শ্যামলাল মিত্র লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
শ্যামলাল মিত্র লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫

৭৪| মিশরযাত্রী বাঙ্গালী - শ্যামলাল মিত্র

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



"মিশর যাত্রী বাঙালি"র লেখক শ্যামলাল মিত্র সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। বইটি প্রকাশিত হয় ১২৯১ সালের আশ্বিন মাসে অর্থাৎ ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে। আগে এই রচনাটি সঞ্জীবনী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে মিশর যুদ্ধে বাঙালি ভারত-সেনা শ্যামলাল মিত্রের অভিজ্ঞতার কথা এই বইতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এর আগে কোন বাঙালি এত দূর দেশে যুদ্ধে যায়নি। শুধু কাবুলে এর আগে কয়েকজন বাঙালি গেছিলেন কিন্তু তাঁরা কোন ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ করেননি। দ্বিতীয় কাবুল যুদ্ধে (১৮৭৮-১৮৮০) শ্যামলাল মিত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখান থেকে ফিরে দুই বছর বিশ্রাম নিয়ে ১৮৮২-র জুলাই মাসে আত্মীয় বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে তিনি মিশর যুদ্ধে যাত্রা করেন। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি বোম্বাই পৌঁছান। 


বোম্বাই অতি চমৎকার দেখতে শহর। সমুদ্রবেষ্টিত, ছোট ছোট সবুজ পাহাড় সম্বলিত এই শহরের সুউচ্চ প্রাসাদ ও সৌধ এখানকার প্রাচুর্যের প্রকাশ। সমস্ত রাস্তায় ট্রামওয়ে, গ্যাসের বাতি ও নল প্রবাহিত জলের ব্যবস্থা আছে। সুন্দর সুন্দর উদ্যান, বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, বাজার সবই রয়েছে এখানে। তার মধ্যে চারদিক থেকে সৈন্যসমাগমে, প্রচুর যুদ্ধসামগ্রী আয়োজনে, বন্দরে বন্দরে পতাকাশোভিত রণতরীর জন্য বোম্বাই শহরের শোভা আরো বর্ধিত হয়েছিল। অগাস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ,'বোম্বে প্রিন্সেস ডক' থেকে জাহাজে তিন মাসের উপযুক্ত খাদ্য সামগ্রী ও প্রয়োজনীয় বস্তু নিয়ে তাঁরা মিশর যাত্রা করেন। জাহাজে একজন বাঙালি কেরানি ছিলেন বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। প্রচুর সেনা, কর্মচারী, ডাক্তার ছাড়াও ৬৫টি অশ্ব ও ৩০০ টি অশ্বেতর (খচ্চর) জাহাজে ছিল। বিদায়কালে যে শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তা হৃদয়ভেদী। 


জাহাজে প্রধান কর্মচারী ও ডাক্তাররা সেলুনে; দ্বিতীয় শ্রেণী অর্থাৎ কেরানী, গোমস্তা প্রভৃতি কেবিনে; অন্যান্য সকলে ডেকে স্থান পেল। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যক্তিরা জাহাজের হোটেলে প্রতিদিন যথাক্রমে চার ও দুই টাকার বিনিময়ে খাদ্যপ্রস্তুতের দ্রব্য পেত। জাহাজ গভীর সমুদ্রে পৌঁছতেই প্রায় সকলে অসুস্থ হয়ে পড়ল। মাথাঘোরা আর বমির পীড়ায় প্রায় সাতদিন এরকম চলল। সমস্ত ভারতবাসীর রান্নার জন্য একটি মাত্র স্থান ও চার ঘন্টা মাত্র সময় নির্ধারিত ছিল। একটা উনুনে হিন্দু-মুসলমান পরপর রান্না করে যে যার স্থানে গিয়ে খাবার খেত। একদিন জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়েছিল কিন্তু তা ঈশ্বরের কৃপায় রক্ষা পায়। তারপরের দিন তাঁরা আদম (এডেন) পৌঁছলেন, জাহাজ বোম্বাই ছাড়ার আট দিন পর। 


