রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

৬৯। তিব্বত অভিযান ২ - শরৎ চন্দ্র দাস



সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


          (আগের পর্বের পরে)

কামবাচান মঠের বড় লামা লেখকদের সহায়তা করলেন। তিনি গোপনে খবর দিলেন যে ওই আধিকারিক গ্রামে এসে পৌঁছানোর আগে লেখকদের গ্রাম থেকে রওনা দিতে হবে চা-থাং-লার উদ্দেশ্যে। 

পরদিন খুব ভোরে যাত্রা করে মাইল তিনেক গিয়ে এল কান-ডুম-চু জলপ্রপাত, যা খুব পবিত্র। এখানে আট জন ভারতীয় সাধু, যাঁরা অষ্টবিদ্যাধর তাং-শ্রুং-গ্যাপা নামে পরিচিত, তাঁরা এখানে স্নান করেছিলেন। হাজার ফুট উঁচু থেকে নামা এই জলপ্রপাত অপূর্ব সুন্দর। পথে একটা ছোট কুন্ড দেখলেন। বৌদ্ধ গুরু পেমা এখানে স্নান করেছিলেন বলে এটি পবিত্র। 

সেদিন সন্ধ্যায় তাঁরা যে গুহায় আশ্রয় নিলেন তার মালিক এক পার্বত্য শেয়াল। গাইড জানাল সেখানে মাস্ক গোট, হিমালয়ের অ্যান্টিলোপ আর নাও  (ওভিস আম্মন) অনেক আছে। স্থানটি ১৮৮২০ ফুট উঁচু। তাঁরা চা আর ভুট্টা খেয়ে রাত কাটালেন। পরদিন পথ চলার সময় লেজহীন একরকম ছোট ছুঁচো দেখলেন যারা নাকি বরফের উপর গজানো মস (moss) খেয়ে থাকে। 

এরপর শুধু বরফ আর বরফ। উনিশ হাজার ফুটের উপর উঠে তাঁদের নিঃশ্বাসের খুব সমস্যা হতে লাগল। সঙ্গে বরফের উপর সূর্যের আলোর ঝলকানিতে চোখে খুব কষ্ট হতে লাগল নীল চশমা থাকা সত্ত্বেও। চলা অসম্ভব হলেও চলতে হল কারণ রাতে থাকার মত কোন জায়গা পাওয়া গেল না। অবশেষে সন্ধ্যে সাতটার সময় একটা জায়গা পেয়ে গাইড রাতে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করল। সেখানে বড় পাথরের ওপর বরফ জমে শক্ত হয়ে আছে। রাতে বরফ গলবে বলবে না বলে পাথর খসে পড়ার ভয় নেই যতক্ষণ না ভোর হচ্ছে। তাই ভোরে আবার যাত্রা শুরু হবে ঠিক করে খালি পেটে তাঁরা বরফের ওপর কম্বল পেতে রাত্রি যাপন করলেন। 


পরদিন ভোরে যেন বরফের সমুদ্রে তাঁদের যাত্রা শুরু হল। বরফে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে আছে। লেখকের পা অবশ হয়ে এল আর চলা যাচ্ছে না। তখন লেখকের পাহাড়ে সাথী গাইড ফুর্চুং তাঁকে পিঠে নিয়ে বেশ কিছু দূর পার করিয়ে দিল। তারপর লেখক আবার চলতে পারলেন। কিন্তু এরপর এল এক বিশাল ঢাল যার উপরে উঠে অন্যদিকে পৌঁছলে রাতে থাকার জায়গা মিলবে। লেখক বারবার পা পিছলে নীচে গড়িয়ে পড়তে থাকেন। তিনি ভাবলেন এবার বরফে ডুবে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। গাইড ফুর্চুং আবার এগিয়ে এল। কুকরি দিয়ে বরফ কেটে লেখককে পা রাখার সিঁড়ি বানিয়ে দিয়ে, তাঁকে হাত ধরে টেনে তুলতে থাকল। অবশেষে সন্ধ্যে ছটায় তাঁরা একটা পার্বত্য গুহায় পৌঁছলেন, যা বেশ বড়, যেখানে রাতে বেশ আরামে থাকা যাবে। আরামে অর্থাৎ বরফের ওপর কম্বল পেতে শোয়া, গুহার ছাদের ফাটল দিয়ে জল পড়ে ভেজা জামা কাপড়ে রাত কাটানো। 

এইভাবে এই পথে সব থেকে শক্ত অংশ চা-থাং-লা পেরোলেন তাঁরা, যা সম্ভবত কুড়ি হাজার ফুট উঁচু। পরদিন ছয় ঘন্টা পাড়ি দিয়ে এই পাস থেকে নামলেন। এরপর তাঁরা চীনের সঙ্গে নেপাল ও সিকিমের সীমান্তে উপস্থিত হলেন। এখানে গাইড খুব ভীত হয়ে পড়ল দোগপাদের জন্য। দোকপারা এই পাস পাহারা দেয়। লেখকরা পর্যটকদের জন্য বন্ধ এই পাসে এসেছেন অবৈধভাবে, তাই তাঁদের পাসপোর্ট কাজে লাগবে না। শাস্তি এড়াতে তাঁরা সন্ধ্যা পর্যন্ত গুহায় লুকিয়ে থেকে রাত্রির অন্ধকারে এক মাইল চওড়া নদী পাথরের উপর দিয়ে পার হলেন। 

এরপর উঁচু পাহাড়ে খাড়াই পথ ধরে এলেন চর্তেন-ন্যিমা-লার দক্ষিণ দিকে। চাঁদের আলোয় অল্প বরফ পড়া মাটিতে কম্বল পেতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন তাঁরা। পরদিন চলার পথ খুব খাড়াই না হলেও কষ্টকর ছিল। তিনদিন কোন খাবার তাঁরা খাননি। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর অবস্থায় আট মাইল হেঁটে চর্তেন-ন্যিমা-লার দক্ষিণ দিকের পাদদেশে পৌঁছালেন তাঁরা। 

ফুর্চুং-এর সাহায্যে লেখক সেই সুউচ্চ পাসের ওপর উঠলেন। নীচে তিব্বতের মালভূমি দেখা গেল। এবার নামার পালা, তিনটের সময় তাঁরা নীচে এক সুন্দর লেকের ধারে নেমে এলেন। আয়নার মতো স্বচ্ছ লেকের জলে চারপাশে শৃঙ্গগুলির আর নীল আকাশের ছায়া পড়েছে। লেক থেকে নির্গত হয়ে চর্তেন ন্যিমা নদী বয়ে গেছে। সেই নদী অনুসরণ করে এবার পথ চলা। ভুট্টা আর চিনি খেয়ে এবার নীচে চলা শুরু হল। হিমালয়ের উত্তর দিকে চারপাশে গাছপালা নেই বললেই চলে (কারণ এই তিব্বত হিমালয় বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে পড়েছে। বৃষ্টিপাত এখানে নগণ্য)। 

সব সময় তাঁদের মনে ভয় যে চর্তেন ন্যিমা গুম্ফাতে যেসব প্রহরী রয়েছে তারা হয়তো দেখে ফেলবে, তাই তাঁরা যতটা সম্ভব বড় বড় পাথরের চাইয়ের আড়াল দিয়ে চলছিলেন। কখনো কোনো পাথর দেখে মনে হচ্ছিল চমরি বা ঘোড়া আসছে। তখন তাঁরা সটান মাটিতে শুয়ে পড়ছিলেন। এইভাবে পাঁচ মাইল পথ পেরিয়ে এক জায়গায় তাঁরা পৌঁছালেন যেখানে অতি প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধদের তৈরি সৌধ আছে। তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, চীন থেকে প্রতিবছর তীর্থযাত্রীরা এখানে আসে। মঠে কোন মানুষ নেই। 

পরবর্তী পথে দু'পাশে সাদাকালো সবুজ রঙের স্লেট পাথর দেখতে থাকলেন, যা এই প্রথম এখানে দেখা গেল। একটানা চলতে চলতে তাঁরা গভীর রাতে তাঁরা থেকং গ্রামের কাছে মূল রাস্তার দেখা পেলেন। তারপর খোলা আকাশের নীচে কম্বল পেতে ঘুম। পরদিন চলার পথে ক'জন পর্যটকের সঙ্গে তাঁদের দেখা হল। তারা সারে চলেছে। লেখককে নেপালি তীর্থযাত্রী বলে পরিচয় দিল গাইড। তাঁরা টাং-লুং নামের একটি গ্রামে আশ্রয় নিলেন একটি বাড়িতে। অনেক গ্রামবাসী তাঁদের দেখতে এল। এসে তারা ভিক্ষা চাইতে লাগল। একজন ফেরিওয়ালা তার স্ত্রীকে নিয়ে তাঁদের কাছে এসে নাচ গান করে গেল তাঁদের শুভযাত্রা কামনা করে। পরদিন ভেড়ার মাংস কিনে খেলেন তাঁরা অনেক দিন পর। ডিমও কিনে নিলেন কিছু। তারপর ঘোড়া ভাড়া করে যাত্রা শুরু হল। 

এবার আরামদায়ক যাত্রা। সুন্দর খান-লা-ডংকি-চু নদীর ধার দিয়ে। থেকে থেকে বার্লি চাষ হয়েছে। চমরি, ভেড়া, ছাগল মাঠে চড়ছে। অজস্র গর্ত থেকে শয়ে শয়ে মারমট এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। একটা ছোট গ্রামে তাঁরা পৌঁছতে জনা কুড়ি গ্রামবাসী এসে তাঁদের কাছে জড়ো হল তাঁরা কি বিক্রি করতে এসেছেন জানতে। লেখকের রিভলবার এবং লামার পিস্তল তাদের পছন্দ হলো ও তারা কিনতে চাইল। মোড়ল চমরি গায়ের লোমের আসনে বসিয়ে বার্লি বিয়ার আর বাটার দেওয়ার চা খাওয়াল। রাতে আরেকটি গ্রামের পথিকদের ছাউনিতে থাকা হলো। 

পরদিন পথে কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে একপাল গাধাকে পেরিয়ে দুপুরে গুরমে নামক শহরে পৌঁছলেন। সেখানে ৬০০ পরিবারের বাস, এরা পশুচারণ করে। নিকটবর্তী পাহাড়ে পশু চড়ায় পশুর চামড়ার তাঁবুতে থে। ফুর্চুং মাংস আর বিয়ার সংগ্রহের জন্য সেই গ্রামে যেতে কুকুর আর গ্রামবাসীরা তাকে ডাকাত মনে করল। পরে সবাইকে দেখে তারা তাঁদের গ্রামে ঢুকতে ও সব খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে দিল। এখানে তাঁরা খবর পেলেন যে কাছে ডাকাতের দল ঘুরছে। লেখক ও লামা তাঁদের বন্দুক, তরোয়াল, ভুটানি ছোরা তৈরি রাখলেন। 

পরদিন যাত্রাকালে দুপুর বেলা বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি হল। ভিজে অবস্থায় তাঁরা মেষপালকদের আস্তানায় আশ্রয় নিলেন। সেই আস্তানায় গোবরের ওপর কম্বল পেতে শুলেন, ভাত আর মাংস রান্না করে খেয়ে। বিকেলে মেষপালকের দল সেখানে ফিরল। তারা সংখ্যায় ৫০০ কম নয়। কুলিরা মেষপালকদের বোঝাল লেখকরা বড় লামা আর ব্যবসায়ী। মেষপালকেরা যেন তাদের বিরক্ত না করে। মেষপালকরা বলল গতকাল ডাকাত এসে তাদের থেকে ভালো ভালো ভেড়া নিয়ে গেছে। লেখকেরা যে ডাকাত নয় তাতেই তারা খুশি। এবার কজন তিব্বতি লেখকদের সহযাত্রী হল। ডাকাতের ভয়ে সবাই সঙ্গী পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হল। ক্যাগো-লা গিরিপথ বেয়ে এবার পথ উতরাই। 

