকুন্ড, শত্রুঘ্নকুন্ড প্রভৃতি ঠান্ডা জলের কুণ্ড আছে। মুঙ্গের থেকে পদব্রজে আট ক্রোশ দূরে জাঙ্গীরায় (জাহাঙ্গীরায়) গেলেন তাঁরা। এই স্থান জহ্নুমুনির তপস্যার স্থান। যিনি গঙ্গাকে গন্ডুষে পান করে নিয়েছিলেন। পাহাড়ের চারপাশ গঙ্গা বেষ্টিত। পাহাড়ের উপর জহ্নুমুনি স্থাপিত শিবমূর্তি। এই পাহাড়ে এত বড় বড় সাপ আছে যে কেউ সেখানে থাকতে পারেনা। এরপর নৌপথে ক্রমে ক্রমে বিহারের ভাগলপুর, ইংলিশের বাজার, কহলগাঁর বাজার (কহলগাঁও) এলো। এইসব স্থানে গঙ্গা খুব বেগবতী, জলের তলায় পাথর ও ডুবো পাহাড় থাকায় অতি সাবধানে নৌকা চালাতে হয়। তারপর পাথরঘাটা (পাথরঘাটা পাহাড়, ভাগলপুরের বটেশ্বর স্থানের নিকটে অবস্থিত), পীরপৈতি,  সাঁকড়িগলির পাহাড় (সকরি গলি) হয়ে এল রাজমহল। 


এখান  থেকে বিহার শেষ হয়ে বর্তমান ঝাড়খন্ড শুরু হল। রাজমহল দোভাষী দেশ অর্থাৎ হিন্দি বাংলা দুই ভাষাই সমান চলে। অনেক বনজঙ্গল কেটে আস্তে আস্তে শহর হয়ে উঠেছে রাজমহল। ম্যাজিস্ট্রেট, কাছারি, ডাকঘর, ডাক্তারখানা, রেলরোড অফিস ইত্যাদি আছে। এরপর শিবগঞ্জ (সাহেবগঞ্জ) এল। এখানে চাল আর তসরের কাপড় সস্তা। মহাজনেরা এখান থেকে এইসব দ্রব্য পশ্চিমে ব্যবসার জন্য নিয়ে যায়। এরপর গঙ্গা ও পদ্মার সঙ্গম এল। আরো দুই ক্রোশ এসে ভাগীরথীর পুরনো মোহনা। জল খুব কম, নৌকা যাওয়ার পথ নেই। পরে এক ক্রোশ এসে আর এক মোহনা, তাও বন্ধ। আরও এক ক্রোশ এসে পদ্মা থেকে খাল কেটে জল এনে গঙ্গাতে মেশানো হয়েছে তা দিয়ে নৌকা যাতায়াত করছে। 


এবার ঝাড়খন্ড পেরিয়ে লেখকেরা তৎকালীন বাংলা বা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের এলাকায় ঢুকলেন। ক্রমে ক্রমে জঙ্গিপুর (জঙ্গিপুর), বালানগর (বালানগর), গয়সাবাদ (গয়সাবাদ), জিয়াগঞ্জ হয়ে মুর্শিদাবাদ। এখানে লেখক দেখলেন নবাবের ইমামবাড়া, নবাবের মহল। নবাবের মহল তিন তলা, সাত দেউড়ি ও হাজার দরজা জানলা দেওয়া (হাজারদুয়ারি)। এক এক দেউড়িতে এক এক জন দারোগা আছে। প্রায় এক ক্রোশ পর্যন্ত নবাবের পরিবারের বাড়িঘর আছে। তাছাড়া আছে চাঁদনী চক। এখানে নানা দেশের সওদাগরেরা উত্তম পসরা দিয়ে দোকান সাজিয়েছে। রাস্তা লন্ঠন দিয়ে আলোকিত। গঙ্গার তীরে বৈঠকখানার ঘর (বসে গঙ্গা উপভোগ করার স্থান) সাজানো আছে। গঙ্গা তীরে কামান পোতা ছিল, সিপাহী বিদ্রোহ কালে সমস্ত কামান, বন্দুক, পিস্তল, তলোয়ার কোম্পানি সরকার উঠিয়ে নিয়ে গেছে। নবাবের প্রহরীরাও শুধু লাঠি দিয়ে দ্বার রক্ষা করছে। 



নবাবের একশ জন বেগম আছে। তাদের পাহারায় আছে খোজা প্রহরী। নবাবের দরবারে আদব কায়দা, সেলাম নাকিব, ফুকারা সবই বজায় আছে। কিন্তু নবাবের কাছে দুজন সাহেব থেকে রাজনীতি ও  বিদ্যাভ্যাস করাচ্ছে। ১৭৫৭ -তে পলাশীর যুদ্ধের ও ১৭৬৪ -তে বক্সার যুদ্ধের পরাজয়ের পরেও বাংলায় নবাবী প্রথা চালু ছিল। ১৭৬৫ থেকে কোম্পানি বাংলার দেওয়ানী লাভ করে কিন্তু নবাব রইলেন বাংলা নিজামত হিসাবে। ১৭৯৩ থেকে এই নবাবী শুধু নামমাত্র নবাবীতে পরিণত হয় এবং এটি বজায় থাকে ১৮৫৮ পর্যন্ত, যখন ব্রিটিশ রাজশক্তি সরাসরি এদেশের শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে নবাবদের থাকার জন্য হাজারদুয়ারি প্রাসাদ তৈরি হয়। ব্রিটিশরা অর্থাৎ কোম্পানির রাজ পুরুষরাও এই প্রাসাদ ব্যবহার করতেন। বাংলার নবাব উপাধি সম্পূর্ণভাবে রদ করা হয় ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে। 


মুর্শিদাবাদ শহরে জগৎ শেঠ, রাজা হরিনাথ কুমার, রায় সাহেব প্রভৃতি ধনীদের ভালো ভালো দোমহলা, তেমহলা, চৌমহলা ইঁটের তৈরি, চুনকাম করা বাড়ি আছে। সেই সব বাড়ির বৈঠকখানা ঝাড়লন্ঠন, আয়না, কৌচ, কেদারা দিয়ে সাজানো। মুর্শিদাবাদে অনেক আরবী আর পার্সি ভাষায় পারদর্শী মৌলবী আছেন। 


এরপর এলো বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার কাশিমবাজার, সয়দাবাদ ,খাগড়া। খাগড়ার কাঁসার বাসন ও চিনির মুড়কি খুব বিখ্যাত। এই মুড়কি খাঁটি ঘীয়ে ভাজা ও রসে পরিপূর্ণ। তারপর বহরমপুর এলো। এখানে কোম্পানির নানা রকম কাছারি, সেনাছাউনি আছে। দেশী পদাতিক যারা সেনাছাউনিতে আছে তাদের কাছে আগে বন্দুক, তরবারি এসব ছিল। এখন তারা শুধু সরু লাঠি নিয়ে প্রহরীর কাজ করে।

                       (চলছে)

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১৭ আশ্বিন ১২৬৪ (২ অক্টোবর ১৮৫৭) থেকে ২১ কার্তিক ১২৬৪ (৬ নভেম্বর ১৮৫৭)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২টি মন্তব্য:

  1. কাশী ভ্রমণের পর বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জায়গা হয়ে বাংলায় মুর্শিদাবাদ শহরের বিভিন্ন স্থানের বিষয়ে জেনে সমৃদ্ধ হলাম। শিউলি

    উত্তরমুছুন