সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
কামবাচান মঠের বড় লামা লেখকদের সহায়তা করলেন। তিনি গোপনে খবর দিলেন যে ওই আধিকারিক গ্রামে এসে পৌঁছানোর আগে লেখকদের গ্রাম থেকে রওনা দিতে হবে চা-থাং-লার উদ্দেশ্যে।
পরদিন খুব ভোরে যাত্রা করে মাইল তিনেক গিয়ে এল কান-ডুম-চু জলপ্রপাত, যা খুব পবিত্র। এখানে আট জন ভারতীয় সাধু, যাঁরা অষ্টবিদ্যাধর তাং-শ্রুং-গ্যাপা নামে পরিচিত, তাঁরা এখানে স্নান করেছিলেন। হাজার ফুট উঁচু থেকে নামা এই জলপ্রপাত অপূর্ব সুন্দর। পথে একটা ছোট কুন্ড দেখলেন। বৌদ্ধ গুরু পেমা এখানে স্নান করেছিলেন বলে এটি পবিত্র।
সেদিন সন্ধ্যায় তাঁরা যে গুহায় আশ্রয় নিলেন তার মালিক এক পার্বত্য শেয়াল। গাইড জানাল সেখানে মাস্ক গোট, হিমালয়ের অ্যান্টিলোপ আর নাও (ওভিস আম্মন) অনেক আছে। স্থানটি ১৮৮২০ ফুট উঁচু। তাঁরা চা আর ভুট্টা খেয়ে রাত কাটালেন। পরদিন পথ চলার সময় লেজহীন একরকম ছোট ছুঁচো দেখলেন যারা নাকি বরফের উপর গজানো মস (moss) খেয়ে থাকে।
এরপর শুধু বরফ আর বরফ। উনিশ হাজার ফুটের উপর উঠে তাঁদের নিঃশ্বাসের খুব সমস্যা হতে লাগল। সঙ্গে বরফের উপর সূর্যের আলোর ঝলকানিতে চোখে খুব কষ্ট হতে লাগল নীল চশমা থাকা সত্ত্বেও। চলা অসম্ভব হলেও চলতে হল কারণ রাতে থাকার মত কোন জায়গা পাওয়া গেল না। অবশেষে সন্ধ্যে সাতটার সময় একটা জায়গা পেয়ে গাইড রাতে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করল। সেখানে বড় পাথরের ওপর বরফ জমে শক্ত হয়ে আছে। রাতে বরফ গলবে বলবে না বলে পাথর খসে পড়ার ভয় নেই যতক্ষণ না ভোর হচ্ছে। তাই ভোরে আবার যাত্রা শুরু হবে ঠিক করে খালি পেটে তাঁরা বরফের ওপর কম্বল পেতে রাত্রি যাপন করলেন।
পরদিন ভোরে যেন বরফের সমুদ্রে তাঁদের যাত্রা শুরু হল। বরফে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে আছে। লেখকের পা অবশ হয়ে এল আর চলা যাচ্ছে না। তখন লেখকের পাহাড়ে সাথী গাইড ফুর্চুং তাঁকে পিঠে নিয়ে বেশ কিছু দূর পার করিয়ে দিল। তারপর লেখক আবার চলতে পারলেন। কিন্তু এরপর এল এক বিশাল ঢাল যার উপরে উঠে অন্যদিকে পৌঁছলে রাতে থাকার জায়গা মিলবে। লেখক বারবার পা পিছলে নীচে গড়িয়ে পড়তে থাকেন। তিনি ভাবলেন এবার বরফে ডুবে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। গাইড ফুর্চুং আবার এগিয়ে এল। কুকরি দিয়ে বরফ কেটে লেখককে পা রাখার সিঁড়ি বানিয়ে দিয়ে, তাঁকে হাত ধরে টেনে তুলতে থাকল। অবশেষে সন্ধ্যে ছটায় তাঁরা একটা পার্বত্য গুহায় পৌঁছলেন, যা বেশ বড়, যেখানে রাতে বেশ আরামে থাকা যাবে। আরামে অর্থাৎ বরফের ওপর কম্বল পেতে শোয়া, গুহার ছাদের ফাটল দিয়ে জল পড়ে ভেজা জামা কাপড়ে রাত কাটানো।
