বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪
১৩। রাজনারায়ণ বসুর আত্ম-চরিত
রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪
১২। দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভ্রমণ
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪
১১। রাজা রামমোহন রায়ের ভ্রমণ
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০২৪
১০। তীর্থ মঙ্গল ৫ বিজয়রাম সেনবিশারদ
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
---- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
এবার ফেরার পালা। প্রথমে ফতুয়ার উদ্দেশ্যে সবাই রওনা দিলেন। নৌকা জুড়াগ্রাম, গাজীপুর হয়ে মুরদপুরে রাত্রিবাস। সেখানে আছেন লিঙ্গদেব রামেশ্বর, যা শ্রীরামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত বলে কবি বলেছেন। ভোজপুরের অধীনস্থ অর্জুনপুরে রাত্রিবাস। শোন নদী বামে রেখে আর ডানে গঙ্গা - এর মধ্যে দিয়ে নৌকা চলল। সেরপুর, দানাপুর (এখানে ইংরাজের কেল্লা অর্থাৎ ছাউনি রয়েছে) হয়ে নৌবহর পাটনায় পৌঁছালো। অনেক যাত্রীকে কর্তা টাকা দিয়ে বাড়ি পাঠালেন ও নিজে মাস খানেক পাটনায় থাকলেন।
কাশী থেকে খিদিরপুর (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে, উল্লেখ্য যে সেই ভ্রমণটি হয়েছিল নদীপথে)
তারপর পালকি করে কর্তা ফতুয়া গেলেন। ফতুয়া থেকে আবার নৌকা যাত্রা। মুনসিকে কর্তা এখানে বিদায় দিলেন। দূরে গৌরীশংকর পাহাড় দেখা গেল। চৌকিঘাটা, দরিয়াপুর, সূর্যগড় হয়ে নৌকা মুঙ্গের এলো। সীতাকুণ্ডে গিয়ে সবাই পুজো দিলেন। তারপর জাংগিরা, সুলতানগঞ্জ হয়ে পাহাড়ের ওপর বটেশ্বর শিব দর্শন করলেন। ভাগলপুর, চম্পা নগর, সুজাগঞ্জ হয়ে পাথরঘাটায় নৌকা এলো। রাত্রি বাস হল পীরপৈতিতে। তেলিয়াগড়ী, সকরিগলি হয়ে রাজমহলে রাত্রি বাস। এরপর নৌকা চলাকালীন জলে তুফান দেখে ভয়ে নদীর পাশে কাশবনে নৌকা ভিড়িয়ে রান্না হল। কাদা জলের মধ্যে বাঘের ডাক শুনতে শুনতে রান্না ও খাওয়া হলো। নৌকা আবার চলল। খেজুরিয়া, সুতী হয়ে দক্ষিণমুখী হয়ে নৌকা চলতে লাগলো। সাহেবঘাটা এলো, সেখানে পীরজাদা সাহেব আছেন। পীরজাদা সাহেব এক মুসলমান ফকির। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাঁর কাছে যেত। পারসী ভাষা ব্যবহার করে কবি বলেছেন যে তাঁর বড়ই বারগা অর্থাৎ মাহাত্ম্য। এরপর ফতুল্লাপুর অর্থাৎ ফতেউল্লাপুর, দুর্গাপুর, জঙ্গিপুর, লক্ষ্মীপুর হয়ে মকুসুদাবাজ অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ এল। সাধকবাগে স্নান খাওয়া করা হলো। পশ্চিম পাড়ে হিরাঝিল, সেঠের বাগান। পরদিন কিরিটেশ্বরী পূজা দিতে গেল সবাই। এবার বামে মঙ্গলটুলি নবাবের বাড়ি রেখে নৌকা চলল। ডানে সাঁইকুলী আর ডাহাপাড়া পেরিয়ে কাশিমবাজার এল নৌকা। কাশিম বাজার বড় শহর, বড় বড় মানুষের বাস। সয়দাবাজ অর্থাৎ সৈয়দাবাদ, খিদিরপুর, চুমরিগাছা, শ্রীশ্যামনগর, পলাশী হয়ে কাটোয়ায় নৌকো এলো। ডানে বারবাজার, বামে মাটিয়ারী। রঘুনন্দন মিত্রের দ্বাদশ শিব মন্দির। তারপর দাই, বুড়ারানীর ঘাট, মানিকচন্দ্রের ঘাট হয়ে ক্রমে অগ্রদ্বীপে নৌকা এলো। সেখানে চৈতন্যদেবের শিষ্য গোবিন্দ ঘোষ ঠাকুরের বাড়ীতে শ্রী চৈতন্যদেব প্রতিষ্ঠিত গোপীনাথ ঠাকুরের মন্দির। কিন্তু গোপীনাথ রাজা নবকৃষ্ণের বাড়িতে (কলকাতার শোভাবাজারের রাজবাড়িতে) আছেন তাই যাত্রীরা দর্শন করতে না পেয়ে আক্ষেপ করল। কাশীপুর, ঘোড়াইক্ষেত্র, গোটপাড়া এল। সিকিরাগাছি, বালডাঙ্গা, মেড়তলা হয়ে নৌকা নবদ্বীপ এলো। সেখানে নাকি সতেরোশ ব্রাহ্মণ আছে, অধ্যাপকও অনেক। তেমোহনি দিয়ে নৌকা পড়ে খরড়ার জলে। গোকুলগঞ্জের ঘাট হয়ে শান্তিপুর এলো। ক্রমে ক্রমে গুপ্তিপাড়া, ফুল্যা-নবলা, হরধাম, সোমড়া, চাকদহ, জিরাট, কাঁচরাপাড়া, হালিশহর, ত্রিবেনী, বাঁশবেড়িয়া, হুগলি, চুঁচুড়া, ফরাসডাঙ্গা,গৌরহাটি, নিমাই তীর্থ ঘাট, মুনিরামপুর, দীঘাঙ্গ, মাহেশ (এখানে জগন্নাথ দেব আছেন, যাত্রীরা নৌকা থেকে নমস্কার জানালো), কোন্নগর, আগরপাড়া, সুকচর (এখানে দামামায় সাড়া দিল কারণ এখানে দেওয়ানজির গ্রাম), বালি, বরানগর, চিৎপুর হয়ে কলিকাতা শহর পৌঁছাল। এভাবে খিদিরপুর গঙ্গার ঘাটে নৌকা এলো। যাত্রা শেষ হলো। বহু লোক শুধু তীর্থযাত্রীদের দর্শনে পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যেই এলো। কর্তা ধুমধাম করে তীর্থশ্রাদ্ধ করলেন। এভাবেই কবি বিজয় রামের তীর্থ মঙ্গলকাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪
৯। তীর্থ মঙ্গল ৪ বিজয়রাম সেনবিশারদ
---- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
গয়াতে অনেক যাত্রী এসে কর্তার সঙ্গী হলেন। এবার ঘোষাল মহাশয় কাশী যাবেন বলে মনস্থ করেছেন। ঘোষাল মহাশয়ের সঙ্গী হয় মহারাষ্ট্র, কুরুক্ষেত্র, উড়িষ্যা, ঢাকা আদি বঙ্গদেশের যাত্রীরা, আগে পিছে পাহারায় এভাবে টিকারী রাজ্যে এলেন। সেখানকার রাজা ছিলেন সুন্দর সা, যাঁকে মীরকাসীম হত্যা করেছিলেন। তাঁর বাড়িতে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হল। থাকার জন্যে দেওয়া হলো বড় বড় ঘর, গালিচা