পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

৬০। ইউরোপে তিন বছর ৬ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - জার্মানী, চেক রিপাবলিক, অস্ট্রিয়া।


হল্যান্ডের আর্মস্টারডাম থেকে রমেশচন্দ্র দত্ত এলেন জার্মানির হ্যানোভারে। শহরের একটি অংশে প্রাচীন বাড়িঘর রয়েছে এবং আরেকটি নতুন অংশ গড়ে উঠেছে। বিখ্যাত গণিতজ্ঞ দার্শনিক লেইবনিজের বাড়ি এখনো দর্শকদের জন্য চিহ্নিত করা আছে। রাজপ্রাসাদ, টাউন হল, চার্চ, বাজার দেখলেন লেখক। 

এর পরের দ্রষ্টব্য বার্লিন। বার্লিন দ্বাদশ শতাব্দীতে একটি মৎস্যজীবীদের গ্রাম ছিল। ১২৫০ সালে এখানে শহর তৈরি করা হয় এবং ১৩০০ সালে প্রাচীর দিয়ে শহর ঘিরে দেওয়া হয়। টিয়ারগার্টেন বার্লিনর সবচেয়ে মনোরম উদ্যান। এখানে একটি বিজয় সৌধ আছে। পার্ক থেকে বেরিয়ে পূর্বদিকে গিয়ে ব্রান্ডেনবুর্গ গেট দিয়ে শহরে ঢুকলেন লেখক। গেটটি ৮৫ ফুট উঁচু, মাথায় বিজয়ের প্রতীক হিসেবে চার ঘোড়ার টানা রথে মহিলার ব্রোঞ্জের মূর্তি কোয়ানড্রিগা অফ ভিকট্রি। পাঁচটি প্রবেশ পথ আছে। মাঝের পথটি রাজকীয় শটকযানের জন্য সংরক্ষিত। ভিতরে প্রথমে পারিস প্লেস নামক স্কোয়ার রয়েছে, সেখানে দু'ধারে গুরুত্বপূর্ণ বাড়ি রয়েছে। যেমন বিভিন্ন এম্বাসিগুলি। এরপর উন্টারডেন লিণ্ডেন নামের সুন্দর রাস্তা শুরু হয়েছে। এই পথে রয়েছে ফ্রেডরিক দি গ্রেট-এর (১৮ শতাব্দীর প্রুশিয়ার শাসক) ব্রোঞ্জ মূর্তি। এর উল্টোদিকে রয়েছে সাধারণ চেহারার রাজপ্রাসাদ বা কাইজারের আবাসস্থল। সেখান থেকে তিনি কাইজারের দর্শন পেলেন রাজবাড়ির জানালায়। রাজপ্রাসাদের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন, রয়াল লাইব্রেরী। এই লাইব্রেরীতে গুটেনবার্গের পার্চমেন্টে লেখা বাইবেল, ১৪৬০ মার্টিন লুথারের বাইবেলের অনুবাদের মতো দুর্লভ সংগ্রহ রয়েছে। রাজপ্রাসাদের সামনে রয়েছে আর্সেনাল বা অস্ত্রাগার, যা পুরনো কামান ও অস্ত্রের মিউজিয়াম। এরপর উন্টারডেন লিনডেন রাস্তার একটি ব্রিজ পেরিয়ে একটা দ্বীপের মতো স্থান আসে। সেই দ্বীপে পুরনো কেল্লা ও পুরনো মিউজিয়াম আছে। এই পুরনো মিউজিয়ামে মূল্যবান অনেক চিত্র আছে। রেমব্রান্ট, রুবেন, ভ্যান ডাইক, রাফায়েল, টিটিয়ান প্রমুখ চিত্রকরের কাজ এখানে আছে। নতুন মিউজিয়ামে অনেক আধুনিক চিত্র, মূর্তি ও মিশরের প্রাচীন সংগ্রহ রয়েছে। প্রাচীন রাজপ্রাসাদটি চারতলা উঁচু, বড় এবং সুসজ্জিত। রাজাদের প্রার্থনা গৃহ রয়েছে, যার ডোম ২৪০ ফুট উঁচু। দ্বীপ থেকে ব্রিজের মাধ্যমে পার হয়ে পুরনো শহরে প্রবেশ করে লেখক টাউন হল (রথ হাউস) দেখলেন, যার মিনার বার্লিন-এর সবচেয়ে উঁচু স্থাপত্য। জার্মানির আরেকটি সুন্দর রাস্তা হল উইলহেম স্ট্রিট। সেখানে তিনি প্রুশিয়ার রাজনীতিবিদ বিসমার্কের বাড়ি দেখলেন। আরেকটি সুন্দর রাস্তা ফ্রেডেরিক স্ট্রীটে রয়েছে বিখ্যাত জার্মান থিয়েটার, যার সামনে শিলার-এর মার্বেল মূর্তি স্থাপিত রয়েছে। আছে ফরাসি ও জার্মান গির্জা এবং গ্যোটের মূর্তি। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে যেখানে উইলহেলম স্ট্রিট আর ফেডরিক স্ট্রীট মিশেছে সেই স্থানকে বেল আলায়েন্স বলা হয়। সেখানে ওয়াটারলুু মনুমেন্ট রয়েছে। এই সৌধের চারটি শ্বেত পাথরের স্তম্ভ ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, জার্মানি ও প্রুশিয়ার প্রতীক। এই চার দেশ নেপোলিয়নের বিজয় গর্বে গর্বিত। এটি বোঝা যায় ইংল্যান্ডের ওয়াটারলু ব্রিজ ও ওয়াটারলু প্রেস, বেলজিয়ামের ব্রুসেলসের বেলজিয়াম সিংহ ওয়াটারলুর রণক্ষেত্রে, আর্মস্ট্রাডামের ওয়াটারলু প্লেস, হেনোভারের ওয়াটারলু স্তম্ভ আর বার্লিনের এই সৌধ থেকে। 


