সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
এবার শুরু হল লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর দ্বিতীয় বার এবং আরো বিশদভাবে দিল্লি দর্শন। সেই সময় দিল্লির সিংহাসনে রয়েছেন শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে তাঁর ক্ষমতা শুধু দিল্লির কেল্লার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর তাঁর বাদশা উপাধি নামমাত্রই হয়ে উঠেছিল। লেখকের বর্ণনায় ইন্দ্রপ্রস্থ বা দিল্লী শহরের আকৃতি ডিমের মতো। এই শহরে প্রকাশিত দ্বার বারটি আর গোপন দ্বার পাঁচটি। প্রকাশিত দ্বারকে দরওয়াজা বলে আর গোপন দ্বার কে খিড়কি বলে। প্রধান দ্বার হল দিল্লি, আজমিরি, কাশ্মিরি, কলিকাতা দরজা প্রভৃতি। এইসব দরজায় অস্ত্রধারী দ্বারপাল ও পদাতিক সৈন্য ছিল। গোপন দরজা যেমন বাহাদুর আলী খান খিড়কি, নিগমবোধ খিড়কি, খাজানা খিড়কি প্রভৃতি। দিল্লি শহর পাঁচ ক্রোশ বিস্তৃত। শহরের স্থানে স্থানে নানা দ্রব্যের ক্রয় বিক্রয়ের সওদাগর, সব দেশের মানুষজন, রাজপুরুষ ও বেশ্যারা থাকে। লাহোর থেকে দিল্লি পর্যন্ত রয়েছে প্রশস্ত রাজপথ। শহরের মধ্যে দিয়ে যমুনা বয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে সেতু আছে তাই দিয়ে লোক চলাচল করে। হীরা, জহরত, চুনি, পান্না, কালাবর্ত অর্থাৎ সোনা রুপার তারের খচিত বস্ত্রের ব্যবহার এখানকার ধনীরা খুব করেন। মাঝে মাঝে এরকম স্থানও আছে যেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অল্প আয়ে জীবন যাপন করে। প্রধান পথের দুই পাশে দোকানগুলি নানা দ্রব্য দিয়ে শোভিত। মাঝেমাঝে কাঠের স্তম্ভে কাচের দীপাধার আছে, রাতে এখানে দীপ জ্বলে নগর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শহরের মধ্যস্থলে জুম্মা মসজিদে অপরাহ্নে মৌলবী, মুন্সি, ফকিররা একসাথে সাধন ভজন করে। ওইখানে চকের মত উত্তম দ্রব্য বিক্রয় হয়। দিল্লির নতুন কেল্লার (লাল কেল্লা) তিনটি দরজা। দিল্লির দ্বারের কাছে লালদীঘি নামে পুষ্করণী আছে যা যমুনার জলে পূর্ণ। তাতে মাছ আছে।
রাজধানীর ব্যক্তিগণ সুসভ্য, সুবেশ, সুআবাস, সুভাষ, সচ্চরিত্র ও স্বধর্মে সুপবিত্র। অপরাহ্ণে সবাই ঘোড়া, হাতি, উট, বিমান(?), রথ, মানুষের টানা গাড়ি, গরুর গাড়ি, মৃগযান(?), চেরেট (চ্যারিয়ট), বগী(?), পালকি, সেজগাড়ি, তানজাম, মেছনি(?), বোচা(?), মহাপা(?)-তে বস্ত্র অলংকারে সুসজ্জিত হয়ে ভ্রমণ করে। যাদের এসব নেই তারাও ভালো বস্ত্র পরে, সুগন্ধি ফুলের মালা বা আতরে মন প্রফুল্ল রাখে। নর্তকী ও বেশ্যারা আপন আপন নায়কের সঙ্গে ভ্রমণ করে।
