রাজেন্দ্রমোহন বসু লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রাজেন্দ্রমোহন বসু লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

৬৭। কাশ্মীর-কুসুম ৩ - রাজেন্দ্রমোহন বসু

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

           
             (আগের পর্বের পরে)

কাশ্মীরের পশ্চিমভাগ : নৌকায় শ্রীনগর থেকে যাত্রা করলে সাফা কদল সেতু পার হলে বাঁদিকে দুধ গঙ্গা প্রবাহিত। কিছুদূর এগোলে বাঁদিকে ফাঁসি কাঠ দেখা যায়। এখানে আগে প্রায়ই দু-একজনের ফাঁসি হতো। বর্তমানে রাজা ফাঁসির আদেশ প্রায় করেন না। এরপর পর্যটকদের জন্য সুন্দর একটি কাঠের বাড়ি আছে। 

তার পর ক্ষীর ভবানী দর্শন। সকালে কুণ্ডের জল সবুজ ছিল যখন লেখক দর্শন করেছিলেন বেলা দশটায় হল গোলাপি। এরপর নদীপথে দু'পাশে গ্রামগুলি, চীনার বন, গালিচার মতো সবুজ ঘাস জমির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলা। 

এ পথের প্রথম হ্রদ হল মানস বল। এই হ্রদের জল অতি গভীর, স্বচ্ছ। নিকটে বাদশা জাহাঙ্গীরের তৈরি বাদশাহবাদের ভগ্নাংশ আছে। এই হ্রদ নীচে অবস্থিত অসংখ্য কুন্ডের জলে পুষ্ট। জলে সাদা ও লাল রঙের পদ্ম বন আছে, যা হ্রদের শোভা দ্বিগুণ করে তুলেছে। সামনের এক অত্যুচ্চ পর্বত থেকে একটি সুন্দর জলপ্রপাত সপ্তধারায় পড়ছে। হ্রদ ও প্রপাতের কাছে রয়েছে একটি প্রাচীন মন্দির। লেখক এই স্থানে ঘাসের উপর রাত কাটাতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না কারণ তিনি শুনলেন রাতে ভাল্লুক প্রকৃতি হিংস্র পশু এখানে জল পান করতে আসে। 

পরবর্তী গন্তব্য উলার হ্রদ। এই হ্রদ এখানকার সর্বাপেক্ষা বৃহৎ হ্রদ। বিতস্তা নদী এর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। অগভীর জলে জলজ লতা, পদ্ম বন আর অনেক মাছ রয়েছে। উলার হ্রদ নৌকায় পার হওয়ার সময় হাওয়ার প্রকোপে নৌকা উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা হয়েছিল। 

এরপর নুরুখালের দিকে উলার হ্রদে প্রবেশ করে লঙ্কাদ্বীপ দর্শন। চারশ বছর আগে মুসলমান নরপতি জালালুর উদ্দীন একটি নির্মাণ করেন। এটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০০ এবং প্রস্থের প্রায় ১৫০ হাত। বড় বড় গাছ বিশেষত তুঁত গাছের নিবিড় অরণ্য এত ঘন যে এখানে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে না। আঙ্গুর ভর্তি লতা গাছগুলির গা বেয়ে উঠেছে। সর্বত্র প্রাসাদ, স্তম্ভের ভগ্নাবশেষ রয়েছে। একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে যেটি হয়তো কোন হিন্দু রাজা পরে স্থাপন করেছিলেন। কাশ্মীরের সুলতান জয়নাল আবেদীন ১৪০৪ -এ হ্রদের মধ্যে জয়নাললঙ্কের কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করিয়েছিলেন। 

এরপর লঙ্কা দ্বীপের বিপরীত দিকে হ্রদের পশ্চিম পাড়ে শকর উদ্দিন পাহাড়। দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে উঠতে হয়। চূড়ায় শকর উদ্দীন নামক বিখ্যাত ফকিরের জেয়ারত অর্থাৎ মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। নীচে উলার হ্রদের দৃশ্য ও হ্রদের পাশের গ্রামগুলির  দৃশ্য এখান থেকে সুন্দর দেখায়। 


হ্রদের দক্ষিণ-পশ্চিম তীরে সোপুর নামের স্থান আছে  পূর্বে এটি একসময় কাশ্মীরের রাজধানী ছিল। এর প্রাচীনতম নাম সুরাপুর। অবন্তিবর্মা নরপতির মন্ত্রী সুর এই শহরের পুনর্নির্মাণ করে করেন বলে এর নাম সুরাপুর। আরো আগে এই স্থানের নাম ছিল কাম্বুরা বা কামপুর। এখানে পর্যটকদের থাকার জন্য দুটি সুন্দর বাড়ি আছে। প্রাচীন দুর্গ, সুন্দর শিব মন্দির ও স্বর্ণচূড়া বিশিষ্ট একটি মসজিদ আছে। এখানকার জলবায়ু খুব স্বাস্থ্যকর তাই ইংরেজরা এখানে ভ্রমণে আসে। মাছ ধরা তাদের প্রধান আনন্দ। 