পথে প্রথমে এলো রি নদীর ধার। সেখানে ভেড়া চড়ছে। দুটি বিশাল পাহারাদার তিব্বতি কুকুর অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ভাবে তাঁদের তাড়া করল। তাদের নিরস্ত করা যখন গেল না তখন একটিকে লামা গুলি করে মারল , অন্যটি ফিরে গেল। পরদিন এল লেখকের দেখা প্রথম তিব্বতের বৌদ্ধমঠ রি-গনপা বা রি মনাস্ট্রি। এই প্রাচীন মঠে ৩০০ লামা থাকেন ও তন্ত্র মতে সাধনা করেন। বড় লামা নাকি তুষারপাত নিয়ন্ত্রণ করার বিদ্যা জানেন। অনবরত তুষারপাতের মধ্যে তাঁরা ক্যা-গো-লা পাসের শীর্ষে পৌঁছলেন। সেখানে নদীর পাথরের ওপর কম্বল পেতে বৃষ্টি আর অসম্ভব ঠান্ডায় হাত-পা অসার অবস্থায় রাত কাটালেন। 


সকালে খালি পেটে অত্যন্ত ঢালুপথে পাস থেকে নামতে থাকলেন তাঁরা। বিকেলে একটা গ্রামে চা, বিয়ার আর বার্লি খেতে পেলেন। পরদিন গ্যা-লা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে তার শেষ প্রান্তে লেখকের গন্তব্য স্থল তাশিহুনপো দেখতে পেলেন। নীচে মধ্য তিব্বতের অন্যতম সুন্দরতম দৃশ্য। পেনাম-ন্যাং চু নদী বয়ে যাচ্ছে। নীচে নেমে ক্রমে তাশিহুনপো মঠের সোনালী চূড়া চোখে পড়ল। পথে অনেক লামা, ব্যবসায়ীদের ঘোড়া, চমরি, গাধার পিঠে যেতে দেখা গেল। 

অবশেষে জংরি থেকে যাত্রা শুরু করার ২১ দিন পরে ৭ জুলাই ১৮৭৯ তাঁরা তাশিলহুনপো পৌঁছালেন। এরপর নতুন দেশে, নতুন পরিবেশে লেখকের মানিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম, প্রধান লামা, মন্ত্রী প্রমুখের সঙ্গে কাটানো সময় এইসব আকর্ষণীয় হওয়া সত্ত্বেও ভ্রমণ কাহিনীর অন্তর্গত করে একে ভারাক্রান্ত না করে এখানেই তাঁর ভ্রমণের প্রথম পর্ব শেষ করা হল। তাশিলহুনপোতে থাকার সময় ঘোড়ায় করে তিনি ও লামা উগ্যেন সাংপো থেকে ঘুরে এসেছিলেন। 

এর পরবর্তী পর্যায়ে তিব্বতের যে ভ্রমণ কাহিনী বর্ণিত হবে তা নেওয়া হবে "জার্নি টু লাসা এন্ড সেন্টার টিবেট" নামে শরৎচন্দ্র দাসের লেখা অন্য বইটির থেকে।

                        (চলছে)

৬৮। তিব্বত অভিযান ১ - শরৎ চন্দ্র দাস

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



শরৎচন্দ্র দাস (১৮৪৯-১৯১৭) তাঁর "জার্নি টু লাসা এন্ড সেন্ট্রাল টিবেট"এবং "অটোবায়োগ্রাফি : ন্যারেটিভ অফ দা ইন্সিডেন্টস অফ মাই আরলি লাইফ" নামক দুটি বইয়ে নিজের ভ্রমণ (মূলতঃ তিব্বত) সম্পর্কে যা লিখেছেন, তা এই পোস্টের উপজীব্য বিষয়। যদিও তাঁর ভ্রমণকে ভ্রমণ না বলে অভিযান বলা উচিত। দুটি বই-ই ইংরেজিতে লেখা কিন্তু যেহেতু বইটি বাঙালির ভ্রমণ কাহিনী তাই এই ব্লগের অন্তর্ভুক্ত হল। জার্নি টু সেন্ট্রাল টিবেট বইটি জন মুরে, লন্ডন থেকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। অটোবায়োগ্রাফি: ন্যারেটিভস অফ দ্য ইনসিডেন্স অফ মাই আরলি লাইফ প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে ১৯৬৯-এর মার্চ মাসে। যদিও দ্বিতীয় লেখাটি প্রথমে প্রবাসী নামক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

শরৎচন্দ্র দাস ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যালেরিয়ার কারণে স্বাস্থ্য উদ্ধারের পড়া স্থগিত রেখে দার্জিলিংয়ের ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলের হেডমাস্টারের চাকরি নিয়ে দার্জিলিং যান। জার্নি টু লাসা বইয়ের মুখবন্ধে ডব্লু ডব্লু রকহিল (আমেরিকান কূটনীতিক এবং প্রথম তিব্বতি ভাষা জানা আমেরিকান) লিখেছেন যে কলেজে পড়ার সময় শরৎচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় হয় অ্যালফ্রেড ক্রফটের, যিনি ডাইরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশনস অফ বেঙ্গল ছিলেন। স্যার আলফ্রেডের সহায়তায় শরৎচন্দ্রের তিব্বত যাত্রা ভারত সরকার অনুমোদন করেছিল। যদিও শরৎচন্দ্রের অটোবায়োগ্রাফি বইতে সেরকম কোন উল্লেখ নেই। 

'অটোবায়োগ্রাফি...'বইটিতে শরৎচন্দ্রের প্রথম দার্জিলিং যাত্রা ১৮৭৬-এ, সিকিম যাত্রা ১৮৭৬ ও ১৮৭৭-এ এবং ১৮৭৭-এ তিব্বতের তাশিলহুনপো যাত্রা বর্ণিত হয়েছে। 'জার্নি টু লাসা এন্ড সেন্ট্রাল টিবেট' বইতে ১৮৮১-১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে শরৎচন্দ্রের তিব্বতের লাসা ও মধ্য তিব্বত যাত্রার কথা বর্ণিত হয়েছে। 

দার্জিলিং-এর ভুটিয়া স্কুলে চাকরিতে যোগদান করার সময় সাহেবগঞ্জে ফেরি স্টিমারে কারাগোলা ঘাট গিয়ে সেখান থেকে মোষের গাড়িতে পূর্ণিয়া হয়ে তিনি শিলিগুড়ি যান। শিলিগুড়ি থেকে কালাবাড়ি পর্যন্ত ঘোড়া চলার রাস্তায় পায়ে হেঁটে যান। তারপর কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিং ঘোড়ায় করে যান। সেই তাঁর প্রথম ঘোড়ায় চড়া। 

দার্জিলিং গিয়ে দার্জিলিংয়ের ডেপুটি কমিশনার জন এডগারের কাছে তিনি জানেন যে মূলত সিকিমের রাজার ছেলে ও সিকিমের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ছেলেদের ইংরেজি শেখানোর জন্য এই স্কুল খোলা হয়েছে। উগ্যেন গ্যাটসো নামের এক অল্পবয়স্ক লামাকে পেমিয়াংশী মঠ থেকে আনা হয় তাঁকে সহায়তা করার জন্য। কিছু স্থানীয় ভুটিয়া শিশুও এই স্কুলে ভর্তি হয়। কাজের প্রয়োজনে তিনি ভুটিয়া শিখে যান এবং তিব্বতি ভাষা শিখতে শুরু করেন কারণ দার্জিলিং-এর ভুটিয়ারা তিব্বতি বলত আর সিকিমের ভাষা হল তিব্বতী ভাষার একটি উপভাষা। সঙ্গী লামাও তিব্বতি ও ইংরেজি শিখতে থাকেন। তিব্বতি ভাষা শেখার সময় লেখক এই ভাষার সাহিত্যের গভীরতা ও প্রাচুর্য দেখে মুগ্ধ হন। 

১৮৭৬-এ স্কুলের বালকদের নিয়ে তিনি সিকিমের পেমিয়াংশী সহ কিছু বৌদ্ধ মঠে বেড়াতে গেছিলেন। সেখানে লামাদের মুখে গল্প শুনে ও বই পড়ে তিনি জানেন ভারতীয় পণ্ডিতরা আগে তিব্বতে কত সম্মান পেতেন। মিস্টার এডগার তাঁকে তিব্বত সম্পর্কে আরো বই দিয়ে উৎসাহিত করেন এবং বলেন যে তাঁকে এখানে আনার একটা উদ্দেশ্য ছিল যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে কিছু ভুটিয়া ছেলেকে তিব্বতি হিমালয় অঞ্চলে পাঠানো। সেই সময় তিব্বতে ইউরোপীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ব্রিটিশ সরকার এর আগে দুজন ভারতীয়কে তিব্বত পাঠিয়েছিল বিভিন্ন জরীপ ও তথ্য সংগ্রহের জন্য, তাঁরা হলেন নাইন সিং আর কিষেন সিং, যাঁরা যথাক্রমে ১৮৬৬ ও ১৮৮০ তে লাসায় গেছিলেন। শরৎ চন্দ্র দাসকেও ব্রিটিশরা অভিযানের অর্থ ও প্রয়োজনীয় সাহায্য দিয়ে তিব্বতে পাঠান। শরৎ চন্দ্র দাসের তিব্বতের ধর্ম ও সংস্কৃতি জানার আগ্রহও তাঁর এই অভিযানে যাওয়ার অন্যতম বড় কারণ ছিল।

ফেব্রুয়ারি ১৮৭৭-এ তিনি ভাই নবীনচন্দ্র দাস, লামা উগ্যেন ও সিকিমের সেনাপতি ছেলেদের সঙ্গে আবার সিকিম যান। ইয়াঙ্গাং, তাসিডিং, সংগাং চোলিং, পেমিয়াংশী প্রভৃতি জায়গায় যান তাঁরা। অটোবায়োগ্রাফি বইতে তিনি তাঁর ভাই নবীনচন্দ্র দাসের এই ভ্রমণ সম্পর্কে লেখা কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন, যা এরকম : ২৭শে জানুয়ারি দার্জিলিং থেকে যাত্রা শুরু করে তাঁরা। পায়ে হেঁটে চললেন শ্যাওলা ধরা পাথর আর নুড়ির ওপর দিয়ে। সেখানে প্রকৃত কোন পথ নেই। ঝরনাই পানীয় জলের একমাত্র উৎস। রাতে বাঁশ দিয়ে একটু আচ্ছাদন বানিয়ে শীত এড়ানোর চেষ্টা। সামান্য বাঁশের সাঁকোতে রঙ্গীতের মতো খরস্রোতা নদী পেরতে হয়। এভাবে প্রথমে নামচির বড় বড় পাথরের তৈরি বৌদ্ধ মঠে পৌঁছান তাঁরা। প্রতিটি পাথরে তিব্বতি ভাষায় দেব দেবীর নাম বা মন্ত্র লেখা। মঠের ভিতরের দেওয়ালে বুদ্ধের নানা ভঙ্গিমার ছবি রয়েছে। মঠের সামনে আছে স্তূপ সেখানে বৌদ্ধ পতাকা উড়ছে, তিব্বতি ভাষার ছবির মত হরফে কিছু লেখা নিয়ে। এই পতাকা প্রতিটি ভুটিয়া গ্রামে দেখা যায়, যা অশুভ আত্মাকে সরিয়ে দেয় এই বিশ্বাস আছে তাদের। গুম্ফার লামার আনুকূল্যে সেখানে রাত্রি বাস করে পরদিন ঘোড়ায় চেপে পাহাড় চড়া শুরু হল। মখমলের মতো সবুজ মসে ঢাকা কাণ্ড-ওয়ালা ওক গাছের নিবিড় জঙ্গল আর গাছ থেকে ঝুলে থাকা বিশাল লম্বা লম্বা লতা। একসময় পাহাড় থেকে নামতে হলো ক্রমাগত পিচ্ছিল পথে। ঘোড়ায় নামা অত্যন্ত আশঙ্কা-জনক, রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা। রাতে টিমি নামের এক গ্রামের একটি বাঁশ ও লম্বা ঘাস দিয়ে তৈরি ঘরে রাত্রিবাস। কাঠের তক্তা দিয়ে বাড়িটিতে দুটি তল তৈরি করা হয়েছে। নীচের তলায় ছাগল, শুয়োর থাকে। ঘরের বাঁশের দেওয়ালে মাংস ঝোলানো আছে। ছাদ থেকে ঝুলছে ভুট্টার সারি। কাঠের একটা আলমারিতে বুদ্ধদেবের মূর্তি আছে, সেখানে সারারাত আলো জ্বালানো ছিল। 

