সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
কুতুবমিনার প্রাঙ্গণ থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে লেখক সিরি বা আলাই দুর্গ দেখলেন। সুলতান আলাউদ্দিন দুর্গটি তৈরি করেছিলেন। এখানে হাজার স্তম্ভের প্রাসাদ ছিল কিন্তু সিরি বর্তমানে ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে। শেরশাহ এই দুর্গের প্রাচীর ভাঙ্গিয়ে এখানকার পাথর ব্যবহার করে শের-ই-গড় বা শের মন্ডল তৈরি করান। সিরির কাছে রয়েছে রওশন চিরাগ যা ফিরোজ শাহ কর্তৃক নির্মিত রওশন চিরাগ নামক মুসাফিরের সমাধি।
পরবর্তী গন্তব্য তুঘলকাবাদ। ভারতে মুসলমান আমলে তৈরি দুর্গগুলির মধ্যে তুঘলকাবাদ শ্রেষ্ঠ। এটি ১৩২১ থেকে ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়। লালকোট বা সিরি দুর্গের মত বিশালত্ব এখানে না থাকলেও এই দুর্গের নিরাপত্তার রক্ষার যে আয়োজন তা প্রশংসনীয়। এখানে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সমাধি রয়েছে, যা তাঁর পুত্র মোহম্মদ বিন তুঘলক তৈরি করিয়েছিলেন। তুঘলাকাবাদের কাছে অবস্থিত একটি ছোট দুর্গ মোহামুদাবাদ, যেটি মোঃ বিন তুঘলকের তৈরি সেটিও দেখলেন।
তারপর তাঁরা দেখলেন জাহানপানাহ্, যা মুঘলদের ক্রমাগত আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য মোহম্মদ বিন তুঘলকের সৃষ্ট আরেকটি শহর। বর্তমানে ধ্বংসস্তুপে পরিণত এই শহরে একসময় সাতটি দুর্গ ও ৫২ টি দরজা ছিল। হুমায়ুনের সমাধির কাছে নীলাবুর্জ বা নীল সমাধি বলে একটি সুন্দর স্থাপত্য আছে। হয়ত কোন মুসলমান ধর্ম গুরুর সমাধি এটি। এর চকচকে নীল টালির কাজ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর দুই তিন মাইল পশ্চিমে রয়েছে তীর বুর্জ নামে তিনটি সমাধি। ছোটা খান, কালা খান ও বড়া খানের সমাধিগুলি লাল বেলে পাথরের তৈরি। লোদী স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই সমাধিগুলি এখন ধ্বংসের পথে।
এরকম শয়ে শয়ে স্থাপত্য ছড়িয়ে রয়েছে অবহেলিত ভাবে দিল্লির এখানে ওখানে। লেখক নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধি দেখলেন। গুরু নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধির পাশে তাঁর শিষ্য ও মহান কবি আমীর খুসরুর সমাধি রয়েছে। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধি তথা দরগার কাছেই শাহজাহান কন্যা জাহানারা সমাধি। তাঁর সমাধিতে লেখা আছে শাহজাহানের কন্যা ও পবিত্র মানব নিজামুদ্দিন চিস্তির শিষ্যা ফকিরা জাহানারা বেগমের সমাধি এটি। তাঁর শেষ ইচ্ছামত তাঁর সমাধির মাথা খোলা রাখা হয়েছে। তারপর দেখলেন জামাতখানা মসজিদ। এর মধ্যে উপরের ডোম থেকে ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দের একটি ঘন্টা ঝুলছে। তাঁরা নিজামুদ্দিনের কুয়ো দেখলেন, ১৩২১ খ্রিস্টাব্দে তৈরি।
