পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

৬৪। পালামৌ - সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম 


সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ বইটির প্রথম সংস্করণ বৈশাখ, ১৩৫১ অর্থাৎ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। তার আগে পালামৌ শীর্ষক প্রবন্ধগুলি সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১৮৮১ ও ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে (১২৮৭ সালে সপ্তম বর্ষ বৎসরে, ১২৮৮ সালে অষ্টম বছরে এবং ১২৮৯ সালে নবম বছরের বিভিন্ন অংশে যথাক্রমে দুটি, তিনটি ও একটি প্রবন্ধ) প্রকাশিত হয়। 



পালামৌ বইতে লেখকের ভ্রমণকাল লেখক সুস্পষ্টভাবে কখনো বলেননি। তবে এই লেখায় লেখক বারবার বলেছেন যে এই ভ্রমণটি তিনি অনেক আগে করেছেন। তাঁর ভাই সাহিত্য -সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'সঞ্জীবনী সুধা' নামে তাঁর সম্পাদনায় যে বইটি ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে; সেখানে তিনি সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখেছেন। সেটি থেকে জানা যায় যে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম সঞ্জীবন চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর জন্ম হয় ১৭৫৬ শকের বৈশাখ মাসে অর্থাৎ ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৮১১ শকের বৈশাখ মাসে অর্থাৎ ১৮৮৯ এ। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন যে চাকরি জীবনের প্রথম দিকে সঞ্জীবচন্দ্র পালামৌ গেছিলেন। জীবনী মূলক প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বিশেষ সাল তারিখ উল্লেখ করেননি। তবুও তিনি লিখেছেন সঞ্জীবচন্দ্রের লেখা 'বেঙ্গল রায়তস' বইটি লেখায় খুশি হয়ে লেফট্যানেন্ট গভর্নর সাহেব তাঁকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদ উপহার দেন। তখন তিনি কৃষ্ণনগরে নিযুক্ত হন। দুই বছর সেখানে থাকার পরে সরকার গুরুতর কাজের ভার দিয়ে তাঁকে পালামৌ পাঠান। বেঙ্গল রায়তস বইটি ১৮৬৪ তে প্রকাশিত হয়।এর থেকে বোঝা যায় উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষে তিনি পালামৌতে গেছিলেন।


ঔপন্যাসিক প্রবন্ধকার এবং বঙ্গদর্শনের অন্যতম সম্পাদক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আরো কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। কন্ঠ মালা (উপন্যাস), মাধবীলতা (উপন্যাস, জাল প্রতাপচাঁদ (ঐতিহাসিক রচনা)। সঞ্জীবচন্দ্র ব্যক্তিগত জীবনে খুব অগোছালো ছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী হওয়া সত্বেও শিক্ষা লাভ তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পর্যন্ত পাওয়া সত্ত্বেও তিনি চাকরি রক্ষা করতে পারেননি। তেমনি লেখার হাত অত্যন্ত পাকা হওয়া সত্ত্বেও পালামৌ রচনাটি তাঁর স্বভাবসুলভ ভাবেই এলোমেলো। এই বইয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভ্রমণ বিষয়ক অংশ এখানে আলোচনা করা হলো। 


যে সময় তাঁর পালামৌ যাওয়া ঠিক হয় তখন তিনি জানতেন না সেই স্থান কত দূরে, কোথায় অবস্থিত। তারপর ম্যাপ দেখে যাত্রাপথ ঠিক করেন। সেই সময় খুব কম মানুষই পালামৌতে গেছেন। রানীগঞ্জে ইংল্যান্ড ট্রানজিট কোম্পানির ডাকগাড়ি ভাড়া করে রাত্রি দেড় প্রহরের সময় হাজারীবাগের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তিনি। সকালে বরাকর নদীর পূর্বপাড়ে গাড়ি থামল। ছোট নদী সবাই হেঁটে পাড় হয়, গাড়িগুলি দিয়ে ঠেলে পার করানো হল। সেখানে তিনি প্রথম বন্য আদিবাসী নারীপুরুষ, বালকবালিকা দেখলেন। তাঁকে সাহেব বলে ডেকে পয়সা চাইতে লাগল বালকবালিকারা কারণ সম্ভবত তাদের ধারণা যারা গাড়ি চড়ে তারা সাহেব। বরাকর থেকে ছোট পাহাড় প্রথম দেখা গেল। কখনো পাহাড় না দেখা লেখক অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। বিকেলে গাড়ি পাহাড়ের কাছ দিয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি নেমে হেঁটে পাহাড়ের কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু অনেক হেঁটে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন ও বুঝলেন পাহাড়ের দূরত্ব স্থির করা বাঙালির পক্ষে বড় কঠিন। (রাধা নাথ শিকদার বাঙালি হয়েও ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করেন। এই খবর নিশ্চয়ই তাঁর জানা ছিল)। 


পরদিন হাজারীবাগ পৌঁছে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়ি আহারাদি সেরে রাত্রি দেড়টার সময় ছোটনাগপুর যাত্রা করলেন পালকি চেপে। সেখান থেকে দু চার দিনে পালামৌ পৌছালেন। রাঁচি থেকে পালামৌ যাওয়ার সময় দূর থেকে পালামৌর পাহাড়কে মেঘ বলে মনে হচ্ছিল। ধীরে ধীরে পাহাড় ও তারপর জঙ্গল স্পষ্ট হল। 


