সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
মাসখানেক বৃন্দাবনে থেকে জন্মাষ্টমীর পরে লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী এবার দ্বাদশ বন পরিক্রমণ বা ৮৪ ক্রোশ পরিক্রমণে বের হলেন। প্রথমে দেখলেন ভোজনটিলা এখানে শ্রীকৃষ্ণ রাখালদের সঙ্গে মুনিদের কাছে অন্নভিক্ষা করে ভোজন করেছিলেন। টিলার উপরে একটি মন্দির, মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণ গোষ্ঠের বেশে বিরাজ করছেন। তারপর এলো অক্রূর ঘাট। শ্রীকৃষ্ণ-বলরামকে কংস রাজার কাছে মথুরায় নিয়ে যাওয়ার সময় যমুনার তীরে রথ রেখে অক্রূর এখানে যমুনা নদীতে স্নান তর্পণ করেছিলেন। এখানে মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণ, বলদেব ও অক্রূরের মূর্তি আছে। এরপর এলো ভূতেশ্বর শিব এবং পাতালদেবী বা মাহেশ্বরী দেবীর মন্দির।
তারপর এলো মধুবন। এই বনে কৃষ্ণকুণ্ড নামক পুষ্করিণীতে স্নান তর্পণ করে মধুবিহারী ঠাকুরের দর্শন করে দুই ক্রোশ দূরে তালবনে যাওয়া হল। তারপর কুমুদবনে কুমুদবিহারী ঠাকুর, কুমুদকুন্ড, কপিলমুনির মন্দির দেখে মধুবনে এসে থাকা হল। পরদিন শান্তনুকুন্ডে স্নান করে শান্তনুবিহারী ঠাকুর দর্শন করে বেহুলা বনের বেহুলাকুন্ড ও বেহুলা গাভী দর্শন এবং রাধা কৃষ্ণ মন্দির দর্শন করে ওই বনে রাত্রিবাস। তারপর দিন অষ্টসখী কুন্দ দর্শন এবং শ্যামকুণ্ড ও রাধা কুণ্ড আর তমাল বৃক্ষের নীচে রাধাকৃষ্ণের চরণচিহ্ন সম্বলিত বেদী দর্শন করলেন। এখানে ভক্তদের থাকার অতিথিশালা আছে। কুন্ডে অনেক মাছ ও কচ্ছপ আছে, কেউ তাদের মারে না। বনে ময়ূর ও বানর আছে অনেক।
এরপর গোবর্ধন পর্বত পরিক্রমে যাত্রা করলেন লেখক। গোবর্ধন পর্বত বৃহৎ কিন্তু তেমন উঁচু নয়। ঘাস, বৃক্ষলতায় ঢাকা। পাহাড়ের উপর গোপালের মূর্তি আছে। ভরতপুরের রাজা গোবর্ধন পর্বতে অনেক দেবতার সম্পত্তি দান করেছেন। গোবর্ধন পর্বতে কুসুম সরোবর টিলা ও কুণ্ড নারদ কুন্ড, ভানু কুণ্ড, মানসী গঙ্গা, চক্র তীর্থের ঘাট, রূপ সনাতন গোস্বামীর ভজন কুটির (এখানে শ্রীচৈতন্যদেব এসেছিলেন), ব্রহ্ম কুণ্ড, পাপ মোচন ইত্যাদি অজস্র তীর্থস্থল আছে, লেখক সব একে একে দর্শন করলেন।
এবার গোবর্ধন থেকে দীগ গ্রাম বা লাঠাবনে এলেন। এখানে ভরতপুরের রাজার বাড়ি রয়েছে। সেই রাজবাড়ী অত্যন্ত সুসজ্জিত। রাজবাড়ীর অতিথিশালায় যাত্রীদের বসবাসের বন্দোবস্ত আছে।