এরপর তাঁদের গন্তব্য ফিরোজাবাদ বা সুলতান ফিরোজ শাহের তৈরি শহর। ফিরোজ শাহের প্রাসাদ ও দুর্গকে ফিরোজ শাহ কোটলা বলা হয়। এখানের জামি মসজিদটি দিল্লির সবথেকে বড় মসজিদ ছিল কিন্তু এখন রয়েছে তার সামান্য ধ্বংসাবশেষ। বর্তমান মসজিদের পাশে একটি পাথরের স্তম্ভ আছে, যেটির সম্পর্কে নানা রকম কাহিনী প্রচলিত। কিন্তু ইউরোপীয় পণ্ডিত জেমস প্রিন্সেপ এর গায়ের লিপির পাঠ করেছেন ও এটিকে অশোকের স্তম্ভ লিপি বলে পরিচয় দিয়েছেন। এটি ফিরোজ শাহ খিজরাবাদ থেকে এখানে আনিয়ে স্থাপন করান। সিরাত-ই-ফিরোজশাহী নামে ফিরোজ শাহের জীবনী গ্রন্থে এই স্তম্ভকে মিনার-ই-জারিন বা স্বর্ণস্তম্ভ বলা হয়েছে। এই স্তম্ভের গায়ে সম্রাট অশোকের ধর্ম প্রচারের বাণী ছাড়াও অন্যান্য কিছু লিপি খোদিত আছে। দ্বিতীয় লিপিটিতে চৌহান রাজা বিশাল দেবের হিমাদ্রি থেকে বিন্ধ্য পর্যন্ত জয়ের কথা লেখা, ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দে। এছাড়া গুপ্ত প্রভৃতি যুগের কিছু লিপিও আছে স্তম্ভের গায়ে। শেষ লিপি আছে ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইব্রাহিম লোদীর নামে। ফিরোজ শাহ মিরাট থেকে আরেকটি অশোক স্তম্ভ আনিয়ে ছিলেন ও সেটি তার কুশক শিকার প্রাসাদ (এটি বর্তমান তিন মূর্তি ভবনের ভিতরে অবস্থিত) প্রাঙ্গনে স্থাপন করিয়েছিলেন। এটি ফারুকশিয়ার বাদশাহ থাকার সময় কামানের গোলায় ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে। কালাম মসজিদ তুর্কমান গেটের কাছে অবস্থিত ১৩৮৭ তে তৈরি মসজিদ। কালান বা বড় মসজিদ নামে খ্যাত মসজিদটি ফিরোজ শাহ তুঘলকের আরেকটি স্থাপত্যের নিদর্শন। এই মসজিদে তাইমুর উপাসনা করতে এসেছিলেন দিল্লি আক্রমণ করে ফেরার দিন। ফিরোজ শাহের শাসনকালে খান-ই-জাহান (ফিরোজশাহের প্রধানমন্ত্রী) খিড়কি নামে মসজিদ, দুর্গ ও গ্রাম তৈরি করেছিলেন। মসজিদটি বিশালাকার জালির কাজ যুক্ত করা খিড়কি যুক্ত। এর নিকটে সাতটি খিলানযুক্ত সাতপুল্লা বাঁধ ফিরোজ শাহের নির্মিত (উইকিপিডিয়ায় বলা আছে এটি মোহাম্মদ বিন তুঘলকের আমলে তৈরি)। ফিরোজ শাহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে সবথেকে মহান কাজ হল যমুনা উপত্যকার কাটা সেচের খালগুলি। ফিরোজশাহ কোটলা এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত কিলা রাই পিথোরা বা তুঘলকাবাদেরই মত। কুতুব থেকে ৪-৫ মাইল দূরে হাউস খাস হলো ফিরোজ শাহের সমাধিস্থল। এই সুলতান এত পাঠান স্থাপত্য নিদর্শন রেখে গেছেন কিন্তু তাঁর সমাধি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে এখানে যে সমাধিটি রয়েছে তা হয়তো পরবর্তীকালে পুনর্গঠন করা হয়েছে সস্তা উপকরণ দিয়ে।
ফিরোজ শাহের রাজত্বকালের পর (১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ) তেমন কোন স্থাপত্য হয়নি সুলতান তুঘলক সাম্রাজ্যকালে। এরপর তাইমুরের ভারত আক্রমণের ফলে দিল্লির বহু স্থাপত্য ধ্বংস হয়ে যায়। লোদী বংশের বহলুল লোদীর সমাধি, সিকান্দার লোদীর সমাধি (সফদরজাং -এ) ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না।