এবার নৌকায় বিতস্তা নদী পথে বারামুলায় আসা হল। এখানে পিরান (ফিরান) এবং দীর্ঘ তিলকধারী পান্ডারা প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল লেখকদের তাদের যজমান করার জন্য। এখানেও মহারাজা পর্যটকদের জন্য একটি বাংলো করে দিয়েছেন। জানা গেল এক ইংরেজ এখানে গুপ্তধনের সন্ধানে খনন কার্য চালাচ্ছেন। কথিত আছে চীন সম্রাটেরা পরাজিত হয়ে এ দেশ পরিত্যাগ কালে বারামুলার কাছে কোন স্থানে বহুমূল্য রত্ন লুকিয়ে রেখে গেছেন। সেই স্থানে পৌঁছে একটি অতি উচ্চ শিবলিঙ্গ ও ভাঙ্গা মন্দির দেখলেন তাঁরা। শোনা যায় সেটি পাণ্ডবরা প্রতিষ্ঠা করেছিল। তার কাছে সেই গুপ্তধন খোঁজার জায়গা। একটি ছোট ঢিপি, যার সারা গায়ে জঙ্গল আর উপরে হিংস্র জন্তুর বাস, সেখানে খনন কার্য চলছে। সেখানে প্রাচীন ইঁটের গাঁথুনি খননের ফলে দেখা যাচ্ছে। (বারামুলার কাছে অবস্থিত এই স্থানটির নাম উস্কুর। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ১৮৬৯-'৭০ এ এখানে বৌদ্ধমঠ জয়েন্দ্র বিহারের অবশেষ  উদ্ধার করেছে এখানে। বৌদ্ধ বিহারের অবশেষ থেকে পাওয়া গান্ধার রীতিতে তৈরি টেরাকোটার বুদ্ধমূর্তি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আছে। ১৮৬৯ ভ্রমণ কালে এই খননকার্য বা তার পূর্ববর্তী অনুসন্ধান নিশ্চয়ই দেখেছিলেন লেখক। কুশান রাজা হুবিষ্ক -র নামে এই জায়গার নাম ছিল হুসকাপুর, তার থেকে উস্কুর। হিউয়েন সাং তাঁর লেখায় এই মঠের কথা লিখেছেন। 

লেখক বলেছেন কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক খনিজ সম্পদ আছে যেগুলি এখনো খনন কার্যের ফলে উদ্ধার করা যায়নি। যাতায়াতের পথে চন্দ্রভাগা নদীতে তিনি নিজেই সোনা এবং রুপো মেশানো পাথর পেয়েছিলেন অনেক পরিমাণে। 

বারামুলা নাম হয়েছে বরাহমুলা থেকে কারণ প্রবাদ আছে যে এখানে বরাহ অবতার ছিলেন। এখানকার এক পর্বতগাত্রে বরাহের খুরের চিহ্ন আছে। আর আছে রামকুন্ড, সীতাকুণ্ড, সূর্যকুন্ড প্রভৃতি অনেক কুন্ড ও তীর্থ। বিতস্তা নদী বারামুলা অতিক্রম করে সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এখানে তার স্রোত তীব্র ও ভয়াবহ। এখানে আর নৌকা যেতে পারে না। 

কাশ্মীরের অধিকতাকে মর্গ বা ক্ষেত্র বলে। নানা রকমের ফুল ফুটে মর্গগুলি অপরূপ শোভা ধারণ করে পর্যটকদের মুগ্ধ করে। গুলমর্গ সবথেকে বেশি সুন্দর। শ্রীনগর থেকে জল ও স্থলপথ মিশ্র করে এখানে যেতে হয়। মর্গের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে এবং পাশের গিরিশ্রেণীর অধিকাংশ অংশে ফুল ফুটে থাকে এই সময়। যত দূর দৃষ্টি যায় ফুল ছাড়া কিছু দেখা যায় না। এখানে পর্যটকদের কোন থাকার জায়গা নেই। ভ্রমণকারীরা নিজের নিজের শিবির স্থাপন করে বাস করে। এর কাছে অনেক গুজ্জর অর্থাৎ গোপালক এবং চোপান বা মেষপালকরা বাস করে। তাই দুধ, দই, ঘি, মাংসের অভাব এখানে হয় না। অন্য দ্রব্য বহু দূর থেকে নিয়ে আসতে হয়। 


খিলানমার্গ আরেকটি রমনীয় মর্গ। যদিও এটি বৃহত্তর কিন্তু ফুলের দিক থেকে গুলমার্গের থেকে কম সৌন্দর্য এখানকার। 

লোলাব একটি অতি উত্তম অঞ্চল। দৈর্ঘ্যে ১৫ মাইল, প্রস্থে কোন কোন স্থানে অতি সংকীর্ণ কোন কোন স্থানে তিন মাইল পর্যন্ত প্রসারিত। চারদিকে সুউচ্চ গিরিশ্রেণী। মধ্যে দিয়ে বড় একটি নদী (লাওল নদী) প্রবাহিত। এখানে ভূমি খুব উর্বর। তুঁত, বাদাম, আখরোট, চিনারের অনেক উদ্যান আছে। তিরিশটির মত গ্রাম নিয়ে এই অঞ্চল তৈরি। জলবায়ু শীতল ও স্বাস্থ্যকর। শিকারিদের স্থান খুব প্রিয় স্থান এটি। ভাল্লুকরা ফল পাকলে দলে দলে এখানে আসে। তাই এই স্থানকে অনেকে ঋক্ষ বন বলে। 


কাশ্মীরের উত্তর অংশ লোলাব অঞ্চলের মতো শ্রীনগরের উত্তর-পূর্ব ভাগে লার নামে একটি অপূর্ব অঞ্চল আছে। এই উপত্যকা দিয়ে সিন্দ নদী (সিন্ধু নদী নয়) প্রবাহিত। দ্রাস, লাদখ, ইয়ারকন্দ যাওয়ার পথ এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে গেছে। আকাশ ছোঁয়া তুষার মন্ডিত পর্বত; চির, ভুর্জপত্রের অরণ্য, সুস্বাদু ফলের বাগান আর গালিচার মতো সবুজ দূর্বায় ঢাকা এই উপত্যকা অসম্ভব সুন্দর। আঙুর, পিচ, আখরোট, নাশপাতি, আপেল ফল চারদিকে ফলে থাকে। নদীর দুধারে ছোট ছোট গ্রাম আছে। তাদের চারপাশে শস্যের ক্ষেত। এই স্থান শিকারের জন্য ভালো। এখানকার জলবায়ু উত্তম। তাই সম্ভ্রান্ত কাশ্মীরীরা এবং পর্যটকেরা শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে এই স্থানে কিছুদিন কাটিয়ে যায়। এই উপত্যকার উত্তর পশ্চিম প্রান্তে কয়েকটি সুন্দর কিন্তু জীর্ণ মন্দির আছে। এখানে একটি পবিত্র ঝর্ণা বা বল আছে। পাথরের তৈরি কুন্ড বা চশমা আছে, তাকে নাগবল বলে। গঙ্গাবল একটি অতি সুন্দর পার্বত্য হ্রদ। এটি হরমুখ পর্বতের ১৬৯০০ ফুট উঁচু শিখরে অবস্থিত। এটি বিতস্তা নদীর উৎস স্থল ও হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ। কাশ্মীরি পন্ডিতের কাছে এই গঙ্গাবল গঙ্গার মতো পবিত্র। প্রতিবছর ভাদ্র মাসে এখানে হাজার হাজার যাত্রী সমাগম হয়। 

