সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৩৯। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৩ ভোলানাথ চন্দ্র


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                 (আগের পর্বের পরে)

জলঙ্গি নদীপথে এর পরের গন্তব্য কৃষ্ণনগর। জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নামে কৃষ্ণনগরের নামকরণ করা হয়েছে। তিনি গত শতাব্দীর (অষ্টাদশ শতাব্দীর) শেষ জমিদার, যিনি অর্থ ব্যয় করে কিছু মূল্যবান কীর্তি রেখে গেছেন। তিনি শিক্ষিত ছিলেন এবং শিক্ষা ও গুণের কদর করতেন। তাঁর সভায় ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর ( বিদ্যাসুন্দর কাব্যের রচয়িতা) সভাকবি ছিলেন। লেখক দেখেন কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদ তখন ভগ্নপ্রায় অবস্থায় আছে। রাজবাড়ির নিকটে অবস্থিত কালীবাড়িতে ভারতচন্দ্রের থাকার ঘরও দেখেন লেখক। 


লেখকের পরবর্তী ভ্রমণ শুরু হয় ১৮৪৬ এর ২৩ শে আগস্ট। নদীয়ার অগ্রদ্বীপ হয়ে লেখক এলেন কাটোয়ায়। অষ্টাদশ শতকের ভূগোলবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র (বাংলার সর্ব প্রথম ম্যাপ) অনুসারে অগ্রদ্বীপ গঙ্গার বাম পাড়ে ছিল কিন্তু এখন সেটা আছে ডান দিকে। অগ্রদ্বীপে এপ্রিল মাসে বার্ষিক মেলা হয়। সেখানে গোপীনাথ মূর্তি দর্শনে এবং ঘোষ ঠাকুরের শ্রাদ্ধ (ঠাকুর গোপীনাথ নিজে গোবিন্দ ঘোষের শ্রাদ্ধ করেন বলে প্রচলিত আছে) দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। বৃন্দাবনের যেমন আগ্রা বা অগ্রবন, নদীয়ার সেরকম অগ্রদ্বীপ বলে লেখক মন্তব্য করেছেন। 


কাটোয়া হল সুপ্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিক আরিয়ানের লেখায় পাওয়া 'কাটাডুপা' নামক স্থান। আগে নিশ্চয়ই নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপে সত্যিই দ্বীপ ছিল। কাটোয়া আগে মুর্শিদাবাদের সামরিক ঘাঁটি ছিল।  নবাব মুর্শিদকুলি খান এখানে পথিকদের সুবিধার জন্য প্রহরার ব্যবস্থা করেছিলেন। চোর ধরা পড়লে তার শরীর দুইভাগ করে রাস্তায় গাছে ঝুলিয়ে রাখা হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে কাটোয়ায় মারাঠা আক্রমণ শুরু হয়। মানুষ শহর, গ্রাম ছেড়ে পালায়। ফলে এই এলাকা জঙ্গলে পরিণত হয় ক্রমে। এখান দিয়ে পথিকের যাতায়াত খুব কষ্টকর ছিল বাঘ ও বুনো শুয়োরের উপদ্রবের কারণে। বৈষ্ণবদের কাছে কাটোয়ার গুরুত্ব অনেক, কারণ চৈতন্যদেবের গৃহত্যাগ করে কাটোয়ায় এসে কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের আগে রবার্ট ক্লাইভ ১৭৫৬ -তে পলাশী যাওয়ার আগে এখানে থেমেছিলেন। কাটোয়াতে নাকি তিনি নির্জন আম বাগানে ধ্যান করেছিলেন। কাটোয়ার বাণিজ্য কেন্দ্র হল অজয় আর ভাগীরথীর সঙ্গমস্থল। সেখানে সব দোকান, গুদাম আছে। এখানে সুতি আর সিল্কের কাপড় ভালো পাওয়া যায়। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ বৈষ্ণব। আলীবর্দী খাঁর দুর্গ (যেখান থেকে তিনি মারাঠাদের পরাজিত করেছিলেন) এখানে ছিল। সেই মাটির তৈরি দুর্গটির আধ মাইল পরিসীমা, ১৪ টি কামান দেওয়ালে গাঁথা। পলাশীর যুদ্ধের সময় ইংরেজ এই দুর্গ বিনষ্ট করে। 


পলাশী কাটোয়া থেকে ১৬ মাইল দূরে অবস্থিত। যুদ্ধক্ষেত্রটি আর নেই, গঙ্গার তলায় চলে গেছে। 


লেখক অজয় নদীতে নৌভ্রমণে গেলেন। এই নদী পাহাড়ি, এতে হড়পা বান আসে পাহাড়ে বৃষ্টি হলে। তখন প্রচন্ড স্রোত ভীষণ শব্দে আশেপাশের মানুষ গবাদি পশু সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অজয় শব্দের অর্থ যাকে হারানো যায় না। পূর্বে অনেক হিন্দু মা তার সন্তানকে অজয়ের জলে স্নান করিয়ে অজেয় তৈরি করতে চাইতেন। হয়তো এই কারণে জেলার নাম বীরভূম। আগে একে মল্লভূমি-ও বলা হতো অর্থাৎ মল্লদের ভূমি। গ্রীক পর্যটক যিনি ২৮৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ভারতে এসেছিলেন সেই মেগাস্থিনিসের ভাষায় অজয় নদী হলো 'অ্যামিষ্টিস'। অজয় নদীর দুই ধারের সৌন্দর্য অপরিসীম। ঢেউ খেলানো জমি, সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রাম, আমগাছের বাগান, পুকুর নিয়ে নয়নাভিরাম দৃশ্য। 


এবার এলো বিশ্রামটুলা। এক প্রাচীন বটগাছের ছায়ায় রয়েছে পবিত্র স্থান। চৈতন্যদেব নাকি এখানে একবার বিশ্রাম নিয়েছিলেন। 


এরপর সুপুরের কাছে অজয় নদীর উপর রেলের ব্রিজ তৈরি হয়েছে। (এটি লেখক নিঃসন্দেহে বই প্রকাশের আগে যুক্ত করেছেন কারণ বাংলার রেল প্রথম এসেছিল ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে। সম্ভবত ১৮৫০-এ এই ব্রিজ তৈরি হয়েছিল)। বহু পূর্বে সুপুর বিখ্যাত শহর ছিল। প্রাচীন প্রবাদে পাওয়া রাজা সুরথ নাকি এই নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর প্রাসাদের চিহ্ন লেখককে দেখানো হলো। সুপুর রাজার কালী মন্দির দেখলেন, যেখানে নাকি রাজা সুরথ হাজার হাজার ছাগবলি দিয়েছিলেন। সুপুরে অনেক ইঁটের তৈরি পাকা বাড়ি আছে। এখানকার প্রধান বাণিজ্য চাল, চিনি, সিল্কের। অনেক সাঁওতাল কাজের জন্য এখানে এসে আছে। এখানে লেখক একজন ভবঘুরেকে দেখলেন যিনি হিংলাজ (বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত), সেতুবন্ধ (রামেশ্বরম), চন্দ্রনাথ (বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত) এবং আরো অনেক তীর্থ দর্শন করে এসেছেন। 


এরপর সুরুল হয়ে লেখক চললেন কেন্দুলির উদ্দেশ্যে। পথে পড়ল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিত্যক্ত রেশমকুঠী। কেন্দুলির কবি জয়দেবের জন্মস্থান। সাধক রামানন্দের শিষ্য জয়দেব শুধু কবি ছিলেন না, ছিলেন সমাজ সংস্কারকও। বাংলার একটি ক্ষুদ্র গ্রাম থেকে গীতগোবিন্দের মহিমা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। 


কেন্দুলি থেকে তাঁরা এলেন দুবরাজপুর। পথে একটি ক্ষুদ্র ন্যাড়া পাহাড় (মামা ভাগ্নে পাহাড় কি?) দেখলেন। পাহাড়ের ছায়ায় দুবরাজপুর শহর রয়েছে। মূলত সাঁওতালরা এখানে বাস করে। প্রধান বাণিজ্য দ্রব্য চিনি, গুড়। দুবরাজপুরের বেশিরভাগ জায়গায় চাষবাস হয় না, শাল জঙ্গলে পরিপূর্ণ। 


এরপর ঘন শালবন, ধানক্ষেত পেরিয়ে সুন্দর সবুজ গ্রাম বক্রেশ্বর দেখা গেল। অনেক মন্দির ও কুন্ডে শোভিত বক্রেশ্বরে প্রতিবছর শিবরাত্রিতে একটি মেলা হয়।  পান্ডাদের অত্যাচারের কথা বলেছেন লেখক এখানে। কুণ্ডের সংখ্যা আট, বেলে পাথরের পাড় ঘেরা এই কুন্ড বা কুঁয়াগুলোর বিভিন্ন দেবতার নামে নাম আছে। কুন্ডগুলোর তাপমাত্রা একরকম নয়। কুন্ডে সালফার আছে, গন্ধের বোঝা যায়। সূর্যকুন্ডের জল সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত, এতে হাত দেওয়া যায় না, ডিম দিলে সেদ্ধ হয়ে যায় কিন্তু ভাত সেদ্ধ হয় না। কুন্ডগুলি থেকে নালা মারফত জল ছোট নদী বা ঝোরায় যাচ্ছে, তার নাম শ্বেতগঙ্গা, এই নদীর জল কিছু অংশে গরম কিছু অংশে ঠান্ডা আর জলের রং সাদা। এবার তাঁরা বক্রেশ্বর শিবমন্দির দেখলেন। মন্দিরের ভেতর অন্ধকার, দীপের অল্প আলোয় দেখতে হয়। 


প্রথমে গভীর শাল গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেক দূর গিয়ে তারপর পাকা রাস্তা দিয়ে দশ মাইল গিয়ে আসে সিউড়ি। সিউড়ি আধুনিক শহর অনেক ইঁটের বাড়ি আছে। পাহাড়ে ঘেরা সিউড়ি স্বাস্থ্যকর স্থান। 


সিউড়ি থেকে এলেন পুরন্দরপুর, যা তার পুরনো গৌরব হারিয়ে এখন একটা সামান্য গ্রাম। (পুরন্দরপুর অতীতে কেন বিখ্যাত ছিল লেখকের ব্যাপারে কোন আলোকপাত করেননি। কোন সূত্র থেকেও জানা যায়নি এই জায়গার ইতিহাস। তবে কি পুরন্দরপুর নাম থেকে তিনি আন্দাজ করেন যে এই স্থানে পূর্বে গড় বা শহর ছিল?)। এখানে তিনি একটি বৃদ্ধাকে দেখেন, যার বয়স জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে তার বয়স প্রায় ১০ বছর ছিল যখন এক টাকায় ৩০ সের চাল পাওয়া যেত। সেটি বাংলার মহাদুর্ভিক্ষের বছরকে বোঝাচ্ছে (১৭৭০), যখন জন শোরের (ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এক গভর্নর জেনারেল) চিঠি থেকে জানা যায় যে 'মাথাপিছু পাঁচ টাকা করে তখন ছোট বাচ্চাদের বিক্রি করা হয়েছিল। মা-বাবা তাদের বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যথায় অনাথ হয়ে তারা শেয়ালের পেটে যেত।' গঙ্গা উপত্যকা দুঃখ আর মৃত্যুতে ছেয়ে গেছিল। হুগলি নদীতে প্রতিদিন হাজার হাজার মৃতদেহ ভেসে যেত। লেখকের ভ্রমণ কাল ১৯৪৬ এ বৃদ্ধার বয়স ছিল ৮৬ বছর। 


এরপর লেখক ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বীরভূম ভ্রমণের কথা লিখেছেন। ১২ বছর পরে লেখক আবার বীরভূমে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রথমে তিনি সাঁইথিয়ার কথা লিখেছেন। সাঁইথিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশ সাধু মাঝি, সিংগ্রা, পাচু, সুকুল এইসব সাঁওতাল বীরদের জন্য তখন সদ্য বিখ্যাত হয়েছে (১৮৫৫-১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ, যার নেতৃত্বে ছিলেন সিধু ও কানু)। ময়ূরাক্ষীর নদীর জলে পুষ্ট সাঁইথিয়া খুব মনোরম স্থান। পূর্ব বীরভূম পশ্চিম বীরভূমের থেকে ভূপ্রকৃতিগত দিক থেকে স্বতন্ত্র। পূর্ব বীরভূম মালভূমির উঁচু নিচু ভূমিরূপ ত্যাগ করে প্রায় সমতল হয়েছে এখানে।মাইলের পর মাইল ধানক্ষেতের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলার মত আনন্দ আর নেই। ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে এই সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাওয়া যেত না। মারাঠাদের লুটতরাজ তারপর নবাবী উচ্ছেদ, মহামারী, মড়কে দক্ষিণবঙ্গের এক তৃতীয়াংশ জমিতে চাষ হতো না। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়া থেকে এই দৃশ্য সম্ভব হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলায় এত নিরবচ্ছিন্ন শান্তি কোনদিন আসেনি। পলাশীর যুদ্ধের দিন থেকে কোনো শত্রু বাংলায় আজ পর্যন্ত পা রাখতে পারেনি, কোন চাষী তার ফসল হারায়নি, কোন মানুষের এক বিন্দু রক্তপাত হয়নি। বৈদেশিক শত্রুর হাত থেকে সুরক্ষিত হয়ে জনসংখ্যা বেড়েছে, চাষ বেড়েছে, জমির মূল্য ৪০ থেকে ৯০ গুন বেড়েছে দক্ষিণবঙ্গে সমস্ত স্থানে। বীরভূমের প্রধান ফসল ধান তারপর হল রেশম চাষ। এখানকার কাল মাটিতে তুঁত ভালো হয়। এটা জানা যায় না যে রেশম চাষ এই দেশের নিজস্ব চাষ নাকি চীন দেশ থেকে আসা চায়ের মতো রেশম চাষও বাইরে থেকে আনা হয়েছে। বাংলায় রেশম চাষ হয় কিন্তু বেনারসে রেশম বস্ত্র তৈরি হয় সর্বোত্তম। মোগল বেগম নুরজাহান রেশম বস্ত্রকে মুঘল বাদশাহদের মধ্যে প্রচলন করেছিলেন। এই নুরজাহান প্রথমে বাংলার বর্ধমানে থাকতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইতালিয়ান পদ্ধতিতে রেশম বয়াlন চালু করেছিল এবং দেশীয়রা নিজস্ব পদ্ধতি ছেড়ে দিয়েছিল। ইতালি থেকে ইংল্যান্ডের রেশম রপ্তানি এক চুক্তির ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুরু করে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে রেশমের রপ্তানি। 


(ইংরেজের গুণগ্রাহী ভোলানাথ চন্দ্র মহাশয়ের আন্দাজ ছিল না যে কিছুকাল পর থেকেই ভারতের অর্থনৈতিক অবনতির সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে ইংরেজ শাসনকালকে চিহ্নিত করা হবে। সবথেকে বড় বৈদেশিক আক্রমণকারী শত্রু হয়ে উঠবে ইংরাজ। দেশীয় শিল্প বিনষ্ট করার জন্য আর জোর করে নীল, রেশম চাষ করার জন্য ভারতবাসী ইংরাজকে ক্ষমা করবে না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল আর বেশিদিন ভারতবাসীর অজানা থাকবে না)।

                        

                        (চলছে)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৩৮। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ২ ভোলানাথ চন্দ্র


