সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
লেখক ভোলানাথ চন্দ্র এরপর বৃন্দাবনের বৈষ্ণব সাধকদের জন্য প্রসিদ্ধ কিছু স্থান দর্শন করলেন। বৈষ্ণব সাধক হরিদাস গোস্বামীর সমাধি বা সমাজ প্রথম দর্শনীয় স্থান। চৈতন্যদেব হিন্দু দাহ-প্রথার বদলে বৈষ্ণবদের মধ্যে সমাধি-প্রথা প্রচলন করেন। হরিদাস তখন শেষ জীবনে হরিনামগান করে দিনাতিপাত করছেন বৃন্দাবনে। বাদশাহ আকবর যমুনা নদীপথে যেতে যেতে একবার হরিদাস গোস্বামীর গান শোনেন এবং সেই গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন তাঁকে রাজসভায় গিয়ে প্রধান গায়কের আসন অলংকৃত করতে। হরিদাস গোস্বামী স্বাভাবিক কারণেই অসম্মত হন। বারংবার অনুরোধে তিনি তাঁর তরুন শিষ্য তানসেন-কে আকবরকে দেয়। তানসেন এরপর আকবরের সভা অলংকৃত করেন এবং কালক্রমে কিংবদন্তি গায়ক হন। বৃন্দাবনে হরিদাস গোস্বামীর অতি সাধারণ দেখতে সমাধি হিন্দুদের দর্শনীয় স্থান।
কার্তিক মাসে বৃন্দাবনে রাস উৎসব পালিত হয়। রাস মন্ডল একটি অঙ্গন যেখানে শ্রীকৃষ্ণের নাম কীর্তন নাচ হয়। সারা শহর জুড়ে রাসমণ্ডল হয় এই সময়।
বৃন্দাবনে লালাবাবুর মতো খ্যাতি আর কারো নেই।ওয়ারেন হেস্টিংস এর দেওয়ান গঙ্গা গোবিন্দ সিংহের নাতি ছিলেন লালা বাবু (লালাবাবুর প্রকৃত নাম কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ)। এই বিশাল ঐশ্বর্যবান মানুষটি যৌবনে সংসার ত্যাগ করে কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর হয়ে বৃন্দাবনে চলে আসে। এখানে একটি অসাধারণ মন্দির তৈরি করান এবং সেই মন্দিরের দরিদ্র সেবায় প্রতিদিন ১০০ টাকা করে খরচ করতেন। প্রতিদিন ৫০০ মানুষ এখানে ঠাকুরের প্রসাদ পেত। মন্দিরের চত্বর প্রতিদিন লালাবাবু নিজে হাতে পরিষ্কার করতেন এবং নিজে ভিক্ষা করে আনা রুটি মাত্র খেতেন। এই সর্বত্যাগী মানুষটি পরে বৃন্দাবন ছেড়ে গিরি গোবর্ধনের গুহায় ধ্যান করার জন্য চলে যান।
পরবর্তী গন্তব্য রূপ গোস্বামীর আশ্রম স্থল। এই আশ্রম এখন আর জঙ্গলের মধ্যে নির্জনে নেই। এটি এখন পাকা রাস্তায় অবস্থিত। সেখানে ভরতপুরের রাজার তৈরি একটি উৎকৃষ্ট মানের মন্দির আছে।
তাঁরা এবার গেলেন নিধুবন, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ রোজ বাঁশি বাজাতেন আর গোপিনীদের সঙ্গে লীলা খেলা করতেন। এটি বর্তমানে শহরের মধ্যে অবস্থিত নীচু প্রাচীর দেওয়া এক স্থান, যেখানে জঙ্গল ঝোপঝাড় আছে। ললিতা কুন্ড বলে একটি জলাশয় আছে এখানে।
তারপর তাঁরা গেলেন মদনমোহনজি দর্শনে। এই মন্দির রানী কুব্জার প্রতিষ্ঠিত। মথুরার পতনের সময় মদনমোহনজি অদৃশ্য হয়েছিলেন। কয়েক শতাব্দী অদৃশ্য থাকার পর তিনি এক চৌবে মহিলার বাড়িতে প্রকট হন, যিনি তাঁকে তাঁর শিশু পুত্রের সঙ্গী হিসেবে রাখেন। পরে মদনমোহন সনাতন গোস্বামীর কাছে আসেন। সনাতন গোস্বামীর দেওয়া অতি সাধারণ প্রসাদে অরুচি হওয়ায় মদনমোহন রাজকীয় খাদ্য অভিলাষ করেন