আদম বন্দরে পৌঁছানোর আগে এক ঝাঁক উড়ুক্কু মাছ উড়ে যেতে দেখলেন। আদমকে ভারতের দ্বার বলা হয় কারণ ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপে আসতে হলে সর্বদা আদম হয়ে আসতে হয়। ইংরেজ সৈন্য এই স্থান সর্বদা সুরক্ষিত রেখেছে। এখানকার আদি অধিবাসীরা কৃষ্ণকায়, দীর্ঘ কোঁকড়া চুল, লাল চোখের অধিকারী, আরবি-ভাষী, অশিক্ষিত এবং ইংরেজদের দ্বারা প্রতিপালিত। কিছু স্থানীয় যুবক জাহাজের চারপাশে সাঁতার কাটতে থাকল, নাবিকরা পয়সা ছুড়ে দিলে তারা সাঁতার কেটে সেখানে পৌঁছে আশ্চর্য উপায়ে সব পয়সা উদ্ধার করে নিয়ে গেল। অপরাহ্নে আবার যাত্রা শুরু হল। জাহাজ এতক্ষণ আরব সাগরে ছিল, এবার লোহিত সাগরে চলতে থাকল। 


আদম থেকে ছয় দিনের পথে সুয়েজ পৌঁছে তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার আদেশ এল। ছোট ছোট নৌকায় তীরে পৌঁছে তাঁরা সাত দিনের কুচকাওয়াজ পথে অর্থাৎ সাত দিন পায়ে হেঁটে বা অশ্বারোহণে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছালেন। ইসমালিয়া থেকে কাসাসিন ১২৯ মাইল রেলওয়ে দ্বারা যুক্ত। রেল লাইনের এক দিকে পানীয় জলের খাল বয়ে গেছে। অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি। এই মরুভূমি বিগত মিশর যুদ্ধের রঙ্গভূমি।


[প্রাচ্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে মিশর ইউরোপীয়দের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান ছিল। মিশরের শাসক মোহাম্মদ আলী পাশার (শাসন কাল ১৮০৫-১৮৪৮) সময় অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে মিশর একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রের পরিণত হয়। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে বৃটেন ভারতে বাণিজ্য বজায় রাখার জন্য এবং বিদেশের মাটিতে নির্মিত প্রথম ব্রিটিশ রেলপথ নির্মাণের জন্য উত্তর মিশরে তাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে ফ্রান্স ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে সংযুক্ত করার জন্য সুয়েজ খাল নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগ করে। ইসমাইল পাশার (শাসনকাল ১৮৬৩-১৮৭৯) নীতির কারণে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আর্থিক সংকট চূড়ান্ত হলে তিনি সুয়েজ খাল কোম্পানির মিশরের শেয়ার ব্রিটেনের কাছে বিক্রি করেন। ইউরোপীয় ও অটোমান শাসনের প্রতি অসন্তোষ ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে মিশরে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহের সূচনা করে। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী ১৮৮২ সালে দেশের আর্থিক স্বার্থ রক্ষার জন্য মিশর দখল করে, যা একটি যুদ্ধে পরিণত হয়। যুদ্ধে ব্রিটেন জয়লাভ করে। জাতীয়তাবাদী নেতা আহমেদ উরাবি (যাঁকে লেখক আরবি পাশা বলে লিখেছেন) সহ বিদ্রোহীরা ধৃত ও শ্রীলঙ্কায় নির্বাসিত হন। এরপর ব্রিটিশ তাওফিক পাশাকে (শাসন কাল ১৮৭৯-১৮৯২) মিশরের শাসনকর্তা বা খেদিভ হিসেবে রেখে একটি নামমাত্র সরকার গঠন করেন। যদিও মিশর অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ রইল কিন্ত প্রকৃতপক্ষে মিশর ব্রিটিশ সামরিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে চলে আসে]। 


মিশরের এই যুদ্ধের বিভিন্ন বর্ণনা যা লেখক লিখেছেন তা ভ্রমণ বিষয়ক না হওয়ায় বর্জিত হল। এরপর যুদ্ধের শেষে সৈন্যরা ফিরে যাচ্ছে। কোথাও বিজয়ী সেনা অবলা মিশরীয় নারীর উপর অত্যাচার করছে, কোথাও অর্থ লুঠ করছে, কোথাও ক্ষুধার্ত মিশরীয়রা দুর্বলের খাবার কেড়ে খাচ্ছে - এইসব বীভৎস দৃশ্যে মিশর ভর্তি। 