পাতা। কোচগ্রাম হয়ে, ধরারার অপূর্ব বাগিচা দর্শন করে, সামনে আদি গঙ্গা দেখে যাত্রীরা জলস্পর্শ করেন। শোন নদী পড়ল পথে। এবার এলো সরসরা (সাসারাম)। কবি বলেছেন এই জায়গাতে হরিশ্চন্দ্রের বাড়ি। পুরাণে হরিশ্চন্দ্রের পুত্র রোহিতাশ্বের নাম থেকে শোন নদীর ওপর রোহিতাশ্বগড় বা রোহতাসগড় নামক পর্বতের নাম হয়েছে বলে কবি এই স্থানকে হরিশ্চন্দ্রের বাড়ি বলেছেন। এছাড়া বলেছেন যে এখানে অরঙ্গ পাৎসার গোড় আছে মানে আওরঙ্গজেবের কবর আছে। আসলে দিল্লির সম্রাট শেরশাহের কবর এখানে আছে। তার অপূর্ব নির্মাণ দেখে যাত্রীরা মুগ্ধ হয়।
কাশী থেকে বিন্ধ্যাচল, চুনার হয়ে কাশী ফেরা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে, উল্লেখ্য যে সেই ভ্রমণটি হয়েছিল নদীপথে)
কর্মনাশা নদীতে যাত্রীরা দুই তিন পয়সা দিয়ে মানুষের কাঁধে চেপে পার হল কারণ প্রচলিত ধারণা ছিল যে জন্ম থেকে যত ধর্ম-কর্ম করা হয় সেই নদীর জল স্পর্শ করলে নাকি সব নষ্ট হয়ে যায়। এবার মোগলসরাই পার হলো। দূরে বেণী মাধবের ধ্বজা দেখতে পাওয়া গেল। দুলভীপুরের বাগিচায় রাত্রি বাস হল।
কাশীর উত্তরভাগে বরণা নদী আর দক্ষিণ ভাগে অসি নদী। কাশীর বসতি অর্ধচন্দ্রাকারে রয়েছে। নদীতে সবাই স্নান ও তর্পণ করল। নৌকা কাশীর বাঙ্গালীঘাটায় অর্থাৎ বাঙালিটোলায় রাখা হল। বিশ্বেশ্বর শিব, অন্নদা দেবীর পূজা করে ও দক্ষিণা দিয়ে, মনিকর্ণিকা ইত্যাদি পঞ্চতীর্থ স্থানে তর্পণ দিয়ে এল সবাই।
এবার যাওয়া হবে প্রয়াগ। মোহনসরাই, মহারাজগঞ্জ, মাধব সরাই, গোপীগঞ্জ, জগদীশসরাই, কুচ, ঝু্চি (ঝুসী) হয়ে গৌতম আশ্রম ও যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞকুন্ড দেখে যাত্রীরা গঙ্গা পার হলেন। যমুনা গঙ্গাতে স্নান করে প্রয়াগ দর্শনে গেলেন। গঙ্গাতীরে পিণ্ডদান, ব্রাহ্মণ বিদায় করলেন। বেণীমাধব দর্শন ও পঞ্চতীর্থতে পুজো দিয়ে প্রয়াগের কেল্লা দর্শন করলেন। অক্ষয় বট দর্শন হলো। দশাশ্বমেধ ও ভরদ্বাজ আশ্রম দর্শন করলেন। এরপর কিছু সঙ্গী বৃন্দাবন গেল। ঘোষাল মহাশয় কাশী ফিরে চললেন।
নৌকা পথে বিন্ধ্যাচলের বিন্ধ্যবাসিনীর কাছে এসে দেড় ক্রোশ পথ পেরিয়ে পাহাড়ের ওপর বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর পূজা দিলেন বলিদান সহ। মৃজাপুর মানে মির্জাপুর, চন্ডাল গড় বা চুনার হয়ে কাশীতে এলেন। মহা ধুমধাম-এর সঙ্গে পূর্বপুরুষ (পিতা) কন্দর্প ঘোষালের নামে শিব প্রতিষ্ঠা করলেন ঘোষাল মহাশয়। কন্দর্পেশ্বর নাম হলো সেই শিবের। এরপর বিশ্বনাথ, অন্নপূর্ণা, কালভৈরব, কেদারেশ্বর, বিশ্বেশ্বর, তিলভাণ্ডেশ্বর