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

হুগলির পূর্বে বাংলার রাজকীয় বন্দর ছিল সাতগাঁ বা সপ্তগ্রাম। গঙ্গা আগে এখান থেকে প্রবাহিত হয়ে আন্দুলের দিকে যেত। কালক্রমে জমে যাওয়া মাটি সরালে এখনো এই অবরুদ্ধ প্রবাহ বরাবর কিছু ধ্বংস হওয়া নৌযান খুঁজে পাওয়া যাবে। সাতগাঁর প্রাচীন ঐতিহ্য এতোটাই ছিল যে রোমানরা তার নাম দিয়েছিল Ganges Regia (গঙ্গা রিদি?)। এটি এক বিশাল রাজকীয় শহর ছিল ও রাজাদের রাজধানী ছিল। প্রথম যে ইউরোপীয়রা বাংলায় এসেছিল তারা দুটি বন্দরের কথা বলেছে - একটি চট্টগ্রাম আর একটি সাতগাঁ। গত শতাব্দীতে (অষ্টাদশ শতাব্দীতে) এখানে অনেকগুলি গ্রামীণ উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। গঙ্গার স্রোত পরিবর্তন এই বাণিজ্য উপনিবেশের পতনের কারণ। হুগলি বন্দরকে প্রধান বন্দর হিসেবে ব্যবহারের প্রচেষ্টাও ক্রমে বিফল হয়। এরপর সেটি পূর্ব গৌরব হারিয়ে একটি সামান্য স্থানে পরিণত হয়। আক্ষরিক অর্থে সপ্তগ্রাম সাতটি গ্রাম নিয়ে তৈরি ছিল। পূর্বে কলকাতার মল্লিক পরিবার সেখানে থাকতেন। পরে তাঁরা হুগলি ও তারও পরে কলকাতায় যান। 


এরপর আসে ত্রিবেণী। তিন নদীর সংযোগস্থল এলাহাবাদের প্রয়াগের মতোই পবিত্র স্থান এই ত্রিবেণী। এখানে প্রতিবছর মার্চ মাসে স্নানের মেলা হয়। পূর্বে কলকাতার বাবুরা ত্রিবেণী পেরিয়ে মফস্বলে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারত না। ত্রিবেণী এতটাই পুরনো জায়গা যে প্লিনি, টলেমি (রোমান ভূগোলবিদ) এর কথা লিখেছেন। এই স্থান সংস্কৃতের একটি পীঠস্থান। এখানে মহাপন্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বাড়ি, যিনি স্যার উইলিয়াম জোন্সের সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন এবং লর্ড কর্নওয়ালিসের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু আইন সংকলন করেছিলেন। তাঁর অভূতপূর্ব স্মৃতিশক্তি ছিল। এই সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে যে একবার স্নান সেরে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর একজন কাফের ও একজন চীনা ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। তারা ঝগড়া মারামারি করছিল। পুলিশের কাছে এই মামলা যাওয়াতে পুলিশ তাঁকে সাক্ষ্য দিতে ডাকে। তিনি বলেন যে তিনি ওই কাফের ও চীনা কারো ভাষা জানেন না কিন্তু তারা কী কী শব্দ উচ্চারণ করেছিল তা সম্পূর্ণ বলতে পারবেন। তাঁর স্মৃতিশক্তিতে সবাই হতচকিত হয়ে জান।  ত্রিবেণীর পরে শুরু হয় সাধারণ গ্রাম বাংলা। ইঁটের বাড়ি এখানে খুব কম দেখা যায়। ঘাট আর মন্দির অনেক দূরে দূরে দেখা যায়। নদী এখানে আরো চওড়া, কিন্তু স্রোত কম কারণ মাঝে মাঝে চরের বাঁধা আছে। 


ত্রিবেণীর চার মাইল উত্তরে ডুমুরদা বা ডুমুরদহ খুব সামান্য গ্রাম কিন্তু ডাকাত আর জলদস্যুর জন্য কুখ্যাত। এখনো সূর্যাস্তের পরে এই জায়গা কোনো নৌকা পেরোয় না। দিনের বেলায়ও এখানকার ঘাটে কোনো নৌকা নোঙর করতে সাহস পায় না। ব্যবসায়ীরা নিজের সঞ্চয় নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় এই স্থান পেরোতে ডাকাতি ও খুনের আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে থাকে। একবার কিছু লোক পূজার ডাকাতেরা হয় নৌকা ফুটো করে দেয়, নয় নৌকা থেকে জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ডাকাতের সরকার বিশ্বনাথবাবু (বিশে ডাকাত) এখানে থাকতো ৬০ বছর আগে অর্থাৎ আনুমানিক ১৭৮৫ নাগাদ। অন্য এক প্রথা ছিল পথিককে আশ্রয় দেওয়া, খাতির যত্ন করা এবং মাঝরাতে তাকে মেরে সর্বস্ব লুটে নেওয়া। বিশে ডাকাতের আক্রমণের গন্ডি বর্তমান যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পুলিশের চোখে ধুলো দিতে সে ওস্তাদ ছিল। একবার তার দলের একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে জঙ্গলে তাকে ফাঁসি দিয়ে মারে। গঙ্গার ধারে তার দোতলা তৈরি বাড়ি এখনো (লেখকের ভ্রমনের সময়) আছে। এখানকার অধিবাসীরা অধিকাংশ মাঝি আর জেলে। এদের অনেকে আবার রাতে ডাকাত। 


এরপর এলো সুকসাগর। তখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সুকসাগরে অনেক অভিজাত পরিবার বাস করত। লর্ড কর্নওয়ালিস অনেক সময় এখানে গ্রীষ্মকাল কাটাতে আসতেন। এখন যেমন ভাইসরয়রা সিমলা যান ব্যারাকপুরের গ্রীষ্মাবাস তৈরী হওয়ার আগে এখানে ছিল তাঁদের গ্রীষ্মের ঠিকানা। এখানে রেভিনিউ বোর্ডও স্থাপিত হয়েছিল তা মুর্শিদাবাদ চলে যাওয়ার আগে। গঙ্গা গতিপথ পরিবর্তন করায় এর অনেক অংশ গঙ্গাবক্ষে বিলীন হয়েছে। পরে সেইসব বাড়ির চিহ্ন নেই। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে প্লাবনে ওই এলাকা প্রচন্ডরকম প্লাবিত হয়েছিল। 


চাকদা, চাকদহ বা চক্রদহ পরবর্তী স্থান। কথিত আছে যে ভগীরথের রথের চাকার আঘাতে মাটিতে একটি সুগভীর খাতের সৃষ্টি হয়ে এই স্থান তৈরি হয়েছে। চাকদা একটা বাণিজ্য কেন্দ্র এখানে আশেপাশের জেলাগুলি থেকে কৃষিজ দ্রব্য আসে বিক্রির জন্য। অন্য সব বড় ভারতীয় বাজারের মতো এখানে অনেক গুদাম আর পতিতালয় আছে। ঘাটে অনেক নৌকা নোঙর করা থাকে। 


অপর পারে বলাগড়, বৈষ্ণব গোঁসাই আর কুলীন-বৈদ্যদের স্বর্গ। তারপর গুপ্তিপাড়া। এখানকার ব্রাহ্মণরা তাঁদের বিদ্যাচর্চার জন্য বিখ্যাত। এখানকার বাঁদরের সংখ্যা প্রচুর এবং তাদের বাঁদরামি সীমা নেই। শোনা যায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় নাকি গুপ্তিপাড়া থেকে বাঁদর আনিয়ে কৃষ্ণনগরে তাদের বিয়ে দিয়েছিলেন বিশাল ধুমধাম করে। সেই বিয়ের খরচ হয়েছিল অর্ধ লক্ষ টাকা। কথায় আছে কাউকে নাকি সে গুপ্তিপাড়া থেকে এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করা অর্থ হলো তাকে বাঁদর বলা। 


গত শতাব্দীতে (অষ্টদশ শতাব্দীতে) গঙ্গা শান্তিপুরের একেবারে পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল। কিন্তু এখন শান্তিপুর শহরের পাশে বিস্তীর্ণ বালির পাড়। শান্তিপুর সম্ভবত বহু প্রাচীনকাল থেকে রয়েছে কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ভাগিরথীতে সবথেকে পুরনো নৌযাত্রার কথা জানা যায় সম্রাট অশোকের সময়। তাঁর পুত্র মহেন্দ্র বৌদ্ধধর্ম প্রচারে শ্রীলঙ্কা গেছিলেন। এই নৌযাত্রা বিষয়ে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। চৈনিক পর্যটক ফা হিয়েন এই পথে সমুদ্রযাত্রা করে নিজের দেশে ফেরেন। পঞ্চম শতাব্দীতে চাঁদ সদাগর (মনসামঙ্গল) ও শ্রীমন্ত-দের (চন্ডীমঙ্গলে) যাত্রা যেহেতু কাহিনী থেকে পাওয়া তার মধ্যে ইতিহাস ও কল্প কাহিনীকে আলাদা করা অসম্ভব। চৈতন্য জীবনীতে শান্তিপুরের উল্লেখ পাওয়া যায়। অদ্বৈতের জন্ম ও সাধনভূমি ছিল এই শান্তিপুর। একসময় শান্তিপুর বড় জনবহুল স্থান ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল শান্তিপুর। লর্ড ওয়েলেসলি এখানে দুদিন থেকেছিলেন। যে বাড়িতে তিনি থেকে ছিলেন সেটি এক লক্ষ টাকায় তৈরি করা হয়েছিল। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে এখানে অত্যন্ত অন্তত কুড়ি হাজার ইঁটের বাড়ি ছিল বলে জানা যায় কিন্তু এখন সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেছে। তবে মিহি সুতোর কাপড়ের জন্য ঢাকার পরেই এর খ্যাতি। অন্তত দশ হাজার তাঁতি পরিবার আছে এখানে। অদ্বৈতের বংশধরেরা এখানে গোঁসাই। এখানকার প্রধান দেবতা শ্যামচাঁদ। এখানে এখনো অনেক টোল আছে। কোন ব্রাহ্মন অবশ্য এখন একশো স্ত্রী রাখে না, বিধবাকে সতী হতে হয় না বরং বিধবাবিবাহ হতে পারে। বারোয়ারি পূজা যা খুব ধুমধাম করে হতো তা এখন হয় না। কোন একবার বারোয়ারী কালীপুজোয় মদ খেয়ে ব্রাহ্মণরা নেশার ঘোরে এক ব্রাহ্মণকে ছাগলের বদলে বলি দিয়ে দিয়েছিলেন বলে লিখেছেন লেখক। শান্তিপুরের নারীরা পাতলা গড়নের, অভিজাত, কোমল দেশীয় সুন্দরী। বিদ্যাসুন্দর যেমন বলেছেন তেমনি এই নারীরা খুব সুন্দর ভাবে চুল বাঁধতে পারে। শান্তিপুরের নারীরা বুদ্ধিমত্তা ও প্রাণবন্ত কথাবার্তায় বিশিষ্ট।


কালনা শহর যদিও শান্তিপুরের মতো আকারে বড় নয় কিন্তু অনেক বেশি অভিজাত ও পরিচ্ছন্ন। এর রাস্তা, বাজার আরো ভালো। আগে গঙ্গানদী বর্তমান শহরের পিছন দিক দিয়ে বইত। এখনকার পুরনো কালনা শহর যেদিকে আছে সেদিকে। এখনকার কালনা বর্ধমানের রাজার তৈরি। রাজা রানীদের নিয়ে তীর্থস্নান করতে আসেন এখানে। বর্ধমান ও কালনার বড় রাস্তা দিয়ে জোড়া, তার প্রতি আট মাইলে বাংলো, আস্তাবল, পুকুর আছে। গঙ্গা এখন আবার নতুন কালনার দিকে সরে যাচ্ছে ফলে এখনকার বাণিজ্যে ভাঁটা পড়েছে। কালনার প্রথমে দেখার জিনিস হল বর্তমান রাজার রাজবাড়ী। এখানে অনেক অভিজাত বাড়ি আর বৃহৎ মন্দির আছে। একটা বিশাল স্থানে দুটি চক্রাকারে (একটির মধ্যে আরেকটি) মন্দিরগুলি রয়েছে। মন্দির খুব কারুকার্যময়। ভিখারিদের খাওয়ানোর জায়গা আছে এখানে। এরপরে দ্রষ্টব্য সমাজ বাড়ি অর্থাৎ রাজার পরিবারের মৃতদের সমাধি। রাজা ক্ষত্রিয় বংশের এবং তাঁরা মৃতদেহের ভষ্ম সংরক্ষণ করে থাকেন। হয়তো তিনি এই প্রথাটা রাজপুতানার রাজাদের বা অন্য কোন উৎস থেকে নিয়েছেন কারণ এমন কোন সংস্থান হিন্দু শাস্ত্রে নেই। এখানে প্রাক্তন রাজার অস্থি রাখা আছে দামি কাপড়ে মুড়ে মখমলের মসনদে রাখা, সঙ্গে রুপার তামাক সেবনের হুঁকা, গোলাপ জল, আলবোলা সব রাখা আছে ঠিক কেমন ভাবে রাজা পূর্বে সিংহাসনে বসতেন।


এর পরে কিছু অংশে গঙ্গার গভীরতা এত কম যে লেখক ও সঙ্গীরা পাড় ধরে হেঁটে চললেন আর নৌকা দড়ির সাহায্যে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। মৃজাপুরের কাছে একটি খাল কেটে সেখান থেকে রাজমহল পর্যন্ত জল নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিলিটারি বোর্ডের দ্বারা, কুড়ি বছর আগে। 