যুদ্ধের শেষে একা লেখক কাইরো ফিরছেন ঘোড়ায় চড়ে সশস্ত্র অবস্থায়। যুদ্ধে তিনি সঙ্গিদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। তিনদিন কিছু খেতে পান নি। ঘোড়াটিও খেতে না পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু কোন গ্রাম চোখে পড়ছে না। যখন লেখক প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন তখন দেখলেন ঘোড়া একটা সবুজ উপবনে প্রবেশ করেছে। ক্রমে একটি গ্রামে এসে পৌঁছলেন লেখক, যেটি যুদ্ধের ফলে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এবং প্রায় পরিত্যক্ত। একটি অসহায়া মিশরীয় মহিলাকে এক নরাধম শ্বেতকায় সৈন্যের হাত থেকে রক্ষা করলেন লেখক। নারীটি কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে লুকিয়ে থাকা একটি তরুণ লেখককে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রুটি, খেজুর, জল খেতে দিল। লেখককে তারাই পথের সন্ধান দিল। 


লেখক নিকটস্থ জাগ-আ-জিগ শহরের রেল স্টেশনে পৌঁছলেন। স্টেশনটি সুন্দর এবং তার সংলগ্ন একটি সুন্দর হোটেল আছে। সেখানে ইংরেজ কর্মচারীর সঙ্গে দেখা করে লেখক তাঁর সঙ্গীদের অবস্থান জানতে পারলেন। পরের দিন কাইরো যাওয়া ঠিক হল। পরদিন সকালে লেখক সেই রাজপুরুষের থেকে শহর দর্শনের পাস, ঘোড়া ও দুজন সঙ্গী নিয়ে জাগ-আ-জিগ শহর দর্শনে বেরোলেন। শহরটি সুন্দর কিন্তু যুদ্ধাবসানে শ্রীহীন। অধিকাংশ বাড়িতে লোকজন নেই, দোকান বাজার বন্ধ। শুধু দু একটি ফল বিক্রেতা রমণী ফলের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে ফল বিক্রি করছে। 


দ্বিপ্রহরে কাইরো যাওয়ার ট্রেন ছাড়ল। কাইরো পৌঁছাতে নয় ঘন্টা লাগল। এই সময় ট্রেন থেকে অনেক নতুন স্থান, সুন্দর উদ্যান, অপূর্ব ঘরবাড়ি এবং নীলনদের শোভা দেখলেন লেখক। নীলনদ এই দেশের মরুভূমিকে জল দিয়ে শস্যশ্যামলা একটি সাম্রাজ্যে পরিণত করেছে। কাইরো স্টেশন থেকে লেখক আবাসীয়া ছাওনিতে কোন মতে আশ্রয় পেলেন এবং সহযোদ্ধা এবং জাহাজের সহযাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হলেন। তারপর থেকে তিনি অফিসের কাজে নিযুক্ত হলেন আবাসীয়া রাজপ্রাসাদে জেনারেল সাহেবের বর্তমান আবাসস্থলে। এক মাসের বেশি কাইরো শহরে থাকার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ- র কাছে শহর ঘুরে দেখার প্রার্থনা জানাতে ভাগ্যক্রমে সেই প্রার্থনা মঞ্জুর হল। 


এর মধ্যে লেখক একদিন এক মিশরীয় সহকর্মীর বাড়িতে রাতে খাবারের জন্য নিমন্ত্রিত হন। বাড়িতে সুন্দর ইঁটের তৈরি দোতলা বাড়ি, সামনে সুন্দর বাগান, নানা ফুলে ভরা। বাড়ির ভেতরে পরিছন্নতা ও সুরুচির ছাপ সর্বত্র। খাবার ঘরে গৃহকর্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তিনি অতিথিদের অতিথিদের সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং তাঁদের যত্ন করে খাওয়ালেন। তারপর অন্য একটি কক্ষে তাঁরা গেলেন। সেখানে টেবিলে কারুকার্য করা ঢাকনা পাতা, তার উপর সোনালী রূপালী রঙের নানা পাত্রে নানা রকম ফল সাজান। এই ফলাহারকালে সকলের ব্যক্তিগত কথা আলোচনা করার সময় জানা গেল এই মিশরীয় ভদ্রলোক আসলে একজন বঙ্গ সন্তান। কিশোর বয়সে পিতামাতৃহীন হয়ে তিনি দেশ ভ্রমণে বের হন এবং দশ বছর যাবত দেশে ভ্রমণ করে বিদেশ যাওয়ার বাসনা হয় তাঁর। তখন একটি জাহাজে কাজ নিয়ে প্রথমে মক্কা ভ্রমণ করে তারপর মিশরে যান। পরে সেখানে মিশরীয় মহিলাকে বিবাহ করে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন। 