কিন্তু তা সনাতনের সাধ্যাতীত ছিল। তখন এক বণিকের মালবাহী নৌকা বালির চড়ায় আটকা পড়ে। সওদাগর সাহায্যের আশায় ঘুরতে ঘুরতে মদনমোহনের মন্দিরে আসেন ও মানত করেন যদি এই যাত্রা তাঁর নৌকার জিনিসপত্র বেঁচে যায় তবে মদনমোহনের সেবায় সেই অর্থ ব্যায়িত করবেন। অলৌকিকভাবে নৌকা উদ্ধার হয় ও বণিকের আশাতীত লাভ হয়। তিনি দেবতার জন্য মন্দির তৈরি করে দেন। সেই মন্দিরের দেবতা বৃন্দাবনের প্রধান তিন দেবতার একজন হন। সনাতন গোস্বামী প্রতিষ্ঠিত সেই মূর্তি এখন জয়পুরে আর প্রাচীন মন্দিরটি পরিতক্ত ও ভগ্নপ্রায়। সনাতনের সমাজ বা সমাধি সেখানে আছে। এখানে চৈতন্যদেব এসেছিলেন। তাঁর পায়ের ছাপ, খড়ম আর যে তেঁতুল গাছের যে ছায়ায় তিনি বসেছিলেন তা রয়েছে। যদিও গাছটি এত পুরনো বলে লেখকের মনে হয় নি আর চরণচিহ্ন খুব ছোট মাপের বলে লেখকের সন্দেহ হয়।
নিকুঞ্জবন যা রাধা কৃষ্ণের অভিসারের উদ্যান সেটি লেখকের পরবর্তী দর্শনীয় স্থান। কথিত আছে নিকুঞ্জ বনে কোন মানুষ রাত কাটাতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে এই বন একটি নীচু পাঁচিল ঘেরা, ঝোপ ঝাড় ঘাসে ঢাকা জমি, যেখানে অনেক হনুমানের বাস। এরমধ্যে লেখক বৃন্দাবন শহর ও তার চারপাশে হনুমানের অত্যাচারের কাহিনী বলেছেন। একটিমাত্র গাছ রয়েছে নিকুঞ্জবনে, যেটি তার প্রাচীনত্ব প্রদর্শন করছে।
বাঁকাবিহারী বৃন্দাবনের সবচেয়ে বড় শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি। তাঁর পাশে কোন রাধা মূর্তি নেই। রাধারমন হলেন গোপাল ভট্ট গোঁসাই-এর প্রতিষ্ঠা একটি শিলা থেকে উদ্গত মূর্তি।
বৃন্দাবনে লেখক নাটক দেখলেন। একটি বড় মন্দিরের উঠানে বা প্রাঙ্গনে সামিয়ানা টাঙিয়ে শয়ে শ়য়ে বাতির আলোতে উজ্জ্বল মঞ্চে নাটক অনুষ্ঠিত হল। রঙিন পাগড়ী শোভিত ব্রজবাসীরা পা মুড়ে মাটিতে বসে সেই নাটক দেখল। ব্রজনারীরা রঙিন পোশাক পড়ে, ঘেরা জায়গায় বসে দেখল। প্রাঙ্গণের মাঝখানে উঁচু মঞ্চের প্রতি প্রান্তে ২টি ছেলে দুটি করে মশাল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। নাটকের বিষয়বস্তু ছিল নিধুবনে রাধা কৃষ্ণ। একটি সুন্দর অল্পবয়সী ছেলে মাথায় মুকুট ও নারীদের সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হয়ে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করল। ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণকে কথা বলতে শুনে খুব ভালো লাগছিল লেখকের।
বৃন্দাবনে তীর্থযাত্রীরা আরও বেশ কিছু স্থানে তীর্থ ভ্রমণ করেন। যেমন - মধুবন বা তাল বন, যেখানে কৃষ্ণ বলরামের বাল্যলীলা হয়েছিল। রাধাকুন্ড, শ্যামকুন্ড, ললিতাকুন্ড (লালাবাবু রাধাকুন্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন, শ্যাম কুন্ডের জলের রং নীলাভ আর ললিতা কুন্ডের জল দুধের মতো সাদা। শ্যাম কুন্ডের পাশে বসে কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর চৈতন্য চরিতামৃত কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন)।
