সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - ইতালি , ভ্যাটিকান সিটি।
রমেশ চন্দ্র দত্তের পরবর্তী দর্শনীয় স্থান ভ্যাটিকান সিটি। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ভ্যাটিকান সিটি রোম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক দেশ হিসেবে স্বীকৃত হয়। লেখক যখন ১৮৮৬ -তে সেখানে গেছেন তখন সেটি রোম। তাই তিনি এটিকে রোম বলে নথিবদ্ধ করেছেন। বর্তমানে ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত মধ্যযুগীয় রোমের সর্বোত্তম স্থাপত্য সেন্ট পিটার্স চার্চ। বিশালত্ব ও সৌন্দর্যে পৃথিবীতে অদ্বিতীয় সেই চার্চের প্রবেশপথে দুটি অর্ধচন্দ্রাকার শ্রেণীতে ২৮৪ টি স্তম্ভ রয়েছে। তার উপরে ১৯২ টি সন্তদের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। চার্চে সুউচ্চ মার্বেল স্তম্ভ, সোনার জলের কাজ করা ছাদ, মার্বেলের রাস্তা, পিলার, ব্রোঞ্জ-এর পিলার, ব্রোঞ্জ-এর আচ্ছাদন, বিশাল ডোম, চার্চের উচ্চতা সবমিলিয়ে অসম্ভব আভিজাত্য, জাঁকজমক যুক্ত পরিবেশ স্বপ্নের জগত তৈরি করেছে। সমস্ত স্থাপত্যের পরিমাপ এত নিখুঁত যে ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। এখানে পোপেদের সমাধি ও মূর্তি রয়েছে। মাইকেল এঞ্জেলোর তৈরি বেশ কিছু অসাধারণ মূর্তি আছে। চার্চের সর্বোচ্চ স্থানের উচ্চতা ৬০৭ ফুট। চার্চের বাইরের যে ৭৭ ফুট লম্বা ওবেলিক আছে তা অত্যন্ত প্রাচীন। এটি মিশর থেকে রোমে আনেন সম্রাট ক্যালীগুলা।
সেন্ট পিটার চার্চ-এর কাছে রয়েছে পোপের প্রাসাদ, যা ১৮৭১ -এর আগে পৃথক সাম্রাজ্য ছিল এবং লেখকের ভ্রমণ কালে তা ইতালির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এই প্রাসাদে অনেক মূল্যবান চিত্রকলা আছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সিস্তিন চ্যাপেলের দেওয়াল জুড়ে মাইকেল এঞ্জেলোর লাস্ট জাজমেন্ট ছবিটি। এই প্রাসাদের পাশে ভ্যাটিকানের মিউজিয়াম অবস্থিত, যেখানে অনেক প্রাচীন ভাস্কর্য রয়েছে। যেমন মাইকেল এঞ্জেলোর অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার।
রোম থেকে ২৬ মাইল দূরে ভেলেত্রি-তে এলেন লেখক। এটি প্রাচীন ভোলসি উপজাতির শহর। এখানে তাদের প্রাচীন দুর্গ রয়েছে। তারপর প্রাচীন শহর সেগ্নি হয়ে সেপ্রানো পেরিয়ে লেখক নেপলস্ পৌঁছলেন। নেপলস্ শহর অন্যান্য ইতালীয় শহরের তুলনায় অপরিষ্কার, রাস্তায় ভিখারীর উৎপাত আছে। রাজপ্রাসাদ, সেন্ট ফ্রান্সিসকো ডি পাওলো চার্চ, অ্যাকুরিয়াম দেখলেন। একটি ইলেকট্রিক ফিস লেখকের হাতে শক দিল লেখক যখন অ্যাকুরিয়ামে তার গায়ে হাত দিয়েছিলেন।
ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি দেখার দীর্ঘকালের স্বপ্ন লেখকের এবার পূর্ণ হল। ২৮ ফ্রাঙ্কের বিনিময়ে একটি কোম্পানি ভিসুভিয়াসের ক্রেটারের কাছে নিয়ে যায়। ঘোড়ার গাড়ি শহর ছেড়ে আঁকাবাঁকা পথে পাহাড়ে উঠতে থাকল। ভিসুভিয়াস পর্বতের গায়ে সর্বত্রই লাভার শত সহস্র বছরের আস্তরণ নানা রকম নকশা তৈরি করেছে। পাহাড়ের উপর থেকে নেপলস্ শহরকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। একটা হোটেলে গাড়ি থেকে নেমে তাঁরা দুপুরের খাবার খেলেন। এরপর পাহাড়ের অংশ এত খাড়াই যে ঘোড়া উঠতে পারে না। সেখানে