(আগের পর্বের পরে)
এই পর্বটি লেখকের বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভ্রমণের কাহিনী। লেখক এলেন জাম্মো কান্দি অর্থাৎ জেমো কান্দিতে। জেমো হলো কান্দির কাছে অবস্থিত একটি গ্রাম। ওয়ারেন হেস্টিংস এর দেওয়ান গঙ্গা গোবিন্দ সিং-এর গ্রাম এটি। তিনি পাইকপাড়া রাজার পিতামহ। ১৭৫০ থেকে ১৭৯৫ বাংলার দেওয়ান পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি চাকরি সূত্রে প্রচুর অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন। কান্দিতে ও পাইকপাড়ায় প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। তিনি দ্বৈত শাসনের (ইংরাজ ও বাংলার নবাবের শাসনের) অবসানে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পতনেও তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসকে সাহায্য করেছিলেন। তিনি এত অর্থশালী ছিলেন যে তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধে কুড়ি লাখ টাকা ব্যয় করেছিলেন। নিমন্ত্রণপত্র সোনার পাতায় লেখা হয়েছিল। নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন প্রদেশের অর্ধেক রাজা, জমিদারেরা, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র শিবচন্দ্র সহ। একইভাবে নাতি লালা বাবুর অন্নপ্রাশনেও তিনি অঢেল ব্যয় করেন। সেই অনুষ্ঠানে সোনামুখীর গদাধর শিরোমনি প্রথম কথকথা করেন ও গঙ্গা গোবিন্দ তাঁকে এক লাখ টাকা দেন খুশি হয়ে। তিনি অনেক কৃষ্ণ মন্দির স্থাপন করেন।
কান্দির মন্দিরের দেবতা মুঘল বাদশাহের মতো যার জাঁকজমকে থাকেন। সেরা মখমলের কারুকার্যময় মসনদে আসীন, সোনা রুপোর অলংকার, তৈজসপত্রে সাজানো। প্রসাদ সারাদিনে যা হয় তা সম্পূর্ণ রাজকীয়। প্রতিদিন মন্দিরের ৫০০ টাকা খরচ হয়। পঞ্চাশ রকম ব্যঞ্জন, দশ রকম মিষ্টান্ন দিয়ে প্রসাদ হয়।
কান্দির রাসযাত্রা অতুলনীয়। আলো, বাজি, গান, বাজনা, নাচে জমজমাট। রাসমন্ডল হল সব দেবতার মন্দিরের ছোট সংস্করণ, সেখানে রামায়ণ মহাভারতের প্রধান চরিত্রদের প্রমাণ মাপের মূর্তি সাজানো হয়। যেমন রামের হরধনুভঙ্গ, অর্জুনের মাছের চোখ বিদ্ধ করা ইত্যাদি মূর্তি সেখানে প্রদর্শিত হয়। ২৫ হাজার মানুষ এই মেলায় আসে। এই মেলায় রাজা দশ হাজার টাকা খরচা করেন।
কান্দি থেকে ষোলো মাইল দূরে বহরমপুর। সমতল ভূমির এই পথে জনবসতি খুব কম। ডাকাতি, খুন খারাপির ভয় আছে। ইংরেজ আমলে বহরমপুরের উন্নতি হয়েছে। এখানকার সেনা ছাউনি, প্যারাড গ্রাউন্ড দর্শনীয়।
বহরমপুরে জর্জ টমাসের সমাধি আছে। জর্জ টমাস আয়ারল্যান্ডের এক বণিক, যিনি হরিয়ানাকে কেন্দ্র করে একটি ছোট রাজ্যের রাজা হয়েছিলেন ১৭৯৮ থেকে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। জলপথে কলকাতা যাওয়ার সময় বহরমপুরে তাঁর মৃত্যু হয় ১৮০২ সালে। বহরমপুরের বুলবুলবোনাতে তাঁর সমাধি আছে।
ব্রিটিশ শিশু সাহিত্যিক মেরি মার্থা শেরউডের (১৭৭৫ -১৮৫১) লেখা 'লিটল হেনরি এন্ড হিজ বিয়ারার' নামক বিখ্যাত শিশু সাহিত্যটির হেনরি নামক ব্রিটিশ শিশুটির সমাধি আছে বহরমপুরে। লেখিকা এক ব্রিটিশ সেনানায়কের সঙ্গে বিবাহ সূত্র ভারতে ১১ বছর ছিলেন। হেনরি তাঁর পুত্র যে মাত্র দুই বছর বয়সে মারা যায়।
তারপর ভোলানাথ চন্দ্র মহাশয় জেনারেল স্টুয়ার্ট (১৭৫৮-১৮২৮) -এর কথা লিখেছেন যিনি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বহরমপুরে থাকতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই সেনা অফিসার হিন্দু সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলেন। লেখক তাঁর সম্পর্কে বলেছেন যে তিনি মূর্তি পূজা ও গঙ্গা ভজনা করতেন দেশীয়দের মত। তাঁর কলকাতার চৌরঙ্গীর মিউজিয়াম সকলের জন্য অবারিত দ্বার ছিল। জীবনের শেষ দিকে তিনি শ'খানেক দরিদ্রকে রোজ খাওয়াতেন। জব চার্ণকের মতো তিনি হিন্দু মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন।
সিপাহী বিদ্রোহের বিপদের আঁচ প্রথম এই বহরমপুরেই অনুভব করা গেছিল। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ১৮৫৭ বহরমপুরের সিপাহীরা বিদ্রোহ শুরু করে। তখন গভর্নর জেনারেলের আদেশে এদের ব্যারাকপুরে পাঠানো হয়।
বহরমপুর থেকে নদীপথে তিন মাইল গেলে আসে কাশিমবাজার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এখানের ডাচ, ফরাসি ও ইংরাজ এই তিন দেশীয় কারখানা ছিল। ইংরাজের কারখানায় কুড়ি লক্ষ টাকার যন্ত্রাদি ছিল সেই সময়। ১৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্শাল নামের ওই কারখানার এক কর্মচারী প্রথম সংস্কৃত শিখেছিলেন ও ভাগবত গীতার ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদের পান্ডুলিপি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এখানকার প্রধান ছিলেন জব চার্নক ১৬৮১-তে। স্যার এফ রাসেল এখানকার প্রধান থাকাকালীন মিস্টার হলওয়েল (যাঁর নামে হলওয়েল মনুমেন্ট হয়েছিল যেটি এখন শহীদ মিনার নামে পরিচিত)। ১৭৪২-এ এখানে একটি অবিস্মরণীয় সতীদাহ দেখেছিলেন। ভদ্রমহিলা এক সম্ভ্রান্ত মারাঠার বিধবা। তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা ও লেডি রাসেল প্রমুখ তাঁকে সতী হতে বিরত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি প্রথমে তাঁর একটি আঙ্গুল আগুনে বহুক্ষণ রাখেন। তারপর অন্য হাতের পাতা আগুনে দেন, তাতে ধুপধুনোও মেশান। এরপর মুর্শিদাবাদের ফৌজদার হুসেন শাহের কাছ থেকে সতী হওয়ার অনুমতি আসে এবং তিনি চিতায় প্রবেশ করেন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস আগে (১৭৫৩) কাশিম বাজারে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি পার্শি ও আর আরবি শিখিয়েছিলেন।
মুর্শিদাবাদ যা আগে মুকসুদাবাদ নামে পরিচিত ছিল, সম্ভবত মুঘল বাদশাহ আকবরের প্রতিষ্ঠিত। মুর্শিদকুলি খান এই স্থান ১৭০৪ -এ অধিকার করার পর নাম দেন মুর্শিদাবাদ। ক্রমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এখানে প্রাসাদ, সরকারি দপ্তর তৈরি হওয়ায় সকলের দৃষ্টি এখানে পড়ে। মুর্শিদাবাদ ঢাকা বা রাজমহলের থেকেও বেশি প্রতিপত্তি সম্পন্ন স্থানে পরিণত হয়।
রবার্ট ক্লাইভ লিখেছেন মুর্শিদাবাদ সমৃদ্ধ জনবহুল ও ধনী স্থান লন্ডনের মতই কিন্তু পুরো লন্ডনের সমগ্র সম্পদের থেকেও মুর্শিদাবাদের এক একজনের কাছে বেশি ধন রয়েছে। মুর্শিদাবাদের জনবসতি এত বেশি ছিল যে ক্লাইভ লিখেছেন যে যখন তিনি ২০০ ইউরোপীয় ও ২০০ দেশীয় সেপাই নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন তখন ইচ্ছা করলে মুর্শিদাবাদবাসীরা শুধু লাঠি আর পাথর দিয়েই তাঁদের ধ্বংস করতে পারত। তখন মুর্শিদাবাদের ঢোকার মুখে কামান সাজানো তোরণদ্বার ছিল। ১৭৭০-এ এক ইংরেজ লেখকের লেখা থেকে জানা যায় যে মুর্শিদাবাদে অনেক ইঁটের বাড়ি, প্রচুর প্রাসাদ, উদ্যান আছে, গঙ্গায় অনেক নৌকা দেখা যায়। কিন্তু ১৮০৮-এ অন্য এক লেখকের লেখায় মুর্শিদাবাদ ভীষণ জনবহুল, নোংরা, কিছু প্রাসাদ আর মসজিদ ছাড়া সব ছোট বাড়ি, কুঁড়েঘর আর গঙ্গায় সারিবদ্ধ জাহাজ দেখা যায় বলে লিখেছেন। মুর্শিদাবাদের অবক্ষয়ের প্রথম কারণ নবাবীর পতন। দ্বিতীয় কারণ, গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার জন্য বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মুর্শিদাবাদের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হওয়া। তৃতীয়ত, ১৭৭০-এর মন্বন্তরে মুর্শিদাবাদের আরো সর্বনাশ হয়। চতুর্থ কারণ, ১৭৭২ মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী ও রাজস্ব বোর্ডকে কলকাতায় সরিয়ে আনা। পঞ্চম কারণ, পুণ্যাহ প্রথার বিলোপ। এই প্রথায় দেশের জমিদারেরা মুর্শিদাবাদে প্রতি বছর এপ্রিল মে- তে এসে দেয় খাজনার নিষ্পত্তি করতেন।১৭৭২ থেকে এই প্রথা বন্ধ হওয়াতে মুর্শিদাবাদ ও সেখানকার নবাবের গুরুত্ব কমলো।
