পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

৭০। তিব্বত অভিযান ৩ - শরৎ চন্দ্র দাস

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


          (আগের পর্বের পরে)

শরৎচন্দ্র দাসের প্রথম তিব্বত ভ্রমণকালে তাশীলহুনপো মঠে ছয় মাস কাল প্রধানমন্ত্রীর অতিথি হিসেবে ছিলেন। সেই সময় মন্ত্রী তাঁর কাছ থেকে পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন এবং সেই সভ্যতা সম্পর্কে আগ্রহান্বিত হন। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় লেখকের দ্বিতীয় বার তিব্বত যাত্রা৭ নভেম্বর ১৮৮১ দার্জিলিং থেকে যখন শরৎচন্দ্র তিব্বতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তখন তাঁর মন আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় ভরা ছিল। 

লামা উগ্যেনের সঙ্গে তিন-চারটে বাঁশ দিয়ে তৈরি নড়বড়ে সেতু পেরিয়ে সরু পিচ্ছিল পথে গভীর রাতে পরিত্যক্ত গোক গ্রামে পৌঁছলেন। ঘাসের উপর কম্বল পেতে বৃষ্টিতে ভিজে রাতে কিছুটা শুয়ে কাটিয়ে ভোর চারটেয় আবার যাত্রা শুরু হল দুর্গম পথে। সকালে রাম্মাম উপত্যকায় পৌঁছলেন তাঁরা। রঙ্গিতের একটি শাখা নদী রাম্মাম ব্রিটিশ ভারত ও স্বাধীন সিকিমের মধ্যে সীমানা রচনা করেছে। 

দার্জিলিং থেকে এই পর্যন্ত লেখককে কেউ দেখতে পায়নি। এবার তিনি ভারতীয় পোশাক ছেড়ে তিব্বতি পোশাক পড়ে নিলেন। তারপর পাহাড়ে ক্রমাগত ওঠা ও নামা করতে করতে তাঁরা ধুরামদিয়েন উপত্যকায় (ভুটিয়াদের ভাষায় চোর্টেন গাঙ) এসে পৌঁছলেন। পথে অনেক অ্যান্টিলোপ আর বন্য ছাগল দেখলেন। এখানকার গ্রামবাসীরা এত গরীব যে তাদের বন্দুক কিনে এসব জন্তু মারার পয়সা নেই। লিম্বু উপজাতিরা জমি চাষ করে না। তারা এক জমিতে তিন চার বছর চাষ করে আর তিন বছর চাষ না করে ফেলে রাখে। তারপর আগাছা আগুনে পুড়িয়ে আবার চাষ করে। লিম্বুদের অনেক বিচিত্র রীতিনীতি আছে। যেমন ছোটখাটো বিষয়ে তারা ড্রাম বাজায়। উদাহরণ - স্বামী যখন গ্রাম থেকে বের হয়ে যায় আর গ্রামে ফেরে তখন স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে স্বামীর সম্মানে ড্রাম বাজায়। 

এরপর এল নিবিড় বন লম্বা পাইন ও ম্যাগনলিয়া গাছের আর বিরাট বিরাট ফার্নের। বুনো শুয়োরের পায়ের চিহ্ন দেখে আর অনেক ছোটো ঝোরা পেরিয়ে দুপুরে ৬০০০ ফুট উপরে উঠে পরিশ্রান্ত হয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা পেলেন না, কারণ সর্বত্র জোকে ছেয়ে আছে। অবশেষে পাহাড় থেকে নীচে নেমে ধর্মীয় লাল কাপড় বাঁধা বাঁশ গাছের ঝোপের ধারে একটা ওক গাছের নীচে রাত্রিযাপন। ভুটিয়া, লেপচা, লিম্বুদের বাড়ি সম্বলিত সমৃদ্ধি হী গ্রামের পাশ দিয়ে তাঁরা চললেন। দেখলেন এলাচ চাষ হয়েছে। নীচে কালাই বা কালহাইত নদী পার হওয়ার জন্য এখানে দুটি বাঁশের তৈরি সাঁকো রয়েছে। এই নদীতে বাঁশের জালে লিম্বুরা সুস্বাদু মাছ ধরে। আবার পাহাড় চড়া লম্বা লম্বা ঘাস বনের ভিতর দিয়ে। এখানে বুনো শুয়োর আর শজারু প্রচুর আছে। উপর থেকে পেমিয়ানশি, হী, ইয়াংতে প্রভৃতি জায়গা দেখা যাচ্ছে। 