এরপর পরবর্তীতে দিল্লিতে স্থাপত্যের কাজ হয় মোগল বাদশাহ হুমায়ুনের আমলে। তিনি পুরানা কিল্লার সংস্করণ করে তার নাম রাখেন দীন-পানাহ্। শেরশাহ দীন-পানাহের নাম পরিবর্তন করে রাখেন শের-ই-গড়। তারপর শেরশাহের পুত্র সেলিম শাহ সেলিম গড় প্রতিষ্ঠা করেন। হুমায়ুন পুনরায় ক্ষমতায় এসে যার নাম দেন নূর গড়। সেলিম গড় ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে।
দিল্লিতে মোগল আমলের প্রথম কীর্তি আজও যা রয়েছে তা হুমায়ুনের সমাধি। এই সমাধি আকবরের মা হামিদা বানু বেগমের নির্দেশে তৈরি হয়েছে। সমাধিটির শ্বেত পাথরের ডোম দূর থেকে দেখা যায়। সমাধির চারদিকে ফুলে ভরা সুন্দর বাগানটি হেঁটে বেড়ানোর জন্য খুব মনোরম। এই সমাধির বাম পাশে তাঁর পত্নী হামিদা বানুর সমাধিও রয়েছে। সিপাহী যুদ্ধের শেষে ব্রিটিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাহাদুর শাহ জাফর (শেষ মুঘল বাদশাহ্) হুমায়ুনের সমাধিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ব্রিটিশদের কাছে ধরা পড়ার আগে। হুমায়ুনের সমাধি চত্বরে আরো কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। যেমন - মোবারক খান খানানের সমাধি (ইনি বাবরের জীবনী তুর্কি থেকে পারসিতে অনুবাদ করেন); ঈশা খানের মসজিদ (ইনি শেরশাহের এক অভিজাত সভাসদ ছিলেন); তাগাহ্ খানের সমাধি (আকবরের প্রধানমন্ত্রী)। মোগল স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন ৬৪ খাম্বা বা ৬৪ পিলার বিশিষ্ট হল। এটি তাগাহ খানের পুত্র খান-ই-আজিম তৈরি করিয়েছিলেন। পুরানা কিলার কাছে অবস্থিত লাল বাংলো ও কালা মহল দুটি মুঘল স্থাপত্যের নমুনা।
আকবর রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার পরে শাহজাহান আবার রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লিতে আনেন। যে নগর শাহজাহান তৈরি করেন, তার নাম দেন শাহাজানাবাদ। বর্তমানে এটি পুরাতন দিল্লি নামে খ্যাত। প্রাচীরে ঘেরা এই নগরে ঢোকার অনেকগুলি দরজা (কাশ্মীরি দরওয়াজা, কাবুল দরজা, তুর্কমান দরওয়াজা, দিল্লী দরওয়াজা, ফরাসখানা দরওয়াজা, রাজঘাট দরওয়াজা আর কলকাতা দরওয়াজা) ছিল। কলকাতা দরওয়াজা থেকে রাজপথ ও রেল স্টেশন যেতে হয়।
দিল্লি গেট দিয়ে শহরে ঢুকলে প্রথমে চাঁদনী চক আসে। রাস্তার দু'ধারে এখানে অসম্ভব জাঁকজমকপূর্ণ দোকান রয়েছে। এখানে যা পাওয়া যায় কলকাতায় তা পাওয়া যায় না। চাঁদনী চকের কাছেই রয়েছে অবশ্য দর্শনীয় জুম্মা মসজিদ। তাজমহলের পরেই ভারতের সবচেয়ে চমৎকার মহল এটি। এটি দিল্লির উচ্চতম মহল ও দিল্লির সব জায়গা থেকে এই মসজিদ দেখতে পাওয়া যায়। জুজুলা পাহাড় নামক ৩০ ফুট উঁচু ঢিপির ওপর অবস্থিত এই জুম্মা মসজিদ। পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ এখানে একসঙ্গে প্রার্থনা করতে প্রার্থনা করতে পারে।