১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জুন শরৎচন্দ্র লামা উগ্যেন গ্যাটসোকে নিয়ে সিকিমের ডুবডি থেকে জংরির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। একটু বেলা হতেই চারপাশে জুনিপার, বার্চ, রডোডেনড্রনের এল ওক, চেস্টনাটের জায়গায়। ৯০০০ ফুট থেকে ১২০০০ ফুট উঁচু এই খাড়াইয়ের নাম মন লেপচা। উপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জোক উধাও হয়ে গেল। বিকেল বেলায় জংরি পৌঁছে চমরি গাই পালকদের বড় বড় পাথরের চাই দিয়ে তৈরি বাড়িতে থাকলেন। ঘরের চাল কাঠের। এখানকার মানুষ করাত, পেরেক এসবের ব্যবহার জানে না। এখানকার অসম্ভব সুন্দর জংলি সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সামনে খাবুর, কাং-লা এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষার ধবল শৃঙ্গ। রাতে লেখক সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের দ্বারা তারা দেখে রাস্তা ঠিক করার চেষ্টা করে পারেননি ঘন কুয়াশার জন্য। 

পরদিন গাছের গুড়ির সাঁকো দিয়ে রথোঙ নদী পার হলেন। পথ চলেছে রডোডেনড্রনের বিস্তীর্ণ ঝোপের মধ্যে দিয়ে। এবার ইউম্পাং ও কাং-লার রাস্তার সংযোগ স্থলে এলেন তাঁরা। এখান থেকে সিঙ্গালীলা, ফালুট, সান্দাকফু, টংলুর দিকে পথ চলে গেছে। লেখকেরা চু-রুং নদীর গতিপথ ধরে এগিয়ে চললেন। বেলায় তাঁরা তে গিয়াক-লা পর্বতের কাছে একটা গুহায় আশ্রয় নিলেন। সেখানে তিনজন তিব্বতীর সঙ্গে দেখা হল। তাদের কাছে খবর পেলেন নেপালি আউটপোস্ট রক্ষীরা যাত্রায় বাধা দেবে না। এখানে কোন গাছপালা নেই, শুধু ঘাস আর লাইকেন। ১৪ হাজার ৮০০ ফিট উচ্চতায় রাতে ঠান্ডায় খুব কষ্টকর ভাবে কাটল। 

ভোরে আবার যাত্রা শুরু। সবুজ ঘাসের প্রান্তর আর চারপাশ ঘিরে সূর্য তুষার শৃঙ্গ। তারপর শুধু বড় বড় পাথরের পথ। সেখানে তিনটি ম্যার্মট দেখলেন তাঁরা। এবার তাঁরা কাং-লা শৃঙ্গের নিচে এসে পৌঁছলেন (১৬ হাজার ৩১৩ ফুট)। দুপুরবেলা মধ্য গগনের সূর্যের আলো বরফের ওপর পড়ে যে ঝলকানি তৈরি হয়েছে তাতে তাকানো যায় না। লেখক আর লামা নীল চশমা পড়লেন। কুলি, গাইডরা তাদের চোখের পাতার নীচে চোয়ালে কালো রং করেছে, এই উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণ প্রতিহত করার জন্য। গাইড ফুর্চুং সাবধান করল এক মুহূর্ত অসতর্ক হলে বরফের ওপরে পা ক্রিভাস বা বরফের ফাটলে পড়লে জীবন শেষ। লেখকের ১০০ ইয়ার্ডের মতো দূরে অ্যাভাল্যাঞ্চ বা তুষারধ্বস হতে দেখলেন। 

দূরে পাথরের উপর কিছু পতাকা উড়ছে দেখা গেল। গাইড ফুর্চুং বলল এটা সিকিম ও নেপালের সীমান্ত। আরো এক মাইলের মতো একটি বরফে ঢাকা ক্ষেত্র পার হতে হবে। কিন্তু ঢাল দ্রুত বাড়ছে আর নরম বরফ ক্রমাগত সবুজ নালায় পরিণত হচ্ছে। গাইড বলল এটি নিয়াম-গা নদী, যার স্রোত সবথেকে মারাত্মক। এই নদীর জল হঠাৎ বেড়ে গিয়ে সেতু ভেঙে পর্যটকদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নেপালি ভুটিয়ারা এই নদীর পুজো করে। অতি সাবধানে এই অংশ পেরিয়ে তারপর আরো ৫ মাইল হেঁটে তাঁরা একটা সমতল ভূমিতে পৌঁছলেন, যেখানে গাছপালা দেখা গেল। এই জায়গার নাম ফুরপা কারপু। নদীর গতিপথ ধরে আবার এগিয়ে চলা। মাঝেমাঝে বড় বড় পাথর দিয়ে তৈরি চমরিপালক আর পর্যটকদের থাকার কিছু আস্তানা করা রয়েছে। আরো নীচে টুংগা কঙমা এল। এখানে আবার রডোডেনড্রন, জুনিপার গাছ ফিরে এসেছে। তাঁরা উচ্চতা বুঝছিলেন জলের স্ফুটনাঙ্ক এবং কখনো কখনো গাছপালার প্রকৃতি পরিবর্তন দেখে। 


এবার আবার উত্তর পূর্ব অভিমুখে হাঁটা। ইয়ালুং নদী পেরিয়ে ডেচান রোলপা মঠ দেখে সো চুঙ্গা লা পর্বতে ওঠা শুরু হল। খাড়াই পথ প্রায় আড়াই হাজার ফুট উঠতে হল। ইয়ারলুঙ্ নদী এবং ইমা-তারি-চু নদীর মধ্যে চারটি শৈলশিরা মৃগেন-লা, পাংগো-লা, সেওন-লা এবং তামা-লা, যেগুলি ১৪৮০০ থেকে ১৫০০০ ফুট উঁচু, পার হলেন। সন্ধ্যেবেলা তাঁরা কামবা-চান-গিউন্সা গ্রামে এলেন। সেখানে পরদিন মঠে গেলেন। এখানকার লামারা লম্বা কানের দুল পরেন আর মাথায় লম্বা চুল রাখেন। এখানে সবাই তাকে নেপালি লামা, পালবু লামা বলে ভাবছিল। রাতে ভাত, আলু, খাসির মাংস আর মারওয়া বিয়ার দিয়ে ভোজ খাওয়াল গ্রামবাসীরা তাঁদের। লামারা ও গ্রামবাসীরা তাঁদের তিব্বত পৌঁছতে সাহায্য করার অঙ্গীকার করলেন। 


পরদিন আবার কাং-চেন নদীর গতিপথ ধরে চলা। বাঁদিকে জান্নু হিমবাহ রেখে চলতে চলতে বিকেলে নদী পেরিয়ে কামবা-চান গ্রামে পৌঁছে নদীর স্রোতে একটা বার্লি মিল চলছে দেখলেন। চারপাশে বার্লি খেত এই গ্রামে। তিনি দেখলেন কাং-চেন শৃঙ্গের উদ্দেশ্যে গ্রামবাসীদের পুজো দেওয়া - বন্দুক ফাটিয়ে, তীর ধনুক ছুড়ে, অ্যাথলেটিক্স করে। 


মঠের বড় লামা গোপনে খবর দিলেন যে সীমান্তে আধিকারিক এখানে আসছেন এবং তিনি গ্রামবাসীদের আদেশ করেছেন যেন তারা কোনো চমরি বা মেষ বিক্রেতাকে তিব্বতে ঢুকতে না দেয় কারণ সেখানে পশুর মরক শুরু হয়েছে। চাথাং-লা পাসটি পর্যটকদের জন্য সাধারণভাবে বন্ধ থাকে আর কাং-লা চেন পাস খোলা থাকে। এবার লেখক তাঁর তিব্বতে পৌঁছানো নিয়ে অত্যন্ত সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়লেন।

                        (চলছে)

      

বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

৬৭। কাশ্মীর-কুসুম ৩ - রাজেন্দ্রমোহন বসু

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

           
             (আগের পর্বের পরে)

কাশ্মীরের পশ্চিমভাগ : নৌকায় শ্রীনগর থেকে যাত্রা করলে সাফা কদল সেতু পার হলে বাঁদিকে দুধ গঙ্গা প্রবাহিত। কিছুদূর এগোলে বাঁদিকে ফাঁসি কাঠ দেখা যায়। এখানে আগে প্রায়ই দু-একজনের ফাঁসি হতো। বর্তমানে রাজা ফাঁসির আদেশ প্রায় করেন না। এরপর পর্যটকদের জন্য সুন্দর একটি কাঠের বাড়ি আছে। 

তার পর ক্ষীর ভবানী দর্শন। সকালে কুণ্ডের জল সবুজ ছিল যখন লেখক দর্শন করেছিলেন বেলা দশটায় হল গোলাপি। এরপর নদীপথে দু'পাশে গ্রামগুলি, চীনার বন, গালিচার মতো সবুজ ঘাস জমির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলা। 

এ পথের প্রথম হ্রদ হল মানস বল। এই হ্রদের জল অতি গভীর, স্বচ্ছ। নিকটে বাদশা জাহাঙ্গীরের তৈরি বাদশাহবাদের ভগ্নাংশ আছে। এই হ্রদ নীচে অবস্থিত অসংখ্য কুন্ডের জলে পুষ্ট। জলে সাদা ও লাল রঙের পদ্ম বন আছে, যা হ্রদের শোভা দ্বিগুণ করে তুলেছে। সামনের এক অত্যুচ্চ পর্বত থেকে একটি সুন্দর জলপ্রপাত সপ্তধারায় পড়ছে। হ্রদ ও প্রপাতের কাছে রয়েছে একটি প্রাচীন মন্দির। লেখক এই স্থানে ঘাসের উপর রাত কাটাতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না কারণ তিনি শুনলেন রাতে ভাল্লুক প্রকৃতি হিংস্র পশু এখানে জল পান করতে আসে। 

পরবর্তী গন্তব্য উলার হ্রদ। এই হ্রদ এখানকার সর্বাপেক্ষা বৃহৎ হ্রদ। বিতস্তা নদী এর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। অগভীর জলে জলজ লতা, পদ্ম বন আর অনেক মাছ রয়েছে। উলার হ্রদ নৌকায় পার হওয়ার সময় হাওয়ার প্রকোপে নৌকা উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা হয়েছিল। 

এরপর নুরুখালের দিকে উলার হ্রদে প্রবেশ করে লঙ্কাদ্বীপ দর্শন। চারশ বছর আগে মুসলমান নরপতি জালালুর উদ্দীন একটি নির্মাণ করেন। এটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০০ এবং প্রস্থের প্রায় ১৫০ হাত। বড় বড় গাছ বিশেষত তুঁত গাছের নিবিড় অরণ্য এত ঘন যে এখানে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে না। আঙ্গুর ভর্তি লতা গাছগুলির গা বেয়ে উঠেছে। সর্বত্র প্রাসাদ, স্তম্ভের ভগ্নাবশেষ রয়েছে। একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে যেটি হয়তো কোন হিন্দু রাজা পরে স্থাপন করেছিলেন। কাশ্মীরের সুলতান জয়নাল আবেদীন ১৪০৪ -এ হ্রদের মধ্যে জয়নাললঙ্কের কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করিয়েছিলেন। 

এরপর লঙ্কা দ্বীপের বিপরীত দিকে হ্রদের পশ্চিম পাড়ে শকর উদ্দিন পাহাড়। দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে উঠতে হয়। চূড়ায় শকর উদ্দীন নামক বিখ্যাত ফকিরের জেয়ারত অর্থাৎ মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। নীচে উলার হ্রদের দৃশ্য ও হ্রদের পাশের গ্রামগুলির  দৃশ্য এখান থেকে সুন্দর দেখায়। 