এইভাবে এই পথে সব থেকে শক্ত অংশ চা-থাং-লা পেরোলেন তাঁরা, যা সম্ভবত কুড়ি হাজার ফুট উঁচু। পরদিন ছয় ঘন্টা পাড়ি দিয়ে এই পাস থেকে নামলেন। এরপর তাঁরা চীনের সঙ্গে নেপাল ও সিকিমের সীমান্তে উপস্থিত হলেন। এখানে গাইড খুব ভীত হয়ে পড়ল দোগপাদের জন্য। দোকপারা এই পাস পাহারা দেয়। লেখকরা পর্যটকদের জন্য বন্ধ এই পাসে এসেছেন অবৈধভাবে, তাই তাঁদের পাসপোর্ট কাজে লাগবে না। শাস্তি এড়াতে তাঁরা সন্ধ্যা পর্যন্ত গুহায় লুকিয়ে থেকে রাত্রির অন্ধকারে এক মাইল চওড়া নদী পাথরের উপর দিয়ে পার হলেন।
এরপর উঁচু পাহাড়ে খাড়াই পথ ধরে এলেন চর্তেন-ন্যিমা-লার দক্ষিণ দিকে। চাঁদের আলোয় অল্প বরফ পড়া মাটিতে কম্বল পেতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন তাঁরা। পরদিন চলার পথ খুব খাড়াই না হলেও কষ্টকর ছিল। তিনদিন কোন খাবার তাঁরা খাননি। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর অবস্থায় আট মাইল হেঁটে চর্তেন-ন্যিমা-লার দক্ষিণ দিকের পাদদেশে পৌঁছালেন তাঁরা।
ফুর্চুং-এর সাহায্যে লেখক সেই সুউচ্চ পাসের ওপর উঠলেন। নীচে তিব্বতের মালভূমি দেখা গেল। এবার নামার পালা, তিনটের সময় তাঁরা নীচে এক সুন্দর লেকের ধারে নেমে এলেন। আয়নার মতো স্বচ্ছ লেকের জলে চারপাশে শৃঙ্গগুলির আর নীল আকাশের ছায়া পড়েছে। লেক থেকে নির্গত হয়ে চর্তেন ন্যিমা নদী বয়ে গেছে। সেই নদী অনুসরণ করে এবার পথ চলা। ভুট্টা আর চিনি খেয়ে এবার নীচে চলা শুরু হল। হিমালয়ের উত্তর দিকে চারপাশে গাছপালা নেই বললেই চলে (কারণ এই তিব্বত হিমালয় বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে পড়েছে। বৃষ্টিপাত এখানে নগণ্য)।
সব সময় তাঁদের মনে ভয় যে চর্তেন ন্যিমা গুম্ফাতে যেসব প্রহরী রয়েছে তারা হয়তো দেখে ফেলবে, তাই তাঁরা যতটা সম্ভব বড় বড় পাথরের চাইয়ের আড়াল দিয়ে চলছিলেন। কখনো কোনো পাথর দেখে মনে হচ্ছিল চমরি বা ঘোড়া আসছে। তখন তাঁরা সটান মাটিতে শুয়ে পড়ছিলেন। এইভাবে পাঁচ মাইল পথ পেরিয়ে এক জায়গায় তাঁরা পৌঁছালেন যেখানে অতি প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধদের তৈরি সৌধ আছে। তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, চীন থেকে প্রতিবছর তীর্থযাত্রীরা এখানে আসে। মঠে কোন মানুষ নেই।
