বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০২৪

১৪। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ১ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

 


 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


শ্রীমন্মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীর প্রথম সংস্করণ জে এন ব্যানার্জি এন্ড সন্স থেকে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। 

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) দার্শনিক ও ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারক ছিলেন। তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি মাঘ উৎসব, নববর্ষ, দীক্ষা দিন প্রভৃতি ব্রাহ্ম উৎসবের প্রবর্তন করেন। ১৮৬৭ সালে বীরভূমের ভুবনডাঙ্গা নামক স্থানে বিশাল ভূমি কিনে তিনি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজকের শান্তিনিকেতন। ব্রাহ্মসমাজ তাঁকে মহর্ষি উপাধিতে ভূষিত করেছিল। 


ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর থেকে দেবেন্দ্রনাথ দুর্গাপূজাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিবছর আশ্বিন মাসে কলকাতার বাইরে বেড়াতে যেতেন বলে নিজেই লিখেছেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে ভ্রমণ সংক্রান্ত উপাদান কিছু আছে, কিন্তু ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে যেহেতু এটি লিখিত হয়নি তাই খুব বেশি তথ্য এখানে পাওয়া যায় না। আত্মজীবনীটি অসমাপ্ত। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত এটি লেখা হয়েছে, যখন তাঁর বয়স মাত্র ৪১ বছর। অর্থাৎ তাঁর জীবনের অর্ধেকের কম সময়ের কথা তিনি লিখে গেছেন। তাই তাঁর সমগ্র ভ্রমণকাহিনীও জানা যায় না।


১৭৬৯ শকের আশ্বিন মাসে অর্থাৎ ১৮৪৭-এর সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে তিনি কাশী যাত্রা করেন। তাঁর এই যাত্রার বাহন ছিল পালকির ডাক। কলকাতা থেকে কাশী যেতে তাঁর ১৪ দিন লাগে এবং যাতায়াত অতি কষ্টকর ছিল বলে তিনি লিখেছেন। কাশীতে তিনি বেদচর্চা করতে গেছিলেন। কাশীর মানমন্দিরে (রাজা জয় সিং নির্মিত) তিনি থাকতেন। বিশ্বেশ্বর মন্দিরের পান্ডা তাঁকে মন্দিরে নিয়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি বলেন যে তিনি তো বিশ্বেশ্বরের মন্দিরেই আছেন, আর কোথাও তাঁর যাওয়ার নেই। কাশীতে অনেক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ তাঁর নিকট আসেন। প্রচুর বেদ-চর্চা হয়। 


এরপর কাশীর মহারাজের ভাই এসে তাঁকে জানান যে রাজা একবার সাক্ষাৎ চান, তাই মহর্ষিকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পরদিন তিনি আবার এসে দেবেন্দ্রনাথকে অপর পাড়ে রামনগরের রাজবাড়ীতে নিয়ে যান। রাজপ্রাসাদের ঘরগুলি ছবি, আয়না, ঝাড় লণ্ঠন, গালিচা, দুলিচা, মেজ, কেদারায় দোকানের মতো ভরা। দুইজন বন্দী (বন্দনা করে যে) রাজার আগমনে যশোগান করলেন। রাজা এসে তাঁকে সমাদরে সভায় নিয়ে গেলেন। সেখানে নৃত্যগীত শুরু হল। রাজা তাঁকে একটি হীরের আংটি উপহার দিলেন। রাজা তাঁকে দশমীতে রামলীলা দর্শনের জন্য আবার আমন্ত্রণ জানালেন। 


রামলীলার দিন রামনগরে গিয়ে দেবেন্দ্রনাথ দেখলেন কাশীর রাজা একটি বিশাল হাতিতে বসে আলবোলা টানছেন আর পিছনে একটি ছোট হাতিতে তাঁর হীরের আলবোলা ধরে বসে আছে তাঁর হুকাবরদার। আরেকটি হাতিতে রাজগুরু গেরুয়া কাপড় পরে বসে আছেন। রাজগুরু মৌন আছেন। পাছে কথা বলে ফেলেন তাই তাঁর জিভে একটি কাঠের খাপ দেওয়া আছে। চারদিকে কর্নেল, জেনারেল প্রভৃতি সেনারক্ষকরা এক একটি হাতিতে চড়ে রাজাকে ঘিরে আছে। দেবেন্দ্রনাথকেও একটি হাতি দেওয়া হল। সবাই মিলে রামলীলার রঙ্গভূমিতে যাওয়া হল। মেলায় গিয়ে দেখলেন সেখানে লোকে লোকারণ্য। সেই মেলার এক জায়গায় চন্দ্রাতপের নীচে একটি ফুলে সাজানো সিংহাসনে একটি বালক তীর ধনুক নিয়ে বসে আছে। সেই বালক রামচন্দ্র সেজেছে। রামকে গিয়ে লোকজন প্রণাম করছে। এরপর যুদ্ধ হলো। কয়েকটি সং রাক্ষস, তাদের মুখে ঘোড়া, উট, ছাগল প্রভৃতির মুখোশ; তারা যুদ্ধের পরামর্শ করছে। কিছু পরে সেখানে একটি বোমা পরল, তার চারদিকে আতশবাজি হতে থাকল। দেবেন্দ্রনাথ এই পর্যন্ত দেখে কাউকে কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেলেন। দেবেন্দ্রনাথের মনে এই বালখিল্য রামলীলা নিশ্চয়ই বিরক্তির সঞ্চার করেছিল। 


পরে তিনি কাশী থেকে নৌকা পথে বিন্ধ্যাচল দেখে মির্জাপুর পর্যন্ত গেলেন। বিন্ধ্যাচলের ক্ষুদ্র পর্বত দেখে তিনি খুব আনন্দ পেলেন কারণ সেটি তাঁর প্রথম পর্বত দর্শন। বিন্ধ্যাচলে তিনি যোগমায়া দেখলেন। পাথরে খোদাই করা দশভূজা মূর্তি যোগমায়ার। সেখানে একটিও মানুষ নেই। এরপর দেখলেন ভোগমায়া। সেখানে প্রচন্ড ভিড়। সেখানে সমানে পাঁঠা বলি হচ্ছে। এরপর মির্জাপুর থেকে স্টিমারে কলকাতার বাড়িতে ফিরলেন। 



দেবেন্দ্রনাথের পরবর্তী ভ্রমণ ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। তিনি কয়েকজন বন্ধু নিয়ে দামোদর নদীতে বেড়াতে যান। দামোদরের বুকে ঘুরে একদিন একটি চড়ে যখন নৌকা লাগল তখন তিনি শুনলেন বর্ধমান সেখান থেকে মাত্র দুই ক্রোশ দূরে। তিনি বর্ধমান দেখতে উৎসাহী হলেন ও সেখানে পৌঁছলেন। সঙ্গে রাজনারায়ণ বসু ও আরো দু একজন ছিলেন। তাঁরা শহর ঘুরে দেখলেন, রাজবাড়িও দেখলেন। তারপর রাতে সেই চড়ে আবার ফিরে এলেন। পরদিন সেই চড়ে একটি সুন্দর ফিটন গাড়ি এসে উপস্থিত হোল। গাড়ি থেকে এক ব্যক্তি নেমে তাঁকে বললেন বর্ধমানের মহারাজা (রাজা মহাতাব চাঁদ) তাঁর সাক্ষাৎ চেয়েছেন। বর্ধমানে নিয়ে গিয়ে দেবেন্দ্রনাথকে একটি সুসজ্জিত বাসস্থানে রাখা হলো। পরদিন মহাসমাদরে তাঁকে রাজবাড়ি নিয়ে আসা হলো। রাজার সঙ্গে পরিচয় ও মতবিনিময় হলো এবং পরে তিনি রাজবাড়ীর মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করলেন। 



১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপূজার সময় দেবেন্দ্রনাথ বাষ্পতরীতে (স্টীমারে) ঢাকায় গেলেন। সেখান থেকে মেঘনা পার হয়ে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে গৌহাটিতে পৌঁছালেন। কামাক্ষা যেতে মনস্থ করাতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হাতি পাঠিয়েছিলেন তাঁর জন্য। তিনি পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন, পিছনে মাহুত হাতি নিয়ে চলল। ক্রমে হাতি পিছিয়ে পড়লো এবং তিনি পদব্রজেই তিন ক্রোশ চলে কামাখ্যা পর্বতের পাদদেশে পৌঁছলেন। পর্বতের পথ পাথরে তৈরি। সেই সোজা উপরে উঠেছে। দুধারে ঘন জঙ্গল। তিনি নির্জন বনপথে একা উঠতে লাগলেন। তখনও সূর্য ওঠেনি, অল্প বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক উপরে ওঠার পরে ক্লান্ত হয়ে পাথরের উপর বসে পড়লে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলেন। চিন্তা হল জঙ্গল থেকে বাঘ ভালুক যদি আসে। এমন সময় মাহুত এসে উপস্থিত। হাতি আনতে না পেরে সে একাই ছুটতে ছুটতে এসেছে। দুজনে আবার পাহাড় চড়তে লাগলেন। পাহাড়ের উপরে একটি বিস্তীর্ণ সমভূমি।। সেখানে অনেকগুলি চালাঘর আছে কিন্তু একটি লোকও চোখে পড়লো না। তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দির যেন একটি পর্বত গহ্বর। সেখানে কোন মূর্তি নেই, কেবল যোনি মুদ্রা আছে। তিনি দর্শন করে ফিরে এসে ব্রহ্মপুত্রে স্নান করে ক্লান্তি দূর করলেন। তারপর দেখেন ৪০০-৫০০ লোক ভিড় করে পাড়ে দাঁড়িয়ে কোলাহল করছে। তারা জানালো তারা কামাখ্যার পান্ডা। অনেক রাত পর্যন্ত দেবীর পূজা করতে হয় তাদের। তাই সকালে উঠতে দেরি হয়। তিনি কামাখ্যা দর্শন করেছেন অথচ পান্ডারা কিছু পায়নি। দেবেন্দ্রনাথ তাদের বললেন তারা তাঁর নিকট থেকে কিছুই পাবে না, তারা যেন চলে যায়। 


১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দেবেন্দ্রনাথ গঙ্গা তীরে বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকা ভাড়া করতে গিয়ে একটি বড় স্টীমার দেখলেন, যেটি দু-তিন দিনের মধ্যে সমুদ্রে যাবে। দেখে তাঁর শখ হল সমুদ্রে যাওয়ার এবং তিনি স্টিমারে একটি ঘর ভাড়া করলেন। সমুদ্রের রূপ তিনি এর আগে দেখেননি।  অখন্ড জলরাশির নীল রূপ আর দিন রাত্রির বিচিত্র শোভা তিনি মগ্ন হয়ে দেখতে লাগলেন। একদিন  জাহাজ এক জায়গায় নোঙর করল। সামনে সাদা বালির চড়ায় একটি বসতি। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে তিনি কয়েকজন চট্টগ্রামবাসী বাঙালিকে দেখলেন। লেখক জিজ্ঞাসা করে জানলেন তারা এখানে ব্যবসা করে। আশ্বিন মাসে তারা এখানে মা দুর্গার প্রতিমা এনেছে। লেখক এবার ব্রহ্মরাজ্যের খাএকফু নগরে (Kyaukpyu) দুর্গোৎসবের কথায় আশ্চর্য হলেন আর ভাবলেন দুর্গোৎসব এড়াতে এত দূরে এসেও সেই দুর্গোৎসবের কথা তাঁকে শুনতে হল। 



