শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৪

২৫। তীর্থ ভ্রমণ ১০ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

২৪ শে বৈশাখ,১২৬২ সালের ভোরবেলা লেখক সঙ্গীদের সঙ্গে ভীমগড়া থেকে চারক্রোশ পাহাড়ে উঠে কেদারনাথ পৌঁছানোর জন্য রওয়ানা হলেন। হরিদ্বার থেকে কেদারনাথ পৌঁছতে পায়ে হেঁটে ১৭ দিন লাগল। প্রথম এক ক্রোশ পথে কোথাও পাথর, কোথাও বরফ, কোথাও বরফ গলা জল, কোথাও ঘাস পাতা, তারপর তিন ক্রোশ বরফের উপর দিয়েই পথ। পর্বতের উচ্চতা গঙ্গাসাগর থেকে ৪০০ ক্রোশ। বরফে চলতে চলতে পা অসার হয়। বরফ কেটে পথ হয়েছে। এক এক পদক্ষেপ হতে পারে এই পরিসর পথ। যে যে স্থানে পথের উপর কোন পদচিহ্ন আছে তার উপর পদক্ষেপ করতে হয়। যদি সামনে থেকে কেউ আসে তাহলে একটু আশেপাশে পা ফেলতে হলে মহাবিপদ হয়। কোথাও বরফে কোমর পর্যন্ত ডুবে যায়। আরো ভুল হলে কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে বলা যায় না। কমবেশি ১০ হাজার হাত নীচে মন্দাকিনী বয়ে যাচ্ছে, তার ওপর বরফ আচ্ছাদিত আছে। মধ্যে মধ্যে কোথাও কোথাও বরফ গলে ফাঁক হয়েছে সেখানে বোঝা যায় মন্দাকিনীর স্রোত বইছে। তাই বরফে পা দিয়ে মন্দাকিনীতে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। লেখক দেখেন এক ব্যক্তি বেহিসাবি পা ফেলাতে অনেক নীচে বরফে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু এক মাস আগে এই ঘটনা হলেও বরফের গুণে দেহ নষ্ট হয় নি। এই কঠিন পথে একটি পুল পার হয়ে কেদারনাথের মন্দির দেখা যায় এক ক্রোশ দূরে। শীতে মন্দির সহ সব কিছু বরফের তলায় চলে যায়। শুধু মন্দিরের উপর যে ত্রিশূল আছে তা ঢাকা পড়ে না। 


কেদারনাথ দর্শনের আগে পঞ্চ গঙ্গাতে স্নান, তর্পণ, হংসতীর্থে শ্রাদ্ধাদি করতে হয়। পঞ্চগঙ্গা হল অলকনন্দা, মন্দাকিনী, দুধগঙ্গা, ক্ষীরগঙ্গা ও মৌগঙ্গা। তারপর মন্দিরে কেদারেশ্বর দর্শন করা হলো। এখানে মহাদেবের মহিষ আকৃতির মূর্তি। এই মূর্তি দর্শন করে মন দেহ ও চক্ষু সফল হল। সমস্ত পথোশ্রমের শান্তি হল। মন্দির খুব অন্ধকার। শুধু ঘি এর প্রদীপ জ্বলে। আটদিকে আটটি স্তম্ভ আছে। পঞ্চগঙ্গার সঙ্গম জলে স্নান করে, বেলপাতা, চন্দন দিয়ে পুজো করে আটটি স্তম্ভ বেষ্টন করে প্রদক্ষিণ করে কেদারনাথকে কোল (আলিঙ্গন?) দিয়ে বারবার প্রদক্ষিণ করতে হয়। কেদারের মন্দিরে সব বরফ তখনো গলেনি, সর্বদা জল পড়ছে। কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ বরফের কারণে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার পর থেকে অক্ষয় তৃতীয়া পর্যন্ত ৬ মাস দ্বার রুদ্ধ থাকেন। অসীমঠ (উখী মঠ বা ঊষা মঠ) ও যোশীমঠ এই দুই স্থানে বাকি ছয় মাস পূজা হয় যথাক্রমে কেদারনাথ ও বদ্রীনাথের। মন্দির বন্ধ করে যাওয়ার সময় ঘি-এর প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়। অক্ষয় তৃতীয়ায় মন্দির খোলা হলে প্রথমে টেরির রাজা, দর্শনের জন্য প্রবেশ মন্দিরে প্রবেশ করলে সেই প্রদীপ নেভে। নাট মন্দিরে পঞ্চপান্ডবের মূর্তি আছে। মন্দিরের ভিতরে ও বাইরে অজস্র দেব-দেবীর, মুনি ঋষির মূর্তি। নাট মন্দিরের মধ্যে শিবের বাহন নন্দীর মূর্তি। 


মন্দিরের উত্তর দিকে আছে মহাপন্থা (মহাপ্রস্থানের পথ)। এখান থেকে তিন ক্রোশ উত্তর মুখে যেতে পারলে হিমলিঙ্গেশ্বর শিব স্পর্শ করা যায়। স্পর্শমাত্র দেহ বজ্র সমান হয়ে স্বশরীরে স্বর্গে যাওয়া যায়। কিন্তু এই তিন ক্রোশ পথ যাওয়া অতি দুষ্কর। কারণ দিনরাত বরফ জলের মতো করে পড়ছে। কেউ কেউ যেতে চেষ্টা করেও পারেনি কারণ মানুষের পায়ের শব্দের কম্পনেও বরফ খসে পড়ে তারা প্রাণ হারায়। এই বরফকে খুনি বরফ বলে। যার গায়ে এই বরফের স্পর্শ লাগবে তার অঙ্গ খসে পড়বে। এইসব কারণে কোম্পানি বাহাদুর ও টেরির রাজার পক্ষ থেকে ৩৬ জন পাহাড়ি মানুষ রক্ষকের কাজ করে যাতে কেউ বিনা অনুমতিতে এই পথে যেতে পারে না। রক্ষকদের দুম্বা ভেড়ার লোমের ও চামড়ার জামা, ইজের, টুপি আছে, তার উপরে কম্বল। তারা আগুনের কুণ্ড সমেত এক ক্রোশ পর্যন্ত যেতে পারে, তার বেশি না। এক বাঙালি একবার দৌঁড়ে ওই পথের এক ক্রোশ পর্যন্ত চলে গেছিল। রক্ষকরা তাকে প্রথমে বুঝিয়ে তারপর মেরে ও বেঁধে বিচার স্থলে নিয়ে যায় এবং ভয় দেখিয়ে অন্যত্র পাঠায়। কেউ যদি ইচ্ছা করে তাঁকে আগে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে বহু জটিল সংযম ও ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তুত হতে হয় ও টেরির রাজার অনুমোদন নিয়ে যেতে হয়। এরকম ব্যক্তি এক ক্রোশ পর্যন্ত গেছেন দেখা গেছে কিন্তু তারপর তাঁদের কী হয়েছে জানা যায়নি। কেদারনাথের মন্দিরের উত্তরাংশ থেকে ঈশান কোণে সাদা যে পাহাড় দেখা যায় তা কৈলাস পর্বত (বাস্তবে কেদারনাথ থেকে কৈলাস পর্বত দেখা যায় না)। ওই স্থানে হরপার্বতীর মন্দির আছে। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় না। পর্বতের ওপর শৃঙ্গের মতো কিছু দেখা যায়। লেখক বলেন যদি ওই বস্তু মন্দির হয়, তবে তাঁর তা দেখা হয়েছে। 


কেদারনাথের পাহাড় ও বদ্রীনারায়ণের পাহাড়ের দূরত্ব তিন ক্রোশ। পূর্বে একজন পূজারী দুই স্থানে পূজা করতো। দুই স্থানে পূজা সেরে বাড়ি ফিরে সে রোজ স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করত এই বলে যে সে যদি দুই পাহাড়ে পূজা করে ফিরতে পারে, তাহলে তার মধ্যে স্ত্রী কেন তার গৃহকর্ম শেষ করতে পারে না। এই ঝগড়া করে সে তার স্ত্রীকে মারতো। একদিন এই অত্যাচারের প্রতিবাদে স্ত্রী আকুল প্রার্থনা করেন শিবের কাছে এবং শিব এমন ব্যবস্থা করলেন যে ব্রাহ্মণ আর একদিনে দুই পাহাড়ে যেতে পারবে না। এই দুই স্থানের মধ্যে উঁচু পর্বত স্থাপন করে দিলেন। তাই কেদার ও বদ্রীর মধ্যে নয় দিনের পথ হয়েছে (এই পাহাড়ের নাম নরনারায়ন পর্বত)। সেদিনই বেলা আড়াইটার পরে কেদারনাথ থেকে ভীমগড়া যাওয়ার পালা। বরফের জন্য সূর্যের তেজ যেন ঢাকা পড়েছে। কাঁচের মতো, স্ফটিকের মত নানারকম বরফ দেখতে দেখতে বহু কষ্টে বেলা চারটেতে ভীমগড়ায় পৌঁছানো হলো। সেখানে তাঁরা তীর্থ উপবাস করলেন। ব্রাহ্মণ ভোজন, পান্ডা বিদায় করলেন এবং বিনিময়ে কেদারনাথের আশীর্বাদি পদ্মফুল পেলেন।

                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৪ বৈশাখ ১২৬২ (৭ মে ১৮৫৫) থেকে ২৪ বৈশাখ ১২৬২ (৭ মার্চ ১৮৫৫)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

                       

বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৪

২৪। তীর্থ ভ্রমণ ৯ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ    ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

