(পৃষ্ঠা ১২) ভ্রমণকারি বন্ধুর পত্র - ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত "ভ্রমণকারি বন্ধুর পত্র", "সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা"য় ১২৬১ বঙ্গাব্দে (১৮৫৪ বা ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দ) প্রকাশিত হয়েছিল। ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত (১৮১২ - ১৮৫৯) একজন প্রখ্যাত বাঙালি কবি ও সাহিত্যিক। তিনি যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে মিলিতভাবে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে "সংবাদ প্রভাকর" পত্রিকা প্রকাশ করতেন। বাংলা কবিতার  জগতে তিনি আধুনিক যুগ এনেছিলেন। প্রচলিত দেবদেবীর বন্দনা সংক্রান্ত কবিতা না লিখে তিনি মানুষের জীবন নিয়ে কবিতা লিখতেন। এছাড়া তিনি অনেক কবি, শিল্পীর জীবনী রচনা করেন। "সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা" বাংলা সাহিত্যের জগতে, নীল বিদ্রোহের ক্ষেত্রে ও জনমত গঠনে অপরিসীম গুরুত্ব রাখে। 


এই রচনাটির নাম যদিও "ভ্রমণকারি বন্ধুর পত্র" কিন্তু এটিকে ঠিক ভ্রমণ কাহিনী বলা চলে না। বরং এটিকে বর্তমান বাংলাদেশের তৎকালীন বিভিন্ন জেলার ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার বললে ভালো হয়। বিভিন্ন জেলার জনগণ, ভূপ্রকৃতি, অর্থ সামাজিক পরিস্থিতি এবং সেইসব এলাকার গুরুত্বপূর্ণ মানুষজনের কথা এই রচনা থেকে জানতে পারা যায়। ভ্রমণ সংক্রান্ত যেটুকু উপাদান এর মধ্যে আছে সেটুকু এখানে পরিবেশন করা হলো। 

বর্তমান রচনায় ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদকের কাছে লিখছেন এমন ভাবে রচনাটি করেছেন। ভ্রমণকারি বন্ধুটি আসলে ঈশ্বর গুপ্ত নিজেই। ১২৬১ সনে (১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে) রাজশাহী জেলা থেকে প্রথম তিনি সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন। সম্প্রতি তিনি কলকাতা থেকে নৌপথে রাজশাহীতে এসেছেন। বর্তমানে পদ্মা নদী তার পরাক্রম হারাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে চড় পড়েছে। নদী নিজের স্রোত কমাতে সেখানকার মানুষ খুব খুশি হয়েছে। তিনি আট দিন ধরে বড় কুটির ঘাটে কাপ্তান সাহেবের বাড়ির নীচে নৌকায় বাস করেছেন। এযাবৎ কোন ভাঙ্গন হতে দেখেননি। যদি আগের মতো নদী ভাঙ্গন অব্যাহত থাকতো তাহলে কাপ্তান সাহেবের সুন্দর বাড়ি, বাগান, ঘোড়ামারার বাজার, কমিশনারের প্রধান কেরানি, কালেক্টরের প্রধান কেরানি, ডেপুটি কালেক্টর, সদর আমিনের বাসা, গভর্নমেন্ট স্কুল বাড়ি সব এতদিন পদ্মার জলে ভেসে যেতো। এবার অতিবৃষ্টিতে পদ্মার জলে প্লাবন হয়েছিল। এখনো খানা ডোবা পূর্ণ আছে। জ্বরের খুব প্রাবল্য হয়েছে, বহু প্রাণহানি ঘটেছে। কদিন পর, লেখক ও সঙ্গীরা রাজশাহীর বড় কুটির ঘাট থেকে নৌকায় পাবনা যাত্রা করলেন। পরদিন সন্ধ্যায় পদ্মা নদী ছেড়ে ইছামতিতে প্রবেশ করলেন। কথায় আছে 'মরা গাঙ কুমিরে ভরা'। শীতকালের অল্প জলে কুমির অপেক্ষা করছে মাছ পশু আর মানুষ খাওয়ার আশায়। ইছামতিতে জল কমে কোন কোন স্থানে আধ হাত জল হয়েছে। বড় নৌকা সেখান দিয়ে যেতে পারেনা। প্রায় সব নদীতে ভয়ংকর ''মসিনা" আছে। এসব জায়গায় নৌকা পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় নেই। এই মসিনার নাম চর। এর উপর স্থলচর প্রাণীর তো কথাই নেই, জলচর প্রাণীও বাস করতে পারে না। দুই প্রকার মসিনা হয়। সচল ও অচল। সচল মসিনা ততো ভয়ংকর না। অচল মসিনার ওপর দিয়ে জলযান গেলে তা রক্ষা করা দুষ্কর, বিশেষত উজানের সময়। ছোট ডিঙ্গি করে অতি কষ্টে তাঁরা পাবনার বাজার ঘাটে পৌঁছালেন।