রেলের ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু এই রেল স্টিম বা ইলেকট্রিকের সাহায্যে চলে না। দড়ি ও পুলির সাহায্যে রেললাইন ধরে গাড়ি টেনে উপরে তোলা হয়। এভাবে প্রায় চূড়ায় পৌঁছনো হলো। তাপমাত্রা অনেক কমে গেছে উচ্চতার সঙ্গে। এরপরের অংশ হেঁটে উঠতে হলো। ক্রেটারের কিনারায় দাঁড়িয়ে লেখক দেখলেন নীচ থেকে সালফার মিশ্রিত সাদা ধোঁয়া সবেগে উপরে উঠে আসছে। সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াস থেকে ধোঁয়ার সঙ্গে মাঝে মাঝেই পাথরের টুকরো উৎক্ষেপিত হচ্ছে। নতুন লাভা গড়াতে দেখলেন তিনি ক্রেটার থেকে। এক টুকরো কাগজ ক্রেটারের মধ্যে ফেলতে তা নীচে না গিয়ে ধোঁয়ার চাপে বুলেটের মত তীব্র বেগে উপরে ফিরে এল।
লেখকের এই সম্পূর্ণ ভ্রমণের মধ্যে সব থেকে বেশি দেখার ইচ্ছা ছিল আঠেরো 'শ বছর ধরে লাভার তলায় থাকা, মাটি খুড়ে পাওয়া পম্পেই। এই শহরের অবশেষ সেই সময়ের মানুষের রোজকার জীবনকে চোখের সামনে দেখা সুযোগ দেয়। সমস্ত প্রাচীন রোমান শহরের মতো পম্পেইতে ফোরাম রয়েছে। সেখানে নেপচুন, জুপিটার, ভেনাস, আইসিস, অগাস্টাস, মার্কারির সুন্দর মন্দির আছে। আছে বিচার সভা, কারাগার, থিয়েটার, আম্ফিথিয়েটার, স্নানাগার, দোকান বাজার, রুটি তৈরির কারখানা ইত্যাদি।হারকিউলানিয়াম গেট, ভেস্টাল কুমারীদের প্রাসাদ, সেসেরোস ভিলা সব দেখলেন লেখক। তবে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি খুব ছোট এবং জানলা নেই। ফলে আলো বাতাস পাওয়ার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। রাস্তাঘাট পাথরে বাঁধানো কিন্তু রাস্তা এমন প্রশস্ত নয়। জল নিকাশি ব্যবস্থা নেই। ঘরের মাপ তখন আশ্চর্যজনক ছোট ছিল এখনকার নিরিখে। সাধারণ মানের গৃহস্থালি দ্রব্য, যেমন - বাতি, তৈজসপত্র প্রভৃতি স্বল্প পরিমাণে এখানে রয়েছে। বেশিরভাগ নেপলসের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। সাধারণ বাড়ির দেওয়ালেও নিম্ন রুচির অশ্লীল ছবি দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ বর্তমানের শালীনতাবোধ ও পাপবোধ তখনকার মানুষের মনে সেভাবে ছিল না।
ভিসুভিয়াসের পাদদেশে হারকিউলিয়াম আরেকটি শহর যা পম্পেই-এর মত অগ্নুৎপাতে ধ্বংস হয়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বর ৭৯ খ্রিস্টাব্দে। তবে এটি পম্পেই-র মতো লাভার ধুলোতে ঢাকা পড়েনি, গভীর লাভার স্তরে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েছিল। নতুন শহরটি পোর্টিসি, রেসিনা, টরে দি গিরেসো নামের নতুন শহরগুলি এই লাভার স্তরের উপর গড়ে উঠেছে। তাই পম্পেই-এর মত এখানে মাটি খুঁড়ে প্রাচীন সভ্যতা উদ্ধার সম্ভব নয়। বিশাল থিয়েটার হারকিউলানিয়মের একটা অংশ শুধু খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে। এটি সম্ভবত ১০০০০ মানুষের একসাথে বসে দেখার থিয়েটার ছিল। এছাড়া অল্প কিছু সাধারন ঘরবাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে যেগুলির গঠন পম্পেই-এর মতই।