দিল্লিদ্বার দক্ষিণ দিকে, লাহোরদ্বার পশ্চিম দিকে। কলকাতা দরজা পূর্বে ছিল না। গভর্নর জেনারেলের আদেশে কলকাতা দরজা হয়েছে। কাশ্মীর দরজার দুই মাইল পরে সেনা ছাউনি। দিল্লির কলেজে ইংরেজি, পার্সি, আরবি, উর্দু ও দেবনাগর এই পাঁচ ভাষায় পড়ানো হয়। লেখক এরপর দিল্লির ৩৩ টি বাজারের নাম জানিয়েছেন। এছাড়াও দিল্লিতে গলিতে গলিতে আরো বাজার আছে। নিগমবোধ খিরড়ির কাছে অনেক হিন্দু দেবালয় আছে।
বাদশাহী তক্ত অর্থাৎ পূর্বের রাজসিংহাসন বহু মহামূল্য পাথরের লতাপাতা, পুষ্প খোদিত ছিল, সেসব খুলে লুট করে নিয়ে গেছে (নাদির শাহ নাকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, কার কথা বলছেন লেখক?)। দেওয়ান ই আমে বাদশাহ আগে বসতেন। ২২ টি থামে ২২ জন সুবা দাঁড়াতেন। সামনে ফুলের বাগান আছে। তারপরে মহাতাব বাগ, আরাম গৃহ, আঁধিয়ারি বাগ আছে। আঁধিয়ারিবাগে অনেক জাতের মেওয়া, ঔষধি গাছপালা আছে। যমুনার জল থেকে ফোয়ারা তৈরি করে রাখা আছে। মাঝে মাঝে আছে চৌবাচ্চায় পদ্ম ফুলের শোভা। একটি ঘর আছে যেখানে শতধারায় ফোয়ারা বসিয়ে জল ছাড়া হতো আর শ্রাবণভাদ্রের মতো বৃষ্টি হতো। নৌকা ভ্রমণের জন্য ব্যবস্থা ছিল বাদশাদের। এরপর মতি মসজিদ বা বাদশাহের ভজনের স্থান। আগে বহু মূল্য পাথরে খচিত ছিল। এখন শুধু শ্বেতপাথর আছে। যে কক্ষে বাদশাহ রাজকার্যে বসেন, দেওয়ানী খাস, তার শোভা অতুলনীয়। দৈর্ঘ্য প্রস্থে বিরাট ঘর। কিন্তু কড়ি বর্গা নেই, পাথরের চাদরের খিলান। তাতে নানা রঙের প্রস্তর খচিত ও চিত্রবিচিত্র আছে। ঘরের মধ্যস্থলে শ্বেত পাথরের রাজসিংহাসন এক হাত উঁচু বেদির ওপর বসানো। ওই তখত ঘরের মধ্যে বন্ধ করা থাকে। যখন বাদশাহ বসেন তার আগে সুসজ্জিত করে বের করা হয়। ওই তখতের চারপাশে মছলন্দের (কারুকার্য করা নরম বসার আসন) বিছানায় বসে রাজপুরুষরা আপন আপন কাজ করতেন। ওই ভবনের উত্তর দ্বারে স্ফটিকের এক চৌকি আছে সেখানে বসে যমুনা দেখা ও শীতল বায়ু সেবন করতেন বাদশাহ।
ভবনের চারদিকে সরদারদের দপ্তর আর খোজা রক্ষক আছে। আরও ভিতরে বাদশাহজাদাদের মহল্লা বা বাদশাহী অন্তঃপুর। বাদশাহের কুড়িজন বিবাহিতা ও বাকি অবিবাহিতা নিয়ে ২০০ বেগম। বাদশার বয়স তখন আশির বেশি, সর্বদা বাইরে আসেন না। অন্তঃপুরে এক মসজিদ আছে, সেখানে স্ত্রীলোকেরা ভজনা করে। দিল্লিশ্বরের ঘুড়ি আর শিকার খেলা খুব প্রিয়। দিল্লিশ্বরের মধ্যমপুত্র মির্জা খুব গুণী ও গান বাজনায় সুপন্ডিত। তিনি খুব সুপুরুষ। ঘোড়া ও কুকুর তাঁর