এরপর ক্রমে লিংচাম, সাংনাগ চোইলিং মঠ, তালে গ্রাম, নামবুরা গ্রাম হয়ে পথ চলা। লেখক পাখি বিশেষ করে ফেসান্ট শিকারী দেখলেন, যারা পাখি শিকার করে স্টাফড পাখি বিক্রি করে দার্জিলিং শহরে। কেটা গ্রামে তাঁরা রইলেন ঘন জঙ্গলের মধ্যে। সেই জঙ্গলে ভালুক, শুয়োর আর লেপার্ডদের স্বর্গরাজ্য। এর পরের পথ আরো আশংকায় কাটল যখন তাঁরা খবর পেলেন এক নরখাদক বাঘ দুজন নেপালি কাঠুরেকে সিঙ্গালিলাতে মেরেছে। গত বছর একটা বাঘ অনেক চমরি মেরেছিল। সবাই ভয় পাচ্ছিল যে যদি সেই বাঘ এখানে ফিরে আসে চমরির লোভে। 

ইয়াম-পুং-লা যদিও জংরি-লার মত উঁচু নয় কিন্তু এখানে ওঠা আরো শক্ত। তারপর দু-লা (দানব পাহাড়) যা চড়ার সময় উগ্যেন ও একজন কুলি অসুস্থ হয়ে পড়ল। বরফের মধ্যে দিয়ে হাঁটা এত কঠিন যে লেখক দুই হাত ও দুই পা ব্যবহার করে চলতে থাকেন। 

২০ নভেম্বর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, হালকা বাতাস বইছিল। গাইড ফুর্চুং কিন্তু তুষার ঝড় আসবে আশঙ্কা করছিল। অনিচ্ছাকৃতভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে সে নিজের জিনিস তুলে নিয়ে রওনা হল। তাঁরা নোগা পাস উঠতে থাকলেন। এক মাইল উপরে ওঠার পর তাঁরা একটি বরফ হয়ে যাওয়া লেকের কাছে পৌঁছলেন। গাইড সামনে গিয়ে কিছু বরফের টুকরো নিয়ে লেকের ওপর ছড়িয়ে পথ নির্দেশ করতে লাগল যাতে কেউ পিছলে পড়ে না যায়। সেই পথ অনুসারে অন্যরা যেতে থাকল গাইডের পিছনে পিছনে। কিছুক্ষণ পর গাইড ভয়ে হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল যে আর এগিয়ে কি লাভ, মৃত্যু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক ঘন্টা আছে, তারপর আমরা শেষ। লেখক জানতে চাইলেন কোথায় সে মৃত্যু দেখছে। গাইড আকাশে দেখাল মেঘগুলো খুব তাড়াতাড়ি সূর্যের উপর দিয়ে হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। সেগুলি নাকি খুব তাড়াতাড়ি গভীর বরফপাত ঘটাবে। কেউ পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। বাঁচার একমাত্র রাস্তা বোগটা-লাতে ফিরে যাওয়া। সে কাঁদতে লাগল। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে ফেরা সম্ভব নয়। তাছাড়া আবারও বরফ পড়তে পারে ফিরে যাওয়ার পর। তাহলে তো আবার ফিরে যেতে হবে। এসব অনেক বুঝিয়ে গাইড ফুর্চুং-কে রাজি করানো হল। লেখক নিজে নেতৃত্ব দিলেন এবং এক ঘন্টা পরে তাঁরা পাসে পৌঁছলেন। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। নীল আকাশকে স্বর্গ মনে হচ্ছে। সূর্যের আলো সব ভয় দূর করে দিয়ে গেছে। 