হ্রদের দক্ষিণ-পশ্চিম তীরে সোপুর নামের স্থান আছে  পূর্বে এটি একসময় কাশ্মীরের রাজধানী ছিল। এর প্রাচীনতম নাম সুরাপুর। অবন্তিবর্মা নরপতির মন্ত্রী সুর এই শহরের পুনর্নির্মাণ করে করেন বলে এর নাম সুরাপুর। আরো আগে এই স্থানের নাম ছিল কাম্বুরা বা কামপুর। এখানে পর্যটকদের থাকার জন্য দুটি সুন্দর বাড়ি আছে। প্রাচীন দুর্গ, সুন্দর শিব মন্দির ও স্বর্ণচূড়া বিশিষ্ট একটি মসজিদ আছে। এখানকার জলবায়ু খুব স্বাস্থ্যকর তাই ইংরেজরা এখানে ভ্রমণে আসে। মাছ ধরা তাদের প্রধান আনন্দ। 


এবার নৌকায় বিতস্তা নদী পথে বারামুলায় আসা হল। এখানে পিরান (ফিরান) এবং দীর্ঘ তিলকধারী পান্ডারা প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল লেখকদের তাদের যজমান করার জন্য। এখানেও মহারাজা পর্যটকদের জন্য একটি বাংলো করে দিয়েছেন। জানা গেল এক ইংরেজ এখানে গুপ্তধনের সন্ধানে খনন কার্য চালাচ্ছেন। কথিত আছে চীন সম্রাটেরা পরাজিত হয়ে এ দেশ পরিত্যাগ কালে বারামুলার কাছে কোন স্থানে বহুমূল্য রত্ন লুকিয়ে রেখে গেছেন। সেই স্থানে পৌঁছে একটি অতি উচ্চ শিবলিঙ্গ ও ভাঙ্গা মন্দির দেখলেন তাঁরা। শোনা যায় সেটি পাণ্ডবরা প্রতিষ্ঠা করেছিল। তার কাছে সেই গুপ্তধন খোঁজার জায়গা। একটি ছোট ঢিপি, যার সারা গায়ে জঙ্গল আর উপরে হিংস্র জন্তুর বাস, সেখানে খনন কার্য চলছে। সেখানে প্রাচীন ইঁটের গাঁথুনি খননের ফলে দেখা যাচ্ছে। (বারামুলার কাছে অবস্থিত এই স্থানটির নাম উস্কুর। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ১৮৬৯-'৭০ এ এখানে বৌদ্ধমঠ জয়েন্দ্র বিহারের অবশেষ  উদ্ধার করেছে এখানে। বৌদ্ধ বিহারের অবশেষ থেকে পাওয়া গান্ধার রীতিতে তৈরি টেরাকোটার বুদ্ধমূর্তি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আছে। ১৮৬৯ ভ্রমণ কালে এই খননকার্য বা তার পূর্ববর্তী অনুসন্ধান নিশ্চয়ই দেখেছিলেন লেখক। কুশান রাজা হুবিষ্ক -র নামে এই জায়গার নাম ছিল হুসকাপুর, তার থেকে উস্কুর। হিউয়েন সাং তাঁর লেখায় এই মঠের কথা লিখেছেন। 

লেখক বলেছেন কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক খনিজ সম্পদ আছে যেগুলি এখনো খনন কার্যের ফলে উদ্ধার করা যায়নি। যাতায়াতের পথে চন্দ্রভাগা নদীতে তিনি নিজেই সোনা এবং রুপো মেশানো পাথর পেয়েছিলেন অনেক পরিমাণে। 

বারামুলা নাম হয়েছে বরাহমুলা থেকে কারণ প্রবাদ আছে যে এখানে বরাহ অবতার ছিলেন। এখানকার এক পর্বতগাত্রে বরাহের খুরের চিহ্ন আছে। আর আছে রামকুন্ড, সীতাকুণ্ড, সূর্যকুন্ড প্রভৃতি অনেক কুন্ড ও তীর্থ। বিতস্তা নদী বারামুলা অতিক্রম করে সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এখানে তার স্রোত তীব্র ও ভয়াবহ। এখানে আর নৌকা যেতে পারে না। 

কাশ্মীরের অধিকতাকে মর্গ বা ক্ষেত্র বলে। নানা রকমের ফুল ফুটে মর্গগুলি অপরূপ শোভা ধারণ করে পর্যটকদের মুগ্ধ করে। গুলমর্গ সবথেকে বেশি সুন্দর। শ্রীনগর থেকে জল ও স্থলপথ মিশ্র করে এখানে যেতে হয়। মর্গের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে এবং পাশের গিরিশ্রেণীর অধিকাংশ অংশে ফুল ফুটে থাকে এই সময়। যত দূর দৃষ্টি যায় ফুল ছাড়া কিছু দেখা যায় না। এখানে পর্যটকদের কোন থাকার জায়গা নেই। ভ্রমণকারীরা নিজের নিজের শিবির স্থাপন করে বাস করে। এর কাছে অনেক গুজ্জর অর্থাৎ গোপালক এবং চোপান বা মেষপালকরা বাস করে। তাই দুধ, দই, ঘি, মাংসের অভাব এখানে হয় না। অন্য দ্রব্য বহু দূর থেকে নিয়ে আসতে হয়। 


খিলানমার্গ আরেকটি রমনীয় মর্গ। যদিও এটি বৃহত্তর কিন্তু ফুলের দিক থেকে গুলমার্গের থেকে কম সৌন্দর্য এখানকার। 

লোলাব একটি অতি উত্তম অঞ্চল। দৈর্ঘ্যে ১৫ মাইল, প্রস্থে কোন কোন স্থানে অতি সংকীর্ণ কোন কোন স্থানে তিন মাইল পর্যন্ত প্রসারিত। চারদিকে সুউচ্চ গিরিশ্রেণী। মধ্যে দিয়ে বড় একটি নদী (লাওল নদী) প্রবাহিত। এখানে ভূমি খুব উর্বর। তুঁত, বাদাম, আখরোট, চিনারের অনেক উদ্যান আছে। তিরিশটির মত গ্রাম নিয়ে এই অঞ্চল তৈরি। জলবায়ু শীতল ও স্বাস্থ্যকর। শিকারিদের স্থান খুব প্রিয় স্থান এটি। ভাল্লুকরা ফল পাকলে দলে দলে এখানে আসে। তাই এই স্থানকে অনেকে ঋক্ষ বন বলে। 


কাশ্মীরের উত্তর অংশ লোলাব অঞ্চলের মতো শ্রীনগরের উত্তর-পূর্ব ভাগে লার নামে একটি অপূর্ব অঞ্চল আছে। এই উপত্যকা দিয়ে সিন্দ নদী (সিন্ধু নদী নয়) প্রবাহিত। দ্রাস, লাদখ, ইয়ারকন্দ যাওয়ার পথ এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে গেছে। আকাশ ছোঁয়া তুষার মন্ডিত পর্বত; চির, ভুর্জপত্রের অরণ্য, সুস্বাদু ফলের বাগান আর গালিচার মতো সবুজ দূর্বায় ঢাকা এই উপত্যকা অসম্ভব সুন্দর। আঙুর, পিচ, আখরোট, নাশপাতি, আপেল ফল চারদিকে ফলে থাকে। নদীর দুধারে ছোট ছোট গ্রাম আছে। তাদের চারপাশে শস্যের ক্ষেত। এই স্থান শিকারের জন্য ভালো। এখানকার জলবায়ু উত্তম। তাই সম্ভ্রান্ত কাশ্মীরীরা এবং পর্যটকেরা শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে এই স্থানে কিছুদিন কাটিয়ে যায়। এই উপত্যকার উত্তর পশ্চিম প্রান্তে কয়েকটি সুন্দর কিন্তু জীর্ণ মন্দির আছে। এখানে একটি পবিত্র ঝর্ণা বা বল আছে। পাথরের তৈরি কুন্ড বা চশমা আছে, তাকে নাগবল বলে। গঙ্গাবল একটি অতি সুন্দর পার্বত্য হ্রদ। এটি হরমুখ পর্বতের ১৬৯০০ ফুট উঁচু শিখরে অবস্থিত। এটি বিতস্তা নদীর উৎস স্থল ও হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ। কাশ্মীরি পন্ডিতের কাছে এই গঙ্গাবল গঙ্গার মতো পবিত্র। প্রতিবছর ভাদ্র মাসে এখানে হাজার হাজার যাত্রী সমাগম হয়। 

সিন্দ  উপত্যকার উত্তর পূর্ব প্রান্তে শ্রীনগর এবং শ্রীনগর থেকে ৫ আড্ডা অর্থাৎ ৫ দিন দূরে সোনামর্গ বা স্বর্ণময় ক্ষেত্র। সোনমার্গ পর্যটকদের কাছে গুলমার্গের সমান বা বেশি জনপ্রিয়। এখানে মহারাজা পর্যটকদের জন্য কয়েকটি বাসগৃহ তৈরি করে দিয়েছেন।

এখানে শেষ হল লেখকের কাশ্মীর ভ্রমণ।

৬৬। কাশ্মীর-কুসুম ২ - রাজেন্দ্রমোহন বসু

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

         
           (আগের পর্বের পরে)

কশ্যপ মুনির আশ্রম ছিল বলে এই রাজ্যের নাম কাশ্মীর আর বর্তমানে কাশ্মীরের রাজধানী হল শ্রীনগর। বিতস্তা (ঝিলম) নদী শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তার উপর সাতটি কাঠের সেতু দিয়ে শহরের দুটি দিক যুক্ত হয়েছে। সেতুকে এখানে কদল বলা হয়। মানুষজন এখানে নদীতে সবসময় নৌকায় যাতায়াত করে। এখানকার সব বাড়ি কাঠের শুধু মহারাজার ও অল্প কজন ধনী ব্যক্তির সুন্দর অট্টালিকা আছে। রাজবাড়ী শের গড়ী প্রাসাদ বিতস্তা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৮৬৯ -এ লেখক যখন এখানে আসেন তখন একবার বর্ষায় নদীতে জলোচ্ছ্বাস হয়ে নদীর তীরের সব কাঠের বাড়ি ভেঙে চুরমার হয়েছিল। 

শ্রীনগরের কাছে একটি হ্রদ আছে ডাল লেক, ডল কথার অর্থ হল সাধারন অর্থাৎ এটি সর্বসাধারণের হ্রদ। এই হ্রদের জল বৃদ্ধি পেলে শ্রীনগর শহর প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই নদী ও হ্রদের মধ্যে একটি বাঁধ আছে। 

শ্রীনগরে এসে নৌকা করে এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত নদীপথে ভ্রমণ করলে সব দেখা যায়। শহরে ঢোকার মুখে মহারাজা বিভিন্ন বাংলো অর্থাৎ বিশ্রামাগার নির্মাণ করে দিয়েছেন, যেগুলি মূলত ইংরেজ পর্যটকদের থাকার জন্য ব্যবহৃত হয়। 

রাজবাড়ী দেখতে অনেকটা সাধারণ কিন্তু নদীর পাড়ে অবস্থিত পাথরের তৈরি এই প্রাসাদ খুব রমণীয় লাগে। রাজবাড়ীর দিকের পাড়ে অবস্থিত গদাধর দেবের সুন্দর সোনার চূড়াযুক্ত মন্দির আছে। শহরে বেশ কিছু খাল আছে সেগুলি নদীর সঙ্গে যুক্ত। খালগুলির ওপর কদল বা সেতু রয়েছে। রাজবাড়ীর বিপরীত দিকে বসন্ত বাগ। এখানে কালো পাথরের একটি উঁচু আসন আছে। প্রতিবছর এখানে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে গদাধর দেবকে এনে গোবর্ধন পূজা ও অন্নকূট উৎসব হয়। এই উৎসবে মহারাজা সমগ্র প্রজাদের অন্নদান করেন। হিন্দু ও মুসলমানদের খাদ্য প্রস্তুত হওয়ার আলাদা স্থান নির্দিষ্ট আছে। নিকটে সাহ হমদানের জেয়ারৎ অর্থাৎ মসজিদ আছে। এটি কাশ্মীরের অতি প্রাচীন ও অত্যুৎকৃষ্ট মসজিদের একটি। কথিত আছে এখানে পূর্বে কালীমন্দির ছিল, তার উপরে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। এই মসজিদের কাছে নদীর অপর পাড়ে নয়া মসজিদ বা পত্তর মসজিদ নামক বেগম নুরজাহানের প্রতিষ্ঠা করা মসজিদ রয়েছে। এরপরে নদীর ডান পাড়ে বাদশাহ জালালউদ্দিনের (পঞ্চদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরের রাজা। ইনি শিল্প সাহিত্য বিষয়ে কাশ্মীরের অনেক উন্নতি করেছিলেন) সমাধি রয়েছে। শোনা যায় তিনি প্রথম তুর্কিস্তান থেকে কাশ্মীরে শালশিল্প, কলমদানির কাজ ও কাচ তৈরি শিক্ষা এনেছিলেন। তাঁর নামে জানা কদলের নাম হয়েছে। 