এরপর জাহাজ মুলমীন ( Mawlamyine) অভিমুখে চলল। জাহাজ সমুদ্র ছেড়ে মুলমীনের নদীতে প্রবেশ করল। এই নদীর শোভা তেমন নেই। জল পঙ্কিল, কুমিরে পূর্ণ বলে কেউ নদীতে স্নান করে না। মুলমীনে একজন মাদ্রাজি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। লেখক তাঁর বাড়িতে কয়েক দিন কাটালেন। মুলমীন শহরের রাস্তাঘাট পরিষ্কার ও প্রশস্ত। দুইধারে দোকানে স্ত্রীলোকেরাই বিক্রির কাজ করছে। তিনি প্যাটরা (বাক্স), উৎকৃষ্ট রেশম বস্ত্র ক্রয় করলেন। এরপর মাছের বাজারে গিয়ে দেখলেন কুমির কেটে বিক্রি হচ্ছে মাছের মতো। লেখক মন্তব্য করেছেন বার্মার মানুষের অহিংস বৌদ্ধধর্ম শুধু মুখে কিন্তু পেটে কুমির। মুলমীনের রাস্তায় একদিন সন্ধ্যায় বেড়ানোর সময় দেবেন্দ্রনাথ এক বাঙালিকে দেখে অবাক হলেন। তারপর ভাবলেন বাঙালির অগম্য স্থান নাই। জিজ্ঞাসা করে জানলেন ব্যক্তিটি দ্বীপান্তরিত হয়ে এসেছিল এখানে। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে আন্দামান দ্বীপে দ্বীপান্তরকরণ শুরু হওয়ার আগে মুলমীনে অন্তরীন করা হতো। এখন শাস্তির মেয়াদ ফুরিয়েছে, কিন্তু টাকার অভাবে দেশে যেতে পারছে না। লেখক তাকে পাথেয় দিতে চাইলেন। কিন্তু সে বলল এখন সে বার্মায় ব্যবসা করছে, বিবাহ করেছে, সুখে আছে, সে আর দেশে ফিরবে না। 


যে মাদ্রাজি ভদ্রলোকের বাড়িতে লেখক আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি তাঁকে এক দর্শনীয় পর্বত গুহা (Kha you gu বা Kayon Cave, Farm Cave) দেখাতে নিয়ে যান। এক অমাবস্যার রাতে একটি লম্বা ডিঙ্গি চড়ে তাঁরা রওনা দিলেন। নৌকায় জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রভৃতি সাত আট জন সঙ্গে চলল। রাতে ১২ ক্রোশ গিয়ে ভোরে নৌকা গন্তব্যে পৌঁছাল। সেখানে একটি ক্ষুদ্র কুটিরে, মুন্ডিত-মস্তক, গেরুয়া বসন পরা কয়েকজন সন্ন্যাসীকে দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। পরে জানলেন এরা ফুঙ্গি, বৌদ্ধদের গুরু ও পুরোহিত। একজন দেখতে পেয়ে লেখককে ঘরের ভিতর নিয়ে গিয়ে পা ধোয়ার জল দিলেন, বসতে আসন দিলেন। বৌদ্ধদের কাছে অতিথি সেবা পরম ধর্ম। এরপর লেখক ও সঙ্গীরা হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গলের মধ্যে রওনা দিলেন সেই গুহার উদ্দেশ্যে। বেলা তিনটের সময় গুহার কাছে এসে পৌঁছে হাতির থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তাঁরা গুহা মুখে এলেন। ছোট গুহা মুখে গুড়ি মেরে প্রবেশ করতে হয়। গুহার ভেতর পিচ্ছিল ও ঘোর অন্ধকার। লেখক ও সঙ্গীরা গুহার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে পাথরের গায়ে গন্ধক চূর্ণ রেখে তাতে আগুন জ্বালালেন একসাথে। গুহার বিভিন্ন স্থান থেকে সেই গন্ধকের আলোয় এই গুহা আলোকিত হয়ে উঠল। গুহার প্রকাণ্ডতা ও তার উপর থেকে বৃষ্টিধারার বেগে বিচিত্র কারুকার্য (stalagmite) দেখে তাঁরা মুগ্ধ হলেন। এরপর জঙ্গলে বনভোজন সেরে তাঁরা ফিরে এলেন। কতগুলি বর্মাবাসীকে এক বাদ্যযন্ত্রের তালে নৃত্য করতে দেখলেন। স্থানীয় এক সম্ভ্রান্ত বার্মিজ পরিবারে নিমন্ত্রিত হয়ে তিনি আতিথ্য উপভোগ করেছিলেন।


১৮৫১ সালের মার্চে দেবেন্দ্রনাথ কটকে যান পালকির ডাকে। সেখানে জমিদারি সংক্রান্ত কাজের পর জগন্নাথ দর্শনের জন্য পুরীতে যান। রাতে পালকির ডাকে চললেন। সকালে পুরীর কাছে চন্দন যাত্রার পুষ্করিণী পৌঁছে স্নান করার সময় পুরীর জগন্নাথের একজন পান্ডা এসে তাঁকে ধরল। লেখক তার সঙ্গে চলতে থাকলেন। লেখকের পায়ে জুতো ছিল না বলে পান্ডা খুব খুশি হল। যখন তাঁরা পুরীতে পৌঁছলেন তখন জগন্নাথ দেবের মন্দিরের দ্বার বন্ধ ছিল। পান্ডা মন্দিরের দ্বার খুলে দিতে বহু মানুষ একসঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করল। ধাক্কাধাক্কিতে লেখকের চশমা খুলে পড়ে ভেঙ্গে গেল। ফলে চশমা ছাড়া লেখক নিরাকার জগন্নাথকেই দেখলেন। তাঁর মনে পড়ল যে একটি প্রবাদ আছে, যে যা মনে করে জগন্নাথ মন্দিরে যায় সে তাই দেখতে পায়। লেখক নিরাকারবাদে বিশ্বাসী বলে নিরাকার জগন্নাথ দেখতে পেয়েছেন এমনটি তিনি লিখেছেন। জগন্নাথের সামনে একটি বড় তাম্রকুণ্ড ভর্তি জল। সেখানে জগন্নাথের ছায়া পড়েছে। সেই ছায়াকে পান্ডারা দন্তধাবন ও স্নান করাল। তারপর জগন্নাথের মূর্তিতে নতুন বসন ও আভরণ পরাল। এরপর তিনি বিমলা দেবী মন্দিরে গেলেন, কিন্তু দেবীকে প্রণাম করলেন না। তাতে যাত্রীরা অসন্তুষ্ট হল। এরপর জগন্নাথের মহাপ্রসাদ নিয়ে শোরগোল পড়ে গেল। লেখক দেখলেন এখানে মহাপ্রসাদ নিয়ে ব্রাহ্মণ, শূদ্রের ভেদাভেদ নেই। এদিক দিয়ে উড়িষ্যাবাসীরা ধন্য। 


এরপর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপূজার সময় ১০০ টাকায় কাশী পর্যন্ত যাওয়ার জন্য তিনি একটি নৌকা ভাড়া করলেন। নবদ্বীপ পৌঁছতে ছয় দিন লাগলো। মুঙ্গেরে পৌঁছে সীতাকুণ্ড দেখতে গেলেন তিন ক্রোশ হেঁটে। তারপর ফতুয়ায় যখন বিস্তীর্ণ গঙ্গার মধ্যে দিয়ে চলেছেন, প্রবল ঝড় উঠল। লেখকের সঙ্গের পানসি আহার্য দ্রব্যসহ জলে ডুবে গেল। পাটনা এসে তিনি নতুন আহারে সামগ্রী কিনলেন। কলকাতা থেকে কাশী পৌঁছতে প্রায় দেড় মাস লাগল। কাশীতে তিনি দশ দিন ছিলেন। 


তারপর ডাকগাড়ি করে এলাহাবাদের অপর পাড়ে পৌঁছে নৌকায় গাড়ি সমেত পার হয়ে প্রয়াগ তীর্থের বেণী ঘাটে পৌঁছলেন। এই ঘাটে লোকে মস্তক মুন্ডন করে, শ্রাদ্ধ, তর্পণ, দান করে। একজন পান্ডা তাঁকে ধরে টানাটানি করতে থাকল। 


কদিন এলাহাবাদের থেকে ডাকগাড়িতে আগ্রা পৌঁছান। আগ্রায় তাজ দেখলেন। তাজের একটা মিনারের ওপর উঠে দেখলেন পশ্চিম দিক লাল করে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, নীচে নীল যমুনা, তার মধ্যে শুভ্র স্বচ্ছ তাজ যেন সৌন্দর্যের ছটা নিয়ে চাঁদ থেকে পৃথিবীতে খসে পড়েছে। 


তারপর যমুনা নদীপথে দিল্লি যাত্রা করলেন। পৌষ মাসের প্রবল শীতে নৌকায় চলাকালীন কোন কোন দিন তিনি যমুনাতে স্নান করতেন, কখনো যমুনার ধারে শস্য ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যেতেন। 


এগার দিনে যমুনা নদীপথে চলে মথুরায় উপস্থিত হলেন। সেখানে এক সন্ন্যাসী তাঁকে শাস্ত্রচর্চার জন্য ডাকেন। বিষ্মিত হয়ে তিনি দেখেন সন্ন্যাসীর কাছে সমস্ত রামমোহন রায়ের বইয়ের হিন্দি অনুবাদ রয়েছে। লেখক তারপর বৃন্দাবন গেলেন। সেখানে লালাবাবুর তৈরি গোবিন্দজীর মন্দির দেখলেন। নাট মন্দিরের চার পাঁচ জন বসে সেতার শুনছিল। লেখক গোবিন্দজিকে প্রণাম করলেন না দেখে তারা সচকিত হল। 


আগ্রা থেকে এক মাস নৌকাযাত্রা করে তিনি দিল্লি এলেন। দেখলেন নদীর পারে খুব ভিড়। দিল্লির বাদশাহ সেখানে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন। লেখক লিখেছে ঘুড়ি ওড়ানো ছাড়া বাদশাহর তখন আর কোন কাজ ছিল না। দিল্লি থেকে আট ক্রোশ দূরে কুতুব মিনার দেখতে গেলেন এবার। লেখক লিখেছেন এটি হিন্দুর পূর্ব কীর্তি। মুসলমানেরা এখন এটিকে কুতুবুদ্দিন বাদশাহের জয়স্তম্ভ বলে, এই জন্য এর নাম কুতুব মিনার। হিন্দুদের মুসলমানরা পরাজিত করার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের কীর্তিও লোপ করেছে। কুতুব মিনার প্রায় ১৬১ হাত উঁচু। তিনি সেই মিনারের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে পুলকিত হলেন। 


এরপর তিনি ডাকগাড়ি করে অম্বালায় গেলেন ও সেখান থেকে ডুলি করে লাহোরে গেলেন। লাহোর থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসর পৌছালেন। 