আর ঘন্টাখানেক চলার পর তাঁরা একটি তিব্বতের লম্বা লেজওয়ালা লেপার্ডের পায়ে চলার ছাপ দেখতে পেলে নরম বরফের ওপর। লেখক যখন বিস্ময় প্রকাশ করলেন যে কি করে এত নরম বরফের উপর দিয়ে লেপার্ড যেতে পারে। তখন সঙ্গীরা বলল লেপার্ডের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে। 

আরও ঘন্টাখানেক চলার পর লেখক যখন অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে হাঁটার ক্ষমতা হারালেন গাইড তাঁর জিনিসপত্র (অভঙ্গুরগুলি) বরফের ওপর ছুঁড়ে দিল, ঢাল বেয়ে তা নেমে গিয়ে পাথরে আটকাল। এবার একই পথে লেখক ঢাল বেয়ে শুয়ে নেমে গেলেন। বিকেলে তাঁরা চুলনকিওক -এর গিরিপথে নেমে গেলেন। এরপর সেমারাম পাস থেকে নামার রাস্তা গভীর বরফের মধ্যে দিয়ে ফুর্চুং কিছুতেই খুঁজে পেল না। শেষে তাঁদের উপর থেকে বরফে গড়িয়ে  কয়েকশ ফুট নীচে নামতে হল। খরগোশ, চামডাং নামের এক রকম পাখি এবং তুষার চিতার পায়ের চিহ্ন দেখলেন লেখক সেখানে। 

কাংপা-চান গ্রামে গাইডের বাড়ি। সেখানে তার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে লেখকের দেখা হল। ক্রমে তাঁরা মান্ডিং গুম্ফাতে পৌঁছলেন। সেখানে তিব্বতে ঢোকার অনুমতি পাওয়ার জন্যে ফুর্চুং লামা ও গ্রামের মাথাদের সঙ্গে অনেক আলোচনা করে রাজি করাল। লেখক অনুমতি পেলেন। তারা তাঁকে তীর্থযাত্রী হিসেবে গণ্য করল এবং স্বীকার করল লেখক তিব্বতি পোশাক পরেন, তিব্বতি রীতিনীতি মানেন ও বেশিরভাগ নেপালির থেকে ভালো তিব্বতী বলেন। প্রধান লামা দেখা করে তাঁদের বিদায় সম্ভাষণ জানালেন এবং এক বছর পর পুনরায় দেখা হওয়ার হওয়ার শুভেচ্ছা জানালেন। 

এবার যাংগমা নদীর পাড় ধরে যাত্রা, যদিও বরফে ঢাকা নদীকে আলাদা করে চেনা যায় না। কোথাও প্রাণের কোন চিহ্ন নেই। সেই বরফের দেশে তারপর চ্যাং-চুব-গ্যা-লা হিমবাহতে উঠতে হল। পথে অনেকবার লেখককে ফুর্চুং পিঠে করে তুলেছে। রাত কাটানোর একটি গুহা গাইড চিনত কিন্তু অন্ধকার রাতে কিছুতেই পথ চিনে সেখানে পৌঁছানো গেল না। বরফের ফাটলে পড়তে পড়তে বাঁচলেন তাঁরা। অবশেষে পাথরের উপর সারারাত হাঁটুতে মুখ গুজে বসে কাটালেন ক্ষুধা তৃষ্ণায়, অস্বাভাবিক ঠান্ডায়। কী যে বিভীষিকাময় রাত সেটি ছিল তা ভাবা যায় না। 

