পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৫

৭২। ভারত ভ্রমণ ১ - বরদাকান্ত সেনগুপ্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


       

"ভারত ভ্রমণ" গ্রন্থের লেখক বরদাকান্ত সেনগুপ্ত সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতে পারা যায়নি। তাঁর লেখা অন্য কয়েকটি বইয়ের নাম শুধুমাত্র জানা গেছে - আমার গান ও কবিতা, সারদা (উপন্যাস), চাঁদের বিয়ে (উপন্যাস), হৈমপ্রভা (উপন্যাস), প্রতিভা (উপন্যাস)। তিনি সঞ্জীবনী, সন্দর্ভ প্রভৃতি পত্রিকায় লিখতেন। এই লেখার ভ্রমণ কাল নির্ধারণ করতেও কিছুটা সমস্যা এসেছে কারণ লেখক লিখেছেন যে এই ভ্রমণ শুরু হয় ১২৮৮ বঙ্গাব্দের ৫ শ্রাবণ অর্থাৎ ১৮৮১ সনের ১৯ জুলাই। অথচ তিনি বইটির উৎসর্গ অংশে তারিখ লিখেছেন মাঘ ১২৮৪ (যেটি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ)। কিন্তু ভ্রমণের আগে উৎসর্গ পর্ব সম্ভব নয়। যেহেতু লেখক ভ্রমণ শুরুর দিনটি বাংলা এবং ইংরেজি দুরকম তারিখে বর্ণনা করেছেন আর উৎসর্গে শুধুমাত্র বাংলা তারিখ উল্লেখ করেছেন, অতএব ধরে নেওয়া হচ্ছে মুদ্রণকালে উৎসর্গের তারিখটি ভুল ছাপা হয়েছে। অর্থাৎ ভ্রমণ শুরু হয়েছিল ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে উনিশে জুলাই তারিখেই। 

বইয়ের শুরুতে তিনি লিখেছেন বাংলা ভাষায় ভ্রমণ বৃত্তান্ত প্রায় নেই। তিনি তিন বছর ধরে ভারতের নানা স্থান ভ্রমণ করে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তা এই বইয়ে লেখা হল। বিবরণ সংগ্রহ করতে দু একজন বিদেশী ভ্রমণকারীর বই, জনপ্রবাদ প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে এই বই লেখা হয়েছে। এই বইটির একটি দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশ হবে বলে তিনি লিখেছেন, যাতে মালব মধ্যভারত, বম্বে ইত্যাদি স্থানের ভ্রমণকাহিনী থাকবে বলে জানান হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় খন্ডটি হয় প্রকাশিত হয়নি অথবা যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি। তাই শুধুমাত্র প্রথম খন্ডের ওপরে ভিত্তি করেই এই ব্লগটি লিখিত হল। 

লেখকের ভ্রমণ তৃষ্ণা বাল্যকাল থেকেই ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি তীব্রতর হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৮৮১ সনের ১৯ শে জুলাই তিনি 'শ _ ' নামক এক উৎসাহি কিশোরকে সঙ্গে নিয়ে গোপনে ঘর ছেড়ে দেশ ভ্রমণে বের হন। যাওয়ার সময় হাওড়া স্টেশনে ডাক-বাক্সে আত্মীয়দের কাছে লেখা চিঠিতে এই গৃহত্যাগের খবর জানিয়ে তাঁরা ট্রেনে উঠলেন। তারপর থেকে শুরু হল লেখকের আসল ভ্রমণ কাহিনী। 

বরদাকান্ত সেনগুপ্তের বেশ কিছু ভ্রমণ স্থান ও ভ্রমণ বিষয়ক কাহিনীর ভোলানাথ চন্দ্রের ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু -র সঙ্গে অনেক মিল আছে। এই কারণে নতুন কোন বিষয়ের অবতারণা হলে তাহলে শুধুমাত্র আলোচনা করা হবে। 