প্রাচীন মুর্শিদাবাদের অল্প কিছু নিদর্শনই লেখকের ভ্রমণ কালে দেখতে পাওয়া যেত। সুন্দর মতিঝিল শুকিয়ে গেছে। গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে আনা কালো মার্বেল পাথরে তৈরি সিরাজ-উদ-দৌলার প্রাসাদের সামান্য কিছু চিহ্ন আছে মাত্র। এখানে রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফরকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব পদে আসীন করেছিলেন। উপচে পড়া সোনারুপোর ধনভান্ডার আর হীরা চুনী বসানো রাজমুকুট যা ক্লাইভ প্রথমে এখানে এসে দেখেছিলেন এবং ১০০ নৌকো করে ৭০০ সিন্দুকে ভরে তার একাংশ প্রথম কিস্তি স্বরূপ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গতে নিয়ে যান। কাটরা মসজিদ (মীরজাফর স্থাপিত) ও তার সংলগ্ন ছাত্রদের পড়াশোনার স্থান এখন ধ্বংসস্তূপ। তোপখানা, নবাবের অস্ত্রাগার এর কাছেই ছিল। অতীতে ভাগীরথীর পশ্চিম পারে মুর্শিদাবাদ শহরের একটি অংশ ছিল। সেখানে নবাবী কবরস্থান ছিল। আলীবর্দী খান, সিরাজদৌল্লা প্রভৃতির কবর সেখানেই ছিল। লেখক এখানে সিরাজদৌলার অত্যন্ত অত্যাচারী ও উৎশৃংখল মানসিকতার কিছু কিছু পরিচয় দিয়েছেন। (তৎকালীন অন্যান্য লেখক, এমনকি পুরনো দেশীয় লেখকদের লেখায় এর প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। সিরাজউদ্দৌলাকে নায়ক কল্পনা করা মনে হয় বিংশ শতাব্দীতে প্রথম শুরু হয়েছিল)। ভাগীরথীর ডানপাড়ে মীরজাফরের বিশাল প্রাসাদ ছিল দুর্গের আকারে ও কামানে সজ্জিত। এই শেঠেরা, যাদের এক সময় ক্ষমতা ছিল শুধু মুদ্রা ফেলে ভাগীরথীর স্রোতকে বন্ধ করে দেওয়ার তাদের বংশধরেরা এখন দরিদ্র। পুরনো ভগ্ন প্রায় বাড়ি আগলে আর অবশিষ্ট ধনরত্ন বেঁচে কোন রকমে জীবন ধারণ করছে।
মুর্শিদাবাদের এখন দেখার জিনিস একটি - হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। সেই নতুন প্রাসাদ কর্নেল ম্যাকলোয়েড এর পরিকল্পনায় তৈরি হয়েছে ১৮৩৭-এ। ৪২৫ ফুট লম্বা, ২০০ ফুট চওড়া ও ৩৮০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই প্রাসাদ বানাতে খরচ হয়েছে কুড়ি লক্ষ টাকা। মার্বেলের মেঝে যুক্ত এই প্রাসাদের সিঁড়ি, ২৯০ ফুট লম্বা হল, আয়না বসানো দরজা, বিভিন্ন রূপে সাজানো ঘরগুলি, নবাবের হাতির দাঁতের কাজ করা সিংহাসন, নবাবদের পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি আঁকা ছবি - সবই দেখার মত। এই প্রাসাদের একটি বারান্দা থেকে লেখক জেনানা অর্থাৎ অন্তঃপুরের এক ঝলক দেখতে পান। জেনানা এলাকায় কোন পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তিনি শোনেন ৩০ জন বেগম বা উপপত্নী সেখানে আছে নবাবের, ৫০ জন আবিসিনিয় খোজার প্রহরায়। আগে নবাবদের হারেমের আকার বড় ছিল। এক নবাবের হারেমে দেড় হাজার মহিলা ছিল। আলীবর্দী খানের অবশ্য একটি মাত্র স্ত্রী ছিল। সিরাজউদ্দৌলার জেনানায় মহিলার সংখ্যা গোনা মুশকিল। মীরজাফর সিরাজের হারেমের অধিকাংশ মেয়েদের ক্লাইভকে দান করেছিলেন।
এরপর দেখা হল ইমামবাড়া। এটি হুগলির ইমামবাড়ার থেকে বড়। আয়না, লন্ঠন, ঝাড়লণ্ঠন দিয়ে সাজানো এই ইমামবাড়ার শোভা অতুলনীয়। নদীতে নবাবের ময়ূরপঙ্খী, বিলাসবহুল নৌকা দেখা যায়। তবে আগে গঙ্গায় যেতে যেতে মুর্শিদাবাদের যে আলোকোজ্জ্বল রূপকথার দেশের মতো ঝলমলে রূপ দেখা যেত তা এখন আর নেই।
এখানকার বেরা উৎসব সম্ভবতঃ সিরাজদৌল্লা চালু করেছিলেন। জলযাত্রা শুভ করতে আর বন্যার রোধে পীর পয়গম্বরের দোয়া চাওয়ার জন্য এই উৎসব করা হয়। ফুল, নারকেল, আলোতে ভরা ছোট ছোট ভেলা ভেসে চলে নদীতে। হাজার মানুষের আশা আর আনন্দ নিয়ে এই উৎসবে যোগ দেয়। ভাদ্র মাসে আজও বেরার মেলা বসে মুর্শিদাবাদে।
নবাবী আস্তাবল, হাতিশালা, অস্ত্রাগার সবই এখনও (লেখকের সময়ে) আছে আগের মত। নবাব নাজিম প্রতিদিন নতুন রাজপোষাক পরেন যা পরদিন ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু নবাবীয়ানা থাকলেও নবাবের ক্ষমতা এই প্রাসাদ বা চারপাশের আধ মাইল গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। এই নামমাত্র নবাবী নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে লুপ্ত হবে বলে লেখক আশা করেছেন। নবাব নাজিম প্রথা ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে লুপ্ত হয় মুর্শিদাবাদে।
বর্তমান ভগবানগোলা থেকে ১২ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল পুরনো ভগবানগোলা, যা আলীবর্দী খানের সময় মুর্শিদাবাদের অন্যতম বন্দর ছিল। নদী গতিপরিবর্তন করেছে, পুরনো ভগবানগোলা জঙ্গলাকীর্ণ হয়েছে। নতুন ভগবানগোলা সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রাম। ফসল ক্ষেত, সবুজ মাঠ, আমবাগান, খেজুর-কলা-তালগাছ দিয়ে সাজানো আনন্দময় গ্রাম জীবনের ছবি।
মুর্শিদাবাদ থেকে চল্লিশ মাইল উত্তরে জঙ্গিপুর যা জাহাঙ্গীরের নামে নামাঙ্কিত। এটি পূর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশমের বৃহত্তম কেন্দ্র ছিল। ১৮৩৩-এর চার্টারের ফলে বাংলায় অন্যান্য রেশম ও সুতির সমস্ত বন্দরের মতোই জঙ্গিপুরেরও বাণিজ্য ধ্বংস হয়।
জঙ্গিপুর থেকে ২১ মাইল গেলে সুতি। এখানে ভাগীরথী গঙ্গা থেকে ভাগ হয়ে শাখা তৈরি করেছে। এখানে ১৭৪০- এ বাঙলার নবাব সরফরাজ খানের সঙ্গে বাঙলার নবাবের অধীন পাটনা বা আজিমাবাদের নাজিম আলিবর্দী খানের মধ্যে গিরিয়ার যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে আলিবর্দী খান জয়লাভ করে বাংলার নবাব হন। ১৭৬৩-তে মীর কাসেম ও ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ এখানেই হয়েছিল। এখানে গঙ্গায় চর পড়ার কারণে নৌযাত্রা খুব কম করা যায়। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী পর্যটক তেভার্নিয়ার চরের কারণে নৌযাত্রা ছেড়ে রাজমহল থেকে হুগলি পর্যন্ত স্থলপথে গিয়েছিলেন বলে তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন। তারপর থেকে নৌকা ভাগীরথী ছাড়িয়ে মূল গঙ্গার স্রোতে পড়ে। রাজমহল থেকে নদীয়া এই ১০০ মাইলে, যেখানে পদ্মা নদীর গঠনের আগে ভাগীরথীর গতিপথ ছিল, তা এখন এক জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে।
(চলছে)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
(আগের পর্বের পরে)
জলঙ্গি নদীপথে এর পরের গন্তব্য কৃষ্ণনগর। জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নামে কৃষ্ণনগরের নামকরণ করা হয়েছে। তিনি গত শতাব্দীর (অষ্টাদশ শতাব্দীর) শেষ জমিদার, যিনি অর্থ ব্যয় করে কিছু মূল্যবান কীর্তি রেখে গেছেন। তিনি শিক্ষিত ছিলেন এবং শিক্ষা ও গুণের কদর করতেন। তাঁর সভায় ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর ( বিদ্যাসুন্দর কাব্যের রচয়িতা) সভাকবি ছিলেন। লেখক দেখেন কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদ তখন ভগ্নপ্রায় অবস্থায় আছে। রাজবাড়ির নিকটে অবস্থিত কালীবাড়িতে ভারতচন্দ্রের থাকার ঘরও দেখেন লেখক।