পরদিন গাইড ও কুলিরা মন্ত্র পাঠ করতে করতে পিঠে বোঝা তুলে নিল। দিনটা খুব ঝকঝকে ছিল। কাংলা চান সামনে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছিল সূর্যের সোনালী আলোতে। আর নতুন বরফপাত হয়নি। অত্যন্ত বিপজ্জনক পথে গাইড সামনে লাঠি দিয়ে বরফ পরীক্ষা করে করে এগিয়ে আর অন্যদের জন্য নরম বরফে পা রাখার জায়গা বানাতে বানাতে চলল। লামা উগ্যেনকে ফুর্চুং-এর কয়েকবার পিঠে নিতে হল। 

ঘন্টাখানেক চলার পর কাংলা চেনের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছলেন তাঁরা। সেখান থেকে বরফের সমুদ্র ছাড়া যেন কিছু দেখা যায় না। তুষার ধ্বসের গর্জন দূর থেকে মাঝে মাঝেই ভেসে আসছে। উত্তুঙ্গ সাদা শৃঙ্গগুলি আকাশ ছুঁয়েছে। লেখকের মনে ভয় দূর হয়ে আশ্চর্য আনন্দের ভাবে ভরে উঠল। সঙ্গে এই পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য ঈশ্বরের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা উপলব্ধি করলেন। 

পরদিন গাইডের পদচিহ্ন অনুসরণ করে দর্রেজে-তাগ রেঞ্জের পাহাড়ের চড়াই পেরিয়ে নীচে এসে রডোডেনড্রন, জুনিপার গাছ দেখলেন বেশ কয়েকদিন পরে। নদীর জলে শব্দ শুনলেন অনেকদিন পর। আর দুদিন পর রান্না করা ভাত আর বাটার চা খেলেন পরম স্বস্তিতে। 

এরপর নদীর গতিপথ ধরে আরো নেমে চলা। এখানে চমরি গাই পালন করা হয়, তাই মাঝে মাঝে নেকড়ের দল তাদের আক্রমণ করে খেতে আসে। এইভাবে ক্রমাগত আরো সাত দিন চলার পর অবশেষে তাঁরা নয় ডিসেম্বর তাশীলহুনপো গিয়ে পৌঁছালেন। পথে একবার তাঁরা এক টাকায় দুটি চমরি ভাড়া করে তার পিঠে সাত মাইল পথ অতিক্রম করেছিলেন। 


মন্ত্রীর প্রতিনিধি শরৎচন্দ্র দাসকে পন্ডিত সম্বোধন করে সাদরে আহ্বান জানালেন। ১৮৮২ এপ্রিল মাসে লেখক তাশীলহুনপো থেকে ডঙটসে যান লাসা যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। সেখানে যাবতীয় বন্দোবস্ত করে ১২ মে ১৮৮২ তিনি লাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন ডংটসে থেকে। মন্ত্রী মহোদয় শরৎচন্দ্রকে আশীর্বাদ করে সাবধান করলেন লাসার মানুষরা তশীহুনপোর মানুষের মতো ভালো নয়, তিনি যেন বেশি দিন কোথাও না থাকেন। লামারা যেন শহরের বাইরে কোথাও থাকেন। তাছাড়াও গুটি বসন্তের প্রকোপ হয়েছে, লাসাতে। সেজন্য তিনি সতর্ক থাকতে বলেন। এবার উগ্যেন লামা ও ফুর্চুং সঙ্গে নেই। সম্পূর্ণ দুজন নতুন সঙ্গীর সঙ্গে তিনি রওনা দিলেন। এবারে তাঁর সঙ্গী দুজন হলেন সেরিং তাশী আর পাদোর

                        (চলছে)

২টি মন্তব্য:

  1. তাশীহুনপোর যাত্রার গল্প অতি ভয়ঙ্কর, বরফের উপর কম্বল বিছিয়ে রাত কাটানো তার উপর ভয়ঙ্কর হিংস্র জন্তু জানোয়ারের আনাগোনা ভাবনাতেই শিউরে উঠছে শরীর। লেখকের দুঃসাহসিকতার সন্মান জানাই। অতি রোমাঞ্চকর একটি পর্ব। শিউলি

    উত্তরমুছুন