৮ ই বৈশাখ ১২৬২ (এপ্রিল ১৮৫৫) যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী হরিদ্বার থেকে বদরীনারায়ণ-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। ১০ জন পুরুষ, ১২ জন মহিলা ও একটি ছয় বছরের শিশুসহ মোট ২৩ জনের দল। এর মধ্যে একটি দম্পতি ঝাপানে ও বাকিরা পদব্রজে রওনা দিলেন। সঙ্গে রয়েছে তিনটি কান্ডি, যার মধ্যে জিনিসপত্র বহন করা হচ্ছে। লেখক ঝাপান ও কান্ডির গঠন সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এক একটি ঝাপানে চারজন বাহক থাকে, ঝাপানে একজন মানুষ বসতে পারে। কান্ডি একজন পিঠে করে বহন করে। ঝাপান ও কান্ডিওয়ালাদের হাতে একটি করে বড় লাঠি থাকে যার ওপর আশ্রয় করে তারা শ্রম দূর করে কাঁধ বদল করে। ঋষিকেশ থেকে কেদার বদরীনারায়ণ দর্শন করে মেলচৌকিতে পৌঁছানোর ঝাপান ভাড়া ৭৫ টাকা করে। কান্ডিতে যত জিনিস নেবে তার প্রতি মন কুড়ি টাকা এই হিসেব। প্রথম দিন তাঁরা ঋষিকেশ পৌঁছলেন এবং লাহোরের রাজা রায় রণজিত সিংহের ধর্মশালায় আশ্রয় পেলেন। 


পরদিন সবাই মিলে লছমন ঝোলায় যাওয়া হলো। লক্ষণজীর মূর্তি দর্শন করে ঝোলার কাছে পৌঁছে সবার জ্ঞান হারানোর দশা হল। ঝোলার আকার ভয়ঙ্কর। এপারে পাহাড়ের ওপর থেকে গঙ্গার ওপারে পাহাড়ের উপরের গাছে তিনটি পাঁচশ হাত দড়ি বাঁধা আছে। সেই দড়িতে আধ হাত অন্তর একটা করে কাঠের টুকরো বাঁধা। দুপাশে দুটি দড়ি বাঁধা কোমর পর্যন্ত উচ্চতায়। দুপাশের দড়ি ধরে ওই কাঠের টুকরোয় পা ফেলে ফেলে হেঁটে ঝোলা পার হতে হয়। যদি অপর পার থেকে সেই সময় কেউ আসে তাহলে পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়। ঝোলার মাঝে অংশ নীচুতে ঝুলে আছে, সেখানে পৌঁছে প্রাণ আরো শঙ্কিত হয়। নীচে গঙ্গার যেরকম স্রোত, তা বিশাল পাথর আর বৃহৎ বৃক্ষকে অনায়াসে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। জলের এমন শব্দ যে ঝোলার হাজার হাত নীচে গঙ্গার জল থাকলেও সেই শব্দে কানে তালা লেগে যা। পাশে আছে এমন লোকের সঙ্গেও চেচিয়ে কথা বলতে হয়। তার ওপর চলতে শুরু করলে ঝোলা হেলতে দুলতে থাকে, মাঝখানে এলে এক পাশ উঁচু অন্য পাশ নিচু হয়ে যায়। তখন সবার প্রাণ যাই যাই অবস্থা হয়। সঙ্গীরা কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলেন। বাকিরা ইষ্ট নাম জপ করতে করতে পার হলেন সেই ঝোলা। 


তারপর ছয় ক্রোশ পাড়ি দিয়ে ফুলাড়ি তে পৌঁছানো হলো। এই ফুলাড়ি পর্যন্ত লক্ষণের তপোবন, এর মধ্যে অনেক সাধু তপস্যা করেন। এখানে একটি মোকামে রাতে থাকা হল বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে আগুনের ধুনি জ্বালিয়ে, তার চারপাশে শুয়ে বসে। পরদিন গঙ্গায় স্নান তর্পণ করে ৬ ক্রোশ অত্যন্ত খাড়াই পথ পেরিয়ে বিজলীতে পৌঁছানো হলো। পাহাড়ে চড়ার ক্লেশ স্থানে স্থানে ঝরনা, বৃক্ষের ছায়া আর চতুর্দিকের শোভা অনেকটা নিরাময় করে। রাতে একটি দোকানে ডাল রুটি খেয়ে সেখানেই থাকা হলো। পরদিন আট ক্রোশ পেরিয়ে মহাদেবকী চটিতে রাত্রি বাস পরদিন ব্যাসকী চটি এলো। সেখানে লছমন ঝোলার মতো কিন্তু ছোট। ব্যাসঝোলা পার হয়ে ব্যাস আশ্রম দর্শন করে রাত্রি বাস করা হলো। ব্যাস আশ্রম থেকে পরদিন ছয় ক্রোশ পাহাড়ি পথ হেঁটে ঝোলা পার হয়ে এলো দেবপ্রয়াগ। দেবপ্রয়াগে প্রায় ২০০ বদরীনারায়ণের পান্ডা আছেন। লেখকদের নির্দিষ্ট পান্ডার বাড়িতে রাত্রি বাস করা হলো। দেবপ্রয়াগে ভাগীরথী আর মন্দাকিনীর সঙ্গম। সঙ্গমে অত্যন্ত ভয়ানক জলের শব্দে কানে তালা লাগে। খাবার দিয়ে মাছের জলকেলি উপভোগ করলেন তারা। এখানে বাজার আছে তবে বেশি কিছু পাওয়া যায় না। মোটা পুরি, দই, চিনি, জিলিপি, তরকারির মধ্যে বিলাতি কুমড়ো। 


এই স্থান থেকে গঙ্গোত্তরী, যমুনোত্তরী যাওয়ার আলাদা পথ। অত্যন্ত কঠিন সেই পথ। খাবারের জিনিস সঙ্গে নিতে হয়, পথে মেলে না। ছয় দিন কষ্ট করে টেরিতে (তেহরি) পৌঁছলে সেখানে রাজার বাড়ি ও ধর্মশালা আছে।সেখানে ধর্মশীল রাজা বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা রেখেছেন। পূর্বে টেরির রাজার রাজ্য দেব প্রয়াগ ও কেদার বদরীনারায়ণ পর্যন্ত ছিল। ইংরাজ যখন সকল রাজ্য অধিকার করেন তখন টেরির রাজা টেরি, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী নিজের অধিকারে রেখে বাকি সব অংশ ইংরাজকে ছেড়ে দেন। গঙ্গোত্রী যমুনোত্রী যেতে হলে ওই রাজার কাছে পাস নিয়ে যেতে হয়। ওই স্থানে যেতে কয়েক বার ছিকাতে পার হতে হয়। নদীর দুই পাড়ে দুই পাহাড়, একটা মোটা দড়ি দুপাশের পাহাড়ের কোনো গাছে বাঁধা আছে। একজন বসতে পারে এমন ছোট একটি মেচের চার কোণে দড়ি বাঁধা। ওই দড়ি শিকার মতো আংটায় ঝোলানো। ওই আংটা উপরের মোটা দড়িতে ঝুলানো। যে পার থেকে পার হবে সেই পারের লোক ছিকা দুলিয়ে ঠেলে দেবে, অন্য যে পারে যখন আসবে সেই পারের লোক রশি ধরে টেনে নেবে। নীচে ভয়ানক নদী, তার মধ্যে অনেক কষ্টে নিজের কোমর ও হাতের ঠেলায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পার হতে হয়। লেখক অবশ্য গঙ্গোত্রী যমুনোত্রী যাননি। সম্ভবত দেবপ্রয়াগে শোনা অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। 


দুদিন পর দেবপ্রয়াগ থেকে ৬ ক্রোশ দূরে রানীবাগ যাওয়া হল এবং গৌতম মুনির মূর্তি দর্শন করে সেখানে থাকা হল। পরবর্তী গন্তব্য শ্রীনগর। সেখানে টেরির কেল্লা আছে, যা এখন কোম্পানির জেলখানা। যারা কেদারনাথ দর্শনে যাচ্ছেন এখানে তাদের সুমার বা গণনা হয়। কেদার ও বদরীনাথের পূজার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এখান থেকে সংগ্রহ করতে হয়, আর উপরের কোন স্থানে পাওয়া যায় না। এরপর শিরবগার আর পানচাকি চটিতে থেকে ঝোলা পার হয়ে রুদ্রপ্রয়াগে আসা হলো। রুদ্রপ্রয়াগের স্নান ও তর্পণ করার জন্য প্রয়াগ স্থলে নামার পথ অতি দুর্গম। ১০০ ধাপ নামার পরে একটি লোহার শিকল ধরে দশ হাত নীচে গেলে জল পাওয়া যায়। এখানে মন্দাকিনী ও অলকানন্দার সংগম। জলের স্রোত ভয়ংকর ও জল অতি শীতল। স্নান করে শিকল ধরে ওঠার সময় প্রাণ বিয়োগের মতো কষ্ট হয়। এরপর রুদ্র নারায়ণ দর্শন করে ছয় ক্রোশ গিয়ে পাহাড়ের উপরে কম্বল আচ্ছাদনে থাকা হল। 


এরপর আরো ছয় ক্রোশ পথ গিয়ে এলো গুপ্তকাশী, এখানে গঙ্গা ও যমুনা মিলিত হয়েছে। বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণার মন্দির আছে। মন্দিরের সামনে এক বড় কুণ্ড। গঙ্গার জল গোমুখ দিয়ে আর যমুনার জল সিংহ মুখ দিয়ে সেই কুন্ডে পড়ছে। কেদারনাথের পান্ডারা গুপ্তকাশীতে থাকেন। গুপ্তকাশী থেকে পাহাড়ে ৮ ক্রোশ উচ্চ চড়াই পথে  তুম্বনাথের (তুঙ্গনাথ) মন্দিরে পৌঁছে সেখানে ধর্মশালায় রাতে থাকা হলো। 


