সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
লেখক ভোলানাথ চন্দ্রের মতে খ্রীষ্টপূর্ব আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইন্দ্রপ্রস্থ রূপে জন্ম নিয়েছিল দিল্লি শহর। মহাভারতের যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যে পাঁচটি গ্রাম বা প্রস্থ বা পাট চেয়েছিলেন সেগুলি হল পানিপথ, ইন্দ্রপাট, তিলপাট বাঘপাট ও সোনপাট (সোনিপাট)। এর মধ্যে ইন্দ্রপ্রস্থ বা ইন্দ্রপাটে যুধিষ্ঠির তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
পুরানা কেল্লা বা লালকোট যুধিষ্ঠিরের তৈরি রাজধানী শহরের ধ্বংসস্তূপে বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠা ও ধ্বংস হওয়া প্রাসাদ, ঘরবাড়ির বর্তমান ধ্বংসাবশেষ। বর্তমানে পুরানা কেল্লায় মুসলমান যুগের স্থাপত্যই চোখে পড়ে, যুধিষ্ঠিরের আমলের কোন স্থাপত্যের চিহ্ন এখন নেই। (উইকিপিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে, খনন কার্যের ফলে পুরনো কেল্লাতে খ্রীষ্টপূর্ব এক হাজার বছর আগের বসবাসের চিহ্ন মাটির পাত্র পাওয়া গেছে। এখানে ক্রমান্বয়ে মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, রাজপুত, সুলতান, মুঘল যুগের বসবাসের চিহ্ন পাওয়া গেছে)। ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রথমে কেল্লাটিকে যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপ্রস্থ বলেছিলেন। যদিও তিনি বলেন বর্তমান প্রাসাদ মুসলমান শাসকদের তৈরি।
বর্তমানে পুরানা কেল্লায় দর্শন দর্শনীয় স্থান এবার দেখলেন লেখক। প্রথমে কিলা কোনা মসজিদ যার নির্মাণ হুমায়ুন শুরু করেছিলেন আর শেরশাহ শেষ করেন। খিলান, নীল টালি, মার্বেল ইত্যাদি আফগান বৈশিষ্ট্য সম্বলিত মসজিদ এটি। কিন্তু মসজিদটি এখন ভগ্নপ্রায়। শের-ই-মন্ডল আরেকটি দর্শনীয় স্থান। এই তিনতলা, আটটি কোণা বিশিষ্ট, লাল পাথরের বিশাল প্রাসাদটি শেরশাহ তৈরি করেছিলেন। সিংহাসন পুনর্বার অধিকার করার পর হুমায়ুন এটি পাঠাগার হিসাবে ব্যবহার করতেন। এর ভিতরে সুন্দর কারুকার্য ছিল, যার সামান্যই এখন অবশিষ্ট আছে। এই ভবনেই হুমায়ুন সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে হুমায়ুন প্রাণ হারান।
দিল্লি ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে মাইল পাঁচেক দূরে অবস্থিত। দিল্লির প্রাচীনতম স্থাপত্য অশোক স্তম্ভ। তারপর প্রাচীনতার দিক থেকে আসে লৌহ স্তম্ভ। মিশ্র ধাতুর তৈরি ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ও ৬০ ফুট উচ্চতার লৌহ স্তম্ভটির ২২ ফুট মাটির উপরে আছে আর বাকী অংশ মাটির তলায় অবস্থিত। এত প্রাচীনকালে এত বড় ধাতুর স্তম্ভটি ঢালাই এর কাজ বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তাছাড়া স্তম্ভে কোন মরচে ধরে নি এখনও। স্তম্ভটির গায়ে সংস্কৃত লিপিতে লেখা আছে। এটি