প্রমুখ সকল দেবদেবীর পূজা করলেন। দুর্গাকুণ্ড সহ যত কুণ্ড আছে সব কুন্ডে স্নান করলেন। কাশীর ব্রাহ্মণ যেন দেবতার মত, অপূর্ব বস্ত্র পরিহিত, কপালে চন্দন, মধ্যে রুলির দাগ। উজ্জ্বল মূর্তির নারীরা যেন বিদ্যাধরী, গজেন্দ্র গামিনী , তাদের লজ্জা ভয় নেই। কাশীতে রানী ভবানী যে কীর্তি রেখে গেছেন সেরকম কেউ করেননি বলে কবি মন্তব্য করেছেন। কত বড় বড় বাড়ি করে, বছরের খরচ দিয়ে বিতরণ করেছেন, কত দেবালয় করেছেন, যে যা চায় তাই পায় এমন ব্যবস্থা। মাধবের ধ্বজা আছে গঙ্গার ধারে, ২০০ হাত উঁচু। সুন্দর পাকে পাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। এক পয়সা করে দিয়ে যাত্রীরা উঠে বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পায়।
এবার কিছু যাত্রীকে কর্তা টাকা দিয়ে বিদায় দিলেন। তারা নিজের নিজের বাড়ি চলে গেল। কর্তা সহ অনেকের মসূরিকা অর্থাৎ বসন্ত রোগ হতে থাকলো, দেখে কর্তা দেশে ফিরতে উদ্যোগ নিলেন। সঙ্গের বৈদ্য, বিজয়রাম সেনবিশারদ (তীর্থ মঙ্গলের লেখক) কর্তাকে সুস্থ করে তুললেন। অতঃপর ঘোষাল মহাশয় কাশীর রাজা বলবন্ত সিংহের সঙ্গে তাঁর রাজবাড়ী, কাশীর অপর পাড়ে শ্রীরামনগরে দেখা করতে চললেন, অসী খাল পথে দশটি নৌকা করে। অপূর্ব রাজবাড়ী দেখে সবাই খুশি। কর্তা রাজার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করলেন।
(চলছে)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
৮। তীর্থ মঙ্গল ৩ বিজয়রাম সেনবিশারদ
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
---- সুমনা দাম
ফতুয়া থেকে গয়া (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে, উল্লেখ্য যে সেই ভ্রমণটি হয়েছিল নদীপথে )
পরের দিন ফল্গু নদীতে স্নান করে প্রেতশীলা দর্শনে সবাই যান। সেখানে পিণ্ডদান করে নেমে ব্রহ্মকুণ্ডে তর্পণ করে কর্তা জল পান করেন। গরমে অস্থির হয়ে বাসায় ফিরে সবাই দই, প্যাড়া দিয়ে জল খান। গয়ার মত প্যাড়া কোথাযও নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। পরদিন পঞ্চতীর্থে পিণ্ডদান করা হয়। উত্তরমানস, উদীচী, কনখল, দক্ষিণ মানস ও জীবলোল এই হল পঞ্চতীর্থ। এরপর কর্তা পালকি চড়ে ধর্মারণ্যে গেলেন। সেখানে প্রচুর ভিখারি। তারপর চললেন বোধগয়ায়, সেখানে অনেক প্রস্তর নির্মিত দেবমূর্তি আছে। পরদিন ব্রহ্ম সরোবরে স্নান ও তর্পণ দান করে যাত্রী নিয়ে কর্তা চললেন। ব্রাহ্মণ ভোজন করালেন। সকালে বিষ্ণু রুদ্রপদে পিন্ডদান করলেন। দুই দিন ধরে ষোড়শ বেদীতে পিণ্ডদান