হিন্দুদের শঙ্করাচার্যের টিব্বা বা পাহাড় মুসলমানদের কাছে তখত-ই সলিমান বা সলোমনের সিংহাসন নামে খ্যাত। এই টিলায় ওঠার দুটি পথ আছে কিন্তু শেষের অংশে এত দুর্গম পথ যা অতি সাবধানে হামাগুড়ি দিয়ে ওঠা নামা করতে হয়। এখানে শিবের মন্দির ও আরো কয়েকটি মন্দির রয়েছে। যে পাথরে তৈরি এই মন্দির তা এই পাহাড়ের নয়। এত বড় বড় খন্ডের পাথর এত উপরে কী করে প্রাচীন সময়ে তোলা হয়েছিল তা ভেবে বোঝা যায় না। হরি পর্বত শ্রীনগরের আরেকটি ছোট টিলা। ১৫৯০-এর বাদশা আকবর এখানে দুর্গের প্রাকার নির্মাণ করেন কিন্তু দুর্গ গঠন করা হয়নি। ভিতরে ছোট মন্দির, কামান ছাড়া কিছু নেই। এই দুই টিলার উপর থেকে শ্রীনগরের দৃশ্য খুব সুন্দর দেখায়। 

শের গড়ী বা রাজবাড়ীর সামনে থেকে চুটকোল নামে একটি খাল বিতস্তা নদীর সঙ্গে ডাল লেককে সংযুক্ত করেছে। এই খালের শুরুতে মহারাজার পালিত হাঁসের দল খেলা করে বেড়ায় আর রাজার নানা রকম রাজ তরী এখানে রাখা থাকে। আধ ক্রোশ দূরে ড্রোগজন বা হ্রদের দ্বার। যখন নদীতে জল কমে থাকে তখন তার কপাট খোলা আর জল বেশি হলে নিজে থেকে কপাট বন্ধ হয়ে যায়। তাই নদীতে জলোচ্ছ্বাসে হ্রদের জল বাড়ে না। এই হ্রদে পদ্ম, কুমুদ প্রভৃতি ফুটে থাকে। এখানকার অনেকে পদ্মপাতায় খাবার খায়। থালার পরিবর্তে এই হ্রদের কিছু অংশে ভাসমান কৃষিক্ষেত্র, কুঁড়েঘর রয়েছে। এই ভাসমান জমি কাশ্মীরীরা তৈরি করে। হ্রদের যে জায়গার জলের গভীরতা কম সেখানে তারা জলজ লতাপাতা, গুল্ম দেড় হাত মতো রেখে কেটে দেয়। তার উপর লতা ও মৃত্তিকা জমিয়ে জমিয়ে তা দৃঢ় করে তোলা হয়, পরে এই জমিতে কৃষি কাজ হয়। জলে যাতে এই ভূখণ্ড ভেসে না যায় তাই লম্বা ও মোটা কাঠ দিয়ে স্থানে স্থানে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। 

হ্রদের পশ্চিম দিকে হজরতবল গ্রামে একটি বড় মসজিদ আছে। সেখানে হজরত মোহাম্মদের শ্মশ্রুর কেশ রক্ষিত আছে বলে কথিত। এখানে প্রতি বছর চারটি মেলা হয়। সেখানে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে উপস্থিত হয়। এই উপলক্ষে ডাল লেকে নৌকা প্রতিযোগিতা হয়। 

চার চিনার একটি ছোট দ্বীপ ডাললেকে, যাতে চারটি চিনার গাছ আছে। নাসিম বাগ, শালিমার বাগ, নিশাত বাগ, চশমা শাহী প্রভৃতি মনোরম ক্রীড়া উপবন রয়েছে। উপবনগুলিতে কৃত্রিম জলপ্রপাত, ফোয়ারা এবং ধাপে ধাপে তৈরি বাগান আছে। এখানকার এইসব বৈশিষ্ট্য বাংলা প্রভৃতি সমতল ভূমিতে অনুপস্থিত। ডাল হ্রদের মধ্যে নিশাত বাগের কাছে একটি ছোট দ্বীপ আছে যার নাম সোনালং অর্থাৎ সুবর্ণ দ্বীপ। এখানে ইঁট পাথরের পুরাতন ইমারতের ধ্বংস চিহ্ন দেখা যায়। 

হ্রদের অনুচ্চ পাহাড়ের গায়ে আছে পরিমহল নামের জাহাঙ্গীর বাদশা নির্মিত  মহলের ধ্বংসাবশেষ। এখান থেকে হ্রদের দৃশ্য অপূর্ব। 

এবারে লেখক কিছু অদ্ভুত নৈসর্গিক ব্যাপারের কথা লিখেছেন, যার ব্যাখ্যা তিনি পাননি। যেমন ক্ষীর ভবানী দেবীর মন্দিরের কুন্ডের জল নিয়ত বর্ণ পরিবর্তন করে। নীল হলুদ প্রভৃতি রং হয়। জল লাল হলে মনে করা হয় অশুভ লক্ষণ, দেবী কুপিত হয়েছেন। 
শ্রীনগরের ডানদিকে ডেনসু নামক পরগণায় বনহামা (বনাহামা, বুদগাম জেলা) নামে একটি গ্রাম আছে। সেখানে একটি কুড়ি হাত চওড়া নালা আছে যেটি সারা বছর শুকনো থাকে। কিন্তু প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এর উপরের উঁচু জমির নানা স্থান থেকে বিন্দু বিন্দু জল নিঃসৃত হয়ে এই নালায় জমে ও এটিকে পূর্ণ করে দেয়। লোকে এখানে পুণ্যস্নান করে, একে জট গঙ্গা বলে। উঁচু জমিকে মহাদেবের জটা ভাবা হয়। 
মাচিহামাতে একটি বড় জলাশয় আছে তাকে হাকের সর (হোকারসার পাখির অভয়ারণ্য) বলা হয়। এই জলাশয় বড় বড় ভাসমান ভূমি খণ্ড আছে। হাওয়ায় এই ভূমিখণ্ডগুলি এদিক ওদিক সরে যায়। ভূমিখন্ডগুলিতে গাছ আছে, গবাদিপশুর পশু চারণভূমি হিসেবে সেগুলি ব্যবহৃত হয়। 
দেবসরে (দেবসার, কুলগাম জেলা) বাসুকি নাগ নামে এক চশমা বা কুণ্ড আছে। বসন্তকালের আগমন থেকে শস্য পাকা পর্যন্ত এই কুন্ডে জল থাকে। তারপর এক ফোঁটাও জল থাকে না। ওই জল সরে গিয়ে পিরপাঞ্জাল পর্বতের অপরদিকে গোলাবগড় নামক কুন্ড পূর্ণ করে। এই ভাবে ছয় মাস ধরে চক্র চলতে থাকে। কিন্তু এই দুই কুন্ডের মধ্যে দূরত্ব দশ ক্রোশ হবে। কিভাবে সংযোগ সম্ভব তা বোঝা যায় না। (বর্তমানে এই জল আসা-যাওয়ার খবর দেবসারে আছে কিন্তু কিসওয়ার জেলার গুলাব গড়ে সেরকম কোন তথ্য পাওয়া যায়নি)। 


এরপর লেখক কাশ্মীরের পূর্ব দিকের স্থান আলোচনা করেছেন: পান্দ্রিতন (পান্দ্রেথন মন্দির) একসময় কাশ্মীরের রাজধানী ছিল। সম্রাট অশোক এখানে একটি বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করেন, যেখানে ভগবান বুদ্ধের দাঁত সংরক্ষিত ছিল। এখন একটি দেবালয়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। 

পাম্পুর কেশর বা জাফরানের জন্মস্থান। এটি অনেক পূর্বে পদ্মপুর নামে এক রাজা স্থাপন করেন আগে নাম ছিল পদ্মপুর, যা পদ্ম নামের এক রাজা প্রতিষ্ঠা করেন। কার্তিক মাসে জাফরানের ফুল ফুটলে অপূর্ব শোভা হয়। 
এর দেড় ক্রোশ দূরে ফুকনাগ ও কালীশনাগ নামে লোহা ও গন্ধক মেশানো জলের কুন্ড আছে, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। 
অবন্তীপুর এককালে কাশ্মীরের রাজধানী ছিল। রাজা অবন্তিবর্মা, এটি স্থাপন করেছিলেন এখন কিন্তু এখন কিছু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে মাত্র। 
এর কিছু দূরে পাহাড়ের উপর প্রাচীন মন্দির রয়েছে একে সমাথাং বলে। কথিত আছে কাশ্মীর যখন জলমগ্ন ছিল তখন মহাত্মা কাশ্যপ এই স্থানে বসে সহস্র সহস্র বছর ধরে যোগ ক্রীড়া সাধন করেন। 
বিজবেহাড়া সম্ভবত বিদ্যাবিহার নামের অপভ্রংশ। সম্রাট অশোক এখানে বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। মুসলমান শাসনকালে সিকান্দার নামে এক শাসক সেটি ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি করেন। রাজা গোলাব সিং সেই মসজিদ নষ্ট করে পুনরায় মন্দির নির্মাণ করেন (বিজয়েশ্বর মন্দির)। 
অনন্ত নাগের নাম মুসলমান আমলে ইসলামাবাদ হয় এবং ইংরেজ আমলেও সেই নামই বজায় ছিল। পূর্বে হিন্দু আমলের নাম হল অনন্তনাগ। অনন্তনাগ কুন্ডটি বৃহৎ এবং এর মধ্যে অনেক মাছ খেলা করে। 
অনন্তনাথ থেকে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত মাটন বা মার্তন্ড বা মাত্তান হিন্দুদের একটি পবিত্র তীর্থ। এখানকার সূর্য মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দর্শনীয়। কাশ্মীরেরা একে পান্ডু লড়ী বলে অর্থাৎ পান্ডবদের নির্মিত মন্দির। ভূমজু গুহা মাত্তান-এর কাছের হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ। এখানে কয়েকটি ছোট ছোট ও দুটি দীর্ঘ গুহা রয়েছে। একটি বড় গুহায় একটি মন্দির রয়েছে। 
আচ্ছাবল একটি প্রাকৃতিক ঝরনা সংলগ্ন উপবন যা জাহাঙ্গীর তাঁর প্রিয়তমা পত্নী নুরজাহানের জন্য নির্মাণ করেন। বল শব্দের অর্থ ঝর্ণা। এখানে ফোয়ারা, জলপ্রপাত, জলাশয়, প্রাচীন মহলের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। 
কুক্কুরনাগ (কোকারনাগ) একটি অনেকগুলি ছোট ছোট ঝর্ণার সমাবেশ।
বৈরনাগ (বেরিনাগ) একটি প্রাকৃতিক ঝরনা ও জলাশয়। এখানে প্রাচীন প্রাচীর, পথ, অট্টালিকার ভগ্নাংশ রয়েছে। সম্রাট জাহাঙ্গীর এগুলি তৈরি করেছিলেন। শাহজাহানের কিছু কীর্তিও এখানে ছিল। কোশানাগ (কৌশার নাগ) বা হরীবল বা হরবাল একটি সুন্দর পার্বত্য হ্রদ। এর থেকে কয়েকটি জলপ্রপাত উৎপন্ন হয়েছে। এর মধ্যে হরবল শ্রেষ্ঠ (আহারবল জলপ্রপাত)। 

হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থ অমরনাথ। প্রতি বছর একমাত্র ভাদ্র মাসের রাখি পূর্ণিমার দিন অমরনাথ দর্শন হয়। ওই দিন সহস্র সহস্র যাত্রী সমবেত হয়ে অমরনাথ দর্শন করেন। কোন কোন অবশ্য নির্ভীক সন্ন্যাসী ওখানে দু-তিন মাস থেকে যান। রাখি পূর্ণিমার ১৫ দিন পূর্বে সকলকে সংগ্রহ করার জন্য কাশ্মীরের রাজা ঝান্ণ্ডি বা ছটি বা পতাকা শ্রীনগরের কাছে রামবাগ উপবনে ওড়ানো হয় এবং ৮ দিন আগে শ্রীনগর থেকে যাত্রা শুরু হয়। সন্ন্যাসী ও দরিদ্র তীর্থযাত্রীদের মহারাজা পাথেয় দেন।  অনন্ত নাগে পতাকা পৌঁছলে যে যেখানে থাকে এসে জড়ো হয়। সেখান থেকে আহার্য ও প্রয়োজনীয় সব দ্রব্য কিনে নিয়ে যেতে হয়। কারণ তার পরে আর কিছু পাওয়া যায় না। পতাকাকে অনুসরণ করে সবাই চলে পরবর্তী আটাশ ক্রোশ ৫ আড্ডায় ও ৫ দিনে। পথ এত দুর্গম ও বিপদজনক যে কোন কোন স্থানে পায়ের শব্দ বা কথা বললেও যে কম্পন হয় তাতে পাহাড়ের গা থেকে শিলা বা বড় খসে পড়ে যাত্রীর প্রাণনাস হয়। প্রচুর তুষারপাত হয়। প্রতি বছর অনেক যাত্রীর মৃত্যু হয়। অনেকে অপারগ হয়ে মাঝ পথে ফিরে আসে। এক ক্রোশ থাকতে পঞ্চতরণী, এই ঝর্ণার পাঁচটি শাখা। এখানে স্নান করে যাত্রীরা বস্ত্র ত্যাগ করে ভুর্জপত্রের কৌপিন পরে বা উলঙ্গ অবস্থায় মহাদেবের জয়ধ্বনি করতে করতে গুহায় যায়। শোনা যায় প্রতি পূর্ণিমায় বরফের লিঙ্গ পূর্ণরূপ ধারণ করেন এবং প্রতিপদ থেকে এক এক কলা হ্রাস পেতে পেতে অমাবস্যায় সম্পূর্ণ অদৃশ্য হন এবং পুনরায় ষোলকলা লাভ করে পরের পক্ষকালে। লিঙ্গ ছাড়া গুহায় শিবের বাহন বৃষের মূর্তি ও কিছু দেবদেবীর ভাঙ্গা মূর্তি রয়েছে। পূজা দিয়ে সেদিনই যাত্রীরা প্রত্যাবর্তন শুরু করে, রাত্রি বাস করে না। 

কাশ্মীরের ঠিক কোন স্থানে সতীর কণ্ঠদেশ পতিত হয়েছিল তা সুনির্দিষ্ট করে জানা যায় না বলে সমগ্র কাশ্মীরকে সারদা পীঠ বলে। সোপুর নামক স্থানে সারদা দেবীর প্রতিমূর্তি আছে। কাশ্মীরি অক্ষরকেও সারদা লিপি বলে। (বর্তমান সোপুর নামক স্থান, বারামুলা জেলাতে সারদা মন্দির আছে। আবার আজাদ কাশ্মীরের নীলম নদীর কাছে সারদা পীঠ, প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সারদা বলতে এই দুই স্থানে অবশ্য সরস্বতী দেবীকে বোঝায়। এই সারদার মন্দির শক্তিপীঠ না হয়ে সারদাপীঠ হওয়া উচিত। অনুরূপে সারদাপীঠ শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত দ্বারকা সারদাপীঠ, শৃঙ্গেরী সারদাপীঠ রয়েছে

                         (চলছে)




৬৫। কাশ্মীর-কুসুম ১ - রাজেন্দ্রমোহন বসু

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


'কাশ্মীর কুসুম' বইটি রাজেন্দ্রমোহন বসুর লেখা। এটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে (জ্যৈষ্ঠ, ১২৮২ বঙ্গাব্দ)। (প্রকাশের সাল সম্পর্কে কিছু ছাপার ভুল আছে বলে মনে হয় কারণ ভ্রমণ কাল প্রকাশকালের পরে হতে পারে না)। রাজেন্দ্র মোহন বসু সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতে পারা যায় না। শুধু উৎসর্গে তিনি নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়, তৎকালীন কাশ্মীরের প্রধান বিচারপতি ও জুডিশিয়াল কমিশনারকে বইটি দিয়েছেন এবং বলেছেন যে তিনি তাঁর স্নেহধন্য। লেখা পড়তে গেলে জানা যায় যে তিনি ১৮৭৯ থেকে কর্মসূত্রে অনেকদিন কাশ্মীরে ছিলেন। কাশ্মীর কুসুম বইটির কিছু অংশ মধ্যস্থ পত্রিকায় এর আগে 'কাশ্মীরের বিবরণ' নামে প্রকাশিত হয়েছিল। কাশ্মীর কুসুম বইটির পুরো নাম 'কাশ্মীর কুসুম অর্থাৎ কাশ্মীরের বিবরণ'। এটিকে ভ্রমণ কাহিনী না বলে কাশ্মীর টুরিস্ট গাইড বলা চলে। কিন্তু যেহেতু লেখক ভূমিকায় বলেছেন যে তিনি কাশ্মীরের এই স্থানগুলি নিজে অবস্থান করেছেন বা ভ্রমণ করেছেন তাই এটিকে ভ্রমণ কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এই বইটিতে তিনি ডঃ ইন্সের 'কাশ্মীর হ্যান্ডবুক' এবং কাশ্মীরের দেওয়ান কৃপারামের ফার্সি 'গুলজারে কাশ্মীর' বই থেকে কিছু তথ্য ব্যবহার করেছেন বলে জানিয়েছেন। 


বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যে এখানে যে কাশ্মীরের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেই অবিভক্ত ভারতের কাশ্মীরে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর বা আজাদ কাশ্মীরের প্রশ্ন উঠে না। কারণ পাকিস্তানের তখন জন্ম হতেই ৭০ বছরের বেশি বাকি। সেই কারণে এখানে কাশ্মীর অবিভক্ত। এই সময় কাশ্মীর স্বাধীন কাশ্মীরের রাজার শাসনাধীন। সেই সময় রণবীর সিং (শাসনকাল ১৮৫৬-১৮৮৫) ছিলেন কাশ্মীরের রাজা এবং তাঁর পিতা ছিলেন  মহারাজা গোলাপ সিং (গুলাব সিং, শাসনকাল ১৮৪৬-১৮৫৬), যাঁর নাম এই বইয়ে কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে। 


এখানে মূলত বর্তমান কাশ্মীরের ভ্রমণস্থান ও যাতায়াতের পথের যা যা বর্ণনা হয়েছে সেগুলি আলোচনা করা হবে। তৎকালীন কাশ্মীরের পশ্চিম সীমা হজারা ও রাওলপিন্ডি, পূর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য ৩৫০ মাইল। উত্তরে বালতি বা ইসকার্দু জেলা, কারাকোরাম পর্যন্ত বিস্তৃত। 


লেখকের বর্ণনা অনুসারে কাশ্মীরে যাওয়ার পাঁচটি প্রধান পথ আছে। 

এক) জম্মু ও বনহাল পথ অর্থাৎ আধুনিক কাশ্মীর রাজার পথ (বর্তমান প্রচলিত জম্মু, বানিহাল পাস পথ)। 

দুই) ভিম্বর ও পীরপঞ্জাল পথ বা পুরনো বাদশাহী পথ (ভিম্বর এখন পাকিস্তান শাসিত আজাদ কাশ্মীরের বা পাকিস্থান অধিকৃত কাশ্মীরের স্থান)। অন্তত সুলতানি আমল থেকে এই রাস্তা ছিল। 

তিন) ভিম্বর ও পুঞ্চ পথ। 

চার) মরি পথ। 

পাঁচ) আবোটাবাদ পথ অর্থাৎ পূর্বের আফগান শাসকদের পথ। 


এই রাজপথগুলির মধ্যে শুধু প্রথম পথ দিয়ে কাশ্মীরে প্রবেশ করতে হলে রাজার আজ্ঞা দরকার। পথে যাতে অনায়াসে যানবাহন ও খাবার ইত্যাদি সহজে পাওয়া যায় তার জন্য কাশ্মীরের রাজা বা ইংরেজ গভর্মেন্টের মধ্যে একজনের পরোয়ানা সঙ্গে রাখা দরকার। কিন্তু কাশ্মীর থেকে বেরোনোর সময় রাজার স্বাক্ষরিত আদেশপত্র ছাড়া কেউ বাইরে যেতে পারবে না। সমস্ত পথেই আড্ডা অর্থাৎ অস্থায়ী থাকার জায়গা রয়েছে। সেখানে থাকার ঘর, ঘোড়া, খচ্চর, পালকি, বাহক সহজে পাওয়া যায়। খাদ্য দ্রব্যের দোকান সেখানে আছে। রাজার বিভিন্ন কর্মচারীরা দেখাশুনা করে যাতে যাত্রীদের কোনো রকম কষ্ট না হয়। 


এক নম্বর পথ অর্থাৎ জম্বু ও বনহাল পথে লাহোর থেকে শ্রীনগর ২৭০ মাইল। এই পথে জম্মু থেকে শ্রীনগর ১১ দিনের পথ। লাহোর থেকে জম্বু প্রায় ১০০ মাইলের পথ। এই পথ দংশাল, কিরিমচী (কিরামচী), মীর, লান্দর, বিলাওত, রামবন (রামবান), রামসু, বনহাল (বানিহাল), বৈরনাগ (ভেরিনাগ), অনন্ত নাগ হয়ে শ্রীনগর হয়ে গেছে। রামবানে যেতে হলে চন্দ্রভাগা নদী পার হতে হয়। অবতরণ অতি ভয়ানক। মাঝে পথ অতি দুর্গম, প্রকৃত পথ নেই। অনন্ত নাগ থেকে সকলে নৌকা পথে শ্রীনগরে যায়, নাহলে স্থলপথে সেখান থেকে দুই দিন লাগে শ্রীনগর যেতে। কাশ্মীরের রাজা এই পথে যাতায়াত করেন। 


দুই নম্বর অর্থাৎ ভিম্বর ও পীরপঞ্জাল পথে লাহোর থেকে শ্রীনগর ২৪৬ মাইল। ভিম্বর থেকে শ্রীনগর ১২ দিনের পর। ভিম্বর, সৈদাবাদ, নাওশেরা, চঙগস, রাজৌরী, থন্নামন্ডি, বরমগোলা, পৌশিয়ানা, আলিয়াবাদসরাই, হীরপুর, শোপিয়ান, রামু হয়ে শ্রীনগর। এই পথে চিত্রপানি নদী পঁচিশ বার পার হতে হয়। এই পথে সুন্দর সুন্দর জলপ্রপাত আছে। (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)। 


তিন নম্বর ভিম্বর ও পুঞ্চ পথে ভিম্বর থেকে শ্রীনগর ১৪ দিনের পথ। ভিম্বর, থন্নামন্ডি, সুরন, পুঞ্চ, কেহুটা, আলিয়াবাদ, হাইদ্রাবাদ, উড়ি, নাওশেরা, বারমুলা (বারামুলা) হয়ে শ্রীনগর (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)। বারমুলা থেকে সবাই নৌকায় শ্রীনগর যায়, নাহলে স্থলপথে দুদিনের পথ। 


চার নম্বর বা মরি পথে লাহোর যাওয়া খুব অসুবিধাজনক। রাওলপিন্ডি থেকে ভালো পথ। মরি, দেউল, কোহালা, দন্না, ময়র, চিক্কর, হত্তি, চকোতি, উরি, নওশেরা, বারমুলা হয়ে শ্রীনগর ১৩৭ মাইল মরি থেকে (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)। 


পাঁচ নম্বর পথ অর্থাৎ আবোটাবাদ পথ ১৫৫ মাইল। আবোটাবাদ, মানশেরা, ঘরী, মোজাফেরাবাদ, হতীয়ান, কন্ডা, কথাই, শাহাদরা, গিঙগল, বারমুলা হয়ে শ্রীনগর (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)।