লেখকের পরবর্তী ভ্রমণ শুরু হয় ১৮৪৬ এর ২৩ শে আগস্ট। নদীয়ার অগ্রদ্বীপ হয়ে লেখক এলেন কাটোয়ায়। অষ্টাদশ শতকের ভূগোলবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র (বাংলার সর্ব প্রথম ম্যাপ) অনুসারে অগ্রদ্বীপ গঙ্গার বাম পাড়ে ছিল কিন্তু এখন সেটা আছে ডান দিকে। অগ্রদ্বীপে এপ্রিল মাসে বার্ষিক মেলা হয়। সেখানে গোপীনাথ মূর্তি দর্শনে এবং ঘোষ ঠাকুরের শ্রাদ্ধ (ঠাকুর গোপীনাথ নিজে গোবিন্দ ঘোষের শ্রাদ্ধ করেন বলে প্রচলিত আছে) দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। বৃন্দাবনের যেমন আগ্রা বা অগ্রবন, নদীয়ার সেরকম অগ্রদ্বীপ বলে লেখক মন্তব্য করেছেন।
কাটোয়া হল সুপ্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিক আরিয়ানের লেখায় পাওয়া 'কাটাডুপা' নামক স্থান। আগে নিশ্চয়ই নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপে সত্যিই দ্বীপ ছিল। কাটোয়া আগে মুর্শিদাবাদের সামরিক ঘাঁটি ছিল। নবাব মুর্শিদকুলি খান এখানে পথিকদের সুবিধার জন্য প্রহরার ব্যবস্থা করেছিলেন। চোর ধরা পড়লে তার শরীর দুইভাগ করে রাস্তায় গাছে ঝুলিয়ে রাখা হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে কাটোয়ায় মারাঠা আক্রমণ শুরু হয়। মানুষ শহর, গ্রাম ছেড়ে পালায়। ফলে এই এলাকা জঙ্গলে পরিণত হয় ক্রমে। এখান দিয়ে পথিকের যাতায়াত খুব কষ্টকর ছিল বাঘ ও বুনো শুয়োরের উপদ্রবের কারণে। বৈষ্ণবদের কাছে কাটোয়ার গুরুত্ব অনেক, কারণ চৈতন্যদেবের গৃহত্যাগ করে কাটোয়ায় এসে কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের আগে রবার্ট ক্লাইভ ১৭৫৬ -তে পলাশী যাওয়ার আগে এখানে থেমেছিলেন। কাটোয়াতে নাকি তিনি নির্জন আম বাগানে ধ্যান করেছিলেন। কাটোয়ার বাণিজ্য কেন্দ্র হল অজয় আর ভাগীরথীর সঙ্গমস্থল। সেখানে সব দোকান, গুদাম আছে। এখানে সুতি আর সিল্কের কাপড় ভালো পাওয়া যায়। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ বৈষ্ণব। আলীবর্দী খাঁর দুর্গ (যেখান থেকে তিনি মারাঠাদের পরাজিত করেছিলেন) এখানে ছিল। সেই মাটির তৈরি দুর্গটির আধ মাইল পরিসীমা, ১৪ টি কামান দেওয়ালে গাঁথা। পলাশীর যুদ্ধের সময় ইংরেজ এই দুর্গ বিনষ্ট করে।
পলাশী কাটোয়া থেকে ১৬ মাইল দূরে অবস্থিত। যুদ্ধক্ষেত্রটি আর নেই, গঙ্গার তলায় চলে গেছে।
লেখক অজয় নদীতে নৌভ্রমণে গেলেন। এই নদী পাহাড়ি, এতে হড়পা বান আসে পাহাড়ে বৃষ্টি হলে। তখন প্রচন্ড স্রোত ভীষণ শব্দে আশেপাশের মানুষ গবাদি পশু সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অজয় শব্দের অর্থ যাকে হারানো যায় না। পূর্বে অনেক হিন্দু মা তার সন্তানকে অজয়ের জলে স্নান করিয়ে অজেয় তৈরি করতে চাইতেন। হয়তো এই কারণে জেলার নাম বীরভূম। আগে একে মল্লভূমি-ও বলা হতো অর্থাৎ মল্লদের ভূমি। গ্রীক পর্যটক যিনি ২৮৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ভারতে এসেছিলেন সেই মেগাস্থিনিসের ভাষায় অজয় নদী হলো 'অ্যামিষ্টিস'। অজয় নদীর দুই ধারের সৌন্দর্য অপরিসীম। ঢেউ খেলানো জমি, সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রাম, আমগাছের বাগান, পুকুর নিয়ে নয়নাভিরাম দৃশ্য।
এবার এলো বিশ্রামটুলা। এক প্রাচীন বটগাছের ছায়ায় রয়েছে পবিত্র স্থান। চৈতন্যদেব নাকি এখানে একবার বিশ্রাম নিয়েছিলেন।
এরপর সুপুরের কাছে অজয় নদীর উপর রেলের ব্রিজ তৈরি হয়েছে। (এটি লেখক নিঃসন্দেহে বই প্রকাশের আগে যুক্ত করেছেন কারণ বাংলার রেল প্রথম এসেছিল ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে। সম্ভবত ১৮৫০-এ এই ব্রিজ তৈরি হয়েছিল)। বহু পূর্বে সুপুর বিখ্যাত শহর ছিল। প্রাচীন প্রবাদে পাওয়া রাজা সুরথ নাকি এই নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর প্রাসাদের চিহ্ন লেখককে দেখানো হলো। সুপুর রাজার কালী মন্দির দেখলেন, যেখানে নাকি রাজা সুরথ হাজার হাজার ছাগবলি দিয়েছিলেন। সুপুরে অনেক ইঁটের তৈরি পাকা বাড়ি আছে। এখানকার প্রধান বাণিজ্য চাল, চিনি, সিল্কের। অনেক সাঁওতাল কাজের জন্য এখানে এসে আছে। এখানে লেখক একজন ভবঘুরেকে দেখলেন যিনি হিংলাজ (বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত), সেতুবন্ধ (রামেশ্বরম), চন্দ্রনাথ (বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত) এবং আরো অনেক তীর্থ দর্শন করে এসেছেন।
এরপর সুরুল হয়ে লেখক চললেন কেন্দুলির উদ্দেশ্যে। পথে পড়ল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিত্যক্ত রেশমকুঠী। কেন্দুলির কবি জয়দেবের জন্মস্থান। সাধক রামানন্দের শিষ্য জয়দেব শুধু কবি ছিলেন না, ছিলেন সমাজ সংস্কারকও। বাংলার একটি ক্ষুদ্র গ্রাম থেকে গীতগোবিন্দের মহিমা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
কেন্দুলি থেকে তাঁরা এলেন দুবরাজপুর। পথে একটি ক্ষুদ্র ন্যাড়া পাহাড় (মামা ভাগ্নে পাহাড় কি?) দেখলেন। পাহাড়ের ছায়ায় দুবরাজপুর শহর রয়েছে। মূলত সাঁওতালরা এখানে বাস করে। প্রধান বাণিজ্য দ্রব্য চিনি, গুড়। দুবরাজপুরের বেশিরভাগ জায়গায় চাষবাস হয় না, শাল জঙ্গলে পরিপূর্ণ।
এরপর ঘন শালবন, ধানক্ষেত পেরিয়ে সুন্দর সবুজ গ্রাম বক্রেশ্বর দেখা গেল। অনেক মন্দির ও কুন্ডে শোভিত বক্রেশ্বরে প্রতিবছর শিবরাত্রিতে একটি মেলা হয়। পান্ডাদের অত্যাচারের কথা বলেছেন লেখক এখানে। কুণ্ডের সংখ্যা আট, বেলে পাথরের পাড় ঘেরা এই কুন্ড বা কুঁয়াগুলোর বিভিন্ন দেবতার নামে নাম আছে। কুন্ডগুলোর তাপমাত্রা একরকম নয়। কুন্ডে সালফার আছে, গন্ধের বোঝা যায়। সূর্যকুন্ডের জল সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত, এতে হাত দেওয়া যায় না, ডিম দিলে সেদ্ধ হয়ে যায় কিন্তু ভাত সেদ্ধ হয় না। কুন্ডগুলি থেকে নালা মারফত জল ছোট নদী বা ঝোরায় যাচ্ছে, তার নাম শ্বেতগঙ্গা, এই নদীর জল কিছু অংশে গরম কিছু অংশে ঠান্ডা আর জলের রং সাদা। এবার তাঁরা বক্রেশ্বর শিবমন্দির দেখলেন। মন্দিরের ভেতর অন্ধকার, দীপের অল্প আলোয় দেখতে হয়।
প্রথমে গভীর শাল গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেক দূর গিয়ে তারপর পাকা রাস্তা দিয়ে দশ মাইল গিয়ে আসে সিউড়ি। সিউড়ি আধুনিক শহর অনেক ইঁটের বাড়ি আছে। পাহাড়ে ঘেরা সিউড়ি স্বাস্থ্যকর স্থান।
সিউড়ি থেকে এলেন পুরন্দরপুর, যা তার পুরনো গৌরব হারিয়ে এখন একটা সামান্য গ্রাম। (পুরন্দরপুর অতীতে কেন বিখ্যাত ছিল লেখকের ব্যাপারে কোন আলোকপাত করেননি। কোন সূত্র থেকেও জানা যায়নি এই জায়গার ইতিহাস। তবে কি পুরন্দরপুর নাম থেকে তিনি আন্দাজ করেন যে এই স্থানে পূর্বে গড় বা শহর ছিল?)। এখানে তিনি একটি বৃদ্ধাকে দেখেন, যার বয়স জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে তার বয়স প্রায় ১০ বছর ছিল যখন এক টাকায় ৩০ সের চাল পাওয়া যেত। সেটি বাংলার মহাদুর্ভিক্ষের বছরকে বোঝাচ্ছে (১৭৭০), যখন জন শোরের (ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এক গভর্নর জেনারেল) চিঠি থেকে জানা যায় যে 'মাথাপিছু পাঁচ টাকা করে তখন ছোট বাচ্চাদের বিক্রি করা হয়েছিল। মা-বাবা তাদের বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যথায় অনাথ হয়ে তারা শেয়ালের পেটে যেত।' গঙ্গা উপত্যকা দুঃখ আর মৃত্যুতে ছেয়ে গেছিল। হুগলি নদীতে প্রতিদিন হাজার হাজার মৃতদেহ ভেসে যেত। লেখকের ভ্রমণ কাল ১৯৪৬ এ বৃদ্ধার বয়স ছিল ৮৬ বছর।