করে দর্শন করে এলেন। এই ১৬ টি বেদী এই গ্রন্থে কবি যেমন বর্ণনা করেছেন তা হল ব্রহ্মপদ, কার্তিক পদ, সত্য পথ, দক্ষিণাগ্নিপদ, আহবনীয় পদ, চন্দ্রপদ, দধীচি পদ, গণেশ পদ, সূর্যপদ, করণ পদ, মাতঙ্গ পদ, ক্রৌঞ্চ পদ, পঞ্চগণেশ, কাশ্যপপদ, আবাসথ্য, গার্হপত্য, অগস্ত। অষ্টতীর্থ কবি বর্ণনা করেছেন এভাবে - রামগয়া, সীতাকুণ্ড, গয়াশির, গয়াকূপ, মুণ্ডপিঠ, আদিগয়া, ধৌতপদ, ভীমগয়া, গোপ্রচার ও গদালোল। এই অষ্টতীর্থে ঘোষাল মহাশয় পিণ্ড দিলেন। অক্ষয় বটে দানসাগর করেন। পান্ডাকে সোনার গয়না, পাঁচশত টাকা ইত্যাদি দিলেন। অন্যান্য যাত্রীরা সাধ্যমত দিল। পরদিন বিষ্ণুপদে গেলেন ও আট তোলা সোনা দিলেন। গদাধর ও গয়েশ্বরীর পুনরায় পূজা করলেন। মহারাষ্ট্রের পাচক দিয়ে সেদিন রান্না করিয়ে চোদ্দোশ গয়ালী অর্থাৎ গয়ার মানুষকে ভোজন করালেন।
(চলছে)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
রবিবার, ২১ জুলাই, ২০২৪
৭। তীর্থ মঙ্গল ২ বিজয়রাম সেনবিশারদ
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
---- সুমনা দাম
এর পরবর্তী অংশে এল রাজমহল পাহাড়। রাজমহলের পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ি চোরের উপদ্রব খুব বেশি ছিল। তাই সকলে সতর্ক হয়ে যান এবং নৌকা খুব দ্রুত বেগে চলতে লাগল। বাঁদিকে উদানালা বা উদয়নালার (এখন ঝাড়খণ্ডের উধরা) যুদ্ধস্থল, যেখানে মীর কাসিমের সঙ্গে ইংরেজ সেনাপতি মেজর অ্যাডামসের যুদ্ধ হয়েছিল। তা বামে রেখে নৌকা অতি বেগে ঝাড়খন্ডের রাজমহলে এসে পৌঁছায়। রাজমহল নগর দেখে সবাই অভিভূত হল। কত শত অট্টালিকা, হাট, বাজার, দোকান। পাঁচ ক্রোশব্যাপী শহরে ঘন ঘন ঘর, স্থানে স্থানে ঘড়ি খানা, তাতে সর্বদা নহবত বাজে (সময় নির্দেশক)। ফৌজদার পালকি চড়ে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে এসে ১০০ টাকা নজরানা দিলেন। তবে কৃষ্ণচন্দ্র সেই টাকা নিলেন না। বসিয়ে অনেক আলাপ কথন করলেন। বিভিন্ন যাত্রীরা বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ঘোষাল মহাশয় ঘুরে ঘুরে তাদের সকলের খোঁজ নেন। দুদিন রাজমহলে থেকে আবার যাত্রা শুরু হয়। মেঘের মতো উঁচু পর্বত দেখা যায়। আর পর্বতের ওপর চোহাড় বা চুয়ারদের বাড়ি। তারা সাঁওতাল পরগনার আদিবাসী জাতি। তাদের গলায় হাঁসুলি, কানে কুন্ডল, হাতে বালা, পায়ে মল, হাতে লাঠি। তাদের দেখে যাত্রীরা ভয় পেয়েছিল। এক চৌহার তাদের প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষাল মহাশয় কে প্রণাম করে কলা উপহার দেয়। ঘোষাল মহাশয় তাকে এক টঙ্কা ইনাম দিয়ে মিষ্টি কথাবার্তা বলেন।