পরবর্তী গন্তব্য দিল্লি দুর্গ যা শাহজাহানের কীর্তি। উঁচু লাল রঙের প্রাচীরে ঘেরা (যমুনা নদীর দিকে প্রাচীর নেই) দুর্গের দরওয়াজা দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমে দেখলেন দেওয়ান-ই-আম বা জনসাধারণের সঙ্গে বাদশাহ্ -এর দেখা করার জায়গা। আগ্রা দুর্গের থেকে এই দুর্গের দেওয়ান-ই-আম আকারে বড়। লাল পাথরের পিলার ও কারুকার্যময় দেওয়ান-ই-আমের দেওয়াল এখন সাদা চুনকাম করা হয়েছে। এটি এখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আস্তানা। শ্বেত পাথরের যে সিংহাসনটি এখানে আছে বলে লেখক শুনেছিলেন, সেটি তাঁকে দেখতে দেওয়া হলো না। এরপর তাঁরা এলেন দেওয়ান-ই-খাসে। এটি ১৫০ ফুট লম্বা, ৪০ ফুট চওড়া, শ্বেত পাথরের স্তম্ভ বিশিষ্ট হল। এই ভবনের মূল্যবান যেসব কারুকার্য ছিল সেসব আর নেই। এখানে একসময় ছিল শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন। অপূর্ব কারুকার্য করা, অগণিত মনি মানিক্য খচিত ময়ূর সিংহাসন, বার্নিয়েরের বর্ণনায় যার হদিশ পাওয়া যায়, সেটি নাদির শাহ লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে। লেখক দেখলেন বেগমদের মহল - রংমহল, মতি মহল। কিন্তু তাঁর মনে হলো সেগুলি বিশেষ কিছু নয়। আসলে বার্নিয়ের প্রমুখের বর্ণনা অনুসারে জানতে পারা সমস্ত প্রাচুর্য বিনষ্ট বা লুণ্ঠিত হয়েছে, সোনা রুপা মূল্যবান পাথর চুরি হয়ে গেছে, শুকিয়ে গেছে ফোয়ারা, ভেলভেট মসলিন প্রভৃতির সাজ বিনষ্ট হয়েছে; পড়ে আছে শুধু পাথরের কাঠামোটুকু। এরপর লেখক বাদশাহের স্নানাগারে গেলেন, যেটি একটি শ্বেত পাথরের ডোম বিশিষ্ট বড় মহল, যেখানে রঙিন কাঁচের জালনা, ফোয়ারা, গরম জল-ঠান্ডা জল আসার নানা রকম ব্যবস্থা, বড় স্নানের চৌবাচ্চা প্রভৃতি রয়েছে। এবার দ্রষ্টব্য তসবীর মহল বা ছবির গ্যালারি। কিন্তু সেখানে কোন ছবি তখন ছিল না। দেওয়ালে সাদা চুল কাম করা হয়েছে। মতি মসজিদ, বাদশাহের উপাসনাগার, এখন অবহেলিত ও হতশ্রী অবস্থায় আছে। এটি বাদসাহ আওরঙ্গজেব তৈরি করিয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের কামানের গোলায় মসজিদের ক্ষতি হয়েছে, সারাইয়ের কাজ চলছে। শাহবাগ বা রাজকীয় উদ্যান যা একসময় অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী ছিল, তা এখন নোংরা, ভগ্ন প্রায় ও পরিত্যক্ত মনে হলো লেখকের। দিওয়ানখানা ও হারেমের কাঠামো ছাড়া আর কিছু এখানে চোখে পড়ে না। ফোয়ারাগুলি শুকিয়ে গেছে।
আগে দিল্লি দরওয়াজা-তে দুটি হাতির পিঠে যোদ্ধার মূর্তি ছিল। এই মূর্তি দুটি রাজপুত বীর জয়মল ও পুত্তের স্মৃতিতে আকবর তৈরি করিয়েছিলেন এবং আগ্রা দুর্গের দরজায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শাহজাহান এই দুটি মূর্তি আগ্রা থেকে এনে দিল্লী দুর্গে রাখেন। আওরঙ্গজেব এটিকে পৌত্তলিকতা ভেবে অন্যত্র সরিয়ে দেন। এখন মূর্তি দুটি অন্যত্র বসানো হবে বলে লেখক শোনেন। (পরে শুধু হাতির মূর্তি দুটি দিল্লি গেটে বসানো হয়। জয়মল ও পুত্তের মূর্তি-দুটি কোথায় আছে তা জানা যায় না)।
(চলছে)