এখানকার বাজার বড় ও সুসজ্জিত ইঁটের তৈরি, চকবন্দি ঘর। অনেক রকম খাদ্যদ্রব্য, পাটের আর সুতোর বস্ত্র, মাছ, তরকারি, ঘি, দুধ, দই সুলভ। শস্য জন্মায় অনেক। এখানে বেশ কিছু নীলের কুঠি আছে। অধিকাংশ নীলকরেরাই অত্যন্ত অত্যাচারী। পাবনায় কদিন থেকে নৌকায় রওনা হলেন তাঁরা। পদ্মা আরো প্রবলা হয়ে উঠলো বাইশ কোদালের মোহনার পরে তেমোহনিতে যমুনা অসম্ভব খরস্রোতা। প্রবলা যমুনার জল অতি নির্মল, এই জল পান করা হয়। এবার আবার পদ্মায় প্রবেশ করে ফরিদপুরের দিকে যাত্রা করা হলো।

ফরিদপুরের টেপাখোলার ঘাটে এল নৌকা। ফরিদপুর বাণিজ্য কেন্দ্র। এখানে এক আনার মাছের দাম কলকাতার এক টাকা হবে। দুধ, ঘি ,সবজি, গুড়, চিনি সবই খুব সস্তা। বাঙালির খাবারের জন্য এটি চরম সুখের স্থান। ফরিদপুরের কাছারির কাছ থেকে ঢোলসমুদ্রের শোভা অত্যন্ত সুন্দর। ঢোলসমুদ্র হল সমুদ্রের মতো বড় এক জলাশয়। জল মিষ্টি, নানা জাতের মাছ আছে। জেলেরা সবসময় এখানে মাছ ধরছে। জলে নানা জলচর পাখি আছে, তাদের মধুর গানে সব দিক মুখরিত। বর্ষায় যখন এর সঙ্গে পদ্মার যোগাযোগ হয়, শোভা আরও বৃদ্ধি পায়। কুশলনাথ নামে এক অশ্বত্থ বৃক্ষ আছে, জেলার সবাই এই কুশলনাথ বৃক্ষের পূজা করে। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার তার তলায় পূজা হয়। ছাগ-মেষ বলি হয়, চিনি দুধ দিয়েও পুজো হয়। নীল কুঠির মালিকেরা অধিকাংশ ইংরাজ। কিছু জমিদারেরও কুঠি আছে। কুঠিয়ালরা অনেকেই খুব অত্যাচারী। লেখক ভ্রমণ করতে যেখানে যান সেখানেই বহু লোকের মুখে এই অত্যাচারের দুঃখের কথা শুনতে পেলেন। 

এরপর তিনি যেস্থানে গেলেন সেটি সুধারাম মজুমদার নামক এক ব্যক্তি জনশূন্য নদীর চরে প্রজাপত্তন করে তৈরি করেছিলেন এবং তার নামে জায়গার নাম হয় সুধারাম। এই স্থান সুধারাম, ভুলুয়া বা নোয়াখালী এই তিন নামেই পরিচিত। এখানে বাঘের ভালই উপদ্রব আছে। 