অমৃতসর পৌঁছে শিখদের উপাসনাস্থল অমৃতসর অর্থাৎ অমৃত সরোবরে পৌঁছানোর জন্য গুরুদোয়ারায় গেলেন। সেখানে দেখলেন একটি বৃহৎ পুষ্করনী, যেটি গুরুর রামদাস খনন করিয়েছিলেন। সরোবরের মধ্যে  উপদ্বীপের ন্যায় পাথরের মন্দির। একটা সেতু দিয়ে সেই মন্দিরে প্রবেশ করলেন। একটি বিচিত্র রঙে রেশমের বস্ত্রে আবৃত  স্তুপে গ্রন্থ (গ্রন্থসাহেব) রয়েছে। মন্দিরের একজন প্রধান শিখ তার ওপর চামর ব্যজন করছেন। গায়কেরা গ্রন্থের গান গাইছে। পাঞ্জাবি স্ত্রী পুরুষ মন্দির প্রদক্ষিণ করে কড়ি ও ফুল দিয়ে প্রণাম করে চলে যাচ্ছে। যেকোনো ধর্মের মানুষ এখানে আসতে পারে, শুধু জুতো খুলে আসতে হবে। গভর্নর জেনারেল লর্ড লিটন জুতো খোলেননি বলে শিখরা খুব অপমানিত হয়েছিল। সন্ধ্যায় আবার সেখানে গিয়ে লেখক গ্রন্থের (গ্রন্থ সাহেবের) আরতি দেখলেন। আরতি শেষে সকলকে মোহন ভোগ দেওয়া হল। দোলের সময় এই মন্দিরে বড় উৎসব হয়। 


অমৃতসরে রামবাগানের কাছে যে বাসায় তিনি থাকতেন তা ভাঙ্গা ও জঙ্গলময় ছিল। ভোরে বাগানে বেড়াতে ও দূর থেকে শিখদের সুমধুর সংগীত শুনতে তাঁর খুব ভালো লাগত। বাগানে মাঝে মাঝে ময়ূর আসত। একদিন আকাশে মেঘ দেখে ময়ূর নৃত্য করতে লাগল। লেখক তখন সেই নৃত্যের তালে তালে বীণা বাজালেন। ক্রমে এত গরম পড়ে গেল যে ঘরে আর থাকা যায় না। বাড়িওয়ালা তখন মাটির নীচের ঘরে থাকতে দিল লেখককে। সেই ঘরে পাশ দিয়ে আলো বাতাস আসে ও ঘর খুব শীতল থাকে। কিন্তু লেখক বুঝলেন তিনি মাটির নীচের ঘরে থাকতে পারবেন না। তিনি চান মুক্ত স্থান। তখন তিনি সিমলা যেতে মনস্থ করলেন। 


২০ এপ্রিল ১৮৫৭ সিমলার উদ্দেশ্যে তিনি যাত্রা করলেন। তিনদিনের পথ পেরিয়ে কালকা উপত্যকায় পৌঁছলেন। সামনে পাহাড় দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, এই ভেবে যে আগামীকাল তিনি সেই পাহাড়ের উপর উঠবেন, পৃথিবী ছেড়ে প্রথম স্বর্গের সিঁড়িতে আরোহন করতে। সেই শুরু হলো লেখকের হিমালয় দর্শন ও হিমালয় ভ্রমণ।

                       (চলছে)

বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪

১৩। রাজনারায়ণ বসুর আত্ম-চরিত


 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


রাজনারায়ণ বসুর আত্ম-চরিত ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে কুন্তলিনী প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। 

রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯) একজন ভারতীয় চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, বাগ্মী। তিনি বেশ কিছু অনুবাদ ও স্বতন্ত্র রচনা করেছেন। বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং ঋষি অরবিন্দ ঘোষ তাঁর দৌহিত্র। 

এই আত্মজীবনীটি অসমাপ্তভাবে লেখার পরে তিনি আরো ২৪-২৫ বছর বেঁচে ছিলেন অর্থাৎ ১৮৭৫ সাল নাগাদ এটি লেখা হয়। এই লেখায় শুধুমাত্র ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্য এই আত্মচরিত থেকে নেওয়া হল। 

১৮৪০-এ তিনি হেয়ার স্কুল থেকে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়ার সময়, ১৮৪৩ সালে রামগোপাল ঘোষের (ইয়াং বেঙ্গল গ্রুপের নেতা, ব্যবসায়ী, বাগ্মী, সমাজ সংস্কারক {জন্ম ১৮১৫ - মৃত্যু ১৮৬৮}। তিনি হিন্দু কলেজে পড়েছিলেন এবং সেখানকার ছাত্রদের নেত্রী স্থানীয় ছিলেন) সঙ্গে আলাপ হয়। রাজনারায়ণ বসু সেই বছর পুজোর সময় রামগোপাল ঘোষের সুন্দর ছোট স্টিমার 'লোটাস'- এ করে রাজমহল ও গৌড়ের ভগ্নাবশেষ দেখতে যান। রামগোপাল ঘোষ এর আগে ল্যান্ডর, মুসৌরি প্রভৃতি স্থানে গেছিলেন, যা তখনকার পক্ষে বীরপুরুষের কাজ। এই দুঃসাহসিক যাত্রায় ছেলে অংশ নেবে জানলে মা যেতে দেবেন না বলে রাজনারায়ণ বসু তাঁকে বলেন রামগোপালবাবুর দেশের বাড়ি বাঘাটিতে যাচ্ছেন। পরে পিতা মাকে সত্যি জানাবেন এই পরিকল্পনা ছিল। অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে তাঁরা রামগোপাল বাবুর বাড়ি উপস্থিত হলেন ব্যাগ তখনও ব্যবহার হতো না। তাঁরা প্রত্যেকে এক একটি কাপড়ের মোট নিয়ে স্টিমারে উঠে ত্রিবেনী পৌঁছলেন। আগে ত্রিবেণী, বলাগড়, শান্তিপুর প্রভৃতি স্থান খুব স্বাস্থ্যকর ছিল। লোকে কলকাতা থেকে জলবায়ু পরিবর্তন করার জন্য সেখানে যেত কিন্তু এখন সেগুলি ম্যালেরিয়ার আখড়া হয়েছে বলে লেখক আফশোস করেছেন। বাঘাটি ত্রিবেনীর কাছের একটি গ্রাম। সেখানে ক'দিন গ্রাম্য দুর্গাপূজা দেখে কাটালেন তাঁরা। তারপর মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা করা হলো। দিনগুলি খুব ভালো কাটতো সকালে উঠে চা-বিস্কুট, ডিম। দুপুরে বাঙালি মতে ডাল, ভাত, মাছের ঝোল আর রাতে ইংরেজি বা হিন্দুস্তানি মতে আহার হত। সকাল বিকাল দুই বেলা তাঁরা তীরে নেমে পাখি মারতেন বন্দুক দিয়ে। বঙ্গদেশের অক্সফোর্ড নবদ্বীপ পেরিয়ে বিল্বগ্রামে মদনমোহন তর্কালঙ্কার (কবি, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক, স্ত্রীশিক্ষার জন্য অনেক কাজ করেছেন) এসে যোগ দিলেন। তাঁরা মুর্শিদাবাদের ঘাটে পৌঁছালে সেখানে তাঁদের স্টিমারকে নবাবের মাল বোঝাই বড় নৌকা ধাক্কা মারলে তাঁদের ছোট স্টিমারের ক্ষতি হল। এর ফলে যে বিবাদ, মারামারি হয় তার ফল স্বরূপ মুর্শিদাবাদে থাকা তাঁরা নিরাপদ মনে করলেন না নিরাপদ মনে করলেন না। তখন তাঁরা রাজমহলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। রাজমহলে মুসলমান নবাবদের নির্মিত অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ দর্শন করেন। কাল পাথরের সিংহ দালান, যা নবাবের দরবার ছিল সেটি প্রধান দর্শনীয়। পরে যখন রাজমহল পর্যন্ত রেল হয় তখন এইসব স্থাপত্য বিনষ্ট হয়েছে। তারপর স্টিমারে রাজমহলের পাহাড়ের দিকে গঙ্গার যে খাঁড়ি গেছে তার ভিতরে কিছুদূর গিয়ে পাহাড়িদের নাচ গান উপভোগ করেন। তাঁরা তারপর রাজমহল থেকে মহানন্দা ও পদ্মা নদী দুটি সংগ্রাম সঙ্গমের দিকে যান। রাজমহল থেকে এই পথে জলদস্যুর ভয়ে তাঁরা স্টিমারের ডেকে বসে রাতে পাহারা দিতেন তরোয়াল হাতে। মহানন্দা নদীতে যখন স্টিমার এল গ্রামবাসীরা দল বেঁধে স্টিমার দেখতে এল কারণ তারা আগে কখনো তা দেখেনি। লেখকরা যখন কেউ গ্রামে কিছু জিনিস কিনতে যেতেন তখন গ্রামবাসীরা তাঁদের দেখে ভয়ে পালিয়ে যেত। একদিন মহানন্দার তীরে রাতে নোঙর করে থাকার সময় বাঘের ডাক শোনা গেল। ভোলাহাটে তাঁরা একটি কড়কড়ে পানিতে (ঘূর্ণি বা rapid) পড়ে অনেক কষ্টে উদ্ধার পেলেন। মালদায় পৌঁছে তাঁরা আট ক্রোশ নানা হিংস্র জন্তুতে পরিপূর্ণ নিবিড় বনের মধ্যে দিয়ে হাতির পিঠে করে বন্দুক হাতে নিয়ে চললেন গৌড়নগর-এর ভগ্নাবশেষ দেখতে। গৌড়ে তাঁরা কোতোয়ালীর ভগ্নাবশেষ, দেওয়ানখানার ভগ্নাবশেষ দেখলেন। ভাগ্যক্রমে বাঘ বা কোন হিংস্র জন্তু তাঁদের সম্মুখীন হয়নি। প্রকান্ড কয়েকটি পুস্করিণী দেখলেন, তাতে বড় বড় কুমির ভাসছে। একটি মনুমেন্টের মতো উঁচু মিনার দেখলেন। শুনলেন রাজজ্যোতিষীরা এখান থেকে অনেক আগে নক্ষত্র দেখতেন। 

১৮৪৬ সালে পুজোর সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তিনি উলুবেড়িয়া হয়ে দামোদর দিয়ে নৌকায় বর্ধমানে যান। এই ঘটনা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী পর্বে বর্ণিত হয়েছে। 

১৮৪৭ সালের পুজোর সময় আবার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌকায় রাজনারায়ণ বসু যাত্রা করেন। দেবেন্দ্রনাথের পরিবারও সেবার সঙ্গে ছিল। নবদ্বীপ ও চুপি পার হয়ে পাটুলির কাছে সন্ধ্যায় অস্বাভাবিক এক ঝড় এল। এর মধ্যে ডিঙ্গি করে পত্রযোগে খবর এল দ্বারকানাথ ঠাকুরের ইংল্যান্ডে মৃত্যু হয়েছে। 