খুব প্রিয়। তিনি গান বাজনা আর ভ্রমণ নিয়ে থাকেন। লাল পর্দা বলে একটি অন্তঃপুর আছে। সেখানে কোনো পুরুষ, খোজা, এমনকি ৫ বছরের বালকেরও প্রবেশাধিকার নেই। সেখানে নারী দোকানীর কাছে বেগমেরা হীরা মোতি ক্রয় করেন। কৌড়িয়া পুলের কাছে বেগমবাগ নামে এক বাগান আছে। অতি সুরম্য, সুশীতল স্থান। পাঞ্জাবি কাটরাতে পাঞ্জাবি সওদাগরদের বাস। এরা দীর্ঘকাল দিল্লিবাসী ও বাণিজ্য কর্ম করে ধনী হয়েছে। সব বাজারে জরি, পাল্লা, কালাবর্ত ও টুপির দোকান আছে। কুর্তা , আঙ্গিয়া, লেহেঙ্গা, দোপাট্টা বহু মূল্য ও উত্তম মানের পাওয়া যায়।
নিগমবোধ ঘাটে প্রতি রবিবার গায়কদের মজলিস হয়। শহরের সব গায়ক সেখানে উপস্থিত হন। কাশ্মীর দরজার কাছে এক সাহেবের বাড়িতে এক জন্তু আছে, তার আকার উটের মতো, গলা লম্বা, মুখ ঘোড়ার মত, পেছনের পা ছোট, গায়ে বাঘের মতো ফোটা ফোটা দাগ, বয়স দুই বছর মাত্র কিন্তু বড় উটের মত লম্বা। যে জন্তুকে লেখক দেখেছেন তা জিরাফ অর্থাৎ এক ইংরেজ সাহেব দিল্লিতে নিজের বাড়িতে জিরাফ পুষেছিলেন। যমুনার নিগমবোধের ঘাটে তিনি নৃসিংহ চতুর্দশীর মেলা দেখেছিলেন। মেলায় প্রহ্লাদ চরিত্র পাঠ হয়। হিরণ্যপসিপুর এক কাগজের স্বরূপ (মডেল) বানিয়ে সন্ধ্যার সময় দৈত্য বিনাশ করা হয়। লেখক রাজা হিন্দুরায়ের এস্টেট নিলাম প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর শিকারের উত্তম উত্তম যন্ত্র ছিল। একটি বন্দুকের দাম ৭০০ টাকার কম না। একটি ঢাল ২,০০০ টাকায় বিক্রি হয়। গ্রাহক না থাকায় হিরা-চুনি-পান্না-মোতির কাজ করা দ্রব্যাদি বিক্রি হলো না।
দিল্লি দরজা থেকে দুই ক্রোশ দূরে পুরনো দিল্লি। সেখানে বাদশাহের পুরনো কেল্লা। অন্য রাজাদের আপন আপন পুরনো কেল্লা, আরবের সরাই (পূর্বে আরব দেশে সওদাগরেরা এসে সেখানে থাকতো)। এর পর এল ভুলভুলড়ি মসজিদ। এই মসজিদে বহু মূল্যবান পাথর ছিল তা ইংরেজ বাহাদুর উঠিয়ে নিয়ে গেছে। (এটি বর্তমান জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া কেন্দ্রীয় মসজিদ)। এই মসজিদ থেকে দু ক্রোশ পথ পেরিয়ে পাহাড়ের উপর বাহাপুরের কালকাদেবীর মন্দির। দেবীর স্বরূপ গোলাকার পাথর আছে যা পুষ্প বস্ত্র অলংকারে আবৃত। মন্দিরের ধর্মশালায় পথিকেরা থাকতে পারে। নবরাত্রিতে এখানে বড় মেলা হয়।