সিন্দ  উপত্যকার উত্তর পূর্ব প্রান্তে শ্রীনগর এবং শ্রীনগর থেকে ৫ আড্ডা অর্থাৎ ৫ দিন দূরে সোনামর্গ বা স্বর্ণময় ক্ষেত্র। সোনমার্গ পর্যটকদের কাছে গুলমার্গের সমান বা বেশি জনপ্রিয়। এখানে মহারাজা পর্যটকদের জন্য কয়েকটি বাসগৃহ তৈরি করে দিয়েছেন।

এখানে শেষ হল লেখকের কাশ্মীর ভ্রমণ।

৬৬। কাশ্মীর-কুসুম ২ - রাজেন্দ্রমোহন বসু

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

         
           (আগের পর্বের পরে)

কশ্যপ মুনির আশ্রম ছিল বলে এই রাজ্যের নাম কাশ্মীর আর বর্তমানে কাশ্মীরের রাজধানী হল শ্রীনগর। বিতস্তা (ঝিলম) নদী শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তার উপর সাতটি কাঠের সেতু দিয়ে শহরের দুটি দিক যুক্ত হয়েছে। সেতুকে এখানে কদল বলা হয়। মানুষজন এখানে নদীতে সবসময় নৌকায় যাতায়াত করে। এখানকার সব বাড়ি কাঠের শুধু মহারাজার ও অল্প কজন ধনী ব্যক্তির সুন্দর অট্টালিকা আছে। রাজবাড়ী শের গড়ী প্রাসাদ বিতস্তা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৮৬৯ -এ লেখক যখন এখানে আসেন তখন একবার বর্ষায় নদীতে জলোচ্ছ্বাস হয়ে নদীর তীরের সব কাঠের বাড়ি ভেঙে চুরমার হয়েছিল। 

শ্রীনগরের কাছে একটি হ্রদ আছে ডাল লেক, ডল কথার অর্থ হল সাধারন অর্থাৎ এটি সর্বসাধারণের হ্রদ। এই হ্রদের জল বৃদ্ধি পেলে শ্রীনগর শহর প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই নদী ও হ্রদের মধ্যে একটি বাঁধ আছে। 

শ্রীনগরে এসে নৌকা করে এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত নদীপথে ভ্রমণ করলে সব দেখা যায়। শহরে ঢোকার মুখে মহারাজা বিভিন্ন বাংলো অর্থাৎ বিশ্রামাগার নির্মাণ করে দিয়েছেন, যেগুলি মূলত ইংরেজ পর্যটকদের থাকার জন্য ব্যবহৃত হয়। 

রাজবাড়ী দেখতে অনেকটা সাধারণ কিন্তু নদীর পাড়ে অবস্থিত পাথরের তৈরি এই প্রাসাদ খুব রমণীয় লাগে। রাজবাড়ীর দিকের পাড়ে অবস্থিত গদাধর দেবের সুন্দর সোনার চূড়াযুক্ত মন্দির আছে। শহরে বেশ কিছু খাল আছে সেগুলি নদীর সঙ্গে যুক্ত। খালগুলির ওপর কদল বা সেতু রয়েছে। রাজবাড়ীর বিপরীত দিকে বসন্ত বাগ। এখানে কালো পাথরের একটি উঁচু আসন আছে। প্রতিবছর এখানে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে গদাধর দেবকে এনে গোবর্ধন পূজা ও অন্নকূট উৎসব হয়। এই উৎসবে মহারাজা সমগ্র প্রজাদের অন্নদান করেন। হিন্দু ও মুসলমানদের খাদ্য প্রস্তুত হওয়ার আলাদা স্থান নির্দিষ্ট আছে। নিকটে সাহ হমদানের জেয়ারৎ অর্থাৎ মসজিদ আছে। এটি কাশ্মীরের অতি প্রাচীন ও অত্যুৎকৃষ্ট মসজিদের একটি। কথিত আছে এখানে পূর্বে কালীমন্দির ছিল, তার উপরে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। এই মসজিদের কাছে নদীর অপর পাড়ে নয়া মসজিদ বা পত্তর মসজিদ নামক বেগম নুরজাহানের প্রতিষ্ঠা করা মসজিদ রয়েছে। এরপরে নদীর ডান পাড়ে বাদশাহ জালালউদ্দিনের (পঞ্চদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরের রাজা। ইনি শিল্প সাহিত্য বিষয়ে কাশ্মীরের অনেক উন্নতি করেছিলেন) সমাধি রয়েছে। শোনা যায় তিনি প্রথম তুর্কিস্তান থেকে কাশ্মীরে শালশিল্প, কলমদানির কাজ ও কাচ তৈরি শিক্ষা এনেছিলেন। তাঁর নামে জানা কদলের নাম হয়েছে। 

হিন্দুদের শঙ্করাচার্যের টিব্বা বা পাহাড় মুসলমানদের কাছে তখত-ই সলিমান বা সলোমনের সিংহাসন নামে খ্যাত। এই টিলায় ওঠার দুটি পথ আছে কিন্তু শেষের অংশে এত দুর্গম পথ যা অতি সাবধানে হামাগুড়ি দিয়ে ওঠা নামা করতে হয়। এখানে শিবের মন্দির ও আরো কয়েকটি মন্দির রয়েছে। যে পাথরে তৈরি এই মন্দির তা এই পাহাড়ের নয়। এত বড় বড় খন্ডের পাথর এত উপরে কী করে প্রাচীন সময়ে তোলা হয়েছিল তা ভেবে বোঝা যায় না। হরি পর্বত শ্রীনগরের আরেকটি ছোট টিলা। ১৫৯০-এর বাদশা আকবর এখানে দুর্গের প্রাকার নির্মাণ করেন কিন্তু দুর্গ গঠন করা হয়নি। ভিতরে ছোট মন্দির, কামান ছাড়া কিছু নেই। এই দুই টিলার উপর থেকে শ্রীনগরের দৃশ্য খুব সুন্দর দেখায়। 