রাধাকুণ্ড থেকে চার মাইল দূরে গোবর্ধন পর্বত যা বৈষ্ণবদের কাছে কৈলাস পর্বতের মতো পবিত্র। এই পর্বত কৃষ্ণ তাঁর কনিষ্ঠ আঙ্গুলে তুলে ধরে ছাতার মতো ব্যবহার করে অতিবৃষ্টিতে সমগ্র বৃন্দাবনকে রক্ষা করেছিলেন। লেখক গিরি গোবর্ধনকে নিয়ে আরো একটি কাহিনী লিখেছেন। লঙ্কায় যুদ্ধকালে লক্ষণ রাবণের বানে আহত হলে চিকিৎসক (সুষেণ) বলেছিলেন হিমালয়ের একটি নির্দিষ্ট পাহাড় থেকে (গন্ধমাদন) নির্দিষ্ট একটি গাছ (বিশল্যকরনী) আনতে পারলেই তাঁকে সুস্থ করা যাবে। হনুমান সেই গাছ আনতে যান কিন্তু কার্যকালে গাছের নাম ভুলে যাওয়াতে সম্পূর্ণ পাহাড়টি পিঠে তুলে লঙ্কা যাত্রা করেন। বর্তমানে যেখানে গোবর্ধন পর্বত রয়েছে সেই স্থানের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় রামের ভাই ভরত সেখানে ছিলেন। তিনি হনুমানকে ভাবেন লঙ্কার রাক্ষস। তাই তিনি তীর ছোঁড়েন হনুমানের পায়ে তীর লাগায় তিনি রাম রাম বলে ওঠেন এবং তাঁর পিঠ থেকে গন্ধমাদন পর্বতের একটি ছোট অংশ পড়ে যায় মাটিতে। ভরত রাম নাম শুনে তাঁর ভুল বোঝেন। তারপর হনুমানের কাছে সব শুনে তাঁকে বলেন তাঁর তীরের ডগায় গন্ধমাদন-সহ বসতে যাতে তীর ছুঁড়ে ভরত তাঁকে আরও তাড়াতাড়ি লঙ্কায় পৌঁছে দিতে পারেন অসুস্থ ভাই লক্ষণের ঔষধ নিয়ে। হনুমান অবশ্য নিজের অলৌকিক শক্তি বলেই লঙ্কায় পৌঁছান। গন্ধমাদনের যে টুকরো ওই স্থানে পড়েছিল তা গোবর্ধন পর্বত নামে খ্যাত হয়।
গোবর্ধন পর্বতে এখন অনেক মন্দির আছে, যার মধ্যে প্রধান মন্দিরে কৃষ্ণের শিশুরূপ গোপাল হিসেবে পূজা হয়। বল্লভাচার্য গোপাল রূপে কৃষ্ণের পূজার প্রথম প্রচলন করে। পঞ্চদশ শতাব্দীর ব্রজ অঞ্চলের বৈষ্ণব ধর্মের সাধক ও দার্শনিক ছিলেন বল্লভাচার্য। প্রতিবছর কার্তিক মাসে অন্নকূট উৎসব বল্লভাচার্য শুরু করেছিলেন, এখনো সেটি এখানে পালিত হয়।
বৃন্দাবন শহরের মাঝখানে রঞ্জিত সিংহের (ভরতপুরের মহারাজা) সুন্দর সমাধি অবস্থিত। এই সমাধির একদিকে একটি জলপূর্ণ পুকুর ও অপরদিকে একটি জলশূন্য পুকুর রয়েছে। এর কারণ শ্রীকৃষ্ণ নাকি একবার তৃষ্ণার্ত হয়ে একটি পুকুরের সমস্ত জল নিঃশেষে পান করে নিয়েছিলেন। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া যখন ভরতপুর আক্রমণ করেছিলেন তখন তিন মাস যাবত দূর্গ অবরোধ করে রেখেছিলেন। সেই সময় রঞ্জিত সিংহ সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করেছিলেন। শূন্য পুকুর সেই অবরোধকে প্রতীকী ভাবে দেখায়।
চরণ পাহাড়ি নামক স্থানে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর গরুর পালের পায়ের চিহ্ন দেখা যায়। এই পাহাড়ের লুকালুকি নামক স্থান ছিল তাঁর লুকোচুরি খেলার স্থান গোপিনীদের সঙ্গে।
কাম্যবন নামক স্থানে পাণ্ডবদের বনপর্বে থাকার সময় শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এখানে তাঁদের মূর্তি, যজ্ঞশালা প্রভৃতি যাত্রীদের দেখানো হয়।