রাজমহল থেকে পাটনা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে, উল্লেখ্য যে সেই ভ্রমণটি হয়েছিল নদীপথে )
এরপর নৌকা এলো সকরীগলি। সেখানে একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে গঙ্গা। পরদিন তেল্যাগাড়ি বা তেলিয়াগড়ি বামে রেখে নৌকা চলল। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সিরাজদৌলা নৌকা করে পলায়ন করার সময় রাজমহলের থেকে কিছু দূরে এক গ্রামে এক ফকিরের আশ্রয়ে আসেন। ফকির গোপনে সিরাজের শত্রুপক্ষের কাছে খবর পাঠান। মীরজাফরের ভ্রাতা মীর দাউদ সিরাজ ও তাঁর পরিবারের সকলকে এখানে বন্দী করে। সেই স্থান পেরিয়ে নৌকা চলল। লক্ষ্মীপুর, শ্রামপুর বামে রেখে নৌকা এগোলো, সামনে দেখা গেল বটেশ্বর পর্বত, যা বিহারে অবস্থিত। পাহাড়ের ওপর নানা মন্দির আছে। ঘোষাল মহাশয় সেখানে পূজা দিলেন। মুনির কুটিরে গিয়েও প্রণাম করলেন। তারপর নৌকা এলো পাথরে বাঁধানো ঘাট পাথরঘাটায়। সেখানে রাত্রি বাস। পরদিন পাহাড়িয়া রাজার বাটি কাহলগ্রাম (যা অতি প্রাচীন নগর। এখনো অনেক প্রাচীন নিদর্শন আছে, এখানে বিক্রমশীলা মহাবিহার পরবর্তীতে খনন কার্যে বেরিয়ে এসেছে) তা পেরিয়ে খাগড়ায় রাত্রি বাস করলেন। পরদিন চপকালী, ডহরগড়, ধীরনগর ডানে রেখে ভাগলপুর, সুজাগঞ্জ বামে রেখে শিবগঞ্জে নৌকা থামল। জলপান ও স্নান পূজা সেরে নৌকা আবার যাত্রা শুরু করল। গোপালপুরে (বিহারের) রাত্রি বাস হল। পরদিন নৌকা জাহাঙ্গীরায় অর্থাৎ জাঙ্গীরায় উপস্থিত হল। বামে এক সুন্দর পাহাড় বর্তমান। ডানদিকে নদীর মধ্যে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে নানা রকম মূর্তি খোদাই করা আছে। পাহাড়ের উপরে গৌরীশংকরের মন্দির আর অনেক সুন্দর অট্টালিকা আছে। নানা উপাচারে কর্তা ও অন্যরা শিবের পূজা করেন। এই স্থানের জল নিয়ে নৌকা চলল বৈদ্যনাথ ধামে পুজো দেওয়ার জন্য। এই স্থান থেকে গঙ্গা উত্তর বাহিনী হল, তাই এখানকার জল পুণ্যজ্ঞানে কর্তা পান করলেন। তারপর বাম দিকের জাঙ্গীরা বা জাহাঙ্গিরা ও ঘোড়াঘাট এবং ডানে কাশীপাড়ার হাট হয়ে নৌকা চলতে থাকলো। দূরে মুঙ্গেরের পাহাড় দেখা গেল। রাতে কোদালিঘাটে থাকা হল। সকালে সাছোঁধন পীরের বাড়ি বামে রেখে নৌকা চলল। সেখানে গুরগুনী সাহেবের ছাউনি ছিল। গুরগুনী সাহেব তথা গুরগিন খাঁ, তথা গ্রেগরি ছিলেন আর্মেনিয়ান। তিনি ও তাঁর ভাই পিদ্রু বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি মীর কাসিমের সেনাপতির পদ পেয়েছিলেন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এই স্থানের পশ্চিমে উষ্ণপ্রস্রবণ সীতাকুণ্ড আছে যা হিন্দুদের তীর্থস্থান।