শের গড়ী বা রাজবাড়ীর সামনে থেকে চুটকোল নামে একটি খাল বিতস্তা নদীর সঙ্গে ডাল লেককে সংযুক্ত করেছে। এই খালের শুরুতে মহারাজার পালিত হাঁসের দল খেলা করে বেড়ায় আর রাজার নানা রকম রাজ তরী এখানে রাখা থাকে। আধ ক্রোশ দূরে ড্রোগজন বা হ্রদের দ্বার। যখন নদীতে জল কমে থাকে তখন তার কপাট খোলা আর জল বেশি হলে নিজে থেকে কপাট বন্ধ হয়ে যায়। তাই নদীতে জলোচ্ছ্বাসে হ্রদের জল বাড়ে না। এই হ্রদে পদ্ম, কুমুদ প্রভৃতি ফুটে থাকে। এখানকার অনেকে পদ্মপাতায় খাবার খায়। থালার পরিবর্তে এই হ্রদের কিছু অংশে ভাসমান কৃষিক্ষেত্র, কুঁড়েঘর রয়েছে। এই ভাসমান জমি কাশ্মীরীরা তৈরি করে। হ্রদের যে জায়গার জলের গভীরতা কম সেখানে তারা জলজ লতাপাতা, গুল্ম দেড় হাত মতো রেখে কেটে দেয়। তার উপর লতা ও মৃত্তিকা জমিয়ে জমিয়ে তা দৃঢ় করে তোলা হয়, পরে এই জমিতে কৃষি কাজ হয়। জলে যাতে এই ভূখণ্ড ভেসে না যায় তাই লম্বা ও মোটা কাঠ দিয়ে স্থানে স্থানে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। 

হ্রদের পশ্চিম দিকে হজরতবল গ্রামে একটি বড় মসজিদ আছে। সেখানে হজরত মোহাম্মদের শ্মশ্রুর কেশ রক্ষিত আছে বলে কথিত। এখানে প্রতি বছর চারটি মেলা হয়। সেখানে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে উপস্থিত হয়। এই উপলক্ষে ডাল লেকে নৌকা প্রতিযোগিতা হয়। 

চার চিনার একটি ছোট দ্বীপ ডাললেকে, যাতে চারটি চিনার গাছ আছে। নাসিম বাগ, শালিমার বাগ, নিশাত বাগ, চশমা শাহী প্রভৃতি মনোরম ক্রীড়া উপবন রয়েছে। উপবনগুলিতে কৃত্রিম জলপ্রপাত, ফোয়ারা এবং ধাপে ধাপে তৈরি বাগান আছে। এখানকার এইসব বৈশিষ্ট্য বাংলা প্রভৃতি সমতল ভূমিতে অনুপস্থিত। ডাল হ্রদের মধ্যে নিশাত বাগের কাছে একটি ছোট দ্বীপ আছে যার নাম সোনালং অর্থাৎ সুবর্ণ দ্বীপ। এখানে ইঁট পাথরের পুরাতন ইমারতের ধ্বংস চিহ্ন দেখা যায়। 

হ্রদের অনুচ্চ পাহাড়ের গায়ে আছে পরিমহল নামের জাহাঙ্গীর বাদশা নির্মিত  মহলের ধ্বংসাবশেষ। এখান থেকে হ্রদের দৃশ্য অপূর্ব। 

এবারে লেখক কিছু অদ্ভুত নৈসর্গিক ব্যাপারের কথা লিখেছেন, যার ব্যাখ্যা তিনি পাননি। যেমন ক্ষীর ভবানী দেবীর মন্দিরের কুন্ডের জল নিয়ত বর্ণ পরিবর্তন করে। নীল হলুদ প্রভৃতি রং হয়। জল লাল হলে মনে করা হয় অশুভ লক্ষণ, দেবী কুপিত হয়েছেন। 
শ্রীনগরের ডানদিকে ডেনসু নামক পরগণায় বনহামা (বনাহামা, বুদগাম জেলা) নামে একটি গ্রাম আছে। সেখানে একটি কুড়ি হাত চওড়া নালা আছে যেটি সারা বছর শুকনো থাকে। কিন্তু প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এর উপরের উঁচু জমির নানা স্থান থেকে বিন্দু বিন্দু জল নিঃসৃত হয়ে এই নালায় জমে ও এটিকে পূর্ণ করে দেয়। লোকে এখানে পুণ্যস্নান করে, একে জট গঙ্গা বলে। উঁচু জমিকে মহাদেবের জটা ভাবা হয়। 
মাচিহামাতে একটি বড় জলাশয় আছে তাকে হাকের সর (হোকারসার পাখির অভয়ারণ্য) বলা হয়। এই জলাশয় বড় বড় ভাসমান ভূমি খণ্ড আছে। হাওয়ায় এই ভূমিখণ্ডগুলি এদিক ওদিক সরে যায়। ভূমিখন্ডগুলিতে গাছ আছে, গবাদিপশুর পশু চারণভূমি হিসেবে সেগুলি ব্যবহৃত হয়। 
দেবসরে (দেবসার, কুলগাম জেলা) বাসুকি নাগ নামে এক চশমা বা কুণ্ড আছে। বসন্তকালের আগমন থেকে শস্য পাকা পর্যন্ত এই কুন্ডে জল থাকে। তারপর এক ফোঁটাও জল থাকে না। ওই জল সরে গিয়ে পিরপাঞ্জাল পর্বতের অপরদিকে গোলাবগড় নামক কুন্ড পূর্ণ করে। এই ভাবে ছয় মাস ধরে চক্র চলতে থাকে। কিন্তু এই দুই কুন্ডের মধ্যে দূরত্ব দশ ক্রোশ হবে। কিভাবে সংযোগ সম্ভব তা বোঝা যায় না। (বর্তমানে এই জল আসা-যাওয়ার খবর দেবসারে আছে কিন্তু কিসওয়ার জেলার গুলাব গড়ে সেরকম কোন তথ্য পাওয়া যায়নি)। 