রাজা ধবের (উইকিপিডিয়ার মতে রাজা চন্দ্র) কীর্তি স্তম্ভ, তিনি বিষ্ণুর উপাসক, যিনি সিন্ধুর বাহ্লিক দমন করেছেন ও সমগ্র পৃথিবী শাসন করেছেন। রাজা ধবের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। লিপির বৈশিষ্ট্য দেখে গুপ্ত যুগের লিপি বলে মনে হয়। হয়তো গুপ্ত পরবর্তী যুগে লেখা এটি। স্তম্ভের গায়ে আরেকটি লিপিতে লেখা আছে ১১০৯ সম্বত অর্থাৎ ১২৫২ খ্রিস্টাব্দে অনঙ্গ পাল দিল্লি শাসন করেছেন (তোমারা সাম্রাজ্যের বংশের প্রতিষ্ঠাতা অনঙ্গ পাল)। হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত আছে এই লৌহ স্তম্ভ পান্ডবদের তৈরি। স্তম্ভ মাটির তলায় এত গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত যে তা বাসুকি নাগের মাথায় বসানো আছে। এক তোমারা রাজা পরবর্তীকালে স্তম্ভটি তুলতে গেলে ভূগর্ভ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে এবং স্তম্ভটি আলগা বা ঢিল্লি হয়ে যায়। সেই ঘটনায় ঢিল্লি থেকে জায়গার নাম হয়েছে দিল্লি। অন্য মতে এক তোমারা রাজার জন্য ঋষি ব্যাস এই লোহার দণ্ডটি মাটিতে পুঁতে দেন। তিনি বলেন বাসুকির মাথায় এটি স্থাপিত হল। কিন্তু কৌতুহলী রাজা যখন এটি তোলার চেষ্টা করেন তিনি দেখেন দন্ড তোলার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বাসুকিনাগের রক্ত দেখা যায় রাজা আবার মাটিতে রোপন করতে চান কিন্তু পুরোটি পারেন না। ঋষি ব্যাস রাজাকে জানান যেমন তোমার জন্য দন্ড মাটিতে আলগা ভাবে বসে রইল তেমনি তোমার রাজত্ব ঢিলে বা অস্থায়ী হবে এবং ঊনবিংশ বংশ পরে প্রথমে চৌহান, পরে তুর্কিদের হাতে দিল্লি চলে যাবে। তৃতীয় মতে রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান ব্রাহ্মণদের সাহায্যে লোহার দন্ড সর্পরাজ শেষনাগের মাথায় রাখেন, যাতে তাঁর সাম্রাজ্য চিরজীবী হয়। কৌতূহলের বসে তিনি সত্যি শেষ নাগের মাথায় দন্ডটি বসানো হয়েছে কিনা দেখার জন্য সেটি তুলে ফেলেন। দন্ডের শেষে রক্ত দেখা যায় এবং রাজা জানতে পারেন তাঁর রাজত্বের মেয়াদ খুব স্বল্পকাল। তারপর থেকে হিন্দু রাজ্যেরও অবসান হবে। অনঙ্গ পাল ২ দিল্লিতে রাজত্ব স্থাপন করে লালকোট দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন লৌহ স্তম্ভটিকে কেন্দ্রে রেখে, ১১১৭ সম্বত বা ১৬০ খ্রিস্টাব্দে।
লালকোট নাম থেকে অনুমান হয় যে দুর্গটি লাল পাথরের তৈরি। কিন্তু ধ্বংসাবশেষ থেকে মনে হয় এটি ধূসর পাথরে তৈরি। এটির পরিসীমা আড়াই মাইল। দুর্গের চারপাশের পরিখা আছে। দুর্গের তিনটি দরজার অবস্থান এখনো দেখা যায়, চতুর্থ দরজাটি বোঝা যায় না প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার কারণে। প্রাচীরের ভেতর যেসব ঘরবাড়ি বা মন্দির ছিল সেগুলির এখন পৃথক অস্তিত্ব নেই, শুধুই ভগ্নস্তূপ। এখান থেকে কিছু দূরে এখনো অনঙ্গ তাল নামে একটি সরোবর আছে। সেটি ১৯ ফুট