অনেক ঘন্টা নদীর পাড় ধরে হাঁটার পর দূরে নদীয়া (নবদ্বীপ) দেখতে পাওয়া গেল। হিন্দুধর্মে নদীয়াকে বিশেষ স্থান দেওয়া হয়। সংস্কৃত শিক্ষা পীঠস্থান ও চৈতন্যদেবের জন্মস্থান হিসেবে নদীয়ার অবদান অশেষ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশ হতে হয় নদীয়ার অবস্থা দেখে। নবদ্বীপে কিন্তু প্রাচীন ভগ্নপ্রায় মন্দির, বসতবাড়ি তেমন দেখা যায় না, পুরনো শহরের কাছে যা আশা করা যায় তার মত। অনেক সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতও চোখে পড়ে না। বরং একটা ছোট মফস্বল শহর আর খেটে খাওয়া ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় দেখা যায়। পুরনো নদীয়া গঙ্গার তলায় তলিয়ে গেছে। পুরনো নদীয়া কৃষ্ণনগরের দিকের পাড়ে ছিল। নদীয়ার সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনীগুলির একটি হলো বিল্লগ্রাম ও ধাত্রীগ্রাম নামে দুই সাধু এখানে থাকতেন, গভীর জঙ্গলে নির্জনে জ্ঞান চর্চার জন্য। জ্ঞানের অন্বেষণে বহু মানুষ তাঁদের কাছে শিক্ষা লাভ করতে আসতেন। জ্ঞানচর্চায় খুশি হয়ে দেবী সরস্বতী এই সাধুদের দেখা দিতেন। অন্য একটি কাহিনী হলো কাশীনাথ নামে এক রাজা প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নদীয়া এলেন। এই স্থান তখন জঙ্গলে ঢাকা লোক চক্ষুর আড়ালে ছিল। কিন্তু রাজার এই স্থান এত ভালো লেগে যায় যে তিনি এখানে রাজধানী তৈরি করা মনস্থ করলেন। তারপর জঙ্গল কেটে রাজধানী গড়ে উঠলো, প্রজাপত্তন হলো। তবে নদীয়ায় ঠিক কবে থেকে এবং কিভাবে গড়ে উঠেছিল তার কোন প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। এমনও শোনা যায় সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণসেনের রাজধানী ছিল নদীয়া। বক্তিয়ার খিলজী যখন বাংলা আক্রমণ করেন তখন তার সৈন্যরা নদীয়া ধ্বংস করে ও গৌড়ে রাজধানী তৈরি হয়। এরপর থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত নদীয়ার বিষয়ে আর কিছু জানা যায় না। তবে সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নিশ্চয়ই নদীয়ার মান অব্যাহত ছিল। শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে আবার নবদ্বীপ জনমানসে জাগরূক হল। শ্রীচৈতন্যের মন্দির ছাড়া নদীয়ায় কালীসাধক আগম বাগীশের র বাড়ির ভগ্নাবশেষ আছে। তিনিই প্রথম কালীমূর্তি তৈরি করেন তাঁর মনের কল্পনা থেকে। এরকম ধারণা আছে যে আদিবাসীদের দেবী ছিলেন কালী আর পূর্ববর্তী যুগে তাঁর পূজা হতো। কিন্তু হিন্দু ধর্মের ইতিহাস পাঠ করে বোঝা যায় যে কালীর বিদেশি উৎস আছে। শক্তির উপাসনা মনে হয় মিশরীয় ও আসিরিয় সভ্যতায় ছিল। কালী মূর্তির পূজা কিন্তু হিন্দুদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।কালীপুজো থেকে আসে তন্ত্রসাধনা। তবে আগম বাগীশ ঠিক কোন সময়কার এবং সত্যিই তাঁর বাড়ি বলে যা রয়েছে সেটি তার বাড়ি কিনা বা তাঁর বাড়ি গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের সময় ডুবে গেছে কিনা তা সঠিক জানা যায় না। পোড়া মাঈ নামক দেবী, যা একটু এক টুকরো কালো পাথরের উপর লাল গৈরিকমাটি মাখানো একটি অতিবৃদ্ধ বটগাছের তলায় বসানো। নদীয়ার গভীর জঙ্গলের মধ্যে ছিলেন রাজা কাশীনাথের লোকেরা জঙ্গলে আগুন লাগিয়েছিল। সেই আগুনে তিনি পুরে কালো হয়ে যান। বটগাছটি পুরাতন সেটি দেখে বোঝা যায়। নদীয়ার এই অংশ গঙ্গার তলায় তলিয়ে যায়নি। পোড়া মায়ের বটগাছের কাছে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় একটি বড় কালী মন্দির তৈরি করে দিয়েছিলেন। লেখকের পর কিছু টোল দেখতে গেলেন। ৫০ টির বেশি টোল আছে নবদ্বীপে। সবচেয়ে বড় পন্ডিত শ্রীরাম শিরোমণি। তাঁর চল্লিশটি ছাত্র। তার মধ্যে একজন আসাম, আরেকজন কালীঘাট, আরেকজন তেলেঙ্গানা থেকে এসেছে। নদীয়ার সাধারণ মানুষ এমনকি মহিলারাও কিছুটা কিছুটা সংস্কৃত শ্লোক বলতে পারেন। তবে ব্রাহ্মণরাই টোলের শিক্ষক ও ছাত্র হয় সেই প্রাচীনকালের মত। কিন্তু ইংরাজি শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের চক্র, আধিপত্য বন্ধ হয়েছে। স্যার উইলিয়াম জোন্স, ডক্টর কেরি প্রমুখ প্রাচ্যবিদ্যার পন্ডিতরা সবাই নদীয়ায় এসেছিলেন। নদীয়াতে লেখক একজন যোগীকে দেখেছিলেন। ব্যক্তিটিকে দেখে মনে হয় ৪০ বছর বয়স, খুব ফর্সা, কালো চুল। তিনি খান না, জলপান করেন না, কথা একটুও বলেন না, পা মুড়ে একই ভঙ্গিতে ধ্যানে বসে আছেন। উপোসের কোন প্রভাব তাঁর চেহারায় পড়েনি। দেশীয় ও ইউরোপীয়রা অনেকে তাঁকে দেখতে আসেন। তাঁর ধ্যান ভাঙ্গানোর জন্য নানা রকম প্রচেষ্টা হয়েছে কিন্তু সেটি সফল হয়নি। 


কাটোয়া রোডে অবস্থিত নদীয়া থেকে চার মাইল পশ্চিমে জহ্নুনগরে (নবদ্বীপ-কাটোয়া রোডে অবস্থিত) জহ্নুমুণীর ছোট প্রাচীন মন্দির। এই মুণী গঙ্গাকে পান করেছিলেন, শেষে কর্ণকুহর পথে গঙ্গাকে আবার মুক্ত করেছিলেন। এই মন্দিরের নীচেই পুরনো নদীখাত। এখানে লেখক শোনেন এই  নগরের এক জমিদার খাজনা দিতে না পারায় পিঁপড়ের ঘরে রেখে শাস্তি দিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের নবাবরা নাকি পোকা ভর্তি ঘরে রেখে মানুষদের শাস্তি দিত। নিকটস্থ ব্রহ্মাদিতলায় এক দুর্গা মন্দির রয়েছে। এখানে আগে নরবলি হত বলে লেখক শোনেন। এখন সেখানে জুলাই মাসে বড় মেলা হয়। এই মেলার বড় আকর্ষণ সাপ খেলা, সাপ ধরা, সাপের বিষ ছাড়ানো ইত্যাদি

                      (চলছে)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৩৭। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১ ভোলানাথ চন্দ্র


  সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



The travels of a Hindoo to various parts of Bengal and upper India by Bholanauth Chunder (দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু টু ভেরিয়াস পার্টস অফ বেঙ্গল এন্ড আপার ইন্ডিয়া বাই ভোলানাথ চন্দ্র) - এই বইটি ইংরেজি ভাষায় লেখা হলেও লেখক যেহেতু বাঙালি তাই এটিকে অবশ্যই 'সেকালের বাঙ্গালীদের ভ্রমণ' ব্লগের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। 


এই বইটি দুটি খন্ডে অর্থাৎ পার্ট ওয়ান এবং পার্ট টু- তে বিভক্ত। বইটি লন্ডনের N. Trubner and Company থেকে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির ভূমিকা লিখেছেন J. Talboys Wheeler, যিনি History of India বইয়ের লেখক। গ্রন্থের শুরুতে ভোলানাথ চন্দ্র বইটি উৎসর্গ করেছেন তৎকালীন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া স্যার জন লেয়ার্ড মেয়ার লরেন্সকে। উৎসর্গ করে তিনি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য ইংরাজ সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এবং ইংরাজ শাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রার্থনা করেছেন, কারণ এই শাসন জনগণের উন্নতি আর সুখ নিয়ে আসবে। এই লেখা ছাড়াও সমগ্র গ্রন্থ দুটির মধ্যে ছড়িয়ে আছে এই লেখকের অসম্ভব ইংরাজ প্রীতি এবং ভারতীয় প্রথা, ভারতীয় ধর্মবিশ্বাস-এর প্রতি কিছুটা অবজ্ঞার ভাব। ভূমিকায় জে. ট্যালবয়েজ হুইলার বলেছেন যে এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি কারণ এই প্রথম কোন ভারতীয় তথা হিন্দু যিনি তাঁর ধর্ম, তীর্থ সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ, এরকম একজন ভারতের প্রকৃত চিত্র অর্থাৎ ভারতীয়দের জীবন, স্বভাব, অনুভব, রীতিনীতি, চিন্তাধারা সব তুলে ধরেছেন, যা আগে কোন ইংরাজ লেখকের বই-এ পাওয়া সম্ভব না। তাই এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইংরাজীভাষী মানুষদের কাছে। তিনি ভোলানাথ চন্দ্র সম্পর্কে বলেন যে এই লেখক বাঙালি, হিন্দু, কলকাতাবাসি, বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁর পিতা মাতা বৈষ্ণব, যদিও ইয়ং বেঙ্গল হওয়ায়, বাবু ভোলানাথ চন্দ্র একজন ঈশ্বরবিশ্বাসী হলেও কোন প্রথা বা মূর্তি পূজাতে বিশ্বাসী নন, অন্য অনেক আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি হিন্দুর মত। ভোলানাথ চন্দ্র ইংরেজি ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ। তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজে ইংরাজি সাহিত্য পড়েছেন এবং তাঁর দেশের শিক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার সদস্য ছিলেন।


এই বইয়ের প্রথম খন্ডে লেখকের ১৮৪৫ থেকে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের ভ্রমণ কাহিনী লিখিত হয়েছে। বই পড়া কালীন জানা যায় যে লেখক ডায়েরি লিখতেন, পরে সেই তথ্য নিয়ে তিনি এই বই রচনা করেন। উল্লেখ্য যে স্থান ও পাত্রের নামের ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যবহৃত বানান এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।


তীর্থ ভ্রমণের লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর রচনার সঙ্গে ভোলানাথ চন্দ্রের রচনার অনেক অমিল আছে যদিও তাঁদের ভ্রমণ করা স্থানগুলি অনেকটাই এক এবং তাঁদের ভ্রমণের সময়কাল কাছাকাছি। এই অমিলগুলো হল - ভোলানাথ চন্দ্র ইংরেজিতে লিখেছেন আর সর্ব্বাধিকারী মহাশয় বাংলায় লিখেছেন। সর্ব্বাধিকারী মহাশয়ের ভাষা অত্যন্ত সহজ সরল, তিনি কোন রকম কাব্য বা অলংকারের ব্যবহার করে তাঁর ভাষাকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেননি। অন্যদিকে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ভোলানাথ চন্দ্র ইংরেজি ভাষায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিকের মতো তাঁর লেখার বাঁধুনি। যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী যে যে স্থান ভ্রমণ করেছেন তার সম্পর্কে অত্যন্ত গোছানো ভঙ্গিতে তথ্য দিয়েছেন। তাঁর বই পড়ে সেই সময়কার সেই সব জায়গার তৎকালীন ও তৎপূর্ববর্তী কালের ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি চিত্র অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে পাওয়া যায়। এখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে যেটুকু পরিবর্তন হয়েছে সেটুকু অনুসন্ধান করলেই যথেষ্ট। কিন্তু ভোলানাথ চন্দ্রের লেখা পড়ে কোন স্থান সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা যায় তা সম্পূর্ণ অনুধাবন করতে অনেক পড়াশোনা করতে হয় (মূলতঃ প্রথম খন্ডে), কারণ তিনি হয়তো অল্প কিছু সূত্র দিয়ে পরবর্তী প্রসঙ্গে চলে যান। দুজনের লেখার আর একটা পার্থক্য হল ভোলানাথ চন্দ্র উপনিবেশিক শাসকদের ইতিহাস নিয়ে বেশি লিখেছেন যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর তুলনায়। দুজনের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির খুব বিশেষ পার্থক্য নেই ইংরেজ শাসন সম্পর্কে। দুজনেই ইংরাজ শাসনে সন্তুষ্ট। তবে যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী ভারতীয় সংস্কৃতি, রীতিনীতিতে আস্থাশীল আর ভোলানাথ চন্দ্র সেসব নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেন। যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর লেখা কাউকে সন্তুষ্ট করা বা কারো প্রশস্তি করার জন্য লেখা নয়। তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন মতামত লিখেছেন। অন্যদিকে ভোলানাথ চন্দ্র সবসময় ইংরেজদের সন্তুষ্ট করার মানসিকতা নিয়ে বইটি লিখেছেন। বন্ধনীর () মধ্যে লিখিত অংশগুলি সেই প্রয়োজনীয় অনুসন্ধানের ফসল। ভারতীয় মানুষের ও স্থানের নামের ইংরেজি বানান তৎকালীন সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেক ভিন্ন ছিল, এই লেখায় লেখকের ব্যবহার করা বানান না লিখে, বর্তমানে ব্যবহৃত বানান লেখা হলো এই বইয়ের সব কটি পর্বে।


প্রথম খন্ডে লেখক-এর প্রথম যাত্রার তারিখ ১১ই ফেব্রুয়ারি ১৮৪৫। লেখক ও তাঁর কিছু সঙ্গী গঙ্গাবক্ষে নৌকায় রওনা দিলেন। কলকাতার তৎকালীন মিন্ট বা ট্যাঁকশাল (১৭৫৭ -তে প্রতিষ্ঠিত, স্ট্রান্ড রোডে অবস্থিত) ও মেটকাফ হল (১৮৪৪ -তে প্রতিষ্ঠিত) ছাড়িয়ে নৌকায় যেতে যেতে এলো চিতপুর, যার আসল নাম কালী চিত্রেশ্বরী (চিত্তেশ্বরী সর্বমঙ্গলা কালী মন্দির, চিতপুর)। কালী চিত্রেশ্বরী দেবীর কাছে আগে অনেক নরবলি হতো। শোনা যায় যে মাঝিরা গান গাইতে গাইতে নৌকা চালাচ্ছিল। সেই সুন্দর গান দেবীর কানে প্রবেশ করে। দেবীর মুখ আগে পূর্ব দিকে ঘুরানো ছিল। গান ভালো করে শোনার জন্য তিনি মুখ ঘোরান। সেই থেকে তাঁর মুখ গঙ্গার দিকে ঘোরানো রয়েছে।



এরপর এলো কাশিপুর। সুন্দর বাড়িঘর, জংলি গোলাপ ও নানা ফুলের শোভা আর জলের ওপর সেসবের শান্ত ছায়া দেখতে থাকলেন লেখক। এর পরের এলাকা অর্থাৎ কাশিপুর থেকে বরানগর ২০০ বছর আগে ডাচদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে সারাদেশের 'খারাপ নারীরা' (বারবনিতা) এখানে এসে থাকত। তারপর পরবর্তীকালে ইংরেজরা এই স্থানকে খুব সুন্দর স্থান হিসেবে দেখেছে। এখন এই স্থান শহরের ক্লান্তি দূর করতে, শান্ত সুন্দর প্রকৃতির মধ্যে নিরিবিলিতে ছুটি কাটাতে ব্যবহার করে ধনী ব্যক্তিরা। (বাংলায় ১৬১৫ থেকে ১৮২৫ পর্যন্ত ডাচ উপনিবেশ ছিল বরাহনগর বা বরানগর। সেখানে সেই সময় ডাচদের বাড়ি, কুঠি, বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। কুটিঘাট নামটি এখনো সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে।) 


এরপর এলো দক্ষিণেশ্বর। আগে এখানে এক মুসলমান রাজকুমার থাকতেন বলে শোনা যায়। এখন আছে বিস্তীর্ণ নানা ফুলে ভরা বাগান, সবুজ ঘাস জমি যা গঙ্গার জল পর্যন্ত ঢালু হয়ে নেমে গেছে। (তখনও দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির স্থাপিত হয়নি। যেটি আঠারোশো পঞ্চান্ন খ্রিস্টাব্দে রানি রাসমণি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়।)


দক্ষিণেশ্বরের বিপরীত পাড়ে বালি গ্রাম। এটি খুব পুরনো আর সনাতন স্থান। কবিকঙ্কনের (কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের)  লেখায় এখানকার উল্লেখ আছে। যদিও লেখক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যের শ্রীমন্ত কিভাবে এখানে আসলেন, যদি সেই সময় গঙ্গা সাতগাঁর নীচ দিয়ে প্রবাহিত হতো। বালির মাটির ঘর আর দুঃস্থ চেহারা এই স্থানের প্রাচীনত্বকে অবিশ্বাস করায়। যে খালের নামে এই জায়গার নাম হয়েছে সেই বালিখালের চারপাশে গ্রাম বাংলার সুন্দর ছবি চোখে পড়ে। এই বালিতে পরবর্তীকালে বাংলার একটি বড় ও মজবুত ব্রিজ হয়েছে। (এই ব্রিজ কিন্তু বালি ব্রিজ নয়। বালি ব্রিজ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বালিখালের উপরের ব্রিজ যা বালি ও উত্তরপাড়াকে সংযুক্ত করেছে। সেটি ১৮৪৬ এ অর্থাৎ লেখক যে বছর ভ্রমণ করছেন তার পরের বছর তৈরি হয়।) 


হুগলি নদীর দুপাড়ে অপূর্ব দৃশ্য সুন্দর। সুন্দর বাগান, বাগান বাড়ি চোখে পড়ে। অল্প দূরে দূরে অনেক সিঁড়ি সম্পন্ন ঘাট রয়েছে গঙ্গায় নামার জন্য। হুগলি নদীর উপত্যকার মতো জনবহুল সমৃদ্ধ লোকবসতি বাংলায় আর নেই। লেখকেরা নৌকায় পানিহাটি পেরোলেন। এটি রাঘব পন্ডিতের সমাজ (রাঘব পন্ডিতের ভবন, পানিহাটি)। শ্রীচৈতন্যদেবের শিষ্য রাঘব পন্ডিতের বাড়ি এই পানিহাটিতে। মাধবী গাছের নীচে রাঘব পন্ডিতের সমাধির কথাও লিখেছেন লেখক। 