বারসানার রাজা বৃষভানুর কন্যা রাধার জন্মস্থল; নন্দগাঁও যা কৃষ্ণের শৈশবের লীলাভূমি; বস্ত্রহরণ ঘাট, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের বস্ত্রহরণ করেন প্রভৃতি দর্শন করেন।
লেখক এরপর দেখেন মহাবন যেখানকার প্রধান দেবতা বলদেও বা বলদেব, যিনি কৃষ্ণের দাদা বলরাম।
গোকূল, যমুনার মধ্যে একটি দ্বীপের মতো স্থানে অবস্থিত। এটি বৃন্দাবনের সুন্দরতম স্থান বলা যায়। এই স্থান এখনও অনেকটা কৃষ্ণের সময়ের গোকূলের মত পরিবেশ বজায় রেখেছে। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এখানকার মূল বিগ্রহ গোকূলনাথ জঙ্গলে লুকানো ছিলেন মুসলমান আক্রমণের কারণে। বল্লভাচার্য তাঁকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেন। আওরঙ্গজেবের সময় আবার মূল মূর্তি অন্যত্র (জয়পুরে) পাঠানো হয়। এখানে আছেন প্রতিমূর্তি। গোকূলে পুতনা-খাল দেখলেন লেখক, যেখানে কংস-প্রেরিত রাক্ষসী পুতনাকে মেরে যমুনায় ভাসিয়ে দেন কৃষ্ণ।
এভাবে শেষ হল লেখক ও তাঁর সঙ্গীদের বৃন্দাবন দর্শন।
লেখকের এর পরবর্তী ভ্রমণকাহিনী এর চার বছর পরে অর্থাৎ ১৮৬৬, ৫ নভেম্বর শুরু হল। এবার কাহিনী শুরু হলো টুন্ডলা জংশন থেকে। এই সময়ের মধ্যে দিল্লি পর্যন্ত রাজপথ নতুন করে তৈরি হয়েছে। ফলে ঘোড়ার গাড়ির গতি অনেক বেড়ে গেছে।
প্রথম উল্লেখযোগ্য স্থান যেটি পথে পড়ল সেটি হলো হাতরাস। ডাকাত, ঠগীর আস্তানা থেকে এখন এটি ব্যস্ত তুলো আর নীলের বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
তারপর এলো আলিগড়, এর প্রাচীন নাম কোল বা কোয়েল। লেখক স্থানটিকে কোয়েল আলিগড় লিখেছেন। এই কোল অতি প্রাচীনকাল থেকে ছিল বলেছেন লেখক। কৃষ্ণ কংসকে বধ করার পর জরাসন্ধ, যিনি কংসের জামাই ছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে আক্রমণ করতে যাওয়ার সময় এখানে বিশ্রাম করেছিলেন। সিন্ধিয়ার সেনানায়ক মসিয়ে পেরোন-এর মাটির দূর্গের জন্য আলিগড় স্মরণীয়। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে (দ্বিতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধে, ১৮০৩ থেকে ১৮০৫) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি লর্ড লেক এই দূর্গটি আক্রমণ করে ধ্বংস করেন, এক প্রবল প্রতিরোধ প্রতিহত করে। এখন শুধু দূর্গটির ধ্বংসাবশেষ আছে জঙ্গলময় পরিবেশে। সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব আলিগড়ে ভালোই পড়েছিল। এখন ধীরে ধীরে জায়গাটি শ্রী ফিরে পাচ্ছে।
আলিগড় থেকে দিল্লি যাওয়ার ট্রেনে করে লেখক রওনা দিলেন পরদিন। খুরজা, বুলন্দশহর, সিকান্দ্রাবাদ, দাদরি, গাজিয়াবাদ হয়ে এল দিল্লি। দূর থেকে চোখে পড়ল কুতুব। ক্রমে ক্রমে হুমায়ুনের সমাধি, যমুনা, আর নানা রকম মিনার-স্তম্ভ-প্রাসাদ-মসজিদ সম্বলিত, বহু প্রতীক্ষিত দিল্লি শহর চোখের সামনে উন্মোচিত হলো।
(চলছে)