কলকাতাবাসীদের পক্ষে বনহাল, পিরপঞ্জাল বা পুঞ্চ পথ নেওয়া দরকার। অন্য দুটি পথ অতি দূর্গম বলে পীরপঞ্জাল পথ নেওয়ায় ভালো। বনহাল পথে যেতে হলে মহারাজার বিশেষ আজ্ঞা আবশ্যক বটে কিন্তু বাঙ্গালীদের প্রতি কোন নিষেধ নেই। 

{বর্তমানে ভারতের জন্য একমাত্র বানিহাল পথ ছাড়া সব পথ বন্ধ কারণ অন্য পথগুলিতে পাকিস্থান অধিকৃত কাশ্মীরের বা আজাদ কাশ্মীরের কিছু স্থান পড়ছে। এছাড়া শিমলা শহর থেকে পর্বতমালা ও শৈল শিখর দিয়ে দুটি পথ আছে কিন্তু পাঞ্জাব সরকারের বিশেষ অনুমতি না হলে কেউ তা ব্যবহার করতে পারে না। (বর্তমানে সিমলা থেকে লাদাখ হয়ে কাশ্মীরে প্রবেশ করা যায় কিন্তু তা অনেক সুউচ্চ গিরিপথ পেরিয়ে)}। 


সমগ্র পথের প্রতি আড্ডাতে থাকার ভালো বাসগৃহ, চারপাই আর খাবার জন্য চাল, আটা, দুধ, ঘি, মাংস ইত্যাদি পাওয়া যায়। কিন্তু কাশ্মীর উপত্যকার সর্বত্র ভ্রমণের আনন্দ নিতে হলে তাঁবু, ক্যাম্পবেড, মসলা, ডাল, আলু, শীতবস্ত্র, ওয়াটার প্রুফ প্রভৃতি নেওয়া দরকার। যদিও সঙ্গে জিনিস কম হলে চলাচলে সুবিধা। পথে মুদ্রা সঙ্গে রাখতে হবে কারণ পাহাড়িরা নোট চোখে দেখেনি, তারা নোট নিতে চায় না। শ্রীনগরে মহারাজা পর্যটকদের জন্য অনেক বাংলো বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেগুলি ইংরেজ দ্বারা সর্বদা পূর্ণ থাকে। শহরে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলি খুব নোংরা। তাই নৌকায় (হাউস বোট) বাস করা শ্রেয়। এ ছাড়া তাঁবু খাটানোর জন্য উপযুক্ত জমি আছে। 


এক আড্ডা থেকে অন্য আড্ডাতে যেতে যান ও বাহকের মূল্য যেরকম ধার্য আছে তা হল - অশ্ব - আট আনা, ভারবাহী খচ্চর - আট আনা, পালকি - চার আনা, পালকি বাহক - নয় আনা,  ভারবাহক - চার আনা, পিঠঠু - বারো আনা (১ আনা=৬.২৫ পয়সা)। অশ্ববাহকেরা একটি আড্ডার বেশি যায় না। মজুরি পেয়েই তারা আবার স্বস্থানে ফিরে যায়। সুতরাং প্রতি আড্ডায় নতুন নতুন অশ্ব, বাহক প্রভৃতি নিয়োগ করতে হয়। 


লেখক সতর্ক করেছেন দুর্গম পথের অর্থ পার্বত্য দেশে যারা যায়নি তাঁরা বুঝবে না। কাশ্মীর যদি স্বর্গ হয় তো সেখানে যাওয়ার পথ স্বর্গের সিঁড়ির মতোই সুকঠিন।  কাশ্মীরের পথ কোন কোনটি এত খাড়া যে উপরে ওঠার সময় ঝাপানে দড়ি বেঁধে টানতে ও অবতরণের সময় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিতে হয়। এইসব চড়াই ওঠার সময় আরোহী ও দর্শক দুয়েরই হৃদকম্প হতে থাকে। কোন কোন স্থানে প্রকৃত পথ নেই। কোন কোন স্থানে পাথর এত পিচ্ছিল যে পা রাখা কষ্টকর। যে যে জায়গায় পথ আছে সেখানে পথ দুই হাতের বেশি চওড়া না আর এত উঁচু যে নিচে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। শীতকালে এই পথগুলি বড় বরফে ঢেকে সম্পূর্ণ অগম্য হয়ে যায়। কিন্তু এইসব ভয়ংকর পথের সৌন্দর্য অপরিসীম। ফুলে-ফলে ভরা এই দুর্গম পথে কিন্তু ডাকাতি ও চুরির ভয় নেই কারণ মহারাজা গোলাপ সিং (শাসনকাল ১৮৪৬ থেকে ১৮৫৬) অত্যন্ত সুকঠিনভাবে শাসন করে গেছেন। ঝাপানে যাত্রা সম্পূর্ণ নিরাপদ নয় কারণ পথের দুর্গমতা ও বাহকের অসাবধানতায় পড়ে গেলে আরোহীর প্রাণ যেতে পারে। ঘোড়ায় যাত্রাও তেমন নিরাপদ নয়। বনহাল পথ ছাড়া অন্য পথগুলিতে ঘোড়া, উট যায়। মোঘল সম্রাটরা ও পীরপঞ্জাল পথ দিয়ে শত শত হাতি নিয়ে যেতেন সেই বর্ণনা বার্নিয়ার লিখে গেছেন। কিন্তু তার মধ্যে ভীষণ বিপদও ঘটত অনেক সময়ই। এছাড়া অনেকে পিঠঠু বা পিঠে উঠে যায়। বাহকের পিঠে একটি ছোট আসন বাঁধা থাকে তাতে হাত পা মুড়ে বসে যেতে হয়। স্থানীয় কাশ্মীরিরা কিন্তু এই দুর্গম পথে যাতায়াত করে সহজে। এমনকি এক নম্বর পথে মহারাজার ডাক জম্মু থেকে শ্রীনগর প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টায় পায়ে হেঁটে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে পৌঁছায়।


লেখক সতর্ক করেছেন কাশ্মীরে গিয়ে পর্যটকেরা যেন মনে রাখেন তাঁরা এক স্বাধীন রাজার দেশে এসেছেন। তাই মহারাজা, তাঁর আত্মীয়, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের সঙ্গে দেখা হলে যেন তাঁরা যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করেন। যেন সেখানকার সব নিয়ম-কানুন মেনে চলেন। গোপনে কোন দ্রব্য সরকারের মাশুল বাঁচিয়ে নিয়ে না আসেন এবং কোন কাশ্মীরিকে মহারাজের অনুমতি ছাড়া যেন কাশ্মীরের সীমা বাইরে না নিয়ে আসেন।

                        (চলছে)


৬৪। পালামৌ - সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম 


সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ বইটির প্রথম সংস্করণ বৈশাখ, ১৩৫১ অর্থাৎ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। তার আগে পালামৌ শীর্ষক প্রবন্ধগুলি সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১৮৮১ ও ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে (১২৮৭ সালে সপ্তম বর্ষ বৎসরে, ১২৮৮ সালে অষ্টম বছরে এবং ১২৮৯ সালে নবম বছরের বিভিন্ন অংশে যথাক্রমে দুটি, তিনটি ও একটি প্রবন্ধ) প্রকাশিত হয়। 



পালামৌ বইতে লেখকের ভ্রমণকাল লেখক সুস্পষ্টভাবে কখনো বলেননি। তবে এই লেখায় লেখক বারবার বলেছেন যে এই ভ্রমণটি তিনি অনেক আগে করেছেন। তাঁর ভাই সাহিত্য -সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'সঞ্জীবনী সুধা' নামে তাঁর সম্পাদনায় যে বইটি ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে; সেখানে তিনি সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখেছেন। সেটি থেকে জানা যায় যে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম সঞ্জীবন চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর জন্ম হয় ১৭৫৬ শকের বৈশাখ মাসে অর্থাৎ ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৮১১ শকের বৈশাখ মাসে অর্থাৎ ১৮৮৯ এ। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন যে চাকরি জীবনের প্রথম দিকে সঞ্জীবচন্দ্র পালামৌ গেছিলেন। জীবনী মূলক প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বিশেষ সাল তারিখ উল্লেখ করেননি। তবুও তিনি লিখেছেন সঞ্জীবচন্দ্রের লেখা 'বেঙ্গল রায়তস' বইটি লেখায় খুশি হয়ে লেফট্যানেন্ট গভর্নর সাহেব তাঁকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদ উপহার দেন। তখন তিনি কৃষ্ণনগরে নিযুক্ত হন। দুই বছর সেখানে থাকার পরে সরকার গুরুতর কাজের ভার দিয়ে তাঁকে পালামৌ পাঠান। বেঙ্গল রায়তস বইটি ১৮৬৪ তে প্রকাশিত হয়।এর থেকে বোঝা যায় উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষে তিনি পালামৌতে গেছিলেন।


ঔপন্যাসিক প্রবন্ধকার এবং বঙ্গদর্শনের অন্যতম সম্পাদক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আরো কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। কন্ঠ মালা (উপন্যাস), মাধবীলতা (উপন্যাস, জাল প্রতাপচাঁদ (ঐতিহাসিক রচনা)। সঞ্জীবচন্দ্র ব্যক্তিগত জীবনে খুব অগোছালো ছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী হওয়া সত্বেও শিক্ষা লাভ তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পর্যন্ত পাওয়া সত্ত্বেও তিনি চাকরি রক্ষা করতে পারেননি। তেমনি লেখার হাত অত্যন্ত পাকা হওয়া সত্ত্বেও পালামৌ রচনাটি তাঁর স্বভাবসুলভ ভাবেই এলোমেলো। এই বইয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভ্রমণ বিষয়ক অংশ এখানে আলোচনা করা হলো। 


যে সময় তাঁর পালামৌ যাওয়া ঠিক হয় তখন তিনি জানতেন না সেই স্থান কত দূরে, কোথায় অবস্থিত। তারপর ম্যাপ দেখে যাত্রাপথ ঠিক করেন। সেই সময় খুব কম মানুষই পালামৌতে গেছেন। রানীগঞ্জে ইংল্যান্ড ট্রানজিট কোম্পানির ডাকগাড়ি ভাড়া করে রাত্রি দেড় প্রহরের সময় হাজারীবাগের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তিনি। সকালে বরাকর নদীর পূর্বপাড়ে গাড়ি থামল। ছোট নদী সবাই হেঁটে পাড় হয়, গাড়িগুলি দিয়ে ঠেলে পার করানো হল। সেখানে তিনি প্রথম বন্য আদিবাসী নারীপুরুষ, বালকবালিকা দেখলেন। তাঁকে সাহেব বলে ডেকে পয়সা চাইতে লাগল বালকবালিকারা কারণ সম্ভবত তাদের ধারণা যারা গাড়ি চড়ে তারা সাহেব। বরাকর থেকে ছোট পাহাড় প্রথম দেখা গেল। কখনো পাহাড় না দেখা লেখক অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। বিকেলে গাড়ি পাহাড়ের কাছ দিয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি নেমে হেঁটে পাহাড়ের কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু অনেক হেঁটে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন ও বুঝলেন পাহাড়ের দূরত্ব স্থির করা বাঙালির পক্ষে বড় কঠিন। (রাধা নাথ শিকদার বাঙালি হয়েও ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করেন। এই খবর নিশ্চয়ই তাঁর জানা ছিল)। 


পরদিন হাজারীবাগ পৌঁছে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়ি আহারাদি সেরে রাত্রি দেড়টার সময় ছোটনাগপুর যাত্রা করলেন পালকি চেপে। সেখান থেকে দু চার দিনে পালামৌ পৌছালেন। রাঁচি থেকে পালামৌ যাওয়ার সময় দূর থেকে পালামৌর পাহাড়কে মেঘ বলে মনে হচ্ছিল। ধীরে ধীরে পাহাড় ও তারপর জঙ্গল স্পষ্ট হল। 