এর একটু পরে এলো খড়দা। যে যুগে ডাকাতেরা আগে চিঠি পাঠিয়ে ডাকাতি করতো আর ডাকাতি করতে এসে গৃহস্থকে পুড়িয়ে মারতো আর বাড়ির মহিলাদের গরম তেলে জীবন্ত ভাজতো সেই সব ভয়ানক ডাকাতির কথা এখানে এলে মনে পড়ে। (এই কথাটি লেখক কেন লিখেছেন সে বিষয়ে বিস্তৃত কিছু বলেননি। ইন্টারনেট এবং বইপত্র খুঁজে এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি)। শ্রীচৈতন্যদেবের অনুসারী সংস্কারক নিত্যানন্দের বসত ছিল এখানে। নীলাচল থেকে ফিরে তিনি খড়দায় এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিবাহ করেন। তাঁর বংশধররা গোঁসাই নামে পরিচিত হন, যাঁরা মানুষকে ভবসাগর পার করতে সাহায্য করেন। নিত্যানন্দ ও তাঁর বংশধরদের সম্পর্কে ইঙ্গ-বঙ্গ সুলভ মানসিকতায় শ্লেষাত্মক কিছু মন্তব্য করেছেন লেখক।


গঙ্গার অপর পাড়ে মাহেশ। জগন্নাথ ও বলরাম দুই ভাই সারাদিন না খেতে পেয়ে দোকানদারের কাছে খাবারের বিনিময়ে একটি বাজুবন্ধ বন্ধক রেখেছিলেন। পুরী যাওয়ার পথে পান্ডারা সেই বাজুবন্ধের কথা ভুলে যাওয়াতে তাঁদের আবার মাহেশে আসতে হয়েছিল বাজুবন্ধ দোকান থেকে ছাড়াতে। এই গল্পটি লেখক বলেছেন। তখন থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে ওয়ারেন হেস্টিংসের বাগান বাড়ি ছিল মাহেশে, (পরে এটি রিষড়ার হেস্টিংস জুট মিল হয়েছিল, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে)। 


এবার তাঁরা কেরি (উইলিয়াম কেরি), ওয়ার্ড (উইলিয়াম ওয়ার্ড), মার্শম্যান (জন ক্লার্ক মার্শম্যানের) - দের কীর্তিস্থলে এলেন (শ্রীরামপুর)। এই তিনজন ক্রিশ্চান মিশনারী শ্রীরামপুরকে কেন্দ্র করে বাংলায় কলেজ, ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। শ্রীরামপুর একটা ছোট শহর যা অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও অভিজাত বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল, এই যখন তিন মাসে ২২ টি জাহাজ এই তৎকালীন বন্দরে জিনিসপত্র আনা নেওয়া করতো। ডেনমার্কের ড্যানিসরা এখানে ৯০ বছর ছিল ও বাণিজ্য করেছিল (১৭৫৫ থেকে ১৮৪৫)। অর্ধ শতাব্দী আগে টিটাগড়ে একটি জাহাজ-ঘাটা বা ডক ইয়ার্ড ছিল। ১৮০০ সাল নাগাদ ডাচরা চুঁচুড়া পর্যন্ত জাহাজ নিয়ে যেত। তখনও গঙ্গানদী পলি জমে এত অগভীর হয়নি। 


গঙ্গার অপর পাড়ে ব্যারাকপুর সুন্দর পার্ক, গভর্নর জেনারেলের বাড়ি (গভর্নমেন্ট হাউস, ব্যারাকপুর) নিয়ে সুসজ্জিত। কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নক দেড়শ বছর আগে এই স্থানে আসতেন ব্যস্ত শহর থেকে দূরে মাঝে মাঝে শান্তিতে কাটাতে (তখনও এই বাড়ি তৈরী হয় নি অবশ্য)। এই বাড়িতে যে ছবির সংগ্রহ আছে তা দেখার মত। পার্কে সুন্দর গাছ, ফুল, ঘাসজমি ছাড়াও রয়েছে চিড়িয়াখানা। সেখানে বাঘ, গন্ডার, ভাল্লুক, জিরাফ আছে, ছুটির দিন আনন্দে কাটানোর জন্য। প্যারেড গ্রাউন্ডটি স্মরণীয়। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে যেসব সিপাই কালাপানি পেরিয়ে বার্মা যেতে অস্বীকার করেছিল তাদের এখানে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল বলে। এখানে মঙ্গল পান্ডে (১৮৫৭)  সিপাহী বিদ্রোহের নাটকে তাঁর ভূমিকা পালন করেছিলেন, যাঁর নাম ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজে একটা গালি হিসেবে রয়ে গেছে। এভাবে ছত্রে ছত্রে লেখকের দেশীয়দের প্রতি ঘৃণা ও ইংরেজদের চাটুকারিতা ফুটে বেরিয়েছে। 


সেখান থেকে নৌকা এলো নিমাই তীর্থ ঘাটে (বৈদ্যবাটি), যা শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতি রক্ষা করছে। যেখানে তিনি দেশ ভ্রমণ কালে এসেছিলেন ও স্নান করেছিলেন। তারপর এলো চাঁপদানি যা বিগতকালে ডাকাতি, খুনখারাপির জন্য কুখ্যাত ছিল। এরপর এলো ঘিরেট্টি অর্থাৎ গৌরহাটি, যা চন্দননগরের ফরাসি গভর্নরের গ্রামীণ শাসনকেন্দ্র। এখানকার দৃশ্য খুব চমৎকার। একসময় সুন্দর ঘাস জমিতে শয়ে শয়ে ঘোড়ার গাড়ি শোভা পেত। কিন্তু এখন তা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। গভর্নরের বাড়ি, যা এক সময় অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাড়ি ছিল ভারতের মধ্যে, যেখানকার আড়ম্বরপূর্ণ সভাগৃহে ক্লাইভ, হেস্টিংস, উইলিয়াম জোনস এসেছিলেন এখন তা মাটিতে মিশে গেছে। কিছুদিন আগেও তার কিছু ভগ্নাংশ গাছপালা দেখা যেত, এখন কিছু অবশিষ্ট নেই, বলেছেন লেখক।


চন্দননগরের ফরাসি পতাকা দূর থেকে দেখা যায়। এখানে ফরাসি উপনিবেশ ষোলশ তিয়াত্তর থেকে গড়ে উঠলেও স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ডুপ্লের সময় থেকে। তাঁর শাসনকালে দুই হাজারের বেশি ইঁটের বাড়ি তৈরি হয়। ১৫ টি ফরাসি বাণিজ্যতরী বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করছিল। কিন্তু এখন চন্দননগর তার সব গৌরব হারিয়ে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। পুরনো দুর্গ (এখন চন্দননগর কোর্ট) ভগ্নপ্রায় হয়ে গেছে। বাড়িগুলো জনহীন, রাস্তাঘাট, নির্জন ঘাটগুলি অবহেলিত ১৭৫৭ এ ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়ে। পরে লেখক সংযোজন করেছেন যে এখন ১৮৬৯ এ চন্দননগর রেলপথে যুক্ত হয়েছে (১৮৫৪), তাই চন্দননগরের উন্নতি হচ্ছে ও পুরনো শ্রী কিছুটা হলেও ফিরে পাচ্ছে। 


১২ ই ফেব্রুয়ারি ১৮৪৫  নৌকা চুঁচুড়া আসে। গঙ্গাধারের সুন্দর ভবনগুলি খুব সুন্দর লাগে দেখতে। সবচেয়ে ভালো বাড়িটা হলো কলেজ। এটি আগে Monsieur Perron- এর, যিনি দোয়াবের সিন্ধিয়ার ফরাসি জেনারেল আর ডেপুটি ছিলেন তাঁর বাড়ি। (তীর্থ ভ্রমণ গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি যে এরপরে সেটি বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদারের ছিল এবং তারপরে সেখানে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়)। চুঁচুড়া একটি ছোট শহর যা কলকাতার ধুলো, নোংরা, শব্দ থেকে মুক্ত, শান্তিপূর্ণ সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর উপযুক্ত জায়গা। জায়গাটি চন্দননগরের থেকে বেশি প্রাণচঞ্চল। চুঁচুড়া ১৬৭৫ থেকে ডাচ অধিকারে ছিল। যতদিন তারা এখান থেকে বাণিজ্য করেছে ততদিন জায়গাটা সমৃদ্ধ ছিল। তারপর জায়গাটা গুরুত্ব ও সমৃদ্ধি হারায়। চুঁচুড়াতে একজন ডাচ গভর্নর গত শতাব্দীর শেষে (অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ) প্রথম 'পাংখা' আবিষ্কার করেন। চুঁচুড়ার ডাচ শাসনের কিছুই অবশিষ্ট নেই শুধু গির্জার (অধুনালুপ্ত) দেওয়ালে রাখা ডাচ গভর্নরদের ঢাল ছাড়া। (চুঁচুড়ায় পর্তুগিজ শাসন ১৫৩৭ থেকে ১৬৩৫, ডাচ শাসন ১৬৩৫ থেকে ১৮২৫, ইংরাজ শাসন ১৮২৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ছিল)।


লেখকেরা এবার হুগলি ঘাটে পৌঁছলেন। এখানে পর্তুগীজদের পুরনো দুর্গ ছিল যার সামান্য ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট আছে মাত্র। পর্তুগীজরা সম্ভবত ১৫৩৭ -তে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। পর্তুগীজরা ভারতীয় বাচ্চাদের অপহরণ করে বা কিনে তাদের দাস হিসেবে ভারতের নানা বাজারে বিক্রি করতো। দিল্লির বাদশাহ শাহজাহান একবার পর্তুগীজদের থেকে সৈন্য ও অস্ত্র সাহায্য চেয়েছিলেন। পর্তুগীজ শাসক তা অস্বীকার করেন ও বিদ্রোহ করেন। শাহজাহানের সৈন্য বাংলায় পর্তুগীজদের আক্রমণ করে সাড়ে তিন মাস হুগলির দুর্গ অবরোধ করে থাকে। হাজারের বেশি পর্তুগীজকে হত্যা করা হয়, চার হাজারের বেশি জনকে যুদ্ধবন্দি করা হয়। সুন্দর যুবকদের আগ্রায় নিয়ে গিয়ে খোঁজা ও মুসলমান করা হয়। মেয়েদের বাদশাহ ও অভিজাতদের হারেমে দিয়ে দেওয়া হয়। বাংলায় পর্তুগীজ বিলুপ্ত হয়ে যায়। রয়ে যায় শুধু পর্তুগীজ গির্জা আর পর্তুগীজ ধাঁচের কোট। 


হুগলির ইমামবাড়া বিখ্যাত। এর উঠান বিস্তৃত ও সুন্দর। মধ্যে ছোট পুকুর, দোতলা সুন্দর পরিচ্ছন্ন অভিজাত বাড়ি, রাজকীয় হলঘর, মুসলিম আদলে ঝাড় লন্ঠন, লন্ঠন রামধনুর রঙে রঙিন। দেওয়ালে নীল ও লাল রঙের কোরানের বাণী লেখা। দরজাগুলো অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ, তার ওপর সোনালী হরফে মসজিদের সালতারিখ, ইতিহাস লেখা। হুগলির সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হলো প্রেস বা ছাপাখানার প্রবর্তন। ১৭৭৮-এ মেসার্স হ্যালডেন ও উইলকিনস বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ছাপান। এরপর থেকে হিন্দু সাহিত্য ব্রাহ্মণদের কুক্ষিগত না থেকে সকলের আয়ত্তের জিনিস হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে এই ঘটনার রেল বা টেলিগ্রাফ এর পত্তনের থেকেও সভ্যতার পক্ষে বেশি মূল্যবান বলে লেখক মন্তব্য করেছেন।


ব্যান্ডেল চার্চ বাংলার সবচেয়ে পুরনো খ্রিস্টান চার্চ। চার্চের গায়ে প্রতিষ্ঠার তারিখ লেখা আছে ১৫৯৯। পর্তুগীজ জেসুইটদের ছবি ও মূর্তি উপাসনা মুঘল বাদশাহদের যথেষ্ট বিরক্তির কারণ হয়েছিল যা তাঁদের বাংলার পর্তুগীজ উপনিবেশ উৎখাতের অন্যতম কারণ।

                      (চলছে)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৩৬। ভ্রমণকারি বন্ধুর পত্র - ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত "ভ্রমণকারি বন্ধুর পত্র", "সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা"য় ১২৬১ বঙ্গাব্দে (১৮৫৪ বা ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ) প্রকাশিত হয়েছিল। ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত (১৮১২ - ১৮৫৯) একজন প্রখ্যাত বাঙালি কবি ও সাহিত্যিক। তিনি যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে মিলিতভাবে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে "সংবাদ প্রভাকর" পত্রিকা প্রকাশ করতেন। বাংলা কবিতার জগতে তিনি আধুনিক যুগ এনেছিলেন। প্রচলিত দেবদেবীর বন্দনা সংক্রান্ত কবিতা না লিখে তিনি মানুষের জীবন নিয়ে কবিতা লিখতেন। এছাড়া তিনি অনেক কবি, শিল্পীর জীবনী রচনা করেন। "সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা" বাংলা সাহিত্যের জগতে, নীল বিদ্রোহের ক্ষেত্রে ও জনমত গঠনে অপরিসীম গুরুত্ব রাখে। 

এই রচনাটির নাম যদিও "ভ্রমণকারি বন্ধুর পত্র" কিন্তু এটিকে ঠিক ভ্রমণ কাহিনী বলা চলে না। বরং এটিকে বর্তমান বাংলাদেশের তৎকালীন বিভিন্ন জেলার ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার বললে ভালো হয়। বিভিন্ন জেলার জনগণ, ভূপ্রকৃতি, অর্থ সামাজিক পরিস্থিতি এবং সেইসব এলাকার গুরুত্বপূর্ণ মানুষজনের কথা এই রচনা থেকে জানতে পারা যায়। ভ্রমণ সংক্রান্ত যেটুকু উপাদান এর মধ্যে আছে সেটুকু এখানে পরিবেশন করা হলো। 

বর্তমান রচনায় ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদকের কাছে লিখছেন এমন ভাবে রচনাটি করেছেন। ভ্রমণকারি বন্ধুটি আসলে ঈশ্বর গুপ্ত নিজেই। ১২৬১ সনে (১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে) রাজশাহী জেলা থেকে প্রথম তিনি সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন। সম্প্রতি তিনি কলকাতা থেকে নৌপথে রাজশাহীতে এসেছেন। বর্তমানে পদ্মা নদী তার পরাক্রম হারাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে চড় পড়েছে। নদী নিজের স্রোত কমাতে সেখানকার মানুষ খুব খুশি হয়েছে। তিনি আট দিন ধরে বড় কুটির ঘাটে কাপ্তান সাহেবের বাড়ির নীচে নৌকায় বাস করেছেন। এযাবৎ কোন ভাঙ্গন হতে দেখেননি। যদি আগের মতো নদী ভাঙ্গন অব্যাহত থাকতো তাহলে কাপ্তান সাহেবের সুন্দর বাড়ি, বাগান, ঘোড়ামারার বাজার, কমিশনারের প্রধান কেরানি, কালেক্টরের প্রধান কেরানি, ডেপুটি কালেক্টর, সদর আমিনের বাসা, গভর্নমেন্ট স্কুল বাড়ি সব এতদিন পদ্মার জলে ভেসে যেতো। এবার অতিবৃষ্টিতে পদ্মার জলে প্লাবন হয়েছিল। এখনো খানা ডোবা পূর্ণ আছে। জ্বরের খুব প্রাবল্য হয়েছে, বহু প্রাণহানি ঘটেছে। কদিন পর, লেখক ও সঙ্গীরা রাজশাহীর বড় কুটির ঘাট থেকে নৌকায় পাবনা যাত্রা করলেন। পরদিন সন্ধ্যায় পদ্মা নদী ছেড়ে ইছামতিতে প্রবেশ করলেন। কথায় আছে 'মরা গাঙ কুমিরে ভরা'। শীতকালের অল্প জলে কুমির অপেক্ষা করছে মাছ, পশু আর মানুষ খাওয়ার আশায়। ইছামতিতে জল কমে কোন কোন স্থানে আধ হাত জল হয়েছে। বড় নৌকা সেখান দিয়ে যেতে পারেনা। প্রায় সব নদীতে ভয়ংকর ''মসিনা" আছে। এসব জায়গায় নৌকা পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় নেই। এই মসিনার নাম চর। এর উপর স্থলচর প্রাণীর তো কথাই নেই, জলচর প্রাণীও বাস করতে পারে না। দুই প্রকার মসিনা হয়। সচল ও অচল। সচল মসিনা ততো ভয়ংকর না। অচল মসিনার ওপর দিয়ে জলযান গেলে তা রক্ষা করা দুষ্কর, বিশেষত উজানের সময়। ছোট ডিঙ্গি করে অতি কষ্টে তাঁরা পাবনার বাজার ঘাটে পৌঁছালেন।