এরপর লেখক ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বীরভূম ভ্রমণের কথা লিখেছেন। ১২ বছর পরে লেখক আবার বীরভূমে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রথমে তিনি সাঁইথিয়ার কথা লিখেছেন। সাঁইথিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশ সাধু মাঝি, সিংগ্রা, পাচু, সুকুল এইসব সাঁওতাল বীরদের জন্য তখন সদ্য বিখ্যাত হয়েছে (১৮৫৫-১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ, যার নেতৃত্বে ছিলেন সিধু ও কানু)। ময়ূরাক্ষীর নদীর জলে পুষ্ট সাঁইথিয়া খুব মনোরম স্থান। পূর্ব বীরভূম পশ্চিম বীরভূমের থেকে ভূপ্রকৃতিগত দিক থেকে স্বতন্ত্র। পূর্ব বীরভূম মালভূমির উঁচু নিচু ভূমিরূপ ত্যাগ করে প্রায় সমতল হয়েছে এখানে।মাইলের পর মাইল ধানক্ষেতের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলার মত আনন্দ আর নেই। ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে এই সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাওয়া যেত না। মারাঠাদের লুটতরাজ তারপর নবাবী উচ্ছেদ, মহামারী, মড়কে দক্ষিণবঙ্গের এক তৃতীয়াংশ জমিতে চাষ হতো না। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়া থেকে এই দৃশ্য সম্ভব হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলায় এত নিরবচ্ছিন্ন শান্তি কোনদিন আসেনি। পলাশীর যুদ্ধের দিন থেকে কোনো শত্রু বাংলায় আজ পর্যন্ত পা রাখতে পারেনি, কোন চাষী তার ফসল হারায়নি, কোন মানুষের এক বিন্দু রক্তপাত হয়নি। বৈদেশিক শত্রুর হাত থেকে সুরক্ষিত হয়ে জনসংখ্যা বেড়েছে, চাষ বেড়েছে, জমির মূল্য ৪০ থেকে ৯০ গুন বেড়েছে দক্ষিণবঙ্গে সমস্ত স্থানে। বীরভূমের প্রধান ফসল ধান তারপর হল রেশম চাষ। এখানকার কাল মাটিতে তুঁত ভালো হয়। এটা জানা যায় না যে রেশম চাষ এই দেশের নিজস্ব চাষ নাকি চীন দেশ থেকে আসা চায়ের মতো রেশম চাষও বাইরে থেকে আনা হয়েছে। বাংলায় রেশম চাষ হয় কিন্তু বেনারসে রেশম বস্ত্র তৈরি হয় সর্বোত্তম। মোগল বেগম নুরজাহান রেশম বস্ত্রকে মুঘল বাদশাহদের মধ্যে প্রচলন করেছিলেন। এই নুরজাহান প্রথমে বাংলার বর্ধমানে থাকতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইতালিয়ান পদ্ধতিতে রেশম বয়াlন চালু করেছিল এবং দেশীয়রা নিজস্ব পদ্ধতি ছেড়ে দিয়েছিল। ইতালি থেকে ইংল্যান্ডের রেশম রপ্তানি এক চুক্তির ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুরু করে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে রেশমের রপ্তানি।
(ইংরেজের গুণগ্রাহী ভোলানাথ চন্দ্র মহাশয়ের আন্দাজ ছিল না যে কিছুকাল পর থেকেই ভারতের অর্থনৈতিক অবনতির সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে ইংরেজ শাসনকালকে চিহ্নিত করা হবে। সবথেকে বড় বৈদেশিক আক্রমণকারী শত্রু হয়ে উঠবে ইংরাজ। দেশীয় শিল্প বিনষ্ট করার জন্য আর জোর করে নীল, রেশম চাষ করার জন্য ভারতবাসী ইংরাজকে ক্ষমা করবে না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল আর বেশিদিন ভারতবাসীর অজানা থাকবে না)।
(চলছে)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
(আগের পর্বের পরে)
হুগলির পূর্বে বাংলার রাজকীয় বন্দর ছিল সাতগাঁ বা সপ্তগ্রাম। গঙ্গা আগে এখান থেকে প্রবাহিত হয়ে আন্দুলের দিকে যেত। কালক্রমে জমে যাওয়া মাটি সরালে এখনো এই অবরুদ্ধ প্রবাহ বরাবর কিছু ধ্বংস হওয়া নৌযান খুঁজে পাওয়া যাবে। সাতগাঁর প্রাচীন ঐতিহ্য এতোটাই ছিল যে রোমানরা তার নাম দিয়েছিল Ganges Regia (গঙ্গা রিদি?)। এটি এক বিশাল রাজকীয় শহর ছিল ও রাজাদের রাজধানী ছিল। প্রথম যে ইউরোপীয়রা বাংলায় এসেছিল তারা দুটি বন্দরের কথা বলেছে - একটি চট্টগ্রাম আর একটি সাতগাঁ। গত শতাব্দীতে (অষ্টাদশ শতাব্দীতে) এখানে অনেকগুলি গ্রামীণ উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। গঙ্গার স্রোত পরিবর্তন এই বাণিজ্য উপনিবেশের পতনের কারণ। হুগলি বন্দরকে প্রধান বন্দর হিসেবে ব্যবহারের প্রচেষ্টাও ক্রমে বিফল হয়। এরপর সেটি পূর্ব গৌরব হারিয়ে একটি সামান্য স্থানে পরিণত হয়। আক্ষরিক অর্থে সপ্তগ্রাম সাতটি গ্রাম নিয়ে তৈরি ছিল। পূর্বে কলকাতার মল্লিক পরিবার সেখানে থাকতেন। পরে তাঁরা হুগলি ও তারও পরে কলকাতায় যান।
এরপর আসে ত্রিবেণী। তিন নদীর সংযোগস্থল এলাহাবাদের প্রয়াগের মতোই পবিত্র স্থান এই ত্রিবেণী। এখানে প্রতিবছর মার্চ মাসে স্নানের মেলা হয়। পূর্বে কলকাতার বাবুরা ত্রিবেণী পেরিয়ে মফস্বলে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারত না। ত্রিবেণী এতটাই পুরনো জায়গা যে প্লিনি, টলেমি (রোমান ভূগোলবিদ) এর কথা লিখেছেন। এই স্থান সংস্কৃতের একটি পীঠস্থান। এখানে মহাপন্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বাড়ি, যিনি স্যার উইলিয়াম জোন্সের সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন এবং লর্ড কর্নওয়ালিসের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু আইন সংকলন করেছিলেন। তাঁর অভূতপূর্ব স্মৃতিশক্তি ছিল। এই সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে যে একবার স্নান সেরে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর একজন কাফের ও একজন চীনা ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। তারা ঝগড়া মারামারি করছিল। পুলিশের কাছে এই মামলা যাওয়াতে পুলিশ তাঁকে সাক্ষ্য দিতে ডাকে। তিনি বলেন যে তিনি ওই কাফের ও চীনা কারো ভাষা জানেন না কিন্তু তারা কী কী শব্দ উচ্চারণ করেছিল তা সম্পূর্ণ বলতে পারবেন। তাঁর স্মৃতিশক্তিতে সবাই হতচকিত হয়ে জান। ত্রিবেণীর পরে শুরু হয় সাধারণ গ্রাম বাংলা। ইঁটের বাড়ি এখানে খুব কম দেখা যায়। ঘাট আর মন্দির অনেক দূরে দূরে দেখা যায়। নদী এখানে আরো চওড়া, কিন্তু স্রোত কম কারণ মাঝে মাঝে চরের বাঁধা আছে।
ত্রিবেণীর চার মাইল উত্তরে ডুমুরদা বা ডুমুরদহ খুব সামান্য গ্রাম কিন্তু ডাকাত আর জলদস্যুর জন্য কুখ্যাত। এখনো সূর্যাস্তের পরে এই জায়গা কোনো নৌকা পেরোয় না। দিনের বেলায়ও এখানকার ঘাটে কোনো নৌকা নোঙর করতে সাহস পায় না। ব্যবসায়ীরা নিজের সঞ্চয় নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় এই স্থান পেরোতে ডাকাতি ও খুনের আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে থাকে। একবার কিছু লোক পূজার ডাকাতেরা হয় নৌকা ফুটো করে দেয়, নয় নৌকা থেকে জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ডাকাতের সরকার বিশ্বনাথবাবু (বিশে ডাকাত) এখানে থাকতো ৬০ বছর আগে অর্থাৎ আনুমানিক ১৭৮৫ নাগাদ। অন্য এক প্রথা ছিল পথিককে আশ্রয় দেওয়া, খাতির যত্ন করা এবং মাঝরাতে তাকে মেরে সর্বস্ব লুটে নেওয়া। বিশে ডাকাতের আক্রমণের গন্ডি বর্তমান যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পুলিশের চোখে ধুলো দিতে সে ওস্তাদ ছিল। একবার তার দলের একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে জঙ্গলে তাকে ফাঁসি দিয়ে মারে। গঙ্গার ধারে তার দোতলা তৈরি বাড়ি এখনো (লেখকের ভ্রমনের সময়) আছে। এখানকার অধিবাসীরা অধিকাংশ মাঝি আর জেলে। এদের অনেকে আবার রাতে ডাকাত।