এরপর লেখক কাশ্মীরের পূর্ব দিকের স্থান আলোচনা করেছেন: পান্দ্রিতন (পান্দ্রেথন মন্দির) একসময় কাশ্মীরের রাজধানী ছিল। সম্রাট অশোক এখানে একটি বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করেন, যেখানে ভগবান বুদ্ধের দাঁত সংরক্ষিত ছিল। এখন একটি দেবালয়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। 

পাম্পুর কেশর বা জাফরানের জন্মস্থান। এটি অনেক পূর্বে পদ্মপুর নামে এক রাজা স্থাপন করেন আগে নাম ছিল পদ্মপুর, যা পদ্ম নামের এক রাজা প্রতিষ্ঠা করেন। কার্তিক মাসে জাফরানের ফুল ফুটলে অপূর্ব শোভা হয়। 
এর দেড় ক্রোশ দূরে ফুকনাগ ও কালীশনাগ নামে লোহা ও গন্ধক মেশানো জলের কুন্ড আছে, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। 
অবন্তীপুর এককালে কাশ্মীরের রাজধানী ছিল। রাজা অবন্তিবর্মা, এটি স্থাপন করেছিলেন এখন কিন্তু এখন কিছু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে মাত্র। 
এর কিছু দূরে পাহাড়ের উপর প্রাচীন মন্দির রয়েছে একে সমাথাং বলে। কথিত আছে কাশ্মীর যখন জলমগ্ন ছিল তখন মহাত্মা কাশ্যপ এই স্থানে বসে সহস্র সহস্র বছর ধরে যোগ ক্রীড়া সাধন করেন। 
বিজবেহাড়া সম্ভবত বিদ্যাবিহার নামের অপভ্রংশ। সম্রাট অশোক এখানে বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। মুসলমান শাসনকালে সিকান্দার নামে এক শাসক সেটি ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি করেন। রাজা গোলাব সিং সেই মসজিদ নষ্ট করে পুনরায় মন্দির নির্মাণ করেন (বিজয়েশ্বর মন্দির)। 
অনন্ত নাগের নাম মুসলমান আমলে ইসলামাবাদ হয় এবং ইংরেজ আমলেও সেই নামই বজায় ছিল। পূর্বে হিন্দু আমলের নাম হল অনন্তনাগ। অনন্তনাগ কুন্ডটি বৃহৎ এবং এর মধ্যে অনেক মাছ খেলা করে। 
অনন্তনাথ থেকে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত মাটন বা মার্তন্ড বা মাত্তান হিন্দুদের একটি পবিত্র তীর্থ। এখানকার সূর্য মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দর্শনীয়। কাশ্মীরেরা একে পান্ডু লড়ী বলে অর্থাৎ পান্ডবদের নির্মিত মন্দির। ভূমজু গুহা মাত্তান-এর কাছের হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ। এখানে কয়েকটি ছোট ছোট ও দুটি দীর্ঘ গুহা রয়েছে। একটি বড় গুহায় একটি মন্দির রয়েছে। 
আচ্ছাবল একটি প্রাকৃতিক ঝরনা সংলগ্ন উপবন যা জাহাঙ্গীর তাঁর প্রিয়তমা পত্নী নুরজাহানের জন্য নির্মাণ করেন। বল শব্দের অর্থ ঝর্ণা। এখানে ফোয়ারা, জলপ্রপাত, জলাশয়, প্রাচীন মহলের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। 
কুক্কুরনাগ (কোকারনাগ) একটি অনেকগুলি ছোট ছোট ঝর্ণার সমাবেশ।
বৈরনাগ (বেরিনাগ) একটি প্রাকৃতিক ঝরনা ও জলাশয়। এখানে প্রাচীন প্রাচীর, পথ, অট্টালিকার ভগ্নাংশ রয়েছে। সম্রাট জাহাঙ্গীর এগুলি তৈরি করেছিলেন। শাহজাহানের কিছু কীর্তিও এখানে ছিল। কোশানাগ (কৌশার নাগ) বা হরীবল বা হরবাল একটি সুন্দর পার্বত্য হ্রদ। এর থেকে কয়েকটি জলপ্রপাত উৎপন্ন হয়েছে। এর মধ্যে হরবল শ্রেষ্ঠ (আহারবল জলপ্রপাত)। 

হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থ অমরনাথ। প্রতি বছর একমাত্র ভাদ্র মাসের রাখি পূর্ণিমার দিন অমরনাথ দর্শন হয়। ওই দিন সহস্র সহস্র যাত্রী সমবেত হয়ে অমরনাথ দর্শন করেন। কোন কোন অবশ্য নির্ভীক সন্ন্যাসী ওখানে দু-তিন মাস থেকে যান। রাখি পূর্ণিমার ১৫ দিন পূর্বে সকলকে সংগ্রহ করার জন্য কাশ্মীরের রাজা ঝান্ণ্ডি বা ছটি বা পতাকা শ্রীনগরের কাছে রামবাগ উপবনে ওড়ানো হয় এবং ৮ দিন আগে শ্রীনগর থেকে যাত্রা শুরু হয়। সন্ন্যাসী ও দরিদ্র তীর্থযাত্রীদের মহারাজা পাথেয় দেন।  অনন্ত নাগে পতাকা পৌঁছলে যে যেখানে থাকে এসে জড়ো হয়। সেখান থেকে আহার্য ও প্রয়োজনীয় সব দ্রব্য কিনে নিয়ে যেতে হয়। কারণ তার পরে আর কিছু পাওয়া যায় না। পতাকাকে অনুসরণ করে সবাই চলে পরবর্তী আটাশ ক্রোশ ৫ আড্ডায় ও ৫ দিনে। পথ এত দুর্গম ও বিপদজনক যে কোন কোন স্থানে পায়ের শব্দ বা কথা বললেও যে কম্পন হয় তাতে পাহাড়ের গা থেকে শিলা বা বড় খসে পড়ে যাত্রীর প্রাণনাস হয়। প্রচুর তুষারপাত হয়। প্রতি বছর অনেক যাত্রীর মৃত্যু হয়। অনেকে অপারগ হয়ে মাঝ পথে ফিরে আসে। এক ক্রোশ থাকতে পঞ্চতরণী, এই ঝর্ণার পাঁচটি শাখা। এখানে স্নান করে যাত্রীরা বস্ত্র ত্যাগ করে ভুর্জপত্রের কৌপিন পরে বা উলঙ্গ অবস্থায় মহাদেবের জয়ধ্বনি করতে করতে গুহায় যায়। শোনা যায় প্রতি পূর্ণিমায় বরফের লিঙ্গ পূর্ণরূপ ধারণ করেন এবং প্রতিপদ থেকে এক এক কলা হ্রাস পেতে পেতে অমাবস্যায় সম্পূর্ণ অদৃশ্য হন এবং পুনরায় ষোলকলা লাভ করে পরের পক্ষকালে। লিঙ্গ ছাড়া গুহায় শিবের বাহন বৃষের মূর্তি ও কিছু দেবদেবীর ভাঙ্গা মূর্তি রয়েছে। পূজা দিয়ে সেদিনই যাত্রীরা প্রত্যাবর্তন শুরু করে, রাত্রি বাস করে না। 

কাশ্মীরের ঠিক কোন স্থানে সতীর কণ্ঠদেশ পতিত হয়েছিল তা সুনির্দিষ্ট করে জানা যায় না বলে সমগ্র কাশ্মীরকে সারদা পীঠ বলে। সোপুর নামক স্থানে সারদা দেবীর প্রতিমূর্তি আছে। কাশ্মীরি অক্ষরকেও সারদা লিপি বলে। (বর্তমান সোপুর নামক স্থান, বারামুলা জেলাতে সারদা মন্দির আছে। আবার আজাদ কাশ্মীরের নীলম নদীর কাছে সারদা পীঠ, প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সারদা বলতে এই দুই স্থানে অবশ্য সরস্বতী দেবীকে বোঝায়। এই সারদার মন্দির শক্তিপীঠ না হয়ে সারদাপীঠ হওয়া উচিত। অনুরূপে সারদাপীঠ শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত দ্বারকা সারদাপীঠ, শৃঙ্গেরী সারদাপীঠ রয়েছে

                         (চলছে)




৬৫। কাশ্মীর-কুসুম ১ - রাজেন্দ্রমোহন বসু

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


'কাশ্মীর কুসুম' বইটি রাজেন্দ্রমোহন বসুর লেখা। এটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে (জ্যৈষ্ঠ, ১২৮২ বঙ্গাব্দ)। (প্রকাশের সাল সম্পর্কে কিছু ছাপার ভুল আছে বলে মনে হয় কারণ ভ্রমণ কাল প্রকাশকালের পরে হতে পারে না)। রাজেন্দ্র মোহন বসু সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতে পারা যায় না। শুধু উৎসর্গে তিনি নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়, তৎকালীন কাশ্মীরের প্রধান বিচারপতি ও জুডিশিয়াল কমিশনারকে বইটি দিয়েছেন এবং বলেছেন যে তিনি তাঁর স্নেহধন্য। লেখা পড়তে গেলে জানা যায় যে তিনি ১৮৭৯ থেকে কর্মসূত্রে অনেকদিন কাশ্মীরে ছিলেন। কাশ্মীর কুসুম বইটির কিছু অংশ মধ্যস্থ পত্রিকায় এর আগে 'কাশ্মীরের বিবরণ' নামে প্রকাশিত হয়েছিল। কাশ্মীর কুসুম বইটির পুরো নাম 'কাশ্মীর কুসুম অর্থাৎ কাশ্মীরের বিবরণ'। এটিকে ভ্রমণ কাহিনী না বলে কাশ্মীর টুরিস্ট গাইড বলা চলে। কিন্তু যেহেতু লেখক ভূমিকায় বলেছেন যে তিনি কাশ্মীরের এই স্থানগুলি নিজে অবস্থান করেছেন বা ভ্রমণ করেছেন তাই এটিকে ভ্রমণ কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এই বইটিতে তিনি ডঃ ইন্সের 'কাশ্মীর হ্যান্ডবুক' এবং কাশ্মীরের দেওয়ান কৃপারামের ফার্সি 'গুলজারে কাশ্মীর' বই থেকে কিছু তথ্য ব্যবহার করেছেন বলে জানিয়েছেন। 


বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যে এখানে যে কাশ্মীরের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেই অবিভক্ত ভারতের কাশ্মীরে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর বা আজাদ কাশ্মীরের প্রশ্ন উঠে না। কারণ পাকিস্তানের তখন জন্ম হতেই ৭০ বছরের বেশি বাকি। সেই কারণে এখানে কাশ্মীর অবিভক্ত। এই সময় কাশ্মীর স্বাধীন কাশ্মীরের রাজার শাসনাধীন। সেই সময় রণবীর সিং (শাসনকাল ১৮৫৬-১৮৮৫) ছিলেন কাশ্মীরের রাজা এবং তাঁর পিতা ছিলেন  মহারাজা গোলাপ সিং (গুলাব সিং, শাসনকাল ১৮৪৬-১৮৫৬), যাঁর নাম এই বইয়ে কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে। 


এখানে মূলত বর্তমান কাশ্মীরের ভ্রমণস্থান ও যাতায়াতের পথের যা যা বর্ণনা হয়েছে সেগুলি আলোচনা করা হবে। তৎকালীন কাশ্মীরের পশ্চিম সীমা হজারা ও রাওলপিন্ডি, পূর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য ৩৫০ মাইল। উত্তরে বালতি বা ইসকার্দু জেলা, কারাকোরাম পর্যন্ত বিস্তৃত। 