সেই পাহাড় ও জঙ্গল নিরবচ্ছিন্ন জঙ্গলের রাস্তায় কতগুলি কোল বালক গলায় ঘন্টা বাঁধা মোষেদের চড়াচ্ছিল। তাদের কৃষ্ণ ঠাকুরের মতো দেখতে। গলায় পুতির সাত নরী, তাতে ধুকধুকির বদলে একটা করে গোল আরসি। পরনে ধড়া, কানে বনফুল। তারা খেলা করছে, নাচ করছে। তারা খর্বাকৃতি, কৃষ্ণবর্ণ। তারা রূপবান না কুৎসিত সে বিচার লেখক অসমর্থ। তবে তিনি অনুভব করেছেন যে এই প্রকৃতির কোলে তারা বিশেষ রূপে সুন্দর। 'বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে' সেই প্রবাদপ্রতিম বাক্য এখানে লেখক লিখেছেন। 


পরে পালামৌ পৌঁছে তিনি দেখলেন সেই নিরবচ্ছিন্ন জঙ্গলের মধ্যে নদী, গ্রাম সবই আছে। পাহাড়ের পর পাহাড় যেন সমুদ্রের অবিরত তরঙ্গ। সেই পাহাড়ে কোন শব্দ দীর্ঘস্থায়ী প্রতিধ্বনি তৈরি করে। প্রধানত কোলেদের বাস। দূরে দূরে তাদের গ্রাম ৩০-৩২ টি ঘর নিয়ে। সবকটি পাতার কুটির। 


কোল নারীরা কটিদেশে একটি ক্ষুদ্র কাপড় মাত্র পরিধান করে, উর্ধাঙ্গ অনাবৃত। আভরণে পুতির সাত নরী হার, তাতে আরসি ঝুলছে। কানে ছোট ছোট বনফুল, মাথায় বড় বনফুল। নারী ও শিশু দল বেঁধে এসে লেখকের পালকি দেখে। কোলেদের মধ্যে বৃদ্ধার সংখ্যা অতি অল্প। অশিতিপর না হলে তারা বৃথা হয় না। অতিশয় পরিশ্রমী বলে হয়তো তারা চিরযৌবনা থাকে। পুরুষ জাতির মধ্যে লেখক জীবনী শক্তি কম দেখেছেন। কোলেরা নারী পুরুষ মদ্যপান করে কিন্তু কেউ মাতলামি করে না। 


প্রতিদিন বিকেলে তিনি লাতেহার পাহাড়ে গিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখার জন্য দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করতেন। একটি পাহাড়কে তিনি ভালোবেসে কুমারী নাম দিয়েছিলেন। তার ছায়ায় বসে তিনি প্রতিদিন দূরে চারদিকে পাহাড়ের পরিখার মধ্যে ছোট্ট পৃথিবী দেখতেন। জঙ্গলের মধ্যে গ্রাম থেকে ধোঁয়া উঠত আর হয়তো মাদলের শব্দ ভেসে আসত। তাঁর সাদা তাঁবুটি যেন জঙ্গলের মধ্যে একলা কপোতের মতো দেখাত। এই ছিল লেখকের দুনিয়া। 


একদিন তিনি দেখলেন একটি যুবক বীর দর্পে কয়েকটি স্ত্রীলোকের বারণ অগ্রাহ্য করে বাঘ মারতে যাচ্ছে কারণ বাঘ তার গরুকে মেরেছে। লেখক বন্দুক নিয়ে তার সঙ্গে গেলেন এবং দুজনে মিলে খুঁজে বার করলেন একটি গুহায় নিদ্রারত বাঘটিকে। বিশাল পাথর গড়িয়ে এনে তার আঘাতে যুবক সেই ঘুমন্ত বাঘকে মেরে নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করল। 


একদিন চন্দ্রালোকিত রাতে আমন্ত্রিত হয়ে কোলেদের নৃত্য দেখে এলেন। লেখকের মনে হল তাদের গানের সুর যেন পাহাড়ের মূলে, পাহাড়ের বুকে গিয়ে লাগছে। সেই নাচের তালে যেন আকাশে চাঁদ হাঁসছে। 


লেখক কোলেদের বিবাহ দেখলেন। এদের বিয়েতে কন্যাহরণ করতে হয় আর কোন মন্ত্র তন্ত্র লাগে না। কোলেদের কাছে বৃহত্তম উৎসব হলো বিয়ে। এই উপলক্ষে তারা ১০ থেকে ১৫ টাকা খরচ করে যা তাদের পক্ষে অত্যন্ত বেশি। সেই অর্থ জোগাড় করতে তারা মহাজনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে সারা জীবনের মতো। 


পালামৌ-এর সম্পদ মহুয়া ফুল। মহুয়া ফুল (লেখকের ভাষায় মৌয়া) ঝরে পড়ে গাছের তলায় ছেয়ে থাকে, হাজার হাজার মাছি মৌমাছি গুনগুন করে সেখানে উড়ে বেড়ায়। সেই আওয়াজ বনময় কোলাহলের মত ছড়িয়ে পড়ে। কোলেরা এই ফুল খাবার হিসেবে ব্যবহার করে। শুকিয়ে রাখলে এই ফুল অনেক দিন থাকে। বর্ষাকালে দরিদ্র কোলেরা শুধু এই ফুল খেয়েই ২-৩ মাস কাটায়। তাছাড়া এই ফুলের তৈরি মদ এখানে ব্যবহার হয়। 


এভাবেই ভ্রমণ কাহিনী শেষ হয় লেখকের। বাকিটুকু অজানাই থেকে যায় পাঠকের।

২টি মন্তব্য:

  1. সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ বইটি থেকে রানিগঞ্জ বরাকর অঞ্চলের পাহাড়ের কোলের জীবনযাত্রার নানান গল্প, কোলেদের বিষয়ক নাজানা কিছু গল্প বেশ উপভোগ করলাম। সুন্দর পর্বটি ।শিউলি

    উত্তরমুছুন