এরপর এলো সুকসাগর। তখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সুকসাগরে অনেক অভিজাত পরিবার বাস করত। লর্ড কর্নওয়ালিস অনেক সময় এখানে গ্রীষ্মকাল কাটাতে আসতেন। এখন যেমন ভাইসরয়রা সিমলা যান ব্যারাকপুরের গ্রীষ্মাবাস তৈরী হওয়ার আগে এখানে ছিল তাঁদের গ্রীষ্মের ঠিকানা। এখানে রেভিনিউ বোর্ডও স্থাপিত হয়েছিল তা মুর্শিদাবাদ চলে যাওয়ার আগে। গঙ্গা গতিপথ পরিবর্তন করায় এর অনেক অংশ গঙ্গাবক্ষে বিলীন হয়েছে। পরে সেইসব বাড়ির চিহ্ন নেই। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে প্লাবনে ওই এলাকা প্রচন্ডরকম প্লাবিত হয়েছিল।
চাকদা, চাকদহ বা চক্রদহ পরবর্তী স্থান। কথিত আছে যে ভগীরথের রথের চাকার আঘাতে মাটিতে একটি সুগভীর খাতের সৃষ্টি হয়ে এই স্থান তৈরি হয়েছে। চাকদা একটা বাণিজ্য কেন্দ্র এখানে আশেপাশের জেলাগুলি থেকে কৃষিজ দ্রব্য আসে বিক্রির জন্য। অন্য সব বড় ভারতীয় বাজারের মতো এখানে অনেক গুদাম আর পতিতালয় আছে। ঘাটে অনেক নৌকা নোঙর করা থাকে।
অপর পারে বলাগড়, বৈষ্ণব গোঁসাই আর কুলীন-বৈদ্যদের স্বর্গ। তারপর গুপ্তিপাড়া। এখানকার ব্রাহ্মণরা তাঁদের বিদ্যাচর্চার জন্য বিখ্যাত। এখানকার বাঁদরের সংখ্যা প্রচুর এবং তাদের বাঁদরামি সীমা নেই। শোনা যায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় নাকি গুপ্তিপাড়া থেকে বাঁদর আনিয়ে কৃষ্ণনগরে তাদের বিয়ে দিয়েছিলেন বিশাল ধুমধাম করে। সেই বিয়ের খরচ হয়েছিল অর্ধ লক্ষ টাকা। কথায় আছে কাউকে নাকি সে গুপ্তিপাড়া থেকে এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করা অর্থ হলো তাকে বাঁদর বলা।
গত শতাব্দীতে (অষ্টদশ শতাব্দীতে) গঙ্গা শান্তিপুরের একেবারে পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল। কিন্তু এখন শান্তিপুর শহরের পাশে বিস্তীর্ণ বালির পাড়। শান্তিপুর সম্ভবত বহু প্রাচীনকাল থেকে রয়েছে কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ভাগিরথীতে সবথেকে পুরনো নৌযাত্রার কথা জানা যায় সম্রাট অশোকের সময়। তাঁর পুত্র মহেন্দ্র বৌদ্ধধর্ম প্রচারে শ্রীলঙ্কা গেছিলেন। এই নৌযাত্রা বিষয়ে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। চৈনিক পর্যটক ফা হিয়েন এই পথে সমুদ্রযাত্রা করে নিজের দেশে ফেরেন। পঞ্চম শতাব্দীতে চাঁদ সদাগর (মনসামঙ্গল) ও শ্রীমন্ত-দের (চন্ডীমঙ্গলে) যাত্রা যেহেতু কাহিনী থেকে পাওয়া তার মধ্যে ইতিহাস ও কল্প কাহিনীকে আলাদা করা অসম্ভব। চৈতন্য জীবনীতে শান্তিপুরের উল্লেখ পাওয়া যায়। অদ্বৈতের জন্ম ও সাধনভূমি ছিল এই শান্তিপুর। একসময় শান্তিপুর বড় জনবহুল স্থান ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল শান্তিপুর। লর্ড ওয়েলেসলি এখানে দুদিন থেকেছিলেন। যে বাড়িতে তিনি থেকে ছিলেন সেটি এক লক্ষ টাকায় তৈরি করা হয়েছিল। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে এখানে অত্যন্ত অন্তত কুড়ি হাজার ইঁটের বাড়ি ছিল বলে জানা যায় কিন্তু এখন সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেছে। তবে মিহি সুতোর কাপড়ের জন্য ঢাকার পরেই এর খ্যাতি। অন্তত দশ হাজার তাঁতি পরিবার আছে এখানে। অদ্বৈতের বংশধরেরা এখানে গোঁসাই। এখানকার প্রধান দেবতা শ্যামচাঁদ। এখানে এখনো অনেক টোল আছে। কোন ব্রাহ্মন অবশ্য এখন একশো স্ত্রী রাখে না, বিধবাকে সতী হতে হয় না বরং বিধবাবিবাহ হতে পারে। বারোয়ারি পূজা যা খুব ধুমধাম করে হতো তা এখন হয় না। কোন একবার বারোয়ারী কালীপুজোয় মদ খেয়ে ব্রাহ্মণরা নেশার ঘোরে এক ব্রাহ্মণকে ছাগলের বদলে বলি দিয়ে দিয়েছিলেন বলে লিখেছেন লেখক। শান্তিপুরের নারীরা পাতলা গড়নের, অভিজাত, কোমল দেশীয় সুন্দরী। বিদ্যাসুন্দর যেমন বলেছেন তেমনি এই নারীরা খুব সুন্দর ভাবে চুল বাঁধতে পারে। শান্তিপুরের নারীরা বুদ্ধিমত্তা ও প্রাণবন্ত কথাবার্তায় বিশিষ্ট।
কালনা শহর যদিও শান্তিপুরের মতো আকারে বড় নয় কিন্তু অনেক বেশি অভিজাত ও পরিচ্ছন্ন। এর রাস্তা, বাজার আরো ভালো। আগে গঙ্গানদী বর্তমান শহরের পিছন দিক দিয়ে বইত। এখনকার পুরনো কালনা শহর যেদিকে আছে সেদিকে। এখনকার কালনা বর্ধমানের রাজার তৈরি। রাজা রানীদের নিয়ে তীর্থস্নান করতে আসেন এখানে। বর্ধমান ও কালনার বড় রাস্তা দিয়ে জোড়া, তার প্রতি আট মাইলে বাংলো, আস্তাবল, পুকুর আছে। গঙ্গা এখন আবার নতুন কালনার দিকে সরে যাচ্ছে ফলে এখনকার বাণিজ্যে ভাঁটা পড়েছে। কালনার প্রথমে দেখার জিনিস হল বর্তমান রাজার রাজবাড়ী। এখানে অনেক অভিজাত বাড়ি আর বৃহৎ মন্দির আছে। একটা বিশাল স্থানে দুটি চক্রাকারে (একটির মধ্যে আরেকটি) মন্দিরগুলি রয়েছে। মন্দির খুব কারুকার্যময়। ভিখারিদের খাওয়ানোর জায়গা আছে এখানে। এরপরে দ্রষ্টব্য সমাজ বাড়ি অর্থাৎ রাজার পরিবারের মৃতদের সমাধি। রাজা ক্ষত্রিয় বংশের এবং তাঁরা মৃতদেহের ভষ্ম সংরক্ষণ করে থাকেন। হয়তো তিনি এই প্রথাটা রাজপুতানার রাজাদের বা অন্য কোন উৎস থেকে নিয়েছেন কারণ এমন কোন সংস্থান হিন্দু শাস্ত্রে নেই। এখানে প্রাক্তন রাজার অস্থি রাখা আছে দামি কাপড়ে মুড়ে মখমলের মসনদে রাখা, সঙ্গে রুপার তামাক সেবনের হুঁকা, গোলাপ জল, আলবোলা সব রাখা আছে ঠিক কেমন ভাবে রাজা পূর্বে সিংহাসনে বসতেন।
এর পরে কিছু অংশে গঙ্গার গভীরতা এত কম যে লেখক ও সঙ্গীরা পাড় ধরে হেঁটে চললেন আর নৌকা দড়ির সাহায্যে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। মৃজাপুরের কাছে একটি খাল কেটে সেখান থেকে রাজমহল পর্যন্ত জল নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিলিটারি বোর্ডের দ্বারা, কুড়ি বছর আগে।
অনেক ঘন্টা নদীর পাড় ধরে হাঁটার পর দূরে নদীয়া (নবদ্বীপ) দেখতে পাওয়া গেল। হিন্দুধর্মে নদীয়াকে বিশেষ স্থান দেওয়া হয়। সংস্কৃত শিক্ষা পীঠস্থান ও চৈতন্যদেবের জন্মস্থান হিসেবে নদীয়ার অবদান অশেষ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশ হতে হয় নদীয়ার অবস্থা দেখে। নবদ্বীপে কিন্তু প্রাচীন ভগ্নপ্রায় মন্দির, বসতবাড়ি তেমন দেখা যায় না, পুরনো শহরের কাছে যা আশা করা যায় তার মত। অনেক সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতও চোখে পড়ে না। বরং একটা ছোট মফস্বল শহর আর খেটে খাওয়া ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় দেখা যায়। পুরনো নদীয়া গঙ্গার তলায় তলিয়ে গেছে। পুরনো নদীয়া কৃষ্ণনগরের দিকের পাড়ে ছিল। নদীয়ার সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনীগুলির একটি হলো বিল্লগ্রাম ও ধাত্রীগ্রাম নামে দুই সাধু এখানে থাকতেন, গভীর জঙ্গলে নির্জনে জ্ঞান চর্চার জন্য। জ্ঞানের অন্বেষণে বহু মানুষ তাঁদের কাছে শিক্ষা লাভ করতে আসতেন। জ্ঞানচর্চায় খুশি হয়ে দেবী সরস্বতী এই সাধুদের দেখা দিতেন। অন্য একটি কাহিনী হলো কাশীনাথ নামে এক রাজা প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নদীয়া এলেন। এই স্থান তখন জঙ্গলে ঢাকা লোক চক্ষুর আড়ালে ছিল। কিন্তু রাজার এই স্থান এত ভালো লেগে যায় যে তিনি এখানে রাজধানী তৈরি করা মনস্থ করলেন। তারপর জঙ্গল কেটে রাজধানী গড়ে উঠলো, প্রজাপত্তন হলো। তবে নদীয়ায় ঠিক কবে থেকে এবং কিভাবে গড়ে উঠেছিল তার কোন প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। এমনও শোনা যায় সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণসেনের রাজধানী ছিল নদীয়া। বক্তিয়ার খিলজী যখন বাংলা আক্রমণ করেন তখন তার সৈন্যরা নদীয়া ধ্বংস করে ও গৌড়ে রাজধানী তৈরি হয়। এরপর থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত নদীয়ার বিষয়ে আর কিছু জানা যায় না। তবে সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নিশ্চয়ই নদীয়ার মান অব্যাহত ছিল। শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে আবার নবদ্বীপ জনমানসে জাগরূক হল। শ্রীচৈতন্যের মন্দির ছাড়া নদীয়ায় কালীসাধক আগম বাগীশের র বাড়ির ভগ্নাবশেষ আছে। তিনিই প্রথম কালীমূর্তি তৈরি করেন তাঁর মনের কল্পনা থেকে। এরকম ধারণা আছে যে আদিবাসীদের দেবী ছিলেন কালী আর পূর্ববর্তী যুগে তাঁর পূজা হতো। কিন্তু হিন্দু ধর্মের ইতিহাস পাঠ করে বোঝা যায় যে কালীর বিদেশি উৎস আছে। শক্তির উপাসনা মনে হয় মিশরীয় ও আসিরিয় সভ্যতায় ছিল। কালী মূর্তির পূজা কিন্তু হিন্দুদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।