শারীগান গেয়ে মাঝিরা নৌকো এগিয়ে নিয়ে চলে। নৌকো মুঙ্গেরের পশ্চিমভাগে উপস্থিত হলে মনোহর মুখার্জি নামক এক ব্যক্তি এসে সকলকে সাদরে তাঁর বাড়ি নিয়ে গিয়ে সে রাতে রাখলেন। পরদিন সবাই মুঙ্গেরের কেল্লা দেখতে গেল। দুই ক্রোশ ব্যাপী পাথরের কেল্লা অত্যন্ত সুন্দর। কেল্লার মধ্যে কত মসজিদ আছে। বহু সেপাই ও তাদের দলপতি পাহারায় রয়েছে। কেল্লার মধ্যে আছে অঙ্গরাজ কর্ণ রাজার স্থান। তিনি নাকি প্রতিদিন সোয়া মণ সোনা দান করতেন। একদিন ত্রিশ মন ঘিতে কড়াই পূর্ণ করে আপন শরীর তাতে ভেজে তিনি নাকি মা কালিকে নিবেদন করেন। মা তাঁর এই প্রসাদ গ্রহণ করেন কিন্তু তাঁকে পুনরায় জীবন দান করেন আশীর্বাদ সহ। কর্ণরাজা এরপর ব্রাহ্মণদের অকাতরে স্বর্ণ বিতরণ করতে থাকেন। রাজা বিক্রমাদিত্য চিন্তিত হন যে এত সোনা কর্ণ কোথায় পান এই ভেবে। তিনি শূদ্র রূপ ধরে আসেন ও বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে কথা বলেন। কর্ণ রাজা তাঁকে একশত টংকা মাহিনা দিয়ে চাকরি দিলেন। কর্ণ রাজার নিদ্রা কালে একদিন বিক্রমাদিত্য একইভাবে কালির পূজা করেন। মা কালী একই রকম ভাবে তাঁকে জীবনদান করেন ও অলৌকিক ক্ষমতা দেন। কর্ণ রাজা ঘুম ভেঙে বুঝলেন যে মা কালী এবার তাঁকে ছেড়ে গেছেন। বিক্রমাদিত্য দুঃখিত কর্ণ রাজাকে বলেন চিন্তা না করতে কারণ তিনি দান করার জন্য যত চান তত স্বর্ণ দেবেন। কর্ণ রাজা বিশ্বাস করলেন না যে বিক্রমাদিত্য কালীর কৃপায় যত খুশি সোনা পাওয়ার ক্ষমতা পেয়েছেন। তারপর বিক্রমাদিত্য তাঁকে সব বলেন ও তাঁর আসল পরিচয় দেন। কর্ণ রাজা তখন বিক্রমাদিত্যের কাছে ক্ষমা চান। এটি একটি প্রচলিত গল্প।
পরদিন সফরাবাজ বামে রেখে সিংহনালা, চৌকিঘাটা, সূর্যনালা ছাড়িয়ে নৌকা সূর্য গড় পৌঁছায়। এইবার প্রচন্ড ঝড় ওঠে। যাত্রীরা নৌকা ডুবে যাওয়ার ভয়ে ইষ্ট দেবতার স্মরণ করতে থাকে। কাশীনাথ যেন ভক্ত কৃষ্ণচন্দ্রের আকুল প্রার্থনা শুনতে পান এবং ঝড় থেমে যায়। শঙ্কর মজুমদারের বাড়িতে সেদিন রাতে থেকে পরদিন দরিয়াপুরের বালির চরে রাত কাটানো হল। নৌকা এলো বাড় নামক স্থানে সেখানে ভোলা বরকন্দাজ নামক নৌযাত্রীর বিরোধ হল। কিন্তু সেপাইরা কর্তাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। তারা কর্তার স্তুতি করে ক্ষমা লাভ করল। রাতে সেখানে থাকাকালীন রামানন্দ সরকার এলেন। তিনি বিরোধের কথা শুনে সমুচিত বিচার হবে বললেন। পরের রাতে নৌকা দেবীপুরে আশ্রয় নেয়।