১৮৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আসাম প্রদেশ দেখতে যাওয়ার জন্য স্টিমারে গঙ্গাসাগর, বড় সুন্দরবন হয়ে যাত্রা করেন রাজনারায়ণ। সুন্দরবনের খাল দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁরা স্টীমার থেকে দূরবীনে পাড়ে হরিণ চড়তে দেখতেন। এক রাতে বাঘের ডাক শুনেছিলেন। তিনি খাদ্যাভ্যাসে বাঙালি ছিলেন। বিজাতীয় খাবার খেতে খেতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে তিনি ঢাকায় পৌঁছে দেবেন্দ্রনাথের থেকে অনুনয়-বিনয় করে ছাড়া পেয়ে ঢাকার বন্ধুর বাড়ি গিয়ে মাছ ভাত খেলেন। 

পরবর্তীকালে ১৮৬০ সালে পুজোর সময় দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি রাজমহল যাত্রা করেন। তখন রেলপথ খুলেছে কিন্তু তাঁরা নৌকায় যান। কালো পাথরের সিংহদালান (যা রেলের অফিস রূপে ব্যবহৃত হচ্ছিল) ছাড়া আর কোন পুরাকীর্তি অবশিষ্ট ছিল না। 

দেওঘরে পরবর্তীকালে রাজনারায়ণ বসুর পশ্চিমের বাসগৃহ ছিল। ১৮৬৭ সাল থেকে পশ্চিমে বিভিন্ন কাজে সূত্রে বারংবার গিয়ে তিনি ভাগলপুর, এলাহাবাদ, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, কানপুর প্রভৃতি জায়গায় যান। আগ্রায় তাজমহল দর্শন করেন। কানপুরে বিঠুর গ্রামের বাল্মিকী তপোবনে যান। অবশ্য তিনি এই সমস্ত জায়গার কোনো ভ্রমণের বর্ণনা দিয়ে যাননি।

রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

১২। দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভ্রমণ

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


শিল্পোদ্যোগী দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬) দেশে বিদেশে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন। তিনি নিজে কোনো ভ্রমণকাহিনী লেখেন নি কিন্তু বিভিন্ন জনকে লেখা তাঁর কিছু চিঠিপত্র পাওয়া গেছে এবং কিছু চিঠিপত্র তৎকালীন 'ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। 

১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য পশ্চিম সফরে বেরিয়েছিলেন। তিনি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে ঘোড়ার গাড়িতে গেছিলেন। সঙ্গে বন্যপ্রাণী ও ডাকাতের আশঙ্কায় অনেক সশস্ত্র পাইক-বরকন্দাজ এবং চাকর, বেয়ারা, খানসামা, বাঙালি কবিরাজ, ইংরেজ ডাক্তার নিয়েছিলেন। এই ভ্রমণের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যের জন্য বাজার দেখতে যাওয়া। 

প্রথমে তিনি রানীগঞ্জের কয়লা খনি দেখেন ও ১৮৩৪ সালে সেটি কিনে নেন। তারপর তিনি গেলেন কাশী, সেখানে এমন ব্যবস্থা করলেন যে কাশীর জরি দেওয়া সব বস্ত্র কলকাতা হয়ে ইউরোপীয় নানা দেশের রপ্তানি হতে থাকল। সেখান থেকে তিনি যান এলাহাবাদ, তারপর আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন। এই পর্বের তাঁর ভ্রমণ সংক্রান্ত খবর খুবই কম পাওয়া যায় চিঠিপত্রের অভাবে। 

১৮৩৮ ও ১৮৪০-'৪১ এ তিনি আবার উত্তর-পশ্চিম ভারত ভ্রমণ করেছিলেন মূলত স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য। শুধু জানা যায় তীর্থস্থানগুলিতে তিনি অনেক দানধ্যান করেছিলেন। 

ইউরোপ যাত্রায় তাঁর উৎসাহের কারণ হাওয়া বদল স্বাস্থ্যের কারণে, নতুন দৃশ্য দেখা, ব্যবসার উন্নতির জন্য জনসংযোগ। ১৮৪২ -এর ৯ জানুয়ারি তাঁর নিজস্ব জাহাজ 'ইন্ডিয়া' করে তিনি বিলাত যাত্রা করেন। সঙ্গে ছিল ভাগ্নে চন্দ্র মোহন চট্টোপাধ্যায়, এক ইংরেজ ডাক্তার, এক সচিব, তিনজন ভৃত্য ও একজন মুসলমান বাবুর্চি। তিনি এই সময় ডায়েরি রাখতেন, যার থেকে তাঁর জীবনীকার কিশোরী চাঁদ মিত্র অনেক তথ্য ব্যবহার করেছেন তাঁর বইয়ে। কিন্তু সেই ডায়েরী পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

সিংহলে তিনি পাহাড়, গাছপালা শোভিত উপত্যকা, নারকেল গাছের শ্রেণী দেখে অত্যন্ত তৃপ্ত হন এবং স্বর্ণলঙ্কা নামের সার্থকতা উপলব্ধি করেন জমির উর্বরতার কারণে। সিংহলের পয়েন্ট দ্য গালে নোঙর করে স্থলভাগে নেমে তিনি ঘুরে দেখেন। দূরে দেখতে পান আদমের শিখর, যার উপর লোকে বলে কুড়ি ফুট লম্বা পায়ের চিহ্ন আছে। গালে দুর্গ, পোতাশ্রয় দেখেন। তাঁদের জাহাজ নোঙর করতেই সিংহলবাসী ছুটে এল পণ্যদ্রব্য ও ফলমূল বিক্রয়ের জন্য। এই দেশের ঘাট, প্রাসাদ সুন্দর ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ফল বাংলাদেশের তুলনায় বড় এবং রসালো। ফুলের রং বেশি উজ্জ্বল। 


এরপর 'ইন্ডিয়া' জাহাজ সুয়েজ বন্দরে এল। দ্বারকানাথ ও সঙ্গীরা বন্দরে নামলেন, জাহাজ কলকাতায় ফিরে গেল। ঘোড়ার গাড়িতে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তিনি মরীচিকা দেখলেন। মরুভূমির মধ্যে মধ্যে পান্থনিবাস ছিল, যেখানে তাঁরা আশ্রয় নেন। এই দীর্ঘ পথে হাট বাজার, দুর্গ, মসজিদ, প্রাসাদ, উদ্যান, হামাম, পিরামিড প্রভৃতি দেখলেন। সুব্রা হয়ে কায়রো গেলেন তিনি। তারপর স্টিমারে চললেন আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে নীলনদ হয়ে।

আলেকজান্দ্রিয়ায় তিনি দেখেন দেশীয় বসতিগুলি নোংরা ও ঘিঞ্জি। কিন্তু যে অঞ্চলে ইউরোপীয়দের বাস সেটি খুব সুন্দর। হোটেল আরামদায়ক ইউরোপীয় মানের। পাশার নতুন প্রাসাদ (১৮১৪ -তে তৈরি মিশরের শাসক ও আধুনিক মিশরের প্রতিষ্ঠাতা মোহম্মদ আলী পাশার প্রাসাদ) দেখে তিনি মুগ্ধ হন। প্রাসাদের খুব কাছে সমুদ্র তীরে একটি স্নানের জায়গা আছে। সেই ঘরে প্রায় ৬০ ফুট পর্যন্ত সমুদ্রের জল ঢুকে গেছে। ৪ ফুট গভীর সমচতুর্ভুজ একটি ৪০ ফুট চৌবাচ্চায় সর্বক্ষণ সমুদ্রের জল এসে পড়ে তিনদিক থেকে। 

মালটায় তাঁদের কোয়ারেনটিনে থাকতে হল। সমুদ্রের ধারে আরামদায়ক হোটেলে পূর্ণ বিশ্রাম আর পায়ে হেঁটে শহর ঘুরে দেখতে তাঁর ভালই লাগছিল। মালটা থেকে ভালেত্তা গেলেন। সেখানকার গির্জা, ক্যাথিড্রাল অপূর্ব সাজসজ্জা দেখে মুগ্ধ হন, যদিও তিনি জানতেন রোমের স্টেন্ট পিটার্স গির্জার তুলনায় এই সেন্ট জন ক্যাথিড্রল কিছুই নয়। ভারতবর্ষের মন্দির, মসজিদ, চার্চগুলি ইউরোপের এই ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। এখানে তিনি অপেরা দেখেন। তারপর ব্রিটিশ রণতরী 'কুইন' দেখে আসেন। একটি শিশু বিদ্যালয় দেখে মনে করেন এই শিক্ষা পদ্ধতি অত্যন্ত উন্নত কারণ শিশুদের সেখানে আটকে রাখা হয়নি, তারা নিজেরাই সেখানে থাকতে ভালোবাসছে। মালটা দ্বীপের সর্বোচ্চ স্থান থেকে বহুদূর পর্যন্ত এমনকি সিসিলি দ্বীপের মাউন্ট এটনা পর্যন্ত দেখা যায়। 


এরপর সিসিলি দ্বীপে মাউন্ট এটনা, সুন্দর শহর মেসসিনা, এওলিয়ান দ্বীপ, স্ট্রম্বেলি আগ্নেয়গিরি দেখে তিনি নেপলস গেলেন। এই শহরে সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ হলেন। খুব চওড়া রাস্তা, ধুলোবালি নেই, রাতে গ্যাসের আলোয় দোকান আলোকিত বলে রাস্তা ঝলমল করে, কফি হাউসগুলি খুব সুন্দর করে সাজান। সান কার্লো থিয়েটার হল ইউরোপের সবথেকে বড় থিয়েটার, তার অভ্যন্তরীণ সাজ সজ্জা অনবদ্য। 

এবার তিনি চললেন রোমে। এই যাত্রা করেছিলেন নিজের চার ঘোড়ার গাড়িতে, যার ঘোড়া প্রতি দশ মাইল অন্তর পরিবর্তন করার ব্যবস্থা ছিল। দ্বারকানাথ কখনো হিমালয়ে যাননি। পাহাড়ি পথ পেরতে তিনি রোমাঞ্চিত, আনন্দিত ও অল্প শঙ্কিত হচ্ছিলেন। রোম শহরের সৌন্দর্য নিজে চোখে না দেখলে বোঝা সম্ভব নয় বলেছেন তিনি। সেন্ট পিটার্স চার্চের বিশালত্ব, সাজসজ্জা, বৈচিত্র্য, শিল্প, স্থাপত্য দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তাছাড়া আরো অনেক প্রদর্শনশালা, চিত্রকলা, ফোয়ারা, গ্রন্থাগার প্রভৃতি দেখেন। সেখানকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া তিনি খুব উপভোগ করেন। তিনি এবার পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পোপের প্রাসাদে। প্রথম একজন ভারতীয়কে দর্শন করে আনন্দ প্রকাশ করেন। তাঁদের সাক্ষাৎ হয় একটি গ্রন্থাগারে, সেটি এত বড় যে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখা শক্ত। তিনি শুনেছিলেন পোপের প্রাসাদে বারো হাজার ঘর আছে, সেগুলি মহান শিল্পীদের চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে সুসজ্জিত। 


এরপর ফ্লোরেন্স, বোলোনা, পাদুয়া হয়ে তিনি ভেনিসে গেলেন। ভেনিসে রাস্তায় সর্বত্র জল দেখে অবাক হলেন। আল্পসের সৌন্দর্যে মোহিত হলেন। 