পরদিন অত্যন্ত খাড়াই পথে কষ্ট করে নেমে পাটন চটিতে পৌঁছে সে রাতে থাকা হলো। পাটন চটি থেকে ছয় ক্রোশ চড়াই উঠে ত্রিযুগনারায়ণ (ত্রিযুগীনারায়ণ) পাহাড়। এই পাহাড়ে কতক চড়াই তারপর কতক সমতল, তাই এই পাহাড়ে ওঠা অনেকটা সুবিধাজনক। গাছের ছায়া, সমতল অংশ এবং ঝর্ণা থাকায় মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়া যায়। এখানে চতুর্ভুজ নারায়ণ মূর্তি আছে। আর সামনের নাট মন্দিরে মহাদেবের ধুনি জ্বলছে। বাইরে পাঁচকুণ্ড ও অনেক দেব দেবীর মূর্তি আছে। এখানে লেখক বলেন যে পাহাড়ি মানুষের উল বা পশমের পোশাক ছাড়া সুতি বস্ত্র পায় না। কেউ ছুঁচ ও সুতি বস্ত্র দিলে তারা খুব খুশি হয়। পর্বত থেকে নেমে কাঠের পুলে গঙ্গা পার হয়ে ঝিলমিল চটি এলো সেখানে রাত্রিবাস। যদিও থাকা খাওয়ার খুব অসুবিধা। ঝিলমিল চটি থেকে মুড়াকাটা অর্থাৎ যেখানে গণেশের মুন্ড কাটা হয়েছিল শনির দৃষ্টির কারণে। 


আরো ছয় ক্রোশ গিয়ে গৌরী কুন্ড। সেখানে কুন্ডের জলে স্নান করে হর গৌরী দর্শন, লক্ষীনারায়ন দর্শন করা হলো। এখানে থাকার ভালো ভালো ঘর আছে। সেখান থেকে চার ক্রোশ গিয়ে ভীমগড়া পৌঁছলেন। সেখানে যাত্রীদের থাকার জন্য পাণ্ডাদের ঘর আছে। এখানে স্বর্গারোহন কালে ভীম পতিত হন। সেদিন বৈশাখ মাসেও সেখানে এত বরফ পড়েছিল প্রচন্ড কষ্ট হয় রাতে। ভীমগড়া থেকে কেদারনাথ চারক্রোশ পথ। খুব ভোরে উঠে গায়ে তুলো ভরা জামা, লুই , বনাত ও কম্বল মুড়ি দিয়ে, হাতে লাঠি, কাঁধে পূজার সরঞ্জাম (পাহাড়ি পথে সংগ্রহ করা বেলপাতা, মধু, চিনি, মেওয়া) নিয়ে "বম কেদার" বলে যাত্রীরা কেদারনাথ দর্শনে যাত্রা করলেন।

                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৮ বৈশাখ ১২৬২ (২১ এপ্রিল ১৮৫৫) থেকে ২৩ বৈশাখ ১২৬২ (৬ মে ১৮৫৫)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

মঙ্গলবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৪

২৩। তীর্থ ভ্রমণ ৮ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

      সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ    ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী লিখেছেন "ফাল্গুনী পৌর্ণমাসীতে শ্রীবৃন্দাবনে ফুলদোলের সময় কুম্ভের মেলা হয়। এই মেলা দ্বাদশ বছর অন্তর হয়। প্রথমে ফুলদোলে শ্রীবৃন্দাবন পরিক্রমের মেলা অন্তে হরিদ্বার গমন করে।"


যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় ১২৬১ সালের চৈত্র মাসে অর্থাৎ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চে বৃন্দাবন থেকে হরিদ্বারে কুম্ভ মেলায় স্নানের জন্য যাত্রা করলেন। ১৫ই চৈত্র ১২৬১ সালে তিনি হরিদ্বারে পৌঁছলেন এবং ২১ থেকে ৩০ চৈত্র কুম্ভ মেলা দর্শন করলেন। অর্থাৎ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে হরিদ্বারে মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি আরো বলেছেন দ্বাদশ কুম্ভের পর যে কুম্ভ হয় তাকে মহাকুম্ভ বলে। কুম্ভ বলার কারণ হলো এই যে বৃহস্পতি কুম্ভরাশিস্থ যে বছর হন, ওই কুম্ভরাশিস্থ বৃহস্পতিতে  মহাবিষুব সংক্রান্তির সঞ্চার যে সময় হয় সেই সময় হরিদ্বারে হর কি পৌরী ঘাটে স্নান হয়। উল্লেখ্য যে সেই সময় ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন বহাল ছিল।


হরিদ্বারের মহাকুম্ভ মেলাতে সেবার বহু দেশের মানুষের একত্র মিলন হয়েছে। প্রায় দেড় ক্রোর মানুষ এসেছে। চারদিকে তিন ক্রোশ পর্যন্ত মানুষের বসতি ও বাজার হয়েছে। স্থানাভাব এত হয়েছে যে সব মানুষ মাথা গোঁজার জায়গা পায়নি। পথ চলতে গেলে ঠেলাঠেলিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। কোম্পানি বাহাদুর এই বন্দোবস্ত করেছিলেন যে, যে পথে লোক একবার যাবে সে পথে আর সে ফিরতে পারবে না। এই বন্দোবস্ত দেখার জন্য স্থানে স্থানে রক্ষীরা লাঠি হাতে ঘুরছিল। গঙ্গার উপর দুটি নৌকার পুল হয়েছিল। একটি নীলপর্বতের সামনে, অপরটি হর কি পৌরী ঘাটের কাছে। একটি দিয়ে পশ্চিমপাড় থেকে পূর্বপাড় ও অপরটি দিয়ে পূর্বপাড় থেকে পশ্চিম পাড়ে যাওয়া যাবে।


মেলায় দোকানপাট অজস্র। মনোহারী দোকান, সাল-জামিয়ার-রেজাই-কম্বল ইত্যাদির দোকান, কাশ্মীর-অমৃতসর-লুধিয়ানা ইত্যাদির পশমিনার দোকান, পিতল-কাঁসা-তামা-লোহার দ্রব্যাদির দোকান, তুলসী-বিল্ব-পলার দোকান, শ্বেতপাথরের বাসন-আসবাবের দোকান, খেলনার দোকান প্রভৃতি। কাবুল-কান্দাহার-কাশ্মীর থেকে মোগল উটের পিঠে বোঝাই করে আনা আনার-আঙ্গুর-সেউ-বিহি-কিসমিস-বাদাম-পেস্তা প্রভৃতি মেওয়া, নানা রকম আচার, নানা জাতীয় মসলার পসরা, পান-তামাকের দোকান, মাটি-কাঠ-পিতল-কাঁসা-নারকেল-পাথর প্রভৃতির নানার বস্তু দিয়ে তৈরী হুঁকার দোকান। এক মাত্র পটল ছাড়া যাবতীয় রকম তরি তরকারির দোকান, কী নেই। আচারের দোকান শত শত ছিল। পাঞ্জাব, লাহোর ও দিল্লির আচারের দোকানে কত রকম যে জিনিসের আচার পাওয়া যেত তা বলার নয়। কয়েকটি অভিনব উপকরণ - আলু, করলা, পেঁপে, সজনে ফুল, সজনে ডাঁটা, বকফুল, ঝিঙে ফুল, বাসক ফুল, কুমড়ো ফুল, কচু, লাউ, কুমড়ো, তুঁত পাতা, আকন্দ পাতা, পদ্মডাঁটা, পদ্মমূল  প্রভৃতি। মোরব্বাওয়ালারা নানা রঙের নানা রকম মোরব্বা - আম, আমলকি, হরতকি, কিসমিস, লেবু ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে বসেছে। মিঠাইওয়ালা বা হালওয়াইরা লাহোর, লুধিয়ানা, অমৃতসর, দিল্লি, মিরাট, আগ্রা, মথুরা ইত্যাদি বিভিন্ন শহর ও গ্রাম থেকে এসেছে। মুগের, উরুদের, মেথির, বেসনের, মগধের, মতিচুরের লাড্ডু, অমৃতি, জিলাপি, রসবড়া, ক্ষুরমা, বরফি, পেড়া, গুজিয়া প্রভৃতি নানা মিঠাই বিক্রি হচ্ছে। গোয়ালারা ক্ষীর, দুধ, দই, রাবড়ি, মাখন, মালাই দিয়ে দোকান সাজিয়েছে। ভারওয়ালা অর্থাৎ ভুনাওয়ালারা খই, মুড়ি, চানা, মকাই, মটর, জোয়ার, বাজরা ইত্যাদির ভাজা নিয়ে বসেছে। তাদের বিক্রি খুব বেশি। দরিদ্র মানুষেরা এক পয়সার এইসব ভাজা কিনে খেয়ে পেট ভরিয়ে তারপর গঙ্গা জল পান করে নিচ্ছে। নানা জাতীয় উদ্ভিজ্জ ওষুধপত্র ও চন্দন, চামর ইত্যাদি পূজার দ্রব্যের দোকানও বসেছে। ডোমদের বানানো বাঁশের লাঠি, সাজি, টুকরির দোকান  বসেছে। অনেক তীর্থযাত্রী ঘটিতে গঙ্গাজল ভরে তার মুখ টিনের চাকতি দিয়ে আটকে গালা দিয়ে বন্ধ করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। তাই টিনের চাকতি আর গালাও বিক্রি হচ্ছে অনেক। মেলার বিভিন্ন স্থানে দোলা (নাগরদোলা) বসেছে। এক এক পয়সায় তিন তিন পাক খাওয়া যাচ্ছে।


মেলায় নানা জায়গা থেকে নানারূপ বেশ ধরে নানা চোর ও জুয়াচোর এসেছে। অন্যমনস্ক কাউকে পেলে তার জিনিসপত্র নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। জলের তলা দিয়ে এসে স্ত্রীর ধনী স্ত্রীলোকদের অলংকার পর্যন্ত চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানে স্থানে পুলিশ ঘুরছে। শত শত চোরকে ধরে চৌকিতে বন্দী করে রেখেছে। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের বড় কর্তাদের জন্য অস্থায়ী ছাউনি তৈরী হয়েছে মেলার জন্য। ঘাটের তদারকি করার জন্য হাতির ওপর আসীন পুলিশ আধিকারিকরা আছেন হর কি পৌরী ঘাটে। ঘাটে খুব ভিড়। বেশিক্ষণ কারো জলে থাকার বা দু-তিন ফুটের বেশি জলে যাওয়ার অনুমতি নেই। মেলা উপলক্ষে প্রায় দুই লক্ষ জন্তু (গরু, হাতি, ঘোড়া, উট) এসেছে। সর্বদা গ্রাম থেকে তাদের জন্য খাদ্যদ্রব্য আসছে।