এখানকার বাজার বড় ও সুসজ্জিত ইঁটের তৈরি, চকবন্দি ঘর। অনেক রকম খাদ্যদ্রব্য, পাটের আর সুতোর বস্ত্র, মাছ, তরকারি, ঘি, দুধ, দই সুলভ। শস্য জন্মায় অনেক। এখানে বেশ কিছু নীলের কুঠি আছে। অধিকাংশ নীলকরেরাই অত্যন্ত অত্যাচারী। পাবনায় কদিন থেকে নৌকায় রওনা হলেন তাঁরা। পদ্মা আরো প্রবলা হয়ে উঠলো বাইশ কোদালের মোহনার পরে। তেমোহনিতে যমুনা অসম্ভব খরস্রোতা। প্রবলা যমুনার জল অতি নির্মল, এই জল পান করা হয়। এবার আবার পদ্মায় প্রবেশ করে ফরিদপুরের দিকে যাত্রা করা হলো।

ফরিদপুরের টেপাখোলার ঘাটে এল নৌকা। ফরিদপুর বাণিজ্য কেন্দ্র। এখানে এক আনার মাছের দাম কলকাতার এক টাকা হবে। দুধ, ঘি ,সবজি, গুড়, চিনি সবই খুব সস্তা। বাঙালির খাবারের জন্য এটি চরম সুখের স্থান। ফরিদপুরের কাছারির কাছ থেকে ঢোলসমুদ্রের শোভা অত্যন্ত সুন্দর। ঢোলসমুদ্র হল সমুদ্রের মতো বড় এক জলাশয়। জল মিষ্টি, নানা জাতের মাছ আছে। জেলেরা সবসময় এখানে মাছ ধরছে। জলে নানা জলচর পাখি আছে, তাদের মধুর গানে সব দিক মুখরিত। বর্ষায় যখন এর সঙ্গে পদ্মার যোগাযোগ হয়, শোভা আরও বৃদ্ধি পায়। কুশলনাথ নামে এক অশ্বত্থ বৃক্ষ আছে, জেলার সবাই এই কুশলনাথ বৃক্ষের পূজা করে। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার তার তলায় পূজা হয়। ছাগ-মেষ বলি হয়, চিনি দুধ দিয়েও পুজো হয়। নীল কুঠির মালিকেরা অধিকাংশ ইংরাজ। কিছু জমিদারেরও কুঠি আছে। কুঠিয়ালরা অনেকেই খুব অত্যাচারী। লেখক ভ্রমণ করতে যেখানে যান সেখানেই বহু লোকের মুখে এই অত্যাচারের দুঃখের কথা শুনতে পেলেন। 

এরপর তিনি যেস্থানে গেলেন সেটি সুধারাম মজুমদার নামক এক ব্যক্তি জনশূন্য নদীর চরে প্রজাপত্তন করে তৈরি করেছিলেন এবং তার নামে জায়গার নাম হয় সুধারাম। এই স্থান সুধারাম, ভুলুয়া বা নোয়াখালী এই তিন নামেই পরিচিত। এখানে বাঘের ভালই উপদ্রব আছে। 

এরপরের জেলা চট্টগ্রাম। এখানে নীল, রেশম প্রভৃতির কুঠি নেই, তাই প্রজারা সুখে আছে। জেলার প্রধান নদী কর্ণফুলী। অত্যন্ত সুন্দর তার শোভা। জাহাজ, নৌকায় পূর্ণ। জলপথে এখানে বাণিজ্য চলে। সমুদ্রের (বঙ্গোপসাগরের) সঙ্গে যোগাযোগ থাকাতে অনেক স্থানে এই নদীর জল লবণাক্ত। সমুদ্র থেকে জাহাজ হাতিয়া ও সন্দীপের মতো বিশাল নদী হয়ে কর্ণফুলীর মধ্যে দিয়ে কলকাতা বা চট্টগ্রাম যায়। এই জাহাজ বা নৌকাগুলির লোহার বাঁধুনী হলে জলে নষ্ট হয়ে যেত তাই "বালাপ" নামের বেতের বাঁধুনি এই নৌকা বা জাহাজে ব্যবহার করা হয়। সমুদ্র তীরে হালিশহর নামে স্থানে বায়ু উত্তম। সাহেবেরা পীড়িত হয়ে আরোগ্যের জন্য হালিশহরে যায়। চন্দ্রনাথ, শম্ভুনাথ, আদিনাথ, পাতাল, দ্বাদশশীলা, জটাশঙ্কর, জ্যোতির্ময়, ধর্মাগ্নি, বিরুপাক্ষ, লবণাক্ষ, সহস্রধারা, বারোবানল, সূর্যকুন্ড, চন্দ্রকুন্ড, কুমারীকুন্ড প্রভৃতি তীর্থ এই জেলায় আছে। শিবচতুর্দশীতে চন্দ্রনাথে বড় মেলা হয়। সমুদ্র তীরে বারুনির মেলাকে মহা মেলা বলা হয়। রাউজান থানায় পাহাড়তলীতে মগেদের প্রকাণ্ড আট দিনব্যাপী মেলা হয়। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের রবিবার সূর্যব্রত মেলা অনেক স্থানে হয়। এখানে শহরের ভিতর মাঝে মাঝে বাঘ এসে অত্যাচার করে। সর্পভয় খুব বেশি আছে। পাহাড়ে গন্ডার, হাতি, ভাল্লুক, বাঘ অনেক আছে। পর্বতে মগ, চাকমা, ত্রিপুরা, কুকি, লুচি কোন প্রভৃতি বন্য জাতির বাস। 

চট্টগ্রাম থেকে তাঁরা এলেন কুমিল্লা। এখানে গোমতী নদী প্রবাহিতা। এখানে ত্রিপুরার রাজার রাজবাড়ি এবং অনেক দিঘী আছে। কামিল্যা পরিত্যাগ করে ডিঙ্গি নৌকায় করে গোমতী নদী থেকে মেঘনা অভিমুখে যাত্রা করলেন তাঁরা। সেদিনই তাঁরা গঙ্গামণ্ডল জমিদারির সদর কাছারি জাফরগঞ্জে এলেন। কাছারিতে কালী প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত আছে, অতিথিরা সবাই প্রসাদ পায়। গোমতী নদীর রূপ অতি ভয়ংকর। মনিপুরের পর্বত থেকে নির্গত হয়ে মেঘনায় এসে মিশেছে। এই নদীর দুই তীর অত্যন্ত শস্য শ্যামলা। মেঘনা, পদ্মা ও কীর্তিনাশা অতিক্রম করে রাজনগরের খালের মধ্যে প্রবেশ করে, বাজারের ঘাট এসে মহারাজা রাজবল্লবভের রাজভবন ও অনেক প্রাচীন কীর্তিকলাপ দেখলেন। রাজনগরে রাজসাগর, রাণীসাগর, আনন্দসাগর, কৃষ্ণসাগর, সুখসাগর, প্রভৃতি সুবৃহৎ সরোবর ও অনেক উদ্যান আছে। শতরত্ন, একুশরত্ন, পঞ্চরত্ন, রাস মঞ্চ, দোল মঞ্চ, বৈঠকখানা, বসতবাটি প্রভৃতি দর্শন করলেন। পরে নওয়া-ভাঙ্গিনি নদী পার হয়ে পদ্মায় প্রবেশ করে বরিশাল জেলায় এলেন। এখানকার চাল বঙ্গদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কুমিরের ভয় এই নদীতে খুব বেশি।
এর বেশী ভ্রমণ সংক্রান্ত উপাদান না থাকায় এখানেই শেষ কবি ঈশ্বর গুপ্তের ভ্রমণ কাহিনীর আলোচনা। 

পরবর্তী পর্বে আরেক ঐতিহাসিক ভ্রমণ কাহিনী আসছে।


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৪

৩৫। তীর্থ ভ্রমণ ২০ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

বহরমপুর থেকে নৌপথে রাঙামেটে (রাঙ্গামাটি), কাঁঠালের বাজার (?), সাটুইয়ের বাজার (?), মালঞ্চ (মালঞ্চ, মুর্শিদাবাদ) এক এক করে পার হলেন লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী ও তার সঙ্গীরা। মুর্শিদাবাদ থেকে মালঞ্চ পর্যন্ত গঙ্গায় অনেক চড়া আছে। দুই দিকে চড়ার মধ্যে স্থানকে বলে মসিনা। সেখানে জল খুব গভীর। মসিনাতে জলে নৌকো উল্টে যাওয়া সম্ভাবনা খুব বেশি তাই খুব সাবধানে নৌকা চলতে লাগলো। একে একে কপোলেশ্বর (?), কালিগঞ্জ (কালিগঞ্জ, নদীয়া), শিরনি, নলেপুর (?), বেলহারিগঞ্জ (?) হয়ে বর্তমান পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া এলো। কাটোয়ার আগে অজয় নদীর মোহনা। 


কাটোয়ায় অনেক বাজার ও ধনী লোকের বাস আছে। এই কাটোয়াতে শ্রীচৈতন্যদেব ভারতী গোঁসাই-এর (কেশব ভারতী) কাছে মন্ত্র নিয়েছিলেন। এখানে মহাপ্রভুর মন্দির আছে, আছে বকুল গাছ, ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ ও রাধাকান্তের রাধামাধব বাটি (কাটোয়া রাধাকান্ত বাড়ি মন্দির)। এবার দাঁইহাট-দেওয়ানগঞ্জ (পূর্ব বর্ধমান) মাটিয়ারী (নদীয়া) হয়ে এলো অগ্রদ্বীপ (পূর্ব বর্ধমান)। সেখানে তাঁরা বাসু ঘোষের গোপীনাথ মূর্তি দর্শন করলেন। (কিন্তু, অগ্রদ্বীপে ভক্ত গোবিন্দ ঘোষের কাছে এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য। এখানে তিনি কৃষ্ণের এক বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে দেন যার নাম গোপীনাথ। লেখক কি গোবিন্দ ঘোষ কে বাসু ঘোষ লিখেছেন?)। 


ক্রমে ঙ্গানদী পাটুলী  (পূর্ব বর্ধমান), বেলপুথুরিয়া (?), নদীয়ার সোনাডাঙ্গা,  কেশেডাঙ্গা হয়ে খড়িয়া (জলঙ্গি) নদীর সঙ্গে মিশে ত্রিমোহনী হয়েছে। এরপর এলো নবদ্বীপ সেখানে অনেক চতুষ্পাঠী আছে। গঙ্গার ভাঙ্গনে চৈতন্যদেবের জন্মস্থান, জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ি গঙ্গাগত। ভক্তরা গৌরাঙ্গের প্রতিমূর্তি তৈরি করেছেন। নবদ্বীপের বৈষ্ণবরা অনেকে মহাপন্ডিত। এখানকার বুড়া শিব ও পাটল দেবী (পোড়ামাতলা কি ?) খুব জাগ্রত। পরদিন মির্জাপুর (?), মথুরাপুর (?) হয়ে কালনায় পৌঁছানো হলো। 


বর্ধমানের রাজা তেজচাঁদ সামসেরজঙ্গ অম্বিকা কালনায় দেবালয় স্থাপন করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র মন্দির, লালজির মন্দির, রাসমণ্ডপ, রাজার বৈঠকখানা, ১০৮ টি মণ্ডলাকৃতি শিব মন্দির একে একে দর্শন করলেন। এটি রাজার দেবোত্তর সম্পত্তি। পূজা, অতিথি সেবার উত্তম বন্দোবস্ত আছে। কালনা পেরিয়ে সাতগেছে (সাতগাছিয়া), গুপ্তিপাড়া এলো, অপর পাড়ে শান্তিপুর। শান্তিপুর অনেক বৈষ্ণব গোস্বামী ও ব্রাহ্মণ পন্ডিতের বাসস্থান। এখানে তাঁতের মিহি কাপড় তৈরি হয়। 


এরপর গঙ্গার দুই পাড়ে একে একে গুপ্তিপাড়া, জিরেট (জিরাট), বলাগর, চাকদহ, সুখসাগর, শিজেডুমুরদহ (ডুমুরদহ) এলো । ডুমুরদহ কেশবরাম, গুমানরায়ের বাড়ি। তারা নৌকায় ডাকাতির সৃষ্টি কর্তা (রঘু ডাকাত ও বিশে ডাকাত কি ? তাদের বাড়ি এখানে ছিল বলে জানা যায়)। তাদের ভয়ে নৌপথে কেউ নির্ভয়ে যাতায়াত করতে পারত না। কলকাতার বাগবাজারের ঘাট পর্যন্ত তাদের বোম্বেটের (জলদস্যুর) নৌকা ঘুরে বেড়াতো। এবার এলো মগরা, ত্রিবেনী, বাঁশবেড়িয়া, ত্রিবেণী। ত্রিবেণীতে দক্ষিণ মুখী গঙ্গা, পশ্চিমমুখী সরস্বতী ও পূর্বমুখী যমুনা যুক্ত হয়েছে। একে মুক্তবেণী বলে। এখানে স্নান তর্পণ করা হলো। 


এরপর রাজা নৃসিংহদেব স্থাপিত হংসেশ্বরী ঠাকুরবাড়ি (বাঁশবেড়িয়া) দেখা হল। মূর্তি অতি চমৎকার। মহাকালের নাভি থেকে উৎসারিত এক পদ্মের মৃণাল, তার নিকটে এক হংসের পিঠে পদ্মাসনে চতুর্ভুজা দেবীমূর্তি। মন্দিরের আকার যন্ত্রাকৃতি। উপরের শৃঙ্গে নানা দেবদেবীর মূর্তি স্থাপিত। এরপর এলো হুগলি। সেখানে প্রাণকৃষ্ণ হালদার নামে চুঁচুড়ার এক অতি ধনী বাবুর নাচঘরে তখন হুগলি কলেজ হয়েছে। মোহম্মদ মসিনের (মহসিন) ইমামবাড়ী অতি উত্তম। চুঁচুড়ায় আছে নাচঘর (বাবু প্রাণকৃষ্ণের কি? এখন তাতে কি হয়েছে?)। তার দুই ক্রোশ দূরে ফরাসডাঙ্গা (চন্দননগর)। এখানে ফরাসিদের রাজ্য (১৯৫০ পর্যন্ত)। খুব সুন্দর শহর ভালো রাস্তা, ভালো বাড়ি, বাজার আছে। 


এভাবে ক্রমে ক্রমে আসে ভদ্রেশ্বর, গোরুটির বাগ (গৌরহাটি), বৈদ্যবাটি, নিমাই তীর্থের ঘাট (বৈদ্যবাটি), শেওড়াফুলি, নিস্তারিনির বাড়ি (শেওড়াফুলি)। পূর্বপাড়ে একে একে কাউগাছি (জগদ্দল), টিটাগড় মণিরামপুর (ব্যারাকপুর); পশ্চিম পাড়ে দেবগঞ্জ (?), সাধু বাবুর বাজার (?), শ্রীরামপুর আসে। শ্রীরামপুরে মার্শম্যান সাহেবের ছাপাখানা। শ্রীরামপুর পূর্বে দিনেমারদের (ডেনমার্কের) অধীন ছিল, এখন কোম্পানি বাহাদুরের রাজ্য। এছাড়া শ্রীরামপুরের রাধাবল্লভজির মন্দিরের উল্লেখও করেন। তারপর এলো মাহেশ (জগন্নাথদেবের মন্দির), রিষড়া, কোন্নগর, কোতরং, উত্তরপাড়া। পূর্বপাড়ে বিশালক্ষীর দহ (টিটাগড়), খড়দহ, রামহরি বিশ্বাসের দ্বাদশ শিবস্থাপন (খড়দা ২৬ মন্দির), বান্ধাঘাট (?), শ্যামসুন্দর ঘাট, সুখচর, পানিহাটি, এড়িয়াদহ (আড়িয়াদহ)। 


