পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

৬৩। ইউরোপে তিন বছর ৯ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - জার্মানি।

২ নভেম্বর ১৮৮৬ থেকে ১৫ ই ডিসেম্বর ১৮৮৬ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ দিনের ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ কালে রমেশ চন্দ্র দত্ত ছটি দেশ এবং তিরিশটি শহর দেখলেন। এরপর লেখক ইউরোপ ভ্রমণার্থীদের জন্য কিছু বক্তব্য রেখেছেন। 


*ইউরোপের প্রতিটি সম্ভ্রান্ত হোটেলে ইংরাজি, ফ্রেঞ্চ ও জার্মান বলা হয়। তাই এর যেকোনো একটি ভাষা জানলে টুরিস্টদের কোন অসুবিধা হয় না।
 
*ব্যাডেকার সিরিজের গাইড বই ভাল। এটি পড়া থাকলে গাইড-এর জন্য পয়সা খরচ করার দরকার হয় না।

* এই ৪৪ দিনের ভ্রমণে তাঁর ৬৬ পাউন্ডের সামান্য বেশি খরচ হয়েছিল। অর্থাৎ প্রতিদিন দেড় পাউন্ড খরচ গড়ে। 

*স্বল্পদিনে বেশি স্থান ঘুরতে হয়েছে বলে খরচ বেশি লেগেছে। যদি এক স্থানে বেশি দিন থাকা হয় তাহলে ইউরোপে হোটেল ভাড়া কম নেওয়া হয়। সাধারণত ইউরোপীয়রা এক দেড় মাস এক জায়গায় থেকে ভ্রমণ করে। 

*তাঁর হোটেল ভাড়া তিরিশ পাউন্ড ও রেল ভাড়া কুড়ি পাউন্ড লেগেছিল। ১৫ পাউন্ড-এ গাড়ি ভাড়া, মিউজিয়াম গ্যালারি ইত্যাদির প্রবেশ মূল্য, মেমেন্টো কেনা, ফটো তোলা প্রভৃতি খরচ হয়েছিল। 

*প্রতিটি দেশের মুদ্রা বিভিন্ন। এটি ভ্রমণকারীর পক্ষে অসুবিধা জনক। যদি সরকার সব দেশে চলে এমন মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ভ্রমণার্থীদের সুবিধা হবে। রমেশ চন্দ্র দত্ত মহাশয়-এর এই দূরদৃষ্টি বহু দিন পর্যন্ত অব্যবহৃত ছিল। পরে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ব্যতীত অন্য যেসব দেশে লেখক ভ্রমণ করেছেন, সেই সব জায়গায় ইউরো নামক একটি সাধারন মুদ্রা প্রচলিত হয়েছে। 


এরপরে লেখক আরেকবার ইউরোপ ভ্রমণ করেন। সেটি মূলত জার্মানিকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ করা হয়। সেই ভ্রমণ কাহিনী তিনি বইয়ের তৃতীয় সংস্করণে যুক্ত করেন। 

১২ ই আগস্ট ১৮৯৩ রমেশ চন্দ্র দত্ত বাইশ বছর পরে আবার জার্মানির কোলন গেলেন। এর মধ্যে ইউরোপের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কোলনে ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দে যে ক্যাথিড্রালের সূচনা হয়েছিল নতুন জার্মান সাম্রাজ্যের সম্রাট উইলিয়াম (প্রথম) ১৮৮০ -তে তার কাজ শেষ করেছেন। সেই বিশাল এবং রাজকীয় ক্যাথিড্রালের বর্ণনা ভাষায় বর্ণনা করা দুষ্কর। 

কোলন থেকে তিনি গেলেন ওয়াইসবাডেন। এটি স্বাস্থ্যধারের স্থান হিসাবে বিখ্যাত। লেখক দেশ থেকে অসুস্থ হয়ে ইউরোপে বায়ু পরিবর্তনে এসেছিলেন। কিন্তু এসেও দেড় মাস ইংল্যান্ডে ম্যালেরিয়ায় অসুস্থ হয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিল সাইটিকা বাতের প্রকোপ। ফলে ওয়াইজবাডেন তাঁর শরীরের পক্ষে ভালো ছিল। এখানকার উষ্ণপ্রস্রবণের জলে প্রতিদিন সকালে স্নান করে এবং সেই জল পান করে অনেকের মতো লেখক মাস খানেকে সুস্থ হয়ে উঠলেন। এখানে তিনি জার্মান ভাষা শিক্ষা করতে থাকেন। 

