সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
আবার নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী। বৃন্দাবন থেকে প্রথমে এলেন চৌমুয়া (চৌমুহান)। সেখানে রাস্তার পূর্বদিকে কোম্পানির শাসন আর পশ্চিম দিকে ভরতপুর, জয়পুর প্রভৃতি রাজাদের শাসন। যেসব রাজারা স্বাধীনতা রেখেছেন তাঁদের নুন, আফিম, ভাঙ, চরস, গুড় ইত্যাদি নিজ রাজ্যে আনার জন্য কোম্পানিকে মাশুল দিতে হয়। বিনা মাশুলে যাতে কোন দ্রব্য যেতে না পারে তা দেখার জন্য কোম্পানি এখানে চৌকি ঘর বানিয়েছে। সাওয়া গ্রাম (?), কুশী (কোশী), হোড়েল গ্রাম (হোদল), পরওল গ্রাম (পলওয়াল) হয়ে বল্লভগড় পৌঁছলেন তিনি। বল্লভগড় ভরতপুর রাজার রাজ্য। এখানে কেল্লা, রাজবাড়ি আছে। এই শহর থেকে রাজা দিল্লি যাওয়ার নতুন রাস্তা তৈরি করছেন। সেখান থেকে ফরিদাবাদ গিয়ে বাদশাহী সরাইয়ে রাত্রিবাস করা হলো। ফরিদাবাদ (হরিয়ানায় অবস্থিত) থেকে পাঁচ ক্রোশ গিয়ে দিল্লি এলো।
কাবুলি দরজা দিয়ে পুরনো কেল্লার মধ্যে প্রবেশ করে লালদীঘি ও আরো কিছু কিছু দ্রষ্টব্য স্থান দেখলেন কিন্তু লাহোর দরজা ও দিল্লী দরজায় দুই পল্টন কোম্পানি সিপাই আছে দেখে এখানকার নিয়ম কানুন না জানায় ভীত হয়ে লেখক ভিতরে যাবেন কিনা এই বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হলেন। অবশেষে দিল্লি দরজার প্রহরীকে বাংলা থেকে দেশ ভ্রমণের জন্য এসেছেন ও দিল্লি শহর দেখার অত্যন্ত বাসনা এই কথা জানানোয় প্রহরী তাঁকে প্রবেশের অনুমতি দেয়। তারপর তিনি নহবত খানা, বাজার প্রকৃতি দেখলেন। দেওয়ানী আমের দরজায় খোজা দ্বারপালেরা ছিল। তাদের অনেক অনুরোধ করে একজনকে সঙ্গে নিয়ে তখত ও আরো কিছু স্থান দেখলেন। কেল্লা থেকে বের হয়ে জুম্মা মসজিদ, অন্যান্য মসজিদ, বাজার, বিশেষত বত্রিশ বাজার দেখে লাহোর দরজার রাস্তায় দেখলেন হিন্দু-মুসলমান, ধনীরা গাড়ী ,পালকি, ঘোড়া, হাতি, দুলি, দোলা চড়ে ভ্রমন করছে। কোথাও নাচ গান বাজনা হচ্ছে।
পরদিন আবার পরবর্তী গন্তব্যের পথে বেরোলেন। বর্তমান হরিয়ানার পানিপথ, করনাল হয়ে থানেশ্বর (থানেসার) পৌঁছলেন চার দিনে। এখানে কুরুক্ষেত্র তীর্থ, কুরুপান্ডবের যুদ্ধস্থান। কুরুক্ষেত্রের পরিক্রম করলে আশি ক্রোশ পথ পরিক্রম বা আট চল্লিশ তীর্থ দর্শন করতে হয়।
লেখক থানেশ্বর শিব, জ্যোতিশ্বর শিব দর্শন, লক্ষ্মীকুণ্ডে স্নান করলেন। চার ক্রোশ দূরে চক্রব্যূহে, যেখানে অভিমন্যুকে সপ্তরথী বধ করেন, সেই ব্যুহের ইঁট এখনো আছে বলে লেখক লিখেছেন। যেখানে ভীষ্মের শরশয্যা হয়েছিল সেখানে এক কুণ্ড আছে। সেটিকে ভীষ্মকুণ্ড বলে। অর্জুন ভীষ্মকে শরশয্যায় শায়িত অবস্থায় বান ছুঁড়ে মাটির তলা থেকে গঙ্গার জল তুলে ভীষ্মকে খাইয়েছিলেন। সেই স্থানে একটি কূপ তৈরী হয়ে গেছিল, যাকে বানগঙ্গা বলা হয়। কর্ণখেড়া নামক স্থানে কর্ণ প্রতিদিন স্নান ও স্বর্ণদান করতেন। লক্ষীকুন্ড হলো সেই স্থান যেখানে কুরুপান্ডবের যুদ্ধের সময় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের রথের ঘোড়াদের জল পান