কালীপুজো থেকে আসে তন্ত্রসাধনা। তবে আগম বাগীশ ঠিক কোন সময়কার এবং সত্যিই তাঁর বাড়ি বলে যা রয়েছে সেটি তার বাড়ি কিনা বা তাঁর বাড়ি গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের সময় ডুবে গেছে কিনা তা সঠিক জানা যায় না। পোড়া মাঈ নামক দেবী, যা একটু এক টুকরো কালো পাথরের উপর লাল গৈরিকমাটি মাখানো একটি অতিবৃদ্ধ বটগাছের তলায় বসানো। নদীয়ার গভীর জঙ্গলের মধ্যে ছিলেন রাজা কাশীনাথের লোকেরা জঙ্গলে আগুন লাগিয়েছিল। সেই আগুনে তিনি পুরে কালো হয়ে যান। বটগাছটি পুরাতন সেটি দেখে বোঝা যায়। নদীয়ার এই অংশ গঙ্গার তলায় তলিয়ে যায়নি। পোড়া মায়ের বটগাছের কাছে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় একটি বড় কালী মন্দির তৈরি করে দিয়েছিলেন। লেখকের পর কিছু টোল দেখতে গেলেন। ৫০ টির বেশি টোল আছে নবদ্বীপে। সবচেয়ে বড় পন্ডিত শ্রীরাম শিরোমণি। তাঁর চল্লিশটি ছাত্র। তার মধ্যে একজন আসাম, আরেকজন কালীঘাট, আরেকজন তেলেঙ্গানা থেকে এসেছে। নদীয়ার সাধারণ মানুষ এমনকি মহিলারাও কিছুটা কিছুটা সংস্কৃত শ্লোক বলতে পারেন। তবে ব্রাহ্মণরাই টোলের শিক্ষক ও ছাত্র হয় সেই প্রাচীনকালের মত। কিন্তু ইংরাজি শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের চক্র, আধিপত্য বন্ধ হয়েছে। স্যার উইলিয়াম জোন্স, ডক্টর কেরি প্রমুখ প্রাচ্যবিদ্যার পন্ডিতরা সবাই নদীয়ায় এসেছিলেন। নদীয়াতে লেখক একজন যোগীকে দেখেছিলেন। ব্যক্তিটিকে দেখে মনে হয় ৪০ বছর বয়স, খুব ফর্সা, কালো চুল। তিনি খান না, জলপান করেন না, কথা একটুও বলেন না, পা মুড়ে একই ভঙ্গিতে ধ্যানে বসে আছেন। উপোসের কোন প্রভাব তাঁর চেহারায় পড়েনি। দেশীয় ও ইউরোপীয়রা অনেকে তাঁকে দেখতে আসেন। তাঁর ধ্যান ভাঙ্গানোর জন্য নানা রকম প্রচেষ্টা হয়েছে কিন্তু সেটি সফল হয়নি।
কাটোয়া রোডে অবস্থিত নদীয়া থেকে চার মাইল পশ্চিমে জহ্নুনগরে (নবদ্বীপ-কাটোয়া রোডে অবস্থিত) জহ্নুমুণীর ছোট প্রাচীন মন্দির। এই মুণী গঙ্গাকে পান করেছিলেন, শেষে কর্ণকুহর পথে গঙ্গাকে আবার মুক্ত করেছিলেন। এই মন্দিরের নীচেই পুরনো নদীখাত। এখানে লেখক শোনেন এই নগরের এক জমিদার খাজনা দিতে না পারায় পিঁপড়ের ঘরে রেখে শাস্তি দিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের নবাবরা নাকি পোকা ভর্তি ঘরে রেখে মানুষদের শাস্তি দিত। নিকটস্থ ব্রহ্মাদিতলায় এক দুর্গা মন্দির রয়েছে। এখানে আগে নরবলি হত বলে লেখক শোনেন। এখন সেখানে জুলাই মাসে বড় মেলা হয়। এই মেলার বড় আকর্ষণ সাপ খেলা, সাপ ধরা, সাপের বিষ ছাড়ানো ইত্যাদি।
(চলছে)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
The travels of a Hindoo to various parts of Bengal and upper India by Bholanauth Chunder (দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু টু ভেরিয়াস পার্টস অফ বেঙ্গল এন্ড আপার ইন্ডিয়া বাই ভোলানাথ চন্দ্র) - এই বইটি ইংরেজি ভাষায় লেখা হলেও লেখক যেহেতু বাঙালি তাই এটিকে অবশ্যই 'সেকালের বাঙ্গালীদের ভ্রমণ' ব্লগের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
এই বইটি দুটি খন্ডে অর্থাৎ পার্ট ওয়ান এবং পার্ট টু- তে বিভক্ত। বইটি লন্ডনের N. Trubner and Company থেকে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির ভূমিকা লিখেছেন J. Talboys Wheeler, যিনি History of India বইয়ের লেখক। গ্রন্থের শুরুতে ভোলানাথ চন্দ্র বইটি উৎসর্গ করেছেন তৎকালীন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া স্যার জন লেয়ার্ড মেয়ার লরেন্সকে। উৎসর্গ করে তিনি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য ইংরাজ সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এবং ইংরাজ শাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রার্থনা করেছেন, কারণ এই শাসন জনগণের উন্নতি আর সুখ নিয়ে আসবে। এই লেখা ছাড়াও সমগ্র গ্রন্থ দুটির মধ্যে ছড়িয়ে আছে এই লেখকের অসম্ভব ইংরাজ প্রীতি এবং ভারতীয় প্রথা, ভারতীয় ধর্মবিশ্বাস-এর প্রতি কিছুটা অবজ্ঞার ভাব। ভূমিকায় জে. ট্যালবয়েজ হুইলার বলেছেন যে এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি কারণ এই প্রথম কোন ভারতীয় তথা হিন্দু যিনি তাঁর ধর্ম, তীর্থ সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ, এরকম একজন ভারতের প্রকৃত চিত্র অর্থাৎ ভারতীয়দের জীবন, স্বভাব, অনুভব, রীতিনীতি, চিন্তাধারা সব তুলে ধরেছেন, যা আগে কোন ইংরাজ লেখকের বই-এ পাওয়া সম্ভব না। তাই এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইংরাজীভাষী মানুষদের কাছে। তিনি ভোলানাথ চন্দ্র সম্পর্কে বলেন যে এই লেখক বাঙালি, হিন্দু, কলকাতাবাসি, বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁর পিতা মাতা বৈষ্ণব, যদিও ইয়ং বেঙ্গল হওয়ায়, বাবু ভোলানাথ চন্দ্র একজন ঈশ্বরবিশ্বাসী হলেও কোন প্রথা বা মূর্তি পূজাতে বিশ্বাসী নন, অন্য অনেক আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি হিন্দুর মত। ভোলানাথ চন্দ্র ইংরেজি ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ। তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজে ইংরাজি সাহিত্য পড়েছেন এবং তাঁর দেশের শিক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার সদস্য ছিলেন।
এই বইয়ের প্রথম খন্ডে লেখকের ১৮৪৫ থেকে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের ভ্রমণ কাহিনী লিখিত হয়েছে। বই পড়া কালীন জানা যায় যে লেখক ডায়েরি লিখতেন, পরে সেই তথ্য নিয়ে তিনি এই বই রচনা করেন। উল্লেখ্য যে স্থান ও পাত্রের নামের ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যবহৃত বানান এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।