পরদিন সেই মিশরীয় তথা বাঙালির সঙ্গে লেখক নীলনদের তীরে পিরামিড দেখতে গেলেন। প্রথমে পিরামিড দেখে তিনি হতাশ হয়ে ভেবেছিলেন এ শুধু কতগুলি শুষ্ক পাথরের স্তুপ। কিন্তু আকাশস্পর্শী পিরামিডগুলোর মধ্যে প্রবেশ করে যা দেখলেন তা কখনো কোথাও দেখেননি, বর্ণনা করার ভাষাও তাঁর নেই বলেছেন তিনি। পিরামিড এত উন্নত প্রযুক্তি দ্বারা নির্মিত হয়েছে যে মনে হয় তা বিধাতা তৈরি করেছেন। ইংরেজরা বহু উন্নতি করেছে বিজ্ঞানে কিন্তু তাদের বর্তমান পূর্তকার্যের থেকে পিরামিড কোটি গুন উন্নত ও স্বতন্ত্র। প্রতিটি পাথর অন্য পাথরের সঙ্গে কোথায় যুক্ত হয়েছে কোনভাবেই বোঝা যায় না আর তাদের আলাদা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। 


কাইরো শহরে প্রশস্ত রাজপথের দুই পাশে দোতলা থেকে পাঁচতলা সুন্দর অট্টালিকা দেখলেন। কিন্তু সর্বত্র বিষাদের ছাপ। পথের ধারে পথিকদের খাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে পশুর মাথার আকৃতি দেওয়া অংশ স্তম্ভের ওপরে বসানো আছে। সেই মুখ এক দিকে ঘোরালে জল পড়ে, অন্যদিকে ঘোরালে জল বন্ধ হয়। একটি স্থানে মন্দিরের সামনে তিনি পানশালা দেখলেন। অন্যত্র রাজকীয় পণ্যশালা দেখলেন, যা একটি বিশাল প্রাসাদ এবং সেখানে অজস্র জিনিসপত্র ক্রয়বিক্রয়ের জন্য সাজানো রয়েছে। এরকম পণ্যশালা ভারতের কোন শহরে লেখক এর আগে দেখেননি। 


এরপর তিনি রাজপ্রাসাদ দেখতে গেলেন। প্রাসাদের সামনে উদ্যানে একদল সুন্দর যোদ্ধার বেশধারী মিশরীয় জয়বাদ্য বাজাচ্ছে। প্রাসাদের দরজায় মিশরীয় যোদ্ধা ও ইংরেজ সশস্ত্র সেনা পাহারা দিচ্ছে। লেখক দেখলেন মিশরের সাধারণ মানুষ যখন যুদ্ধের কারণে গভীর বিষাদের মগ্ন তখন রাজপ্রাসাদে আমত প্রমোদ আনন্দ লীলা চলছে ইংরেজদের সঙ্গে। মিশরের রাজা আজ বিজয়ী ইংরেজ সেনাপতিকে আমন্ত্রণ করেছেন, তাই এত ধুমধাম আয়োজন। লেখক ইংরেজের মোহিনী শক্তিতে অবাক হলেন আর মিশর রাজের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন। এরপর লেখক যুদ্ধে আহত, পীড়িত, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহীন যোদ্ধাদের দেখতে গেলেন। তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট চোখে দেখা যায় না। তবে দেখলেন কজন তুরস্ক দেশের মেয়ে নিজেরা অগ্রবর্তী হয়ে রোগীদের সেবার ভার তুলে নিয়েছেন। 