ট্রেনে প্রথম ভ্রমণ স্থানগুলি পরপর বলা হল - শ্রীরামপুর, মাহেশ, বৈদ্যবাটি, চন্দননগর, চুঁচুড়া, হুগলি ইমামবাড়ী, সপ্তগ্রাম, পান্ডুয়া, বর্ধমান। এই পর্যন্ত অংশে নতুন কথা লেখক যা লিখেছেন তা হল - (প্রথম) মহম্মদ মহসিন তাঁর দুঃখিনী বোনের সমব্যথী হয়ে ইমামবাড়ী প্রতিষ্ঠা করে মুসলমান গরীব ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন এবং নিজে ও তাঁর বোন সন্ন্যাসের ন্যায় জীবন বেছে নিয়েছিলেন। (দ্বিতীয়) বর্ধমানে আত্মীয়ের বাড়িতে ধরা পড়ে যেতে যেতে পালিয়ে কিভাবে তাঁরা বর্ধমান থেকে পালালেন সেই বর্ণনা। 

বর্ধমানের পরেই কানু জংশন স্টেশন (খানা জংশন)। সেখান থেকে লুপ লাইনের গাড়িতে রাজমহল চললেন। পথে পড়ল তিনপাহাড় স্টেশন। তিনপাহাড়ের দৃশ্য খুব সুন্দর। পাহাড় কেটে রেলপথ তৈরি হয়েছে। এখানে রেলগাড়ি পরিবর্তন করে তাঁরা রাজমহল গেলেন। সেখানে তাঁরা ইলিশ মাছ রান্না করে খেয়ে একটা দোকানে শয়ন করলেন। রাজমহল থেকে ট্রেনে লক্ষীসরাই হয়ে মোকামা পৌঁছে অন্য গাড়িতে বারেঘাটের (বরদাঘাট, নেপাল) উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। তাঁরা তখন দেশ ছেড়ে নেপাল যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। 

ট্রেনে মত পরিবর্তন করে তাঁরা বেনারস পর্যন্ত টিকিট বাড়িয়ে নিলেন। বাঁকিপুর, দানাপুর, আরা, শোন নদীর সেতু ইত্যাদি পেরিয়ে মোগলসরাই পৌঁছাল ট্রেন। এরপর তাঁরা অন্য ট্রেনে রাজঘাট (বেনারসের একটি ঘাট) পৌঁছে নৌকা পার হয়ে বেনারস গেলেন। বিশ্বনাথ মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, জ্ঞানবাপি, বেনীমাধবের ধ্বজা দেখে কাশীতে মনিকর্নিকা ঘাটে তাঁরা ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে দেখলেন। সেখানকার লোকেরা মহাপুরুষের অনেক অলৌকিক কীর্তির কথা বলল কিন্তু লেখক সেসব কিছু দেখেননি। এরপর মানমন্দির, তিল ভান্ডেশ্বর, সারনাথ দর্শন করলেন। 


এবার বেনারস থেকে ঔড এন্ড রোহিলখন্ডের রেলওয়েতে তাঁরা এবার অযোধ্যা যাত্রা করলেন। একটা সরাইতে খাটিয়া আর ছারপোকার কামড় খেয়ে কাটালেন। অবশ্য দোকানে লুচি তরকারি খেয়েছিলেন তার আগে। অযোধ্যায় পান্ডার উপদ্রব সহ্য করে, অজস্র বাঁদরের লীলা খেলা দেখে লেখক মন্তব্য করেছেন অযোধ্যায় এখন দেখার বিশেষ কিছু নেই যে কটি মন্দির আছে তা আধুনিক বলে মনে হয়। মন্দিরের মধ্যে হনুমান গড় (অন্য নাম মহাবীর গড়) সর্বপ্রধান, এরপরে গুরুত্বপূর্ণ রামচন্দ্রের জন্মস্থান। সরযূ নদীর তীরে রামঘাট, সীতাঘাট, লক্ষণঘাট প্রভৃতি আছে। 