জার্মানির আরেকটি শহর ড্রেসডেন হল সাক্সনি প্রদেশে অবস্থিত সাম্রাজ্যের একটি সদস্য। এখানকার জুইঙ্গার প্রাসাদের চিত্রশালা ড্রেসডেনকে ইউরোপের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান দিয়েছে। এখানে পোর্সেলিন আবিষ্কার হয়েছিল এবং পোর্সেলিনের কাজ এখানে অত্যন্ত বিখ্যাত। চিত্রশালার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অবদান হলো র‍্যাফায়েল-এর ম্যাডোনা। এছাড়া মাইকেল এঞ্জেলো, টিটিয়ান, রুবেন, ভ্যান ডাইক প্রমুখের চিত্রকলা এই গ্যালারিতে শোভা পাচ্ছে। 


ড্রেসডেন থেকে বোহেমিয়া (বর্তমান চেক রিপাবলিক) যাওয়ার পথে এলব নদীর দুপাশে সুউচ্চ পাহাড় আর জঙ্গল। এই অববাহিকাকে সাক্সন সুইজারল্যান্ড বলা হয় এর চমৎকার সৌন্দর্য আর বন্য পরিবেশের জন্য। লেখক লিখেছেন বোহেমিয়া যখন স্বাধীন ছিল তখন প্রাগ তার রাজধানী ছিল। (এখন চেক রিপাবলিকের রাজধানীর প্রাগ)। এই শহরটি মলডাউ নদীর দু'তীরে অবস্থিত। শহরটি এখনো প্রাচীনতা ছেড়ে আধুনিক সময়ে আসেনি বলে মনে হয়। শহরে ঢোকার প্রাচীন প্রবেশদ্বারের নাম পালভারথুর্ম। তারপর এলো গ্রস রিং বা বড় ক্ষেত্র, যেখানে বোহেমিয়ান রাজা ও নাইটরা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রভৃতি করত। এর কাছেই রয়েছে পুরনো ঘেটো বা ইহুদিদের বাসস্থান, যেখানে অনেক অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে এবং শেষে তাদের শহর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। মোলডাও নদী বা ভলতাভা নদীর পাড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে বোহেমিয়ান রাজাদের প্রাসাদ দেখার মত। পাহাড়ের নীচে রয়েছে ওয়ালেনস্টাইন প্যালেস, যা ওয়ালেনস্টাইন নামক তিরিশ বছরের যুদ্ধের নায়কের প্রাসাদ। বোহেমিয়ার গৌরব অনেকাংশেই বিনষ্ট হয়েছে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়াতে। কিন্তু অনেকাংশেই স্লাভদের মধ্যে দেশপ্রেম বজায় আছে। 