এরপরের জেলা চট্টগ্রাম। এখানে নীল, রেশম প্রভৃতির কুঠি নেই, তাই প্রজারা সুখে আছে। জেলার প্রধান নদী কর্ণফুলী। অত্যন্ত সুন্দর তার শোভা। জাহাজ, নৌকায় পূর্ণ। জলপথে এখানে বাণিজ্য চলে। সমুদ্রের (বঙ্গোপসাগরের) সঙ্গে যোগাযোগ থাকাতে অনেক স্থানে এই নদীর জল লবণাক্ত। সমুদ্র থেকে জাহাজ হাতিয়া ও সন্দীপের মতো বিশাল নদী হয়ে কর্ণফুলীর মধ্যে দিয়ে কলকাতা বা চট্টগ্রাম যায়। এই জাহাজ বা নৌকাগুলির লোহার বাঁধুনী হলে জলে নষ্ট হয়ে যেত তাই বালাপ নামের বেতের বাঁধুনি এই নৌকা বা জাহাজে ব্যবহার করা হয়। সমুদ্র তীরে হালিশহর নামে স্থানে বায়ু উত্তম। সাহেবেরা পীড়িত হয়ে আরোগ্যের জন্য হালিশহরে যায়। চন্দ্রনাথ, শম্ভুনাথ, আদিনাথ, পাতাল, দ্বাদশশীলা, জটাশঙ্কর, জ্যোতির্ময়, ধর্মাগ্নি, বিরুপাক্ষ, লবণাক্ষ, সহস্রধারা, বারোবানল, সূর্যকুন্ড, চন্দ্রকুন্ড, কুমারীকুন্ড প্রভৃতি তীর্থ এই জেলায় আছে। শিবচতুর্দশীতে চন্দ্রনাথে বড় মেলা হয়। সমুদ্র তীরে বারুনির মেলা কে মহা মেলা বলা হয়। রাউজান থানায় পাহাড়তলীতে মগেদের প্রকাণ্ড আট দিনব্যাপী মেলা হয়। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের রবিবার সূর্যব্রত মেলা অনেক স্থানে হয়। এখানে শহরের ভিতর মাঝে মাঝে বাঘ এসে অত্যাচার করে। সর্প ভয় খুব বেশি আছে। পাহাড়ে গন্ডার, হাতি, ভাল্লুক, বাঘ অনেক আছে। পর্বতে মগ, চাকমা, ত্রিপুরা, কুকি, লুচি কোন প্রভৃতি বন্য জাতির বাস। 

চট্টগ্রাম থেকে তাঁরা এলেন কুমিল্লা। এখানে গোমতী নদী প্রবাহিতা। এখানে ত্রিপুরার রাজার রাজবাড়ি এবং অনেক দীঘি প্রভৃতি আছে। কামিল্যা পরিত্যাগ করে ডিঙ্গি নৌকায় করে গোমতী নদী থেকে মেঘনা অভিমুখে যাত্রা করলেন তাঁরা। সেদিনই তাঁরা গঙ্গামণ্ডল জমিদারির সদর কাছারি জাফরগঞ্জে এলেন। কাছারিতে কালী প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত আছে, অতিথিরা সবাই প্রসাদ পায়। গোমতী নদীর রূপ অতি ভয়ংকর। মনিপুরের পর্বত থেকে নির্গত হয়ে মেঘনায় এসে মিশেছে। এই নদীর দুই তীর অত্যন্ত শস্য শ্যামলা। মেঘনা, পদ্মা ও কীর্তিনাশা অতিক্রম করে রাজনগরের খালের মধ্যে প্রবেশ করে বাজারের ঘাট এসে মহারাজা রাজবল্লবভের রাজভবন ও অনেক প্রাচীন কীর্তিকলাপ দেখলেন। রাজনগরে রাজসাগর, রাণীসাগর, আনন্দসাগর, কৃষ্ণসাগর, সুখসাগর, প্রভৃতি সুবৃহৎ সরোবর ও অনেক উদ্যান আছে। শতরত্ন, একুশরত্ন,, পঞ্চরত্ন ,রাস মঞ্চ, দোল মঞ্চ, বৈঠকখানা, বসতবাটি প্রভৃতি দর্শন করলেন। পরে নওয়া-ভাঙ্গিনি নদী পার হয়ে পদ্মায় প্রবেশ করে বরিশাল জেলায় এলেন। এখানকার চাল বঙ্গদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কুমিরের ভয় এই নদীতে খুব বেশি।
এর বেশী ভ্রমণ সংক্রান্ত উপাদান না থাকায় এখানেই শেষ কবি ঈশ্বর গুপ্তের ভ্রমণ কাহিনীর আলোচনা। 

পরবর্তী পর্বে আরেক ঐতিহাসিক ভ্রমণ কাহিনী আসছে।


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...