পরদিন বৈকুণ্ঠপুর-এর কাছে গৌরীশঙ্কর দেবতার দর্শন ও পূজা হল। তারপর নৌকা এলো ফতুয়া শহরে বা ফতোয়াতে। এটি গঙ্গা ও পুনপুন নদীর সঙ্গমস্থল ও তীর্থ স্থল। এখানে যাত্রা শ্রাদ্ধ করে গয়া যেতে হত। সেখানকার বাজারে নানা রঙের বস্ত্র বিক্রয় হয়। সেই শহরে রাত্রিবাস হলো। পরদিন নৌপথে রাজা রামনারায়ণ (যিনি নবাব আলীবর্দী খাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু ও পাটনার নায়েব নাজিম ছিলেন। সিরাজদৌলার সময়ও নবাবী সেনার অধিনায়ক ও মীরজাফরের সময়ও তিনি পাটনার নায়েক-নবাব ছিলেন। মীর কাশেমের সময় পাটনায় বন্দী ও নিহত হন।) আর জাফর খাঁর (বাংলার নবাব মুর্শিদ মুর্শিদকুলি খাঁর অপর নাম) -এর বাগান পড়ল। লোনগোলা, রেকাবগঞ্জ, মারুগঞ্জ, আদামট ছাড়িয়ে নৌকা এসে ফরাসের কুটিঘাটে থামল। সবাই পাটনায় উপস্থিত হলো। সেদিন বিষ্ণু সিংহের বাড়িতে সবাই আশ্রয় নিল। অপূর্ব সুন্দর পাকা বাড়ি, বড় বড় ঘর। চার শত যাত্রী সেই কোঠাবাড়িতে রইল। অন্য যাত্রীরা অন্যান্য বাড়িতে রইল। পাটনা বড় বড় বাড়ি হাটবাজার নিয়ে বড় শহর কিন্তু ছোট ছোট নোংরা গলিও ছিল সেই শহরে। কর্তা পাটনার সুবাদার সেতাব রায়ের কাছে ভেট পাঠালেন। সঙ্গে গেল পার্সি-নবীস মুন্সী বিশ্বনাথ। কর্তা অন্যদিন নিজেও সুবেদারের সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন। কর্তাকে সেতাব রায় ঘোড়া,শাল প্রভৃতি উপহার দিলেন। সেতাব রায় ছিলেন আজিমাবাদের সুবেদার বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা। এরপর ঘোষাল মহাশয় কিছুদিন পাটনায় বসবাস করেন। তখন সেখানকার ইংরেজদের অধীনস্থ দেওয়ান শান্তিরাম নানাপ্রকার তত্ত্ব দেন ঘোষাল মহাশয়কে। এবার তাদের সঙ্গী হলেন মনসা রাম যিনি ছিলেন পাটনার প্রধান কুঠিয়াল। তিনি নবাব মীরকাসিমের দ্বারা উৎপীড়িত ও লুন্ঠিত হন।
(চলছে)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
২। গোড়ার কথা
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ---- সুমনা দাম বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...
-
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ------- সুমনা দাম স্বর্ণকুমারী দেবী ( ১৮৫৫-১৯৩২ ) অন্যতম প্রথম বাঙা...
-
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ------- সুমনা দাম (আগের পর্বের পরে) আগস্...
-
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ------- সুমনা দাম "আ ভিজিট টু ইউরোপ" ত্রৈলোক্যনাথ মুখ...