কংখলে বিভিন্ন আখড়া আছে। সেখানে আখড়াধারি গোস্বামীরা বা মোহন্তরা শিষ্যদের সঙ্গে দরিদ্র অভূক্ত ব্যক্তিদেরও আহার করান। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সাধুরা কেউ এক পায়ে, কেউ ঊর্ধ্ববাহু হয়ে, কেউ লোহার কাঁটার উপর দাঁড়িয়ে, কেউ আগুনের উপর দাঁড়িয়ে আছেন কেউ মৌনি, কেউ শুধু ফলাহারি, কেউ গাঁজা-চরসে মগ্ন, কেউ ছাই মাখা। আখড়ার মোহন্তদের সঙ্গে আগে অস্ত্রধারী নাগা সৈন্য থাকতো। এই মোহন্তদের মধ্যে কে আগে স্নানের অধিকার পাবে এই নিয়ে পূর্বে বিবাদ হয়ে প্রাণ পর্যন্ত যেত। তাই সেই বার কোম্পানি বাহাদুর নিয়ম করেছেন যে কোনো অস্ত্র নিয়ে স্নানে যাওয়া যাবে না। কোম্পানির সৈন্যরা এইসব মোহন্তদের স্নানের সময় চার পাশে ঘিরে রইল। এছাড়া বাঁশ দিয়ে পথ ঘিরে এমন ব্যবস্থা করল যাতে পদস্পৃষ্ট হয়ে মানুষ মারা না যায়। একেক জন গোস্বামীর সঙ্গে চল্লিশটি উট, একশ ঘোড়া, বারটি সুসজ্জিত হাতি। আগে আগে বাদ্যধ্বনি করে হাজার শিষ্য, দুইশ পরমহংস, একশ দন্ডী ও নানা অভ্যাগত নিয়ে এক একজন গোস্বামীর শোভাযাত্রা। মোহান্তদের স্নান শেষ হলে অন্যান্য সন্ন্যাসীদের স্নান শুরু হল। তাঁদেরও রাজা ও ধনী শিষ্য আছেন। তাঁদের সঙ্গেও হাতি-ঘোড়া-উট আছে। তাঁদের স্নান সমাপ্ত হলে বিকানীরের রাজার স্নান হল। রাজার সঙ্গে তিরিশ হাজার লোক। ঐশ্বর্যের অসম্ভব প্রদর্শন ও অজস্র দানের মধ্যে দিয়ে বিকানীরের রাজার স্নান শেষ হলে অন্যান্য রাজাদের স্নান হল। রাত একটা পর্যন্ত স্নান সমানে চলেছিল সংক্রান্তির দিন। রাজপুরুষ অর্থাৎ কোম্পানির আধিকারিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে প্রাণহানির ঘটে নি। সর্দিগর্মি হয়ে অনেকে অসুস্থ হয়েছিল। তাদের সঙ্গেসঙ্গে সেই স্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার লোক ছিল এবং চিকিৎসার জন্যে ডাক্তারের ব্যবস্থা ছিল। সংক্রান্তির স্নানের পরেও মেলা আরো দিন সাতেক রইল। তারপর মেলার অস্থায়ী ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে মেলা ভঙ্গ করা হলো।

                       (চলছে)

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২১ চৈত্র ১২৬১ (৪ এপ্রিল ১৮৫৫) থেকে ৩০ চৈত্র ১২৬১ (১৩ এপ্রিল ১৮৫৫)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ১২ আগস্ট, ২০২৪

২২। তীর্থ ভ্রমণ ৭ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

  সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)


বৃন্দাবনের ঝুলনযাত্রা দর্শন শেষে লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা চললেন হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে।


বৃন্দাবন থেকে মাঠগ্রাম (মান্ট), কোররি (?), খয়ের (খাইর), খুরজা  (খুর্জা), গোলচি (?), হাপর (হাপুর) হয়ে ষষ্ঠ দিনে মিরাট এসে পৌঁছলেন যাত্রীরা। এখানে কোম্পানি বাহাদুরের সেনা ছাউনি আছে। অন্তত ১৫০ জন বাঙালি আছে মিরাটে। এখানে একটি কালীবাড়ি আছে। লেখক এখানে বলেছেন যে সমস্ত জায়গায় কালীবাড়ি আছে সে সব জায়গায় তার খরচ বাঙালি বাবুরা মাসিক হারে নিয়মিত দেন। দুটি কারণে কালীবাড়ি তৈরী হয়। প্রথম কারণ, যেসব জায়গায় বাঙালিরা ভিক্ষা বা কাজের প্রয়োজনে বা দেশ ভ্রমনে আসেন, সেইসব জায়গায় তাদের থাকার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয় কালীবাড়ি। দ্বিতীয় কারণ, এইসব অঞ্চলে জীব হিংসাকে নীচু চোখে দেখা হয়। কারো মনে 'বৃথা মাংস ভক্ষণ করবো না' এই ভাব এলে তিনি দেবীর কাছে বলি দিয়ে মাংস খান। মিরাট খুব সুন্দর শহর। স্থানে স্থানে ভালো বাজার আছে। জজ, কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার প্রভৃতির কাছারি আছে। জেলখানা, ডাক্তারখানা, ইলেকট্রিক-টেলিগ্রাফ অফিস আছে। বাঙ্গালী, দেশোয়ালি, পাঞ্জাবি, ফিরিঙ্গি, মুসলমান সবাই দোকান করেছে বাজারে, সেখানে সকল দেশের দ্রব্য পাওয়া যায়। কাজিকাপুর (খোজ কি পুর) হয়ে তৃতীয় দিনের রুড়কি (রুরকি, হরিয়ানা) পৌঁছলেন। এটি নতুন শহর। কোম্পানি বাহাদুর এই স্থানের নাম দিয়েছেন নিউ কলকাতা। এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হয়েছে। এখানে লোহার দ্রব্যাদি তৈরির এক উন্নত মানের কারখানাও হয়েছে, সেখানে মূলত লোহার বোট তৈরি হচ্ছে। 




   বৃন্দাবন থেকে হরিদ্বার ( বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)



রুরকিতে এক নতুন ধরনের খুব মজবুত পুল তৈরি হয়েছে। এই পুল যে লহরের (খাল, আপার গ্যাঞ্জেস ক্যানাল) ওপর অবস্থিত তা ইংরেজ সরকার তৈরি করেছেন, হরিদ্বার থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত। এর ফলে জলপথে যাতায়াত, বাণিজ্য, যুদ্ধসংক্রান্ত দ্রব্য আনা নেওয়া, ফসলে জলসেচ ইত্যাদির সুবন্দোবস্ত হয়েছে। এতে রাজা-প্রজা দুয়েরই লাভ।


এরপর জলাপুর (?) হয়ে লেখক ও সঙ্গীরা হরিদ্বার পৌঁছলেন, বৃন্দাবন থেকে রওনা হওয়ার একাদশ দিনে। হরিদ্বার পৌঁছে হরপিড়ি ঘাটে (হর কি পৌরী ঘাট) তর্পণ করে থাকার ঘর খোঁজা হলো। কিন্তু আসন্ন কুম্ভ মেলায় প্রচুর যাত্রী-সমাগম উপলক্ষে ঘরের ভাড়া খুব বেশি। প্রতি ঘর পনেরো দিনে ১০০ টাকা করে ভাড়া। সেসব ঘর তেমন পরিচ্ছন্নও না। তাই তাঁরা গঙ্গার ধারে ঘাসের কুঁড়েঘর তৈরি করে থাকলেন। কুশবর্তের ঘাটে তীর্থশ্রাদ্ধ করলেন। সেখানে জলে অনেক মাছের জলকেলি দেখা হল। নৌকার পুলে গঙ্গা পার হয়ে আর নীলগঙ্গা নৌকায় পার হয়ে নীলপর্বতের নীচে এলেন। সেই পাহাড়ের উপর প্রায় তিন ক্রোশ উঠতে হয়। এই পর্বতের উত্তর দিকে এক নিবিড় বন আছে, তার মধ্যে অনেক সাধু যোগসাধন করছেন। কিন্তু তাঁদের দর্শন করতে যাওয়া খুব কঠিন। কারণ ওই বনে হাতি, বাঘ, ভাল্লুক, শুকর প্রভৃতি বন্য জন্তু আছে। নীল পর্বতের উপরে চন্ডীদেবীর মন্দির। দেবী দর্শন ও পূজা করে পূর্ব দিকের পাহাড়ে অর্ধ-ক্রোশ উঁচুতে অঞ্জনা দেবী দর্শন করে পাহাড়ের দক্ষিণ দিক থেকে নামার সময় নীলকন্ঠেশ্বর শিবসহ অনেক দেব দেবীর দর্শন করে গৌরী কুন্ডের কাছে আসা হলো। কুন্ডে জলস্পর্শ করলেন ও বড় বড় মাছেদের কুণ্ডের জলে খেলা দেখলেন তাঁরা। এরপর তাঁরা হর কি পৌরী থেকে পাহাড়ের ধারে ধারে এক ক্রোশ গিয়ে পাহাড়ের নীচে বিষকেশ্বর দর্শন করলেন। সেখানে অনেক বিষবৃক্ষ আছে। ওই স্থানে বহু সন্ন্যাসী থাকেন, তাই সর্বদা হরহর শব্দের মুখরিত। 