এবার লেখক পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিষয়ে বলেন কিন্তু তিনি তাঁকে পৃথুরাজা নামে বিবৃত করেছেন। পৃথুরাজার রাজধানী গড়ের মধ্যে চতুর্দিক বেষ্টিত আছে। তিনি যোগমায়া দেবীর উপাসক, তাঁর মূর্তি কেল্লার মধ্যে আছে (ছিল?)। কেল্লার মধ্যে যজ্ঞস্থান আছে। সেখানে মুনিগন এক রাজসিক যজ্ঞ করেন। এক স্তম্ভ (কুতুব মিনারের পাশে লৌহ মিনার) মুনিরা যজ্ঞ কুন্ডের মধ্যে স্থাপিত করে বলেন যে এই স্তম্ভের মধ্যস্থল নাগরাজের মাথার ওপর স্থাপিত হল। যতদিন স্তম্ভ থাকবে ততদিন তাঁর রাজ্য থাকবে। এই কথায় রাজার মনে সন্দেহ হওয়াতে তিনি ওই স্তম্ভ হেলানোর চেষ্টা করেন। ওই স্তম্ভের তলায় থেকে রক্তপাত হল। রাজার মনে সন্দেহ আসাতে মুনি দুঃখিত হন ও বলেন যে স্তম্ভ স্থাপনের উদ্দেশ্য সফল হবে না আর স্তম্ভটি সব সময় ঈষৎ দক্ষিণ-পশ্চিমে হেলে থাকবে। স্তম্ভের উপর দেবনাগরীতে এসব লেখা আছে। মুসলমান ও ইংরাজ রাজত্বে তারা ওই স্তম্ভ ওঠানোর জন্য অনেক খনন করেছে কিন্তু শেষ সীমা পায়নি। কামানের গোলা ছুড়েও স্তম্ভকে ফেলতে বা ভাঙতে পারেনি। স্তম্ভের গায়ে পার্সী অক্ষরে এসব লেখা আছে আর গোলার দাগও আছে। ওই স্তম্ভের কিছু দূরে একটি বৃহৎ ও উচ্চ স্তম্ভাকৃতি ছয় তলা উঁচু ঘর আছে, যাকে লাট বলে (কুতুবমিনার), যার ওপর বসে নাকি রাজকন্যা নয় ক্রোশ দূরে যমুনা দর্শন ও পূজা করবেন বলে রাজা এটি নির্মাণ করেছিলেন। এই স্তম্ভের আকারে পরে কলকাতার মনুমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল বলে লেখক বলেন। রাজার বাড়ি প্রস্তর নির্মিত ও উত্তম প্রস্তর দ্বারা খচিত ছিল এই স্তম্ভ গুলো বাড়ির ভিতরে ছিল। মুসলমানদের রাজ্য হওয়াতে ওই রাজবাড়িতে আর যজ্ঞভূমিতে যেসব দেবদেবীর মন্দির ও যজ্ঞকুন্ড ছিল সব ভেঙে ভালো ভালো যেসব পাথরের দরজা ছিল তা উঠিয়ে দিল্লিতে নিয়ে যায়। দেবালয়ের স্থানে মসজিদ তৈরি হয় এবং স্থানে স্থানে কবর দেওয়া হয়। এভাবে হিন্দুদের সব ধর্ম বিষয়ক স্থান ছিল সব ভেঙে ফেলা হয়। ধাতু ও পাথরের স্তম্ভ ভাঙ্গতে পারেনি, আজ পর্যন্ত বজায় আছে।
লেখক এবার যান দিল্লি বা ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে গড় মুক্তেশ্বরে (গড়মুক্তেশ্বর, উত্তর প্রদেশ) যেখানে পাণ্ডবদের স্থাপিত মুক্তেশ্বর শিব আছে। সেখান থেকে ত্রিশ ক্রোশ দূরে হস্তিনাপুরি (হস্তিনাপুর, উত্তর প্রদেশ), যা কুরুকুলের আদি রাজ্য এখন নিবিড় জঙ্গলে পরিণত হয়ে আছে। সেখানে সন্ন্যাসীরা আছেন। কুরুকুলের ঘরবাড়ি বর্তমানে নেই, শুধু স্থানে স্থানে চিহ্ন আছে।
(চলছে)
এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১৬ বৈশাখ ১২৬৩ (২৯ এপ্রিল ১৮৫৬) থেকে ১২ জ্যৈষ্ঠ ১২৬৩ (২৬ মে ১৮৫৬)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!