পূর্ব পাড়ে নসরাই (যেখানে ম্যাগাজিন ?), রাসমনির নবরত্ন শিবালয় (দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমনির প্রতিষ্ঠিত মা ভবতারিণীর মন্দির গঠনে নবরত্ন ধাঁচের আর শিব মন্দিরগুলি আট চালা। দক্ষিণেশ্বর শিবের নাম। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে যখন মন্দিরের উদ্বোধন হয়েছিল তখন লেখক তীর্থ ভ্রমণ করছিলেন অন্য প্রদেশে। তাই তিনি জানতেন না নবরত্ন মন্দিরটি কালীঠাকুরের। নৌকোয় যেতে যেতে দেখে নিশ্চয়ই তিনি মনে করেন বড় নবরত্ন মন্দিরটি দক্ষিণেশ্বর শিবের মন্দির)। 


পশ্চিমপাড়ে ভদ্রকালী, উত্তরপাড়া, বালি, বারাকপুর (?), ঘুসড়ি (ঘুসুড়ি), শালিখা (সালকিয়া), গোলাবাড়ির ঘাট, নিমকের গোলা (নমক গোলাঘাট), হাবড়া (হাওড়া) যে স্থানে রেল রোড। তারপর রামকৃষ্ণপুর, শিবপুর; পূর্ব পাড়ে কাশীপুর, চিৎপুর, সুরের বাজার (?), বাগবাজারের বান্ধাঘাট, বাগবাজারের অন্নপূর্ণা ঘাট (আগে বাগ বাজারে অনেকগুলি গঙ্গার ঘাট ছিল)। অন্নপূর্ণা ঘাটে নৌযাত্রা শেষ হলো। 


পালকি করে কলকাতার বাসায় এলেন লেখক। সেখানে পুত্র, জামাতা এদের সঙ্গে প্রায় পৌনে চার বছর পরে পুনর্মিলন হোল। এরপর তিনি রেলগাড়িতে কোন্নগর পর্যন্ত গেছিলেন। 


অবশেষে সাত অগ্রহায়ণ কলকাতার বমশালের ঘাট (সম্ভবতঃ ব্যাংকশাল রোডের ঘাট) থেকে নৌকা যাত্রা করেন বাড়ি রাধানগরের উদ্দেশ্যে। পথে দেখেন কলে জল উঠছে, খিদিরপুরে গঙ্গার পুল দেখেন, কোম্পানির বাগান বা শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন, 'যেখানে সবরকম বৃক্ষলতা আছে'। এবারের অন্য পথের নৌযাত্রায় সাঁকরাল (সাঁকরাইল), বাউরিয়া, বজবজ, উলুবেড়িয়া হয়ে নুরপুর, গেঁওখালি বাজারে গঙ্গা থেকে নৌকা রুপনারায়ণ নদীতে প্রবেশ করল। 


এরপর রূপনারায়ণ নদী ধরে নৌকো চললো। তমলুক (এখানে বর্গভীমার মন্দির আছে বলে লেখক লিখেছেন), কাঁটাপুকুর (কাঁটাপুকুর, পূর্ব মেদিনীপুর) কোলা (কোলাঘাট), মুন্সিরহাট (? , এটি বর্তমান হাওড়া জেলার মুন্সিরহাট নয়), ভাটরা (ভাটোরা, হাওড়া), ধনডাঙ্গা (ধলডাঙ্গা, হাওড়া), হেনর ঘাট (?), জগৎপুর ( জগৎপুর, হুগলী), তিতুর পাড়ার ঘাট (?) হয়ে নৌকো গড়ের ঘাটে (জগৎপুর, হুগলী) পৌঁছাল। তারপর পালকিতে করে সেনহাট, খানাকুল, রামনগর বাজার ইত্যাদি পেরিয়ে ৯ অগ্রহায়ণ লেখক তাঁর রাধনগরের বাড়ি ফিরলেন। এইভাবে যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয়ের পৌঁনে চার বছরের দীর্ঘ তীর্থ ভ্রমণ শেষ হলো।

                     

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১২ কার্তিক ১২৬৪ (৭ নভেম্বর ১৮৫৭) থেকে ৯ অগ্রহায়ণ ১২৬৪ (২৪ নভেম্বর ১৮৫৭)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৪

৩৪। তীর্থ ভ্রমণ ১৯ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                   (আগের পর্বের পরে)

অবশেষে ১৭ আশ্বিন ১২৬৪ সালে দেশে ফেরার জন্য কাশী থেকে নৌকায় যাত্রা করা হলো। 


প্রথমে কিছুদিন বিহারের গাজিপুরে থাকা হল। গাজিপুর ভালো শহর। ৫০০০ ঘর আছে। প্রধানত মুসলমানদের বাস। নানা রকম দোকান বাজার আছে। গাজিপুরে নানা রকম উত্তম মানের কাপড় তৈরি হয়। তাছাড়া গোলাপের আতর তৈরি ও বিক্রি হয় প্রচুর। গাজিপুরের পূর্বের নাম গাধিপুর। গঙ্গাতীরে লর্ড কর্নওয়ালিসের সমাধি আছে। 


নদীপথে তারপর এলো বগসর বা বক্সার। এখানে কোম্পানির সিপাহীদের প্রয়োজনীয় ঘোড়ার প্রজনন ও প্রতিপালন করা হয়। ক্রমে ক্রমে বিহারের ত্রিভবানী (তরিয়ানি ছাপরা?), সারন-ছাপরা (ছাপরা), দানাপুর ( দানাপুর), বাঁকিপুর (বাঁকিপুর) হয়ে নৌকা চলতে থাকলো। এইসব স্থান কুমার সিংহ বা কুনওয়ার সিং-এর এলাকা, তাই কোম্পানি খুব সতর্ক। এবার তাঁরা পাটনা এলেন। 


পাটনা খুব প্রাচীন শহর। পাঁচ ক্রোশ বিস্তৃত এই শহরে এক লক্ষের বেশি হিন্দু ও মুসলমানের বসবাস। চকের বাজার খুব বড় ও সুসজ্জিত। জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর, কমিশনারদের কাছারি, ডাকঘর, আফিমের কুঠি, সেনা ছাউনি, সাহেবদের বাংলো সব নিয়ে জমজমাট শহর। পাটনায় পাটনদেবী আছেন। আগে পাটনার নাম ছিল পাটন। সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাবে পাটনায় অন্য জায়গার লোকেদের রাত দশটার পরে রাস্তায় চলাচল শক্ত। তিনবার জিজ্ঞাসা করে উত্তর না পেলে গুলি করার হুকুম আছে। শহরের দোকানদারের বিক্রি ভালো হয় না। লুটের ভয়ে তারা দোকানে বেশি জিনিস রাখে না। 


এই অস্থির পরিস্থিতিতে লেখক দুজন সঙ্গীর সঙ্গে পালকি করে চললেন গয়ার উদ্দেশ্যে। বর্ষার জন্য রাস্তার অবস্থা খারাপ। কোন কোন নদীর কাঠের পুল ভেঙ্গে গেছে, একটা তাল গাছের কাণ্ডের উপর দিয়ে নদী পার হতে হল। পুনপুনা তীর্থে স্নান তর্পণ করে মশৌরী গ্রাম (মাসুরী), জাহানা (জাহানা), মকদমপুর (মকদমপুর) হয়ে গয়া এসে পৌঁছানো হলো। সেখানে বাঙালি এবং গয়ালীরা শ্যামাপূজা করেছে দেখলেন। গয়ার দোকান বাজারের আগের মত সুসজ্জিত অবস্থা নেই। ব্যবসায়ীরা খুব কষ্টে আছে। সাহেবদের থাকার বাংলো, কাছারি, ডাক্তারখানা, জেলখানার অংশ পুড়ে গেছে এই বিদ্রোহে। বাঙালিরা অনেকে স্ত্রী-পুত্র-পরিবারকে দেশে পাঠিয়েছে। মন্দির রাতে বন্ধ হয়ে যায়। চারদিকে ত্রাসের পরিবেশে ডাকাতি সন্ত্রাস চলছে। মানুষ টাকা পয়সা দামি জিনিস মাটির তলায় পুঁতে রেখে মলিন পোশাকে ছদ্মবেশে আছে। এর মধ্যে গয়ায় পূজা, স্নান, পিণ্ডদান করে লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা আবার পাটনা ফিরে এলেন। 


এবার পাটনার গঙ্গার ঘাটে লেখক ছট বা ষষ্ঠী ব্রত দেখলেন। শহরের সমস্ত স্ত্রীলোক উত্তম বস্ত্রালঙ্কারে সেজে; পালকি, ডুলি, পদব্রজে; রওশান চৌকি, টিকারা, তাসা, কাড়া বাদ্য সমবিহারে; নানা জাতীয় ফল, পাঁচকলাই-এর অঙ্কুর, নানা রকম পুরি, কচুরি জাতীয় খাদ্যদ্রব্য আর কাঁদি কাঁদি পাকা কলা; নতুন প্রদীপ, আলতা, হরতকি, বয়রা, পান সুপারি নিয়ে গঙ্গার ঘাটে উপস্থিত। সূর্যোদয়ে সকলে গঙ্গাস্নান ও সূর্য পূজা করে ঘরে ফেরে। সেদিন কারো বাড়িতে রান্না হয় না, আগের দিনে তৈরি খাবার খায় সবাই। এই উপলক্ষে আগের দিন থেকে মোট তিন দিন মেলা হয়। 


১১ কার্তিক ১২৬৪ সালে পাটনা থেকে গঙ্গায় নৌকা যোগে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন সবাই। মারুগঞ্জ (মারুফগঞ্জ), বৈকন্ঠপুর (বৈকুন্ঠপুর), রূপসগ্রাম (রূপসপুর) হয়ে নৌকা চলল। রূপসের কাছে দস্যু জালেম-জোলম-এর ঘর। এই দস্যুরা নৌকা লুট করতো, মহাজনকে চিঠি দিয়ে আক্রমণ করতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই দস্যুদের দমন করে প্রাণদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু এখন সিপাহী বিদ্রোহের রাজদ্রোহীদের লুঠতরাজ সেইসব ডাকাতের থেকেও বেশি ভয়ানক হয়েছে। এরপর বাড়গ্রাম (বাড়ধ), দরিয়াপুর হয়ে মুঙ্গের এলো। 


গঙ্গা তীরের বাজারে সব রকম জিনিসের সুসজ্জিত দোকান রয়েছে। ব্যাধেরা পাখি ধরে বাজারে বিক্রি করছে। পাথরের ভালো ভালো থালা বাটিও বিক্রি হচ্ছে। মুঙ্গের থেকে জলপথে দুই ক্রোশ গিয়ে পাহাড়ের কাছে সীতাকুন্ড। প্রাচীরে ঘেরা এই কুন্ডতে জলে গরম ধোঁয়া উঠছে, জল এত গরম যে স্নান করা যায় না এছাড়া রামকুন্ড, লক্ষণকুন্ড, ভরতকুন্ড, শত্রুঘ্নকুন্ড প্রভৃতি ঠান্ডা জলের কুণ্ড আছে। মুঙ্গের থেকে পদব্রজে আট ক্রোশ দূরে জাঙ্গীরায় (জাহাঙ্গীরায়) গেলেন তাঁরা। এই স্থান জহ্নুমুনির তপস্যার স্থান। যিনি গঙ্গাকে গন্ডুষে পান করে নিয়েছিলেন। পাহাড়ের চারপাশ গঙ্গা বেষ্টিত। পাহাড়ের উপর জহ্নুমুনি স্থাপিত শিবমূর্তি। এই পাহাড়ে এত বড় বড় সাপ আছে যে কেউ সেখানে থাকতে পারেনা। এরপর নৌপথে ক্রমে ক্রমে বিহারের ভাগলপুর, ইংলিশের বাজার, কহলগাঁর বাজার (কহলগাঁও) এলো। এইসব স্থানে গঙ্গা খুব বেগবতী, জলের তলায় পাথর ও ডুবো পাহাড় থাকায় অতি সাবধানে নৌকা চালাতে হয়। তারপর পাথরঘাটা (পাথরঘাটা পাহাড়, ভাগলপুরের বটেশ্বর স্থানের নিকটে অবস্থিত), পীরপৈতি,  সাঁকড়িগলির পাহাড় (সকরি গলি) হয়ে এল রাজমহল। 


এখান  থেকে বিহার শেষ হয়ে বর্তমান ঝাড়খন্ড শুরু হল। রাজমহল দোভাষী দেশ অর্থাৎ হিন্দি বাংলা দুই ভাষাই সমান চলে। অনেক বনজঙ্গল কেটে আস্তে আস্তে শহর হয়ে উঠেছে রাজমহল। ম্যাজিস্ট্রেট, কাছারি, ডাকঘর, ডাক্তারখানা, রেলরোড অফিস ইত্যাদি আছে। এরপর শিবগঞ্জ (সাহেবগঞ্জ) এল। এখানে চাল আর তসরের কাপড় সস্তা। মহাজনেরা এখান থেকে এইসব দ্রব্য পশ্চিমে ব্যবসার জন্য নিয়ে যায়। এরপর গঙ্গা ও পদ্মার সঙ্গম এল। আরো দুই ক্রোশ এসে ভাগীরথীর পুরনো মোহনা। জল খুব কম, নৌকা যাওয়ার পথ নেই। পরে এক ক্রোশ এসে আর এক মোহনা, তাও বন্ধ। আরও এক ক্রোশ এসে পদ্মা থেকে খাল কেটে জল এনে গঙ্গাতে মেশানো হয়েছে তা দিয়ে নৌকা যাতায়াত করছে। 


এবার ঝাড়খন্ড পেরিয়ে লেখকেরা তৎকালীন বাংলা বা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের এলাকায় ঢুকলেন। ক্রমে ক্রমে জঙ্গিপুর (জঙ্গিপুর), বালানগর (বালানগর), গয়সাবাদ (গয়সাবাদ), জিয়াগঞ্জ হয়ে মুর্শিদাবাদ। এখানে লেখক দেখলেন নবাবের ইমামবাড়া, নবাবের মহল। নবাবের মহল তিন তলা, সাত দেউড়ি ও হাজার দরজা জানলা দেওয়া (হাজারদুয়ারি)। এক এক দেউড়িতে এক এক জন দারোগা আছে। প্রায় এক ক্রোশ পর্যন্ত নবাবের পরিবারের বাড়িঘর আছে। তাছাড়া আছে চাঁদনী চক। এখানে নানা দেশের সওদাগরেরা উত্তম পসরা দিয়ে দোকান সাজিয়েছে। রাস্তা লন্ঠন দিয়ে আলোকিত। গঙ্গার তীরে বৈঠকখানার ঘর (বসে গঙ্গা উপভোগ করার স্থান) সাজানো আছে। গঙ্গা তীরে কামান পোতা ছিল, সিপাহী বিদ্রোহ কালে সমস্ত কামান, বন্দুক, পিস্তল, তলোয়ার কোম্পানি সরকার উঠিয়ে নিয়ে গেছে। নবাবের প্রহরীরাও শুধু লাঠি দিয়ে দ্বার রক্ষা করছে। 