লেখকের বর্ণনা অনুসারে কাশ্মীরে যাওয়ার পাঁচটি প্রধান পথ আছে। 

এক) জম্মু ও বনহাল পথ অর্থাৎ আধুনিক কাশ্মীর রাজার পথ (বর্তমান প্রচলিত জম্মু, বানিহাল পাস পথ)। 

দুই) ভিম্বর ও পীরপঞ্জাল পথ বা পুরনো বাদশাহী পথ (ভিম্বর এখন পাকিস্তান শাসিত আজাদ কাশ্মীরের বা পাকিস্থান অধিকৃত কাশ্মীরের স্থান)। অন্তত সুলতানি আমল থেকে এই রাস্তা ছিল। 

তিন) ভিম্বর ও পুঞ্চ পথ। 

চার) মরি পথ। 

পাঁচ) আবোটাবাদ পথ অর্থাৎ পূর্বের আফগান শাসকদের পথ। 


এই রাজপথগুলির মধ্যে শুধু প্রথম পথ দিয়ে কাশ্মীরে প্রবেশ করতে হলে রাজার আজ্ঞা দরকার। পথে যাতে অনায়াসে যানবাহন ও খাবার ইত্যাদি সহজে পাওয়া যায় তার জন্য কাশ্মীরের রাজা বা ইংরেজ গভর্মেন্টের মধ্যে একজনের পরোয়ানা সঙ্গে রাখা দরকার। কিন্তু কাশ্মীর থেকে বেরোনোর সময় রাজার স্বাক্ষরিত আদেশপত্র ছাড়া কেউ বাইরে যেতে পারবে না। সমস্ত পথেই আড্ডা অর্থাৎ অস্থায়ী থাকার জায়গা রয়েছে। সেখানে থাকার ঘর, ঘোড়া, খচ্চর, পালকি, বাহক সহজে পাওয়া যায়। খাদ্য দ্রব্যের দোকান সেখানে আছে। রাজার বিভিন্ন কর্মচারীরা দেখাশুনা করে যাতে যাত্রীদের কোনো রকম কষ্ট না হয়। 


এক নম্বর পথ অর্থাৎ জম্বু ও বনহাল পথে লাহোর থেকে শ্রীনগর ২৭০ মাইল। এই পথে জম্মু থেকে শ্রীনগর ১১ দিনের পথ। লাহোর থেকে জম্বু প্রায় ১০০ মাইলের পথ। এই পথ দংশাল, কিরিমচী (কিরামচী), মীর, লান্দর, বিলাওত, রামবন (রামবান), রামসু, বনহাল (বানিহাল), বৈরনাগ (ভেরিনাগ), অনন্ত নাগ হয়ে শ্রীনগর হয়ে গেছে। রামবানে যেতে হলে চন্দ্রভাগা নদী পার হতে হয়। অবতরণ অতি ভয়ানক। মাঝে পথ অতি দুর্গম, প্রকৃত পথ নেই। অনন্ত নাগ থেকে সকলে নৌকা পথে শ্রীনগরে যায়, নাহলে স্থলপথে সেখান থেকে দুই দিন লাগে শ্রীনগর যেতে। কাশ্মীরের রাজা এই পথে যাতায়াত করেন। 


দুই নম্বর অর্থাৎ ভিম্বর ও পীরপঞ্জাল পথে লাহোর থেকে শ্রীনগর ২৪৬ মাইল। ভিম্বর থেকে শ্রীনগর ১২ দিনের পর। ভিম্বর, সৈদাবাদ, নাওশেরা, চঙগস, রাজৌরী, থন্নামন্ডি, বরমগোলা, পৌশিয়ানা, আলিয়াবাদসরাই, হীরপুর, শোপিয়ান, রামু হয়ে শ্রীনগর। এই পথে চিত্রপানি নদী পঁচিশ বার পার হতে হয়। এই পথে সুন্দর সুন্দর জলপ্রপাত আছে। (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)। 


তিন নম্বর ভিম্বর ও পুঞ্চ পথে ভিম্বর থেকে শ্রীনগর ১৪ দিনের পথ। ভিম্বর, থন্নামন্ডি, সুরন, পুঞ্চ, কেহুটা, আলিয়াবাদ, হাইদ্রাবাদ, উড়ি, নাওশেরা, বারমুলা (বারামুলা) হয়ে শ্রীনগর (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)। বারমুলা থেকে সবাই নৌকায় শ্রীনগর যায়, নাহলে স্থলপথে দুদিনের পথ। 


চার নম্বর বা মরি পথে লাহোর যাওয়া খুব অসুবিধাজনক। রাওলপিন্ডি থেকে ভালো পথ। মরি, দেউল, কোহালা, দন্না, ময়র, চিক্কর, হত্তি, চকোতি, উরি, নওশেরা, বারমুলা হয়ে শ্রীনগর ১৩৭ মাইল মরি থেকে (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)। 


পাঁচ নম্বর পথ অর্থাৎ আবোটাবাদ পথ ১৫৫ মাইল। আবোটাবাদ, মানশেরা, ঘরী, মোজাফেরাবাদ, হতীয়ান, কন্ডা, কথাই, শাহাদরা, গিঙগল, বারমুলা হয়ে শ্রীনগর (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)।


কলকাতাবাসীদের পক্ষে বনহাল, পিরপঞ্জাল বা পুঞ্চ পথ নেওয়া দরকার। অন্য দুটি পথ অতি দূর্গম বলে পীরপঞ্জাল পথ নেওয়ায় ভালো। বনহাল পথে যেতে হলে মহারাজার বিশেষ আজ্ঞা আবশ্যক বটে কিন্তু বাঙ্গালীদের প্রতি কোন নিষেধ নেই। 