জার্মানির মধ্যে দিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঘোড়ার গাড়িতে চললেন। জার্মানির শিক্ষার মান দেখে প্রশংসা করেছেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে রেলে মেনটস গেলেন। সেখান থেকে ভাসমান সেতুতে রাইন নদী পার হয়ে স্টিমারে কোলন যান। সেখানকার ক্যাথিড্রাল ভালো লাগে তাঁর। 

এরপর রেইনবো নামের স্টিমারে ইংলিশ চ্যানেল পার হন তাঁরা। ডোভার ও ক্যান্টারবেরি হয়ে তিনি ১০ জুন (কলকাতা ছাড়ার পাঁচ মাস দুই দিন পর) লন্ডনে পৌঁছান। 

লন্ডনের নগরজীবনের প্রাণচাঞ্চল্য, যানবাহন, দোকান এবং শহরের মানুষরা তাঁকে আলোড়িত করেছিল। রাজপরিবার ও অভিজাতরা তাঁর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলেন। এখানকার অভিজাতদের বাগান দেখে নিজের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির বাগান সম্পর্কে তিনি হতাশা প্রকাশ করেছেন। মহারানী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক তিনি আমন্ত্রিত হন তিনি। সেখানকার জগৎ বিখ্যাত সাহিত্যিক ওয়াল্টার স্কট, চার্লস ডিকেন্স প্রমুখের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। 

এরপর তিনি স্কটল্যান্ড বেড়াতে গেলেন। সেখানকার গ্লাসগো, এডিনবরা দেখলেন। ইংল্যান্ডের লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, শেফিল্ড গেলেন। এইসব স্থানের শিল্পপ্রযুক্তির বিষয়ে তিনি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। 

এবার তিনি গেলেন ব্রিষ্টল এবং রাজা রামমোহন রায়ের জঙ্গলাকীর্ণ সমাধি থেকে তাঁর দেহাবশেষ স্থানান্তরিত করে আর্নোস ভেলে ভারতীয় স্থাপত্যে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। 

১৫ই অক্টোবর ১৮৪২ জাহাজে উঠে তিন দিন পরে তাঁরা প্যারিস পৌঁছান। তিনি প্যারিসকে সৌন্দর্য ও প্রাণোচ্ছলতায় পূর্ণ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার তীর্থ হিসেবে বর্ণনা করলেন তিনি। প্যারিসের প্রবেশপথ এবং প্যারিসের আলোকোজ্জ্বল সৌন্দর্যে তিনি বিমুগ্ধ হন। ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ তাঁকে আপ্যায়ন করেছিলেন। 

১৮৪২ -র ৯ অক্টোবর স্বদেশে ফেরার জন্য দ্বারকানাথ মার্সেই থেকে রওনা দেন। কলকাতায় এসে পৌঁছান ডিসেম্বর মাসে, প্রায় এগারো মাস বিদেশে কাটানোর পরে। 


দ্বারকানাথের দ্বিতীয়বার বিদেশ সফর শুরু হয় ১৮৪৫ এর ৮ই মার্চ কলকাতা থেকে 'বেন্টিংক' জাহাজে। এবার সঙ্গে ছিল ১৬ বছর বয়েসি কনিষ্ঠ পুত্র নগেন্দ্রনাথ, ভাগ্নে নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ব্যক্তিগত ইংরেজ চিকিৎসক, প্রাইভেট সেক্রেটারি, তিনজন ভৃত্য। 

এবার কায়রোতে ওটোমান সাম্রাজ্যের ভাইসরয় ও মিশরের শাসক মোহম্মদ আলী পাশা তাঁকে খুব সমাদর করেন। 

নেপলস্ বন্দরে তাঁর জাহাজ পৌঁছালে তাঁকে তোপধ্বনিতে আহ্বান জানান হয়। এরপর পিসা, জেনোয়া হয়ে প্যারিস যান তিনি। 

ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ প্রায়ই তাঁকে রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ করতেন। লন্ডনে তিনি রানীর কাছে আমন্ত্রণ পান এবারও। পরে প্যারিসে বেশ কিছুকাল কাটিয়ে লন্ডন ফেরেন। 

উশৃঙ্খল আমোদপ্রমোদময় জীবনযাপন ও বিশ্রামের অভাবে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। অমিতব্যয়িতার কারণে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। 

অবশেষে, আগস্ট ১৮৪৬ -এ লন্ডনের সেন্ট জর্জেস হোটেলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ভারতীয় রাজকীয় পোশাক আর অসম্ভব দানশীলতা তাঁকে প্রিন্স হিসেবে লন্ডন ও প্যারিসবাসীর মধ্যে পরিচিত করেছিল। কেনসাল গ্রীনের সমাধিক্ষেত্রে তাঁর দেহ সমাহিত হয় যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে। যদিও তাঁর সমাধিটি তাঁর বর্ণময় জীবনের তুলনায় অত্যন্ত সাধারণ। 

তথ্যসূত্র: Memoir of Dwarakanath Tagore - কিশোরীচাঁদ মিত্র (১৮৭০)

শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

১১। রাজা রামমোহন রায়ের ভ্রমণ

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


নবযুগের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২ - ১৮৩৩) তাঁর জীবনকালে বেশ কিছু ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু তিনি কোন ভ্রমণ কাহিনী লেখেন নি। তবে তাঁর লেখা চিঠিপত্র থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায় এবং তাঁর জীবনীকারেরাও সেই সব তথ্য দিয়ে গেছেন। তাই রাজা রামমোহন রায়ের ভ্রমণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য না পাওয়া গেলেও কিছু তথ্য পাওয়া যায় যা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। 

মাত্র ষোলো বছর বয়সে রাজা রামমোহন রায় "হিন্দুদের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী" নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই উপলক্ষে পিতার সঙ্গে তাঁর সংঘাত হয়েছিল এবং তিনি গৃহত্যাগ করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। এই দেশভ্রমণ কালে তিনি সেইসব স্থানের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার জন্য বিভিন্ন ভাষা শিখেছিলেন। এর আগে তিনি সংস্কৃত ও পারসী ভাষায় দক্ষ ছিলেন। ভারতের ঠিক কোথায় কোথায় তিনি গিয়েছিলেন তা জানা যায় না। 


অবশেষে সেই কিশোর বয়সে কিশোর রামমোহন হিমালয় পার হয়ে তিব্বতে যান। প্রধানত বিদেশী শাসকের প্রতি ঘৃণার কারণে ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার উদ্দেশ্যে তিনি তিব্বত গেছিলেন। নিঃসম্বল কিশোরটি কী অসম্ভব কষ্ট করে, এতদিন পূর্বে, কত দুর্গম পথ অতিক্রম করে তিব্বতে পৌঁছেছিল তা অভাবনীয়। তিব্বতে গিয়ে তিনি দেখেন লামারা সেখানে অবতারের স্থান নিয়েছেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম পৌত্তলিকতা ও অন্য নানা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে পড়েছে। তিনি প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেখানকার মানুষদের বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন। কিন্তু কোমল হৃদয় মহিলারা তাঁকে বারবার উদ্ধার করেছেন। তিনি পরে বলেন যে তিব্বতি মহিলাদের এই সস্নেহ ব্যবহার তাঁকে নারীদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল করেছিল। তাঁর এই কিশোর বয়েসের ভ্রমণ সম্পর্কে তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'সংবাদ কৌমুদী' পত্রিকায় তিনি পরে লিখেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই সব লেখা পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 



ইউরোপীয়দের ধর্ম, রাজনীতি, আচার ব্যবহার স্বচক্ষে দেখে জ্ঞানলাভ করার জন্য বিলাত যাত্রায় রামমোহন আগ্রহী ছিলেন। কিন্ত বিলেত যাত্রার প্রয়োজনীয় অর্থ তাঁর ছিল না। সেই অর্থসমস্যা সমাধান হয় যখন দিল্লির বাদশা দ্বিতীয় আকবর শাহ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক কিছু অধিকার থেকে চ্যুত হওয়াতে ইংল্যান্ডের রাজ দরবারে আবেদন করার জন্য রামমোহন রায়কে প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করতে চান। এছাড়া তাঁর বিলাত যাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন সনদের বিচারে উপস্থিত থাকা। এই সনদের দ্বারা ভারতবর্ষে আগামী দিনে দীর্ঘ কালের জন্য ভারতীয়দের প্রতি ব্যবহারের নীতি নির্ধারণ হবে। সতীদাহ বিষয়ক প্রিভি কাউন্সিলে আপিলের শুনানি হওয়ারও কথা ছিল। রামমোহন রায়ের বিদেশ যাত্রার পূর্বেই তাঁর কীর্তির খ্যাতি ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইংল্যান্ড যাত্রার পূর্বে বাদশা আকবর শাহ্ (দ্বিতীয়) তাঁকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন।   


১৮৩০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজা রামমোহন রায় তাঁর পালিত পুত্র ১২ বছরের রাজা রাম এবং ভৃত্যদ্বয় রামরত্ন মুখোপাধ্যায় ও রামহরি দাসকে নিয়ে অ্যালবিয়ান নামক জাহাজে বিলাত যাত্রা করেন। দুধপানের সুবিধার জন্য সুবিধার জন্য জাহাজে তিনি দুটি দুগ্ধবতী গাভী নিয়ে যান। কোন সমুদ্র পীড়া তাঁর হয়নি কিন্তু তাঁর সঙ্গীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি পথে উত্তমাশা অন্তরীপে নেমেছিলেন। 


১৮৩১ সালের ৮ ই এপ্রিল চার মাস তেইশ দিনে জাহাজ গন্তব্য লিভারপুলে পৌঁছায়। এপ্রিল মাসের শেষে তিনি রেলপথে লিভারপুল থেকে লন্ডনে যান। পথে সুন্দর বাড়ি ঘর, উদ্যান, সেতু, কৃত্রিম হ্রদ-খাল প্রভৃতি দেখে বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় তিনি খুব আনন্দ পান এবং ভারতবর্ষের দারিদ্র্যের কারণ উপলব্ধি করেন। পথে তিনি ম্যানচেস্টার শহরে যান এবং সেখানকার কারখানা দেখে ও কারখানায় নারী পুরুষকে কাজ করতে দেখে আনন্দিত হন। দরিদ্র স্ত্রী পুরুষরা ভারতের রাজা এসেছে শুনে কাজ ছেড়ে তাঁকে দেখতে ভিড় জমায়। 


ইংল্যান্ডের সর্বত্র ও লন্ডনে বিখ্যাত জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা তাঁর সঙ্গে এসে দেখা করেন। তাঁর বিপুল খ্যাতি আরো সুদূর প্রসারী হয়। লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁর সম্মানে ভোজসভা অনুষ্ঠিত করেছিল। 

১৮৩২ এর শরৎকালে তিনি ফ্রান্সে যান। সঙ্গী হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট মানবহিতৈষী ডেভিড হেয়ারের এক ভাই। ফ্রান্সের সম্রাট লুই ফিলিপ তাঁকে আমন্ত্রণ করে একত্রে ভোজন করেছিলেন। 