তিন ক্রোশ দূরে কঙ্খল তীর্থদর্শন, স্নান, তর্পণ করে দক্ষেশ্বর শিব দর্শন করলেন। এখানে দক্ষযজ্ঞ হয়েছিল। এর অর্ধ-ক্রোশ পশ্চিমে সতীকুন্ড, যেখানে সতী দেহত্যাগ করেছিলেন। কংখলে অনেক মোহন্তদের আখড়া আছে। এখানে অনেক বাগান, ময়দান আছে, কুম্ভ মেলা উপলক্ষে আগত রাজা জমিদার প্রভৃতি ধনী ব্যক্তিরা ছাউনি তৈরি করে আছেন। হর কি পৌরী ঘাট ছাড়া নীলধারা, ত্রিধারা, পঞ্চধারা, সপ্তধারা ভ্রমণ ও জলস্পর্শ করলেন সবাই। এছাড়া নগর ভ্রমণ এবং সাধুদের ভজন শ্রবণ করা হলো প্রতিদিন।

                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৫ চৈত্র ১২৬১ (১৯ মার্চ ১৮৫৫) থেকে ২০ চৈত্র ১২৬১ (৩ এপ্রিল ১৮৫৫)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০২৪

২১ | তীর্থ ভ্রমণ ৬ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

জয়পুর ত্যাগ করে বগড়ু (বগরু) নামের স্থানে পৌঁছলেন লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা। সেখানে রানীর এক বাগান আছে। তাতে রানী প্রতিষ্ঠিত শিব আছে, মিষ্টি জলের কুয়া আছে। সামনে রাজার সৈন্য ও ছটি কামান রয়েছে। সেখানে রাত্রি বাস। তারপর পাড়ু, বাঁদরিসুদরি (বান্দর সিন্দরি) পেরিয়ে এলো কৃষ্ণগড় (কিশানগড়)। এখানকার রাজা স্বাধীন। রাজধানী খুব সুন্দর। রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলার ব্যবস্থা খুব ভালো। সুন্দর বাগান, ধর্মশালা আছে। লেখকেরা রাজবাড়ী, কেল্লা ও শহরের সর্বত্র ঘুরে দেখলেন। পরবর্তী পথে পরল বাণ নদী (ওল্ড ক্যানাল?)। এই নদীতে সম্বর লবণ জন্মায়। তারপরে কাউড়ি পেরিয়ে বুড়া পুষ্কর এল। এটি একটি বড় কুণ্ড। কুণ্ডের চারপাশে পাকা ঘাট। পঞ্চম দিনে এলো ব্রহ্মপুষ্কর। 



  জয়পুর থেকে আজমীর (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


এখানে শিব মন্দির ও অতিথি শালা আছে। লেখক লিখেছেন যে পুষ্কর তীর্থ সকল তীর্থের গুরু। এখানে তিনটি পুষ্কর আছে। বুড়া পুষ্কর, মধ্য পুষ্কর ও কনিষ্ঠ পুষ্কর। এই তিন পুষ্কর শিব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা  এই ত্রিদেবের যজ্ঞস্থান। বুড়া পুষ্কর শিবের, মধ্য পুরস্কার বিষ্ণুর ও কনিষ্ঠ পুরস্কার ব্রহ্মার যজ্ঞভূমি। এই কুন্ডের পরিক্রমণ করতে পাঁচ ক্রোশ পথ হাঁটতে হয়। কুন্ডের চারদিকে মন্দির ও বসতি। কুন্ডের জল সুনির্মল, তাতে শ্বেতপদ্ম ফুটে কুণ্ডের শোভাবর্ধন করছে। জলজন্তুর মধ্যে নানারকম মাছ, মকর (শুশুক), কুমীর প্রভৃতি আছে। পুষ্করের পান্ডারা বেদজ্ঞ, সৌম্য, যা দেওয়া হয় তাতেই তাঁরা সন্তুষ্ট। 


এখানে সাবিত্রী পাহাড় নামে তিন ক্রোশ উঁচু এক পাহাড় আছে। সাবিত্রী দেবীর মন্দির তার চূড়ায় অবস্থিত। মন্দিরে সরস্বতী মূর্তি আছে। এক ব্রাহ্মণ বাঙালি কন্যা বিধবা হয়ে প্রায় চল্লিশ বছর ওই সম্পূর্ণ নির্জন পাহাড়ে থেকে সাবিত্রীর তপস্যা করেন। রাতে পূজারীরাও পাহাড় থেকে নেমে আসেন, কিন্তু ওই তপস্বিনী একা থাকেন। পর্বতে নানা হিংস্র জন্তু আছে। পাহাড়ের উপরে পথের মধ্যভাগে এক উদাসীন (তাঁর বয়স একশ বছরের বেশি হবে) একা থেকে তপস্যা করেন।


পুষ্করে ১৫ টি ঘাট আছে। যথা চন্দ্রঘাট, বরাহঘাট (এখানে বরাহদেবের মূর্তি আছে), সাবিত্রীঘাট, রাজঘাট, ব্রহ্মাঘাট, সপ্তর্ষিঘাট প্রভৃতি। কুণ্ডের পশ্চিম দিকে ব্রহ্মার মন্দির, যে স্থানে তিনি যজ্ঞ করেছিলেন। মূর্তির বাম দিকে গায়ত্রী দেবীর মূর্তি। মন্দিরের দালানে নারদের একটি প্রতিমূর্তি আছে। ঘাটের কাছে অটমটেশ্বর শিব আছেন। সমভূমি থেকে আট হাত নীচে শিবের স্থান। পুষ্কর তীর্থের আদি দেব অটমটেশ্বর। প্রথমে এই শিব পূজা করে সকল দেব দর্শন ও পূজা করতে হয়। এইসব দুর্গম নির্জন তীর্থের কোন কোন স্থানে একাকী কিছু সন্ন্যাসী বা তপস্বী বাস করেন। পুষ্কর তীর্থের পরিক্রমা পঞ্চক্রোশী, পর্বতের ভিতর দিয়ে পথ। এর মধ্যে অনেক তীর্থ আছে। মরীচী, অঙ্গিরা, অত্রি, পুলস্ত প্রভৃতি মুনিদের কুটির আছে। আছে নাগ কুণ্ড, বামদেব কুণ্ড, ভৃগু কুণ্ড, কপিল কুণ্ড প্রভৃতি তীর্থস্থান। কপিল আশ্রম হয়ে পর্বতের গুহায় ঢুকে চারশ হাত ভিতরে গিয়ে কপিলেশ্বর শিব আছেন। অন্য এক গুহার মধ্যে বেশ কিছুটা সুড়ঙ্গে গমন করে নীলেশ্বর শিবের দর্শন করতে হয়। কিছুদিন পুষ্করে থেকে লেখক এবং তাঁর সহযাত্রীরা সমস্ত দেবদেবী, তীর্থস্থান দর্শন করে আজমীরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।


পুষ্কর থেকে আজমীর আট ক্রোশ পাহাড়ি পথ। আজমীর শহরে অনেক ধনী ব্যক্তি বসবাস করেন। সুন্দর সুন্দর শ্বেত পাথরের ভবন, খোদিত মূর্তি দ্বারা সজ্জিত। কিন্তু জল নিকাশি ব্যবস্থা নেই। যোধপুরের রাজা শাসন করেন এই স্থান। রাজার কেল্লা পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। শহরে নানা রকম জিনিসের দোকান আছে, তার মধ্যে শ্বেত পাথরের বাসন, দেবদেবীর মূর্তি, সিংহাসন, কৌচ, কেদারা ইত্যাদি খুব ভালো পাওয়া যায়। 


আজমীরে খাজা সাহেব বলে এক পীর আছেন, তাঁর বড়ই মাহাত্ম্য। হিন্দু মুসলমান সবাই তাঁর  দর্শনে যায়। এখানে লেখক তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। পূর্বে এখানে চন্দ্রনাথ নামে শিবের স্থান ছিল। একজন মুসলমান ভিস্তি জলসমেত তাঁর ভিস্তি একটি গাছের ওপর রেখে খাচ্ছিলেন। ফোঁটা ফোঁটা জল শিবের মাথায় পড়ছিল। সেই জল পেয়ে শিব সন্তুষ্ট হয়ে ভিস্তিকে বলেন যে তিনি তৃপ্ত হয়ে ভিস্তিকে বর দিতে চান। ভিস্তি তখন শিবের কাছে বর চান যে এই স্থানে শিবের যে নাম আছে তা অপ্রকাশিত হয়ে যেন তাঁর নাম প্রকাশিত হয়। শিব তাই বর দান করেন। শিবের স্থানের উপর মসজিদ, কবর হয় এবং তিনি খাজা সাহেব নামে খ্যাত হন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধরেরা বজায় রেখেছেন সেই ঐতিহ্য। ফকির প্রতিদিন শিবের পুজো ও খাজা সাহেবের শিরনি দুই দেন এখানে একসঙ্গে। এখানে মানত করলে তা পূর্ণ হয় বলে প্রচলিত আছে। দিল্লির বাদশা এই মসজিদ নানা রকম প্রস্তরে খোচিত করে স্তম্ভাদি নির্মাণ করিয়ে দিয়েছেন। সামনের নাটমন্দিরে নর্তকীরা, সর্বদা নৃত্য-গীত-বাদ্য করে। অতিথিশালায় অনেক ফকির বাস করেন।



আজমীর থেকে জয়পুর হয়ে মথুরা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)