করানোর জন্য সরোবর সৃষ্টি করেছিলেন। এখানে লক্ষ্মী, নারায়ণ, শিব ও কালীর মন্দির আছে। এই কুণ্ড হিন্দুদের মহাতীর্থ। আওরঙ্গজেব বাদশা এই তীর্থ লোপ করার জন্য নানারকম চেষ্টা করে শেষে ওই কুন্ডের ওপর সেতু বেঁধে দ্বীপের মধ্যে এক কেল্লা ও মসজিদ তৈরি করে দেন। কেল্লাতে সৈন্যরা নিযুক্ত ছিল এবং তাদের দায়িত্ব ছিল হিন্দুরা যাতে জলস্পর্শ করতে না পারে তার জন্য পাহারা দেওয়া। কিছুদিন হল দাক্ষিণাত্যের পুণা-সেতারার রাজা অমৃতরায় এসে বাদশাহের সঙ্গে যুদ্ধ করে এই তীর্থ মুক্ত করেছেন। পরে ওই রাজ্য শিখদের অর্পণ করে তিনি স্বদেশে চলে যান। তখন থেকে রঞ্জিত সিংহের সময় পর্যন্ত হিন্দু রাজ্য অথবা শিখরাজ্য ছিল। পরে ইংরাজের অধিকারে যায়। এখন আর তীর্থলোপের সম্ভাবনা নেই বরং ক্রমে তীর্থ উদ্ধারের বিশেষ ব্যবস্থা হচ্ছে। কুরুক্ষেত্রের মৃত্তিকার রক্ত বর্ণ বৃষ্টি হলে মনে হয় রক্ত। অস্থিপুরা নামে যে তীর্থ আছে তাতে যুদ্ধে হতদের সৎকার হয় এবং কুরুকূল বধূরা সেখানে সহমৃতা হন। চক্রতীর্থ সেই স্থান যেখানে যুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেন না বলে শ্রীকৃষ্ণ সুদর্শন চক্র রেখে দেন। দুর্যোধনটিলার কাছে দুর্যোধনের শিবির ছিল। এই সব তীর্থস্থান দর্শন করা ছাড়াও লেখক থানেশ্বর শহর ভ্রমণ করলেন। শহরের রাস্তা, নর্দমা সব ইঁট বাঁধানো। সেকাচিল্লির কেল্লা দেখলেন, তাতে পাথরের ভালো কাজ ছিল কিন্তু এখন ভগ্ন প্রায়। ওই মিনারে উঠলে কুরুক্ষেত্রের সকল অংশ দেখা যায়।
বেশ কিছুদিন কুরুক্ষেত্রে কাটিয়ে এবার তিনি পিপলি, সাহাবাদ হয়ে আম্বালায় এলেন। সেখানে তখন ইংরেজদের সেনা ছাউনি ছিল। প্যারেডের মাঠে সৈন্যদের যুদ্ধ শিক্ষা হচ্ছিল। এই চাউনিতে কালা অর্থাৎ দেশীয় সিপাই ছিল তিন পল্টন। তারপর রামপুরা (রামপুর, পাঞ্জাব), সরহিন্দ (সরেন্দা), লস্করের সরাই (সরাই বানজারা) হয়ে এলো লুধিয়ানা (লুধিয়ানা,পাঞ্জাব)। এখানে পশমের বস্ত্র তৈরি ও বিক্রি হয়। এটি বড় শহর। ম্যাজিস্ট্রেট, কাছারি, ডাকঘর, ডাক্তার-খানা আছে। লুধিয়ানা থেকে সাটলেজ(শতদ্রু নদী) নৌকার পুলে পার হয়ে রাজা রঞ্জিত সিংহের দুর্গ ফোলবের (ফিলোউর) আসেন। সাহেবদের সেনা ছাউনি আছে এখানে। এরপর ফাগুওয়াড়া শহর (ফাগওয়ারা), হরেলা (?), হুশিয়ারপুর (হোসিয়ারপুর) হয়ে বাহাদুরপুরে (?) এসে রাজা রনজিত সিংহের গুরু নানকের গদি দেখলেন। এবার লেখক জোয়ালজি অর্থাৎ জ্বালামুখী (বর্তমান হিমাচল প্রদেশে অবস্থিত তীর্থস্থান) গমনের উদ্যোগ নিলেন।
( চলছে )
এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২০ মাঘ ১২৬২ (৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬ ) থেকে ২০ ফাল্গুন ১২৬২ (৪ মার্চ ১৮৫৬ )
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
পর্বে আলোচিত বেশ কিছু স্থান ইতিমধ্যেই ঘুরেছি , পর্বে যেমন বর্ননা আছে সেই প্রসঙ্গ গুলোর সঙ্গে পরিচিত থাকলে অনেক বেশি উপভোগ করতে পারতাম। তথাপি এখনও জানতে পেরে বেশ আনন্দ পেলাম।
উত্তরমুছুনশিউলি
ধন্যবাদ 🙏
উত্তরমুছুন