{বর্তমানে ভারতের জন্য একমাত্র বানিহাল পথ ছাড়া সব পথ বন্ধ কারণ অন্য পথগুলিতে পাকিস্থান অধিকৃত কাশ্মীরের বা আজাদ কাশ্মীরের কিছু স্থান পড়ছে। এছাড়া শিমলা শহর থেকে পর্বতমালা ও শৈল শিখর দিয়ে দুটি পথ আছে কিন্তু পাঞ্জাব সরকারের বিশেষ অনুমতি না হলে কেউ তা ব্যবহার করতে পারে না। (বর্তমানে সিমলা থেকে লাদাখ হয়ে কাশ্মীরে প্রবেশ করা যায় কিন্তু তা অনেক সুউচ্চ গিরিপথ পেরিয়ে)}। 


সমগ্র পথের প্রতি আড্ডাতে থাকার ভালো বাসগৃহ, চারপাই আর খাবার জন্য চাল, আটা, দুধ, ঘি, মাংস ইত্যাদি পাওয়া যায়। কিন্তু কাশ্মীর উপত্যকার সর্বত্র ভ্রমণের আনন্দ নিতে হলে তাঁবু, ক্যাম্পবেড, মসলা, ডাল, আলু, শীতবস্ত্র, ওয়াটার প্রুফ প্রভৃতি নেওয়া দরকার। যদিও সঙ্গে জিনিস কম হলে চলাচলে সুবিধা। পথে মুদ্রা সঙ্গে রাখতে হবে কারণ পাহাড়িরা নোট চোখে দেখেনি, তারা নোট নিতে চায় না। শ্রীনগরে মহারাজা পর্যটকদের জন্য অনেক বাংলো বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেগুলি ইংরেজ দ্বারা সর্বদা পূর্ণ থাকে। শহরে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলি খুব নোংরা। তাই নৌকায় (হাউস বোট) বাস করা শ্রেয়। এ ছাড়া তাঁবু খাটানোর জন্য উপযুক্ত জমি আছে। 


এক আড্ডা থেকে অন্য আড্ডাতে যেতে যান ও বাহকের মূল্য যেরকম ধার্য আছে তা হল - অশ্ব - আট আনা, ভারবাহী খচ্চর - আট আনা, পালকি - চার আনা, পালকি বাহক - নয় আনা,  ভারবাহক - চার আনা, পিঠঠু - বারো আনা (১ আনা=৬.২৫ পয়সা)। অশ্ববাহকেরা একটি আড্ডার বেশি যায় না। মজুরি পেয়েই তারা আবার স্বস্থানে ফিরে যায়। সুতরাং প্রতি আড্ডায় নতুন নতুন অশ্ব, বাহক প্রভৃতি নিয়োগ করতে হয়। 


লেখক সতর্ক করেছেন দুর্গম পথের অর্থ পার্বত্য দেশে যারা যায়নি তাঁরা বুঝবে না। কাশ্মীর যদি স্বর্গ হয় তো সেখানে যাওয়ার পথ স্বর্গের সিঁড়ির মতোই সুকঠিন।  কাশ্মীরের পথ কোন কোনটি এত খাড়া যে উপরে ওঠার সময় ঝাপানে দড়ি বেঁধে টানতে ও অবতরণের সময় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিতে হয়। এইসব চড়াই ওঠার সময় আরোহী ও দর্শক দুয়েরই হৃদকম্প হতে থাকে। কোন কোন স্থানে প্রকৃত পথ নেই। কোন কোন স্থানে পাথর এত পিচ্ছিল যে পা রাখা কষ্টকর। যে যে জায়গায় পথ আছে সেখানে পথ দুই হাতের বেশি চওড়া না আর এত উঁচু যে নিচে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। শীতকালে এই পথগুলি বড় বরফে ঢেকে সম্পূর্ণ অগম্য হয়ে যায়। কিন্তু এইসব ভয়ংকর পথের সৌন্দর্য অপরিসীম। ফুলে-ফলে ভরা এই দুর্গম পথে কিন্তু ডাকাতি ও চুরির ভয় নেই কারণ মহারাজা গোলাপ সিং (শাসনকাল ১৮৪৬ থেকে ১৮৫৬) অত্যন্ত সুকঠিনভাবে শাসন করে গেছেন। ঝাপানে যাত্রা সম্পূর্ণ নিরাপদ নয় কারণ পথের দুর্গমতা ও বাহকের অসাবধানতায় পড়ে গেলে আরোহীর প্রাণ যেতে পারে। ঘোড়ায় যাত্রাও তেমন নিরাপদ নয়। বনহাল পথ ছাড়া অন্য পথগুলিতে ঘোড়া, উট যায়। মোঘল সম্রাটরা ও পীরপঞ্জাল পথ দিয়ে শত শত হাতি নিয়ে যেতেন সেই বর্ণনা বার্নিয়ার লিখে গেছেন। কিন্তু তার মধ্যে ভীষণ বিপদও ঘটত অনেক সময়ই। এছাড়া অনেকে পিঠঠু বা পিঠে উঠে যায়। বাহকের পিঠে একটি ছোট আসন বাঁধা থাকে তাতে হাত পা মুড়ে বসে যেতে হয়। স্থানীয় কাশ্মীরিরা কিন্তু এই দুর্গম পথে যাতায়াত করে সহজে। এমনকি এক নম্বর পথে মহারাজার ডাক জম্মু থেকে শ্রীনগর প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টায় পায়ে হেঁটে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে পৌঁছায়।


লেখক সতর্ক করেছেন কাশ্মীরে গিয়ে পর্যটকেরা যেন মনে রাখেন তাঁরা এক স্বাধীন রাজার দেশে এসেছেন। তাই মহারাজা, তাঁর আত্মীয়, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের সঙ্গে দেখা হলে যেন তাঁরা যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করেন। যেন সেখানকার সব নিয়ম-কানুন মেনে চলেন। গোপনে কোন দ্রব্য সরকারের মাশুল বাঁচিয়ে নিয়ে না আসেন এবং কোন কাশ্মীরিকে মহারাজের অনুমতি ছাড়া যেন কাশ্মীরের সীমা বাইরে না নিয়ে আসেন।

                        (চলছে)


২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...