আজমীর থেকে লেখকেরা আবার মথুরায় ফিরে চললেন। কৃষ্ণগড় (কিষানগড়), পরাসনি (পড়াসোলি গ্রাম), দুদুগ্রাম (দুদু), বগড়ু গ্রাম (বগরু), বড়েনা গ্রাম (?), বাউড়ি (?) হয়ে পঞ্চম দিনে তাঁরা জয়পুর পৌঁছলেন। আবার সব দেবদেবী দর্শন করে, নগর ভ্রমণ করে বেড়ালেন। রাজার বাগানে বাঘ, হরিণ, পুষ্করিণীতে জলচর পাখি দেখে আনন্দ পেলেন। এরপর ঘাট দরজা (ঘাট গেট, জয়পুর), মোহনপুরা (মোহনপুরা), দোশাগ্রাম (দোসা), সেকেন্দরা (সিকান্দ্রা), বেশোড়া (?), ছোকরাবার (?), গাগরাআনি (?), শোক (শোঙখ), সসা (শোনশা) হয়ে দশম দিনে মথুরা এলেন। 


এবার বৃন্দাবনে লেখক ঝুলন দর্শন করার সুযোগ পেলেন। বিভিন্ন মন্দির স্বর্ণ নির্মিত হিন্দোলা (দোলনা), ঝাড় লন্ঠন, বড় বড় আয়না, নানা রকম দ্রব্য দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা মেলাও হয়। ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনের ফুলদোলের সময় কুম্ভের মেলা হয় প্রতি বারো বছর অন্তর। ফুলদোলে বৃন্দাবন পরিক্রমার মেলা শেষে সবাই হরিদ্বারে যায়। এই সময় বৃন্দাবনে নানা দেশ থেকে বৈষ্ণব, সন্ন্যাসী, গোস্বামী, মোহন্ত, নাগা প্রমুখরা আসেন ও যমুনার চরে থাকেন। চতুর্দিক মুখরিত হয় পূজাপাঠ, গীতবাদ্যে।বৃন্দাবনে বারোটি আখড়া আছে। এই সময় আখড়াধারীরা আপন আপন গদি থেকে আসেন। তাঁদের সঙ্গে আসে হাতি, ঘোড়া, উট, নীলগাই, হরিণ, নীল বানর প্রভৃতি। আখড়ার মোহন্ত আখড়ার রুপার হাওদা দেওয়া, সোনা রুপার নিশান সম্বলিত হাতির উপরে চড়ে ঘোরেন। শ্বেত চামরের ব্যজন দিয়ে তাঁর সেবা করা হয়। সঙ্গে আসে সোনা রুপোর বল্লম হাতে তিন চার শত নাগারক্ষী। 

                      (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৪ আষাঢ় ১২৬১ (৮ জুন ১৮৫৪) থেকে ৪ চৈত্র ১২৬১ (১৮ মার্চ ১৮৫৪)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০২৪

২০। তীর্থ ভ্রমণ ৫ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


     সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                    (আগের পর্বের পরে)

অনধিক দুই সপ্তাহ মথুরায় থাকার পর এবার নতুন পথে নতুন সঙ্গীদের সঙ্গে যাত্রা শুরু হল। এবার লক্ষ্য জয়পুর ও পুষ্কর তীর্থ। শনশাগ্রাম (শোনশা, উত্তর প্রদেশ), শোঙ্ক (শোঙখ), কুম্ভীরা (কুমহের, রাজস্থান) হয়ে চললেন। কুম্ভীরাতে ভরতপুরের রাজার কেল্লা আছে। শহরে অনেক ধনীর বসবাস। দ্বারে দ্বারে রক্ষী দিয়ে শহর সুরক্ষিত। কেল্লার মধ্যে বড় বড় কামান আছে আর কেল্লা প্রাচীরে ঘেরা। বুরুজের ঘরে গুলি চালানোর ফোঁকর আছে। কুম্ভীরা ছেড়ে হেলেনাগ্রাম (হোলেনা, রাজস্থান)। সেখানে রানীর তলাব বা পুষ্করিণী আছে, চতুর্দিকে সান বাঁধানো ঘাট। মধ্যে মধ্যে বুরুজ আছে। তার উপরে ঘর, ধর্মশালা মহাবীরের স্থান, শিব মন্দির, বৈষ্ণব আখড়া, সব রয়েছে। এরপর মৌয়া (?), বিশড়া (বসরা,রাজস্থান), সেকেন্দরা (সিকান্দ্রা), মোহনপুরা (মোহনপুরা) হয়ে জয়পুর পৌঁছানো হল প্রায় ১২ দিনে। পথে নানা স্থানে পর্বত জঙ্গল আছে। পথ খুব খারাপ। তিন ক্রোশ অন্তর একটি করে গ্রাম মেলে।

 

মথুরা থেকে জয়পুর লেখক বর্ণিত পথে (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


জয়পুর শহরের রাস্তা চৌপাড়বন্দী অর্থাৎ পাশার ছকের আকারে চারিদিকে সমান চওড়া রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে সুন্দর সুন্দর শ্বেত পাথরের বাড়ি, তাতে নানা প্রকার দেব মূর্তি ও অন্যান্য মূর্তি খোদিত আছে। ওই বাড়িগুলি ধনী শেঠেদের বাসস্থান। বাড়ীর নিচের তলায় দোকান। এক একটি পট্টিতে শুধু এক এক শ্রেণীর দোকান থাকে। চুড়ি পট্টিতে প্রায় ২৫০ চুড়ির দোকান, জুতা পট্টিতে ৫০০ জুতার দোকান। এরকমভাবে কম্বল আসন, উলের বস্ত্র, অন্য দ্রব্য, হালওয়ার দোকান, মেওয়ার দোকান। পশমিনা, হীরা, পান্না, মোতির দোকান বা গদি দোতলার উপর। শহর চারপাশে পাথরের চার স্তরের প্রাচীর বেষ্টিত প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হয়ে চতুর্থ দ্বারে প্রবিষ্ট হয়ে রাজবাড়ীর কাছে যাওয়া যায়। সেখানে গোবিন্দজির মন্দিরও আছে, যা রক্ষা করছে পদাতিক সেনারা। গোবিন্দজির গোস্বামীকে খবর দিলে এক ছড়িবরদার একটি পাঁচ রঙের ঝড়ি হাতে করে এসে আগে আগে চলল, তাই কোন দ্বারে রক্ষীরা লেখকদের আটকালো না। শ্বেত পাথরে নির্মিত গোবিন্দজির মূর্তি রত্ন সিংহাসনে বিরাজিত ও রাজ পরিচ্ছদে সুসজ্জিত। মন্দিরে দিনে সাতবার ভোগ ও আরতি হয়। লেখকেরা দেব দর্শন ও আরতি দর্শন করলেন। গোবিন্দজির বাম ভাগে শ্রীমতিজির মূর্তি ও ডান ভাগে রাজকন্যার (রাজা সবাই জয় সিংহের কন্যা) পানের বাটা হাতে নিয়ে মূর্তি বিরাজিত আছে।


লেখক এখানে কয়েকটি কাহিনী বলেছেন - দিল্লির বাদশা আকবর বৃন্দাবনের গোবিন্দ, গোপীনাথ ও মদনমোহন মন্দির ভাঙ্গার আদেশ দেন (খুব সম্ভবত এই বাদশা আকবর না হয়ে আওরঙ্গজেব হবেন)। এই সংবাদ শুনেই জয়পুরের মহারাজ সওয়ায় জয়সিংহ বৃন্দাবনে গোস্বামীদের যত দেবমূর্তি ছিল সব জয়পুরে রাজধানীতে নিয়ে যান ও মন্দির স্থাপিত করেন। রাজকন্যা সর্বদা গোবিন্দজির মন্দিরে যেতেন যা অন্দরমহলের কাছে অবস্থিত ছিল। রাজকন্যার বিবাহকাল উপস্থিত হলে কন্যা বিবাহে অসম্মত হন এবং গোবিন্দজির শ্রীঅঙ্গে লিপ্ত হয়ে যান। এই কারণে তাঁর মূর্তি গোবিন্দজির ডানপাশে বিদ্যমান। জয়পুরে বৃন্দাবন ধামের সমস্ত দেবমূর্তি রয়ে গেছেন, কেবল মদনমোহনজির মূর্তি কড়োরির রাজা নিয়ে গেছেন ও সেই মূর্তি সেখানে আছেন। বৃন্দাবনে এইসব মন্দিরে প্রতিমূর্তি রয়েছে মাত্র। জয়পুরের রাজা গোবিন্দজির দেওয়ান হিসেবে রাজাকার্য পরিচালনা করেন। রাজ সিংহাসনে তিনি বসেন না। শহর থেকে ছয় ক্রোশ দূরে পাহাড়ের ওপর শিলাদেবীর মন্দির। এই দেবী পূর্বে মথুরাতে কংস রাজার রঙ্গস্থলে শিলারূপে ছিলেন। ওই শিলাতে কংস দেবকীর সন্তানদের আঁছড়ে বিনষ্ট করত। পূর্বে জয়পুরের এই মন্দির নরবলি হত। রাজা সওয়ায় জয়সিংহ নরবলি রদ করেছেন বলে নাকি দেবী রুষ্ঠ হয়ে বাম দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন।


সবাই রাজবাড়ী, গোপীনাথজির মন্দির ও অন্যান্য মন্দির দর্শন করলেন। কিছুদিন জয়পুরে বসবাস করে তারপর পুষ্করের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।


                        (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৭ আষাঢ় ১২৬১ (২১ জুন ১৮৫৪) থেকে ২৩ আষাঢ় ১২৬১ (৭ জুলাই ১৮৫৪)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০২৪

১৯। তীর্থ ভ্রমণ ৪ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                  -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