নবাবের একশ জন বেগম আছে। তাদের পাহারায় আছে খোজা প্রহরী। নবাবের দরবারে আদব কায়দা, সেলাম নাকিব, ফুকারা সবই বজায় আছে। কিন্তু নবাবের কাছে দুজন সাহেব থেকে রাজনীতি ও  বিদ্যাভ্যাস করাচ্ছে। ১৭৫৭ -তে পলাশীর যুদ্ধের ও ১৭৬৪ -তে বক্সার যুদ্ধের পরাজয়ের পরেও বাংলায় নবাবী প্রথা চালু ছিল। ১৭৬৫ থেকে কোম্পানি বাংলার দেওয়ানী লাভ করে কিন্তু নবাব রইলেন বাংলা নিজামত হিসাবে। ১৭৯৩ থেকে এই নবাবী শুধু নামমাত্র নবাবীতে পরিণত হয় এবং এটি বজায় থাকে ১৮৫৮ পর্যন্ত, যখন ব্রিটিশ রাজশক্তি সরাসরি এদেশের শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে নবাবদের থাকার জন্য হাজারদুয়ারি প্রাসাদ তৈরি হয়। ব্রিটিশরা অর্থাৎ কোম্পানির রাজ পুরুষরাও এই প্রাসাদ ব্যবহার করতেন। বাংলার নবাব উপাধি সম্পূর্ণভাবে রদ করা হয় ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে। 


মুর্শিদাবাদ শহরে জগৎ শেঠ, রাজা হরিনাথ কুমার, রায় সাহেব প্রভৃতি ধনীদের ভালো ভালো দোমহলা, তেমহলা, চৌমহলা ইঁটের তৈরি, চুনকাম করা বাড়ি আছে। সেই সব বাড়ির বৈঠকখানা ঝাড়লন্ঠন, আয়না, কৌচ, কেদারা দিয়ে সাজানো। মুর্শিদাবাদে অনেক আরবী আর পার্সি ভাষায় পারদর্শী মৌলবী আছেন। 


এরপর এলো বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার কাশিমবাজার, সয়দাবাদ ,খাগড়া। খাগড়ার কাঁসার বাসন ও চিনির মুড়কি খুব বিখ্যাত। এই মুড়কি খাঁটি ঘীয়ে ভাজা ও রসে পরিপূর্ণ। তারপর বহরমপুর এলো। এখানে কোম্পানির নানা রকম কাছারি, সেনাছাউনি আছে। দেশী পদাতিক যারা সেনাছাউনিতে আছে তাদের কাছে আগে বন্দুক, তরবারি এসব ছিল। এখন তারা শুধু সরু লাঠি নিয়ে প্রহরীর কাজ করে।

                       (চলছে)

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১৭ আশ্বিন ১২৬৪ (২ অক্টোবর ১৮৫৭) থেকে ২১ কার্তিক ১২৬৪ (৬ নভেম্বর ১৮৫৭)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৪

৩৩। তীর্থ ভ্রমণ ১৮ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

এবার গঙ্গা নদীতে জলপথে প্রয়াগ থেকে কাশী যাত্রা। সারাদিন বজরা চলে। মাঝে মাঝে চড়াইয়ে বজরা নোঙর করে রান্নাখাওয়া হয়। এভাবে চলার পর চতুর্থ দিন এলো বিন্দুবাসিনী বা বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মন্দির। দেবী সিংহবাহিনী, চতুর্ভূজা। তাছাড়া আছেন মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী মূর্তি। গঙ্গাতীর থেকে এক ক্রোশ দূরে পাহাড়ের (বিন্ধ্য পর্বত) উপর যোগমায়া দেবীর অষ্টভূজা মূর্তি সম্বলিত মন্দির। এছাড়া বটুক ভৈরব সহ অন্য নানা দেবদেবীর মন্দির। বিন্দুবাসিনী মন্দিরের চারদিকে পাণ্ডাদের বসতি, অনেক দোকানও আছে। প্রতিদিন মহাকালীর সামনে অনেক বলিদান হয়। বিন্দুবাসিনী মন্দিরের ভিতর এক কক্ষ (কাঠরা) আছে, যার মধ্যে যাত্রীদের ঢুকিয়ে পান্ডারা দরজা বন্ধ করে দেয়। ভোগ ইত্যাদি বাবদ টাকা পয়সা যতক্ষণ না আদায় হয় সেই কক্ষের দরজা তারা খোলে না। সুন্দরী কুমারীরাও পয়সার জন্য মন্দিরে চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। অনেক সন্ন্যাসী এই স্থানে তপস্যা করেন। 


দুই ক্রোশ দূরে মির্জাপুর (মৃজাপুর) একটি বড় শহর। অনেক বাঙালি এখানে ব্যবসা করে। গঙ্গার ঘাটগুলি পাথরে বাঁধানো ও সেখানে সুন্দর সুন্দর মন্দিরে শিব স্থাপিত আছে। শহরের মধ্যে ইঁট ও পাথরের তৈরি বাড়ি ও মন্দির সুগঠিত। শহরের রাস্তা পাথর দিয়ে তৈরি, নর্দমাও পাথরের। এখানে সরকারি নানা রকম কাছারি আছে। 


এবার বজরা এলো চন্ডালগড় (চুনার)। পাহাড়ের উপর কেল্লা। এই কেল্লা পূর্বে চন্দ্ররাজার ছিল, পরে রামনগরের রাজা অধিকার করেছিলেন। এখন তা কোম্পানি অধিকার করেছে। এখানে বেশ কিছু সাহেবদের বাংলো আছে। 


চন্ডালগড় থেকে তিন ক্রোশ দূরে ছোট কলকাতা, এখানে সাহেবদের বাংলো, কোম্পানির সেনা ছাউনি আছে বলে এই নাম হয়েছে। এরপর এলো রামনগর এখানে রাজার বাড়ি ও ব্যাসদেব স্থাপিত শিব এবং ব্যাসের মূর্তি আছে। তাই একে ব্যাস কাশীও বলে। 


রামনগর থেকে কাশীধামের অসির ঘাট আধ ক্রোশ আর বরণা নদীর ঘাট তিন ক্রোশ। এবার দ্বিতীয়বার লেখক কাশীতে এলেন। পঞ্চক্রোশী কাশী অর্ধচন্দ্রাকৃতি।  বিশ্বেশ্বরের মন্দির মহারাজ রঞ্জিত সিংহ সুবর্ণমণ্ডিত করে দিয়েছেন। মন্দিরের অমূল্য রত্ন ভান্ডার আছে। মন্দিরে চারটি দ্বার। পশ্চিম দ্বারের সামনে নাটমন্দির। তার মধ্যে রাজা হরিশচন্দ্রের স্থাপিত শিব। এছাড়া চতুর্দিকে পার্বতী, অন্নপূর্ণা, অবিমুক্তেশ্বর প্রভৃতি দেবদেবীর মন্দির আছে। উত্তরদিকে জ্ঞানবাপী নামে এক কূপ আছে। মুকুন্দ ব্রহ্মচারী (প্রয়াগ সংক্রান্ত পর্ব দর্শণীয়) যখন কাশীধামে আসেন, বিশ্বেশ্বররের পূজার জলের সন্ধানে মাটি নিজের হাতের মুঠির আঘাত করলে যোগবলে ভগবতী উঠে আসেন, এই সেই কূপ। 


উত্তর দিকে বিশ্বেশ্বরের পুরনো মন্দির আছে। বিশ্বেশ্বর গুপ্ত হয়েছেন সেখানে কারণ আওরঙ্গজেব বাদশাহ ওই মন্দিরের প্রতি "অত্যাচার করে" মসজিদ ও বিশ্বেশ্বরের মন্দির ভেঙে তার উপরে আপন কবরস্থান নির্মাণ করেছেন (যদিও তাঁর কবর আওরঙ্গবাদ, মহারাষ্ট্রতে)। কাউকে সেখানে তারা ঢুকতে দেয় না। কেউ কেউ (হিন্দু) বহু স্তব স্তুতি করে ও রক্ষকদের পুরস্কার দিয়ে ওই স্থানে যোগ সাধনে যেতেন বলে শোনেন লেখক। 


এরপর লেখক কাশীধামের প্রধান তীর্থস্থানগুলি বর্ণনা করেন। যেমন অন্নপূর্ণা, কেদারঘাটে কেদারেশ্বর, শ্মশানেশ্বর, তিলভাণ্ডেশ্বর, লোলার্ক তীর্থ, দুর্গাকুণ্ড। কাশীধামের যাত্রাগুলির বিষয়েও তিনি বলেন। দক্ষিণ মানস যাত্রা, পশ্চিম মানস যাত্রা, উত্তর মানস যাত্রা, এ ছাড়া পাঁচ, সাত ও নয় দিনের পঞ্চক্রোশী যাত্রাও করেন পুণ্যার্থীরা। 


উত্তর মানসের একটি তীর্থস্থল হলো লাট ভৈরব। এখানে ভৈরবের দন্ড ও ভৈরবের যাতা আছে। কাশীতে পাপকর্ম করলে ভৈরবের দন্ড ও যাতাতে ছয় হাজার বছর ধরে পেষিত হতে হয় বলে প্রচলিত আছে। এই যাতা নিয়ে হিন্দু ও মুসলমানের বিবাদ হয়। ওই স্থানে মুসলমানেরা মসজিদ করতে শুরু করলে হিন্দুরা বাধা দেয় ও মুসলমানদের পরাভূত করে। পরে রাতে মুসলমানেরা যাতার চারদিকে আগুন দেয়, কিন্তু যাতার হানি হয় না। এবার গোরক্ত দিয়ে আগুন দেওয়া হলে যাতা ভেঙ্গে যায়। সকালে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা শুরু হয়। তখন কাশীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মাধ্যক্ষ জজ রেনলিক হিন্দুদের অনুমতি দেন মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার। হাজার হাজার মুসলমান হত হয়। যারা বেঁচে গেল তাদের মুখে শূকরের রক্ত, গোবর ইত্যাদি দিয়ে, কর্ণচ্ছেদ করে, মুসলমানদের দেবালয়ে শুকর ছেদন করে, তাদের স্ত্রীগণের দুরবস্থা করে হিন্দুরা অত্যাচার চালায়। অনেক মুসলমান দেশ ত্যাগ করে। পরে সাহেবরা এসে হিন্দুদের শান্ত করে তাদের তামার যাতা তৈরি করে দেন। এখন সেই যাতাই আছে। 


কাশী শহরের বাড়িগুলি পাথরের তৈরি। বড় বড় তিন থেকে পাঁচতলা উঁচু। দুপাশে বাড়ির মাঝে দেড় হাত প্রমাণ গলিপথ। শহরে পাঁচ হাজার ফটক আর এক এক ফটকের মধ্যে পাঁচ, ছয়, সাতটি গলি আছে। গলিতে ঢুকে পথ চেনা খুব শক্ত। কাশীতে অনেক চক ও বাজার আছে। তাছাড়া প্রতি মহল্লাতে অনেক দোকান ও পানের দোকান আছে। সাটিন, মখমল, বারাণসী তিল্লার কাজে নীলাম্বরী পীতাম্বরী শাড়ি পাওয়া যায়। 


কাশীতে তীর্থদর্শনের বর্ণনা প্রথমবার কাশী ভ্রমণপর্বে দেওয়া হয়েছে বলে এখানে আর পুনরাবৃত্তি করা হলো না। 


এবার লেখক বাড়ি ফেরার জন্য উদ্যোগী হলেন। নানারকম বাধাবিঘ্নের পর জ্যৈষ্ঠমাসে নৌকায় গমনের কথা হলে মাঝি বললো যে এখন ঝড়-বৃষ্টি সময়ে নৌকায় যাওয়া যাবে না। আষাঢ়মাসে যাওয়া যেতে পারে। সঙ্গীরা জলপথে না দিয়ে ডাকগাড়িতে (ঘোড়ার গাড়ি) যাওয়া কথা ঠিক করলেন। তখন খবর এলো মিরাট ও দিল্লিতে নানা অঘটন ঘটেছে। কলকাতা যাওয়ার রাস্তা শিগগির বন্ধ হয়ে যাবে। এবার শুরু হল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ। সিপাহী বিদ্রোহের বিশদ বিবরণ লেখক দিয়েছেন, কিন্তু এই ভ্রমণ সংক্রান্ত আলোচনায় তার প্রয়োজন নেই বলে সেটা উপস্থাপন করা হলো না। বিদ্রোহ চলাকালীন লেখক কাশীতেই থাকেন। কাশীতে বিদ্রোহের তেমন প্রভাব পড়ে নি।


লেখক কাশীর বিভিন্ন তীর্থস্থানে দর্শন, পূজন, তর্পণ করতে থাকেন। ভাদ্রমাসে গঙ্গার জল এত বৃদ্ধি পায় যে গত কুড়ি বছরে সেরূপ হয়নি। কাশীর পুষ্করভাস্কর তীর্থে গঙ্গার জল পৌঁছায়, মণিকর্ণিকা ঘাটের চক্রতীর্থের ইন্দ্রদুমনেশ্বর শিবের মস্তকের ওপর দিয়ে গঙ্গার জল প্রবাহিত হয়ে সেই সব তীর্থের মাহাত্ম্য বেড়ে যায়। ফলে সবাই ওই স্থানগুলোতে পুণ্যস্নান করে। এছাড়া তিনি এই সময় লক্ষ্মীকুণ্ড মেলা, তিলতৃতীয়া ব্রত, গণেশ চৌথ, বরণা যাত্রা ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান দর্শন করেন। 


৩ আশ্বিন ১২৬৪ সূর্য গ্রহণ হয়। সূর্যগ্রহণকালে নানা দেশের রাজা ও ধনী ব্যক্তিরা এবং সাধারন মানুষরা কাশীর গঙ্গায় স্নান করতে আসতো। কাশীর পাণ্ডাদের এই সময় বিশাল অর্থলাভ হতো। এক একজন রাজা সোনায় মোড়া হাতি, ঘোড়া দান করতেন। কিন্তু এই বছর কোম্পানি সরকারের কাছে খবর এলো যে এই উপলক্ষে ছদ্মবেশে বিদ্রোহীরা কুমার সিংহ (বিহারের ভোজপুরের কুনওয়ার সিং) ও কানপুরের নানা সাহেবের নেতৃত্বে কাশীতে প্রবেশ করবে। তাই সরকারের কর্মকর্তারা স্থানে স্থানে পথ বন্ধ করে বন্দুকসহ প্রস্তুত থাকলো আর সব আসা-যাওয়া, নৌকা পারাপার বন্ধ রাখল। অন্য কোন জায়গার মানুষকে কাশীতে ঢুকতে দিলো না। ফলে পাণ্ডাদের বিশেষ অর্থক্ষতি হলো। 


এরপর লেখক কাশীতে শারদীয়া দুর্গাপূজা দেখেন। কাশীর বাঙালিরা দুর্গাবাটিতে (পুরনো দুর্গাবাড়ি, বেনারস) দুর্গোৎসব করেন। নবরাত্রির মেলাও হতো সেখানে নয় দিনব্যাপী। কাশীতে বলিদান নিষিদ্ধ কিন্তু দুর্গাবাড়িতে শুধু বলিদান হতে পারতো।


                        (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১১ পৌষ ১২৬৩ (২৬ ডিসেম্বর ১৮৫৬) থেকে ১৬ আশ্বিন ১২৬৪ (১ অক্টোবর ১৮৫৭)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৪

৩২। তীর্থ ভ্রমণ ১৭ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

       

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                     (আগের পর্বের পরে)


দেড় মাস দিল্লি থাকার পর লেখক প্রয়াগের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। পথে বদরপুর গ্রাম পড়ল। সেখানে বুলকট্রেনের বয়েল বদল করা হয়। মানে সেখানে গরুর গাড়ির গরু পাল্টানো হয়। পঞ্চম দিনে বৃন্দাবনে পৌঁছানো হলো। সেখানে দেব দর্শন, পূজা ও বন্ধুদের কাছে শেষবারের মতো বিদায় নিয়ে আবার পথ চলা শুরু। সেকেন্দরাবাগ অর্থাৎ সুলতান সিকান্দার শাহ লোদীর প্রতিষ্ঠিত সিকান্দ্রাবাদ হয়ে তিনদিনে সবাই আগরায় (আগ্রা) পৌঁছালেন। 