এবার লেখক এলেন অস্ট্রিয়া দেশের ভিয়েনা শহরে। এটি রাজধানী শহর। ইউরোপের প্রতিটি দেশে গত ২০-৩০ বছরে রাজধানী শহরগুলিকে প্যারিসের মতো গড়ে তোলার জন্য সৌন্দর্যায়ন হয়েছে। কিন্তু সেই কাজ ভিয়েনায় অসম্ভব ভালো হয়েছে। নতুন চওড়া রাস্তা, স্কোয়ার, বাগান, প্রাসাদোপম বাড়ির সারি তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে শহরের মধ্যে প্রকৃতির ছোঁয়াও রাখা হয়েছে। পুরনো শহর দানিউব ক্যানালের ডান পাড়ে অবস্থিত ( দানিউব ক্যানাল দানিউব নদীর সঙ্গে যুক্ত খাল, যা ১৮৬৭ সালে মূলত নৌযান চলাচলের জন্য নির্মিত হয়েছিল)। দানিউব ক্যানালের পাশ দিয়ে যে অর্ধ বৃত্তাকার প্রশস্ত পথ গেছে তাকে রিং ইন ভিয়েনা বলা হয়। এই রাস্তার পাশে বিশ্ববিদ্যালয়, হোটেল ডি ভিল, পার্লামেন্ট ভবন, থিয়েটার হল, পালৈ দি জাস্টিস, রাজপ্রাসাদ, অপেরা হাউস, সেন্ট চার্লস চার্চ, সুন্দর পার্ক প্রভৃতি রয়েছে। ভিয়েনা রাজপ্রাসাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কক্ষটি হলো রেগালিয়া, এটি ঐতিহাসিক রাজকীয় সাজ সজ্জার প্রতীক। এই সাজ সজ্জার মাধ্যমে রাজা রানীর ক্ষমতা প্রতিফলিত হতো। এটি অস্ট্রিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতি অংশ হিসেবে সংরক্ষিত। এখানে রাজারাণীর ব্যবহৃত বাসনপত্র, পোশাক, গয়না, ঘড়ি, রত্ন সংগ্রহ, রাজ মুকুট , সেপ্টার বা রাজদণ্ড, অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি দেখা যায়। এখানে ফ্লোরেন্টিন নামে একটা হীরা রয়েছে, যা পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম হীরা। এই প্রাসাদের রাজকীয় অশ্বালয়ে নানা জাতের, নানা মাপের ঘোড়ার বিশাল সংগ্রহ আছে। আর আছে প্রাচীনকাল থেকে নানা রকম ঘোড়ার গাড়ির সংগ্রহ। এরপর লেখক দেখলেন বেলভেডের প্যালেস। প্রাসাদের বাগান, মূর্তি প্রভৃতি আগের মত রেখে বাকিটা মিউজিয়াম হিসেবে সাজানো হয়েছে। এখানকার পিকচার গ্যালারী অসাধারণ। টি, রুবেন, র‍্যাফায়েল, আলবার্ট ডুরে প্রমুখ শিল্পীদের আঁকা ছবি এখানে রয়েছে। প্র্যাটের হল শহরের একটি বড় ও সুন্দর পার্ক। এটি পর্যটকদের কাছে প্যারিসের বয়া দে বুলগানের মতো জনপ্রিয়। 


ভিয়েনার পর লেখক গেলেন সালজবুর্গ, যা পাহাড়ের মাঝখানে সালজ নদীর তীরে অবস্থিত। চারদিকের সুউচ্চ তুষারশৃঙ্গ একে অসাধারণ সৌন্দর্য দিয়েছে। 


সালজবুর্গে অল্প সময় কাটিয়ে তিনি আরো পশ্চিমে বাভারিয়া রাজ্যে চললেন। আল্পসের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তিনি ট্রাউনস্টাইন পেরিয়ে পাহাড় আর পাইন গাছে সাজানো ছবির মত সুন্দর গ্রামে বেরগেনে এলেন। এরপর একটা চেমস নামের সুন্দর লেক পেরোলেন। লেকের মধ্যে দূরে তিনটি জঙ্গলে ভরা দ্বীপ দেখা গেল। আগে ওই দ্বীপগুলিতে খ্রিস্টান সাধু-সাদ্ধিরা বাস করতেন। 