সেকেন্দ্রার থেকে বেউরগ্রাম(?), বিগরাই-এর বাজার সরাই (বিঘ্রাই, উত্তরপ্রদেশ) মিঠেপুর (মিঠেপুর), শকুয়াবাদ (শিকোহাবাদ), রাজার টাল (রাজা কা টাল), উশানী (ইন্দানী) হয়ে খাঁদানি (?) পৌঁছানো হলো পঞ্চম দিনে। সেখানে দুজন বৃন্দাবনের কুঞ্জবাসী লেখকদের সঙ্গী হলেন। লেখক শুনেছিলেন যে কাশীর কেশেল, প্রয়াগের প্রয়াগী আর বৃন্দাবনের কুঞ্জবাসী তিন সমান। তারা যাত্রীদের প্রায় ডাকাতি করে অর্থ হরণ করে। লেখক তাদের বললেন যে তাঁরা প্রথমে আগ্রা যাবেন। সঙ্গের টাকা শেষ, আগ্রায় গিয়ে টাকা সংগ্রহ করবেন, তারপর বৃন্দাবন যাবেন। বৃন্দাবনে কুঞ্জবাসীর কুঞ্জে থাকবেন না, বাড়ি ভাড়া করে থাকবেন। এই কথায় তারা বুঝল যে লেখকের কী অভিপ্রায়। তখন তারা বলল কুঞ্জবাসীর অর্থ লোভের কাহিনী মিথ্যা নয় কিন্তু তারা যে সেরকম নয় তা পরীক্ষা করে দেখুন লেখক। তাছাড়া তারা লেখকের জন্য অর্থের বন্দোবস্ত করে দেবেন। ফলে তারা লেখকের সঙ্গে চলল। 

খাঁদানি থেকে বৃন্দাবন, মথুরা যাওয়ার দুটি পথ। একটি পথ পশ্চিম দিকে ডাকের যাতায়াতের, আগ্রা হয়ে আর এক পথ বলদেব হয়ে। লেখকেরা বলদেব হয়ে গেলেন। বলদেবের দর্শন হলো। এখানকার পান্ডারা নিষ্ঠুর ও ভীষণ আকৃতির। মাখন মিছরি ভোগ দিয়ে দর্শন করে পুরি কচুরি প্রসাদ পেয়ে সেখানে রাত্রি বাস। ব্রহ্মাণ্ড ঘাট দর্শনে গেলেন পরদিন, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ মৃত্তিকা ভোজন করেছিলেন। লেখক বলেন সেখানকার মৃত্তিকা খেতে সুস্বাদু, ওই ঘাটে যমুনাতে স্নান তর্পণ করে গোকুল মহাবন পরিক্রমা করে শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি, সূতিকা গৃহ, ষষ্ঠী পূজার ঘর, দধি মন্থনের স্থান, পুতনাবধ স্থান, গেন্দ খেলার আঙিনা, বন্ধন। ধূলা়খেলার স্থান ইত্যাদি দেখলেন।



সিকান্দার রাও থেকে বৃন্দাবন (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)

 পরদিন গোকুল মহাবন থেকে নতুন গোকুল গেলেন ও দর্শন করলেন। তারপর যমুনা পার হয়ে মথুরা পৌছলেন। সেখানে বিশ্রাম ঘাটে স্নান, মুকুট দর্শনাদি করে, মথুরা মন্ডল দর্শন করে তিন ক্রোশ গিয়ে শ্রী বৃন্দাবন ধামে প্রবেশ করে দর্শন করলেন গোবিন্দ, গোপীনাথ, মদন মোহন এই প্রধান তিন মন্দির।মথুরায় যমুনার তীরে অনেক ঘাট পাকা বাঁধানো আছে আর অনেক ঘাটে শিব স্থাপিত আছেন। প্রধান ঘাট চব্বিশটি তাছাড়াও ধনীদের বাঁধানো আরও অনেক ঘাট আছে। মথুরা নগরে উত্তরদ্বার জয় সিংহপুরী, দক্ষিণ দ্বার কোগ্রাম। 


নগরের মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ঘর রয়েছে। ছয় হাজার ঘর মুসলমান, বাকিরা হিন্দু। হিন্দুদের মধ্যে চৌবের সংখ্যা অধিক। যেসব যাত্রী মথুরা বৃন্দাবনে আসে চৌবেরা তাদের মথুরা পরিক্রমা স্নান দান শ্রাদ্ধ দর্শন করিয়ে জীবন যাপন করে। এরা লেখাপড়া করে না আর দিনে চার বেলা সিদ্ধি খায়। মথুরায় নানা দেশের (সুরাট, বোম্বাই, গুজরাট, জয়পুর, বিকানীর, মাড়োয়ার, দিল্লি প্রভৃতি) ধনী সেঠেদের বাস। 


দ্বারকাধীশের  মন্দিরের সম্পত্তির পরিমাণ অতুল। মনি মুক্তার গহনা, বস্ত্র, ঝুলনের হিন্দোলা প্রভৃতির অমূল্য সম্ভার। প্রতিদিন তিনবার নতুন পোশাকে শৃঙ্গার হয়। দেবালয়ে মানুষ প্রতিদিন উত্তম আহার পায়। নিকটে রয়েছে কংস টীলা যেখানে কংস রাজার কেল্লা ছিল। 


শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমিকে মধুপুরি বলে। তার চারিদিকে চার দ্বারে চার অনাদি শিব আছেন। পূর্বদ্বারে পিঁপুড়েশ্বর, দক্ষিণদ্বারে রঙ্গেশ্বর, পশ্চিমদ্বারে ভূতেশ্বর ও উত্তরদ্বারে গোকর্ণেশ্বর। পশ্চিম দ্বারে মহেশ্বরী দেবীর মহাপীঠ, এখানে ভগবতীর অঙ্গ পতন হয়েছিল। এখানে দর্শনীয় রয়েছে ধ্রুবটীলা, সপ্তর্ষিটীলা বলিটীলা, কংশটীলা, মহাবিদ্যা দেবী। রয়েছে বলদেব জিউয়ের মন্দির, সেখানে স্বর্ণরৌপ্যের বড় আধিক্য। বড় বড় ধনী শিষ্য। সাধারণ মানুষের দর্শন করা কঠিন। শহরের মধ্যে কুব্জানাথের মন্দির।তার কাছে রাধা গোবিন্দজীউর মন্দির, রাধাকান্তজীউর মন্দির। এইসব মন্দিরে ১৫ দিন ব্যাপী ঝুলন হয়। দ্বারকাধীশের মন্দিরে একমাস ধরে ঝুলন হয়। 


মথুরায় ২৫ টি ঘাট ও তীর্থ। মধ্যখানে বিশ্রান্ত ঘাট যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলদেব কংশকে বধ করে বসে বিশ্রাম করেছিলেন। তার উত্তরে ১২ টি ও দক্ষিণে ১২ টি ঘাট। অগ্রহায়ন মাসে শুক্লা দশমীতে ওই স্থানে কংসবধ লীলা অনুষ্ঠিত হয়। বিশাল মেলাও হয়।


মথুরায় স্থানে স্থানে বাজার আছে। হালওয়া পট্টি, কাপড়ের দোকান, গন্ধিদের দোকান, বিলাতি দ্রব্য সবই পাওয়া যায়। রাস্তার দুই পাশে উচু উঁচু বাড়ি, তার নিচে দোকান। একটি ভালো মসজিদ আছে, সেখানে মুসলমানেরা ঘটনা করে। এখানে কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার, সদর আমিন, সদর আলার কাছারী আছে। সৈন্য ও সৈনাধ্যক্ষদের ছাওনি আছে। বাঙ্গালীঘাটাতে বাঙালিদের বাস। সাহেব আছে জন পঁচিশ। মথুরায় কেউ দুঃখী বা অভাবী নয়। স্ত্রী লোকেরা শ্রীসম্পন্না। তারা ঘাগড়া কাঁচলি, উড়ানি পড়ে। চৌবের স্ত্রী লোকেরা শাড়ি, উড়ানি পরে। এত ভালো দই লেখক আর কোথায় দেখেননি। এ ছাড়া খাজা, প্যাড়া, কুমড়ার মিঠাই, খাস্তা কচুরি, মগধের লাড্ডুও ভালো পাওয়া যায়। পশম বা উলের কাপড়ের অনেক দোকান আছে। কাবুলিওয়ালাদের আনা আনার, বাদাম, পেস্তা ইত্যাদি পাওয়া যায়। বৃন্দাবন ধামে নানা দেশের ধনী ও সাধারণ মানুষের বাস। নানা দেবালয় স্থাপনা করে, দেব সেবা, সদাব্রত, ধর্মশালা, জলসত্র, দরিদ্র ভোজন, এমনকি বানর কচ্ছপ ময়ূর প্রভৃতি পশুপাখিদেরও খাদ্য বিতরণ প্রভৃতি চলেছে। নৃত্য গীত মহোৎসব শ্রীমৎ ভাগবত পাঠ প্রভৃতিও সর্বক্ষণ চলেছে। 


বৃন্দাবনের যমুনাতে দ্বাদশঘাট আছে, যথা কালিদহ, গোপাল ঘাট, আবির ঘাট, সিঙ্গার ঘাট প্রভৃতি। প্রতিটি ঘাটের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা কাহিনী যুক্ত। এছাড়া কেবার বন বা কেতকি বন, অটল বন, বিশ্রাম বাগ, রাধা বন, বংশী বট, গোপীশ্বর মহাদেব, পুলিন, নিধুবন, নিকুঞ্জ বন, লোটন বন প্রভৃতি অসংখ্য ধর্মীয় দর্শনীয় স্থান রয়েছে। লেখক একে একে সব দর্শন করেন। প্রতিটি স্থানের মাহাত্ম্য তিনি সংক্ষেপে সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন। 


এবার তিনি ব্রজভূমিতে চারিদেব অর্থাৎ বলদেব, হরদেব, কেশবদেব ও গোবিন্দদেব দর্শন করেন। এই স্থানগুলি বৃন্দাবন থেকে কিছু দূরে অবস্থিত। লেখক এখানে তাঁর দুএকটি নিরীক্ষণ জানিয়েছেন। যেমন - মন্দিরগুলিতে যে ব্যক্তি যে রকম ভেট দেয়, সেই অনুসারে দর্শনের সুবিধা, সেই প্রসাদ শিরবস্ত্র প্রভৃতি পায়। ভেট না পেলে বিশেষত বাঙ্গালীদের ক্ষেত্রে দর্শনে বিশেষ ব্যাঘাত করা হয় কিন্তু অন্য দেশীয়রা যা দেয় তাই গ্রহণ করা হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের শিষ্য সনাতন গোস্বামী মথুরায় সাধনভজন কালে দৈববাণীতে মদনমোহনজীউ-এর মূর্তি লাভ করেন। সেই মূর্তি কালক্রমে বর্তমান মদনমোহনজীউ-এর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত। শ্রীচৈতন্যদেব এখানে এসেছিলেন এবং সনাতন গোস্বামীর ভজনাগারে মহাপ্রভুর পদচিহ্ন বর্তমান আছে।