উত্তর দক্ষিণে আগ্রা শহর দুই ক্রোশ দীর্ঘ ও পূর্ব পশ্চিমে এক ক্রোশ প্রস্থ। এখানে খুব ভালো বাজার আছে। হালওয়াই-এর পট্টি, ভুনাওয়ালাদের পট্টি, গান্ধির দোকান (ফুলেল আতর, গোলাপ জল প্রভৃতি বিক্রির), জরির আর তিল্লার কাজের দোকান, গুড়গুড়ি-আলবোলার দোকান, ভালো গালিচা, সতরঞ্চির দোকান প্রভৃতি অনেক আছে। আগ্রা শহরে প্রায় ৫০০ বাঙালি আছে। অনেক সাহেবও আছে। এখানে নানা রকম কাছারি, ট্রেজারি, ব্যাংক, আদালত আছে। 


আগ্রা অতি প্রাচীন শহর। যখন হিন্দুদের রাজ্য ছিল তখন এর নাম ছিল অগ্রবন। মুসলমান রাজ্য হওয়াতে আকবর বাদশাহ এখানে কেল্লা তৈরি করে নাম দেন আকবরাবাদ। পরে মহারাষ্ট্রীয়গন দখল করাতে নাম হয়ে যায় আগ্রা। 


আগ্রার কেল্লা যমুনার উপরে অবস্থিত। প্রস্তর নির্মিত মজবুত উঁচু প্রাচীর যুক্ত এই কেল্লার মধ্যে মতি মসজিদ আছে। তার মধ্যে আছে শ্বেত পাথরের তৈরি প্রশস্ত ঘর যেখানে ১৫০০ মানুষ এক সঙ্গে বসে উপাসনা করতে পারে। যেখানে বাদশাহদের কাছারি হতো সেটি দেওয়ান দেওয়ান-ই-আম-খাস। বসার তখ্ত আছে নানা বর্ণের প্রস্তরে খচিত। সিংহাসনের সামনে সোমনাথ মন্দিরের চন্দনের গেট। দেওয়ান-ই-আমের হাওয়াখানায় বাদশাহের কষ্টিপাথরের আরবি লিপি খোদিত তখতের সামনে উজিরের শ্বেত পাথরের তখত। এর দক্ষিণে শিশমহল যেখানে বেগমেরা থাকতেন। শ্বেতপাথরে তৈরি সুবর্ণ খচিত নানা বর্ণের প্রস্তরে চিত্র বিচিত্র। এখানে অতি সৌখিন স্নানাগার আছে। নানা জাতীয় পুষ্পের উদ্যান আছে আছে। আছে  সোনার ছাতা লাগানো  সম্বল বুরুজ (সামান বুর্জ?)। 


আগ্রার কেল্লা থেকে দেড় ক্রোশ দক্ষিণে যমুনার উপরে তাজবিবির রোজা যাতে শাজাহান বাদশাহের ও তাজবিবির কবর আছে। লেখক তাজমহলের কথা বলছেন। মহলটি পুরো মর্মর বা মার্বেল বা শ্বেতপাথরে তৈরি। তার উপর দামী দামী পাথরের ঝাড়, ফুল, ফল, পাতা যার যেমন রং সেই রংয়ের পাথর বসিয়ে খুব ভালো করে পালিশ করে তৈরি। সোনার কাজ অনেক আছে। ভবনটি চার তলা। নীচে দুটি কবর আছে, তার উপর তলায় ওই দুটি কবরের আকৃতি আছে। যে ব্যক্তি এই ভাস্কর্য শিল্প করেছেন তিনি সামান্য মানুষ নন, বিশ্বকর্মার ন্যায় তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি। পালিশ এমন সুন্দর যে সাপ উঠতে পারেনা, মশা মাছি বসলে পড়ে যায়। চার তলার ওপর হাওয়াখানা বুরুজ আছে, সেটি থেকে বহু দূরে দেখা যায়। এছাড়া অনেক ঝাঝরি, স্তম্ভ ইত্যাদি আছে। সামনে যে পুষ্পের উদ্যান আছে তার শোভা অপূর্ব। সেই সুগন্ধযুক্ত উদ্যানের চারপাশে পাথরের বাঁধানো পথ। তার দুই ধারে জলের খাল চারপাশকে সুশীতল রাখে। শ্বেতপাথরের বসার সুন্দর জায়গা আছে। বাগানে অসংখ্য রকমের ফুল ও ফলের গাছ আছে। এমন কি সবজির গাছ, পাহাড়ি ফুলের গাছ, মেওয়ার গাছও আছে। 


পরবর্তী দর্শনীয় স্থান বর্তমান উত্তরপ্রদেশের বটেশ্বর। এবার তাঁরা পদব্রজে না গিয়ে যমুনায় বজরা করে চললেন। নাগরিয়া, চীনবাস হয়ে এলো বটেশ্বর। এই পথে ডাকাতের উপদ্রব খুব বেশি। বটেশ্বর শিব, চতুর্ভুজ নারায়ণ, গৌরীশংকর মন্দির দর্শন ও পূজা করে, তাঁরা শহর দেখলেন। এটি ভাদরিয়া রাজার রাজ্য (চম্বল নদী উপত্যকার রাজত্ব করা রাজপুত রাজবংশ ভাদরিয়া)। যমুনার ধারে শহর। আগের রাজা ও ধনীরা, যমুনার ঘাট বাঁধিয়ে তার উপর শিব মন্দির স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু দেখে মনে হল পূজা তেমন হয় না এখন। চল্লিশ হাজার ঘর, সব জাতির বাস। ধনী ব্যক্তি অনেক আছে । এখানে ২০০ টি শিব মন্দির আছে। শহরে গোঁসাই, সন্ন্যাসী, মোহান্তদের আখড়া আছে। এখানে কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে মেলা হয়। অনেক দেশ থেকে মানুষ এখানে আসে। হাতি, ঘোড়া, উট, গরু, গাধা প্রভৃতি পশু হাজার হাজার বিক্রি হয়। এই মেলা দুই মাস ব্যাপী চলে। জয়পুর, কড়রি, বিকানীর, হাতরাস, ভরতপুর , গোয়ালিয়রের রাজারা এই মেলায় আসেন। 


পরদিন জলপথে ভাদোরিয়ার রাজার এলাকা পান্নায় (?) এলেন। এখানে রাজার বাড়ি, কেল্লা আছে। রাজবাড়ীতে লক্ষীনারায়ণ মূর্তি দর্শন করা হলো। সেদিন রাতে যমুনার ঘাটের কাছে থাকার সময় তাঁরা আশ্চর্য এক দৃশ্য দেখলেন। জলের মধ্যে কখনো মানুষের আকৃতি, কখনো গাছের মতো হয়ে, জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে উঠে, আবার জল মন্থন করে, জল কল্লোলের মতো শব্দ করে, জল দুই তিন হাত উপরে ওঠে, আবার ডিঙ্গির মতো ভেসে কিছুদূর চলে যায়। তারপর ধোপা যেমন কাপড় কাছে সেরকম শব্দ ও জলোচ্ছ্বাস হতে থাকলো। এরকম অনেক রাত পর্যন্ত চলল। সকালে পরীক্ষা করে কিন্তু যমুনার জলে কিছু দেখতে পাওয়া গেল না (মনে হয় শুশুক বা সেরকম কোনো জলচর প্রাণীরা ঝাঁক বেঁধে এসেছিল)। 


এরপর জলপথে ঘাটকো নামক স্থানে ভাদোরিয়া রাজার ভবনে বিহারিজি দর্শন করে ইটওয়া (এটয়া) তে পৌঁছলেন। এটয়া বড় শহর। অনেক বাঙালি বাবু থাকেন। ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টরের কাছারি, ডাকঘর, ছাউনি সব আছে। এরপর জলপথে আদোনি (আন্দায়া), ভরে (ভরেহ্) হয়ে যমুনা ও চম্বল নদীর সঙ্গমস্থলে পৌঁছলেন তাঁরা। এরপর জলপথে যেতে যেতে উল্লেখ্য স্থান এল অরুয়া, কালপী (কালপি)। কালপিতে শহর দেখা ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হল। এখানে কেল্লা, শিব ও নারায়ণের মন্দির, বাঙালি বাবুদের স্থাপিত কালীবাড়ি, সাহেবদের বাংলা ও গোরস্থান দেখা হল। জলপথে পরবর্তী স্থান যেখানে তাঁরা শহর দেখলেন, হল হামিরপুর (হামিরপুর)। এখানে কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট-এর কাছারি ডাকঘর, শিবমন্দির আছে। তারপর কোরনি (?), প্রদনগ্রাম (?) হয়ে প্রয়াগ যাত্রা। 


যমুনার এই জলপথে ডাকাতের খুব ভয় আছে। বজরার ছাদ থেকে এক ক্রোশ পর্যন্ত দেখা যায়। সেখানে চারজন সিপাহী বন্দুক, তলোয়ার নিয়ে পাহারা দেয়। বারো জন মাঝির যমদূতের মতো স্বাস্থ্য। একটি পাহাড়ি কুকুর আছে, তার সিংহের মতো তেজ। তবু একবার ডাকাতির চেষ্টা হয় লেখকদের বজরায়। লেখক ভাবেন যে কোম্পানি বাহাদুরের রাজ্যে এখনো এত সাহসী দস্যু আছে। 


যমুনার স্থানে স্থানে সারস, মানিকজোড়, শামুকখোল, বালিহাঁস, খড়হাঁস, চক্রবাক, বক, চিল, গাংচিল, পানকৌড়ি, সরাল ইত্যাদি নানা জাতীয় শত সহস্র পাখি জলে বিচরণ করে। মকর (অধুনা বিলুপ্তপ্রায় ডুগং বা মেলেটি কি ?), হরেল (ঘড়িয়াল,),  কুমির, কচ্ছপ প্রভৃতি জলজন্তুকে চড়ায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়। গঙ্গায় যত শুশুক, হাঙ্গর আছে যমুনাতে তত জল জন্তু নেই। 


চলার পথে একে একে তাঁরা পার হলেন চিল্লাতারা (চিল্লা ও তারা), লভেটা (?), ডাকাতির জন্য বিখ্যাত চরখা মারখা গ্রাম, কৃষ্ণগড় (?), রাজাপুর (রাজাপুর), প্রতাপপুর (?) এসব হয়ে বজরা এল এলাহাবাদের ঘাটে। শেষের দিকে যমুনার জলের তলায় অনেক ডুবো পাহাড় বা পাথর ছিল। খুব সাবধানে বজরা চালাতে হলো। 


দ্বিতীয়বার এলাহাবাদ এসে লেখক আরো বিস্তৃত ভাবে এলাহাবাদের বর্ণনা দিয়েছেন। শহরটি পাঁচ ক্রোশ বিস্তৃত। এখানে পাঁচটি প্রধান বাজার আছে - দারাগঞ্জ, কিটগঞ্জ (কিট সাহেবের বাজার), মুঠিগঞ্জ, কটরা বাজার, বড়বাজার চক। প্রয়াগী পান্ডার বসতি প্রায় ষোলোশ। তারা সবাই ধনবান। রাজারাজড়ারা এই স্থানে এসে এক লক্ষ মুদ্রা পর্যন্ত দান করেন। যুক্তবেনী অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা ও অন্তঃসলিলা সরস্বতীর সঙ্গমস্থল প্রয়াগ। দেবতা আছেন বেণীমাধব, ভরদ্বাজ ও সোমেশ্বর। আকবর বাদশাহের সময় প্রয়াগের নাম এলাহাবাদ হয়েছে (উল্লেখ্য যে ২০১৮ থেকে আবার এলাহাবাদের নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ)। বাদশাহ আকবর কাম্যকূপের উপরে যমুনার তীরে ত্রিবেণী সঙ্গমে কেল্লা স্থাপন করেছেন। অক্ষয়বট কেল্লার ভিতরে রয়েছে। এলাহাবাদ কেল্লার মতো সুগঠিত কেল্লা প্রায় দেখা যায় না। এর মধ্যে বাদশাহের শিশমহল, আয়নামহল, লালমহল, দেওয়ান খাস ও সমস্ত কাছারি ছিল। লেখকের দর্শনকালে কোম্পানি অন্যান্য দেশে রাজ্য জয় করে পরাজিত রাজাদের এখানে এনে বন্দী করে রাখতো। কোম্পানির ম্যাগাজিন, তোপখানা, শেলেখানা হয়েছে কেল্লায়। এই শহরে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর, মুন্সেফ, আবগারি প্রভৃতির কাছারি, সেনা ছাউনি, হাসপাতাল আছে। অনেক বাঙালি এখানে বাস করে। রাস্তাঘাট খুব ভালো। রাস্তার দুই পাশে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সাজানো সুন্দর সুন্দর দোকান ও পাকা বাড়ি। শহরে কম বেশি এক লক্ষ হিন্দু ও মুসলিমের বাস। 


প্রয়াগের কাম্যকূপে যে যা কামনা করে প্রাণ ত্যাগ করবে তার সেই মনোবাসনা সিদ্ধ হবে ও সেই ব্যক্তি জাতিস্মর হবে বলে প্রবাদ ছিল। এরপর লেখক এক অদ্ভুত গল্প বলেছেন। মুকুন্দ ব্রহ্মচারী নামক এক সাধক সোমেশ্বর শিবের তপস্যায় দেবাদেশ পান যে তাঁকে পুণর্জন্ম নিয়ে ঐশ্বর্য ভোগ করতে হবে এবং তাঁর শিষ্য বীরভদ্রেরও একই পরিণাম হবে। শিষ্য গুরুকে না ছেঁকে দুগ্ধ দিতেন পানের জন্য। যোগবলে তা জানতে পারেন গুরু। সেই কাজ যবন তুল্য ছিল। তাই তিনি বুঝতে পারেন পুণর্জন্মকালে তাঁকে যবন রূপে অর্থাৎ বিধর্মী হিসাবে জন্ম নিতে হবে। গুরুশিষ্য তখন কাম্যকূপে প্রাণত্যাগ করে নিজ নিজ কামনা অনুসারে আকবর ও বীরবল রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। তাঁদের পূর্বজন্মের স্মৃতি স্মরণ হলো। তখন আকবর ও বীরবল পূর্বের তপস্যাক্ষেত্র প্রয়াগে এলেন এবং  বিবেচনা করলেন এরূপ কূপ কলিযুগে রাখা উচিত নয় যেখানে প্রাণ ত্যাগ করলে যে কোন মানুষ যেকোনো রূপ ধারণ করে জন্ম নিতে পারবে। তাই সিসা গলিয়ে কূপ বন্ধ করিয়ে তার ওপর কেল্লা তৈরি করালেন। অক্ষয় বট কিন্তু রৌদ্র বাতাস বৃষ্টি না পেয়েও কেল্লার মধ্যে জীবিত থেকে গেল। সেই ব্রহ্মচারীর তপোবন কেল্লার অপর পারে আরইন গ্রামে সোমেশ্বর শিবমন্দিরের কাছে ছিল লেখক বলেছেন। এই গ্রামের দক্ষিণে ঝুশীগ্রাম, সেখানে গৌতম মুনির আশ্রম ছিল। 


প্রয়াগে মাঘ মাসে মাঘমেলা হয়। নানা দেশ থেকে মানুষ, রাজা, সাধুসন্ত, আখড়াধারী গোঁসাইরা আসেন। নানাদেশ থেকে মহাজন ও দোকানদারেরা এসে ক্রয়-বিক্রয়ের দোকান করে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পদাতিকদের নিয়ে নিজে সর্বদা তদারক করেন মেলার। যেসব জমিতে যাত্রীরা থাকার অস্থায়ী ঘর করে ও দোকানদারেরা অস্থায়ী দোকান তৈরি করে তার উপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চড়া হারে কর ধার্য করে।

                     (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১২৬৩ (২৭ মে ১৮৫৬) থেকে ১০ পৌষ ১২৬৩ (২৫ ডিসেম্বর ১৮৫৬)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...