লম্বা ও ১৫২ ফুট চওড়া ও ৪০ ফুট গভীর। নিশ্চয়ই দুর্গের লোকেদের জল সরবরাহ করার জন্য সরোবরটি খনন করা হয়েছিল। পৃথ্বীরাজ চৌহানের সময় লালকোট কেল্লার বাইরেও শহর বিস্তীর্ণ হয়েছিল। বৃহত্তর শহরের সুরক্ষার জন্য বাইরে চার মাইলের বেশি পরিসীমার প্রাচীর দেওয়া হয়েছিল লালকোট দুর্গকে কেন্দ্র করে। লালকোট কেল্লার নাম সেই সময় হয় কিলা রাই পিথোরা অর্থাৎ রাজা পৃথ্বীরাজের কেল্লা। এই প্রাচীরে নটি ফটক ছিল, যার মধ্যে চারটির চিহ্ন এখনো পাওয়া যায়। লাল কোটের উত্তর দিকে রঞ্জিত গেট দিয়ে মোহাম্মদ ঘোরীর বিধ্বংসী বাহিনী লালকোটে প্রবেশ করেছিল।
ভারতের মাটিতে প্রথম মুসলমান মসজিদ কুতুবউদ্দিন-এর তৈরি মসজিদ হল মসজিদ-ই-কুতুব-উল-ইসলাম। কুতুব মিনার চত্বরে অবস্থিত এই মসজিদের ১৬৫ ফুট লম্বা ও ৩১ ফুট চওড়া। প্রার্থনা গৃহটি ৫ সারি সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত হিন্দুস্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটি একটি ১৪৫ ফুট লম্বা ও ৯৬ ফুট চওড়া প্রাঙ্গণের প্রান্তে অবস্থিত। প্রাঙ্গণের মাঝখানে রয়েছে সেই বিখ্যাত লৌহ স্তম্ভ। এই প্রাঙ্গণটিতে অন্তত ১২০০ হিন্দুস্তম্ভ ব্যবহার করা হয়েছে। হিন্দু মন্ভদিরের ভগ্নাংশ ব্যবহার করে তিন বছরের মধ্যে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল।
কুতুব মিনার মানুষের তৈরি (লেখকের সময় পর্যন্ত) পৃথিবী সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভ। এটি ২৩৮ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা ভূমি পৃষ্ঠ থেকে। নীচের দিকে এই মিনারের চব্বিশটি পৃষ্ঠতল আছে ১৪৭ ফুট পরিধি যুক্ত। উপরের দিকে এটি বৃত্তাকার। এর মোট পাঁচ তলা আছে। প্রতিটিতে ঝুল বারান্দা আছে। তিন তলা পর্যন্ত মিনারটি লাল বেলে পাথরের ও তার উপরের শ্বেত পাথরের তৈরি। ভেতরের দিক ধূসর পাথরের তৈরি। মিনারের ভিতরে সিঁড়ি আছে, ভিতরে আলো হাওয়া পূর্ণ পরিবেশ। বারান্দা ও মিনারের বহির্গাত্রে কোরআনের বাণী আরবিতে লেখা আছে। মিনারের গায়ের লিপি থেকে জানা যায় সুলতান আলতামাস বা ইলতুৎমিস মিনারের কাজ শেষ করিয়েছিলেন। মিনারের গায়ে ফিরোজ শাহ তুঘলকের নামও আছে। বাজ পড়ে একবার মিনার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ফিরোজ শাহ তুঘলক সেটি সারাই করান ১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে মিনারে আবার সারাইয়ের কাজ করতে হয়। তৎকালীন সুলতান সিকান্দার লোদী সেই কাজ করান। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে এক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুতুবমিনার। ব্রিটিশ সরকার তখন মেরামত করেন। ১৮৪৭ এ আবার কিছু সংস্কার করান ব্রিটিশ সরকার।