পরবর্তী পথে দু'পাশে সাদাকালো সবুজ রঙের স্লেট পাথর দেখতে থাকলেন, যা এই প্রথম এখানে দেখা গেল। একটানা চলতে চলতে তাঁরা গভীর রাতে তাঁরা থেকং গ্রামের কাছে মূল রাস্তার দেখা পেলেন। তারপর খোলা আকাশের নীচে কম্বল পেতে ঘুম। পরদিন চলার পথে ক'জন পর্যটকের সঙ্গে তাঁদের দেখা হল। তারা সারে চলেছে। লেখককে নেপালি তীর্থযাত্রী বলে পরিচয় দিল গাইড। তাঁরা টাং-লুং নামের একটি গ্রামে আশ্রয় নিলেন একটি বাড়িতে। অনেক গ্রামবাসী তাঁদের দেখতে এল। এসে তারা ভিক্ষা চাইতে লাগল। একজন ফেরিওয়ালা তার স্ত্রীকে নিয়ে তাঁদের কাছে এসে নাচ গান করে গেল তাঁদের শুভযাত্রা কামনা করে। পরদিন ভেড়ার মাংস কিনে খেলেন তাঁরা অনেক দিন পর। ডিমও কিনে নিলেন কিছু। তারপর ঘোড়া ভাড়া করে যাত্রা শুরু হল।
এবার আরামদায়ক যাত্রা। সুন্দর খান-লা-ডংকি-চু নদীর ধার দিয়ে। থেকে থেকে বার্লি চাষ হয়েছে। চমরি, ভেড়া, ছাগল মাঠে চড়ছে। অজস্র গর্ত থেকে শয়ে শয়ে মারমট এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। একটা ছোট গ্রামে তাঁরা পৌঁছতে জনা কুড়ি গ্রামবাসী এসে তাঁদের কাছে জড়ো হল তাঁরা কি বিক্রি করতে এসেছেন জানতে। লেখকের রিভলবার এবং লামার পিস্তল তাদের পছন্দ হলো ও তারা কিনতে চাইল। মোড়ল চমরি গায়ের লোমের আসনে বসিয়ে বার্লি বিয়ার আর বাটার দেওয়ার চা খাওয়াল। রাতে আরেকটি গ্রামের পথিকদের ছাউনিতে থাকা হলো।
পরদিন পথে কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে একপাল গাধাকে পেরিয়ে দুপুরে গুরমে নামক শহরে পৌঁছলেন। সেখানে ৬০০ পরিবারের বাস, এরা পশুচারণ করে। নিকটবর্তী পাহাড়ে পশু চড়ায় পশুর চামড়ার তাঁবুতে থে। ফুর্চুং মাংস আর বিয়ার সংগ্রহের জন্য সেই গ্রামে যেতে কুকুর আর গ্রামবাসীরা তাকে ডাকাত মনে করল। পরে সবাইকে দেখে তারা তাঁদের গ্রামে ঢুকতে ও সব খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে দিল। এখানে তাঁরা খবর পেলেন যে কাছে ডাকাতের দল ঘুরছে। লেখক ও লামা তাঁদের বন্দুক, তরোয়াল, ভুটানি ছোরা তৈরি রাখলেন।
পরদিন যাত্রাকালে দুপুর বেলা বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি হল। ভিজে অবস্থায় তাঁরা মেষপালকদের আস্তানায় আশ্রয় নিলেন। সেই আস্তানায় গোবরের ওপর কম্বল পেতে শুলেন, ভাত আর মাংস রান্না করে খেয়ে। বিকেলে মেষপালকের দল সেখানে ফিরল। তারা সংখ্যায় ৫০০ কম নয়। কুলিরা মেষপালকদের বোঝাল লেখকরা বড় লামা আর ব্যবসায়ী। মেষপালকেরা যেন তাদের বিরক্ত না করে। মেষপালকরা বলল গতকাল ডাকাত এসে তাদের থেকে ভালো ভালো ভেড়া নিয়ে গেছে। লেখকেরা যে ডাকাত নয় তাতেই তারা খুশি। এবার কজন তিব্বতি লেখকদের সহযাত্রী হল। ডাকাতের ভয়ে সবাই সঙ্গী পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হল। ক্যাগো-লা গিরিপথ বেয়ে এবার পথ উতরাই।