১৮৩৩ -এর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ব্রিষ্টল আসেন। লন্ডনের তুলনায় শান্ত শহরটিতে এসে তাঁর ভালো লেগেছিল। কিন্তু অসুস্থ হয়ে সেখানেই ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ তিনি দেহত্যাগ করেন।
স্টেপলটন গ্রোভের কাছে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়েছিল। তাঁর বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুর পরে বিলেতে গিয়ে সেই হতশ্রী সমাধি থেকে তাঁর দেহাবশেষ স্থানান্তরিত করেন আর্নোস ভেলে এবং ভারতীয় স্থাপত্যে সুন্দর সমাধিটি তৈরি করিয়ে দেন।

তথ্য সূত্র: মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় - নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (১৮৮২)।

বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০২৪

১০। তীর্থ মঙ্গল ৫ বিজয়রাম সেনবিশারদ

      সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                        ---- সুমনা দাম 

              (আগের পর্বের পরে)

এবার ফেরার পালা। প্রথমে ফতুয়ার উদ্দেশ্যে সবাই রওনা দিলেন। নৌকা জুড়াগ্রাম, গাজীপুর হয়ে মুরদপুরে রাত্রিবাস। সেখানে আছেন লিঙ্গদেব রামেশ্বর, যা শ্রীরামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত বলে কবি বলেছেন। ভোজপুরের অধীনস্থ অর্জুনপুরে রাত্রিবাস। শোন নদী বামে রেখে আর ডানে গঙ্গা - এর মধ্যে দিয়ে নৌকা চলল। সেরপুর, দানাপুর (এখানে ইংরাজের কেল্লা অর্থাৎ ছাউনি রয়েছে) হয়ে নৌবহর পাটনায় পৌঁছালো। অনেক যাত্রীকে কর্তা টাকা দিয়ে বাড়ি পাঠালেন ও নিজে মাস খানেক পাটনায় থাকলেন।


কাশী থেকে খিদিরপুর (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে, উল্লেখ্য যে সেই ভ্রমণটি হয়েছিল নদীপথে)


তারপর পালকি করে কর্তা ফতুয়া গেলেন। ফতুয়া থেকে আবার নৌকা যাত্রা। মুনসিকে কর্তা এখানে বিদায় দিলেন। দূরে গৌরীশংকর পাহাড় দেখা গেল। চৌকিঘাটা, দরিয়াপুর, সূর্যগড় হয়ে নৌকা মুঙ্গের এলো। সীতাকুণ্ডে গিয়ে সবাই পুজো দিলেন। তারপর জাংগিরা, সুলতানগঞ্জ হয়ে পাহাড়ের ওপর বটেশ্বর শিব দর্শন করলেন। ভাগলপুর, চম্পা নগর, সুজাগঞ্জ হয়ে পাথরঘাটায় নৌকা এলো। রাত্রি বাস হল পীরপৈতিতে। তেলিয়াগড়ী, সকরিগলি হয়ে রাজমহলে রাত্রি বাস। এরপর নৌকা চলাকালীন জলে তুফান দেখে ভয়ে নদীর পাশে কাশবনে নৌকা ভিড়িয়ে রান্না হল। কাদা জলের মধ্যে বাঘের ডাক শুনতে শুনতে রান্না ও খাওয়া হলো। নৌকা আবার চলল। খেজুরিয়া, সুতী হয়ে দক্ষিণমুখী হয়ে নৌকা চলতে লাগলো। সাহেবঘাটা এলো, সেখানে পীরজাদা সাহেব আছেন। পীরজাদা সাহেব এক মুসলমান ফকির। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাঁর কাছে যেত। পারসী ভাষা ব্যবহার করে কবি বলেছেন যে তাঁর বড়ই বারগা অর্থাৎ মাহাত্ম্য। এরপর ফতুল্লাপুর অর্থাৎ ফতেউল্লাপুর, দুর্গাপুর, জঙ্গিপুর, লক্ষ্মীপুর হয়ে মকুসুদাবাজ অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ এল। সাধকবাগে স্নান খাওয়া করা হলো। পশ্চিম পাড়ে হিরাঝিল, সেঠের বাগান। পরদিন কিরিটেশ্বরী পূজা দিতে গেল সবাই। এবার বামে মঙ্গলটুলি নবাবের বাড়ি রেখে নৌকা চলল। ডানে সাঁইকুলী আর ডাহাপাড়া পেরিয়ে কাশিমবাজার এল নৌকা। কাশিম বাজার বড় শহর, বড় বড় মানুষের বাস। সয়দাবাজ অর্থাৎ সৈয়দাবাদ, খিদিরপুর, চুমরিগাছা, শ্রীশ্যামনগর, পলাশী হয়ে কাটোয়ায় নৌকো এলো। ডানে বারবাজার, বামে মাটিয়ারী। রঘুনন্দন মিত্রের দ্বাদশ শিব মন্দির। তারপর দাই, বুড়ারানীর ঘাট, মানিকচন্দ্রের ঘাট হয়ে ক্রমে অগ্রদ্বীপে নৌকা এলো। সেখানে চৈতন্যদেবের শিষ্য গোবিন্দ ঘোষ ঠাকুরের বাড়ীতে শ্রী চৈতন্যদেব প্রতিষ্ঠিত গোপীনাথ ঠাকুরের মন্দির। কিন্তু গোপীনাথ রাজা নবকৃষ্ণের বাড়িতে (কলকাতার শোভাবাজারের রাজবাড়িতে) আছেন তাই যাত্রীরা দর্শন করতে না পেয়ে আক্ষেপ করল। কাশীপুর, ঘোড়াইক্ষেত্র, গোটপাড়া এল। সিকিরাগাছি, বালডাঙ্গা, মেড়তলা হয়ে নৌকা নবদ্বীপ এলো। সেখানে নাকি সতেরোশ ব্রাহ্মণ আছে, অধ্যাপকও অনেক। তেমোহনি দিয়ে নৌকা পড়ে খরড়ার জলে। গোকুলগঞ্জের ঘাট হয়ে শান্তিপুর এলো। ক্রমে ক্রমে গুপ্তিপাড়া, ফুল্যা-নবলা, হরধাম, সোমড়া, চাকদহ, জিরাট, কাঁচরাপাড়া, হালিশহর, ত্রিবেনী, বাঁশবেড়িয়া, হুগলি, চুঁচুড়া, ফরাসডাঙ্গা,গৌরহাটি, নিমাই তীর্থ ঘাট, মুনিরামপুর, দীঘাঙ্গ, মাহেশ (এখানে জগন্নাথ দেব আছেন, যাত্রীরা নৌকা থেকে নমস্কার জানালো), কোন্নগর, আগরপাড়া, সুকচর (এখানে দামামায় সাড়া দিল কারণ এখানে দেওয়ানজির গ্রাম), বালি, বরানগর, চিৎপুর হয়ে কলিকাতা শহর পৌঁছাল। এভাবে খিদিরপুর গঙ্গার ঘাটে নৌকা এলো। যাত্রা শেষ হলো। বহু লোক শুধু তীর্থযাত্রীদের দর্শনে পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যেই এলো। কর্তা ধুমধাম করে তীর্থশ্রাদ্ধ করলেন। এভাবেই কবি বিজয় রামের তীর্থ মঙ্গলকাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটলো



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪

৯। তীর্থ মঙ্গল ৪ বিজয়রাম সেনবিশারদ


         সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                      ---- সুমনা দাম 

               (আগের পর্বের পরে)

গয়াতে অনেক যাত্রী এসে কর্তার সঙ্গী হলেন। এবার ঘোষাল মহাশয় কাশী যাবেন বলে মনস্থ করেছেন। ঘোষাল মহাশয়ের সঙ্গী হয় মহারাষ্ট্র, কুরুক্ষেত্র, উড়িষ্যা, ঢাকা আদি বঙ্গদেশের যাত্রীরা, আগে পিছে পাহারায় এভাবে টিকারী রাজ্যে এলেন। সেখানকার রাজা ছিলেন সুন্দর সা, যাঁকে মীরকাসীম হত্যা করেছিলেন। তাঁর বাড়িতে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হল। থাকার জন্যে দেওয়া হলো বড় বড় ঘর, গালিচা পাতা। কোচগ্রাম হয়ে, ধরারার অপূর্ব বাগিচা দর্শন করে, সামনে আদি গঙ্গা দেখে যাত্রীরা জলস্পর্শ করেন। শোন নদী পড়ল পথে। এবার এলো সরসরা (সাসারাম)। কবি বলেছেন এই জায়গাতে হরিশ্চন্দ্রের বাড়ি। পুরাণে হরিশ্চন্দ্রের পুত্র রোহিতাশ্বের নাম থেকে শোন নদীর ওপর রোহিতাশ্বগড় বা রোহতাসগড় নামক পর্বতের নাম হয়েছে বলে কবি এই স্থানকে হরিশ্চন্দ্রের বাড়ি বলেছেন। এছাড়া বলেছেন যে এখানে অরঙ্গ পাৎসার গোড় আছে মানে আওরঙ্গজেবের কবর আছে। আসলে দিল্লির সম্রাট শেরশাহের কবর এখানে আছে। তার অপূর্ব নির্মাণ দেখে যাত্রীরা মুগ্ধ হয়।


কাশী থেকে বিন্ধ্যাচল, চুনার হয়ে কাশী ফেরা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে, উল্লেখ্য যে সেই ভ্রমণটি হয়েছিল নদীপথে)


কর্মনাশা নদীতে যাত্রীরা দুই তিন পয়সা দিয়ে মানুষের কাঁধে চেপে পার হল কারণ প্রচলিত ধারণা ছিল যে জন্ম থেকে যত ধর্ম-কর্ম করা হয় সেই নদীর জল স্পর্শ করলে নাকি সব নষ্ট হয়ে যায়। এবার মোগলসরাই পার হলো। দূরে বেণী মাধবের ধ্বজা দেখতে পাওয়া গেল। দুলভীপুরের বাগিচায় রাত্রি বাস হল।


কাশীর উত্তরভাগে বরণা নদী আর দক্ষিণ ভাগে অসি নদী। কাশীর বসতি অর্ধচন্দ্রাকারে রয়েছে। নদীতে সবাই স্নান ও তর্পণ করল। নৌকা কাশীর বাঙ্গালীঘাটায় অর্থাৎ বাঙালিটোলায় রাখা হল। বিশ্বেশ্বর শিব, অন্নদা দেবীর পূজা করে ও দক্ষিণা দিয়ে, মনিকর্ণিকা ইত্যাদি পঞ্চতীর্থ স্থানে তর্পণ দিয়ে এল সবাই। 


এবার যাওয়া হবে প্রয়াগ। মোহনসরাই, মহারাজগঞ্জ, মাধব সরাই, গোপীগঞ্জ, জগদীশসরাই, কুচ, ঝু্চি (ঝুসী) হয়ে গৌতম আশ্রম ও যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞকুন্ড দেখে যাত্রীরা গঙ্গা পার হলেন। যমুনা গঙ্গাতে স্নান করে প্রয়াগ দর্শনে গেলেন। গঙ্গাতীরে পিণ্ডদান, ব্রাহ্মণ বিদায় করলেন। বেণীমাধব দর্শন ও পঞ্চতীর্থতে পুজো দিয়ে প্রয়াগের কেল্লা দর্শন করলেন। অক্ষয় বট দর্শন হলো। দশাশ্বমেধ ও ভরদ্বাজ আশ্রম দর্শন করলেন। এরপর কিছু সঙ্গী বৃন্দাবন গেল। ঘোষাল মহাশয় কাশী ফিরে চললেন।


নৌকা পথে বিন্ধ্যাচলের বিন্ধ্যবাসিনীর কাছে এসে দেড় ক্রোশ পথ পেরিয়ে পাহাড়ের ওপর বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর পূজা দিলেন বলিদান সহ। মৃজাপুর মানে মির্জাপুর, চন্ডাল গড় বা চুনার হয়ে কাশীতে এলেন। মহা ধুমধাম-এর সঙ্গে পূর্বপুরুষ (পিতা) কন্দর্প ঘোষালের নামে শিব প্রতিষ্ঠা করলেন ঘোষাল মহাশয়। কন্দর্পেশ্বর নাম হলো সেই শিবের। এরপর বিশ্বনাথ, অন্নপূর্ণা, কালভৈরব, কেদারেশ্বর, বিশ্বেশ্বর, তিলভাণ্ডেশ্বর প্রমুখ সকল দেবদেবীর পূজা করলেন। দুর্গাকুণ্ড সহ যত কুণ্ড আছে সব কুন্ডে স্নান করলেন। কাশীর ব্রাহ্মণ যেন দেবতার মত, অপূর্ব বস্ত্র পরিহিত, কপালে চন্দন, মধ্যে রুলির দাগ। উজ্জ্বল মূর্তির নারীরা যেন বিদ্যাধরী, গজেন্দ্র গামিনী , তাদের লজ্জা ভয় নেই। কাশীতে রানী ভবানী যে কীর্তি রেখে গেছেন সেরকম কেউ করেননি বলে কবি মন্তব্য করেছেন। কত বড় বড় বাড়ি করে, বছরের খরচ দিয়ে বিতরণ করেছেন, কত দেবালয় করেছেন, যে যা চায় তাই পায় এমন ব্যবস্থা। মাধবের ধ্বজা আছে গঙ্গার ধারে, ২০০ হাত উঁচু। সুন্দর পাকে পাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। এক পয়সা করে দিয়ে যাত্রীরা উঠে বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পায়। 


এবার কিছু যাত্রীকে কর্তা টাকা দিয়ে বিদায় দিলেন। তারা নিজের নিজের বাড়ি চলে গেল। কর্তা সহ অনেকের মসূরিকা অর্থাৎ বসন্ত রোগ হতে থাকলো, দেখে কর্তা দেশে ফিরতে উদ্যোগ নিলেন। সঙ্গের বৈদ্য, বিজয়রাম সেনবিশারদ (তীর্থ মঙ্গলের লেখক) কর্তাকে সুস্থ করে তুললেন। অতঃপর ঘোষাল মহাশয় কাশীর রাজা বলবন্ত সিংহের সঙ্গে তাঁর রাজবাড়ী, কাশীর অপর পাড়ে শ্রীরামনগরে দেখা করতে চললেন, অসী খাল পথে দশটি নৌকা করে। অপূর্ব রাজবাড়ী দেখে সবাই খুশি। কর্তা রাজার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করলেন।

                     (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

৮। তীর্থ মঙ্গল ৩ বিজয়রাম সেনবিশারদ


                  

       সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                       ---- সুমনা দাম 

           
             (আগের পর্বের পরে)

ঘোষাল মহাশয় সহ নৌযাত্রীরা আবার এলেন ফতুয়াতে, যেখানে পুনপুনা নদী গঙ্গায় এসে মেশে। সেখানে কর্তা ও সকলে শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করে পিণ্ডদান করেন। কর্তার আজ্ঞায় সকলে সিদ্ধ চাল ও পান গুয়া, মানে পান সুপারি পরিত্যাগ করলেন। এরপর তাঁরা এলেন হিলসা শহর, সেখানে সুন্দর বাগান ছিল। সেখানে তাঁরা থাকলেন। রোদ এড়াতে এখন ঘোষাল মহাশয় রাতে নৌযাত্রা করছেন। এরপর ইছালমপুর মানে ইসলামপুর। খুব সুন্দর শহর। এখানে মানুষ  ইঁদারার জল খায়। রাতে নৌযাত্রা করে ভোরে গয়া পৌঁছলেন তাঁরা। পালকি, ঘোড়া করে কর্তা সবাইকে নিয়ে চললেন। পথে বিভিন্ন চৌকিতে টাকা দিতে হয় কর্তার, যেসব টাকা নাকি পান মাধবরাম নামের ধনী ব্যক্তি। কর্তা রইলেন রাজা রামনারায়ণের বাগান বাড়িতে। সেদিন গয়ার বিভিন্ন বিশিষ্ট লোক এসে কর্তার সঙ্গে দেখা করলেন। তাদের কাছে ফল্গু নদী, সুউচ্চ পর্বত ইত্যাদি বিষয়ে জানা গেল। গয়ার নারীরা পরমা সুন্দরী, তারা গজেন্দ্র গমনে ধীরে ধীরে চলে। সবাই সংযম পালন করলেন এখানে সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে। এখানে পাপকর্ম করলে নরকে যেতে হবে। এবারে ঘোষাল মহাশয় সব যাত্রীসহ চললেন গয়া শ্রাদ্ধ করতে। গয়ার পুরোহিতদের সাহায্যে দান ধ্যান করে ফল্গু তীরে ব্রাহ্মণদের ফলাহার ও দক্ষিণাদান করে ফকির ও বৈষ্ণবদের এক পয়সা করে দিয়ে শ্রাদ্ধসম্পন্ন হয়। পরদিন রামশীলা ও কাক বলি দর্শন। আকাশ প্রমাণ উঁচু রামশীলাতে উঠে সবাই পিণ্ড দিল। পর্বত চূড়ায় শ্রী রামের মূর্তিতে প্রণাম করে রাম হ্রদে পিণ্ড দিয়ে কাকবলি হয়ে সবাই ফেরে।



ফতুয়া থেকে গয়া (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে, উল্লেখ্য যে সেই ভ্রমণটি হয়েছিল নদীপথে )


পরের দিন ফল্গু নদীতে স্নান করে প্রেতশীলা দর্শনে সবাই যান। সেখানে পিণ্ডদান করে নেমে ব্রহ্মকুণ্ডে তর্পণ করে কর্তা জল পান করেন। গরমে অস্থির হয়ে বাসায় ফিরে সবাই দই, প্যাড়া দিয়ে জল খান। গয়ার মত প্যাড়া কোথাযও নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। পরদিন পঞ্চতীর্থে পিণ্ডদান করা হয়। উত্তরমানস, উদীচী, কনখল, দক্ষিণ মানস ও জীবলোল এই হল পঞ্চতীর্থ। এরপর কর্তা পালকি চড়ে ধর্মারণ্যে গেলেন। সেখানে প্রচুর ভিখারি। তারপর চললেন বোধগয়ায়, সেখানে অনেক প্রস্তর নির্মিত দেবমূর্তি আছে। পরদিন ব্রহ্ম সরোবরে স্নান ও তর্পণ দান করে যাত্রী নিয়ে কর্তা চললেন। ব্রাহ্মণ ভোজন করালেন। সকালে বিষ্ণু রুদ্রপদে পিন্ডদান করলেন। দুই দিন ধরে ষোড়শ বেদীতে পিণ্ডদান করে দর্শন করে এলেন। এই ১৬ টি বেদী এই গ্রন্থে কবি যেমন বর্ণনা করেছেন তা হল ব্রহ্মপদ, কার্তিক পদ, সত্য পথ, দক্ষিণাগ্নিপদ, আহবনীয় পদ, চন্দ্রপদ, দধীচি পদ, গণেশ পদ, সূর্যপদ, করণ পদ, মাতঙ্গ পদ, ক্রৌঞ্চ পদ, পঞ্চগণেশ, কাশ্যপপদ, আবাসথ্য, গার্হপত্য, অগস্ত। অষ্টতীর্থ কবি বর্ণনা করেছেন এভাবে - রামগয়া, সীতাকুণ্ড, গয়াশির, গয়াকূপ, মুণ্ডপিঠ, আদিগয়া, ধৌতপদ, ভীমগয়া, গোপ্রচার ও গদালোল। এই অষ্টতীর্থে ঘোষাল মহাশয় পিণ্ড দিলেন। অক্ষয় বটে দানসাগর করেন। পান্ডাকে সোনার গয়না, পাঁচশত টাকা ইত্যাদি দিলেন। অন্যান্য যাত্রীরা সাধ্যমত দিল। পরদিন বিষ্ণুপদে গেলেন ও আট তোলা সোনা দিলেন। গদাধর ও গয়েশ্বরীর পুনরায় পূজা করলেন। মহারাষ্ট্রের পাচক দিয়ে সেদিন রান্না করিয়ে চোদ্দোশ গয়ালী অর্থাৎ গয়ার মানুষকে ভোজন করালেন।

                        

                  (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

রবিবার, ২১ জুলাই, ২০২৪

৭। তীর্থ মঙ্গল ২ বিজয়রাম সেনবিশারদ


                      

       সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                      ---- সুমনা দাম 

          
             (আগের পর্বের পরে)


এর পরবর্তী অংশে এল রাজমহল পাহাড়। রাজমহলের পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ি চোরের উপদ্রব খুব বেশি ছিল। তাই সকলে সতর্ক হয়ে যান এবং নৌকা খুব দ্রুত বেগে চলতে লাগল। বাঁদিকে উদানালা বা উদয়নালার (এখন ঝাড়খণ্ডের উধরা) যুদ্ধস্থল, যেখানে মীর কাসিমের সঙ্গে ইংরেজ সেনাপতি মেজর অ্যাডামসের যুদ্ধ হয়েছিল। তা বামে রেখে নৌকা অতি বেগে ঝাড়খন্ডের রাজমহলে এসে পৌঁছায়। রাজমহল নগর দেখে সবাই অভিভূত হল। কত শত অট্টালিকা, হাট, বাজার, দোকান। পাঁচ ক্রোশব্যাপী শহরে ঘন ঘন ঘর, স্থানে স্থানে ঘড়ি খানা, তাতে সর্বদা নহবত বাজে (সময় নির্দেশক)। ফৌজদার পালকি চড়ে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে এসে ১০০ টাকা নজরানা দিলেন। তবে কৃষ্ণচন্দ্র সেই টাকা নিলেন না। বসিয়ে অনেক আলাপ কথন করলেন। বিভিন্ন যাত্রীরা বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ঘোষাল মহাশয় ঘুরে ঘুরে তাদের সকলের খোঁজ নেন। দুদিন রাজমহলে থেকে আবার যাত্রা শুরু হয়। মেঘের মতো উঁচু পর্বত দেখা যায়। আর পর্বতের ওপর চোহাড় বা চুয়ারদের বাড়ি। তারা সাঁওতাল পরগনার আদিবাসী জাতি। তাদের গলায় হাঁসুলি, কানে কুন্ডল, হাতে বালা, পায়ে মল, হাতে লাঠি। তাদের দেখে যাত্রীরা ভয় পেয়েছিল। এক চৌহার তাদের প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষাল মহাশয় কে প্রণাম করে কলা উপহার দেয়। ঘোষাল মহাশয় তাকে এক টঙ্কা ইনাম দিয়ে মিষ্টি কথাবার্তা বলেন।


রাজমহল থেকে পাটনা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে, উল্লেখ্য যে সেই ভ্রমণটি হয়েছিল নদীপথে )


এরপর নৌকা এলো সকরীগলি। সেখানে একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে গঙ্গা। পরদিন তেল্যাগাড়ি বা তেলিয়াগড়ি বামে রেখে নৌকা চলল। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সিরাজদৌলা নৌকা করে পলায়ন করার সময় রাজমহলের থেকে কিছু দূরে এক গ্রামে এক ফকিরের আশ্রয়ে আসেন। ফকির গোপনে সিরাজের শত্রুপক্ষের কাছে খবর পাঠান। মীরজাফরের ভ্রাতা মীর দাউদ সিরাজ ও তাঁর পরিবারের সকলকে এখানে বন্দী করে। সেই স্থান পেরিয়ে নৌকা চলল। লক্ষ্মীপুর, শ্রামপুর বামে রেখে নৌকা এগোলো, সামনে দেখা গেল বটেশ্বর পর্বত, যা বিহারে অবস্থিত। পাহাড়ের ওপর নানা মন্দির আছে। ঘোষাল মহাশয় সেখানে পূজা দিলেন। মুনির কুটিরে গিয়েও প্রণাম করলেন। তারপর নৌকা এলো পাথরে বাঁধানো ঘাট পাথরঘাটায়। সেখানে রাত্রি বাস। পরদিন পাহাড়িয়া রাজার বাটি কাহলগ্রাম (যা অতি প্রাচীন নগর। এখনো অনেক প্রাচীন নিদর্শন আছে, এখানে বিক্রমশীলা মহাবিহার পরবর্তীতে খনন কার্যে বেরিয়ে এসেছে) তা পেরিয়ে খাগড়ায় রাত্রি বাস করলেন। পরদিন চপকালী, ডহরগড়, ধীরনগর ডানে রেখে ভাগলপুর, সুজাগঞ্জ বামে রেখে শিবগঞ্জে নৌকা থামল। জলপান ও স্নান পূজা সেরে নৌকা আবার যাত্রা শুরু করল। গোপালপুরে (বিহারের) রাত্রি বাস হল। পরদিন নৌকা জাহাঙ্গীরায় অর্থাৎ জাঙ্গীরায় উপস্থিত হল। বামে এক সুন্দর পাহাড় বর্তমান।  ডানদিকে নদীর মধ্যে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে নানা রকম মূর্তি খোদাই করা আছে। পাহাড়ের উপরে গৌরীশংকরের মন্দির আর অনেক সুন্দর অট্টালিকা আছে। নানা উপাচারে কর্তা ও অন্যরা শিবের পূজা করেন। এই স্থানের জল নিয়ে নৌকা চলল বৈদ্যনাথ ধামে পুজো দেওয়ার জন্য। এই স্থান থেকে গঙ্গা উত্তর বাহিনী হল, তাই এখানকার জল পুণ্যজ্ঞানে কর্তা পান করলেন। তারপর বাম দিকের জাঙ্গীরা বা জাহাঙ্গিরা ও ঘোড়াঘাট এবং ডানে কাশীপাড়ার হাট হয়ে নৌকা চলতে থাকলো। দূরে মুঙ্গেরের পাহাড় দেখা গেল। রাতে কোদালিঘাটে থাকা হল। সকালে সাছোঁধন পীরের বাড়ি বামে রেখে নৌকা চলল। সেখানে গুরগুনী সাহেবের ছাউনি ছিল। গুরগুনী সাহেব তথা গুরগিন খাঁ, তথা গ্রেগরি ছিলেন আর্মেনিয়ান। তিনি ও তাঁর ভাই পিদ্রু বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি মীর কাসিমের সেনাপতির পদ পেয়েছিলেন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এই স্থানের পশ্চিমে উষ্ণপ্রস্রবণ সীতাকুণ্ড আছে যা হিন্দুদের তীর্থস্থান। 


শারীগান গেয়ে মাঝিরা নৌকো এগিয়ে নিয়ে চলে। নৌকো মুঙ্গেরের পশ্চিমভাগে উপস্থিত হলে মনোহর মুখার্জি নামক এক ব্যক্তি এসে সকলকে সাদরে তাঁর বাড়ি নিয়ে গিয়ে সে রাতে রাখলেন। পরদিন সবাই মুঙ্গেরের কেল্লা দেখতে গেল। দুই ক্রোশ ব্যাপী পাথরের কেল্লা অত্যন্ত সুন্দর। কেল্লার মধ্যে কত মসজিদ আছে। বহু সেপাই ও তাদের দলপতি পাহারায় রয়েছে। কেল্লার মধ্যে আছে অঙ্গরাজ কর্ণ রাজার স্থান। তিনি নাকি প্রতিদিন সোয়া মণ সোনা দান করতেন। একদিন ত্রিশ মন ঘিতে কড়াই পূর্ণ করে আপন শরীর তাতে ভেজে তিনি নাকি মা কালিকে নিবেদন করেন। মা তাঁর এই প্রসাদ গ্রহণ করেন কিন্তু তাঁকে পুনরায় জীবন দান করেন আশীর্বাদ সহ। কর্ণরাজা এরপর ব্রাহ্মণদের অকাতরে স্বর্ণ বিতরণ করতে থাকেন। রাজা বিক্রমাদিত্য চিন্তিত হন যে এত সোনা কর্ণ কোথায় পান এই ভেবে। তিনি শূদ্র রূপ ধরে আসেন ও বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে কথা বলেন। কর্ণ রাজা তাঁকে একশত টংকা মাহিনা দিয়ে চাকরি দিলেন। কর্ণ রাজার নিদ্রা কালে একদিন বিক্রমাদিত্য একইভাবে কালির পূজা করেন। মা কালী একই রকম ভাবে তাঁকে জীবনদান করেন ও অলৌকিক ক্ষমতা দেন। কর্ণ রাজা ঘুম ভেঙে বুঝলেন যে মা কালী এবার তাঁকে ছেড়ে গেছেন। বিক্রমাদিত্য দুঃখিত কর্ণ রাজাকে বলেন চিন্তা না করতে কারণ তিনি দান করার জন্য যত চান তত স্বর্ণ দেবেন। কর্ণ রাজা বিশ্বাস করলেন না যে বিক্রমাদিত্য কালীর কৃপায় যত খুশি সোনা পাওয়ার ক্ষমতা পেয়েছেন। তারপর বিক্রমাদিত্য তাঁকে সব বলেন ও  তাঁর আসল পরিচয় দেন। কর্ণ রাজা তখন বিক্রমাদিত্যের কাছে ক্ষমা চান। এটি একটি প্রচলিত গল্প। 


পরদিন সফরাবাজ বামে রেখে সিংহনালা, চৌকিঘাটা, সূর্যনালা ছাড়িয়ে নৌকা সূর্য গড় পৌঁছায়। এইবার প্রচন্ড ঝড় ওঠে। যাত্রীরা নৌকা ডুবে যাওয়ার ভয়ে ইষ্ট দেবতার স্মরণ করতে থাকে। কাশীনাথ যেন ভক্ত কৃষ্ণচন্দ্রের আকুল প্রার্থনা শুনতে পান এবং ঝড় থেমে যায়। শঙ্কর মজুমদারের বাড়িতে সেদিন রাতে থেকে পরদিন দরিয়াপুরের বালির চরে রাত কাটানো হল। নৌকা এলো বাড় নামক স্থানে সেখানে ভোলা বরকন্দাজ নামক নৌযাত্রীর বিরোধ হল। কিন্তু সেপাইরা কর্তাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। তারা কর্তার স্তুতি করে ক্ষমা লাভ করল। রাতে সেখানে থাকাকালীন রামানন্দ সরকার এলেন। তিনি বিরোধের কথা শুনে সমুচিত বিচার হবে বললেন। পরের রাতে নৌকা দেবীপুরে আশ্রয় নেয়।


পরদিন বৈকুণ্ঠপুর-এর কাছে গৌরীশঙ্কর দেবতার দর্শন ও পূজা হল। তারপর নৌকা এলো ফতুয়া শহরে বা ফতোয়াতে। এটি গঙ্গা ও পুনপুন নদীর সঙ্গমস্থল ও তীর্থ স্থল। এখানে যাত্রা শ্রাদ্ধ করে গয়া যেতে হত। সেখানকার বাজারে নানা রঙের বস্ত্র বিক্রয় হয়। সেই শহরে রাত্রিবাস হলো। পরদিন নৌপথে রাজা রামনারায়ণ (যিনি নবাব আলীবর্দী খাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু ও পাটনার নায়েব নাজিম ছিলেন। সিরাজদৌলার সময়ও নবাবী সেনার অধিনায়ক ও মীরজাফরের সময়ও তিনি পাটনার নায়েক-নবাব ছিলেন। মীর কাশেমের সময় পাটনায় বন্দী ও নিহত হন।) আর জাফর খাঁর (বাংলার নবাব মুর্শিদ মুর্শিদকুলি খাঁর অপর নাম) -এর বাগান পড়ল। লোনগোলা, রেকাবগঞ্জ, মারুগঞ্জ, আদামট ছাড়িয়ে নৌকা এসে ফরাসের কুটিঘাটে থামল। সবাই পাটনায় উপস্থিত হলো। সেদিন বিষ্ণু সিংহের বাড়িতে সবাই আশ্রয় নিল। অপূর্ব সুন্দর পাকা বাড়ি, বড় বড় ঘর। চার শত যাত্রী সেই কোঠাবাড়িতে রইল। অন্য যাত্রীরা অন্যান্য বাড়িতে রইল। পাটনা বড় বড় বাড়ি হাটবাজার নিয়ে বড় শহর কিন্তু ছোট ছোট নোংরা গলিও ছিল সেই শহরে। কর্তা পাটনার সুবাদার সেতাব রায়ের কাছে ভেট পাঠালেন। সঙ্গে গেল পার্সি-নবীস মুন্সী বিশ্বনাথ। কর্তা অন্যদিন নিজেও সুবেদারের সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন। কর্তাকে সেতাব রায় ঘোড়া,শাল প্রভৃতি উপহার দিলেন। সেতাব রায় ছিলেন আজিমাবাদের সুবেদার বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা। এরপর ঘোষাল মহাশয় কিছুদিন পাটনায় বসবাস করেন। তখন সেখানকার ইংরেজদের অধীনস্থ দেওয়ান শান্তিরাম নানাপ্রকার তত্ত্ব দেন ঘোষাল মহাশয়কে। এবার তাদের সঙ্গী হলেন মনসা রাম যিনি ছিলেন পাটনার প্রধান কুঠিয়াল। তিনি নবাব মীরকাসিমের দ্বারা উৎপীড়িত ও লুন্ঠিত হন।

                                         

                                (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...