অবশেষে ১৮৮২ পয়লা অক্টোবর থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীকে ফেরত পাঠানোর কাজ শুরু হল। ভারতবাহিনী পদাতিক, অশ্বারোহী, তাছাড়া উট, খচ্চর, ঘোড়ার গাড়ি সব একের পর এক দাঁড়িয়ে আদেশ পাওয়া মাত্র বাজনার সঙ্গে কুচকাওয়াজ করে যাত্রা শুরু হল। এইভাবে সাত দিন কুচকাওয়াজে এই পথ অতিক্রম করা হল। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে এইভাবে তাঁরা কাইরো থেকে সুয়েজ যাত্রা করলেন। প্রতি রাতে ইংরেজরা তাঁবুতে শয়ন করল এবং ভালো খাবার পেল। ভারতীয় সৈন্যদের জন্য কোন ছাউনি ছিল না, খাবারের বন্দোবস্তও তেমন ছিল না। এমনকি মরুভূমিতে প্রচন্ড তাপে পানীয় জল পাওয়া দুষ্কর ছিল। এর উপর ছিল ইংরেজ ঊর্ধ্বতনদের অকথ্য অত্যাচার যার কিছু বর্ণনা লেখক তাঁর বইতে দিয়েছেন। সুয়েজ উপকূলে এসে বহু তাঁবু পরল। প্রথমে সাহেবরা জাহাজে চলে গেল, তারপর ধীরে ধীরে অন্যরা। কিন্তু লেখক কোন ভারতগামী জাহাজ যে স্থান পেলেন না। 


সুয়েজে প্রায় একমাস থাকার পর লেখক একটি জাহাজে স্থান পেলেন। সেনাবাহিনীর ইংরেজ ক্যাপ্টেনের অত্যাচারী মনোভাবের জন্য লেখক থাকার জায়গাও ভালো পেলেন না জাহাজে। খুব কষ্ট করে দিন কাটাতে লাগলেন। একদিন লোহিত সাগরে জাহাজ প্রচন্ড বজ্রবিদ্যুৎসহ তুফানে পড়ে কোনক্রমে রক্ষা পেল। কিন্তু এর দুদিন পর জাহাজ আরো বড় ঝড়ে পড়ল। ঢেউ এসে জাহাজের দোতলার ডেকে পড়ছিল। হঠাৎ একটি তরঙ্গ এসে লেখককে একেবারে নীচে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তিনি নীচের তলায় একটি ফলকের ওপর পড়লেন এবং তাঁর পা একটি খচ্চরের দুই পায়ের মধ্যে জড়িয়ে যাওয়ায় সমুদ্রে পড়লেন না। জ্ঞান হারিয়ে তিনি সেখানে পড়ে রইলেন আর তাঁর ওপর দিয়ে সমুদ্রের জলস্রোত বয়ে যেতে থাকল। কিছু পরে জ্ঞান হলে তিনি বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন ও কিছু লোকের সাহায্যে তিনি তাঁর শোয়ার জায়গায় এসে দেখলেন তাঁর প্রায় সমস্ত জিনিসপত্রই জলে ভেসে চলে গেছে। এমনকি তার পোশাক এবং প্রিয়জনদের জন্য কেনা তাঁর সব উপহার ভেসে গেছিল। শারীরিক ও মানসিক অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে এবং তার মধ্যে ইংরেজ প্রভুর নানা অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে তিনি অবশেষে বোম্বাই ফিরলেন। 


বোম্বাই থেকে তিনি এলাহাবাদে যান এবং সেখানে তাঁকে  কিছুকাল কাজ করতে হয়। তিন সপ্তাহ পর তিনি রাউলপিন্ডি যাওয়ার পাস পান। এরপর লেখক কলকাতায় গেলেন যা লেখক তাঁর জন্মভূমি বলে লিখেছেন। পনেরো দিন কলকাতায় কাটিয়ে রেলে পাঞ্জাব রওনা দিলেন তিনি। পথে কাশী, প্রয়াগ, কানপুর, আলীগড়, অমৃতসর, লাহোর প্রভৃতি স্থানে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে ১৮৮৩ -র শুরুতে রাউলপিন্ডি পৌঁছালেন তাঁর নিকটজনদের কাছে। ফেরার পথে জাহাজে তাঁর যে দুর্ঘটনা হয়েছিল তার ফলে তিনি অকর্মণ্য হয়ে যান ও পদচ্যুত হন। ইংরেজ গভর্মেন্ট তাঁর প্রতি নির্দয় ব্যবহার করে। 


পরিশেষে, লেখক ভারতবাসীদের দাসত্ব মনোভাব থেকে জেগে উঠে স্বাধীন কৃষি-বাণিজ্যের উন্নতি করে দেশের উন্নতি সাধন আর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ভাব জাগরিত করতে আহ্বান জানিয়েছেন।

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...