নেপলসের মিউজিয়ামে পম্পেই ও হারকিউলিয়ামে পাওয়া জিনিসপত্র রাখা আছে। ব্রোঞ্জের তৈরি ছোট বড় নানা মূর্তি, প্রধানত দেব-দেবী রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিনটি হরিণ শিশুর মূর্তি, যাদের একটি ঘুমন্ত, অন্যটি নৃত্যরত ও তৃতীয়টি নেশাগ্রস্ত। তাছাড়া গৃহস্থালির বাসনপত্র, বাতি, ওজন, তুলা দণ্ড, কৃষি যন্ত্র, সূত্রধরের যন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র, অস্ত্রপোচারের যন্ত্র, বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতি রয়েছে। ধনীদের ব্যবহারের সোনা রুপার পাত্র, গয়না রয়েছে। সেই সময়ের খাদ্যশস্য, সবজি, ডিম, ফল প্রভৃতি দেখা যায়। সেই সুদুরের মানুষরা যখন তারা জানতো না হঠাৎ তাদের জীবন থেমে যাবে, তখন তারা এইসব খাদ্যদ্রব্য ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রহ করে রেখেছিল।
এবার রোম হয়ে লেখক পিসাতে গেলেন অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হলেও আধুনিক পিসা খ্যাত তার হেলানো মিনারের জন্য। এই মিনার বেলফ্রী বা ঘন্টা ঘরে ক্যাথিড্রাল এর এক প্রান্তে অবস্থিত। আট তলা এই টাওয়ার ১৮০ ফুট উঁচু। এটি একদিকে এতটাই ঝুঁকে আছে যে মনে হয় পড়ে যাবে। ক্যাথিড্রালটি একাদশ শতকে তৈরি। বলা হয় এখানকার ব্রোঞ্জ বাতির দোলন দেখে গ্যালিলিও তাঁর পেন্ডুলামের তত্ত্ব আবিষ্কার করেন।
পিসা থেকে জেনোয়া আসার পরে ইতালির পর্বতমালা অ্যাপেনাইন ধীরে ধীরে সমুদ্রের কাছে পৌঁছায়। ট্রেন অসংখ্য টানেলের মধ্যে দিয়ে সেই পাহাড় পেরোয়। জেনোয়া অশ্বখুরের আকৃতিতে সমুদ্রের (লিগুরিয়ান সী) তীরে অবস্থিত। পাহাড় যেন এর তিন দিকে প্রাকৃতিক অ্যাম্ফিথিয়েটার তৈরি করেছে। এটি কলম্বাসের জন্মস্থান। এখানে তাঁর স্মৃতিসৌধ তথা মূর্তি আছে শ্বেত পাথরের তৈরি। জেনোয়ায় একাদশ শতাব্দীতে তৈরি ইটালিয়ান রাজপুরুষদের তৈরি অনেক মধ্যযুগীয় প্রাসাদ আছে। তার মধ্যে এন্ডরিয়া ডোরিয়ার প্রাসাদ লেখক দেখেছিলেন। এই শহরের ক্যাম্পো সান্তো বা সমাধিস্থল অত্যন্ত সুন্দর ও দর্শনীয়।
এবার তিনি গেলেন জেনোয়া থেকে টুরিন। পথে অ্যাপেনাইন পর্বত ও পিডমন্ট সমতলভূমির অপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল। টুরিন পিডমনটের রাজধানী, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়াও আধুনিক উন্নয়নের জন্য প্রসিদ্ধ। আধুনিকতায় একে প্যারিস, বার্লিন, ভিয়েনার সঙ্গে তুলনা করা চলে। উত্তর দক্ষিণ বিস্তৃত চওড়া সুন্দর রাস্তায় সাজানো শহরটি মনোরম। শহরের বড় বড় রাস্তা, স্কোয়ার, রেল স্টেশনে বৈদ্যুতিক আলো রয়েছে (ইউরোপের রাস্তা ইত্যাদিতে সেই সময় বিদ্যুৎ তেমন ছিল না। যদিও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের রাস্তায় প্রথম বৈদ্যুতিকরণ হয়েছিল)। এখানকার পালাজ্জো মাদাম বা লেডিস প্যালেস দর্শনীয়। ১৩ ডিসেম্বর টুরিন ত্যাগ করে রিভোলি হয়ে মাউন্টা সেনি টানেল দিয়ে আল্পস পর্বত পেরিয়ে তাঁরা মোডেন পৌঁছলেন। এটি সীমানা শহর। এখানে সঙ্গের জিনিসপত্র পরীক্ষা হল। পরদিন তাঁরা প্যারিসে পৌঁছলেন।
(চলছে)
তৎকালীন ভ্যাটিকান সিটির সুন্দর বর্ননা, ভেসুভিয়াসের বর্ননা, পিসার ক্যাথিড্রালের ব্রোঞ্জ বাতির দোলন দেখেই গ্যালেলিও তাঁর পেন্ডুলামের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন । কলোম্বাসের জন্মস্থান জেনোয়ার প্রসঙ্গে সুন্দর বর্ননা এই পর্বটি পড়ে পরিচিত হলাম। শিউলি
উত্তরমুছুনপড়তে থাকুন, ঘুরতে থাকুন!
উত্তরমুছুন