সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০২৪

১৭। তীর্থ ভ্রমণ ২ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

      সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                    -------  সুমনা দাম


                   (আগের পর্বের পরে)

এবার নতুন সঙ্গীদের সঙ্গে কাশীর উদ্দেশ্যে গয়া থেকে পদব্রজে লেখক যদুনাথ সর্ববাধিকারী রওনা দিলেন। সঙ্গে কয়েকজন নারী থাকায় পালকি এবং মোষের গাড়িও ছিল। প্রথমে এলো যমুনা গ্রাম (যমুনানগর, বিহার)। এখানে কাশীর গঙ্গাপুত্র পান্ডা বা তার সহকারীরা তাঁদের ধরলেন। তারপর পঞ্চাননপুর (পঞ্চাননপুর, বিহার) হয়ে গো (?) এসে রাত্রি বাস। পরদিন পুনপুনা (পুনপুন, বিহার) গিয়ে রাত্রি বাস। পরদিন দাও নগর (দাউদ নগর, বিহার) হয়ে পড়োড়িতে পোখাড়া, বিহার)  রাত্রি বাস। এইসব স্থানে পথিকদের থাকার জায়গা আছে। পড়োড়ি থেকে আকড়ি (আকোড়িগোলা, বিহার)। সেখানে শোন নদী দেড় ক্রোশ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার চওড়া। সেখানে স্নান করে সরসরামে (সাসারাম) যান। 


সাসারাম পুরনো শহর, সেখানে বাদশাহী সরাইখানা আছে। শহরে নানা জাতির বাস। ডাকঘর, মুনসেফি, রেজিস্টারী কাছারি আছে। দুলিচা, গালিচা, সতরঞ্চের তাঁতিরা জিনিসপত্র নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। এখান থেকে বাড়িতে চিঠি দেওয়া হল। এখান থেকে শিবসাগর সরাই (শিবসাগর, বিহার)। সেখানে স্নান করে জাহানাবাদে গিয়ে (জাহানাবাদ, বিহার) থাকা হলো। জাহানাবাদ থেকে মোহনিয়া (মোহানিয়া, বিহার)। সেখানে সুন্দর পুস্করণী, শিব মন্দির রয়েছে। লোহা ও মনোহারী দ্রব্যের বাজার রয়েছে। উল ও সুতার দুলিচা, আসন বোনার কারিগরদের ঘর রয়েছে। তারা ফরমাস মেনে চার টাকা থেকে ষোলো টাকা গজ দরে উত্তম গালিচা বানাচ্ছে। এখান থেকে লেখকেরা এলেন কর্মনাশা নদী তীরে । এই নদীর জল স্পর্শ করার বিষয়ে শাস্ত্রে নিষেধ আছে। স্পর্শে সকল কর্ম নাশ হয়। আগে এই নদীতে পোল ছিল না। নীচু জাতের মানুষেরা পার করে দিত, তাতে মানুষের কষ্ট হতো। এখন কোম্পানি বাহাদুর এখানে পোল করে দিয়েছেন। এখানে বাজার, দোকান, অনেক বসতি আছে। তাঁরা এবার জগদীশের সরাই (?) নামক স্থানে গিয়ে থাকলেন। সেখান থেকে দুলাইপুর (দুলহিপুর, উত্তর প্রদেশ) গেলেন  সেখানে সরাই আছে। সরাইয়ে রাত্রি বাস। দুলাইপুর থেকে বারাণসী অর্থাৎ কাশী তিন ক্রোশ।




 
      গয়া থেকে কাশী (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে কাশী অবস্থিত। অত্যন্ত সুন্দর, সুবর্ণময় এই কাশীপুরী অতি মনোরম স্থান। দক্ষিণে অসি, উত্তরে বরুণা নদী। এখানে অনেক পারঘাট আছে। আনন্দ কানন, গৌরীপীঠ, মহাশ্মশান, উত্তর বাহিনী গঙ্গা, চক্রতীর্থ, মণিকর্ণিকার জন্য কাশী প্রসিদ্ধ। দশাশ্বমেধের শীতলা ঘাটে পার হয়ে ইতালি নিবাসী তারাচাঁদ দেবের বাড়িতে সকলের থাকা হল। সেই দিন তীর্থ উপবাস করে সন্ধ্যায় বিশ্বনাথের দর্শন ও রাতে অভিষেক ও আরতি দর্শন করা হল। সেই আরতি এতই চমৎকার যে দেখেছে সেই জানবে বলেছেন লেখক। 


পরদিন মনিকর্নিকায় স্নান, তর্পণ করে বিশ্বেশ্বর, অন্নপূর্ণাদর্শন, তীর্থ শ্রাদ্ধ করে ব্রাহ্মণ সধবা কুমারীদের ভোজন করানো হল। পরদিন দক্ষিণ মানসের উদ্যেশ্যে যাত্রা করে প্রথমে কেদার ঘাটে কেদারনাথ দর্শন করে, ক্রমে পঁচিশ দেবদেবী দর্শন ও পূজা করতে করতে তিল ভান্ডেশ্বরে দর্শনে দক্ষিণ মানস দর্শন সম্পন্ন হল। তারপরের দিন পশ্চিম মানস যাত্রা করে প্রথমে পাতালেশ্বর দর্শন, শঙ্খকর্ণ মহাদেব দর্শন করে বাইশ স্থানে দেবদেবী দর্শন করা হল। পরদিন মনিকর্ণিকা তে স্নান ও তর্পণ করে দক্ষিণ মানসের উদ্দেশ্যে যাত্রা। জ্ঞানব্যাপী হয়ে দক্ষিণ মানসের বাষট্টি স্থানে দেব-দেবী দর্শন ঢুন্ডি গনেশ, বিশ্বেশ্বর, অন্নপূর্ণা, কেদার, দুর্গাদেবী, শীতলাদেবীর পূজা দেওয়া হয়। তারপর দিন পঞ্চতীর্থে স্নানাদি করে গমন। প্রথমে অসি সঙ্গমে, শেষে মনিকর্ণিকাতে স্নান করে সমাপ্ত হল। অসি, দশাশ্বমেধ, বরুণা, পঞ্চগঙ্গা, মণিকর্ণিকা এই পাঁচস্থানে তর্পণ ও ব্রাহ্মণ ভোজন করানো হল। তারপর আরো পাঁচ দিন কাশীধাম দর্শন করা হল। 


আরো কিছুদিন কাশীধামে থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু গ্রীষ্ম বৃদ্ধি হয়ে বসন্ত আর ওলাওঠার প্রকোপে অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে দেখে তাঁরা এবার কাশী ত্যাগ করে প্রয়াগতীর্থ হয়ে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

                       ( চলছে)

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৭ চৈত্র ১২৬০ (১১ মার্চ ১৮৫৪) থেকে ২৩ চৈত্র ১২৬০ (৬ এপ্রিল ১৮৫৪)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০২৪

১৬। তীর্থ ভ্রমণ ১ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

     

 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                     ---- সুমনা দাম


তীর্থমঙ্গলের পরে বাংলা ভাষায় পাওয়া ভ্রমণ সাহিত্যটি গদ্যে লেখা এবং ডাইরি বা রোজনামচার আকারে লেখা। তীর্থ ভ্রমণের লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী (১৮০৫ -১৮৭১) এই ভ্রমণটি শুরু করেন ২৬০ সনের (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪  খ্রিস্টাব্দ) ১১ই ফাল্গুন তাঁর বর্তমান খানাকুলে অবস্থিত রাধানগরের বাড়ি থেকে। ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরেন ৯ ই অগ্রহায়ণ, ১২৬৪ সনে (২৪ ভেম্বর ১৮৫৭)। এই সময়ে ভারত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে ছিল। এই ভ্রমণটি ভারতের রেল পূর্ববর্তী কালের ভ্রমণ। ভারতীয় রেল ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বোম্বে থেকে থানে ও কল্যান অব্দি এবং হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত প্রথম শুরু হয়। দেশের অন্যান্য জায়গায় তখন কোনো রেলের সংযোগ ছিল না। তীর্থমঙ্গলের কবি বিজয়রাম, জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের যে সহায় সম্বল পেয়েছিলেন বর্তমান গ্রন্থের লেখকের সেরকম কিছু ছিল না। তিনি মূলতঃ পদব্রজে, নিজের চেষ্টায়, নিজের সামান্য অর্থে এই ভ্রমণ করেছেন। তিনি আত্মীয়-স্বজনকে শোনানোর জন্য নিজের দিনলিপি লিখেছিলেন, পরবর্তীকালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক নগেন্দ্র নাথ বসুর সম্পাদনায় তীর্থ ভ্রমণ নাম নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
 



  রাধানগর থেকে গয়া (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


লেখক তীর্থ ভ্রমণের পূর্বে অম্বল রোগে অত্যন্ত পীড়িত হয়েছিলেন। ভগ্ন স্বাস্থ্যের উদ্ধারের জন্য তিনি পশ্চিম দেশে যেতে অভিপ্রায় করেন। চিকিৎসকও তাকে পদব্রজে পশ্চিম বা উত্তর দেশে ভ্রমণের পরামর্শ দেন। তিনি প্রথমে বৃন্দাবন পর্যন্ত যেতে আগ্রহী ছিলেন। ভ্রমণের শুরুতে ৩০ টাকা সঙ্গে নিয়েছিলেন। বাড়ির অনেকেই তাঁকে এই ভ্রমণে যেতে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিল। তীর্থ ভ্রমণের পূর্বে ব্রাহ্মণ- কায়স্থ ভোজন, শ্রাদ্ধ, সংযম পালন করে তিনি খানাকুলের নিকটস্থ রাধাবল্লভপুরের ঈশ্বরচন্দ্র কওড়ি, নকুড়চন্দ্র বসু, রামধন সিংহ এবং মুটে হিসাবে বিশ্বনাথ তাঁতিকে নিয়ে রওনা হলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের দাদা গোরাচাঁদ কওড়ি এর তিন বছর আগে যাত্রী নিয়ে গয়া তীর্থে গেছিলেন। প্রথমদিকেই বিশ্বনাথ তাঁতি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। 
যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় রাধাবল্লভপুর থেকে জাহানাবাদের (বর্তমান আরামবাগ) অপর পাড়ে কালিপুর (দ্বারকেশ্বরের অপর পাড়ে) হয়ে গৌরহাটি (গৌরহাটি, খানাকুল) পৌঁছান। পরদিন কোতলপুর (কোতুলপুর, বাঁকুড়া) নামক সমৃদ্ধস্থানে থাকা হয়। কোতুলপুর থেকে বালসী (বালসী, বাঁকুড়া) গিয়ে লক্ষীনারায়ণশীলা দর্শন করা হয়। লেখক এই স্থানের আর্থ-সামাজিক নানা কথা লিখেছেন। তীর্থস্থানের পুরোহিতদের লোক ঠকানোর কথাও লিখেছেন। তারপর পাত্রসায়ের হয়ে সোনামুখী গ্রামে (বর্তমান সোনামুখী, বাঁকুড়া) যান বনের ভিতর দিয়ে। সেখানে তখন নানা হিংস্র জন্তু যেমন ভাল্লুক ছিল। বর্ধমান রাজার শ্রীমদ ভগবতদের বিখ্যাত কথক গদাধর শিরোমনির বাসস্থান এই সোনামুখী। তাঁর অর্থানুকুল্যে জঙ্গলের মধ্যে এই বসতি গড়ে উঠেছে। তাঁর গৃহে গোবর্ধন পর্বতের মন্দিরাকৃতি দেবালয় আছে। সোনামুখী থেকে বেরিয়ে ইচলার খাল (অধুনা লুপ্ত?)। তারও কিছু পরে দামোদর নদীর শ্রীরামপুর ঘাট (?)। আরো গেলে গোপালপুরের (বিষ্ণুপুরের নিকট) পাকা রাস্তা পাওয়া যায়। যে রাস্তা বর্ধমান থেকে দিল্লী পর্যন্ত যায় (বর্তমানে বর্ধমান-বিষ্ণুপুর রোড)। 


এই রাস্তার কিছু দূর অন্তর চটী বা পথিকদের রাত্রিবাসের স্থান। রাস্তার দুই ধারে দোকান। দোকানগুলি খোলার ঘর, পথিকদের থাকার স্থান বড় বড় ঘর। সকল ঘরের ভাড়া দিতে হয় না। হাঁড়ি, কাঠ বাবদ পয়সা দিতে হয়। চাল, ডাল ওই দোকান থেকে নিতে হয় আর তরকারি, মাছ, তেল, দুধ, দই বিক্রি করতে বিক্রেতা আসে। ধোপা, নাপিত ইত্যাদি সবই চটীতে পাওয়া যায়। ইঁদাড়া বা কুয়োতে পথিকের জন্য ভালো পানীয় জল আছে। পুলিশের চৌকি থানা আছে। এরপর এল অন্ডাল (পশ্চিম বর্ধমান)। অন্ডাল থেকে এক ক্রোশ দূরে মধুবন। খুব ঘন মহুয়া গাছের জঙ্গল। 
তারপর ফয়েদপুর, তারপর বোগড়া  (বর্তমান রানীগঞ্জ স্টেশন-এর কাছে)। এখানকার গোবিন্দ পন্ডিত ২৪ পরগনা জেলায় ডেপুটি কালেক্টর -এর কাজ করেন। পথিকদের সুবিধার্থে রাস্তার ধারে সুন্দর ফুল, ফলের বাগান, তার মধ্যে দশ বিঘা পুকুর ও জলসত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন গোবিন্দ পন্ডিত মহাশয়। বগোড়া থেকে নিয়ামতপুর (নেয়ামতপুর, পশ্চিম বর্ধমান) হয়ে যাত্রা করেন। এই পথে অশ্বারোহী প্রহরীরা পাহারা দেয় বলে নিরাপদ। 


এবার এলো এক লাল মাটির পাহাড়, মেটে সিঁদরে পাহাড়, যার পশ্চিমে বরাকর নদী। পূর্ব তীরে রাজা হরিশচন্দ্রের দুটি শিব মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের সামনে ও পেছনে পাথরের তৈরি গরু ও শুকরের মূর্তি। এই হরিশচন্দ্র পঞ্চকোট বংশের রাজা ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীতে। নিয়ামতপুর রাজা হরিশচন্দ্রের রাজধানী, গড় পঞ্চকোট থেকে কিছু দূরে অবস্থিত। বরাকর নদ পায়ে হেঁটে পার হয়ে পশ্চিম পাড়ে নৃসেচটী। সেখানে প্রায় ৪০ টি বড় ঘর আছে পথিকদের জন্য। এই চটী পার হয়ে চাস চটী (চাস,ঝাড়খন্ড)। তারপর গোবিন্দপুর-এর চটী (গোবিন্দপুর, ঝাড়খন্ড)। 


'এই চটি পর্যন্ত মগঘ রাজ্য। মৎস্য দেশ, বরাকর অবধি বিরাট রাজ্য। তাহার পর জরাসন্ধাধিকার মগধ' - এটি লেখক বলেছেন। তবে এই বক্তব্য মহাভারত অনুসরণে হলেও এটি সম্পূর্ণভাবে লেখকের মতবাদ। এখানকার মানুষ আধা হিন্দিভাষী আধা বাংলাভাষী। 
এবারে পাহাড়ি পথ গিয়ে রাজগঞ্জ (ঝাড়খন্ড)। এখানে সাহেবদের থাকার একটা বাংলো আছে। এরপর চড়াই উত্তরায় পেরিয়ে তোপচাঁচির চটী। জরাসন্ধের গড় এটি দেখেই সম্ভবত তাঁর মনে হয় মগধের জরাসন্ধের কথা।


লেখক  পরেশনাথ পাহাড় দেখেন এ পথে। সব থেকে বড় পাহাড়। সেই পাহাড় ফল ফুল লতা বৃক্ষ হিংস্র জন্তু পূর্ণ। পাহাড় চূড়ায় সরাবগি বণিকদের কুলদেবতা (জৈনদের সরাবগি অর্থাৎ শ্রাবক বলা হয় হত) অর্থাৎ জৈনদের তীর্থস্থান পরেশনাথের মন্দির আছে। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় পাহাড়ের নিচে মহুয়া বনে পরেশনাথের মেলা বসে। সেখানে আগরওয়ালা ধর্মশালা আছে। পাহাড়ের ওপরে পুস্করিণী ও পুষ্পদ্দান আছে। পরেশনাথ পাহাড়ের নিচে জরাসন্ধের কেল্লার পাশ দিয়ে ডুমরিচটী (ডুমরি, ঝাড়খন্ড)। চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত। সেখানে ঝরনার জলে স্নান করে থাকা হলো। তারপর বগোদরের চটী (বগোদর,ঝাড়খন্ড), বরকাট্টা চটী, আটকা চটী। এখানে চিঠি দেওয়ার ডাকঘর আছে। লেখক কলকাতায় পত্র দিলেন।


তারপর বরশোত (ঝাড়খন্ড), বরহি (ঝাড়খন্ড), চোপারন (চৌপারন) প্রভৃতি পার্বত্য চটী পেরিয়ে এল ভয়ানক জঙ্গলের ভেলুয়া (ভেলওয়া, ঝাড়খন্ড)। এখানে পর্বতে দস্যু আছে যারা পথিকদের আক্রমণ করে সব হরণ করে নেয়। এই পথে ঘোড়া বদল করার অশ্বশাল আছে। তারপর বারা চটী (বারা, ঝাড়খন্ড)। কুশলা নদী (?) পেরিয়ে বোধগয়া (বর্তমানে বিহার) এলেন। লেখক এখানে গয়াসুর বিষ্ণুর সঙ্গে যুদ্ধ করেন বলে লিখেছেন। এখানে ধর্মারণ্যে রাজার মন্দির আছে। (আলেকজান্ডার কানিংহাম, ডিরেক্টর জেনারেল, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ১৮৭৮ এর মহাবোধি মন্দির করেন। তার আগে বৌদ্ধ স্থাপত্য সব মাটির তলায় ছিল। তাই যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় এখানে বৌদ্ধ কোন ধর্ম স্থানের উল্লেখ করেননি)। লেখক বলেন যে বোধগয়াতে তখন এক মোহন্ত ছিলেন, অনেক রাজা তাঁর শিষ্য। তাঁদের দেওয়া ধন, ভূসম্পত্তি, বিশাল বাগান রয়েছে। যারা তীর্থ শ্রাদ্ধ করে আসে না তারা গয়া ধাম যাওয়ার আগে বোধগয়াতে শ্রাদ্ধ করে। গয়াল অর্থাৎ গয়ার পান্ডার লোকেরা এসে এখানে নিজের নিজের যাত্রী নিয়ে যায়। ব্রহ্মযোনি পাহাড়ে পৌঁছে বিষ্ণু মন্দিরের ধ্বজা দেখিয়ে সেতুয়ারা প্রতি ব্যক্তির থেকে এক টাকা করে নেয় ধ্বজা দক্ষিনা স্বরূপ। 


গয়াতে পৌঁছে ক্ষৌর কর্ম, ফল্গু নদীতে স্নান, তর্পণ, বিষ্ণুপদ দর্শন, গয়েশ্বরী দেবী দর্শন, অহল্যাবাই প্রতিষ্ঠিত মন্দির দর্শন এবং বিষ্ণুপদে পিন্ডদান করা হল। এখানে তিনি বিভিন্ন প্রকার শ্রাদ্ধ , গয়াক্ষেত্রের মহিমা, পিন্ডদানের বিভিন্ন বেদী (ষোল বেদী), অষ্টতীর্থ এসব বর্ণনা করেছেন। তারপর প্রেতশিলা, রামশিলা, রামগয়া, সীতাকুণ্ড, গয়া কুপ, ধৌতপদ, ভীমগয়ার কথা লিখেছেন। ফল্গু নদীতে জলে স্রোতের প্রকাশ নেই কিন্তু খনন করলে জল ওঠে। ওই জল সুপেয়। বালি খনন করলে যে জল পাওয়া যায় তার মধ্যে ছোট ছোট মাছ খেলা করতে দেখা যায় বলে লিখেছেন। গয়া ক্ষেত্রের বিষ্ণুমন্দিরে হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী প্রবেশ করতে পারে না বলে জানিয়েছেন। গয়ার পান্ডা সম্প্রদায় ও গয়ালদের ব্যাপারে বলেছেন যে তারা ধনী দুষ্কর্মা আর লোভী। গয়াতে পুত্রের পাঠানো টাকা দিয়ে দেনা শোধ করে কাশী যাত্রার চেষ্টায় রইলেন। শম্ভু কওড়ি ছাড়া বাকি দুই সঙ্গী স্বদেশে ফিরে গেলেন। 


গয়া শহরে তখন প্রায় দশ হাজার ঘর ছিল। মুসলমানরা শহরের বাইরে থাকতো। শহরের উত্তর দিকে সাহেবগঞ্জ। সেখানে বাজারে পিতল কাঁসার জিনিস, কম্বল, শতরঞ্চি, গালিচা, কাপড়, মনোহারী জিনিস, বাঁশের জিনিস, লাঠি, লোহার জিনিস, জুতা ইত্যাদির দোকান ছিল। তারপর কারাগার, যার প্রাচীর ছিল ১১ হাত উঁচু। ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সদর আলা, সদর আমিন, মুন্সেফ, জজদের কাছারি, ডাকঘর, আফিমের কুঠি (সেখান থেকে কোটি টাকার বেশি দাদনে আফিমের আমদানি হয়)। সরকারি ডাক্তার এক বাঙালি বাবু। তারপরে সেনা ছাউনি। শহরে পুলিশের প্রহরা ছিল। সব বাজারে পুরি, কচুরি, লাড্ডু, প্যাড়া ইত্যাদি পাওয়া যায়। গয়েশ্বরী পাহাড় থেকে আনা খুব ভালো পাথরের বাসন বিক্রি হয়।
                 
                     ( চলছে )
 
এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১১ ফাল্গুন ১২৬০ (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪) থেকে ৬ চৈত্র ১২৬০ (২০ মার্চ ১৮৫৪)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৪

১৫। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ২ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


               (আগের পর্বের পরে)

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঝাঁপানে (একটি কেদারা যা চারজন লোক বহন করে) করে ঘুরে ঘুরে হিমালয় পর্বতে উঠতে লাগলেন। কখনো একটানা উপরে উঠে, কখনো কিছুটা নেমে নদীর ধার পর্যন্ত গিয়ে, তারপর আবার উঠে চলতে থাকে ঝাঁপান। নদীর ধারে রান্না, খাওয়া হল। তারপর আবার সামনের পাহাড়ে চড়া। রাতে হরিপুরে রাত্রি যাপন। এভাবে চলতে চলতে তাঁরা সিমলার বাজারে উপস্থিত হলেন। দোকানদারেরা তাঁকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো। সেই বাজারেই বাসা ঠিক করে তাঁরা থাকলেন এক বছর। ১৮৫৭ -র এপ্রিল থেকে ১৮৫৮ - র এপ্রিল পর্যন্ত। 


সেখানে যেসব বাঙালি কর্মসূত্রে থাকে তারা এসে লেখকের সঙ্গে দেখা করে। তাদের কাছে শুনে তিনি একটি সুন্দর জলপ্রপাত দেখতে গেলেন। ঝাঁপানে করে খাদের মধ্যে নেমে দেখলেন সেখানে লোকের বসতি, শস্য ক্ষেত রয়েছে, গরু-মোষ চড়ছে। দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন। আরও নীচে গিয়ে আর ঝাঁপানে যাওয়ার পথ নেই। পায়ে হেঁটে নীচে গিয়ে লাঠি ধরে ধীরে ধীরে জলপ্রপাতের নিকটে উপস্থিত হলেন। তিনশ হাত উঁচু থেকে জলধারা পড়ছে। পাথরের ওপর প্রতিঘাতে ফেনা তৈরি হচ্ছে। তিনি বসে জলক্রিড়া দেখতে লাগলেন। পরের রবিবার আবার তিনি সঙ্গীদের নিয়ে জলপ্রপাতে গিয়ে বনভোজন করলেন। জলপ্রপাতের জলে স্নান করে খুব আনন্দ পেলেন তিনি। 


একদিন লেখক খবর পেলেন গুর্খা সৈন্যরা সিমলা লুঠ করতে আসছে। সিমলাতে খবর এল সিপাহীদের বিদ্রোহে দিল্লি ও মিরাটে গুরুতর হত্যাকাণ্ড হয়েছে। সিমলায় সাহেবরা গুর্খা সৈন্যদের নিরস্ত্র হতে হুকুম দিতে তারা রেগে একজোট হল ও হুকুম মানল না। এরপর আরো গুর্খা সৈন্য সিমলা আক্রমণ করতে এল। সিমলার বাঙালিরা ভীত হয়ে পালাতে লাগলো। সাহেবরাও পালিয়ে গেলে, সিমলা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ায় দেবেন্দ্রনাথ দেখলেন এবার সিমলা ছাড়তে হবে। কিন্তু কুলি না পাওয়া গেলে কি করে সম্ভব স্থান পরিবর্তন। এমন সময় এক দীর্ঘকায় রক্তচক্ষু কৃষ্ণ-বর্ণের পুরুষ এসে আশ্বাস দিল যে সে কুলি সংগ্রহ করে দেবে। লেখক অত্যন্ত সংশয়গ্রস্ত হয়ে রাজি হলেন। পরের রাতে সেই ব্যক্তি কুলি নিয়ে এল এবং লেখক তাদের সঙ্গে চললেন। প্রতিমুহূর্তে ভয় হতে থাকল যে এরা তাঁদের মেরে, খাদে ফেলে দিয়ে, সব টাকা লুঠ করে পালাবে। কিন্তু লেখক ক্রমে দেখলেন এরা খুব বিশ্বাসী। এমনকি তাঁর পকেটের কিছু টাকা ছড়িয়ে পড়েছিল, কুলিরা সেসব কুড়িয়ে এনে তাঁকে দিল। কুলিরা তাঁদের ডগসাহীতে (দাগশাই) পৌঁছে দিল। সেখানে এক গোয়ালার বাড়িতে ভাঙ্গা ঘরে দড়ির খাটিয়ায় লেখক রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন দেখলেন এক পাহাড়ের চূড়ায় সাহেব সৈন্যরা মদের খালি বাক্স বসিয়ে এক চক্রাকৃতি কেল্লা তৈরি করে তার মধ্যে পতাকা উড়িয়েছে। তারা ভয়ে ভয়ে লেখকের কাছে জানতে চাইল গুর্খারা এখানে আসছে কিনা। লেখক সেই গোয়ালার ভাঙ্গা ঘরে আরো কিছুদিন কাটালেন। তারপর শিমলা নির্বিঘ্ন হয়েছে শুনে সেখানে যাওয়ার উদ্যোগ করলেন। কুলি পাওয়া গেল না, একটি ঘোড়া পাওয়া গেল মাত্র। জৈষ্ঠ্যমাসের উত্তাপে তৃষ্ণার্ত হয়ে বহু পথ পার হয়ে মধ্যাহ্নে একটি বাংলো পেলেন এবং দৈবক্রমে সামান্য জল ও খাবার ও পেলেন। সন্ধ্যের সময় সিমলা ফিরে এলেন। 


সিমলা ফেরার কিছুদিন পরে দেবেন্দ্রনাথ একটি ঝাঁপানে করে সঙ্গীদের ছাড়া একাকী আরও উত্তরের পর্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পথে ভাঙা সেতুর কার্নিশের উপর দিয়ে হেঁটে পার হতে হল, যার নীচে ভয়ানক গভীর খাদ। পর্বত একেবারে প্রাচীরের মতো খরা উপরে উঠেছে, নীচে বিষম খাদ। তার ওপর নিকটস্থ গ্রাম থেকে বাঘের মতো কুকুর তাড়া করে এল। এই সংকটময় পথ পেরিয়ে একটি শূন্য পান্থশালা পেয়ে সেখানে থাকা হলো। সঙ্গে রান্না করার কোনো লোক নেই, তাই তিনি ঝাঁপানিদের মকাই-যব মেশানো রুটি খেলেন। কতগুলি পাহাড়ি এসে নাচ গান করছিল। তার মধ্যে একজনের দেখলেন নাক নেই। শুনলেন ভালুক থাবা মেরে নাক উঠিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু তাও সে আনন্দ করছে, নাচছে। পাহাড়িদের সারল্য দেখে লেখক খুব প্রীত হলেন। পরদিন রাতে আরেকটি পাহাড় চূড়ায় থাকলেন তাঁরা। গ্রামবাসীরা বলল এখানে তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। শীতকালে বরফ, ক্ষেতের সময় ভালুক শুয়োরের অত্যাচার প্রভৃতি। লেখক জানলেন এখানে স্ত্রীলোকের সংখ্যা কম বলে পাণ্ডবদের মতো তারা সব ভাই মিলে একজন স্ত্রীকে বিবাহ করে। সেই স্ত্রীর সন্তানরা তাদের সবাইকে বাবা বলে। পরদিন চড়াই পথে ঝাঁপানে যাওয়া গেল না। দেবেন্দ্রনাথকে সেই দুর্গম পথ পদব্রজে যেতে হল। শিখরে উঠে একটি ঘর থাকার জন্য পাওয়া গেল। পরদিন আরো উপরে উঠে নারকান্ডাতে পৌঁছানো গেল। এখানকার উচ্চতা ও শীত আরো বেশি। পরদিনও পায়ে হেঁটে চললেন লেখক। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। যেতে যেতে দেখলেন অনেক বৃক্ষ দাবানলে পুড়ে গেছে। কোন গাছে ফুল ফল নেই। শুধু কেলু (পাইন) নামক বৃক্ষের কদাকার ফল দেখা যায় যা পশু পাখিও খায় না। কিন্তু পাহাড়ের গায়ের তৃণলতাতে নানা রঙের ফুল ফল ধরে আছে। এই ফুলে গন্ধ নেই কিন্তু একরকম সাদা গোলাপ ফুটেছে তার গন্ধে চারিদিক আমোদিত। মাঝে মাঝে লাল রংয়ের স্ট্রবেরিও দেখা যায়। এই নির্জন প্রদেশের সুন্দর পুষ্পলতা দেখে তাঁর মনে ঈশ্বরের করুণার কথা পুনরায় প্রতিয়মান হল। জোরে জোরে হাফেজের কবিতা পড়তে পড়তে সন্ধ্যেবেলা তিনি সুংরি পাহাড়ের চূড়ায় পৌছলেন। সামনের পর্বতের কোনোটি নিবিড় বনের ঢাকা - ভাল্লুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তুর বাসস্থান, কোন পর্বত গমের খেতে ঢাকা - সোনার বরন, কোন পর্বতের গা আগাগোড়া তৃণ-আবৃত, আবার কোন কোনটি তৃণশূন্য। সূর্য অস্ত গেলে লেখক একা শৃঙ্গে বসে রইলেন। দূর থেকে পর্বতের স্থানে স্থানে কেবল প্রদীপের আলো মানুষের বসতির পরিচয় দিতে থাকল। পরদিন কেলুবনের ভিতর দিয়ে অবতরণ শুরু হল। তাঁর মনে হল পর্বতের নীচ থেকে উপর পর্যন্ত বৃক্ষরা যেন সৈন্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এটি ঈশ্বরের এক আশ্চর্য মহিমা। পথে একটি প্রস্রবণে হিমশীতল জলে স্নান করে উপাসনা করলেন দেবেন্দ্রনাথ। তারপর ছাগলের দুধ এনে দিল ঝাঁপানিরা। দেবেন্দ্রনাথের অভ্যাস ছিল উপাসনার পর দুগ্ধ পানের। কিন্তু এরকম দুর্গম অঞ্চলে দুগ্ধ পাওয়া বিস্ময়কর। তিনি ঈশ্বরের করুণায় ধন্য হলেন। পাহাড়ি পথে নীচে নামতে নামতে বোয়ালি (বাওলি, উত্তর প্রদেশ) নামক স্থানে এলেন তাঁরা। এই পাহাড়ের নীচে নগরী নদী (?) বয়ে গেছে। এখান থেকে দূরে শতদ্রু নদী দেখা যায়। শতদ্রু নদী তীরে রামপুর (রামপুর, উত্তর প্রদেশ) অবস্থিত। তারপর ভজ্জীর (ইংরেজ শাসনকালের একটি নামমাত্র সার্বভৌম রাজ্য, যেটি বর্তমানের হিমাচল প্রদেশে অবস্থিত ছিল) রাণার রাজধানী সোহিনী (সুনী, হিমাচল প্রদেশ) হয়ে শতদ্রু নদী নীচে বিলাসপুরে (বিলাসপুর, উত্তর প্রদেশ) গিয়ে পর্বত ত্যাগ করে পাঞ্জাবে সমতলে প্রবাহিত হয়েছে। পরদিন পর্বতে অবতরণ করে নগরী নদীতীরে উপস্থিত হলেন তাঁরা। এই নদী বিশাল বিশাল পাথরের খন্ডে আঘাত পেয়ে গম্ভীর শব্দের ক্রুদ্ধ ভাবে বয়ে চলেছে নীচের দিকে। নদীর উপরে সেতু পেরিয়ে একটি সুন্দর বাংলোয় তাঁরা আশ্রয় নিলেন। উপত্যকাটিতে একটি মাত্র পরিবার বসবাস করছে। তাদের আনন্দ ও সন্তোষ থেকে লেখকের মনে হল কোন রাজাও এত সুখী নন। সেদিন সন্ধ্যায় নদীতীরে ভ্রমণকালে তিনি পাহাড়ে দাবানল দেখলেন। পরদিন নদীর হিমশীতল জল ঘটি করে তুলে স্নান করলেন। এরপর পাহাড়ে আরোহন করে দারুণঘাট (দারানঘাটি, হিমাচল প্রদেশ) নামক স্থানে পৌঁছে দেখলেন সামনে এক ভীষণ উঁচু তুষারাবৃত শৃঙ্গ। আষাঢ় মাসের প্রথম দিনে লেখক এখানে তুষারপাত দেখলেন। এই পর্বত থেকে অবরোহন করে সিরাহন (সারাহান, হিমাচল প্রদেশ) নামক পর্বতে উপস্থিত হলেন দেবেন্দ্রনাথ। এখানে রামপুরের রাণার অট্টালিকা আছে। এরপর আরো দিন দশেক যাত্রা করে সিমলার বাসায় পৌঁছলেন। এই কুড়ি দিনের পর্বত ভ্রমণ পর্বে ঈশ্বর তাঁকে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি শিক্ষা দিয়ে ধন্য করেছেন বলে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হলেন লেখক। 


এবার হিমালয়ে বর্ষা ঋতু এল। মাথার উপরে নয়, পাহাড়ের নীচে মেঘ দেখে লেখক আশ্চর্য হলেন। মাঝে মাঝে এক পক্ষ কাল বৃষ্টি চলল, সূর্যের দেখা মিলল না। ঝরনার বর্ষার জলে পরিপুষ্ট হয়ে উঠল আর পথ হয়ে উঠল দুর্গমতর। আশ্বিনে শরৎকালের কোন বিশিষ্ট রূপ নেই হিমালয়ে। শীতে পর্বত তলা থেকে শিখর পর্যন্ত বরফে আবৃত হয়ে শুভ্র রূপ ধারণ করল। ভোরে বেড়ানোর অভ্যাস কিন্তু প্রবল শীতেও দেবেন্দ্রনাথ অব্যাহত রাখলেন। প্রতিদিন সকালে বহুদূর ভ্রমণ করে এসে চা ও দুধ খেতেন। বেলায় স্নানের সময় বরফ মেশানো জল মাথায় ঢালতেন। মুহূর্তের জন্য যেন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেত, কিন্তু পরক্ষণে তা দ্বিগুণ বেগে চলে শরীরে স্ফূর্তি আর তেজ সঞ্চার করত। শীতের রাতেও তিনি ঘরে আগুন জ্বালাতেন না। শীত সহ্য করে সহিষ্ণুতা বৃদ্ধির প্রয়াস করতেন। রাতে শয়নকক্ষের দরজা খুলে রাখতেন। শীতের রাতে ঠান্ডা বাতাস তাঁর খুব ভালো লাগত। দিনরাত তিনি আধ্যাত্মিক চিন্তায় ব্যাপৃত থাকতেন। 


মাঘ মাসের শেষে (ফেব্রুয়ারি ১৮৫৮) ভজ্জীর রাণার মন্ত্রী রাণাসাহেবের নিমন্ত্রণ নিয়ে এলেন। তিনি ঝাঁপানে নীচে উপত্যকায় নামতে থাকলেন। সন্ধ্যায় শতদ্রু নদীর তীরে রাণার রাজধানী সোহিনী নগরে পৌঁছলেন। সেখানে তিনি রাজগুরু ও রাণার সঙ্গে ধর্মালোচনা করলেন। শতদ্রু নদীর তীরে তিনি একাকী ভ্রমণ করলেন। চর্ম মশকে (এক রকম বড় চামড়ার থলে) চড়ে তিনি অপর পাড়েও গেছিলেন। শতদ্রু নদীতে বড় বড় পাথর থাকায় নৌকা চালানো যায় না। তীরে অনেকে স্নান করছিল। তারা বিশ্বাস করে এখানে স্নান করলে নানা রোগের উপশম হয়। সপ্তাহখানেক এখানে থেকে তিনি সিমলা ফিরে গেলেন। পথে বনের মধ্যে রত্নকুণ্ডল, হীরার কণ্ঠী, মুক্তার মালা ও দিব্য বস্ত্র পরিধান করে রাজকুমারকে মৃগয়া করতে দেখলেন। তাকে দেখে মনে হল যেন বনদেবতা। 


চৈত্র মাসের শেষে চারদিক পাহাড় ফুলে ফুলে ভরে উঠল। এক বছর সিমলা বাজারের বাসায় কাটিয়ে এবার তিনি পর্বতের উপর একটি সুন্দর, নির্জন স্থানে বাংলো নিলেন। সেই চূড়ায় একটিমাত্র বৃক্ষ ছিল, যা তাঁর নির্জনের বন্ধু হল। বৈশাখ মাসে তিনি পশমের পোশাকে ঘুরছেন এই রহস্য স্বদেশী বাঙালি কি করে বুঝবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। নির্জন পাহাড়ে পাথরে তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন। কখনো যতদূর মন চাইত নির্জন বনময় পথে তত দূর পায়ে হেঁটে চলতেন। এরপর আবার বর্ষা এল। বর্ষার জলে প্রবল বেগে নিম্ন মুখে ছুটে চলা নদীকে দেখে তাঁর উপলব্ধি হল যে নদীর সাধ্য নেই নিজের জন্য এই পূণ্যভূমিতে স্থির হয়ে থাকার। তাকে সর্বশক্তিমানের শাসনে নিম্নের ভূমিকে শস্যশালিনী করার জন্য উদ্ধত ভাব পরিত্যাগ করে, কর্দমাক্ত হলেও, নিম্নগামিনী হতেই হবে। তেমনই তাঁর হৃদয় অন্তর্যামীর আদেশ পেলেন যে, তিনি এখানে অবস্থান করে যে শিক্ষা লাভ করেছেন তা পৃথিবীতে গিয়ে প্রচার করতে হবে। এই উপলব্ধির পর তিনি বাড়ি ফিরতে উদ্যোগী হলেন। 


১৬ অক্টোবর, ১৮৫৮ বিজয়া দশমীর দিন তিনি প্রায় দুই বছর পর সিমলা ছেড়ে ঝাঁপানে করে অবরোহন শুরু করলেন। ক্রমে কালকা, পঞ্জৌর (পনজৌর, পাঞ্জাব) হয়ে অম্বালা এলেন। এখান থেকে ডাকের গাড়ি ভাড়া করে রাত দিন চলতে থাকলেন। গাড়ি থেকে দেখলেন ঘোড়সওয়ার গাড়ির পাশে পাশে ছুটে চলেছে। বিদ্রোহীদের ভয়ে গভর্নমেন্ট পথিকদের নিরাপত্তার জন্য রাতে ঘোড়সওয়ার ছোটানোর নিয়ম করেছে। কানপুরের নিকট একস্থানে তিনি দেখলেন একটি মাঠে অনেক ভিড়, অনেক তাঁবু পড়েছে। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানলেন দিল্লির বাদশাহকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য এই ব্যবস্থা। সিমলা যাওয়ার পথে বাদশাহকে আনন্দে ঘুড়ি ওড়াতে দেখেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। আজ তিনি বন্দী হয়ে কারাগারে যাচ্ছেন। এই সংসারে কখন কার ভাগ্যে কি ঘটে বলা যায় না এ কথা ভাবলেন দেবেন্দ্রনাথ। কানপুর থেকে রেলপথ খুলেছে এখন। তিনি টিকিট কাটার চেষ্টা করে প্রথমে ব্যর্থ হলেন, কারণ শুধু আহত সৈন্যদের রেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে বাঙালি স্টেশনমাস্টার, যিনি তত্ত্ববোধিনী পাঠশালায় তাঁর ছাত্র ছিলেন, তিনি তাঁকে চিনতে পারায় টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। এলাহাবাদে তখনও স্টেশন তৈরি হয়নি। পথের মধ্যে এক স্থানে রেল থামল। তাঁরা নেমে হেঁটে তিন ক্রোশ দূরে এলাহাবাদের ডাকবাংলোতে গেলেন। ডাক বাংলো ঘর না থাকায় লালকুঠি নামক কেল্লার কাছের একটি স্থানে থাকা হল। এলাহাবাদে তিনি দেখলেন বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে যে কেউ যদি আরও পূর্বাঞ্চলে যেতে চায় সরকার তার জীবনের জন্য দায়ী থাকবে না। শুনলেন দানাপুরে কুমার সিংহের (কুনোয়ার সিং) লড়াই চলছে। তিনি ভাবলেন এত বিপদে না গিয়ে জলপথে যাওয়ার কথা। স্টীমারে আশ্রয় পাওয়াও তখন ব্রিগেডিয়ারের অনুমতি সাপেক্ষ। কারণ সৈনিক ও তাদের পরিবারদের জন্য স্টীমার সংরক্ষিত। দেবেন্দ্রনাথের পরিচয় পেয়ে ব্রিগেডিয়ার অনুমতি দিলেন। কিন্তু স্টীমারে ঘর না থাকায় সঙ্গের কার্গো বোটে কাপ্তানের কেবিনে তাঁর স্থান হল। পথে সেই কেবিনও তাঁকে ইংরাজ মহিলাদের থাকার জন্য ছেড়ে দিয়ে ডেকে কাটাতে হল। তারপর রামপুরে স্টীমার বদল করে ১৫ই নভেম্বর ১৮৫৮ -তে তিনি একচল্লিশ বছর বয়সে কলকাতা ফিরলেন। 


দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রমণ কাহিনী এখানেই শেষ হল কারণ তাঁর আত্মজীবনী অসমাপ্তভাবে এখানেই সমাপ্ত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০২৪

১৪। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ১ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

 


 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


শ্রীমন্মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীর প্রথম সংস্করণ জে এন ব্যানার্জি এন্ড সন্স থেকে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। 

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) দার্শনিক ও ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারক ছিলেন। তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি মাঘ উৎসব, নববর্ষ, দীক্ষা দিন প্রভৃতি ব্রাহ্ম উৎসবের প্রবর্তন করেন। ১৮৬৭ সালে বীরভূমের ভুবনডাঙ্গা নামক স্থানে বিশাল ভূমি কিনে তিনি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজকের শান্তিনিকেতন। ব্রাহ্মসমাজ তাঁকে মহর্ষি উপাধিতে ভূষিত করেছিল। 


ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর থেকে দেবেন্দ্রনাথ দুর্গাপূজাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিবছর আশ্বিন মাসে কলকাতার বাইরে বেড়াতে যেতেন বলে নিজেই লিখেছেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে ভ্রমণ সংক্রান্ত উপাদান কিছু আছে, কিন্তু ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে যেহেতু এটি লিখিত হয়নি তাই খুব বেশি তথ্য এখানে পাওয়া যায় না। আত্মজীবনীটি অসমাপ্ত। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত এটি লেখা হয়েছে, যখন তাঁর বয়স মাত্র ৪১ বছর। অর্থাৎ তাঁর জীবনের অর্ধেকের কম সময়ের কথা তিনি লিখে গেছেন। তাই তাঁর সমগ্র ভ্রমণকাহিনীও জানা যায় না।


১৭৬৯ শকের আশ্বিন মাসে অর্থাৎ ১৮৪৭-এর সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে তিনি কাশী যাত্রা করেন। তাঁর এই যাত্রার বাহন ছিল পালকির ডাক। কলকাতা থেকে কাশী যেতে তাঁর ১৪ দিন লাগে এবং যাতায়াত অতি কষ্টকর ছিল বলে তিনি লিখেছেন। কাশীতে তিনি বেদচর্চা করতে গেছিলেন। কাশীর মানমন্দিরে (রাজা জয় সিং নির্মিত) তিনি থাকতেন। বিশ্বেশ্বর মন্দিরের পান্ডা তাঁকে মন্দিরে নিয়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি বলেন যে তিনি তো বিশ্বেশ্বরের মন্দিরেই আছেন, আর কোথাও তাঁর যাওয়ার নেই। কাশীতে অনেক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ তাঁর নিকট আসেন। প্রচুর বেদ-চর্চা হয়। 


এরপর কাশীর মহারাজের ভাই এসে তাঁকে জানান যে রাজা একবার সাক্ষাৎ চান, তাই মহর্ষিকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পরদিন তিনি আবার এসে দেবেন্দ্রনাথকে অপর পাড়ে রামনগরের রাজবাড়ীতে নিয়ে যান। রাজপ্রাসাদের ঘরগুলি ছবি, আয়না, ঝাড় লণ্ঠন, গালিচা, দুলিচা, মেজ, কেদারায় দোকানের মতো ভরা। দুইজন বন্দী (বন্দনা করে যে) রাজার আগমনে যশোগান করলেন। রাজা এসে তাঁকে সমাদরে সভায় নিয়ে গেলেন। সেখানে নৃত্যগীত শুরু হল। রাজা তাঁকে একটি হীরের আংটি উপহার দিলেন। রাজা তাঁকে দশমীতে রামলীলা দর্শনের জন্য আবার আমন্ত্রণ জানালেন। 


রামলীলার দিন রামনগরে গিয়ে দেবেন্দ্রনাথ দেখলেন কাশীর রাজা একটি বিশাল হাতিতে বসে আলবোলা টানছেন আর পিছনে একটি ছোট হাতিতে তাঁর হীরের আলবোলা ধরে বসে আছে তাঁর হুকাবরদার। আরেকটি হাতিতে রাজগুরু গেরুয়া কাপড় পরে বসে আছেন। রাজগুরু মৌন আছেন। পাছে কথা বলে ফেলেন তাই তাঁর জিভে একটি কাঠের খাপ দেওয়া আছে। চারদিকে কর্নেল, জেনারেল প্রভৃতি সেনারক্ষকরা এক একটি হাতিতে চড়ে রাজাকে ঘিরে আছে। দেবেন্দ্রনাথকেও একটি হাতি দেওয়া হল। সবাই মিলে রামলীলার রঙ্গভূমিতে যাওয়া হল। মেলায় গিয়ে দেখলেন সেখানে লোকে লোকারণ্য। সেই মেলার এক জায়গায় চন্দ্রাতপের নীচে একটি ফুলে সাজানো সিংহাসনে একটি বালক তীর ধনুক নিয়ে বসে আছে। সেই বালক রামচন্দ্র সেজেছে। রামকে গিয়ে লোকজন প্রণাম করছে। এরপর যুদ্ধ হলো। কয়েকটি সং রাক্ষস, তাদের মুখে ঘোড়া, উট, ছাগল প্রভৃতির মুখোশ; তারা যুদ্ধের পরামর্শ করছে। কিছু পরে সেখানে একটি বোমা পরল, তার চারদিকে আতশবাজি হতে থাকল। দেবেন্দ্রনাথ এই পর্যন্ত দেখে কাউকে কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেলেন। দেবেন্দ্রনাথের মনে এই বালখিল্য রামলীলা নিশ্চয়ই বিরক্তির সঞ্চার করেছিল। 


পরে তিনি কাশী থেকে নৌকা পথে বিন্ধ্যাচল দেখে মির্জাপুর পর্যন্ত গেলেন। বিন্ধ্যাচলের ক্ষুদ্র পর্বত দেখে তিনি খুব আনন্দ পেলেন কারণ সেটি তাঁর প্রথম পর্বত দর্শন। বিন্ধ্যাচলে তিনি যোগমায়া দেখলেন। পাথরে খোদাই করা দশভূজা মূর্তি যোগমায়ার। সেখানে একটিও মানুষ নেই। এরপর দেখলেন ভোগমায়া। সেখানে প্রচন্ড ভিড়। সেখানে সমানে পাঁঠা বলি হচ্ছে। এরপর মির্জাপুর থেকে স্টিমারে কলকাতার বাড়িতে ফিরলেন। 



দেবেন্দ্রনাথের পরবর্তী ভ্রমণ ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। তিনি কয়েকজন বন্ধু নিয়ে দামোদর নদীতে বেড়াতে যান। দামোদরের বুকে ঘুরে একদিন একটি চড়ে যখন নৌকা লাগল তখন তিনি শুনলেন বর্ধমান সেখান থেকে মাত্র দুই ক্রোশ দূরে। তিনি বর্ধমান দেখতে উৎসাহী হলেন ও সেখানে পৌঁছলেন। সঙ্গে রাজনারায়ণ বসু ও আরো দু একজন ছিলেন। তাঁরা শহর ঘুরে দেখলেন, রাজবাড়িও দেখলেন। তারপর রাতে সেই চড়ে আবার ফিরে এলেন। পরদিন সেই চড়ে একটি সুন্দর ফিটন গাড়ি এসে উপস্থিত হোল। গাড়ি থেকে এক ব্যক্তি নেমে তাঁকে বললেন বর্ধমানের মহারাজা (রাজা মহাতাব চাঁদ) তাঁর সাক্ষাৎ চেয়েছেন। বর্ধমানে নিয়ে গিয়ে দেবেন্দ্রনাথকে একটি সুসজ্জিত বাসস্থানে রাখা হলো। পরদিন মহাসমাদরে তাঁকে রাজবাড়ি নিয়ে আসা হলো। রাজার সঙ্গে পরিচয় ও মতবিনিময় হলো এবং পরে তিনি রাজবাড়ীর মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করলেন। 



১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপূজার সময় দেবেন্দ্রনাথ বাষ্পতরীতে (স্টীমারে) ঢাকায় গেলেন। সেখান থেকে মেঘনা পার হয়ে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে গৌহাটিতে পৌঁছালেন। কামাক্ষা যেতে মনস্থ করাতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হাতি পাঠিয়েছিলেন তাঁর জন্য। তিনি পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন, পিছনে মাহুত হাতি নিয়ে চলল। ক্রমে হাতি পিছিয়ে পড়লো এবং তিনি পদব্রজেই তিন ক্রোশ চলে কামাখ্যা পর্বতের পাদদেশে পৌঁছলেন। পর্বতের পথ পাথরে তৈরি। সেই সোজা উপরে উঠেছে। দুধারে ঘন জঙ্গল। তিনি নির্জন বনপথে একা উঠতে লাগলেন। তখনও সূর্য ওঠেনি, অল্প বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক উপরে ওঠার পরে ক্লান্ত হয়ে পাথরের উপর বসে পড়লে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলেন। চিন্তা হল জঙ্গল থেকে বাঘ ভালুক যদি আসে। এমন সময় মাহুত এসে উপস্থিত। হাতি আনতে না পেরে সে একাই ছুটতে ছুটতে এসেছে। দুজনে আবার পাহাড় চড়তে লাগলেন। পাহাড়ের উপরে একটি বিস্তীর্ণ সমভূমি।। সেখানে অনেকগুলি চালাঘর আছে কিন্তু একটি লোকও চোখে পড়লো না। তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দির যেন একটি পর্বত গহ্বর। সেখানে কোন মূর্তি নেই, কেবল যোনি মুদ্রা আছে। তিনি দর্শন করে ফিরে এসে ব্রহ্মপুত্রে স্নান করে ক্লান্তি দূর করলেন। তারপর দেখেন ৪০০-৫০০ লোক ভিড় করে পাড়ে দাঁড়িয়ে কোলাহল করছে। তারা জানালো তারা কামাখ্যার পান্ডা। অনেক রাত পর্যন্ত দেবীর পূজা করতে হয় তাদের। তাই সকালে উঠতে দেরি হয়। তিনি কামাখ্যা দর্শন করেছেন অথচ পান্ডারা কিছু পায়নি। দেবেন্দ্রনাথ তাদের বললেন তারা তাঁর নিকট থেকে কিছুই পাবে না, তারা যেন চলে যায়। 


১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দেবেন্দ্রনাথ গঙ্গা তীরে বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকা ভাড়া করতে গিয়ে একটি বড় স্টীমার দেখলেন, যেটি দু-তিন দিনের মধ্যে সমুদ্রে যাবে। দেখে তাঁর শখ হল সমুদ্রে যাওয়ার এবং তিনি স্টিমারে একটি ঘর ভাড়া করলেন। সমুদ্রের রূপ তিনি এর আগে দেখেননি।  অখন্ড জলরাশির নীল রূপ আর দিন রাত্রির বিচিত্র শোভা তিনি মগ্ন হয়ে দেখতে লাগলেন। একদিন  জাহাজ এক জায়গায় নোঙর করল। সামনে সাদা বালির চড়ায় একটি বসতি। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে তিনি কয়েকজন চট্টগ্রামবাসী বাঙালিকে দেখলেন। লেখক জিজ্ঞাসা করে জানলেন তারা এখানে ব্যবসা করে। আশ্বিন মাসে তারা এখানে মা দুর্গার প্রতিমা এনেছে। লেখক এবার ব্রহ্মরাজ্যের খাএকফু নগরে (Kyaukpyu) দুর্গোৎসবের কথায় আশ্চর্য হলেন আর ভাবলেন দুর্গোৎসব এড়াতে এত দূরে এসেও সেই দুর্গোৎসবের কথা তাঁকে শুনতে হল। 



এরপর জাহাজ মুলমীন ( Mawlamyine) অভিমুখে চলল। জাহাজ সমুদ্র ছেড়ে মুলমীনের নদীতে প্রবেশ করল। এই নদীর শোভা তেমন নেই। জল পঙ্কিল, কুমিরে পূর্ণ বলে কেউ নদীতে স্নান করে না। মুলমীনে একজন মাদ্রাজি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। লেখক তাঁর বাড়িতে কয়েক দিন কাটালেন। মুলমীন শহরের রাস্তাঘাট পরিষ্কার ও প্রশস্ত। দুইধারে দোকানে স্ত্রীলোকেরাই বিক্রির কাজ করছে। তিনি প্যাটরা (বাক্স), উৎকৃষ্ট রেশম বস্ত্র ক্রয় করলেন। এরপর মাছের বাজারে গিয়ে দেখলেন কুমির কেটে বিক্রি হচ্ছে মাছের মতো। লেখক মন্তব্য করেছেন বার্মার মানুষের অহিংস বৌদ্ধধর্ম শুধু মুখে কিন্তু পেটে কুমির। মুলমীনের রাস্তায় একদিন সন্ধ্যায় বেড়ানোর সময় দেবেন্দ্রনাথ এক বাঙালিকে দেখে অবাক হলেন। তারপর ভাবলেন বাঙালির অগম্য স্থান নাই। জিজ্ঞাসা করে জানলেন ব্যক্তিটি দ্বীপান্তরিত হয়ে এসেছিল এখানে। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে আন্দামান দ্বীপে দ্বীপান্তরকরণ শুরু হওয়ার আগে মুলমীনে অন্তরীন করা হতো। এখন শাস্তির মেয়াদ ফুরিয়েছে, কিন্তু টাকার অভাবে দেশে যেতে পারছে না। লেখক তাকে পাথেয় দিতে চাইলেন। কিন্তু সে বলল এখন সে বার্মায় ব্যবসা করছে, বিবাহ করেছে, সুখে আছে, সে আর দেশে ফিরবে না। 


যে মাদ্রাজি ভদ্রলোকের বাড়িতে লেখক আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি তাঁকে এক দর্শনীয় পর্বত গুহা (Kha you gu বা Kayon Cave, Farm Cave) দেখাতে নিয়ে যান। এক অমাবস্যার রাতে একটি লম্বা ডিঙ্গি চড়ে তাঁরা রওনা দিলেন। নৌকায় জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রভৃতি সাত আট জন সঙ্গে চলল। রাতে ১২ ক্রোশ গিয়ে ভোরে নৌকা গন্তব্যে পৌঁছাল। সেখানে একটি ক্ষুদ্র কুটিরে, মুন্ডিত-মস্তক, গেরুয়া বসন পরা কয়েকজন সন্ন্যাসীকে দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। পরে জানলেন এরা ফুঙ্গি, বৌদ্ধদের গুরু ও পুরোহিত। একজন দেখতে পেয়ে লেখককে ঘরের ভিতর নিয়ে গিয়ে পা ধোয়ার জল দিলেন, বসতে আসন দিলেন। বৌদ্ধদের কাছে অতিথি সেবা পরম ধর্ম। এরপর লেখক ও সঙ্গীরা হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গলের মধ্যে রওনা দিলেন সেই গুহার উদ্দেশ্যে। বেলা তিনটের সময় গুহার কাছে এসে পৌঁছে হাতির থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তাঁরা গুহা মুখে এলেন। ছোট গুহা মুখে গুড়ি মেরে প্রবেশ করতে হয়। গুহার ভেতর পিচ্ছিল ও ঘোর অন্ধকার। লেখক ও সঙ্গীরা গুহার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে পাথরের গায়ে গন্ধক চূর্ণ রেখে তাতে আগুন জ্বালালেন একসাথে। গুহার বিভিন্ন স্থান থেকে সেই গন্ধকের আলোয় এই গুহা আলোকিত হয়ে উঠল। গুহার প্রকাণ্ডতা ও তার উপর থেকে বৃষ্টিধারার বেগে বিচিত্র কারুকার্য (stalagmite) দেখে তাঁরা মুগ্ধ হলেন। এরপর জঙ্গলে বনভোজন সেরে তাঁরা ফিরে এলেন। কতগুলি বর্মাবাসীকে এক বাদ্যযন্ত্রের তালে নৃত্য করতে দেখলেন। স্থানীয় এক সম্ভ্রান্ত বার্মিজ পরিবারে নিমন্ত্রিত হয়ে তিনি আতিথ্য উপভোগ করেছিলেন।


১৮৫১ সালের মার্চে দেবেন্দ্রনাথ কটকে যান পালকির ডাকে। সেখানে জমিদারি সংক্রান্ত কাজের পর জগন্নাথ দর্শনের জন্য পুরীতে যান। রাতে পালকির ডাকে চললেন। সকালে পুরীর কাছে চন্দন যাত্রার পুষ্করিণী পৌঁছে স্নান করার সময় পুরীর জগন্নাথের একজন পান্ডা এসে তাঁকে ধরল। লেখক তার সঙ্গে চলতে থাকলেন। লেখকের পায়ে জুতো ছিল না বলে পান্ডা খুব খুশি হল। যখন তাঁরা পুরীতে পৌঁছলেন তখন জগন্নাথ দেবের মন্দিরের দ্বার বন্ধ ছিল। পান্ডা মন্দিরের দ্বার খুলে দিতে বহু মানুষ একসঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করল। ধাক্কাধাক্কিতে লেখকের চশমা খুলে পড়ে ভেঙ্গে গেল। ফলে চশমা ছাড়া লেখক নিরাকার জগন্নাথকেই দেখলেন। তাঁর মনে পড়ল যে একটি প্রবাদ আছে, যে যা মনে করে জগন্নাথ মন্দিরে যায় সে তাই দেখতে পায়। লেখক নিরাকারবাদে বিশ্বাসী বলে নিরাকার জগন্নাথ দেখতে পেয়েছেন এমনটি তিনি লিখেছেন। জগন্নাথের সামনে একটি বড় তাম্রকুণ্ড ভর্তি জল। সেখানে জগন্নাথের ছায়া পড়েছে। সেই ছায়াকে পান্ডারা দন্তধাবন ও স্নান করাল। তারপর জগন্নাথের মূর্তিতে নতুন বসন ও আভরণ পরাল। এরপর তিনি বিমলা দেবী মন্দিরে গেলেন, কিন্তু দেবীকে প্রণাম করলেন না। তাতে যাত্রীরা অসন্তুষ্ট হল। এরপর জগন্নাথের মহাপ্রসাদ নিয়ে শোরগোল পড়ে গেল। লেখক দেখলেন এখানে মহাপ্রসাদ নিয়ে ব্রাহ্মণ, শূদ্রের ভেদাভেদ নেই। এদিক দিয়ে উড়িষ্যাবাসীরা ধন্য। 


এরপর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপূজার সময় ১০০ টাকায় কাশী পর্যন্ত যাওয়ার জন্য তিনি একটি নৌকা ভাড়া করলেন। নবদ্বীপ পৌঁছতে ছয় দিন লাগলো। মুঙ্গেরে পৌঁছে সীতাকুণ্ড দেখতে গেলেন তিন ক্রোশ হেঁটে। তারপর ফতুয়ায় যখন বিস্তীর্ণ গঙ্গার মধ্যে দিয়ে চলেছেন, প্রবল ঝড় উঠল। লেখকের সঙ্গের পানসি আহার্য দ্রব্যসহ জলে ডুবে গেল। পাটনা এসে তিনি নতুন আহারে সামগ্রী কিনলেন। কলকাতা থেকে কাশী পৌঁছতে প্রায় দেড় মাস লাগল। কাশীতে তিনি দশ দিন ছিলেন। 


তারপর ডাকগাড়ি করে এলাহাবাদের অপর পাড়ে পৌঁছে নৌকায় গাড়ি সমেত পার হয়ে প্রয়াগ তীর্থের বেণী ঘাটে পৌঁছলেন। এই ঘাটে লোকে মস্তক মুন্ডন করে, শ্রাদ্ধ, তর্পণ, দান করে। একজন পান্ডা তাঁকে ধরে টানাটানি করতে থাকল। 


কদিন এলাহাবাদের থেকে ডাকগাড়িতে আগ্রা পৌঁছান। আগ্রায় তাজ দেখলেন। তাজের একটা মিনারের ওপর উঠে দেখলেন পশ্চিম দিক লাল করে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, নীচে নীল যমুনা, তার মধ্যে শুভ্র স্বচ্ছ তাজ যেন সৌন্দর্যের ছটা নিয়ে চাঁদ থেকে পৃথিবীতে খসে পড়েছে। 


তারপর যমুনা নদীপথে দিল্লি যাত্রা করলেন। পৌষ মাসের প্রবল শীতে নৌকায় চলাকালীন কোন কোন দিন তিনি যমুনাতে স্নান করতেন, কখনো যমুনার ধারে শস্য ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যেতেন। 


এগার দিনে যমুনা নদীপথে চলে মথুরায় উপস্থিত হলেন। সেখানে এক সন্ন্যাসী তাঁকে শাস্ত্রচর্চার জন্য ডাকেন। বিষ্মিত হয়ে তিনি দেখেন সন্ন্যাসীর কাছে সমস্ত রামমোহন রায়ের বইয়ের হিন্দি অনুবাদ রয়েছে। লেখক তারপর বৃন্দাবন গেলেন। সেখানে লালাবাবুর তৈরি গোবিন্দজীর মন্দির দেখলেন। নাট মন্দিরের চার পাঁচ জন বসে সেতার শুনছিল। লেখক গোবিন্দজিকে প্রণাম করলেন না দেখে তারা সচকিত হল। 


আগ্রা থেকে এক মাস নৌকাযাত্রা করে তিনি দিল্লি এলেন। দেখলেন নদীর পারে খুব ভিড়। দিল্লির বাদশাহ সেখানে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন। লেখক লিখেছে ঘুড়ি ওড়ানো ছাড়া বাদশাহর তখন আর কোন কাজ ছিল না। দিল্লি থেকে আট ক্রোশ দূরে কুতুব মিনার দেখতে গেলেন এবার। লেখক লিখেছেন এটি হিন্দুর পূর্ব কীর্তি। মুসলমানেরা এখন এটিকে কুতুবুদ্দিন বাদশাহের জয়স্তম্ভ বলে, এই জন্য এর নাম কুতুব মিনার। হিন্দুদের মুসলমানরা পরাজিত করার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের কীর্তিও লোপ করেছে। কুতুব মিনার প্রায় ১৬১ হাত উঁচু। তিনি সেই মিনারের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে পুলকিত হলেন। 


এরপর তিনি ডাকগাড়ি করে অম্বালায় গেলেন ও সেখান থেকে ডুলি করে লাহোরে গেলেন। লাহোর থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসর পৌছালেন। 


অমৃতসর পৌঁছে শিখদের উপাসনাস্থল অমৃতসর অর্থাৎ অমৃত সরোবরে পৌঁছানোর জন্য গুরুদোয়ারায় গেলেন। সেখানে দেখলেন একটি বৃহৎ পুষ্করনী, যেটি গুরুর রামদাস খনন করিয়েছিলেন। সরোবরের মধ্যে  উপদ্বীপের ন্যায় পাথরের মন্দির। একটা সেতু দিয়ে সেই মন্দিরে প্রবেশ করলেন। একটি বিচিত্র রঙে রেশমের বস্ত্রে আবৃত  স্তুপে গ্রন্থ (গ্রন্থসাহেব) রয়েছে। মন্দিরের একজন প্রধান শিখ তার ওপর চামর ব্যজন করছেন। গায়কেরা গ্রন্থের গান গাইছে। পাঞ্জাবি স্ত্রী পুরুষ মন্দির প্রদক্ষিণ করে কড়ি ও ফুল দিয়ে প্রণাম করে চলে যাচ্ছে। যেকোনো ধর্মের মানুষ এখানে আসতে পারে, শুধু জুতো খুলে আসতে হবে। গভর্নর জেনারেল লর্ড লিটন জুতো খোলেননি বলে শিখরা খুব অপমানিত হয়েছিল। সন্ধ্যায় আবার সেখানে গিয়ে লেখক গ্রন্থের (গ্রন্থ সাহেবের) আরতি দেখলেন। আরতি শেষে সকলকে মোহন ভোগ দেওয়া হল। দোলের সময় এই মন্দিরে বড় উৎসব হয়। 


অমৃতসরে রামবাগানের কাছে যে বাসায় তিনি থাকতেন তা ভাঙ্গা ও জঙ্গলময় ছিল। ভোরে বাগানে বেড়াতে ও দূর থেকে শিখদের সুমধুর সংগীত শুনতে তাঁর খুব ভালো লাগত। বাগানে মাঝে মাঝে ময়ূর আসত। একদিন আকাশে মেঘ দেখে ময়ূর নৃত্য করতে লাগল। লেখক তখন সেই নৃত্যের তালে তালে বীণা বাজালেন। ক্রমে এত গরম পড়ে গেল যে ঘরে আর থাকা যায় না। বাড়িওয়ালা তখন মাটির নীচের ঘরে থাকতে দিল লেখককে। সেই ঘরে পাশ দিয়ে আলো বাতাস আসে ও ঘর খুব শীতল থাকে। কিন্তু লেখক বুঝলেন তিনি মাটির নীচের ঘরে থাকতে পারবেন না। তিনি চান মুক্ত স্থান। তখন তিনি সিমলা যেতে মনস্থ করলেন। 


২০ এপ্রিল ১৮৫৭ সিমলার উদ্দেশ্যে তিনি যাত্রা করলেন। তিনদিনের পথ পেরিয়ে কালকা উপত্যকায় পৌঁছলেন। সামনে পাহাড় দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, এই ভেবে যে আগামীকাল তিনি সেই পাহাড়ের উপর উঠবেন, পৃথিবী ছেড়ে প্রথম স্বর্গের সিঁড়িতে আরোহন করতে। সেই শুরু হলো লেখকের হিমালয় দর্শন ও হিমালয় ভ্রমণ।

                       (চলছে)

বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪

১৩। রাজনারায়ণ বসুর আত্ম-চরিত


 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


রাজনারায়ণ বসুর আত্ম-চরিত ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে কুন্তলিনী প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। 

রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯) একজন ভারতীয় চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, বাগ্মী। তিনি বেশ কিছু অনুবাদ ও স্বতন্ত্র রচনা করেছেন। বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং ঋষি অরবিন্দ ঘোষ তাঁর দৌহিত্র। 

এই আত্মজীবনীটি অসমাপ্তভাবে লেখার পরে তিনি আরো ২৪-২৫ বছর বেঁচে ছিলেন অর্থাৎ ১৮৭৫ সাল নাগাদ এটি লেখা হয়। এই লেখায় শুধুমাত্র ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্য এই আত্মচরিত থেকে নেওয়া হল। 

১৮৪০-এ তিনি হেয়ার স্কুল থেকে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়ার সময়, ১৮৪৩ সালে রামগোপাল ঘোষের (ইয়াং বেঙ্গল গ্রুপের নেতা, ব্যবসায়ী, বাগ্মী, সমাজ সংস্কারক {জন্ম ১৮১৫ - মৃত্যু ১৮৬৮}। তিনি হিন্দু কলেজে পড়েছিলেন এবং সেখানকার ছাত্রদের নেত্রী স্থানীয় ছিলেন) সঙ্গে আলাপ হয়। রাজনারায়ণ বসু সেই বছর পুজোর সময় রামগোপাল ঘোষের সুন্দর ছোট স্টিমার 'লোটাস'- এ করে রাজমহল ও গৌড়ের ভগ্নাবশেষ দেখতে যান। রামগোপাল ঘোষ এর আগে ল্যান্ডর, মুসৌরি প্রভৃতি স্থানে গেছিলেন, যা তখনকার পক্ষে বীরপুরুষের কাজ। এই দুঃসাহসিক যাত্রায় ছেলে অংশ নেবে জানলে মা যেতে দেবেন না বলে রাজনারায়ণ বসু তাঁকে বলেন রামগোপালবাবুর দেশের বাড়ি বাঘাটিতে যাচ্ছেন। পরে পিতা মাকে সত্যি জানাবেন এই পরিকল্পনা ছিল। অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে তাঁরা রামগোপাল বাবুর বাড়ি উপস্থিত হলেন ব্যাগ তখনও ব্যবহার হতো না। তাঁরা প্রত্যেকে এক একটি কাপড়ের মোট নিয়ে স্টিমারে উঠে ত্রিবেনী পৌঁছলেন। আগে ত্রিবেণী, বলাগড়, শান্তিপুর প্রভৃতি স্থান খুব স্বাস্থ্যকর ছিল। লোকে কলকাতা থেকে জলবায়ু পরিবর্তন করার জন্য সেখানে যেত কিন্তু এখন সেগুলি ম্যালেরিয়ার আখড়া হয়েছে বলে লেখক আফশোস করেছেন। বাঘাটি ত্রিবেনীর কাছের একটি গ্রাম। সেখানে ক'দিন গ্রাম্য দুর্গাপূজা দেখে কাটালেন তাঁরা। তারপর মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা করা হলো। দিনগুলি খুব ভালো কাটতো সকালে উঠে চা-বিস্কুট, ডিম। দুপুরে বাঙালি মতে ডাল, ভাত, মাছের ঝোল আর রাতে ইংরেজি বা হিন্দুস্তানি মতে আহার হত। সকাল বিকাল দুই বেলা তাঁরা তীরে নেমে পাখি মারতেন বন্দুক দিয়ে। বঙ্গদেশের অক্সফোর্ড নবদ্বীপ পেরিয়ে বিল্বগ্রামে মদনমোহন তর্কালঙ্কার (কবি, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক, স্ত্রীশিক্ষার জন্য অনেক কাজ করেছেন) এসে যোগ দিলেন। তাঁরা মুর্শিদাবাদের ঘাটে পৌঁছালে সেখানে তাঁদের স্টিমারকে নবাবের মাল বোঝাই বড় নৌকা ধাক্কা মারলে তাঁদের ছোট স্টিমারের ক্ষতি হল। এর ফলে যে বিবাদ, মারামারি হয় তার ফল স্বরূপ মুর্শিদাবাদে থাকা তাঁরা নিরাপদ মনে করলেন না নিরাপদ মনে করলেন না। তখন তাঁরা রাজমহলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। রাজমহলে মুসলমান নবাবদের নির্মিত অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ দর্শন করেন। কাল পাথরের সিংহ দালান, যা নবাবের দরবার ছিল সেটি প্রধান দর্শনীয়। পরে যখন রাজমহল পর্যন্ত রেল হয় তখন এইসব স্থাপত্য বিনষ্ট হয়েছে। তারপর স্টিমারে রাজমহলের পাহাড়ের দিকে গঙ্গার যে খাঁড়ি গেছে তার ভিতরে কিছুদূর গিয়ে পাহাড়িদের নাচ গান উপভোগ করেন। তাঁরা তারপর রাজমহল থেকে মহানন্দা ও পদ্মা নদী দুটি সংগ্রাম সঙ্গমের দিকে যান। রাজমহল থেকে এই পথে জলদস্যুর ভয়ে তাঁরা স্টিমারের ডেকে বসে রাতে পাহারা দিতেন তরোয়াল হাতে। মহানন্দা নদীতে যখন স্টিমার এল গ্রামবাসীরা দল বেঁধে স্টিমার দেখতে এল কারণ তারা আগে কখনো তা দেখেনি। লেখকরা যখন কেউ গ্রামে কিছু জিনিস কিনতে যেতেন তখন গ্রামবাসীরা তাঁদের দেখে ভয়ে পালিয়ে যেত। একদিন মহানন্দার তীরে রাতে নোঙর করে থাকার সময় বাঘের ডাক শোনা গেল। ভোলাহাটে তাঁরা একটি কড়কড়ে পানিতে (ঘূর্ণি বা rapid) পড়ে অনেক কষ্টে উদ্ধার পেলেন। মালদায় পৌঁছে তাঁরা আট ক্রোশ নানা হিংস্র জন্তুতে পরিপূর্ণ নিবিড় বনের মধ্যে দিয়ে হাতির পিঠে করে বন্দুক হাতে নিয়ে চললেন গৌড়নগর-এর ভগ্নাবশেষ দেখতে। গৌড়ে তাঁরা কোতোয়ালীর ভগ্নাবশেষ, দেওয়ানখানার ভগ্নাবশেষ দেখলেন। ভাগ্যক্রমে বাঘ বা কোন হিংস্র জন্তু তাঁদের সম্মুখীন হয়নি। প্রকান্ড কয়েকটি পুস্করিণী দেখলেন, তাতে বড় বড় কুমির ভাসছে। একটি মনুমেন্টের মতো উঁচু মিনার দেখলেন। শুনলেন রাজজ্যোতিষীরা এখান থেকে অনেক আগে নক্ষত্র দেখতেন। 

১৮৪৬ সালে পুজোর সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তিনি উলুবেড়িয়া হয়ে দামোদর দিয়ে নৌকায় বর্ধমানে যান। এই ঘটনা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী পর্বে বর্ণিত হয়েছে। 

১৮৪৭ সালের পুজোর সময় আবার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌকায় রাজনারায়ণ বসু যাত্রা করেন। দেবেন্দ্রনাথের পরিবারও সেবার সঙ্গে ছিল। নবদ্বীপ ও চুপি পার হয়ে পাটুলির কাছে সন্ধ্যায় অস্বাভাবিক এক ঝড় এল। এর মধ্যে ডিঙ্গি করে পত্রযোগে খবর এল দ্বারকানাথ ঠাকুরের ইংল্যান্ডে মৃত্যু হয়েছে। 

১৮৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আসাম প্রদেশ দেখতে যাওয়ার জন্য স্টিমারে গঙ্গাসাগর, বড় সুন্দরবন হয়ে যাত্রা করেন রাজনারায়ণ। সুন্দরবনের খাল দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁরা স্টীমার থেকে দূরবীনে পাড়ে হরিণ চড়তে দেখতেন। এক রাতে বাঘের ডাক শুনেছিলেন। তিনি খাদ্যাভ্যাসে বাঙালি ছিলেন। বিজাতীয় খাবার খেতে খেতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে তিনি ঢাকায় পৌঁছে দেবেন্দ্রনাথের থেকে অনুনয়-বিনয় করে ছাড়া পেয়ে ঢাকার বন্ধুর বাড়ি গিয়ে মাছ ভাত খেলেন। 

পরবর্তীকালে ১৮৬০ সালে পুজোর সময় দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি রাজমহল যাত্রা করেন। তখন রেলপথ খুলেছে কিন্তু তাঁরা নৌকায় যান। কালো পাথরের সিংহদালান (যা রেলের অফিস রূপে ব্যবহৃত হচ্ছিল) ছাড়া আর কোন পুরাকীর্তি অবশিষ্ট ছিল না। 

দেওঘরে পরবর্তীকালে রাজনারায়ণ বসুর পশ্চিমের বাসগৃহ ছিল। ১৮৬৭ সাল থেকে পশ্চিমে বিভিন্ন কাজে সূত্রে বারংবার গিয়ে তিনি ভাগলপুর, এলাহাবাদ, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, কানপুর প্রভৃতি জায়গায় যান। আগ্রায় তাজমহল দর্শন করেন। কানপুরে বিঠুর গ্রামের বাল্মিকী তপোবনে যান। অবশ্য তিনি এই সমস্ত জায়গার কোনো ভ্রমণের বর্ণনা দিয়ে যাননি।

রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

১২। দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভ্রমণ

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


শিল্পোদ্যোগী দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬) দেশে বিদেশে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন। তিনি নিজে কোনো ভ্রমণকাহিনী লেখেন নি কিন্তু বিভিন্ন জনকে লেখা তাঁর কিছু চিঠিপত্র পাওয়া গেছে এবং কিছু চিঠিপত্র তৎকালীন 'ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। 

১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য পশ্চিম সফরে বেরিয়েছিলেন। তিনি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে ঘোড়ার গাড়িতে গেছিলেন। সঙ্গে বন্যপ্রাণী ও ডাকাতের আশঙ্কায় অনেক সশস্ত্র পাইক-বরকন্দাজ এবং চাকর, বেয়ারা, খানসামা, বাঙালি কবিরাজ, ইংরেজ ডাক্তার নিয়েছিলেন। এই ভ্রমণের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যের জন্য বাজার দেখতে যাওয়া। 

প্রথমে তিনি রানীগঞ্জের কয়লা খনি দেখেন ও ১৮৩৪ সালে সেটি কিনে নেন। তারপর তিনি গেলেন কাশী, সেখানে এমন ব্যবস্থা করলেন যে কাশীর জরি দেওয়া সব বস্ত্র কলকাতা হয়ে ইউরোপীয় নানা দেশের রপ্তানি হতে থাকল। সেখান থেকে তিনি যান এলাহাবাদ, তারপর আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন। এই পর্বের তাঁর ভ্রমণ সংক্রান্ত খবর খুবই কম পাওয়া যায় চিঠিপত্রের অভাবে। 

১৮৩৮ ও ১৮৪০-'৪১ এ তিনি আবার উত্তর-পশ্চিম ভারত ভ্রমণ করেছিলেন মূলত স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য। শুধু জানা যায় তীর্থস্থানগুলিতে তিনি অনেক দানধ্যান করেছিলেন। 

ইউরোপ যাত্রায় তাঁর উৎসাহের কারণ হাওয়া বদল স্বাস্থ্যের কারণে, নতুন দৃশ্য দেখা, ব্যবসার উন্নতির জন্য জনসংযোগ। ১৮৪২ -এর ৯ জানুয়ারি তাঁর নিজস্ব জাহাজ 'ইন্ডিয়া' করে তিনি বিলাত যাত্রা করেন। সঙ্গে ছিল ভাগ্নে চন্দ্র মোহন চট্টোপাধ্যায়, এক ইংরেজ ডাক্তার, এক সচিব, তিনজন ভৃত্য ও একজন মুসলমান বাবুর্চি। তিনি এই সময় ডায়েরি রাখতেন, যার থেকে তাঁর জীবনীকার কিশোরী চাঁদ মিত্র অনেক তথ্য ব্যবহার করেছেন তাঁর বইয়ে। কিন্তু সেই ডায়েরী পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

সিংহলে তিনি পাহাড়, গাছপালা শোভিত উপত্যকা, নারকেল গাছের শ্রেণী দেখে অত্যন্ত তৃপ্ত হন এবং স্বর্ণলঙ্কা নামের সার্থকতা উপলব্ধি করেন জমির উর্বরতার কারণে। সিংহলের পয়েন্ট দ্য গালে নোঙর করে স্থলভাগে নেমে তিনি ঘুরে দেখেন। দূরে দেখতে পান আদমের শিখর, যার উপর লোকে বলে কুড়ি ফুট লম্বা পায়ের চিহ্ন আছে। গালে দুর্গ, পোতাশ্রয় দেখেন। তাঁদের জাহাজ নোঙর করতেই সিংহলবাসী ছুটে এল পণ্যদ্রব্য ও ফলমূল বিক্রয়ের জন্য। এই দেশের ঘাট, প্রাসাদ সুন্দর ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ফল বাংলাদেশের তুলনায় বড় এবং রসালো। ফুলের রং বেশি উজ্জ্বল। 


এরপর 'ইন্ডিয়া' জাহাজ সুয়েজ বন্দরে এল। দ্বারকানাথ ও সঙ্গীরা বন্দরে নামলেন, জাহাজ কলকাতায় ফিরে গেল। ঘোড়ার গাড়িতে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তিনি মরীচিকা দেখলেন। মরুভূমির মধ্যে মধ্যে পান্থনিবাস ছিল, যেখানে তাঁরা আশ্রয় নেন। এই দীর্ঘ পথে হাট বাজার, দুর্গ, মসজিদ, প্রাসাদ, উদ্যান, হামাম, পিরামিড প্রভৃতি দেখলেন। সুব্রা হয়ে কায়রো গেলেন তিনি। তারপর স্টিমারে চললেন আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে নীলনদ হয়ে।

আলেকজান্দ্রিয়ায় তিনি দেখেন দেশীয় বসতিগুলি নোংরা ও ঘিঞ্জি। কিন্তু যে অঞ্চলে ইউরোপীয়দের বাস সেটি খুব সুন্দর। হোটেল আরামদায়ক ইউরোপীয় মানের। পাশার নতুন প্রাসাদ (১৮১৪ -তে তৈরি মিশরের শাসক ও আধুনিক মিশরের প্রতিষ্ঠাতা মোহম্মদ আলী পাশার প্রাসাদ) দেখে তিনি মুগ্ধ হন। প্রাসাদের খুব কাছে সমুদ্র তীরে একটি স্নানের জায়গা আছে। সেই ঘরে প্রায় ৬০ ফুট পর্যন্ত সমুদ্রের জল ঢুকে গেছে। ৪ ফুট গভীর সমচতুর্ভুজ একটি ৪০ ফুট চৌবাচ্চায় সর্বক্ষণ সমুদ্রের জল এসে পড়ে তিনদিক থেকে। 

মালটায় তাঁদের কোয়ারেনটিনে থাকতে হল। সমুদ্রের ধারে আরামদায়ক হোটেলে পূর্ণ বিশ্রাম আর পায়ে হেঁটে শহর ঘুরে দেখতে তাঁর ভালই লাগছিল। মালটা থেকে ভালেত্তা গেলেন। সেখানকার গির্জা, ক্যাথিড্রাল অপূর্ব সাজসজ্জা দেখে মুগ্ধ হন, যদিও তিনি জানতেন রোমের স্টেন্ট পিটার্স গির্জার তুলনায় এই সেন্ট জন ক্যাথিড্রল কিছুই নয়। ভারতবর্ষের মন্দির, মসজিদ, চার্চগুলি ইউরোপের এই ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। এখানে তিনি অপেরা দেখেন। তারপর ব্রিটিশ রণতরী 'কুইন' দেখে আসেন। একটি শিশু বিদ্যালয় দেখে মনে করেন এই শিক্ষা পদ্ধতি অত্যন্ত উন্নত কারণ শিশুদের সেখানে আটকে রাখা হয়নি, তারা নিজেরাই সেখানে থাকতে ভালোবাসছে। মালটা দ্বীপের সর্বোচ্চ স্থান থেকে বহুদূর পর্যন্ত এমনকি সিসিলি দ্বীপের মাউন্ট এটনা পর্যন্ত দেখা যায়। 


এরপর সিসিলি দ্বীপে মাউন্ট এটনা, সুন্দর শহর মেসসিনা, এওলিয়ান দ্বীপ, স্ট্রম্বেলি আগ্নেয়গিরি দেখে তিনি নেপলস গেলেন। এই শহরে সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ হলেন। খুব চওড়া রাস্তা, ধুলোবালি নেই, রাতে গ্যাসের আলোয় দোকান আলোকিত বলে রাস্তা ঝলমল করে, কফি হাউসগুলি খুব সুন্দর করে সাজান। সান কার্লো থিয়েটার হল ইউরোপের সবথেকে বড় থিয়েটার, তার অভ্যন্তরীণ সাজ সজ্জা অনবদ্য। 

এবার তিনি চললেন রোমে। এই যাত্রা করেছিলেন নিজের চার ঘোড়ার গাড়িতে, যার ঘোড়া প্রতি দশ মাইল অন্তর পরিবর্তন করার ব্যবস্থা ছিল। দ্বারকানাথ কখনো হিমালয়ে যাননি। পাহাড়ি পথ পেরতে তিনি রোমাঞ্চিত, আনন্দিত ও অল্প শঙ্কিত হচ্ছিলেন। রোম শহরের সৌন্দর্য নিজে চোখে না দেখলে বোঝা সম্ভব নয় বলেছেন তিনি। সেন্ট পিটার্স চার্চের বিশালত্ব, সাজসজ্জা, বৈচিত্র্য, শিল্প, স্থাপত্য দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তাছাড়া আরো অনেক প্রদর্শনশালা, চিত্রকলা, ফোয়ারা, গ্রন্থাগার প্রভৃতি দেখেন। সেখানকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া তিনি খুব উপভোগ করেন। তিনি এবার পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পোপের প্রাসাদে। প্রথম একজন ভারতীয়কে দর্শন করে আনন্দ প্রকাশ করেন। তাঁদের সাক্ষাৎ হয় একটি গ্রন্থাগারে, সেটি এত বড় যে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখা শক্ত। তিনি শুনেছিলেন পোপের প্রাসাদে বারো হাজার ঘর আছে, সেগুলি মহান শিল্পীদের চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে সুসজ্জিত। 


এরপর ফ্লোরেন্স, বোলোনা, পাদুয়া হয়ে তিনি ভেনিসে গেলেন। ভেনিসে রাস্তায় সর্বত্র জল দেখে অবাক হলেন। আল্পসের সৌন্দর্যে মোহিত হলেন। 

জার্মানির মধ্যে দিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঘোড়ার গাড়িতে চললেন। জার্মানির শিক্ষার মান দেখে প্রশংসা করেছেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে রেলে মেনটস গেলেন। সেখান থেকে ভাসমান সেতুতে রাইন নদী পার হয়ে স্টিমারে কোলন যান। সেখানকার ক্যাথিড্রাল ভালো লাগে তাঁর। 

এরপর রেইনবো নামের স্টিমারে ইংলিশ চ্যানেল পার হন তাঁরা। ডোভার ও ক্যান্টারবেরি হয়ে তিনি ১০ জুন (কলকাতা ছাড়ার পাঁচ মাস দুই দিন পর) লন্ডনে পৌঁছান। 

লন্ডনের নগরজীবনের প্রাণচাঞ্চল্য, যানবাহন, দোকান এবং শহরের মানুষরা তাঁকে আলোড়িত করেছিল। রাজপরিবার ও অভিজাতরা তাঁর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলেন। এখানকার অভিজাতদের বাগান দেখে নিজের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির বাগান সম্পর্কে তিনি হতাশা প্রকাশ করেছেন। মহারানী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক তিনি আমন্ত্রিত হন তিনি। সেখানকার জগৎ বিখ্যাত সাহিত্যিক ওয়াল্টার স্কট, চার্লস ডিকেন্স প্রমুখের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। 

এরপর তিনি স্কটল্যান্ড বেড়াতে গেলেন। সেখানকার গ্লাসগো, এডিনবরা দেখলেন। ইংল্যান্ডের লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, শেফিল্ড গেলেন। এইসব স্থানের শিল্পপ্রযুক্তির বিষয়ে তিনি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। 

এবার তিনি গেলেন ব্রিষ্টল এবং রাজা রামমোহন রায়ের জঙ্গলাকীর্ণ সমাধি থেকে তাঁর দেহাবশেষ স্থানান্তরিত করে আর্নোস ভেলে ভারতীয় স্থাপত্যে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। 

১৫ই অক্টোবর ১৮৪২ জাহাজে উঠে তিন দিন পরে তাঁরা প্যারিস পৌঁছান। তিনি প্যারিসকে সৌন্দর্য ও প্রাণোচ্ছলতায় পূর্ণ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার তীর্থ হিসেবে বর্ণনা করলেন তিনি। প্যারিসের প্রবেশপথ এবং প্যারিসের আলোকোজ্জ্বল সৌন্দর্যে তিনি বিমুগ্ধ হন। ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ তাঁকে আপ্যায়ন করেছিলেন। 

১৮৪২ -র ৯ অক্টোবর স্বদেশে ফেরার জন্য দ্বারকানাথ মার্সেই থেকে রওনা দেন। কলকাতায় এসে পৌঁছান ডিসেম্বর মাসে, প্রায় এগারো মাস বিদেশে কাটানোর পরে। 


দ্বারকানাথের দ্বিতীয়বার বিদেশ সফর শুরু হয় ১৮৪৫ এর ৮ই মার্চ কলকাতা থেকে 'বেন্টিংক' জাহাজে। এবার সঙ্গে ছিল ১৬ বছর বয়েসি কনিষ্ঠ পুত্র নগেন্দ্রনাথ, ভাগ্নে নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ব্যক্তিগত ইংরেজ চিকিৎসক, প্রাইভেট সেক্রেটারি, তিনজন ভৃত্য। 

এবার কায়রোতে ওটোমান সাম্রাজ্যের ভাইসরয় ও মিশরের শাসক মোহম্মদ আলী পাশা তাঁকে খুব সমাদর করেন। 

নেপলস্ বন্দরে তাঁর জাহাজ পৌঁছালে তাঁকে তোপধ্বনিতে আহ্বান জানান হয়। এরপর পিসা, জেনোয়া হয়ে প্যারিস যান তিনি। 

ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ প্রায়ই তাঁকে রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ করতেন। লন্ডনে তিনি রানীর কাছে আমন্ত্রণ পান এবারও। পরে প্যারিসে বেশ কিছুকাল কাটিয়ে লন্ডন ফেরেন। 

উশৃঙ্খল আমোদপ্রমোদময় জীবনযাপন ও বিশ্রামের অভাবে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। অমিতব্যয়িতার কারণে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। 

অবশেষে, আগস্ট ১৮৪৬ -এ লন্ডনের সেন্ট জর্জেস হোটেলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ভারতীয় রাজকীয় পোশাক আর অসম্ভব দানশীলতা তাঁকে প্রিন্স হিসেবে লন্ডন ও প্যারিসবাসীর মধ্যে পরিচিত করেছিল। কেনসাল গ্রীনের সমাধিক্ষেত্রে তাঁর দেহ সমাহিত হয় যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে। যদিও তাঁর সমাধিটি তাঁর বর্ণময় জীবনের তুলনায় অত্যন্ত সাধারণ। 

তথ্যসূত্র: Memoir of Dwarakanath Tagore - কিশোরীচাঁদ মিত্র (১৮৭০)

শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

১১। রাজা রামমোহন রায়ের ভ্রমণ

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


নবযুগের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২ - ১৮৩৩) তাঁর জীবনকালে বেশ কিছু ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু তিনি কোন ভ্রমণ কাহিনী লেখেন নি। তবে তাঁর লেখা চিঠিপত্র থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায় এবং তাঁর জীবনীকারেরাও সেই সব তথ্য দিয়ে গেছেন। তাই রাজা রামমোহন রায়ের ভ্রমণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য না পাওয়া গেলেও কিছু তথ্য পাওয়া যায় যা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। 

মাত্র ষোলো বছর বয়সে রাজা রামমোহন রায় "হিন্দুদের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী" নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই উপলক্ষে পিতার সঙ্গে তাঁর সংঘাত হয়েছিল এবং তিনি গৃহত্যাগ করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। এই দেশভ্রমণ কালে তিনি সেইসব স্থানের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার জন্য বিভিন্ন ভাষা শিখেছিলেন। এর আগে তিনি সংস্কৃত ও পারসী ভাষায় দক্ষ ছিলেন। ভারতের ঠিক কোথায় কোথায় তিনি গিয়েছিলেন তা জানা যায় না। 


অবশেষে সেই কিশোর বয়সে কিশোর রামমোহন হিমালয় পার হয়ে তিব্বতে যান। প্রধানত বিদেশী শাসকের প্রতি ঘৃণার কারণে ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার উদ্দেশ্যে তিনি তিব্বত গেছিলেন। নিঃসম্বল কিশোরটি কী অসম্ভব কষ্ট করে, এতদিন পূর্বে, কত দুর্গম পথ অতিক্রম করে তিব্বতে পৌঁছেছিল তা অভাবনীয়। তিব্বতে গিয়ে তিনি দেখেন লামারা সেখানে অবতারের স্থান নিয়েছেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম পৌত্তলিকতা ও অন্য নানা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে পড়েছে। তিনি প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেখানকার মানুষদের বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন। কিন্তু কোমল হৃদয় মহিলারা তাঁকে বারবার উদ্ধার করেছেন। তিনি পরে বলেন যে তিব্বতি মহিলাদের এই সস্নেহ ব্যবহার তাঁকে নারীদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল করেছিল। তাঁর এই কিশোর বয়েসের ভ্রমণ সম্পর্কে তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'সংবাদ কৌমুদী' পত্রিকায় তিনি পরে লিখেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই সব লেখা পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 



ইউরোপীয়দের ধর্ম, রাজনীতি, আচার ব্যবহার স্বচক্ষে দেখে জ্ঞানলাভ করার জন্য বিলাত যাত্রায় রামমোহন আগ্রহী ছিলেন। কিন্ত বিলেত যাত্রার প্রয়োজনীয় অর্থ তাঁর ছিল না। সেই অর্থসমস্যা সমাধান হয় যখন দিল্লির বাদশা দ্বিতীয় আকবর শাহ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক কিছু অধিকার থেকে চ্যুত হওয়াতে ইংল্যান্ডের রাজ দরবারে আবেদন করার জন্য রামমোহন রায়কে প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করতে চান। এছাড়া তাঁর বিলাত যাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন সনদের বিচারে উপস্থিত থাকা। এই সনদের দ্বারা ভারতবর্ষে আগামী দিনে দীর্ঘ কালের জন্য ভারতীয়দের প্রতি ব্যবহারের নীতি নির্ধারণ হবে। সতীদাহ বিষয়ক প্রিভি কাউন্সিলে আপিলের শুনানি হওয়ারও কথা ছিল। রামমোহন রায়ের বিদেশ যাত্রার পূর্বেই তাঁর কীর্তির খ্যাতি ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইংল্যান্ড যাত্রার পূর্বে বাদশা আকবর শাহ্ (দ্বিতীয়) তাঁকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন।   


১৮৩০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজা রামমোহন রায় তাঁর পালিত পুত্র ১২ বছরের রাজা রাম এবং ভৃত্যদ্বয় রামরত্ন মুখোপাধ্যায় ও রামহরি দাসকে নিয়ে অ্যালবিয়ান নামক জাহাজে বিলাত যাত্রা করেন। দুধপানের সুবিধার জন্য সুবিধার জন্য জাহাজে তিনি দুটি দুগ্ধবতী গাভী নিয়ে যান। কোন সমুদ্র পীড়া তাঁর হয়নি কিন্তু তাঁর সঙ্গীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি পথে উত্তমাশা অন্তরীপে নেমেছিলেন। 


১৮৩১ সালের ৮ ই এপ্রিল চার মাস তেইশ দিনে জাহাজ গন্তব্য লিভারপুলে পৌঁছায়। এপ্রিল মাসের শেষে তিনি রেলপথে লিভারপুল থেকে লন্ডনে যান। পথে সুন্দর বাড়ি ঘর, উদ্যান, সেতু, কৃত্রিম হ্রদ-খাল প্রভৃতি দেখে বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় তিনি খুব আনন্দ পান এবং ভারতবর্ষের দারিদ্র্যের কারণ উপলব্ধি করেন। পথে তিনি ম্যানচেস্টার শহরে যান এবং সেখানকার কারখানা দেখে ও কারখানায় নারী পুরুষকে কাজ করতে দেখে আনন্দিত হন। দরিদ্র স্ত্রী পুরুষরা ভারতের রাজা এসেছে শুনে কাজ ছেড়ে তাঁকে দেখতে ভিড় জমায়। 


ইংল্যান্ডের সর্বত্র ও লন্ডনে বিখ্যাত জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা তাঁর সঙ্গে এসে দেখা করেন। তাঁর বিপুল খ্যাতি আরো সুদূর প্রসারী হয়। লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁর সম্মানে ভোজসভা অনুষ্ঠিত করেছিল। 

১৮৩২ এর শরৎকালে তিনি ফ্রান্সে যান। সঙ্গী হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট মানবহিতৈষী ডেভিড হেয়ারের এক ভাই। ফ্রান্সের সম্রাট লুই ফিলিপ তাঁকে আমন্ত্রণ করে একত্রে ভোজন করেছিলেন। 


১৮৩৩ -এর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ব্রিষ্টল আসেন। লন্ডনের তুলনায় শান্ত শহরটিতে এসে তাঁর ভালো লেগেছিল। কিন্তু অসুস্থ হয়ে সেখানেই ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ তিনি দেহত্যাগ করেন।
স্টেপলটন গ্রোভের কাছে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়েছিল। তাঁর বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুর পরে বিলেতে গিয়ে সেই হতশ্রী সমাধি থেকে তাঁর দেহাবশেষ স্থানান্তরিত করেন আর্নোস ভেলে এবং ভারতীয় স্থাপত্যে সুন্দর সমাধিটি তৈরি করিয়ে দেন।

তথ্য সূত্র: মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় - নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (১৮৮২)।

বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০২৪

১০। তীর্থ মঙ্গল ৫ বিজয়রাম সেনবিশারদ

      সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                        ---- সুমনা দাম 

              (আগের পর্বের পরে)

এবার ফেরার পালা। প্রথমে ফতুয়ার উদ্দেশ্যে সবাই রওনা দিলেন। নৌকা জুড়াগ্রাম, গাজীপুর হয়ে মুরদপুরে রাত্রিবাস। সেখানে আছেন লিঙ্গদেব রামেশ্বর, যা শ্রীরামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত বলে কবি বলেছেন। ভোজপুরের অধীনস্থ অর্জুনপুরে রাত্রিবাস। শোন নদী বামে রেখে আর ডানে গঙ্গা - এর মধ্যে দিয়ে নৌকা চলল। সেরপুর, দানাপুর (এখানে ইংরাজের কেল্লা অর্থাৎ ছাউনি রয়েছে) হয়ে নৌবহর পাটনায় পৌঁছালো। অনেক যাত্রীকে কর্তা টাকা দিয়ে বাড়ি পাঠালেন ও নিজে মাস খানেক পাটনায় থাকলেন।


কাশী থেকে খিদিরপুর (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে, উল্লেখ্য যে সেই ভ্রমণটি হয়েছিল নদীপথে)


তারপর পালকি করে কর্তা ফতুয়া গেলেন। ফতুয়া থেকে আবার নৌকা যাত্রা। মুনসিকে কর্তা এখানে বিদায় দিলেন। দূরে গৌরীশংকর পাহাড় দেখা গেল। চৌকিঘাটা, দরিয়াপুর, সূর্যগড় হয়ে নৌকা মুঙ্গের এলো। সীতাকুণ্ডে গিয়ে সবাই পুজো দিলেন। তারপর জাংগিরা, সুলতানগঞ্জ হয়ে পাহাড়ের ওপর বটেশ্বর শিব দর্শন করলেন। ভাগলপুর, চম্পা নগর, সুজাগঞ্জ হয়ে পাথরঘাটায় নৌকা এলো। রাত্রি বাস হল পীরপৈতিতে। তেলিয়াগড়ী, সকরিগলি হয়ে রাজমহলে রাত্রি বাস। এরপর নৌকা চলাকালীন জলে তুফান দেখে ভয়ে নদীর পাশে কাশবনে নৌকা ভিড়িয়ে রান্না হল। কাদা জলের মধ্যে বাঘের ডাক শুনতে শুনতে রান্না ও খাওয়া হলো। নৌকা আবার চলল। খেজুরিয়া, সুতী হয়ে দক্ষিণমুখী হয়ে নৌকা চলতে লাগলো। সাহেবঘাটা এলো, সেখানে পীরজাদা সাহেব আছেন। পীরজাদা সাহেব এক মুসলমান ফকির। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাঁর কাছে যেত। পারসী ভাষা ব্যবহার করে কবি বলেছেন যে তাঁর বড়ই বারগা অর্থাৎ মাহাত্ম্য। এরপর ফতুল্লাপুর অর্থাৎ ফতেউল্লাপুর, দুর্গাপুর, জঙ্গিপুর, লক্ষ্মীপুর হয়ে মকুসুদাবাজ অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ এল। সাধকবাগে স্নান খাওয়া করা হলো। পশ্চিম পাড়ে হিরাঝিল, সেঠের বাগান। পরদিন কিরিটেশ্বরী পূজা দিতে গেল সবাই। এবার বামে মঙ্গলটুলি নবাবের বাড়ি রেখে নৌকা চলল। ডানে সাঁইকুলী আর ডাহাপাড়া পেরিয়ে কাশিমবাজার এল নৌকা। কাশিম বাজার বড় শহর, বড় বড় মানুষের বাস। সয়দাবাজ অর্থাৎ সৈয়দাবাদ, খিদিরপুর, চুমরিগাছা, শ্রীশ্যামনগর, পলাশী হয়ে কাটোয়ায় নৌকো এলো। ডানে বারবাজার, বামে মাটিয়ারী। রঘুনন্দন মিত্রের দ্বাদশ শিব মন্দির। তারপর দাই, বুড়ারানীর ঘাট, মানিকচন্দ্রের ঘাট হয়ে ক্রমে অগ্রদ্বীপে নৌকা এলো। সেখানে চৈতন্যদেবের শিষ্য গোবিন্দ ঘোষ ঠাকুরের বাড়ীতে শ্রী চৈতন্যদেব প্রতিষ্ঠিত গোপীনাথ ঠাকুরের মন্দির। কিন্তু গোপীনাথ রাজা নবকৃষ্ণের বাড়িতে (কলকাতার শোভাবাজারের রাজবাড়িতে) আছেন তাই যাত্রীরা দর্শন করতে না পেয়ে আক্ষেপ করল। কাশীপুর, ঘোড়াইক্ষেত্র, গোটপাড়া এল। সিকিরাগাছি, বালডাঙ্গা, মেড়তলা হয়ে নৌকা নবদ্বীপ এলো। সেখানে নাকি সতেরোশ ব্রাহ্মণ আছে, অধ্যাপকও অনেক। তেমোহনি দিয়ে নৌকা পড়ে খরড়ার জলে। গোকুলগঞ্জের ঘাট হয়ে শান্তিপুর এলো। ক্রমে ক্রমে গুপ্তিপাড়া, ফুল্যা-নবলা, হরধাম, সোমড়া, চাকদহ, জিরাট, কাঁচরাপাড়া, হালিশহর, ত্রিবেনী, বাঁশবেড়িয়া, হুগলি, চুঁচুড়া, ফরাসডাঙ্গা,গৌরহাটি, নিমাই তীর্থ ঘাট, মুনিরামপুর, দীঘাঙ্গ, মাহেশ (এখানে জগন্নাথ দেব আছেন, যাত্রীরা নৌকা থেকে নমস্কার জানালো), কোন্নগর, আগরপাড়া, সুকচর (এখানে দামামায় সাড়া দিল কারণ এখানে দেওয়ানজির গ্রাম), বালি, বরানগর, চিৎপুর হয়ে কলিকাতা শহর পৌঁছাল। এভাবে খিদিরপুর গঙ্গার ঘাটে নৌকা এলো। যাত্রা শেষ হলো। বহু লোক শুধু তীর্থযাত্রীদের দর্শনে পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যেই এলো। কর্তা ধুমধাম করে তীর্থশ্রাদ্ধ করলেন। এভাবেই কবি বিজয় রামের তীর্থ মঙ্গলকাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটলো



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...