প্রিয়েন ও ইন নদী পেরিয়ে তিনি বাভেরিয়ার রোজেনহাইম শহরে পৌঁছলেন। এখান থেকে মিউনিখ মাত্র ৪০ মাইল দূরে। তাও সময়ের অভাবে সেখানে তিনি যেতে পারলেন না বলে লেখক আফসোস করেছেন। 


রোজেনহাইম থেকে ইন্সব্রুক (টিরোলের রাজধানী) পর্যন্ত পথ ইন নদীর পাড় ধরে রয়েছে। এই অববাহিকা অসম্ভব সুন্দর। তুষারাবৃত পর্বত, গিরিখাত নিয়ে। নভেম্বরে বরফে ঢাকা ইন্সব্রুক খুব সুন্দর। তার রাজা ম্যাক্সমিলারের (হোলি রোমান এম্পায়ার) পঞ্চদশ শতাব্দীর কারুকার্যময় সমাধি, রাজার মূর্তি, ক্যাথিড্রাল দেখলেন। ২৪ শে নভেম্বর ১৮৮৬ অস্ট্রিয়া থেকে ইটালির উদ্দেশ্যে ব্রেনার পাস পেরিয়ে যাত্রা করলেন রমেশ চন্দ্র দত্ত। আল্পস পর্বতের এই পাস অস্ট্রিয়া ও ইটালির মধ্যে সীমানা রচনা করেছে। ট্রেন ধীরে ধীরে সীল উপত্যকায় উপরে উঠতে থাকল। মধ্যে মধ্যে সরু গিরিখাত পাহাড় কেটে তৈরি করা টানেল পরল। নীচে সিল নদীর ফেনিল জল সশব্দে বয়ে চলেছে জঙ্গলে ঢাকা অধিত্যকায় আর চারদিক ঘিরে রয়েছে সাত হাজার ফুট উঁচু বরফে ঢাকা পর্বত শৃঙ্গ। উপরে উঠতে উঠতে ট্রেন এবার সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা অঞ্চলে পৌঁছালো। তারপর এল ৪৪৯০ ফুট উঁচু ব্রেনার পাস। ট্রেন এখানে ৫ মিনিট থামল। নভেম্বর মাসে সেখানকার তুষারাবৃত দৃশ্য নীল আকাশের পটভূমিতে অসম্ভব সুন্দর লাগল। এরপর ট্রেন নামতে শুরু করল। আবার অনেক টানেল পেরিয়ে নীচে এবার আদিজে নদীর সুন্দর উপত্যকা দেখা গেল। 


পাহাড় থেকে অপূর্ব সুন্দর উপত্যকায় নেমে ট্রেন আদিজের ধার ঘেঁষে চলতে থাকল। ছোট ছোট গ্রামের বাড়ি, চার্চ, আঙ্গুর বাগান চোখে পড়তে লাগল। আঙুর থেকে এখানে টিরোল ওয়াইন তৈরি করা হয়। (টিরোল অস্ট্রিয়ার একটি রাজ্য)। তাঁদের ট্রেন টিরোলের রাজধানী বটজেন পৌঁছাল। এখানে উত্তর দিক উঁচু পাহাড়ে এমনভাবে ঘেরা যে ঠান্ডা বাতাস আরো উত্তর দিক থেকে আসতে পারে না, দক্ষিণ থেকে উষ্ণতর বাতাস এসে স্থানটিকে আরামদায়ক আবহাওয়া দেয়। তাই এটি একটি স্বাস্থ্য নিবাস হিসেবে গড়ে উঠেছে। এরপর ট্রেন্ট, আলা হয়ে ট্রেন পৌঁছালো ভেরোনা, লেখক এবার ইতালি দেশে প্রবেশ করলেন।
                     
                            (চলছে)

২টি মন্তব্য:

  1. জার্মানি চেক রিপাবলিক, অস্ট্রেয়ার মনোরম ভ্রমণ কাহিনী পাঠের মাধ্যমে এই দেশগুলোর বহু চিত্র ধরা দিল যা আমার অজানা ছিল। ধন্যবাদ লেখিকাকে। শিউলি

    উত্তরমুছুন