মাঝে মাঝে আশেপাশের জঙ্গলে, রাইন নদীতে আনন্দ ভ্রমণ করতেন। জঙ্গলে গাছের নীচে বই হাতে গ্রীষ্মের দুপুরে একলা উপভোগ করতে তাঁর খুব ভালো লাগত। অনেক ইউরোপীয় শহরে প্রাকৃতিক জঙ্গল শহরের খুব কাছে সংরক্ষণ করা হয়েছে। জঙ্গলের পথ ধরে পাহাড়ি পথে ওঠা নামা করে, আশেপাশের সোনেনবার্গ, নেরোবার্গ, আইসেনহান্ড প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে আসলেন। কখনো রাইন নদীতে স্টিমারে করে জার্মানির ন্যাশনাল মনুমেন্ট দেখতে গেলেন। ন্যাশনাল মনুমেন্ট জার্মেনিয়ার মূর্তি ৩৩ ফুট লম্বা মূর্তি, ৩৮ ফুট বেদির উপরে বসানো এবং ৭৪০ ফুট পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। (জার্মেনিয়া এক মহিলার মূর্তি যার মাথায় ওক পাতার সজ্জা, ডান হাতে জার্মান রাজকীয় মুকুট এবং বাঁ হাতে খোলা তরোয়াল। জার্মেনিয়া সমগ্র জার্মান জাতির প্রতীক)। 


রাইন নদীর ধারে অবস্থিত কিছু জার্মান শহরে ও নদীপথে ঘুরে এলেন লেখক। বর্তমানে প্রুশিয়ায় অবস্থিত ফ্র্যাঙ্কফার্ট প্রখ্যাত লেখক গ্যোটের জন্মস্থান রূপে ভ্রমণকারীদের কাছে জনপ্রিয়। লেখকের বাড়ি, মূর্তি, পুরনো টাউন হল, ক্যাথিড্রাল এবং ইহুদিদের মলিন বসতি এখানকার দ্রষ্টব্য স্থান। 

রাইন নদীর ধারে আরেকটি শহর মেইন্স। এখানে ছাপাখানার আবিষ্কর্তা গুটেনবার্গের জন্ম হয়েছিল এবং একটি স্ট্যাচু তাঁর স্মরণে এখানে রয়েছে। আরেকদিন তিনি গেলেন ওর্মসে। মার্টিন লুথার কিং-এর জন্মস্থানে। তাঁর স্মৃতিসৌধ, স্ট্যাচু দেখলেন। রাইন নদী ধরে আরও এগোলে রাইনের উপনদী নেকার এসে রাইন নদীতে মেশে। নেকারের পাড়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় নগরী হাইডেলবার্গ। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় জার্মানির মধ্যে সর্বপ্রাচীন। চতুর্দশ শতাব্দীতে তৈরি এখানকার প্রাচীন ভগ্নপ্রায় দুর্গ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। রাইন নদী ধরে আরও এগোলে আসে স্পিরেস। তারপর স্ট্রাসবুর্গ, আলসেক, মেটস, লরাইন প্রভৃতি শহর। এগুলি অনেক যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস বহন করে চলেছে। 

রাইনল্যান্ড অর্থাৎ রাইন নদীর ধারের এই টুকরো টুকরো বেড়ানোর কথা দিয়েই শেষ হয় লেখক রমেশ চন্দ্র দত্তের ১৮৬৮ থেকে ১৮৭১ পর্যন্ত তিন বছর ইউরোপে বাস এবং পরবর্তী ১৮৮৬১৮৯৩ সালে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে তাঁর ভ্রমণকাহিনী। বইটি এত বেশি তথ্য নির্ভর যে পরবর্তীকালে ইউরোপের এই ব্লগে এই দেশগুলির অন্য লেখকদের ভ্রমণ কাহিনী যখন বর্ণিত হবে, তখন এটিকে ভিত্তি হিসেবে রেখে নতুন তথ্য যোগ করা হবে মাত্র। রমেশ চন্দ্র দত্ত মহাশয়-এর ইউরোপের ইতিহাস এবং স্থানগুলি সম্পর্কে এত বিশদ জ্ঞান থাকার কারণে তাঁর লেখা রচনা আজও বহু অংশে প্রাসঙ্গিক।

২টি মন্তব্য:

  1. ইউরোপ ভ্রমণের এই পর্বটিও পূর্বের ন্যায় অতি উন্নত। ইউরোপ ভ্রমণের জন্য যেকটি ভাষার সহিত পরিচিতি প্রয়োজন, গাইড বই, হোটেল সংক্রান্ত তথ্য ও বিভিন্ন স্থানের তথ্য সুন্দর ভাবে বর্ননা করা হয়েছে। শিউলি

    উত্তরমুছুন