তীর্থ ভ্রমণের লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর রচনার সঙ্গে ভোলানাথ চন্দ্রের রচনার অনেক অমিল আছে যদিও তাঁদের ভ্রমণ করা স্থানগুলি অনেকটাই এক এবং তাঁদের ভ্রমণের সময়কাল কাছাকাছি। এই অমিলগুলো হল - ভোলানাথ চন্দ্র ইংরেজিতে লিখেছেন আর সর্ব্বাধিকারী মহাশয় বাংলায় লিখেছেন। সর্ব্বাধিকারী মহাশয়ের ভাষা অত্যন্ত সহজ সরল, তিনি কোন রকম কাব্য বা অলংকারের ব্যবহার করে তাঁর ভাষাকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেননি। অন্যদিকে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ভোলানাথ চন্দ্র ইংরেজি ভাষায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিকের মতো তাঁর লেখার বাঁধুনি। যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী যে যে স্থান ভ্রমণ করেছেন তার সম্পর্কে অত্যন্ত গোছানো ভঙ্গিতে তথ্য দিয়েছেন। তাঁর বই পড়ে সেই সময়কার সেই সব জায়গার তৎকালীন ও তৎপূর্ববর্তী কালের ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি চিত্র অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে পাওয়া যায়। এখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে যেটুকু পরিবর্তন হয়েছে সেটুকু অনুসন্ধান করলেই যথেষ্ট। কিন্তু ভোলানাথ চন্দ্রের লেখা পড়ে কোন স্থান সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা যায় তা সম্পূর্ণ অনুধাবন করতে অনেক পড়াশোনা করতে হয় (মূলতঃ প্রথম খন্ডে), কারণ তিনি হয়তো অল্প কিছু সূত্র দিয়ে পরবর্তী প্রসঙ্গে চলে যান। দুজনের লেখার আর একটা পার্থক্য হল ভোলানাথ চন্দ্র উপনিবেশিক শাসকদের ইতিহাস নিয়ে বেশি লিখেছেন যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর তুলনায়। দুজনের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির খুব বিশেষ পার্থক্য নেই ইংরেজ শাসন সম্পর্কে। দুজনেই ইংরাজ শাসনে সন্তুষ্ট। তবে যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী ভারতীয় সংস্কৃতি, রীতিনীতিতে আস্থাশীল আর ভোলানাথ চন্দ্র সেসব নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেন। যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর লেখা কাউকে সন্তুষ্ট করা বা কারো প্রশস্তি করার জন্য লেখা নয়। তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন মতামত লিখেছেন। অন্যদিকে ভোলানাথ চন্দ্র সবসময় ইংরেজদের সন্তুষ্ট করার মানসিকতা নিয়ে বইটি লিখেছেন। বন্ধনীর () মধ্যে লিখিত অংশগুলি সেই প্রয়োজনীয় অনুসন্ধানের ফসল। ভারতীয় মানুষের ও স্থানের নামের ইংরেজি বানান তৎকালীন সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেক ভিন্ন ছিল, এই লেখায় লেখকের ব্যবহার করা বানান না লিখে, বর্তমানে ব্যবহৃত বানান লেখা হলো এই বইয়ের সব কটি পর্বে।
প্রথম খন্ডে লেখক-এর প্রথম যাত্রার তারিখ ১১ই ফেব্রুয়ারি ১৮৪৫। লেখক ও তাঁর কিছু সঙ্গী গঙ্গাবক্ষে নৌকায় রওনা দিলেন। কলকাতার তৎকালীন মিন্ট বা ট্যাঁকশাল (১৭৫৭ -তে প্রতিষ্ঠিত, স্ট্রান্ড রোডে অবস্থিত) ও মেটকাফ হল (১৮৪৪ -তে প্রতিষ্ঠিত) ছাড়িয়ে নৌকায় যেতে যেতে এলো চিতপুর, যার আসল নাম কালী চিত্রেশ্বরী (চিত্তেশ্বরী সর্বমঙ্গলা কালী মন্দির, চিতপুর)। কালী চিত্রেশ্বরী দেবীর কাছে আগে অনেক নরবলি হতো। শোনা যায় যে মাঝিরা গান গাইতে গাইতে নৌকা চালাচ্ছিল। সেই সুন্দর গান দেবীর কানে প্রবেশ করে। দেবীর মুখ আগে পূর্ব দিকে ঘুরানো ছিল। গান ভালো করে শোনার জন্য তিনি মুখ ঘোরান। সেই থেকে তাঁর মুখ গঙ্গার দিকে ঘোরানো রয়েছে।
এরপর এলো কাশিপুর। সুন্দর বাড়িঘর, জংলি গোলাপ ও নানা ফুলের শোভা আর জলের ওপর সেসবের শান্ত ছায়া দেখতে থাকলেন লেখক। এর পরের এলাকা অর্থাৎ কাশিপুর থেকে বরানগর ২০০ বছর আগে ডাচদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে সারাদেশের 'খারাপ নারীরা' (বারবনিতা) এখানে এসে থাকত। তারপর পরবর্তীকালে ইংরেজরা এই স্থানকে খুব সুন্দর স্থান হিসেবে দেখেছে। এখন এই স্থান শহরের ক্লান্তি দূর করতে, শান্ত সুন্দর প্রকৃতির মধ্যে নিরিবিলিতে ছুটি কাটাতে ব্যবহার করে ধনী ব্যক্তিরা। (বাংলায় ১৬১৫ থেকে ১৮২৫ পর্যন্ত ডাচ উপনিবেশ ছিল বরাহনগর বা বরানগর। সেখানে সেই সময় ডাচদের বাড়ি, কুঠি, বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। কুটিঘাট নামটি এখনো সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে।)
এরপর এলো দক্ষিণেশ্বর। আগে এখানে এক মুসলমান রাজকুমার থাকতেন বলে শোনা যায়। এখন আছে বিস্তীর্ণ নানা ফুলে ভরা বাগান, সবুজ ঘাস জমি যা গঙ্গার জল পর্যন্ত ঢালু হয়ে নেমে গেছে। (তখনও দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির স্থাপিত হয়নি। যেটি আঠারোশো পঞ্চান্ন খ্রিস্টাব্দে রানি রাসমণি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়।)
দক্ষিণেশ্বরের বিপরীত পাড়ে বালি গ্রাম। এটি খুব পুরনো আর সনাতন স্থান। কবিকঙ্কনের (কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের) লেখায় এখানকার উল্লেখ আছে। যদিও লেখক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যের শ্রীমন্ত কিভাবে এখানে আসলেন, যদি সেই সময় গঙ্গা সাতগাঁর নীচ দিয়ে প্রবাহিত হতো। বালির মাটির ঘর আর দুঃস্থ চেহারা এই স্থানের প্রাচীনত্বকে অবিশ্বাস করায়। যে খালের নামে এই জায়গার নাম হয়েছে সেই বালিখালের চারপাশে গ্রাম বাংলার সুন্দর ছবি চোখে পড়ে। এই বালিতে পরবর্তীকালে বাংলার একটি বড় ও মজবুত ব্রিজ হয়েছে। (এই ব্রিজ কিন্তু বালি ব্রিজ নয়। বালি ব্রিজ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বালিখালের উপরের ব্রিজ যা বালি ও উত্তরপাড়াকে সংযুক্ত করেছে। সেটি ১৮৪৬ এ অর্থাৎ লেখক যে বছর ভ্রমণ করছেন তার পরের বছর তৈরি হয়।)
হুগলি নদীর দুপাড়ে অপূর্ব দৃশ্য সুন্দর। সুন্দর বাগান, বাগান বাড়ি চোখে পড়ে। অল্প দূরে দূরে অনেক সিঁড়ি সম্পন্ন ঘাট রয়েছে গঙ্গায় নামার জন্য। হুগলি নদীর উপত্যকার মতো জনবহুল সমৃদ্ধ লোকবসতি বাংলায় আর নেই। লেখকেরা নৌকায় পানিহাটি পেরোলেন। এটি রাঘব পন্ডিতের সমাজ (রাঘব পন্ডিতের ভবন, পানিহাটি)। শ্রীচৈতন্যদেবের শিষ্য রাঘব পন্ডিতের বাড়ি এই পানিহাটিতে। মাধবী গাছের নীচে রাঘব পন্ডিতের সমাধির কথাও লিখেছেন লেখক।
এর একটু পরে এলো খড়দা। যে যুগে ডাকাতেরা আগে চিঠি পাঠিয়ে ডাকাতি করতো আর ডাকাতি করতে এসে গৃহস্থকে পুড়িয়ে মারতো আর বাড়ির মহিলাদের গরম তেলে জীবন্ত ভাজতো সেই সব ভয়ানক ডাকাতির কথা এখানে এলে মনে পড়ে। (এই কথাটি লেখক কেন লিখেছেন সে বিষয়ে বিস্তৃত কিছু বলেননি। ইন্টারনেট এবং বইপত্র খুঁজে এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি)। শ্রীচৈতন্যদেবের অনুসারী সংস্কারক নিত্যানন্দের বসত ছিল এখানে। নীলাচল থেকে ফিরে তিনি খড়দায় এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিবাহ করেন। তাঁর বংশধররা গোঁসাই নামে পরিচিত হন, যাঁরা মানুষকে ভবসাগর পার করতে সাহায্য করেন। নিত্যানন্দ ও তাঁর বংশধরদের সম্পর্কে ইঙ্গ-বঙ্গ সুলভ মানসিকতায় শ্লেষাত্মক কিছু মন্তব্য করেছেন লেখক।
গঙ্গার অপর পাড়ে মাহেশ। জগন্নাথ ও বলরাম দুই ভাই সারাদিন না খেতে পেয়ে দোকানদারের কাছে খাবারের বিনিময়ে একটি বাজুবন্ধ বন্ধক রেখেছিলেন। পুরী যাওয়ার পথে পান্ডারা সেই বাজুবন্ধের কথা ভুলে যাওয়াতে তাঁদের আবার মাহেশে আসতে হয়েছিল বাজুবন্ধ দোকান থেকে ছাড়াতে। এই গল্পটি লেখক বলেছেন। তখন থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে ওয়ারেন হেস্টিংসের বাগান বাড়ি ছিল মাহেশে, (পরে এটি রিষড়ার হেস্টিংস জুট মিল হয়েছিল, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে)।