এবার তাঁরা ৫-৬ মাইল হেঁটে ফাইজাবাদে এলেন। শহরটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মুসলমান রাজা কর্তৃত প্রতিষ্ঠিত বলে মসজিদ ও সুন্দর অট্টালিকায় পরিপূর্ণ। এখানে ব্রিটিশ সেনানিবাস আছে। এই ফাইজাবাদেই সুজাউদ্দৌল্লার পুত্র নবাব আসাফুদ্দৌলার প্রবঞ্চনায় হেস্টিং সুজাউদ্দৌল্লার বিধবা বেগম ও মাতার ভাতৃদ্বয়কে নির্দয় উৎপীড়ন করে সর্বস্ব অপহরণ করেছিলেন। সেখানে ভাত খাওয়ার জন্য (অনেকদিন লুচিপুরি খেয়ে বাঙালির রসনা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল) অনেক অস্থির হয়ে তাঁরা চাল, আলু ও এক ঠাকুর জোগাড় করে বহু আকাঙ্ক্ষিত ভাত খেলেন। যদিও সেই ভাত আধ সেদ্ধ বা আধ ফোঁটা ছিল, তবু শাল পাতায় ঢালা সেই ভাত খেয়ে যে তৃপ্তি তিনি পেলেন তা বোধহয় জীবনে কোনদিন পাননি। 

রাতে বেনারসের ট্রেনে তাঁরা লখনৌ রওনা দিলেন। লখনৌ পৌঁছে লেখক দ্বিধা ভয় কাটিয়ে একজন অপরিচিত বাঙালি অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। লখনৌতে তাঁরা চক, কেল্লা দেখলেন। লখনৌয়ের মানুষজনের ভদ্রতা, আদবকায়দা সংক্রান্ত গল্প শুনেছিলেন, এখন স্বচক্ষে দেখলেন। কোইশোর বাগ (কাইজার বাগ) ওয়াজেদ আলী সাহেবের সময় অসাধারণ শোভাসম্পন্ন ছিল কিন্তু ইংরেজদের হাতে পড়ে শোভা বিনষ্ট হয়েছে। এর মাঝখানে ক্যানিং কলেজ ও সরকারি অফিস, মিলিটারি জেলখানা হয়েছে। রেসিডেন্সিতে বিখ্যাত ইংরাজ সেনানিদের সমাধি দেখলেন। সিপাহী বিদ্রোহের সময় মৃত ইংরেজ শিশুদের সমাধি দেখে ও ফলকে লেখা পড়ে তাঁর মন ব্যথাতুর হয়ে উঠল। লখনৌয়ের মিউজিয়াম দেখলেন এরপর। সেখানে একটি পিস্তল দেখে খুব কষ্ট পেলেন। এই পিস্তল দিয়ে সিপাহী বিদ্রোহে দিল্লির বাদশাহের এক পুত্রকে হত্যা করা হয়েছিল। এখন রাজগৌরবে ইংরেজ সেটি যত্ন করে মিউজিয়ামে রেখেছে। লখনৌর পুরনো রাজবাড়ি ছত্র মঞ্জিল এখন অফিস ও ক্লাব রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইমামবাড়া অতি সুন্দর দেখতে। এই মসজিদের পশ্চিমে হোসেনাবাদ নামে একটি বড় সুন্দর মসজিদ আছে। 

এরপর লেখক কানপুর গেলেন একা। সিপাহী বিদ্রোহে নিহত ইংরেজদের স্মরণে নির্মিত স্মরণ উদ্যান, স্মরণ কূপ দেখলেন। এই উদ্যানে কোট-প্যান্ট পরা থাকলে প্রবেশ অবাধ। লেখকের জজ সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি পত্র আনতে হয়েছিল কারণ তিনি কোট প্যান্ট পরিধান করেন নি। মেমোরিয়াল চার্চ ও মেমোরিয়াল হোটেল দেখলেন। চার্চের দেওয়ালে সিপাহী বিদ্রোহের দৃশ্য চিত্রিত। যেমন - সাহেবের সিপাহী পা ধরে প্রাণভিক্ষা চাওয়া আর সিপাহী তাকে বধ করার জন্য তরবারি তোলার চিত্র। হোটেলটি সিপাহীদের আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেছিল। 