পথে প্রথমে এলো রি নদীর ধার। সেখানে ভেড়া চড়ছে। দুটি বিশাল পাহারাদার তিব্বতি কুকুর অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ভাবে তাঁদের তাড়া করল। তাদের নিরস্ত করা যখন গেল না তখন একটিকে লামা গুলি করে মারল , অন্যটি ফিরে গেল। পরদিন এল লেখকের দেখা প্রথম তিব্বতের বৌদ্ধমঠ রি-গনপা বা রি মনাস্ট্রি। এই প্রাচীন মঠে ৩০০ লামা থাকেন ও তন্ত্র মতে সাধনা করেন। বড় লামা নাকি তুষারপাত নিয়ন্ত্রণ করার বিদ্যা জানেন। অনবরত তুষারপাতের মধ্যে তাঁরা ক্যা-গো-লা পাসের শীর্ষে পৌঁছলেন। সেখানে নদীর পাথরের ওপর কম্বল পেতে বৃষ্টি আর অসম্ভব ঠান্ডায় হাত-পা অসার অবস্থায় রাত কাটালেন।
সকালে খালি পেটে অত্যন্ত ঢালুপথে পাস থেকে নামতে থাকলেন তাঁরা। বিকেলে একটা গ্রামে চা, বিয়ার আর বার্লি খেতে পেলেন। পরদিন গ্যা-লা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে তার শেষ প্রান্তে লেখকের গন্তব্য স্থল তাশিহুনপো দেখতে পেলেন। নীচে মধ্য তিব্বতের অন্যতম সুন্দরতম দৃশ্য। পেনাম-ন্যাং চু নদী বয়ে যাচ্ছে। নীচে নেমে ক্রমে তাশিহুনপো মঠের সোনালী চূড়া চোখে পড়ল। পথে অনেক লামা, ব্যবসায়ীদের ঘোড়া, চমরি, গাধার পিঠে যেতে দেখা গেল।
অবশেষে জংরি থেকে যাত্রা শুরু করার ২১ দিন পরে ৭ জুলাই ১৮৭৯ তাঁরা তাশিলহুনপো পৌঁছালেন। এরপর নতুন দেশে, নতুন পরিবেশে লেখকের মানিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম, প্রধান লামা, মন্ত্রী প্রমুখের সঙ্গে কাটানো সময় এইসব আকর্ষণীয় হওয়া সত্ত্বেও ভ্রমণ কাহিনীর অন্তর্গত করে একে ভারাক্রান্ত না করে এখানেই তাঁর ভ্রমণের প্রথম পর্ব শেষ করা হল। তাশিলহুনপোতে থাকার সময় ঘোড়ায় করে তিনি ও লামা উগ্যেন সাংপো থেকে ঘুরে এসেছিলেন।
এর পরবর্তী পর্যায়ে তিব্বতের যে ভ্রমণ কাহিনী বর্ণিত হবে তা নেওয়া হবে "জার্নি টু লাসা এন্ড সেন্টার টিবেট" নামে শরৎচন্দ্র দাসের লেখা অন্য বইটির থেকে।
(চলছে)
লেখকের বরফের কঠিন বিস্তীর্ণ পথ অতিক্রম করার বর্ণনা এই পর্বের আকর্ষণ ।জংরি থেকে তাশিহুনপো একুশ দিনের বরফের পথের এক অতি কষ্টকর যাত্রার গল্প জানলাম পর্বের মাধ্যমে।শিউলি
উত্তরমুছুনধন্যবাদ 🙏
উত্তরমুছুনAsadharan laglo, jatra poth ebong tader obhigyota. Sotti e onobodyo.
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুন