শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০২৪

২১ | তীর্থ ভ্রমণ ৬ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

জয়পুর ত্যাগ করে বগড়ু (বগরু) নামের স্থানে পৌঁছলেন লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা। সেখানে রানীর এক বাগান আছে। তাতে রানী প্রতিষ্ঠিত শিব আছে, মিষ্টি জলের কুয়া আছে। সামনে রাজার সৈন্য ও ছটি কামান রয়েছে। সেখানে রাত্রি বাস। তারপর পাড়ু, বাঁদরিসুদরি (বান্দর সিন্দরি) পেরিয়ে এলো কৃষ্ণগড় (কিশানগড়)। এখানকার রাজা স্বাধীন। রাজধানী খুব সুন্দর। রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলার ব্যবস্থা খুব ভালো। সুন্দর বাগান, ধর্মশালা আছে। লেখকেরা রাজবাড়ী, কেল্লা ও শহরের সর্বত্র ঘুরে দেখলেন। পরবর্তী পথে পরল বাণ নদী (ওল্ড ক্যানাল?)। এই নদীতে সম্বর লবণ জন্মায়। তারপরে কাউড়ি পেরিয়ে বুড়া পুষ্কর এল। এটি একটি বড় কুণ্ড। কুণ্ডের চারপাশে পাকা ঘাট। পঞ্চম দিনে এলো ব্রহ্মপুষ্কর। 



  জয়পুর থেকে আজমীর (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


এখানে শিব মন্দির ও অতিথি শালা আছে। লেখক লিখেছেন যে পুষ্কর তীর্থ সকল তীর্থের গুরু। এখানে তিনটি পুষ্কর আছে। বুড়া পুষ্কর, মধ্য পুষ্কর ও কনিষ্ঠ পুষ্কর। এই তিন পুষ্কর শিব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা  এই ত্রিদেবের যজ্ঞস্থান। বুড়া পুষ্কর শিবের, মধ্য পুরস্কার বিষ্ণুর ও কনিষ্ঠ পুরস্কার ব্রহ্মার যজ্ঞভূমি। এই কুন্ডের পরিক্রমণ করতে পাঁচ ক্রোশ পথ হাঁটতে হয়। কুন্ডের চারদিকে মন্দির ও বসতি। কুন্ডের জল সুনির্মল, তাতে শ্বেতপদ্ম ফুটে কুণ্ডের শোভাবর্ধন করছে। জলজন্তুর মধ্যে নানারকম মাছ, মকর (শুশুক), কুমীর প্রভৃতি আছে। পুষ্করের পান্ডারা বেদজ্ঞ, সৌম্য, যা দেওয়া হয় তাতেই তাঁরা সন্তুষ্ট। 


এখানে সাবিত্রী পাহাড় নামে তিন ক্রোশ উঁচু এক পাহাড় আছে। সাবিত্রী দেবীর মন্দির তার চূড়ায় অবস্থিত। মন্দিরে সরস্বতী মূর্তি আছে। এক ব্রাহ্মণ বাঙালি কন্যা বিধবা হয়ে প্রায় চল্লিশ বছর ওই সম্পূর্ণ নির্জন পাহাড়ে থেকে সাবিত্রীর তপস্যা করেন। রাতে পূজারীরাও পাহাড় থেকে নেমে আসেন, কিন্তু ওই তপস্বিনী একা থাকেন। পর্বতে নানা হিংস্র জন্তু আছে। পাহাড়ের উপরে পথের মধ্যভাগে এক উদাসীন (তাঁর বয়স একশ বছরের বেশি হবে) একা থেকে তপস্যা করেন।


পুষ্করে ১৫ টি ঘাট আছে। যথা চন্দ্রঘাট, বরাহঘাট (এখানে বরাহদেবের মূর্তি আছে), সাবিত্রীঘাট, রাজঘাট, ব্রহ্মাঘাট, সপ্তর্ষিঘাট প্রভৃতি। কুণ্ডের পশ্চিম দিকে ব্রহ্মার মন্দির, যে স্থানে তিনি যজ্ঞ করেছিলেন। মূর্তির বাম দিকে গায়ত্রী দেবীর মূর্তি। মন্দিরের দালানে নারদের একটি প্রতিমূর্তি আছে। ঘাটের কাছে অটমটেশ্বর শিব আছেন। সমভূমি থেকে আট হাত নীচে শিবের স্থান। পুষ্কর তীর্থের আদি দেব অটমটেশ্বর। প্রথমে এই শিব পূজা করে সকল দেব দর্শন ও পূজা করতে হয়। এইসব দুর্গম নির্জন তীর্থের কোন কোন স্থানে একাকী কিছু সন্ন্যাসী বা তপস্বী বাস করেন। পুষ্কর তীর্থের পরিক্রমা পঞ্চক্রোশী, পর্বতের ভিতর দিয়ে পথ। এর মধ্যে অনেক তীর্থ আছে। মরীচী, অঙ্গিরা, অত্রি, পুলস্ত প্রভৃতি মুনিদের কুটির আছে। আছে নাগ কুণ্ড, বামদেব কুণ্ড, ভৃগু কুণ্ড, কপিল কুণ্ড প্রভৃতি তীর্থস্থান। কপিল আশ্রম হয়ে পর্বতের গুহায় ঢুকে চারশ হাত ভিতরে গিয়ে কপিলেশ্বর শিব আছেন। অন্য এক গুহার মধ্যে বেশ কিছুটা সুড়ঙ্গে গমন করে নীলেশ্বর শিবের দর্শন করতে হয়। কিছুদিন পুষ্করে থেকে লেখক এবং তাঁর সহযাত্রীরা সমস্ত দেবদেবী, তীর্থস্থান দর্শন করে আজমীরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।


পুষ্কর থেকে আজমীর আট ক্রোশ পাহাড়ি পথ। আজমীর শহরে অনেক ধনী ব্যক্তি বসবাস করেন। সুন্দর সুন্দর শ্বেত পাথরের ভবন, খোদিত মূর্তি দ্বারা সজ্জিত। কিন্তু জল নিকাশি ব্যবস্থা নেই। যোধপুরের রাজা শাসন করেন এই স্থান। রাজার কেল্লা পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। শহরে নানা রকম জিনিসের দোকান আছে, তার মধ্যে শ্বেত পাথরের বাসন, দেবদেবীর মূর্তি, সিংহাসন, কৌচ, কেদারা ইত্যাদি খুব ভালো পাওয়া যায়। 


আজমীরে খাজা সাহেব বলে এক পীর আছেন, তাঁর বড়ই মাহাত্ম্য। হিন্দু মুসলমান সবাই তাঁর  দর্শনে যায়। এখানে লেখক তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। পূর্বে এখানে চন্দ্রনাথ নামে শিবের স্থান ছিল। একজন মুসলমান ভিস্তি জলসমেত তাঁর ভিস্তি একটি গাছের ওপর রেখে খাচ্ছিলেন। ফোঁটা ফোঁটা জল শিবের মাথায় পড়ছিল। সেই জল পেয়ে শিব সন্তুষ্ট হয়ে ভিস্তিকে বলেন যে তিনি তৃপ্ত হয়ে ভিস্তিকে বর দিতে চান। ভিস্তি তখন শিবের কাছে বর চান যে এই স্থানে শিবের যে নাম আছে তা অপ্রকাশিত হয়ে যেন তাঁর নাম প্রকাশিত হয়। শিব তাই বর দান করেন। শিবের স্থানের উপর মসজিদ, কবর হয় এবং তিনি খাজা সাহেব নামে খ্যাত হন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধরেরা বজায় রেখেছেন সেই ঐতিহ্য। ফকির প্রতিদিন শিবের পুজো ও খাজা সাহেবের শিরনি দুই দেন এখানে একসঙ্গে। এখানে মানত করলে তা পূর্ণ হয় বলে প্রচলিত আছে। দিল্লির বাদশা এই মসজিদ নানা রকম প্রস্তরে খোচিত করে স্তম্ভাদি নির্মাণ করিয়ে দিয়েছেন। সামনের নাটমন্দিরে নর্তকীরা, সর্বদা নৃত্য-গীত-বাদ্য করে। অতিথিশালায় অনেক ফকির বাস করেন।



আজমীর থেকে জয়পুর হয়ে মথুরা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)



আজমীর থেকে লেখকেরা আবার মথুরায় ফিরে চললেন। কৃষ্ণগড় (কিষানগড়), পরাসনি (পড়াসোলি গ্রাম), দুদুগ্রাম (দুদু), বগড়ু গ্রাম (বগরু), বড়েনা গ্রাম (?), বাউড়ি (?) হয়ে পঞ্চম দিনে তাঁরা জয়পুর পৌঁছলেন। আবার সব দেবদেবী দর্শন করে, নগর ভ্রমণ করে বেড়ালেন। রাজার বাগানে বাঘ, হরিণ, পুষ্করিণীতে জলচর পাখি দেখে আনন্দ পেলেন। এরপর ঘাট দরজা (ঘাট গেট, জয়পুর), মোহনপুরা (মোহনপুরা), দোশাগ্রাম (দোসা), সেকেন্দরা (সিকান্দ্রা), বেশোড়া (?), ছোকরাবার (?), গাগরাআনি (?), শোক (শোঙখ), সসা (শোনশা) হয়ে দশম দিনে মথুরা এলেন। 


এবার বৃন্দাবনে লেখক ঝুলন দর্শন করার সুযোগ পেলেন। বিভিন্ন মন্দির স্বর্ণ নির্মিত হিন্দোলা (দোলনা), ঝাড় লন্ঠন, বড় বড় আয়না, নানা রকম দ্রব্য দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা মেলাও হয়। ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনের ফুলদোলের সময় কুম্ভের মেলা হয় প্রতি বারো বছর অন্তর। ফুলদোলে বৃন্দাবন পরিক্রমার মেলা শেষে সবাই হরিদ্বারে যায়। এই সময় বৃন্দাবনে নানা দেশ থেকে বৈষ্ণব, সন্ন্যাসী, গোস্বামী, মোহন্ত, নাগা প্রমুখরা আসেন ও যমুনার চরে থাকেন। চতুর্দিক মুখরিত হয় পূজাপাঠ, গীতবাদ্যে।বৃন্দাবনে বারোটি আখড়া আছে। এই সময় আখড়াধারীরা আপন আপন গদি থেকে আসেন। তাঁদের সঙ্গে আসে হাতি, ঘোড়া, উট, নীলগাই, হরিণ, নীল বানর প্রভৃতি। আখড়ার মোহন্ত আখড়ার রুপার হাওদা দেওয়া, সোনা রুপার নিশান সম্বলিত হাতির উপরে চড়ে ঘোরেন। শ্বেত চামরের ব্যজন দিয়ে তাঁর সেবা করা হয়। সঙ্গে আসে সোনা রুপোর বল্লম হাতে তিন চার শত নাগারক্ষী। 

                      (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৪ আষাঢ় ১২৬১ (৮ জুন ১৮৫৪) থেকে ৪ চৈত্র ১২৬১ (১৮ মার্চ ১৮৫৪)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০২৪

২০। তীর্থ ভ্রমণ ৫ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


     সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                    (আগের পর্বের পরে)

অনধিক দুই সপ্তাহ মথুরায় থাকার পর এবার নতুন পথে নতুন সঙ্গীদের সঙ্গে যাত্রা শুরু হল। এবার লক্ষ্য জয়পুর ও পুষ্কর তীর্থ। শনশাগ্রাম (শোনশা, উত্তর প্রদেশ), শোঙ্ক (শোঙখ), কুম্ভীরা (কুমহের, রাজস্থান) হয়ে চললেন। কুম্ভীরাতে ভরতপুরের রাজার কেল্লা আছে। শহরে অনেক ধনীর বসবাস। দ্বারে দ্বারে রক্ষী দিয়ে শহর সুরক্ষিত। কেল্লার মধ্যে বড় বড় কামান আছে আর কেল্লা প্রাচীরে ঘেরা। বুরুজের ঘরে গুলি চালানোর ফোঁকর আছে। কুম্ভীরা ছেড়ে হেলেনাগ্রাম (হোলেনা, রাজস্থান)। সেখানে রানীর তলাব বা পুষ্করিণী আছে, চতুর্দিকে সান বাঁধানো ঘাট। মধ্যে মধ্যে বুরুজ আছে। তার উপরে ঘর, ধর্মশালা মহাবীরের স্থান, শিব মন্দির, বৈষ্ণব আখড়া, সব রয়েছে। এরপর মৌয়া (?), বিশড়া (বসরা,রাজস্থান), সেকেন্দরা (সিকান্দ্রা), মোহনপুরা (মোহনপুরা) হয়ে জয়পুর পৌঁছানো হল প্রায় ১২ দিনে। পথে নানা স্থানে পর্বত জঙ্গল আছে। পথ খুব খারাপ। তিন ক্রোশ অন্তর একটি করে গ্রাম মেলে।

 

মথুরা থেকে জয়পুর লেখক বর্ণিত পথে (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


জয়পুর শহরের রাস্তা চৌপাড়বন্দী অর্থাৎ পাশার ছকের আকারে চারিদিকে সমান চওড়া রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে সুন্দর সুন্দর শ্বেত পাথরের বাড়ি, তাতে নানা প্রকার দেব মূর্তি ও অন্যান্য মূর্তি খোদিত আছে। ওই বাড়িগুলি ধনী শেঠেদের বাসস্থান। বাড়ীর নিচের তলায় দোকান। এক একটি পট্টিতে শুধু এক এক শ্রেণীর দোকান থাকে। চুড়ি পট্টিতে প্রায় ২৫০ চুড়ির দোকান, জুতা পট্টিতে ৫০০ জুতার দোকান। এরকমভাবে কম্বল আসন, উলের বস্ত্র, অন্য দ্রব্য, হালওয়ার দোকান, মেওয়ার দোকান। পশমিনা, হীরা, পান্না, মোতির দোকান বা গদি দোতলার উপর। শহর চারপাশে পাথরের চার স্তরের প্রাচীর বেষ্টিত প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হয়ে চতুর্থ দ্বারে প্রবিষ্ট হয়ে রাজবাড়ীর কাছে যাওয়া যায়। সেখানে গোবিন্দজির মন্দিরও আছে, যা রক্ষা করছে পদাতিক সেনারা। গোবিন্দজির গোস্বামীকে খবর দিলে এক ছড়িবরদার একটি পাঁচ রঙের ঝড়ি হাতে করে এসে আগে আগে চলল, তাই কোন দ্বারে রক্ষীরা লেখকদের আটকালো না। শ্বেত পাথরে নির্মিত গোবিন্দজির মূর্তি রত্ন সিংহাসনে বিরাজিত ও রাজ পরিচ্ছদে সুসজ্জিত। মন্দিরে দিনে সাতবার ভোগ ও আরতি হয়। লেখকেরা দেব দর্শন ও আরতি দর্শন করলেন। গোবিন্দজির বাম ভাগে শ্রীমতিজির মূর্তি ও ডান ভাগে রাজকন্যার (রাজা সবাই জয় সিংহের কন্যা) পানের বাটা হাতে নিয়ে মূর্তি বিরাজিত আছে।


লেখক এখানে কয়েকটি কাহিনী বলেছেন - দিল্লির বাদশা আকবর বৃন্দাবনের গোবিন্দ, গোপীনাথ ও মদনমোহন মন্দির ভাঙ্গার আদেশ দেন (খুব সম্ভবত এই বাদশা আকবর না হয়ে আওরঙ্গজেব হবেন)। এই সংবাদ শুনেই জয়পুরের মহারাজ সওয়ায় জয়সিংহ বৃন্দাবনে গোস্বামীদের যত দেবমূর্তি ছিল সব জয়পুরে রাজধানীতে নিয়ে যান ও মন্দির স্থাপিত করেন। রাজকন্যা সর্বদা গোবিন্দজির মন্দিরে যেতেন যা অন্দরমহলের কাছে অবস্থিত ছিল। রাজকন্যার বিবাহকাল উপস্থিত হলে কন্যা বিবাহে অসম্মত হন এবং গোবিন্দজির শ্রীঅঙ্গে লিপ্ত হয়ে যান। এই কারণে তাঁর মূর্তি গোবিন্দজির ডানপাশে বিদ্যমান। জয়পুরে বৃন্দাবন ধামের সমস্ত দেবমূর্তি রয়ে গেছেন, কেবল মদনমোহনজির মূর্তি কড়োরির রাজা নিয়ে গেছেন ও সেই মূর্তি সেখানে আছেন। বৃন্দাবনে এইসব মন্দিরে প্রতিমূর্তি রয়েছে মাত্র। জয়পুরের রাজা গোবিন্দজির দেওয়ান হিসেবে রাজাকার্য পরিচালনা করেন। রাজ সিংহাসনে তিনি বসেন না। শহর থেকে ছয় ক্রোশ দূরে পাহাড়ের ওপর শিলাদেবীর মন্দির। এই দেবী পূর্বে মথুরাতে কংস রাজার রঙ্গস্থলে শিলারূপে ছিলেন। ওই শিলাতে কংস দেবকীর সন্তানদের আঁছড়ে বিনষ্ট করত। পূর্বে জয়পুরের এই মন্দির নরবলি হত। রাজা সওয়ায় জয়সিংহ নরবলি রদ করেছেন বলে নাকি দেবী রুষ্ঠ হয়ে বাম দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন।


সবাই রাজবাড়ী, গোপীনাথজির মন্দির ও অন্যান্য মন্দির দর্শন করলেন। কিছুদিন জয়পুরে বসবাস করে তারপর পুষ্করের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।


                        (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৭ আষাঢ় ১২৬১ (২১ জুন ১৮৫৪) থেকে ২৩ আষাঢ় ১২৬১ (৭ জুলাই ১৮৫৪)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০২৪

১৯। তীর্থ ভ্রমণ ৪ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                  -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

সেকেন্দ্রার থেকে বেউরগ্রাম(?), বিগরাই-এর বাজার সরাই (বিঘ্রাই, উত্তরপ্রদেশ) মিঠেপুর (মিঠেপুর), শকুয়াবাদ (শিকোহাবাদ), রাজার টাল (রাজা কা টাল), উশানী (ইন্দানী) হয়ে খাঁদানি (?) পৌঁছানো হলো পঞ্চম দিনে। সেখানে দুজন বৃন্দাবনের কুঞ্জবাসী লেখকদের সঙ্গী হলেন। লেখক শুনেছিলেন যে কাশীর কেশেল, প্রয়াগের প্রয়াগী আর বৃন্দাবনের কুঞ্জবাসী তিন সমান। তারা যাত্রীদের প্রায় ডাকাতি করে অর্থ হরণ করে। লেখক তাদের বললেন যে তাঁরা প্রথমে আগ্রা যাবেন। সঙ্গের টাকা শেষ, আগ্রায় গিয়ে টাকা সংগ্রহ করবেন, তারপর বৃন্দাবন যাবেন। বৃন্দাবনে কুঞ্জবাসীর কুঞ্জে থাকবেন না, বাড়ি ভাড়া করে থাকবেন। এই কথায় তারা বুঝল যে লেখকের কী অভিপ্রায়। তখন তারা বলল কুঞ্জবাসীর অর্থ লোভের কাহিনী মিথ্যা নয় কিন্তু তারা যে সেরকম নয় তা পরীক্ষা করে দেখুন লেখক। তাছাড়া তারা লেখকের জন্য অর্থের বন্দোবস্ত করে দেবেন। ফলে তারা লেখকের সঙ্গে চলল। 

খাঁদানি থেকে বৃন্দাবন, মথুরা যাওয়ার দুটি পথ। একটি পথ পশ্চিম দিকে ডাকের যাতায়াতের, আগ্রা হয়ে আর এক পথ বলদেব হয়ে। লেখকেরা বলদেব হয়ে গেলেন। বলদেবের দর্শন হলো। এখানকার পান্ডারা নিষ্ঠুর ও ভীষণ আকৃতির। মাখন মিছরি ভোগ দিয়ে দর্শন করে পুরি কচুরি প্রসাদ পেয়ে সেখানে রাত্রি বাস। ব্রহ্মাণ্ড ঘাট দর্শনে গেলেন পরদিন, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ মৃত্তিকা ভোজন করেছিলেন। লেখক বলেন সেখানকার মৃত্তিকা খেতে সুস্বাদু, ওই ঘাটে যমুনাতে স্নান তর্পণ করে গোকুল মহাবন পরিক্রমা করে শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি, সূতিকা গৃহ, ষষ্ঠী পূজার ঘর, দধি মন্থনের স্থান, পুতনাবধ স্থান, গেন্দ খেলার আঙিনা, বন্ধন। ধূলা়খেলার স্থান ইত্যাদি দেখলেন।



সিকান্দার রাও থেকে বৃন্দাবন (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)

 পরদিন গোকুল মহাবন থেকে নতুন গোকুল গেলেন ও দর্শন করলেন। তারপর যমুনা পার হয়ে মথুরা পৌছলেন। সেখানে বিশ্রাম ঘাটে স্নান, মুকুট দর্শনাদি করে, মথুরা মন্ডল দর্শন করে তিন ক্রোশ গিয়ে শ্রী বৃন্দাবন ধামে প্রবেশ করে দর্শন করলেন গোবিন্দ, গোপীনাথ, মদন মোহন এই প্রধান তিন মন্দির।মথুরায় যমুনার তীরে অনেক ঘাট পাকা বাঁধানো আছে আর অনেক ঘাটে শিব স্থাপিত আছেন। প্রধান ঘাট চব্বিশটি তাছাড়াও ধনীদের বাঁধানো আরও অনেক ঘাট আছে। মথুরা নগরে উত্তরদ্বার জয় সিংহপুরী, দক্ষিণ দ্বার কোগ্রাম। 


নগরের মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ঘর রয়েছে। ছয় হাজার ঘর মুসলমান, বাকিরা হিন্দু। হিন্দুদের মধ্যে চৌবের সংখ্যা অধিক। যেসব যাত্রী মথুরা বৃন্দাবনে আসে চৌবেরা তাদের মথুরা পরিক্রমা স্নান দান শ্রাদ্ধ দর্শন করিয়ে জীবন যাপন করে। এরা লেখাপড়া করে না আর দিনে চার বেলা সিদ্ধি খায়। মথুরায় নানা দেশের (সুরাট, বোম্বাই, গুজরাট, জয়পুর, বিকানীর, মাড়োয়ার, দিল্লি প্রভৃতি) ধনী সেঠেদের বাস। 


দ্বারকাধীশের  মন্দিরের সম্পত্তির পরিমাণ অতুল। মনি মুক্তার গহনা, বস্ত্র, ঝুলনের হিন্দোলা প্রভৃতির অমূল্য সম্ভার। প্রতিদিন তিনবার নতুন পোশাকে শৃঙ্গার হয়। দেবালয়ে মানুষ প্রতিদিন উত্তম আহার পায়। নিকটে রয়েছে কংস টীলা যেখানে কংস রাজার কেল্লা ছিল। 


শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমিকে মধুপুরি বলে। তার চারিদিকে চার দ্বারে চার অনাদি শিব আছেন। পূর্বদ্বারে পিঁপুড়েশ্বর, দক্ষিণদ্বারে রঙ্গেশ্বর, পশ্চিমদ্বারে ভূতেশ্বর ও উত্তরদ্বারে গোকর্ণেশ্বর। পশ্চিম দ্বারে মহেশ্বরী দেবীর মহাপীঠ, এখানে ভগবতীর অঙ্গ পতন হয়েছিল। এখানে দর্শনীয় রয়েছে ধ্রুবটীলা, সপ্তর্ষিটীলা বলিটীলা, কংশটীলা, মহাবিদ্যা দেবী। রয়েছে বলদেব জিউয়ের মন্দির, সেখানে স্বর্ণরৌপ্যের বড় আধিক্য। বড় বড় ধনী শিষ্য। সাধারণ মানুষের দর্শন করা কঠিন। শহরের মধ্যে কুব্জানাথের মন্দির।তার কাছে রাধা গোবিন্দজীউর মন্দির, রাধাকান্তজীউর মন্দির। এইসব মন্দিরে ১৫ দিন ব্যাপী ঝুলন হয়। দ্বারকাধীশের মন্দিরে একমাস ধরে ঝুলন হয়। 


মথুরায় ২৫ টি ঘাট ও তীর্থ। মধ্যখানে বিশ্রান্ত ঘাট যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলদেব কংশকে বধ করে বসে বিশ্রাম করেছিলেন। তার উত্তরে ১২ টি ও দক্ষিণে ১২ টি ঘাট। অগ্রহায়ন মাসে শুক্লা দশমীতে ওই স্থানে কংসবধ লীলা অনুষ্ঠিত হয়। বিশাল মেলাও হয়।


মথুরায় স্থানে স্থানে বাজার আছে। হালওয়া পট্টি, কাপড়ের দোকান, গন্ধিদের দোকান, বিলাতি দ্রব্য সবই পাওয়া যায়। রাস্তার দুই পাশে উচু উঁচু বাড়ি, তার নিচে দোকান। একটি ভালো মসজিদ আছে, সেখানে মুসলমানেরা ঘটনা করে। এখানে কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার, সদর আমিন, সদর আলার কাছারী আছে। সৈন্য ও সৈনাধ্যক্ষদের ছাওনি আছে। বাঙ্গালীঘাটাতে বাঙালিদের বাস। সাহেব আছে জন পঁচিশ। মথুরায় কেউ দুঃখী বা অভাবী নয়। স্ত্রী লোকেরা শ্রীসম্পন্না। তারা ঘাগড়া কাঁচলি, উড়ানি পড়ে। চৌবের স্ত্রী লোকেরা শাড়ি, উড়ানি পরে। এত ভালো দই লেখক আর কোথায় দেখেননি। এ ছাড়া খাজা, প্যাড়া, কুমড়ার মিঠাই, খাস্তা কচুরি, মগধের লাড্ডুও ভালো পাওয়া যায়। পশম বা উলের কাপড়ের অনেক দোকান আছে। কাবুলিওয়ালাদের আনা আনার, বাদাম, পেস্তা ইত্যাদি পাওয়া যায়। বৃন্দাবন ধামে নানা দেশের ধনী ও সাধারণ মানুষের বাস। নানা দেবালয় স্থাপনা করে, দেব সেবা, সদাব্রত, ধর্মশালা, জলসত্র, দরিদ্র ভোজন, এমনকি বানর কচ্ছপ ময়ূর প্রভৃতি পশুপাখিদেরও খাদ্য বিতরণ প্রভৃতি চলেছে। নৃত্য গীত মহোৎসব শ্রীমৎ ভাগবত পাঠ প্রভৃতিও সর্বক্ষণ চলেছে। 


বৃন্দাবনের যমুনাতে দ্বাদশঘাট আছে, যথা কালিদহ, গোপাল ঘাট, আবির ঘাট, সিঙ্গার ঘাট প্রভৃতি। প্রতিটি ঘাটের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা কাহিনী যুক্ত। এছাড়া কেবার বন বা কেতকি বন, অটল বন, বিশ্রাম বাগ, রাধা বন, বংশী বট, গোপীশ্বর মহাদেব, পুলিন, নিধুবন, নিকুঞ্জ বন, লোটন বন প্রভৃতি অসংখ্য ধর্মীয় দর্শনীয় স্থান রয়েছে। লেখক একে একে সব দর্শন করেন। প্রতিটি স্থানের মাহাত্ম্য তিনি সংক্ষেপে সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন। 


এবার তিনি ব্রজভূমিতে চারিদেব অর্থাৎ বলদেব, হরদেব, কেশবদেব ও গোবিন্দদেব দর্শন করেন। এই স্থানগুলি বৃন্দাবন থেকে কিছু দূরে অবস্থিত। লেখক এখানে তাঁর দুএকটি নিরীক্ষণ জানিয়েছেন। যেমন - মন্দিরগুলিতে যে ব্যক্তি যে রকম ভেট দেয়, সেই অনুসারে দর্শনের সুবিধা, সেই প্রসাদ শিরবস্ত্র প্রভৃতি পায়। ভেট না পেলে বিশেষত বাঙ্গালীদের ক্ষেত্রে দর্শনে বিশেষ ব্যাঘাত করা হয় কিন্তু অন্য দেশীয়রা যা দেয় তাই গ্রহণ করা হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের শিষ্য সনাতন গোস্বামী মথুরায় সাধনভজন কালে দৈববাণীতে মদনমোহনজীউ-এর মূর্তি লাভ করেন। সেই মূর্তি কালক্রমে বর্তমান মদনমোহনজীউ-এর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত। শ্রীচৈতন্যদেব এখানে এসেছিলেন এবং সনাতন গোস্বামীর ভজনাগারে মহাপ্রভুর পদচিহ্ন বর্তমান আছে।

                   ( চলছে )

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৬১ (৩১ মে ১৮৫৪) থেকে ৬ আষাঢ় ১২৬১ (২০ জুন ১৮৫৪)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০২৪

১৮। তীর্থ ভ্রমণ ৩ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                  -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

কাশী ছাড়ার পর প্রথম মেড়ুয়াডিহিতে (মারুয়াডিহ, উত্তর প্রদেশ) রাত্রি বাস। তারপর তামেচাবাদ (তামাচাবাদ) হয়ে মহারাজগঞ্জ (মহারাজগঞ্জ), পরদিন গোপীগঞ্জে (গোপিগঞ্জ) স্থিতি। তারপর ক্রমে হাড়িয়া (হরিয়া), ঝুসীগ্রাম (ঝুসী) হয়ে  নৌকার পুলে গঙ্গা পার হয়ে এক ক্রোশ গিয়ে ত্রিধারা অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর নদীর ঘাট বেনীঘাটে রাত্রি বাস। এখানে যাত্রীদের প্রয়াগে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়াগীরা (প্রযাগের পান্ডা) উপস্থিত। প্রয়াগীরা অত্যন্ত লোভী, নির্দয়, নিষ্ঠুর। প্রথমে যাত্রী নেওয়ার সময় ভদ্র ব্যবহার করে কিন্ত পরে দুর্ব্যবহার করে। তাদের সৈন্য আছে (!) যাত্রীরা প্রয়াগতীর্থে পৌঁছে মুন্ডন ও উপবাস করলেন। 


পরদিন ত্রিধারাতে স্নান তর্পণ, তীর্থশ্রাদ্ধ, ব্রাহ্মণ ভোজন, প্রয়াগ মাহাত্ম্য শ্রবণ করলেন। তারপরের দিন আবার ত্রিধারায় স্নান করে পঞ্চক্রোশী পরিক্রমণ, বেণীমাধব দর্শন, কেল্লার ভিতরে অক্ষয়বট দর্শন, সরস্বতী নদীর গুপ্ত ভাব দর্শন প্রভৃতি করলেন। সরস্বতী নদীর উপরে যমুনার পশ্চিম ধারে পাথরের তৈরি কেল্লা। কেল্লার মধ্যে বাড়িঘর। বড় বড় কামান বন্দুক তরবারিতে কেল্লা সুরক্ষিত। কেল্লায় এক ক্রোশ অন্তর  পদাতিকদের ছাউনি। শহরে বাজার, কাছারি, ডাক্তারখানা, ডাকঘর সব আছে। উত্তরে স্টিমার অফিস। এই প্রয়াগকে এলাহাবাদ বলে। শহরে ৫০ হাজার ঘর আছে। জল বাতাস খুব ভালো, শরীর ভালো থাকে।


এরপর লেখক তিতু বাগদি আর মহেন্দ্রনাথ মিত্র সহ বৃন্দাবন যাত্রা করলেন। বাকিরা দেশে ফিরে গেলেন। এরপর দুর্গাগঞ্জ , ইমামগঞ্জ, গোলামীপুর (গুলামীপুর), ভূধরের সরাই (?), চৌধুরী সরাই (চৌধুরী সরাই), কুঙরপুর (কুনওয়ারপুর), খাজুয়া (খাজুয়া) হয়ে ছয় দিনে কানপুর পৌঁছলেন। এখানে ইংরাজ সরকারের পদাতিক সৈন্যদের শিক্ষার স্থান রয়েছে। দুর্গ নির্মিত নেই, মাঠের মধ্যে ছাউনি। এখানে অনেক গোলাগুলি, বারুদের সংগ্রহ আছে। প্রহরীরা সতর্কভাবে পাহারা দেয়। বাদশাহী আমলের বড় বড় মজবুত সরাই আছে পথিকদের জন্য। প্রায় ৩০০ বাঙালি আছেন। এক কালীবাড়ি আছে, সেখানে অতিথিরা থাকতে পারেন। জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টরের কাছারি, দেওয়ানি ও ফৌজদারির কাছারি আছে।




কানপুর থেকে সেকেন্দা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


কানপুরের উত্তর পূর্বে আট ক্রোশ দূরে বিঠোর (বিঠুর)। এটি বাল্মিকী মুনির তপোবন। সীতার বসবাস স্থান, লব কুশের জন্মস্থান। পুনা সেতারার বাজিরাও এর বাড়ি ও সৈন্য কিছু এখানে আছে। তার দত্তক পুত্রের পুত্র নানা সাহেব ওই পদাতিক সৈন্য নিয়ে এখানে থাকেন। 


এবার এলেন কান্যকুব্জ   (কনৌজ)। এখানে কনৌজের ব্রাহ্মণদের বাস স্থান। এখন থেকে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা গৌড়ে এসে কৌলিন্য প্রথার সূচনা করেছিল। এখানে অনেক প্রাচীন দেবালয়, প্রাচীন অট্টালিকা আছে ও অনেক পন্ডিত বেদজ্ঞ বসবাস করেন। 


এবার গঙ্গা পার হয়ে লক্ষ্ণৌ শহর, যা তখন নবাবের অধিকারে ছিল।সেখানকার মানুষ ধনী, মহাবলশালী, উগ্র স্বভাব এবং অল্প কথায় বিবাদ হলেও তরবারি চলে। ইংরাজ সরকারের তরফ থেকে একজন রেসিডেন্ট ও দুই দল সৈন্য আছে। নবাবের রাজ্য অধিক দূর নহে অথচ ৫২ রাজার সিংহাসন _ এই মন্তব্য করেছেন লেখক সকলেরই সৈন্য সমাবেশ আছে। এক হাজারের কম বন্দুকধারী কারো না। দশ হাজার পর্যন্ত অনেকেরই আছে। শহর প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। শহরে প্রবেশের সময় নবাবের দ্বারপাল নাম ধাম জিজ্ঞেস করে। অস্ত্রধারী ভিন্ন রাজ্যবাসীকে প্রবেশ করতে দেয় না। কোনো বিদেশি এই রাজ্যে এলে স্থানে স্থানে বলপূর্বক তার থেকে টাকা-পয়সা নেওয়া হয়, এমন অরাজগতা বিদ্যমান। নবাব দুর্গের মধ্যে সাত মহলায় বাস করেন। গোমতী নদীর তীরে এই শহর। মচ্ছিভবন নামে একটা বড় বাড়ি আছে, তার মধ্যে ফুল ফলের বাগান পুকুর আর থাকার ভালো ভালো ঘর আছে। মাটির নীচে নবাবদের গোরস্থান আর মৃত নবাবদের ধন দৌলত কোষাগার করে রাখা আছে। অনেক প্রহরী ও কামান আছে সেসব পাহারা দেওয়ার। নবাবদের অজস্র ধন-সম্পদ আছে। একজন বাঙালি জহুরী লেখককে জানালেন প্রতি বছর ক্রোর টাকার জহরত্ নবাবরা ক্রয় করেন। তাদের জুতোর উপরেও হিরে বসানো থাকে।


পরবর্তী গন্তব্য অযোধ্যা, শ্রীরামচন্দ্রের রাজধানী বন জঙ্গল হয়েছে। মধ্যে মধ্যে বসতি ও রাম সীতার মূর্তি আছে। রামনবমীতে মেলা হয়। পাঁচ ছয় হাজার বৈষ্ণব শ্রীরামের জন্মভূমি ও হনুমান গড়িতে আছে, সর্বদা ভজন সাধনে উম্মত্ত। বড় বড় হনুমান আছে কিন্তু তারা কারো ক্ষতি করে না। বরং স্তবস্তুতি করলে পথিককে পথ দেখানোর জন্য আগে আগে যায়। যেখানে রামচন্দ্রের জন্মভূমি সেই দ্বারে এক বৃহৎ হনুমান আছে তাকে কিছু খাদ্য দ্রব্য না দিলে পথ ছাড়ে না। যে স্থানে রাজ সিংহাসন ছিল সেখানে উচ্চ দ্বীপের ন্যায় হয়ে আছে। রাজধানী প্রায় দশ ক্রোশ পর্যন্ত ছিল। বাড়িঘরের চিহ্ন ইঁট পাথর তখনও ছিল।


গঙ্গা পার হয়ে মিথিলায় (নাকি সীতাপুর, উত্তর প্রদেশ?)। এর মধ্যে নৈমিষারণ্যে যান, যেখানে ৬০ সহস্র ঋষির তপোবন ছিল। নানা ফুলে সুশোভিত বন, নির্জন স্থান দেখে খুব আনন্দলাভ করলেন। এবার সেকেন্দ্রা (সিকান্দ্রা) উপস্থিত হলেন। সেখানে জেলার কাছারি, ডাকঘর, ডাক্তার-খানা আছে । এখানে এমন কাছারি দেখেন যেখানে মুসলমান মুন্সেফ আর ব্রাহ্মণ দারোগা। দোকান ঘরে থাকার ব্যবস্থা আছে। দোকানে পুরি, কচুরি, মিঠাই, প্যাঁড়া পাওয়া যায়। সেকেন্দ্রা থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হলো।

                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৪ চৈত্র ১২৬০ (৭ এপ্রিল ১৮৫৪) থেকে ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১২৬২ (৩০ মে ১৮৫৪)




প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

১৭। তীর্থ ভ্রমণ ২ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

      সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                    -------  সুমনা দাম


                   (আগের পর্বের পরে)

এবার নতুন সঙ্গীদের সঙ্গে কাশীর উদ্দেশ্যে গয়া থেকে পদব্রজে লেখক যদুনাথ সর্ববাধিকারী রওনা দিলেন। সঙ্গে কয়েকজন নারী থাকায় পালকি এবং মোষের গাড়িও ছিল। প্রথমে এলো যমুনা গ্রাম (যমুনানগর, বিহার)। এখানে কাশীর গঙ্গাপুত্র পান্ডা বা তার সহকারীরা তাঁদের ধরলেন। তারপর পঞ্চাননপুর (পঞ্চাননপুর, বিহার) হয়ে গো (?) এসে রাত্রি বাস। পরদিন পুনপুনা (পুনপুন, বিহার) গিয়ে রাত্রি বাস। পরদিন দাও নগর (দাউদ নগর, বিহার) হয়ে পড়োড়িতে পোখাড়া, বিহার)  রাত্রি বাস। এইসব স্থানে পথিকদের থাকার জায়গা আছে। পড়োড়ি থেকে আকড়ি (আকোড়িগোলা, বিহার)। সেখানে শোন নদী দেড় ক্রোশ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার চওড়া। সেখানে স্নান করে সরসরামে (সাসারাম) যান। 


সাসারাম পুরনো শহর, সেখানে বাদশাহী সরাইখানা আছে। শহরে নানা জাতির বাস। ডাকঘর, মুনসেফি, রেজিস্টারী কাছারি আছে। দুলিচা, গালিচা, সতরঞ্চের তাঁতিরা জিনিসপত্র নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। এখান থেকে বাড়িতে চিঠি দেওয়া হল। এখান থেকে শিবসাগর সরাই (শিবসাগর, বিহার)। সেখানে স্নান করে জাহানাবাদে গিয়ে (জাহানাবাদ, বিহার) থাকা হলো। জাহানাবাদ থেকে মোহনিয়া (মোহানিয়া, বিহার)। সেখানে সুন্দর পুস্করণী, শিব মন্দির রয়েছে। লোহা ও মনোহারী দ্রব্যের বাজার রয়েছে। উল ও সুতার দুলিচা, আসন বোনার কারিগরদের ঘর রয়েছে। তারা ফরমাস মেনে চার টাকা থেকে ষোলো টাকা গজ দরে উত্তম গালিচা বানাচ্ছে। এখান থেকে লেখকেরা এলেন কর্মনাশা নদী তীরে । এই নদীর জল স্পর্শ করার বিষয়ে শাস্ত্রে নিষেধ আছে। স্পর্শে সকল কর্ম নাশ হয়। আগে এই নদীতে পোল ছিল না। নীচু জাতের মানুষেরা পার করে দিত, তাতে মানুষের কষ্ট হতো। এখন কোম্পানি বাহাদুর এখানে পোল করে দিয়েছেন। এখানে বাজার, দোকান, অনেক বসতি আছে। তাঁরা এবার জগদীশের সরাই (?) নামক স্থানে গিয়ে থাকলেন। সেখান থেকে দুলাইপুর (দুলহিপুর, উত্তর প্রদেশ) গেলেন  সেখানে সরাই আছে। সরাইয়ে রাত্রি বাস। দুলাইপুর থেকে বারাণসী অর্থাৎ কাশী তিন ক্রোশ।




 
      গয়া থেকে কাশী (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে কাশী অবস্থিত। অত্যন্ত সুন্দর, সুবর্ণময় এই কাশীপুরী অতি মনোরম স্থান। দক্ষিণে অসি, উত্তরে বরুণা নদী। এখানে অনেক পারঘাট আছে। আনন্দ কানন, গৌরীপীঠ, মহাশ্মশান, উত্তর বাহিনী গঙ্গা, চক্রতীর্থ, মণিকর্ণিকার জন্য কাশী প্রসিদ্ধ। দশাশ্বমেধের শীতলা ঘাটে পার হয়ে ইতালি নিবাসী তারাচাঁদ দেবের বাড়িতে সকলের থাকা হল। সেই দিন তীর্থ উপবাস করে সন্ধ্যায় বিশ্বনাথের দর্শন ও রাতে অভিষেক ও আরতি দর্শন করা হল। সেই আরতি এতই চমৎকার যে দেখেছে সেই জানবে বলেছেন লেখক। 


পরদিন মনিকর্নিকায় স্নান, তর্পণ করে বিশ্বেশ্বর, অন্নপূর্ণাদর্শন, তীর্থ শ্রাদ্ধ করে ব্রাহ্মণ সধবা কুমারীদের ভোজন করানো হল। পরদিন দক্ষিণ মানসের উদ্যেশ্যে যাত্রা করে প্রথমে কেদার ঘাটে কেদারনাথ দর্শন করে, ক্রমে পঁচিশ দেবদেবী দর্শন ও পূজা করতে করতে তিল ভান্ডেশ্বরে দর্শনে দক্ষিণ মানস দর্শন সম্পন্ন হল। তারপরের দিন পশ্চিম মানস যাত্রা করে প্রথমে পাতালেশ্বর দর্শন, শঙ্খকর্ণ মহাদেব দর্শন করে বাইশ স্থানে দেবদেবী দর্শন করা হল। পরদিন মনিকর্ণিকা তে স্নান ও তর্পণ করে দক্ষিণ মানসের উদ্দেশ্যে যাত্রা। জ্ঞানব্যাপী হয়ে দক্ষিণ মানসের বাষট্টি স্থানে দেব-দেবী দর্শন ঢুন্ডি গনেশ, বিশ্বেশ্বর, অন্নপূর্ণা, কেদার, দুর্গাদেবী, শীতলাদেবীর পূজা দেওয়া হয়। তারপর দিন পঞ্চতীর্থে স্নানাদি করে গমন। প্রথমে অসি সঙ্গমে, শেষে মনিকর্ণিকাতে স্নান করে সমাপ্ত হল। অসি, দশাশ্বমেধ, বরুণা, পঞ্চগঙ্গা, মণিকর্ণিকা এই পাঁচস্থানে তর্পণ ও ব্রাহ্মণ ভোজন করানো হল। তারপর আরো পাঁচ দিন কাশীধাম দর্শন করা হল। 


আরো কিছুদিন কাশীধামে থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু গ্রীষ্ম বৃদ্ধি হয়ে বসন্ত আর ওলাওঠার প্রকোপে অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে দেখে তাঁরা এবার কাশী ত্যাগ করে প্রয়াগতীর্থ হয়ে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

                       ( চলছে)

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৭ চৈত্র ১২৬০ (১১ মার্চ ১৮৫৪) থেকে ২৩ চৈত্র ১২৬০ (৬ এপ্রিল ১৮৫৪)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০২৪

১৬। তীর্থ ভ্রমণ ১ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

     

 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                     ---- সুমনা দাম


তীর্থমঙ্গলের পরে বাংলা ভাষায় পাওয়া ভ্রমণ সাহিত্যটি গদ্যে লেখা এবং ডাইরি বা রোজনামচার আকারে লেখা। তীর্থ ভ্রমণের লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী (১৮০৫ -১৮৭১) এই ভ্রমণটি শুরু করেন ২৬০ সনের (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪  খ্রিস্টাব্দ) ১১ই ফাল্গুন তাঁর বর্তমান খানাকুলে অবস্থিত রাধানগরের বাড়ি থেকে। ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরেন ৯ ই অগ্রহায়ণ, ১২৬৪ সনে (২৪ ভেম্বর ১৮৫৭)। এই সময়ে ভারত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে ছিল। এই ভ্রমণটি ভারতের রেল পূর্ববর্তী কালের ভ্রমণ। ভারতীয় রেল ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বোম্বে থেকে থানে ও কল্যান অব্দি এবং হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত প্রথম শুরু হয়। দেশের অন্যান্য জায়গায় তখন কোনো রেলের সংযোগ ছিল না। তীর্থমঙ্গলের কবি বিজয়রাম, জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের যে সহায় সম্বল পেয়েছিলেন বর্তমান গ্রন্থের লেখকের সেরকম কিছু ছিল না। তিনি মূলতঃ পদব্রজে, নিজের চেষ্টায়, নিজের সামান্য অর্থে এই ভ্রমণ করেছেন। তিনি আত্মীয়-স্বজনকে শোনানোর জন্য নিজের দিনলিপি লিখেছিলেন, পরবর্তীকালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক নগেন্দ্র নাথ বসুর সম্পাদনায় তীর্থ ভ্রমণ নাম নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
 



  রাধানগর থেকে গয়া (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


লেখক তীর্থ ভ্রমণের পূর্বে অম্বল রোগে অত্যন্ত পীড়িত হয়েছিলেন। ভগ্ন স্বাস্থ্যের উদ্ধারের জন্য তিনি পশ্চিম দেশে যেতে অভিপ্রায় করেন। চিকিৎসকও তাকে পদব্রজে পশ্চিম বা উত্তর দেশে ভ্রমণের পরামর্শ দেন। তিনি প্রথমে বৃন্দাবন পর্যন্ত যেতে আগ্রহী ছিলেন। ভ্রমণের শুরুতে ৩০ টাকা সঙ্গে নিয়েছিলেন। বাড়ির অনেকেই তাঁকে এই ভ্রমণে যেতে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিল। তীর্থ ভ্রমণের পূর্বে ব্রাহ্মণ- কায়স্থ ভোজন, শ্রাদ্ধ, সংযম পালন করে তিনি খানাকুলের নিকটস্থ রাধাবল্লভপুরের ঈশ্বরচন্দ্র কওড়ি, নকুড়চন্দ্র বসু, রামধন সিংহ এবং মুটে হিসাবে বিশ্বনাথ তাঁতিকে নিয়ে রওনা হলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের দাদা গোরাচাঁদ কওড়ি এর তিন বছর আগে যাত্রী নিয়ে গয়া তীর্থে গেছিলেন। প্রথমদিকেই বিশ্বনাথ তাঁতি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। 
যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় রাধাবল্লভপুর থেকে জাহানাবাদের (বর্তমান আরামবাগ) অপর পাড়ে কালিপুর (দ্বারকেশ্বরের অপর পাড়ে) হয়ে গৌরহাটি (গৌরহাটি, খানাকুল) পৌঁছান। পরদিন কোতলপুর (কোতুলপুর, বাঁকুড়া) নামক সমৃদ্ধস্থানে থাকা হয়। কোতুলপুর থেকে বালসী (বালসী, বাঁকুড়া) গিয়ে লক্ষীনারায়ণশীলা দর্শন করা হয়। লেখক এই স্থানের আর্থ-সামাজিক নানা কথা লিখেছেন। তীর্থস্থানের পুরোহিতদের লোক ঠকানোর কথাও লিখেছেন। তারপর পাত্রসায়ের হয়ে সোনামুখী গ্রামে (বর্তমান সোনামুখী, বাঁকুড়া) যান বনের ভিতর দিয়ে। সেখানে তখন নানা হিংস্র জন্তু যেমন ভাল্লুক ছিল। বর্ধমান রাজার শ্রীমদ ভগবতদের বিখ্যাত কথক গদাধর শিরোমনির বাসস্থান এই সোনামুখী। তাঁর অর্থানুকুল্যে জঙ্গলের মধ্যে এই বসতি গড়ে উঠেছে। তাঁর গৃহে গোবর্ধন পর্বতের মন্দিরাকৃতি দেবালয় আছে। সোনামুখী থেকে বেরিয়ে ইচলার খাল (অধুনা লুপ্ত?)। তারও কিছু পরে দামোদর নদীর শ্রীরামপুর ঘাট (?)। আরো গেলে গোপালপুরের (বিষ্ণুপুরের নিকট) পাকা রাস্তা পাওয়া যায়। যে রাস্তা বর্ধমান থেকে দিল্লী পর্যন্ত যায় (বর্তমানে বর্ধমান-বিষ্ণুপুর রোড)। 


এই রাস্তার কিছু দূর অন্তর চটী বা পথিকদের রাত্রিবাসের স্থান। রাস্তার দুই ধারে দোকান। দোকানগুলি খোলার ঘর, পথিকদের থাকার স্থান বড় বড় ঘর। সকল ঘরের ভাড়া দিতে হয় না। হাঁড়ি, কাঠ বাবদ পয়সা দিতে হয়। চাল, ডাল ওই দোকান থেকে নিতে হয় আর তরকারি, মাছ, তেল, দুধ, দই বিক্রি করতে বিক্রেতা আসে। ধোপা, নাপিত ইত্যাদি সবই চটীতে পাওয়া যায়। ইঁদাড়া বা কুয়োতে পথিকের জন্য ভালো পানীয় জল আছে। পুলিশের চৌকি থানা আছে। এরপর এল অন্ডাল (পশ্চিম বর্ধমান)। অন্ডাল থেকে এক ক্রোশ দূরে মধুবন। খুব ঘন মহুয়া গাছের জঙ্গল। 
তারপর ফয়েদপুর, তারপর বোগড়া  (বর্তমান রানীগঞ্জ স্টেশন-এর কাছে)। এখানকার গোবিন্দ পন্ডিত ২৪ পরগনা জেলায় ডেপুটি কালেক্টর -এর কাজ করেন। পথিকদের সুবিধার্থে রাস্তার ধারে সুন্দর ফুল, ফলের বাগান, তার মধ্যে দশ বিঘা পুকুর ও জলসত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন গোবিন্দ পন্ডিত মহাশয়। বগোড়া থেকে নিয়ামতপুর (নেয়ামতপুর, পশ্চিম বর্ধমান) হয়ে যাত্রা করেন। এই পথে অশ্বারোহী প্রহরীরা পাহারা দেয় বলে নিরাপদ। 


এবার এলো এক লাল মাটির পাহাড়, মেটে সিঁদরে পাহাড়, যার পশ্চিমে বরাকর নদী। পূর্ব তীরে রাজা হরিশচন্দ্রের দুটি শিব মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের সামনে ও পেছনে পাথরের তৈরি গরু ও শুকরের মূর্তি। এই হরিশচন্দ্র পঞ্চকোট বংশের রাজা ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীতে। নিয়ামতপুর রাজা হরিশচন্দ্রের রাজধানী, গড় পঞ্চকোট থেকে কিছু দূরে অবস্থিত। বরাকর নদ পায়ে হেঁটে পার হয়ে পশ্চিম পাড়ে নৃসেচটী। সেখানে প্রায় ৪০ টি বড় ঘর আছে পথিকদের জন্য। এই চটী পার হয়ে চাস চটী (চাস,ঝাড়খন্ড)। তারপর গোবিন্দপুর-এর চটী (গোবিন্দপুর, ঝাড়খন্ড)। 


'এই চটি পর্যন্ত মগঘ রাজ্য। মৎস্য দেশ, বরাকর অবধি বিরাট রাজ্য। তাহার পর জরাসন্ধাধিকার মগধ' - এটি লেখক বলেছেন। তবে এই বক্তব্য মহাভারত অনুসরণে হলেও এটি সম্পূর্ণভাবে লেখকের মতবাদ। এখানকার মানুষ আধা হিন্দিভাষী আধা বাংলাভাষী। 
এবারে পাহাড়ি পথ গিয়ে রাজগঞ্জ (ঝাড়খন্ড)। এখানে সাহেবদের থাকার একটা বাংলো আছে। এরপর চড়াই উত্তরায় পেরিয়ে তোপচাঁচির চটী। জরাসন্ধের গড় এটি দেখেই সম্ভবত তাঁর মনে হয় মগধের জরাসন্ধের কথা।


লেখক  পরেশনাথ পাহাড় দেখেন এ পথে। সব থেকে বড় পাহাড়। সেই পাহাড় ফল ফুল লতা বৃক্ষ হিংস্র জন্তু পূর্ণ। পাহাড় চূড়ায় সরাবগি বণিকদের কুলদেবতা (জৈনদের সরাবগি অর্থাৎ শ্রাবক বলা হয় হত) অর্থাৎ জৈনদের তীর্থস্থান পরেশনাথের মন্দির আছে। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় পাহাড়ের নিচে মহুয়া বনে পরেশনাথের মেলা বসে। সেখানে আগরওয়ালা ধর্মশালা আছে। পাহাড়ের ওপরে পুস্করিণী ও পুষ্পদ্দান আছে। পরেশনাথ পাহাড়ের নিচে জরাসন্ধের কেল্লার পাশ দিয়ে ডুমরিচটী (ডুমরি, ঝাড়খন্ড)। চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত। সেখানে ঝরনার জলে স্নান করে থাকা হলো। তারপর বগোদরের চটী (বগোদর,ঝাড়খন্ড), বরকাট্টা চটী, আটকা চটী। এখানে চিঠি দেওয়ার ডাকঘর আছে। লেখক কলকাতায় পত্র দিলেন।


তারপর বরশোত (ঝাড়খন্ড), বরহি (ঝাড়খন্ড), চোপারন (চৌপারন) প্রভৃতি পার্বত্য চটী পেরিয়ে এল ভয়ানক জঙ্গলের ভেলুয়া (ভেলওয়া, ঝাড়খন্ড)। এখানে পর্বতে দস্যু আছে যারা পথিকদের আক্রমণ করে সব হরণ করে নেয়। এই পথে ঘোড়া বদল করার অশ্বশাল আছে। তারপর বারা চটী (বারা, ঝাড়খন্ড)। কুশলা নদী (?) পেরিয়ে বোধগয়া (বর্তমানে বিহার) এলেন। লেখক এখানে গয়াসুর বিষ্ণুর সঙ্গে যুদ্ধ করেন বলে লিখেছেন। এখানে ধর্মারণ্যে রাজার মন্দির আছে। (আলেকজান্ডার কানিংহাম, ডিরেক্টর জেনারেল, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ১৮৭৮ এর মহাবোধি মন্দির করেন। তার আগে বৌদ্ধ স্থাপত্য সব মাটির তলায় ছিল। তাই যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় এখানে বৌদ্ধ কোন ধর্ম স্থানের উল্লেখ করেননি)। লেখক বলেন যে বোধগয়াতে তখন এক মোহন্ত ছিলেন, অনেক রাজা তাঁর শিষ্য। তাঁদের দেওয়া ধন, ভূসম্পত্তি, বিশাল বাগান রয়েছে। যারা তীর্থ শ্রাদ্ধ করে আসে না তারা গয়া ধাম যাওয়ার আগে বোধগয়াতে শ্রাদ্ধ করে। গয়াল অর্থাৎ গয়ার পান্ডার লোকেরা এসে এখানে নিজের নিজের যাত্রী নিয়ে যায়। ব্রহ্মযোনি পাহাড়ে পৌঁছে বিষ্ণু মন্দিরের ধ্বজা দেখিয়ে সেতুয়ারা প্রতি ব্যক্তির থেকে এক টাকা করে নেয় ধ্বজা দক্ষিনা স্বরূপ। 


গয়াতে পৌঁছে ক্ষৌর কর্ম, ফল্গু নদীতে স্নান, তর্পণ, বিষ্ণুপদ দর্শন, গয়েশ্বরী দেবী দর্শন, অহল্যাবাই প্রতিষ্ঠিত মন্দির দর্শন এবং বিষ্ণুপদে পিন্ডদান করা হল। এখানে তিনি বিভিন্ন প্রকার শ্রাদ্ধ , গয়াক্ষেত্রের মহিমা, পিন্ডদানের বিভিন্ন বেদী (ষোল বেদী), অষ্টতীর্থ এসব বর্ণনা করেছেন। তারপর প্রেতশিলা, রামশিলা, রামগয়া, সীতাকুণ্ড, গয়া কুপ, ধৌতপদ, ভীমগয়ার কথা লিখেছেন। ফল্গু নদীতে জলে স্রোতের প্রকাশ নেই কিন্তু খনন করলে জল ওঠে। ওই জল সুপেয়। বালি খনন করলে যে জল পাওয়া যায় তার মধ্যে ছোট ছোট মাছ খেলা করতে দেখা যায় বলে লিখেছেন। গয়া ক্ষেত্রের বিষ্ণুমন্দিরে হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী প্রবেশ করতে পারে না বলে জানিয়েছেন। গয়ার পান্ডা সম্প্রদায় ও গয়ালদের ব্যাপারে বলেছেন যে তারা ধনী দুষ্কর্মা আর লোভী। গয়াতে পুত্রের পাঠানো টাকা দিয়ে দেনা শোধ করে কাশী যাত্রার চেষ্টায় রইলেন। শম্ভু কওড়ি ছাড়া বাকি দুই সঙ্গী স্বদেশে ফিরে গেলেন। 


গয়া শহরে তখন প্রায় দশ হাজার ঘর ছিল। মুসলমানরা শহরের বাইরে থাকতো। শহরের উত্তর দিকে সাহেবগঞ্জ। সেখানে বাজারে পিতল কাঁসার জিনিস, কম্বল, শতরঞ্চি, গালিচা, কাপড়, মনোহারী জিনিস, বাঁশের জিনিস, লাঠি, লোহার জিনিস, জুতা ইত্যাদির দোকান ছিল। তারপর কারাগার, যার প্রাচীর ছিল ১১ হাত উঁচু। ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সদর আলা, সদর আমিন, মুন্সেফ, জজদের কাছারি, ডাকঘর, আফিমের কুঠি (সেখান থেকে কোটি টাকার বেশি দাদনে আফিমের আমদানি হয়)। সরকারি ডাক্তার এক বাঙালি বাবু। তারপরে সেনা ছাউনি। শহরে পুলিশের প্রহরা ছিল। সব বাজারে পুরি, কচুরি, লাড্ডু, প্যাড়া ইত্যাদি পাওয়া যায়। গয়েশ্বরী পাহাড় থেকে আনা খুব ভালো পাথরের বাসন বিক্রি হয়।
                 
                     ( চলছে )
 
এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১১ ফাল্গুন ১২৬০ (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪) থেকে ৬ চৈত্র ১২৬০ (২০ মার্চ ১৮৫৪)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৪

১৫। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ২ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


               (আগের পর্বের পরে)

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঝাঁপানে (একটি কেদারা যা চারজন লোক বহন করে) করে ঘুরে ঘুরে হিমালয় পর্বতে উঠতে লাগলেন। কখনো একটানা উপরে উঠে, কখনো কিছুটা নেমে নদীর ধার পর্যন্ত গিয়ে, তারপর আবার উঠে চলতে থাকে ঝাঁপান। নদীর ধারে রান্না, খাওয়া হল। তারপর আবার সামনের পাহাড়ে চড়া। রাতে হরিপুরে রাত্রি যাপন। এভাবে চলতে চলতে তাঁরা সিমলার বাজারে উপস্থিত হলেন। দোকানদারেরা তাঁকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো। সেই বাজারেই বাসা ঠিক করে তাঁরা থাকলেন এক বছর। ১৮৫৭ -র এপ্রিল থেকে ১৮৫৮ - র এপ্রিল পর্যন্ত। 


সেখানে যেসব বাঙালি কর্মসূত্রে থাকে তারা এসে লেখকের সঙ্গে দেখা করে। তাদের কাছে শুনে তিনি একটি সুন্দর জলপ্রপাত দেখতে গেলেন। ঝাঁপানে করে খাদের মধ্যে নেমে দেখলেন সেখানে লোকের বসতি, শস্য ক্ষেত রয়েছে, গরু-মোষ চড়ছে। দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন। আরও নীচে গিয়ে আর ঝাঁপানে যাওয়ার পথ নেই। পায়ে হেঁটে নীচে গিয়ে লাঠি ধরে ধীরে ধীরে জলপ্রপাতের নিকটে উপস্থিত হলেন। তিনশ হাত উঁচু থেকে জলধারা পড়ছে। পাথরের ওপর প্রতিঘাতে ফেনা তৈরি হচ্ছে। তিনি বসে জলক্রিড়া দেখতে লাগলেন। পরের রবিবার আবার তিনি সঙ্গীদের নিয়ে জলপ্রপাতে গিয়ে বনভোজন করলেন। জলপ্রপাতের জলে স্নান করে খুব আনন্দ পেলেন তিনি। 


একদিন লেখক খবর পেলেন গুর্খা সৈন্যরা সিমলা লুঠ করতে আসছে। সিমলাতে খবর এল সিপাহীদের বিদ্রোহে দিল্লি ও মিরাটে গুরুতর হত্যাকাণ্ড হয়েছে। সিমলায় সাহেবরা গুর্খা সৈন্যদের নিরস্ত্র হতে হুকুম দিতে তারা রেগে একজোট হল ও হুকুম মানল না। এরপর আরো গুর্খা সৈন্য সিমলা আক্রমণ করতে এল। সিমলার বাঙালিরা ভীত হয়ে পালাতে লাগলো। সাহেবরাও পালিয়ে গেলে, সিমলা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ায় দেবেন্দ্রনাথ দেখলেন এবার সিমলা ছাড়তে হবে। কিন্তু কুলি না পাওয়া গেলে কি করে সম্ভব স্থান পরিবর্তন। এমন সময় এক দীর্ঘকায় রক্তচক্ষু কৃষ্ণ-বর্ণের পুরুষ এসে আশ্বাস দিল যে সে কুলি সংগ্রহ করে দেবে। লেখক অত্যন্ত সংশয়গ্রস্ত হয়ে রাজি হলেন। পরের রাতে সেই ব্যক্তি কুলি নিয়ে এল এবং লেখক তাদের সঙ্গে চললেন। প্রতিমুহূর্তে ভয় হতে থাকল যে এরা তাঁদের মেরে, খাদে ফেলে দিয়ে, সব টাকা লুঠ করে পালাবে। কিন্তু লেখক ক্রমে দেখলেন এরা খুব বিশ্বাসী। এমনকি তাঁর পকেটের কিছু টাকা ছড়িয়ে পড়েছিল, কুলিরা সেসব কুড়িয়ে এনে তাঁকে দিল। কুলিরা তাঁদের ডগসাহীতে (দাগশাই) পৌঁছে দিল। সেখানে এক গোয়ালার বাড়িতে ভাঙ্গা ঘরে দড়ির খাটিয়ায় লেখক রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন দেখলেন এক পাহাড়ের চূড়ায় সাহেব সৈন্যরা মদের খালি বাক্স বসিয়ে এক চক্রাকৃতি কেল্লা তৈরি করে তার মধ্যে পতাকা উড়িয়েছে। তারা ভয়ে ভয়ে লেখকের কাছে জানতে চাইল গুর্খারা এখানে আসছে কিনা। লেখক সেই গোয়ালার ভাঙ্গা ঘরে আরো কিছুদিন কাটালেন। তারপর শিমলা নির্বিঘ্ন হয়েছে শুনে সেখানে যাওয়ার উদ্যোগ করলেন। কুলি পাওয়া গেল না, একটি ঘোড়া পাওয়া গেল মাত্র। জৈষ্ঠ্যমাসের উত্তাপে তৃষ্ণার্ত হয়ে বহু পথ পার হয়ে মধ্যাহ্নে একটি বাংলো পেলেন এবং দৈবক্রমে সামান্য জল ও খাবার ও পেলেন। সন্ধ্যের সময় সিমলা ফিরে এলেন। 


সিমলা ফেরার কিছুদিন পরে দেবেন্দ্রনাথ একটি ঝাঁপানে করে সঙ্গীদের ছাড়া একাকী আরও উত্তরের পর্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পথে ভাঙা সেতুর কার্নিশের উপর দিয়ে হেঁটে পার হতে হল, যার নীচে ভয়ানক গভীর খাদ। পর্বত একেবারে প্রাচীরের মতো খরা উপরে উঠেছে, নীচে বিষম খাদ। তার ওপর নিকটস্থ গ্রাম থেকে বাঘের মতো কুকুর তাড়া করে এল। এই সংকটময় পথ পেরিয়ে একটি শূন্য পান্থশালা পেয়ে সেখানে থাকা হলো। সঙ্গে রান্না করার কোনো লোক নেই, তাই তিনি ঝাঁপানিদের মকাই-যব মেশানো রুটি খেলেন। কতগুলি পাহাড়ি এসে নাচ গান করছিল। তার মধ্যে একজনের দেখলেন নাক নেই। শুনলেন ভালুক থাবা মেরে নাক উঠিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু তাও সে আনন্দ করছে, নাচছে। পাহাড়িদের সারল্য দেখে লেখক খুব প্রীত হলেন। পরদিন রাতে আরেকটি পাহাড় চূড়ায় থাকলেন তাঁরা। গ্রামবাসীরা বলল এখানে তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। শীতকালে বরফ, ক্ষেতের সময় ভালুক শুয়োরের অত্যাচার প্রভৃতি। লেখক জানলেন এখানে স্ত্রীলোকের সংখ্যা কম বলে পাণ্ডবদের মতো তারা সব ভাই মিলে একজন স্ত্রীকে বিবাহ করে। সেই স্ত্রীর সন্তানরা তাদের সবাইকে বাবা বলে। পরদিন চড়াই পথে ঝাঁপানে যাওয়া গেল না। দেবেন্দ্রনাথকে সেই দুর্গম পথ পদব্রজে যেতে হল। শিখরে উঠে একটি ঘর থাকার জন্য পাওয়া গেল। পরদিন আরো উপরে উঠে নারকান্ডাতে পৌঁছানো গেল। এখানকার উচ্চতা ও শীত আরো বেশি। পরদিনও পায়ে হেঁটে চললেন লেখক। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। যেতে যেতে দেখলেন অনেক বৃক্ষ দাবানলে পুড়ে গেছে। কোন গাছে ফুল ফল নেই। শুধু কেলু (পাইন) নামক বৃক্ষের কদাকার ফল দেখা যায় যা পশু পাখিও খায় না। কিন্তু পাহাড়ের গায়ের তৃণলতাতে নানা রঙের ফুল ফল ধরে আছে। এই ফুলে গন্ধ নেই কিন্তু একরকম সাদা গোলাপ ফুটেছে তার গন্ধে চারিদিক আমোদিত। মাঝে মাঝে লাল রংয়ের স্ট্রবেরিও দেখা যায়। এই নির্জন প্রদেশের সুন্দর পুষ্পলতা দেখে তাঁর মনে ঈশ্বরের করুণার কথা পুনরায় প্রতিয়মান হল। জোরে জোরে হাফেজের কবিতা পড়তে পড়তে সন্ধ্যেবেলা তিনি সুংরি পাহাড়ের চূড়ায় পৌছলেন। সামনের পর্বতের কোনোটি নিবিড় বনের ঢাকা - ভাল্লুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তুর বাসস্থান, কোন পর্বত গমের খেতে ঢাকা - সোনার বরন, কোন পর্বতের গা আগাগোড়া তৃণ-আবৃত, আবার কোন কোনটি তৃণশূন্য। সূর্য অস্ত গেলে লেখক একা শৃঙ্গে বসে রইলেন। দূর থেকে পর্বতের স্থানে স্থানে কেবল প্রদীপের আলো মানুষের বসতির পরিচয় দিতে থাকল। পরদিন কেলুবনের ভিতর দিয়ে অবতরণ শুরু হল। তাঁর মনে হল পর্বতের নীচ থেকে উপর পর্যন্ত বৃক্ষরা যেন সৈন্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এটি ঈশ্বরের এক আশ্চর্য মহিমা। পথে একটি প্রস্রবণে হিমশীতল জলে স্নান করে উপাসনা করলেন দেবেন্দ্রনাথ। তারপর ছাগলের দুধ এনে দিল ঝাঁপানিরা। দেবেন্দ্রনাথের অভ্যাস ছিল উপাসনার পর দুগ্ধ পানের। কিন্তু এরকম দুর্গম অঞ্চলে দুগ্ধ পাওয়া বিস্ময়কর। তিনি ঈশ্বরের করুণায় ধন্য হলেন। পাহাড়ি পথে নীচে নামতে নামতে বোয়ালি (বাওলি, উত্তর প্রদেশ) নামক স্থানে এলেন তাঁরা। এই পাহাড়ের নীচে নগরী নদী (?) বয়ে গেছে। এখান থেকে দূরে শতদ্রু নদী দেখা যায়। শতদ্রু নদী তীরে রামপুর (রামপুর, উত্তর প্রদেশ) অবস্থিত। তারপর ভজ্জীর (ইংরেজ শাসনকালের একটি নামমাত্র সার্বভৌম রাজ্য, যেটি বর্তমানের হিমাচল প্রদেশে অবস্থিত ছিল) রাণার রাজধানী সোহিনী (সুনী, হিমাচল প্রদেশ) হয়ে শতদ্রু নদী নীচে বিলাসপুরে (বিলাসপুর, উত্তর প্রদেশ) গিয়ে পর্বত ত্যাগ করে পাঞ্জাবে সমতলে প্রবাহিত হয়েছে। পরদিন পর্বতে অবতরণ করে নগরী নদীতীরে উপস্থিত হলেন তাঁরা। এই নদী বিশাল বিশাল পাথরের খন্ডে আঘাত পেয়ে গম্ভীর শব্দের ক্রুদ্ধ ভাবে বয়ে চলেছে নীচের দিকে। নদীর উপরে সেতু পেরিয়ে একটি সুন্দর বাংলোয় তাঁরা আশ্রয় নিলেন। উপত্যকাটিতে একটি মাত্র পরিবার বসবাস করছে। তাদের আনন্দ ও সন্তোষ থেকে লেখকের মনে হল কোন রাজাও এত সুখী নন। সেদিন সন্ধ্যায় নদীতীরে ভ্রমণকালে তিনি পাহাড়ে দাবানল দেখলেন। পরদিন নদীর হিমশীতল জল ঘটি করে তুলে স্নান করলেন। এরপর পাহাড়ে আরোহন করে দারুণঘাট (দারানঘাটি, হিমাচল প্রদেশ) নামক স্থানে পৌঁছে দেখলেন সামনে এক ভীষণ উঁচু তুষারাবৃত শৃঙ্গ। আষাঢ় মাসের প্রথম দিনে লেখক এখানে তুষারপাত দেখলেন। এই পর্বত থেকে অবরোহন করে সিরাহন (সারাহান, হিমাচল প্রদেশ) নামক পর্বতে উপস্থিত হলেন দেবেন্দ্রনাথ। এখানে রামপুরের রাণার অট্টালিকা আছে। এরপর আরো দিন দশেক যাত্রা করে সিমলার বাসায় পৌঁছলেন। এই কুড়ি দিনের পর্বত ভ্রমণ পর্বে ঈশ্বর তাঁকে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি শিক্ষা দিয়ে ধন্য করেছেন বলে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হলেন লেখক। 


এবার হিমালয়ে বর্ষা ঋতু এল। মাথার উপরে নয়, পাহাড়ের নীচে মেঘ দেখে লেখক আশ্চর্য হলেন। মাঝে মাঝে এক পক্ষ কাল বৃষ্টি চলল, সূর্যের দেখা মিলল না। ঝরনার বর্ষার জলে পরিপুষ্ট হয়ে উঠল আর পথ হয়ে উঠল দুর্গমতর। আশ্বিনে শরৎকালের কোন বিশিষ্ট রূপ নেই হিমালয়ে। শীতে পর্বত তলা থেকে শিখর পর্যন্ত বরফে আবৃত হয়ে শুভ্র রূপ ধারণ করল। ভোরে বেড়ানোর অভ্যাস কিন্তু প্রবল শীতেও দেবেন্দ্রনাথ অব্যাহত রাখলেন। প্রতিদিন সকালে বহুদূর ভ্রমণ করে এসে চা ও দুধ খেতেন। বেলায় স্নানের সময় বরফ মেশানো জল মাথায় ঢালতেন। মুহূর্তের জন্য যেন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেত, কিন্তু পরক্ষণে তা দ্বিগুণ বেগে চলে শরীরে স্ফূর্তি আর তেজ সঞ্চার করত। শীতের রাতেও তিনি ঘরে আগুন জ্বালাতেন না। শীত সহ্য করে সহিষ্ণুতা বৃদ্ধির প্রয়াস করতেন। রাতে শয়নকক্ষের দরজা খুলে রাখতেন। শীতের রাতে ঠান্ডা বাতাস তাঁর খুব ভালো লাগত। দিনরাত তিনি আধ্যাত্মিক চিন্তায় ব্যাপৃত থাকতেন। 


মাঘ মাসের শেষে (ফেব্রুয়ারি ১৮৫৮) ভজ্জীর রাণার মন্ত্রী রাণাসাহেবের নিমন্ত্রণ নিয়ে এলেন। তিনি ঝাঁপানে নীচে উপত্যকায় নামতে থাকলেন। সন্ধ্যায় শতদ্রু নদীর তীরে রাণার রাজধানী সোহিনী নগরে পৌঁছলেন। সেখানে তিনি রাজগুরু ও রাণার সঙ্গে ধর্মালোচনা করলেন। শতদ্রু নদীর তীরে তিনি একাকী ভ্রমণ করলেন। চর্ম মশকে (এক রকম বড় চামড়ার থলে) চড়ে তিনি অপর পাড়েও গেছিলেন। শতদ্রু নদীতে বড় বড় পাথর থাকায় নৌকা চালানো যায় না। তীরে অনেকে স্নান করছিল। তারা বিশ্বাস করে এখানে স্নান করলে নানা রোগের উপশম হয়। সপ্তাহখানেক এখানে থেকে তিনি সিমলা ফিরে গেলেন। পথে বনের মধ্যে রত্নকুণ্ডল, হীরার কণ্ঠী, মুক্তার মালা ও দিব্য বস্ত্র পরিধান করে রাজকুমারকে মৃগয়া করতে দেখলেন। তাকে দেখে মনে হল যেন বনদেবতা। 


চৈত্র মাসের শেষে চারদিক পাহাড় ফুলে ফুলে ভরে উঠল। এক বছর সিমলা বাজারের বাসায় কাটিয়ে এবার তিনি পর্বতের উপর একটি সুন্দর, নির্জন স্থানে বাংলো নিলেন। সেই চূড়ায় একটিমাত্র বৃক্ষ ছিল, যা তাঁর নির্জনের বন্ধু হল। বৈশাখ মাসে তিনি পশমের পোশাকে ঘুরছেন এই রহস্য স্বদেশী বাঙালি কি করে বুঝবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। নির্জন পাহাড়ে পাথরে তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন। কখনো যতদূর মন চাইত নির্জন বনময় পথে তত দূর পায়ে হেঁটে চলতেন। এরপর আবার বর্ষা এল। বর্ষার জলে প্রবল বেগে নিম্ন মুখে ছুটে চলা নদীকে দেখে তাঁর উপলব্ধি হল যে নদীর সাধ্য নেই নিজের জন্য এই পূণ্যভূমিতে স্থির হয়ে থাকার। তাকে সর্বশক্তিমানের শাসনে নিম্নের ভূমিকে শস্যশালিনী করার জন্য উদ্ধত ভাব পরিত্যাগ করে, কর্দমাক্ত হলেও, নিম্নগামিনী হতেই হবে। তেমনই তাঁর হৃদয় অন্তর্যামীর আদেশ পেলেন যে, তিনি এখানে অবস্থান করে যে শিক্ষা লাভ করেছেন তা পৃথিবীতে গিয়ে প্রচার করতে হবে। এই উপলব্ধির পর তিনি বাড়ি ফিরতে উদ্যোগী হলেন। 


১৬ অক্টোবর, ১৮৫৮ বিজয়া দশমীর দিন তিনি প্রায় দুই বছর পর সিমলা ছেড়ে ঝাঁপানে করে অবরোহন শুরু করলেন। ক্রমে কালকা, পঞ্জৌর (পনজৌর, পাঞ্জাব) হয়ে অম্বালা এলেন। এখান থেকে ডাকের গাড়ি ভাড়া করে রাত দিন চলতে থাকলেন। গাড়ি থেকে দেখলেন ঘোড়সওয়ার গাড়ির পাশে পাশে ছুটে চলেছে। বিদ্রোহীদের ভয়ে গভর্নমেন্ট পথিকদের নিরাপত্তার জন্য রাতে ঘোড়সওয়ার ছোটানোর নিয়ম করেছে। কানপুরের নিকট একস্থানে তিনি দেখলেন একটি মাঠে অনেক ভিড়, অনেক তাঁবু পড়েছে। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানলেন দিল্লির বাদশাহকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য এই ব্যবস্থা। সিমলা যাওয়ার পথে বাদশাহকে আনন্দে ঘুড়ি ওড়াতে দেখেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। আজ তিনি বন্দী হয়ে কারাগারে যাচ্ছেন। এই সংসারে কখন কার ভাগ্যে কি ঘটে বলা যায় না এ কথা ভাবলেন দেবেন্দ্রনাথ। কানপুর থেকে রেলপথ খুলেছে এখন। তিনি টিকিট কাটার চেষ্টা করে প্রথমে ব্যর্থ হলেন, কারণ শুধু আহত সৈন্যদের রেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে বাঙালি স্টেশনমাস্টার, যিনি তত্ত্ববোধিনী পাঠশালায় তাঁর ছাত্র ছিলেন, তিনি তাঁকে চিনতে পারায় টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। এলাহাবাদে তখনও স্টেশন তৈরি হয়নি। পথের মধ্যে এক স্থানে রেল থামল। তাঁরা নেমে হেঁটে তিন ক্রোশ দূরে এলাহাবাদের ডাকবাংলোতে গেলেন। ডাক বাংলো ঘর না থাকায় লালকুঠি নামক কেল্লার কাছের একটি স্থানে থাকা হল। এলাহাবাদে তিনি দেখলেন বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে যে কেউ যদি আরও পূর্বাঞ্চলে যেতে চায় সরকার তার জীবনের জন্য দায়ী থাকবে না। শুনলেন দানাপুরে কুমার সিংহের (কুনোয়ার সিং) লড়াই চলছে। তিনি ভাবলেন এত বিপদে না গিয়ে জলপথে যাওয়ার কথা। স্টীমারে আশ্রয় পাওয়াও তখন ব্রিগেডিয়ারের অনুমতি সাপেক্ষ। কারণ সৈনিক ও তাদের পরিবারদের জন্য স্টীমার সংরক্ষিত। দেবেন্দ্রনাথের পরিচয় পেয়ে ব্রিগেডিয়ার অনুমতি দিলেন। কিন্তু স্টীমারে ঘর না থাকায় সঙ্গের কার্গো বোটে কাপ্তানের কেবিনে তাঁর স্থান হল। পথে সেই কেবিনও তাঁকে ইংরাজ মহিলাদের থাকার জন্য ছেড়ে দিয়ে ডেকে কাটাতে হল। তারপর রামপুরে স্টীমার বদল করে ১৫ই নভেম্বর ১৮৫৮ -তে তিনি একচল্লিশ বছর বয়সে কলকাতা ফিরলেন। 


দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রমণ কাহিনী এখানেই শেষ হল কারণ তাঁর আত্মজীবনী অসমাপ্তভাবে এখানেই সমাপ্ত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০২৪

১৪। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ১ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

 


 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


শ্রীমন্মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীর প্রথম সংস্করণ জে এন ব্যানার্জি এন্ড সন্স থেকে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। 

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) দার্শনিক ও ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারক ছিলেন। তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি মাঘ উৎসব, নববর্ষ, দীক্ষা দিন প্রভৃতি ব্রাহ্ম উৎসবের প্রবর্তন করেন। ১৮৬৭ সালে বীরভূমের ভুবনডাঙ্গা নামক স্থানে বিশাল ভূমি কিনে তিনি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজকের শান্তিনিকেতন। ব্রাহ্মসমাজ তাঁকে মহর্ষি উপাধিতে ভূষিত করেছিল। 


ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর থেকে দেবেন্দ্রনাথ দুর্গাপূজাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিবছর আশ্বিন মাসে কলকাতার বাইরে বেড়াতে যেতেন বলে নিজেই লিখেছেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে ভ্রমণ সংক্রান্ত উপাদান কিছু আছে, কিন্তু ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে যেহেতু এটি লিখিত হয়নি তাই খুব বেশি তথ্য এখানে পাওয়া যায় না। আত্মজীবনীটি অসমাপ্ত। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত এটি লেখা হয়েছে, যখন তাঁর বয়স মাত্র ৪১ বছর। অর্থাৎ তাঁর জীবনের অর্ধেকের কম সময়ের কথা তিনি লিখে গেছেন। তাই তাঁর সমগ্র ভ্রমণকাহিনীও জানা যায় না।


১৭৬৯ শকের আশ্বিন মাসে অর্থাৎ ১৮৪৭-এর সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে তিনি কাশী যাত্রা করেন। তাঁর এই যাত্রার বাহন ছিল পালকির ডাক। কলকাতা থেকে কাশী যেতে তাঁর ১৪ দিন লাগে এবং যাতায়াত অতি কষ্টকর ছিল বলে তিনি লিখেছেন। কাশীতে তিনি বেদচর্চা করতে গেছিলেন। কাশীর মানমন্দিরে (রাজা জয় সিং নির্মিত) তিনি থাকতেন। বিশ্বেশ্বর মন্দিরের পান্ডা তাঁকে মন্দিরে নিয়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি বলেন যে তিনি তো বিশ্বেশ্বরের মন্দিরেই আছেন, আর কোথাও তাঁর যাওয়ার নেই। কাশীতে অনেক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ তাঁর নিকট আসেন। প্রচুর বেদ-চর্চা হয়। 


এরপর কাশীর মহারাজের ভাই এসে তাঁকে জানান যে রাজা একবার সাক্ষাৎ চান, তাই মহর্ষিকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পরদিন তিনি আবার এসে দেবেন্দ্রনাথকে অপর পাড়ে রামনগরের রাজবাড়ীতে নিয়ে যান। রাজপ্রাসাদের ঘরগুলি ছবি, আয়না, ঝাড় লণ্ঠন, গালিচা, দুলিচা, মেজ, কেদারায় দোকানের মতো ভরা। দুইজন বন্দী (বন্দনা করে যে) রাজার আগমনে যশোগান করলেন। রাজা এসে তাঁকে সমাদরে সভায় নিয়ে গেলেন। সেখানে নৃত্যগীত শুরু হল। রাজা তাঁকে একটি হীরের আংটি উপহার দিলেন। রাজা তাঁকে দশমীতে রামলীলা দর্শনের জন্য আবার আমন্ত্রণ জানালেন। 


রামলীলার দিন রামনগরে গিয়ে দেবেন্দ্রনাথ দেখলেন কাশীর রাজা একটি বিশাল হাতিতে বসে আলবোলা টানছেন আর পিছনে একটি ছোট হাতিতে তাঁর হীরের আলবোলা ধরে বসে আছে তাঁর হুকাবরদার। আরেকটি হাতিতে রাজগুরু গেরুয়া কাপড় পরে বসে আছেন। রাজগুরু মৌন আছেন। পাছে কথা বলে ফেলেন তাই তাঁর জিভে একটি কাঠের খাপ দেওয়া আছে। চারদিকে কর্নেল, জেনারেল প্রভৃতি সেনারক্ষকরা এক একটি হাতিতে চড়ে রাজাকে ঘিরে আছে। দেবেন্দ্রনাথকেও একটি হাতি দেওয়া হল। সবাই মিলে রামলীলার রঙ্গভূমিতে যাওয়া হল। মেলায় গিয়ে দেখলেন সেখানে লোকে লোকারণ্য। সেই মেলার এক জায়গায় চন্দ্রাতপের নীচে একটি ফুলে সাজানো সিংহাসনে একটি বালক তীর ধনুক নিয়ে বসে আছে। সেই বালক রামচন্দ্র সেজেছে। রামকে গিয়ে লোকজন প্রণাম করছে। এরপর যুদ্ধ হলো। কয়েকটি সং রাক্ষস, তাদের মুখে ঘোড়া, উট, ছাগল প্রভৃতির মুখোশ; তারা যুদ্ধের পরামর্শ করছে। কিছু পরে সেখানে একটি বোমা পরল, তার চারদিকে আতশবাজি হতে থাকল। দেবেন্দ্রনাথ এই পর্যন্ত দেখে কাউকে কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেলেন। দেবেন্দ্রনাথের মনে এই বালখিল্য রামলীলা নিশ্চয়ই বিরক্তির সঞ্চার করেছিল। 


পরে তিনি কাশী থেকে নৌকা পথে বিন্ধ্যাচল দেখে মির্জাপুর পর্যন্ত গেলেন। বিন্ধ্যাচলের ক্ষুদ্র পর্বত দেখে তিনি খুব আনন্দ পেলেন কারণ সেটি তাঁর প্রথম পর্বত দর্শন। বিন্ধ্যাচলে তিনি যোগমায়া দেখলেন। পাথরে খোদাই করা দশভূজা মূর্তি যোগমায়ার। সেখানে একটিও মানুষ নেই। এরপর দেখলেন ভোগমায়া। সেখানে প্রচন্ড ভিড়। সেখানে সমানে পাঁঠা বলি হচ্ছে। এরপর মির্জাপুর থেকে স্টিমারে কলকাতার বাড়িতে ফিরলেন। 



দেবেন্দ্রনাথের পরবর্তী ভ্রমণ ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। তিনি কয়েকজন বন্ধু নিয়ে দামোদর নদীতে বেড়াতে যান। দামোদরের বুকে ঘুরে একদিন একটি চড়ে যখন নৌকা লাগল তখন তিনি শুনলেন বর্ধমান সেখান থেকে মাত্র দুই ক্রোশ দূরে। তিনি বর্ধমান দেখতে উৎসাহী হলেন ও সেখানে পৌঁছলেন। সঙ্গে রাজনারায়ণ বসু ও আরো দু একজন ছিলেন। তাঁরা শহর ঘুরে দেখলেন, রাজবাড়িও দেখলেন। তারপর রাতে সেই চড়ে আবার ফিরে এলেন। পরদিন সেই চড়ে একটি সুন্দর ফিটন গাড়ি এসে উপস্থিত হোল। গাড়ি থেকে এক ব্যক্তি নেমে তাঁকে বললেন বর্ধমানের মহারাজা (রাজা মহাতাব চাঁদ) তাঁর সাক্ষাৎ চেয়েছেন। বর্ধমানে নিয়ে গিয়ে দেবেন্দ্রনাথকে একটি সুসজ্জিত বাসস্থানে রাখা হলো। পরদিন মহাসমাদরে তাঁকে রাজবাড়ি নিয়ে আসা হলো। রাজার সঙ্গে পরিচয় ও মতবিনিময় হলো এবং পরে তিনি রাজবাড়ীর মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করলেন। 



১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপূজার সময় দেবেন্দ্রনাথ বাষ্পতরীতে (স্টীমারে) ঢাকায় গেলেন। সেখান থেকে মেঘনা পার হয়ে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে গৌহাটিতে পৌঁছালেন। কামাক্ষা যেতে মনস্থ করাতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হাতি পাঠিয়েছিলেন তাঁর জন্য। তিনি পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন, পিছনে মাহুত হাতি নিয়ে চলল। ক্রমে হাতি পিছিয়ে পড়লো এবং তিনি পদব্রজেই তিন ক্রোশ চলে কামাখ্যা পর্বতের পাদদেশে পৌঁছলেন। পর্বতের পথ পাথরে তৈরি। সেই সোজা উপরে উঠেছে। দুধারে ঘন জঙ্গল। তিনি নির্জন বনপথে একা উঠতে লাগলেন। তখনও সূর্য ওঠেনি, অল্প বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক উপরে ওঠার পরে ক্লান্ত হয়ে পাথরের উপর বসে পড়লে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলেন। চিন্তা হল জঙ্গল থেকে বাঘ ভালুক যদি আসে। এমন সময় মাহুত এসে উপস্থিত। হাতি আনতে না পেরে সে একাই ছুটতে ছুটতে এসেছে। দুজনে আবার পাহাড় চড়তে লাগলেন। পাহাড়ের উপরে একটি বিস্তীর্ণ সমভূমি।। সেখানে অনেকগুলি চালাঘর আছে কিন্তু একটি লোকও চোখে পড়লো না। তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দির যেন একটি পর্বত গহ্বর। সেখানে কোন মূর্তি নেই, কেবল যোনি মুদ্রা আছে। তিনি দর্শন করে ফিরে এসে ব্রহ্মপুত্রে স্নান করে ক্লান্তি দূর করলেন। তারপর দেখেন ৪০০-৫০০ লোক ভিড় করে পাড়ে দাঁড়িয়ে কোলাহল করছে। তারা জানালো তারা কামাখ্যার পান্ডা। অনেক রাত পর্যন্ত দেবীর পূজা করতে হয় তাদের। তাই সকালে উঠতে দেরি হয়। তিনি কামাখ্যা দর্শন করেছেন অথচ পান্ডারা কিছু পায়নি। দেবেন্দ্রনাথ তাদের বললেন তারা তাঁর নিকট থেকে কিছুই পাবে না, তারা যেন চলে যায়। 


১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দেবেন্দ্রনাথ গঙ্গা তীরে বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকা ভাড়া করতে গিয়ে একটি বড় স্টীমার দেখলেন, যেটি দু-তিন দিনের মধ্যে সমুদ্রে যাবে। দেখে তাঁর শখ হল সমুদ্রে যাওয়ার এবং তিনি স্টিমারে একটি ঘর ভাড়া করলেন। সমুদ্রের রূপ তিনি এর আগে দেখেননি।  অখন্ড জলরাশির নীল রূপ আর দিন রাত্রির বিচিত্র শোভা তিনি মগ্ন হয়ে দেখতে লাগলেন। একদিন  জাহাজ এক জায়গায় নোঙর করল। সামনে সাদা বালির চড়ায় একটি বসতি। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে তিনি কয়েকজন চট্টগ্রামবাসী বাঙালিকে দেখলেন। লেখক জিজ্ঞাসা করে জানলেন তারা এখানে ব্যবসা করে। আশ্বিন মাসে তারা এখানে মা দুর্গার প্রতিমা এনেছে। লেখক এবার ব্রহ্মরাজ্যের খাএকফু নগরে (Kyaukpyu) দুর্গোৎসবের কথায় আশ্চর্য হলেন আর ভাবলেন দুর্গোৎসব এড়াতে এত দূরে এসেও সেই দুর্গোৎসবের কথা তাঁকে শুনতে হল। 



এরপর জাহাজ মুলমীন ( Mawlamyine) অভিমুখে চলল। জাহাজ সমুদ্র ছেড়ে মুলমীনের নদীতে প্রবেশ করল। এই নদীর শোভা তেমন নেই। জল পঙ্কিল, কুমিরে পূর্ণ বলে কেউ নদীতে স্নান করে না। মুলমীনে একজন মাদ্রাজি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। লেখক তাঁর বাড়িতে কয়েক দিন কাটালেন। মুলমীন শহরের রাস্তাঘাট পরিষ্কার ও প্রশস্ত। দুইধারে দোকানে স্ত্রীলোকেরাই বিক্রির কাজ করছে। তিনি প্যাটরা (বাক্স), উৎকৃষ্ট রেশম বস্ত্র ক্রয় করলেন। এরপর মাছের বাজারে গিয়ে দেখলেন কুমির কেটে বিক্রি হচ্ছে মাছের মতো। লেখক মন্তব্য করেছেন বার্মার মানুষের অহিংস বৌদ্ধধর্ম শুধু মুখে কিন্তু পেটে কুমির। মুলমীনের রাস্তায় একদিন সন্ধ্যায় বেড়ানোর সময় দেবেন্দ্রনাথ এক বাঙালিকে দেখে অবাক হলেন। তারপর ভাবলেন বাঙালির অগম্য স্থান নাই। জিজ্ঞাসা করে জানলেন ব্যক্তিটি দ্বীপান্তরিত হয়ে এসেছিল এখানে। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে আন্দামান দ্বীপে দ্বীপান্তরকরণ শুরু হওয়ার আগে মুলমীনে অন্তরীন করা হতো। এখন শাস্তির মেয়াদ ফুরিয়েছে, কিন্তু টাকার অভাবে দেশে যেতে পারছে না। লেখক তাকে পাথেয় দিতে চাইলেন। কিন্তু সে বলল এখন সে বার্মায় ব্যবসা করছে, বিবাহ করেছে, সুখে আছে, সে আর দেশে ফিরবে না। 


যে মাদ্রাজি ভদ্রলোকের বাড়িতে লেখক আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি তাঁকে এক দর্শনীয় পর্বত গুহা (Kha you gu বা Kayon Cave, Farm Cave) দেখাতে নিয়ে যান। এক অমাবস্যার রাতে একটি লম্বা ডিঙ্গি চড়ে তাঁরা রওনা দিলেন। নৌকায় জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রভৃতি সাত আট জন সঙ্গে চলল। রাতে ১২ ক্রোশ গিয়ে ভোরে নৌকা গন্তব্যে পৌঁছাল। সেখানে একটি ক্ষুদ্র কুটিরে, মুন্ডিত-মস্তক, গেরুয়া বসন পরা কয়েকজন সন্ন্যাসীকে দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। পরে জানলেন এরা ফুঙ্গি, বৌদ্ধদের গুরু ও পুরোহিত। একজন দেখতে পেয়ে লেখককে ঘরের ভিতর নিয়ে গিয়ে পা ধোয়ার জল দিলেন, বসতে আসন দিলেন। বৌদ্ধদের কাছে অতিথি সেবা পরম ধর্ম। এরপর লেখক ও সঙ্গীরা হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গলের মধ্যে রওনা দিলেন সেই গুহার উদ্দেশ্যে। বেলা তিনটের সময় গুহার কাছে এসে পৌঁছে হাতির থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তাঁরা গুহা মুখে এলেন। ছোট গুহা মুখে গুড়ি মেরে প্রবেশ করতে হয়। গুহার ভেতর পিচ্ছিল ও ঘোর অন্ধকার। লেখক ও সঙ্গীরা গুহার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে পাথরের গায়ে গন্ধক চূর্ণ রেখে তাতে আগুন জ্বালালেন একসাথে। গুহার বিভিন্ন স্থান থেকে সেই গন্ধকের আলোয় এই গুহা আলোকিত হয়ে উঠল। গুহার প্রকাণ্ডতা ও তার উপর থেকে বৃষ্টিধারার বেগে বিচিত্র কারুকার্য (stalagmite) দেখে তাঁরা মুগ্ধ হলেন। এরপর জঙ্গলে বনভোজন সেরে তাঁরা ফিরে এলেন। কতগুলি বর্মাবাসীকে এক বাদ্যযন্ত্রের তালে নৃত্য করতে দেখলেন। স্থানীয় এক সম্ভ্রান্ত বার্মিজ পরিবারে নিমন্ত্রিত হয়ে তিনি আতিথ্য উপভোগ করেছিলেন।


১৮৫১ সালের মার্চে দেবেন্দ্রনাথ কটকে যান পালকির ডাকে। সেখানে জমিদারি সংক্রান্ত কাজের পর জগন্নাথ দর্শনের জন্য পুরীতে যান। রাতে পালকির ডাকে চললেন। সকালে পুরীর কাছে চন্দন যাত্রার পুষ্করিণী পৌঁছে স্নান করার সময় পুরীর জগন্নাথের একজন পান্ডা এসে তাঁকে ধরল। লেখক তার সঙ্গে চলতে থাকলেন। লেখকের পায়ে জুতো ছিল না বলে পান্ডা খুব খুশি হল। যখন তাঁরা পুরীতে পৌঁছলেন তখন জগন্নাথ দেবের মন্দিরের দ্বার বন্ধ ছিল। পান্ডা মন্দিরের দ্বার খুলে দিতে বহু মানুষ একসঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করল। ধাক্কাধাক্কিতে লেখকের চশমা খুলে পড়ে ভেঙ্গে গেল। ফলে চশমা ছাড়া লেখক নিরাকার জগন্নাথকেই দেখলেন। তাঁর মনে পড়ল যে একটি প্রবাদ আছে, যে যা মনে করে জগন্নাথ মন্দিরে যায় সে তাই দেখতে পায়। লেখক নিরাকারবাদে বিশ্বাসী বলে নিরাকার জগন্নাথ দেখতে পেয়েছেন এমনটি তিনি লিখেছেন। জগন্নাথের সামনে একটি বড় তাম্রকুণ্ড ভর্তি জল। সেখানে জগন্নাথের ছায়া পড়েছে। সেই ছায়াকে পান্ডারা দন্তধাবন ও স্নান করাল। তারপর জগন্নাথের মূর্তিতে নতুন বসন ও আভরণ পরাল। এরপর তিনি বিমলা দেবী মন্দিরে গেলেন, কিন্তু দেবীকে প্রণাম করলেন না। তাতে যাত্রীরা অসন্তুষ্ট হল। এরপর জগন্নাথের মহাপ্রসাদ নিয়ে শোরগোল পড়ে গেল। লেখক দেখলেন এখানে মহাপ্রসাদ নিয়ে ব্রাহ্মণ, শূদ্রের ভেদাভেদ নেই। এদিক দিয়ে উড়িষ্যাবাসীরা ধন্য। 


এরপর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপূজার সময় ১০০ টাকায় কাশী পর্যন্ত যাওয়ার জন্য তিনি একটি নৌকা ভাড়া করলেন। নবদ্বীপ পৌঁছতে ছয় দিন লাগলো। মুঙ্গেরে পৌঁছে সীতাকুণ্ড দেখতে গেলেন তিন ক্রোশ হেঁটে। তারপর ফতুয়ায় যখন বিস্তীর্ণ গঙ্গার মধ্যে দিয়ে চলেছেন, প্রবল ঝড় উঠল। লেখকের সঙ্গের পানসি আহার্য দ্রব্যসহ জলে ডুবে গেল। পাটনা এসে তিনি নতুন আহারে সামগ্রী কিনলেন। কলকাতা থেকে কাশী পৌঁছতে প্রায় দেড় মাস লাগল। কাশীতে তিনি দশ দিন ছিলেন। 


তারপর ডাকগাড়ি করে এলাহাবাদের অপর পাড়ে পৌঁছে নৌকায় গাড়ি সমেত পার হয়ে প্রয়াগ তীর্থের বেণী ঘাটে পৌঁছলেন। এই ঘাটে লোকে মস্তক মুন্ডন করে, শ্রাদ্ধ, তর্পণ, দান করে। একজন পান্ডা তাঁকে ধরে টানাটানি করতে থাকল। 


কদিন এলাহাবাদের থেকে ডাকগাড়িতে আগ্রা পৌঁছান। আগ্রায় তাজ দেখলেন। তাজের একটা মিনারের ওপর উঠে দেখলেন পশ্চিম দিক লাল করে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, নীচে নীল যমুনা, তার মধ্যে শুভ্র স্বচ্ছ তাজ যেন সৌন্দর্যের ছটা নিয়ে চাঁদ থেকে পৃথিবীতে খসে পড়েছে। 


তারপর যমুনা নদীপথে দিল্লি যাত্রা করলেন। পৌষ মাসের প্রবল শীতে নৌকায় চলাকালীন কোন কোন দিন তিনি যমুনাতে স্নান করতেন, কখনো যমুনার ধারে শস্য ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যেতেন। 


এগার দিনে যমুনা নদীপথে চলে মথুরায় উপস্থিত হলেন। সেখানে এক সন্ন্যাসী তাঁকে শাস্ত্রচর্চার জন্য ডাকেন। বিষ্মিত হয়ে তিনি দেখেন সন্ন্যাসীর কাছে সমস্ত রামমোহন রায়ের বইয়ের হিন্দি অনুবাদ রয়েছে। লেখক তারপর বৃন্দাবন গেলেন। সেখানে লালাবাবুর তৈরি গোবিন্দজীর মন্দির দেখলেন। নাট মন্দিরের চার পাঁচ জন বসে সেতার শুনছিল। লেখক গোবিন্দজিকে প্রণাম করলেন না দেখে তারা সচকিত হল। 


আগ্রা থেকে এক মাস নৌকাযাত্রা করে তিনি দিল্লি এলেন। দেখলেন নদীর পারে খুব ভিড়। দিল্লির বাদশাহ সেখানে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন। লেখক লিখেছে ঘুড়ি ওড়ানো ছাড়া বাদশাহর তখন আর কোন কাজ ছিল না। দিল্লি থেকে আট ক্রোশ দূরে কুতুব মিনার দেখতে গেলেন এবার। লেখক লিখেছেন এটি হিন্দুর পূর্ব কীর্তি। মুসলমানেরা এখন এটিকে কুতুবুদ্দিন বাদশাহের জয়স্তম্ভ বলে, এই জন্য এর নাম কুতুব মিনার। হিন্দুদের মুসলমানরা পরাজিত করার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের কীর্তিও লোপ করেছে। কুতুব মিনার প্রায় ১৬১ হাত উঁচু। তিনি সেই মিনারের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে পুলকিত হলেন। 


এরপর তিনি ডাকগাড়ি করে অম্বালায় গেলেন ও সেখান থেকে ডুলি করে লাহোরে গেলেন। লাহোর থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসর পৌছালেন। 


অমৃতসর পৌঁছে শিখদের উপাসনাস্থল অমৃতসর অর্থাৎ অমৃত সরোবরে পৌঁছানোর জন্য গুরুদোয়ারায় গেলেন। সেখানে দেখলেন একটি বৃহৎ পুষ্করনী, যেটি গুরুর রামদাস খনন করিয়েছিলেন। সরোবরের মধ্যে  উপদ্বীপের ন্যায় পাথরের মন্দির। একটা সেতু দিয়ে সেই মন্দিরে প্রবেশ করলেন। একটি বিচিত্র রঙে রেশমের বস্ত্রে আবৃত  স্তুপে গ্রন্থ (গ্রন্থসাহেব) রয়েছে। মন্দিরের একজন প্রধান শিখ তার ওপর চামর ব্যজন করছেন। গায়কেরা গ্রন্থের গান গাইছে। পাঞ্জাবি স্ত্রী পুরুষ মন্দির প্রদক্ষিণ করে কড়ি ও ফুল দিয়ে প্রণাম করে চলে যাচ্ছে। যেকোনো ধর্মের মানুষ এখানে আসতে পারে, শুধু জুতো খুলে আসতে হবে। গভর্নর জেনারেল লর্ড লিটন জুতো খোলেননি বলে শিখরা খুব অপমানিত হয়েছিল। সন্ধ্যায় আবার সেখানে গিয়ে লেখক গ্রন্থের (গ্রন্থ সাহেবের) আরতি দেখলেন। আরতি শেষে সকলকে মোহন ভোগ দেওয়া হল। দোলের সময় এই মন্দিরে বড় উৎসব হয়। 


অমৃতসরে রামবাগানের কাছে যে বাসায় তিনি থাকতেন তা ভাঙ্গা ও জঙ্গলময় ছিল। ভোরে বাগানে বেড়াতে ও দূর থেকে শিখদের সুমধুর সংগীত শুনতে তাঁর খুব ভালো লাগত। বাগানে মাঝে মাঝে ময়ূর আসত। একদিন আকাশে মেঘ দেখে ময়ূর নৃত্য করতে লাগল। লেখক তখন সেই নৃত্যের তালে তালে বীণা বাজালেন। ক্রমে এত গরম পড়ে গেল যে ঘরে আর থাকা যায় না। বাড়িওয়ালা তখন মাটির নীচের ঘরে থাকতে দিল লেখককে। সেই ঘরে পাশ দিয়ে আলো বাতাস আসে ও ঘর খুব শীতল থাকে। কিন্তু লেখক বুঝলেন তিনি মাটির নীচের ঘরে থাকতে পারবেন না। তিনি চান মুক্ত স্থান। তখন তিনি সিমলা যেতে মনস্থ করলেন। 


২০ এপ্রিল ১৮৫৭ সিমলার উদ্দেশ্যে তিনি যাত্রা করলেন। তিনদিনের পথ পেরিয়ে কালকা উপত্যকায় পৌঁছলেন। সামনে পাহাড় দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, এই ভেবে যে আগামীকাল তিনি সেই পাহাড়ের উপর উঠবেন, পৃথিবী ছেড়ে প্রথম স্বর্গের সিঁড়িতে আরোহন করতে। সেই শুরু হলো লেখকের হিমালয় দর্শন ও হিমালয় ভ্রমণ।

                       (চলছে)

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...