এবার তাঁরা কেরি (উইলিয়াম কেরি), ওয়ার্ড (উইলিয়াম ওয়ার্ড), মার্শম্যান (জন ক্লার্ক মার্শম্যানের) - দের কীর্তিস্থলে এলেন (শ্রীরামপুর)। এই তিনজন ক্রিশ্চান মিশনারী শ্রীরামপুরকে কেন্দ্র করে বাংলায় কলেজ, ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। শ্রীরামপুর একটা ছোট শহর যা অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও অভিজাত বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল, এই যখন তিন মাসে ২২ টি জাহাজ এই তৎকালীন বন্দরে জিনিসপত্র আনা নেওয়া করতো। ডেনমার্কের ড্যানিসরা এখানে ৯০ বছর ছিল ও বাণিজ্য করেছিল (১৭৫৫ থেকে ১৮৪৫)। অর্ধ শতাব্দী আগে টিটাগড়ে একটি জাহাজ-ঘাটা বা ডক ইয়ার্ড ছিল। ১৮০০ সাল নাগাদ ডাচরা চুঁচুড়া পর্যন্ত জাহাজ নিয়ে যেত। তখনও গঙ্গানদী পলি জমে এত অগভীর হয়নি।
গঙ্গার অপর পাড়ে ব্যারাকপুর সুন্দর পার্ক, গভর্নর জেনারেলের বাড়ি (গভর্নমেন্ট হাউস, ব্যারাকপুর) নিয়ে সুসজ্জিত। কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নক দেড়শ বছর আগে এই স্থানে আসতেন ব্যস্ত শহর থেকে দূরে মাঝে মাঝে শান্তিতে কাটাতে (তখনও এই বাড়ি তৈরী হয় নি অবশ্য)। এই বাড়িতে যে ছবির সংগ্রহ আছে তা দেখার মত। পার্কে সুন্দর গাছ, ফুল, ঘাসজমি ছাড়াও রয়েছে চিড়িয়াখানা। সেখানে বাঘ, গন্ডার, ভাল্লুক, জিরাফ আছে, ছুটির দিন আনন্দে কাটানোর জন্য। প্যারেড গ্রাউন্ডটি স্মরণীয়। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে যেসব সিপাই কালাপানি পেরিয়ে বার্মা যেতে অস্বীকার করেছিল তাদের এখানে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল বলে। এখানে মঙ্গল পান্ডে (১৮৫৭) সিপাহী বিদ্রোহের নাটকে তাঁর ভূমিকা পালন করেছিলেন, যাঁর নাম ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজে একটা গালি হিসেবে রয়ে গেছে। এভাবে ছত্রে ছত্রে লেখকের দেশীয়দের প্রতি ঘৃণা ও ইংরেজদের চাটুকারিতা ফুটে বেরিয়েছে।
সেখান থেকে নৌকা এলো নিমাই তীর্থ ঘাটে (বৈদ্যবাটি), যা শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতি রক্ষা করছে। যেখানে তিনি দেশ ভ্রমণ কালে এসেছিলেন ও স্নান করেছিলেন। তারপর এলো চাঁপদানি যা বিগতকালে ডাকাতি, খুনখারাপির জন্য কুখ্যাত ছিল। এরপর এলো ঘিরেট্টি অর্থাৎ গৌরহাটি, যা চন্দননগরের ফরাসি গভর্নরের গ্রামীণ শাসনকেন্দ্র। এখানকার দৃশ্য খুব চমৎকার। একসময় সুন্দর ঘাস জমিতে শয়ে শয়ে ঘোড়ার গাড়ি শোভা পেত। কিন্তু এখন তা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। গভর্নরের বাড়ি, যা এক সময় অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাড়ি ছিল ভারতের মধ্যে, যেখানকার আড়ম্বরপূর্ণ সভাগৃহে ক্লাইভ, হেস্টিংস, উইলিয়াম জোনস এসেছিলেন এখন তা মাটিতে মিশে গেছে। কিছুদিন আগেও তার কিছু ভগ্নাংশ গাছপালা দেখা যেত, এখন কিছু অবশিষ্ট নেই, বলেছেন লেখক।
চন্দননগরের ফরাসি পতাকা দূর থেকে দেখা যায়। এখানে ফরাসি উপনিবেশ ষোলশ তিয়াত্তর থেকে গড়ে উঠলেও স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ডুপ্লের সময় থেকে। তাঁর শাসনকালে দুই হাজারের বেশি ইঁটের বাড়ি তৈরি হয়। ১৫ টি ফরাসি বাণিজ্যতরী বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করছিল। কিন্তু এখন চন্দননগর তার সব গৌরব হারিয়ে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। পুরনো দুর্গ (এখন চন্দননগর কোর্ট) ভগ্নপ্রায় হয়ে গেছে। বাড়িগুলো জনহীন, রাস্তাঘাট, নির্জন ঘাটগুলি অবহেলিত ১৭৫৭ এ ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়ে। পরে লেখক সংযোজন করেছেন যে এখন ১৮৬৯ এ চন্দননগর রেলপথে যুক্ত হয়েছে (১৮৫৪), তাই চন্দননগরের উন্নতি হচ্ছে ও পুরনো শ্রী কিছুটা হলেও ফিরে পাচ্ছে।
১২ ই ফেব্রুয়ারি ১৮৪৫ নৌকা চুঁচুড়া আসে। গঙ্গাধারের সুন্দর ভবনগুলি খুব সুন্দর লাগে দেখতে। সবচেয়ে ভালো বাড়িটা হলো কলেজ। এটি আগে Monsieur Perron- এর, যিনি দোয়াবের সিন্ধিয়ার ফরাসি জেনারেল আর ডেপুটি ছিলেন তাঁর বাড়ি। (তীর্থ ভ্রমণ গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি যে এরপরে সেটি বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদারের ছিল এবং তারপরে সেখানে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়)। চুঁচুড়া একটি ছোট শহর যা কলকাতার ধুলো, নোংরা, শব্দ থেকে মুক্ত, শান্তিপূর্ণ সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর উপযুক্ত জায়গা। জায়গাটি চন্দননগরের থেকে বেশি প্রাণচঞ্চল। চুঁচুড়া ১৬৭৫ থেকে ডাচ অধিকারে ছিল। যতদিন তারা এখান থেকে বাণিজ্য করেছে ততদিন জায়গাটা সমৃদ্ধ ছিল। তারপর জায়গাটা গুরুত্ব ও সমৃদ্ধি হারায়। চুঁচুড়াতে একজন ডাচ গভর্নর গত শতাব্দীর শেষে (অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ) প্রথম 'পাংখা' আবিষ্কার করেন। চুঁচুড়ার ডাচ শাসনের কিছুই অবশিষ্ট নেই শুধু গির্জার (অধুনালুপ্ত) দেওয়ালে রাখা ডাচ গভর্নরদের ঢাল ছাড়া। (চুঁচুড়ায় পর্তুগিজ শাসন ১৫৩৭ থেকে ১৬৩৫, ডাচ শাসন ১৬৩৫ থেকে ১৮২৫, ইংরাজ শাসন ১৮২৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ছিল)।
লেখকেরা এবার হুগলি ঘাটে পৌঁছলেন। এখানে পর্তুগীজদের পুরনো দুর্গ ছিল যার সামান্য ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট আছে মাত্র। পর্তুগীজরা সম্ভবত ১৫৩৭ -তে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। পর্তুগীজরা ভারতীয় বাচ্চাদের অপহরণ করে বা কিনে তাদের দাস হিসেবে ভারতের নানা বাজারে বিক্রি করতো। দিল্লির বাদশাহ শাহজাহান একবার পর্তুগীজদের থেকে সৈন্য ও অস্ত্র সাহায্য চেয়েছিলেন। পর্তুগীজ শাসক তা অস্বীকার করেন ও বিদ্রোহ করেন। শাহজাহানের সৈন্য বাংলায় পর্তুগীজদের আক্রমণ করে সাড়ে তিন মাস হুগলির দুর্গ অবরোধ করে থাকে। হাজারের বেশি পর্তুগীজকে হত্যা করা হয়, চার হাজারের বেশি জনকে যুদ্ধবন্দি করা হয়। সুন্দর যুবকদের আগ্রায় নিয়ে গিয়ে খোঁজা ও মুসলমান করা হয়। মেয়েদের বাদশাহ ও অভিজাতদের হারেমে দিয়ে দেওয়া হয়। বাংলায় পর্তুগীজ বিলুপ্ত হয়ে যায়। রয়ে যায় শুধু পর্তুগীজ গির্জা আর পর্তুগীজ ধাঁচের কোট।
হুগলির ইমামবাড়া বিখ্যাত। এর উঠান বিস্তৃত ও সুন্দর। মধ্যে ছোট পুকুর, দোতলা সুন্দর পরিচ্ছন্ন অভিজাত বাড়ি, রাজকীয় হলঘর, মুসলিম আদলে ঝাড় লন্ঠন, লন্ঠন রামধনুর রঙে রঙিন। দেওয়ালে নীল ও লাল রঙের কোরানের বাণী লেখা। দরজাগুলো অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ, তার ওপর সোনালী হরফে মসজিদের সালতারিখ, ইতিহাস লেখা। হুগলির সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হলো প্রেস বা ছাপাখানার প্রবর্তন। ১৭৭৮-এ মেসার্স হ্যালডেন ও উইলকিনস বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ছাপান। এরপর থেকে হিন্দু সাহিত্য ব্রাহ্মণদের কুক্ষিগত না থেকে সকলের আয়ত্তের জিনিস হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে এই ঘটনার রেল বা টেলিগ্রাফ এর পত্তনের থেকেও সভ্যতার পক্ষে বেশি মূল্যবান বলে লেখক মন্তব্য করেছেন।
ব্যান্ডেল চার্চ বাংলার সবচেয়ে পুরনো খ্রিস্টান চার্চ। চার্চের গায়ে প্রতিষ্ঠার তারিখ লেখা আছে ১৫৯৯। পর্তুগীজ জেসুইটদের ছবি ও মূর্তি উপাসনা মুঘল বাদশাহদের যথেষ্ট বিরক্তির কারণ হয়েছিল যা তাঁদের বাংলার পর্তুগীজ উপনিবেশ উৎখাতের অন্যতম কারণ।
(চলছে)
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ---- সুমনা দাম বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...