                   ( চলছে )

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৬১ (৩১ মে ১৮৫৪) থেকে ৬ আষাঢ় ১২৬১ (২০ জুন ১৮৫৪)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০২৪

১৮। তীর্থ ভ্রমণ ৩ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                  -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

কাশী ছাড়ার পর প্রথম মেড়ুয়াডিহিতে (মারুয়াডিহ, উত্তর প্রদেশ) রাত্রি বাস। তারপর তামেচাবাদ (তামাচাবাদ) হয়ে মহারাজগঞ্জ (মহারাজগঞ্জ), পরদিন গোপীগঞ্জে (গোপিগঞ্জ) স্থিতি। তারপর ক্রমে হাড়িয়া (হরিয়া), ঝুসীগ্রাম (ঝুসী) হয়ে  নৌকার পুলে গঙ্গা পার হয়ে এক ক্রোশ গিয়ে ত্রিধারা অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর নদীর ঘাট বেনীঘাটে রাত্রি বাস। এখানে যাত্রীদের প্রয়াগে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়াগীরা (প্রযাগের পান্ডা) উপস্থিত। প্রয়াগীরা অত্যন্ত লোভী, নির্দয়, নিষ্ঠুর। প্রথমে যাত্রী নেওয়ার সময় ভদ্র ব্যবহার করে কিন্ত পরে দুর্ব্যবহার করে। তাদের সৈন্য আছে (!) যাত্রীরা প্রয়াগতীর্থে পৌঁছে মুন্ডন ও উপবাস করলেন। 


পরদিন ত্রিধারাতে স্নান তর্পণ, তীর্থশ্রাদ্ধ, ব্রাহ্মণ ভোজন, প্রয়াগ মাহাত্ম্য শ্রবণ করলেন। তারপরের দিন আবার ত্রিধারায় স্নান করে পঞ্চক্রোশী পরিক্রমণ, বেণীমাধব দর্শন, কেল্লার ভিতরে অক্ষয়বট দর্শন, সরস্বতী নদীর গুপ্ত ভাব দর্শন প্রভৃতি করলেন। সরস্বতী নদীর উপরে যমুনার পশ্চিম ধারে পাথরের তৈরি কেল্লা। কেল্লার মধ্যে বাড়িঘর। বড় বড় কামান বন্দুক তরবারিতে কেল্লা সুরক্ষিত। কেল্লায় এক ক্রোশ অন্তর  পদাতিকদের ছাউনি। শহরে বাজার, কাছারি, ডাক্তারখানা, ডাকঘর সব আছে। উত্তরে স্টিমার অফিস। এই প্রয়াগকে এলাহাবাদ বলে। শহরে ৫০ হাজার ঘর আছে। জল বাতাস খুব ভালো, শরীর ভালো থাকে।


এরপর লেখক তিতু বাগদি আর মহেন্দ্রনাথ মিত্র সহ বৃন্দাবন যাত্রা করলেন। বাকিরা দেশে ফিরে গেলেন। এরপর দুর্গাগঞ্জ , ইমামগঞ্জ, গোলামীপুর (গুলামীপুর), ভূধরের সরাই (?), চৌধুরী সরাই (চৌধুরী সরাই), কুঙরপুর (কুনওয়ারপুর), খাজুয়া (খাজুয়া) হয়ে ছয় দিনে কানপুর পৌঁছলেন। এখানে ইংরাজ সরকারের পদাতিক সৈন্যদের শিক্ষার স্থান রয়েছে। দুর্গ নির্মিত নেই, মাঠের মধ্যে ছাউনি। এখানে অনেক গোলাগুলি, বারুদের সংগ্রহ আছে। প্রহরীরা সতর্কভাবে পাহারা দেয়। বাদশাহী আমলের বড় বড় মজবুত সরাই আছে পথিকদের জন্য। প্রায় ৩০০ বাঙালি আছেন। এক কালীবাড়ি আছে, সেখানে অতিথিরা থাকতে পারেন। জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টরের কাছারি, দেওয়ানি ও ফৌজদারির কাছারি আছে।




কানপুর থেকে সেকেন্দা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


কানপুরের উত্তর পূর্বে আট ক্রোশ দূরে বিঠোর (বিঠুর)। এটি বাল্মিকী মুনির তপোবন। সীতার বসবাস স্থান, লব কুশের জন্মস্থান। পুনা সেতারার বাজিরাও এর বাড়ি ও সৈন্য কিছু এখানে আছে। তার দত্তক পুত্রের পুত্র নানা সাহেব ওই পদাতিক সৈন্য নিয়ে এখানে থাকেন। 


এবার এলেন কান্যকুব্জ   (কনৌজ)। এখানে কনৌজের ব্রাহ্মণদের বাস স্থান। এখন থেকে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা গৌড়ে এসে কৌলিন্য প্রথার সূচনা করেছিল। এখানে অনেক প্রাচীন দেবালয়, প্রাচীন অট্টালিকা আছে ও অনেক পন্ডিত বেদজ্ঞ বসবাস করেন। 


এবার গঙ্গা পার হয়ে লক্ষ্ণৌ শহর, যা তখন নবাবের অধিকারে ছিল।সেখানকার মানুষ ধনী, মহাবলশালী, উগ্র স্বভাব এবং অল্প কথায় বিবাদ হলেও তরবারি চলে। ইংরাজ সরকারের তরফ থেকে একজন রেসিডেন্ট ও দুই দল সৈন্য আছে। নবাবের রাজ্য অধিক দূর নহে অথচ ৫২ রাজার সিংহাসন _ এই মন্তব্য করেছেন লেখক সকলেরই সৈন্য সমাবেশ আছে। এক হাজারের কম বন্দুকধারী কারো না। দশ হাজার পর্যন্ত অনেকেরই আছে। শহর প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। শহরে প্রবেশের সময় নবাবের দ্বারপাল নাম ধাম জিজ্ঞেস করে। অস্ত্রধারী ভিন্ন রাজ্যবাসীকে প্রবেশ করতে দেয় না। কোনো বিদেশি এই রাজ্যে এলে স্থানে স্থানে বলপূর্বক তার থেকে টাকা-পয়সা নেওয়া হয়, এমন অরাজগতা বিদ্যমান। নবাব দুর্গের মধ্যে সাত মহলায় বাস করেন। গোমতী নদীর তীরে এই শহর। মচ্ছিভবন নামে একটা বড় বাড়ি আছে, তার মধ্যে ফুল ফলের বাগান পুকুর আর থাকার ভালো ভালো ঘর আছে। মাটির নীচে নবাবদের গোরস্থান আর মৃত নবাবদের ধন দৌলত কোষাগার করে রাখা আছে। অনেক প্রহরী ও কামান আছে সেসব পাহারা দেওয়ার। নবাবদের অজস্র ধন-সম্পদ আছে। একজন বাঙালি জহুরী লেখককে জানালেন প্রতি বছর ক্রোর টাকার জহরত্ নবাবরা ক্রয় করেন। তাদের জুতোর উপরেও হিরে বসানো থাকে।


পরবর্তী গন্তব্য অযোধ্যা, শ্রীরামচন্দ্রের রাজধানী বন জঙ্গল হয়েছে। মধ্যে মধ্যে বসতি ও রাম সীতার মূর্তি আছে। রামনবমীতে মেলা হয়। পাঁচ ছয় হাজার বৈষ্ণব শ্রীরামের জন্মভূমি ও হনুমান গড়িতে আছে, সর্বদা ভজন সাধনে উম্মত্ত। বড় বড় হনুমান আছে কিন্তু তারা কারো ক্ষতি করে না। বরং স্তবস্তুতি করলে পথিককে পথ দেখানোর জন্য আগে আগে যায়। যেখানে রামচন্দ্রের জন্মভূমি সেই দ্বারে এক বৃহৎ হনুমান আছে তাকে কিছু খাদ্য দ্রব্য না দিলে পথ ছাড়ে না। যে স্থানে রাজ সিংহাসন ছিল সেখানে উচ্চ দ্বীপের ন্যায় হয়ে আছে। রাজধানী প্রায় দশ ক্রোশ পর্যন্ত ছিল। বাড়িঘরের চিহ্ন ইঁট পাথর তখনও ছিল।


গঙ্গা পার হয়ে মিথিলায় (নাকি সীতাপুর, উত্তর প্রদেশ?)। এর মধ্যে নৈমিষারণ্যে যান, যেখানে ৬০ সহস্র ঋষির তপোবন ছিল। নানা ফুলে সুশোভিত বন, নির্জন স্থান দেখে খুব আনন্দলাভ করলেন। এবার সেকেন্দ্রা (সিকান্দ্রা) উপস্থিত হলেন। সেখানে জেলার কাছারি, ডাকঘর, ডাক্তার-খানা আছে । এখানে এমন কাছারি দেখেন যেখানে মুসলমান মুন্সেফ আর ব্রাহ্মণ দারোগা। দোকান ঘরে থাকার ব্যবস্থা আছে। দোকানে পুরি, কচুরি, মিঠাই, প্যাঁড়া পাওয়া যায়। সেকেন্দ্রা থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হলো।

                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৪ চৈত্র ১২৬০ (৭ এপ্রিল ১৮৫৪) থেকে ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১২৬২ (৩০ মে ১৮৫৪)




প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...