দীগবন থেকে কাম্যবনে এলেন। সেখানে বিমল কুন্ড ও বিমলা দেবী দর্শন করলেন। পরদিন কাম্যবনের যশোদা কুন্ড, সূর্যকুন্ড, লুকলুক কুন্ড, চরণ পাহাড়, কৃষ্ণকুণ্ড দেখলেন। শ্রী গোবিন্দজি, গোপীনাথজি ও মদন মোহনজির মন্দির দেখলেন। গোবিন্দজির মন্দিরের দুপাশে বৃন্দাদেবী ও জগন্নাথ দেবের মন্দির। যুধিষ্ঠিরের বনবাসের যজ্ঞস্থান চৌরাশি স্তম্ভের গৃহ এবং পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদীর মূর্তি দেখলেন। ঔরঙ্গজেব বাদশাহের দৌরাত্বের সময় বৃন্দাবনের সকল দেব-দেবীর মূর্তি কাম্যবনে রাখা হয়েছিল।
কাম্যবন থেকে আসা হলো বরসান। সেখানে দেহকুণ্ড, বৃষভানু কুন্ড, নারায়ণীজি মন্দির, অষ্ট সখীর কুন্ড প্রভৃতি দর্শন করা হলো। বরসান থেকে নন্দগ্রাম যাওয়ার পথে সংকেত বট ও যোগমায়া দেবীর মূর্তি দেখে নন্দ গ্রামে পৌঁছে নন্দ ঘোষের বাসস্থান, পাহাড়ের উপরে নন্দ, যশোদা, কৃষ্ণ, বলরাম মূর্তি, ঐরাবত কুণ্ড, কেলি কদম্ব বৃক্ষ, পবন সরোবর দেখা হল।
নন্দ গ্রাম থেকে শ্বাসকুন্ড, কদম্বখন্ডি, সূর্য কুন্ড, কিশোরী কুণ্ড, জাবট, রাসস্থলী, খদির বন দেখে কোকিল বনে আসা হলো। কোকিল বনে কোকিল বিহারী ঠাকুর আছেন।
তারপর শেরশায়ীতে বিষ্ণুর অনন্ত শয়নে মূর্তি ও ক্ষীরোদ সাগর নামক পুষ্করিণী দেখলেন। এরপর এলেন সে। সেখানে গোবিন্দজি, গোপীনাথজি, মদনমোহনজির দেবালয় দর্শন করলেন।
এর পরের গন্তব্য নন্দঘাট। সেখানে শ্রীজীব গোস্বামীর ভজন কুটির আছে। প্রথমে ভদ্রবন ও পরে ভাণ্ডীর বট দেখলেন, এটি গোপালের গোচারণ ক্ষেত্র।
এরপর বেলবন, পানিঘাট, আন্দি নান্দি বন হয়ে বলদেব এলো। এই স্থানের পান্ডারা অতি চতুর, প্রতারক, ছলেবলে যাত্রীদের সর্বনাশ করে।
পরের গন্তব্য মহাবন বা গোকুল, যা নন্দ ঘোষের বাড়ি। নন্দ ঘোষের বাড়ি একটি উঁচু টিলার উপর অবস্থিত। তখন ওই বাড়িতে তহশিলদারের কাছারি। সেই বাড়িতে লেখক গোপালের স্মৃতি বিজড়িত সব স্থান দেখলেন।
এই স্থানের তিন ক্রোশ উত্তরে রাওল গ্রাম যা বৃষভানু রাজার বাস অর্থাৎ রাধারানীর জন্মস্থান।
এইসব দর্শন করে কোগ্রামের কাছে যমুনা পার হয়ে নওরঙ্গবাদে উঠে মথুরায় এলেন।
এই পরিক্রমণের সময় লেগেছিল প্রায় ১৫ দিন এবং ৮৪ ক্রোশ অর্থাৎ প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পরিক্রমণ করেছিলেন লেখক। বৃন্দাবন পরিক্রমণ আজও বহাল থাকলেও এই স্থানগুলির বেশিরভাগই অধুনালুপ্ত।
(চলছে)
এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১২৬২ (৭ জুন ১৮৫৫ ) থেকে ১৯ মাঘ ১২৬২ (২ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬ )
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!