যযমৌ (জজমউ) নামে স্থান কানপুরের দক্ষিণে গঙ্গা তীরে অবস্থিত। একে যযাতি রাজার বাড়ি বলা হয়। এখানে অনেক মাটির ঢিবি ছাড়া প্রাচীনকালের কিছু দেখার নেই। লোকে বলে উঁচু একটা ঢিপিতে যযাতি রাজার সিংহাসন আছে।  ( পরে কিছু খনন কার্য করে খ্রিস্ট পূর্ব ১৩০০-১২০০ - এর চিহ্ন পাওয়া গেছে। খনন কার্য সম্পূর্ণ করা আজও হয়নি)। 

কানপুরের উত্তরে বিটুনগর (বিঠুর) হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ। এটি বাল্মিকী মুনির আশ্রম ছিল বলে প্রচলিত আছে। লেখক বলেন ত্রেতা যুগে রামচন্দ্র সীতাকে এই বিঠুরে বনবাসে পাঠিয়ে ভবিষ্যতে লব কুশের যুদ্ধের সূত্রপাত করেছিলেন যেমন, তেমনই ইংরেজ কলিযুগে পেশোয়া বাজিরাও-কে বিঠুরে বনবাসে পাঠিয়ে ভবিষ্যতে সিপাহী যুদ্ধের সূত্রপাত করে। ইংরেজ রাজত্বতে অনেক নির্দোষীর বনবাসের বিশেষ ত্রুটি হয় না তাই জন্যই বোধহয় ইংরেজ রাজত্বকে অনেকে রাম রাজত্ব বলে। 

এরপর লেখক টুন্ডলা হয়ে আগ্রা গেলেন রেলপথে। আগ্রায় তাঁরা এক বাঙালি বাবুর বাড়িতে সানন্দে আশ্রয় পেলেন। তাজমহলের শিল্প সম্বন্ধে ইউরোপীয়দের বিশ্বাস শাহজাহানের রাজত্বকালে দিল্লির আগ্রা দরবারে অস্টিন ডি বার্ডিয়াক্স নামে এক ইউরোপীয় নক্সা-নবীশ ছিলেন। তাঁর নকশা অনুসারে তাজমহল তৈরি হয়। কিন্তু লেখক বলেন এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তাজমহলের প্রবেশদ্বারের ডানপাশে নির্মাণকর্তার নাম হিসেবে আমানত খাঁ সিরাজীর নাম রয়েছে। অস্টিনের নকশা অনুসারে তৈরি হলে তাঁর নামও তাজমহলের গায়ে লেখা থাকত। এরপর আগ্রা দুর্গ দেখলেন। সেখানকার বর্ণনা ও ইতিহাস আলোচনা পুনরাবৃত্তি এড়াতে এখানে রাখা হল না। 


লেখক জেনানা, মতি মসজিদ, নগদা মসজিদ, শিশমহল প্রভৃতি দর্শন করলেন। এরপর ইতমুদৌল্লা, রামবাগ, আগ্রা কলেজ, সেনানিবাস দেখে সেকেন্দায় আকবরের সমাধি দেখতে গেলেন। সেকেন্দ্রার মসজিদের কাছে আকবরের পর্তুগীজ পত্নী মনিবেগমের সমাধি রয়েছে। অযোধ্যার মতো আগ্রাতেও বানরের উৎপাত দেখলেন লেখক।

                     (চলছে)

২টি মন্তব্য:

  1. এই ভ্রমণ বৃত্তান্তের মাধ্যমে বেনারস ,লখনৌ ও অযোধ্যা শহরের কিছু গল্প জানলাম। ফাইজাবাদ শহর টির সঙ্গে জড়িত কিছু কাহিনীর ও শহরের নানান স্থানের বিষয়ে অবগত হলাম। কানপুরের ও কানপুরের বিটুনগর আগ্রা শহরের নানান কাহিনীতে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারলাম। শিউলি

    উত্তরমুছুন