কুতুব মিনার হিন্দু রাজাদের কীর্তি কিনা তাই নিয়ে বিতর্ক আছে। হিন্দুরা বিশ্বাস করে হিন্দু এক রাজা তাঁর কন্যার সূর্যের উপাসনা ও যমুনা দর্শনের জন্য এই মিনার তৈরি করিয়েছিলেন। হিন্দুদের স্বপক্ষে আরো যুক্তি এই যে মিনারের প্রবেশপথ উত্তরমুখী, যা হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত। মুসলমানদের প্রচলিত প্রবেশপথ পূর্বমুখী। বারান্দাগুলিতে যে ঘন্টা সাজানো আছে তা হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত। অন্যদিকে মুঘল বাদশাহ আকবর শাহ ২ -এর মুন্সি সৈয়দ আহমেদ লিখে গেছে কুতুব মিনার আসলে মসজিদ-ই-কুতুব-উল-ইসলামের মজিনাহ্ বা আজান দেওয়ার স্থান। কুতুব মিনারের আরবি লিপিতে মোহম্মদ ঘোরীর প্রশস্তি ও কুতুবুদ্দিনের নাম পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে মিনার তৈরির কাজ শুরু করেন কুতুবউদ্দিন এবং আলতামস বা ইলতুৎমিস সেই কাজ শেষ করেন। কবি চাঁদ বরদোই, যিনি পৃথ্বীরাজ চৌহানের জীবনী লিখে গেছেন, তাঁর লেখায় এই মিনারের কোন উল্লেখ নেই। তাই এটি সুলতানি আমলে তৈরি হয়েছে এই যুক্তিটি বেশি গ্রহণযোগ্য। তবে হিন্দু স্থপতিদের দ্বারা কুতুব মিনার তৈরি বলে এই স্থাপত্যে কিছু কিছু হিন্দু প্রভাব পড়েছে। লেখক যখন কুতুব মিনারে গেছিলেন তখন তার চূড়া পর্যন্ত দর্শনার্থীদের যাওয়ার অধিকার ছিল।
লেখক এবং সঙ্গীরা এবার কুতুব মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থিত অসমাপ্ত মিনারটি দেখলেন। এটি কুতুব মিনারের থেকে দ্বিগুণ বড় করে তৈরি করার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। হিন্দুদের মতে এই মিনার থেকে রাজকন্যার গঙ্গা দেখার ব্যবস্থা করার জন্য সেটি তৈরি হচ্ছিল কিন্তু মুসলমান আক্রমণের ফলে কাজটি শেষ হয়নি। অন্য মতে আলাউদ্দিন খিলজি এই মিনারটি তৈরি করেছিলেন কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও পরে মারা যাওয়ায় এই কাজ শেষ হয়নি।
প্রাঙ্গণের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে সুলতান আলতামসের সমাধি। সমাধির ভিতর দিকে দেওয়াল খুব সুন্দর করে তৈরি। সমাধিটি ভালোভাবে সংরক্ষিত আছে। এর মাথার ওপর খোলা, যেন স্বর্গের সঙ্গে পৃথিবীর মধ্যে কোন বাধা রাখা হয়নি।
এবার তাঁরা মেহেরৌলির প্রাচীন কুঁয়া দেখলেন, যেটি নাকি অনঙ্গপাল ২ -এর তৈরি (মেহেরৌলির বাউলি)। পরবর্তী দর্শনীয় স্থান আদম খানের সমাধি (আদম খান আকবরের একজন সেনাপতি ছিলেন)।
সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী নির্মিত আলাই দরওয়াজার বিশালত্ব ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হয়। এর গায়ে আরবি অক্ষরে লেখা আছে ১৩১০ খ্রিষ্টাব্দে এর তৈরি কথা। দেখলেন হুমায়ুনের ধর্মগুরু ইমাম জামিনের সমাধি, আকবরের অন্যতম ভ্রাতৃসম মোহম্মদ কুলি খানের সমাধি, মোহম্মদ কুলি খানের সমাধির বাড়িটি এখন মেটকাফ হাউস নামে পরিচিত হয়েছে (চার্লস মেটকাফ তখন দিল্লির বাদশাহের দরবারে ব্রিটিশ প্রতিনিধি ছিলেন)।
(চলছে)