সেই পাহাড় ও জঙ্গল নিরবচ্ছিন্ন জঙ্গলের রাস্তায় কতগুলি কোল বালক গলায় ঘন্টা বাঁধা মোষেদের চড়াচ্ছিল। তাদের কৃষ্ণ ঠাকুরের মতো দেখতে। গলায় পুতির সাত নরী, তাতে ধুকধুকির বদলে একটা করে গোল আরসি। পরনে ধড়া, কানে বনফুল। তারা খেলা করছে, নাচ করছে। তারা খর্বাকৃতি, কৃষ্ণবর্ণ। তারা রূপবান না কুৎসিত সে বিচার লেখক অসমর্থ। তবে তিনি অনুভব করেছেন যে এই প্রকৃতির কোলে তারা বিশেষ রূপে সুন্দর। 'বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে' সেই প্রবাদপ্রতিম বাক্য এখানে লেখক লিখেছেন। 


পরে পালামৌ পৌঁছে তিনি দেখলেন সেই নিরবচ্ছিন্ন জঙ্গলের মধ্যে নদী, গ্রাম সবই আছে। পাহাড়ের পর পাহাড় যেন সমুদ্রের অবিরত তরঙ্গ। সেই পাহাড়ে কোন শব্দ দীর্ঘস্থায়ী প্রতিধ্বনি তৈরি করে। প্রধানত কোলেদের বাস। দূরে দূরে তাদের গ্রাম ৩০-৩২ টি ঘর নিয়ে। সবকটি পাতার কুটির। 


কোল নারীরা কটিদেশে একটি ক্ষুদ্র কাপড় মাত্র পরিধান করে, উর্ধাঙ্গ অনাবৃত। আভরণে পুতির সাত নরী হার, তাতে আরসি ঝুলছে। কানে ছোট ছোট বনফুল, মাথায় বড় বনফুল। নারী ও শিশু দল বেঁধে এসে লেখকের পালকি দেখে। কোলেদের মধ্যে বৃদ্ধার সংখ্যা অতি অল্প। অশিতিপর না হলে তারা বৃথা হয় না। অতিশয় পরিশ্রমী বলে হয়তো তারা চিরযৌবনা থাকে। পুরুষ জাতির মধ্যে লেখক জীবনী শক্তি কম দেখেছেন। কোলেরা নারী পুরুষ মদ্যপান করে কিন্তু কেউ মাতলামি করে না। 


প্রতিদিন বিকেলে তিনি লাতেহার পাহাড়ে গিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখার জন্য দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করতেন। একটি পাহাড়কে তিনি ভালোবেসে কুমারী নাম দিয়েছিলেন। তার ছায়ায় বসে তিনি প্রতিদিন দূরে চারদিকে পাহাড়ের পরিখার মধ্যে ছোট্ট পৃথিবী দেখতেন। জঙ্গলের মধ্যে গ্রাম থেকে ধোঁয়া উঠত আর হয়তো মাদলের শব্দ ভেসে আসত। তাঁর সাদা তাঁবুটি যেন জঙ্গলের মধ্যে একলা কপোতের মতো দেখাত। এই ছিল লেখকের দুনিয়া। 


একদিন তিনি দেখলেন একটি যুবক বীর দর্পে কয়েকটি স্ত্রীলোকের বারণ অগ্রাহ্য করে বাঘ মারতে যাচ্ছে কারণ বাঘ তার গরুকে মেরেছে। লেখক বন্দুক নিয়ে তার সঙ্গে গেলেন এবং দুজনে মিলে খুঁজে বার করলেন একটি গুহায় নিদ্রারত বাঘটিকে। বিশাল পাথর গড়িয়ে এনে তার আঘাতে যুবক সেই ঘুমন্ত বাঘকে মেরে নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করল। 


একদিন চন্দ্রালোকিত রাতে আমন্ত্রিত হয়ে কোলেদের নৃত্য দেখে এলেন। লেখকের মনে হল তাদের গানের সুর যেন পাহাড়ের মূলে, পাহাড়ের বুকে গিয়ে লাগছে। সেই নাচের তালে যেন আকাশে চাঁদ হাঁসছে। 


লেখক কোলেদের বিবাহ দেখলেন। এদের বিয়েতে কন্যাহরণ করতে হয় আর কোন মন্ত্র তন্ত্র লাগে না। কোলেদের কাছে বৃহত্তম উৎসব হলো বিয়ে। এই উপলক্ষে তারা ১০ থেকে ১৫ টাকা খরচ করে যা তাদের পক্ষে অত্যন্ত বেশি। সেই অর্থ জোগাড় করতে তারা মহাজনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে সারা জীবনের মতো। 


পালামৌ-এর সম্পদ মহুয়া ফুল। মহুয়া ফুল (লেখকের ভাষায় মৌয়া) ঝরে পড়ে গাছের তলায় ছেয়ে থাকে, হাজার হাজার মাছি মৌমাছি গুনগুন করে সেখানে উড়ে বেড়ায়। সেই আওয়াজ বনময় কোলাহলের মত ছড়িয়ে পড়ে। কোলেরা এই ফুল খাবার হিসেবে ব্যবহার করে। শুকিয়ে রাখলে এই ফুল অনেক দিন থাকে। বর্ষাকালে দরিদ্র কোলেরা শুধু এই ফুল খেয়েই ২-৩ মাস কাটায়। তাছাড়া এই ফুলের তৈরি মদ এখানে ব্যবহার হয়। 


এভাবেই ভ্রমণ কাহিনী শেষ হয় লেখকের। বাকিটুকু অজানাই থেকে যায় পাঠকের।

বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

৬৩। ইউরোপে তিন বছর ৯ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - জার্মানি।

২ নভেম্বর ১৮৮৬ থেকে ১৫ ই ডিসেম্বর ১৮৮৬ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ দিনের ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ কালে রমেশ চন্দ্র দত্ত ছটি দেশ এবং তিরিশটি শহর দেখলেন। এরপর লেখক ইউরোপ ভ্রমণার্থীদের জন্য কিছু বক্তব্য রেখেছেন। 


*ইউরোপের প্রতিটি সম্ভ্রান্ত হোটেলে ইংরাজি, ফ্রেঞ্চ ও জার্মান বলা হয়। তাই এর যেকোনো একটি ভাষা জানলে টুরিস্টদের কোন অসুবিধা হয় না।
 
*ব্যাডেকার সিরিজের গাইড বই ভাল। এটি পড়া থাকলে গাইড-এর জন্য পয়সা খরচ করার দরকার হয় না।

* এই ৪৪ দিনের ভ্রমণে তাঁর ৬৬ পাউন্ডের সামান্য বেশি খরচ হয়েছিল। অর্থাৎ প্রতিদিন দেড় পাউন্ড খরচ গড়ে। 

*স্বল্পদিনে বেশি স্থান ঘুরতে হয়েছে বলে খরচ বেশি লেগেছে। যদি এক স্থানে বেশি দিন থাকা হয় তাহলে ইউরোপে হোটেল ভাড়া কম নেওয়া হয়। সাধারণত ইউরোপীয়রা এক দেড় মাস এক জায়গায় থেকে ভ্রমণ করে। 

*তাঁর হোটেল ভাড়া তিরিশ পাউন্ড ও রেল ভাড়া কুড়ি পাউন্ড লেগেছিল। ১৫ পাউন্ড-এ গাড়ি ভাড়া, মিউজিয়াম গ্যালারি ইত্যাদির প্রবেশ মূল্য, মেমেন্টো কেনা, ফটো তোলা প্রভৃতি খরচ হয়েছিল। 

*প্রতিটি দেশের মুদ্রা বিভিন্ন। এটি ভ্রমণকারীর পক্ষে অসুবিধা জনক। যদি সরকার সব দেশে চলে এমন মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ভ্রমণার্থীদের সুবিধা হবে। রমেশ চন্দ্র দত্ত মহাশয়-এর এই দূরদৃষ্টি বহু দিন পর্যন্ত অব্যবহৃত ছিল। পরে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ব্যতীত অন্য যেসব দেশে লেখক ভ্রমণ করেছেন, সেই সব জায়গায় ইউরো নামক একটি সাধারন মুদ্রা প্রচলিত হয়েছে। 


এরপরে লেখক আরেকবার ইউরোপ ভ্রমণ করেন। সেটি মূলত জার্মানিকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ করা হয়। সেই ভ্রমণ কাহিনী তিনি বইয়ের তৃতীয় সংস্করণে যুক্ত করেন। 

১২ ই আগস্ট ১৮৯৩ রমেশ চন্দ্র দত্ত বাইশ বছর পরে আবার জার্মানির কোলন গেলেন। এর মধ্যে ইউরোপের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কোলনে ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দে যে ক্যাথিড্রালের সূচনা হয়েছিল নতুন জার্মান সাম্রাজ্যের সম্রাট উইলিয়াম (প্রথম) ১৮৮০ -তে তার কাজ শেষ করেছেন। সেই বিশাল এবং রাজকীয় ক্যাথিড্রালের বর্ণনা ভাষায় বর্ণনা করা দুষ্কর। 

কোলন থেকে তিনি গেলেন ওয়াইসবাডেন। এটি স্বাস্থ্যধারের স্থান হিসাবে বিখ্যাত। লেখক দেশ থেকে অসুস্থ হয়ে ইউরোপে বায়ু পরিবর্তনে এসেছিলেন। কিন্তু এসেও দেড় মাস ইংল্যান্ডে ম্যালেরিয়ায় অসুস্থ হয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিল সাইটিকা বাতের প্রকোপ। ফলে ওয়াইজবাডেন তাঁর শরীরের পক্ষে ভালো ছিল। এখানকার উষ্ণপ্রস্রবণের জলে প্রতিদিন সকালে স্নান করে এবং সেই জল পান করে অনেকের মতো লেখক মাস খানেকে সুস্থ হয়ে উঠলেন। এখানে তিনি জার্মান ভাষা শিক্ষা করতে থাকেন। 

মাঝে মাঝে আশেপাশের জঙ্গলে, রাইন নদীতে আনন্দ ভ্রমণ করতেন। জঙ্গলে গাছের নীচে বই হাতে গ্রীষ্মের দুপুরে একলা উপভোগ করতে তাঁর খুব ভালো লাগত। অনেক ইউরোপীয় শহরে প্রাকৃতিক জঙ্গল শহরের খুব কাছে সংরক্ষণ করা হয়েছে। জঙ্গলের পথ ধরে পাহাড়ি পথে ওঠা নামা করে, আশেপাশের সোনেনবার্গ, নেরোবার্গ, আইসেনহান্ড প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে আসলেন। কখনো রাইন নদীতে স্টিমারে করে জার্মানির ন্যাশনাল মনুমেন্ট দেখতে গেলেন। ন্যাশনাল মনুমেন্ট জার্মেনিয়ার মূর্তি ৩৩ ফুট লম্বা মূর্তি, ৩৮ ফুট বেদির উপরে বসানো এবং ৭৪০ ফুট পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। (জার্মেনিয়া এক মহিলার মূর্তি যার মাথায় ওক পাতার সজ্জা, ডান হাতে জার্মান রাজকীয় মুকুট এবং বাঁ হাতে খোলা তরোয়াল। জার্মেনিয়া সমগ্র জার্মান জাতির প্রতীক)। 


রাইন নদীর ধারে অবস্থিত কিছু জার্মান শহরে ও নদীপথে ঘুরে এলেন লেখক। বর্তমানে প্রুশিয়ায় অবস্থিত ফ্র্যাঙ্কফার্ট প্রখ্যাত লেখক গ্যোটের জন্মস্থান রূপে ভ্রমণকারীদের কাছে জনপ্রিয়। লেখকের বাড়ি, মূর্তি, পুরনো টাউন হল, ক্যাথিড্রাল এবং ইহুদিদের মলিন বসতি এখানকার দ্রষ্টব্য স্থান। 

রাইন নদীর ধারে আরেকটি শহর মেইন্স। এখানে ছাপাখানার আবিষ্কর্তা গুটেনবার্গের জন্ম হয়েছিল এবং একটি স্ট্যাচু তাঁর স্মরণে এখানে রয়েছে। আরেকদিন তিনি গেলেন ওর্মসে। মার্টিন লুথার কিং-এর জন্মস্থানে। তাঁর স্মৃতিসৌধ, স্ট্যাচু দেখলেন। রাইন নদী ধরে আরও এগোলে রাইনের উপনদী নেকার এসে রাইন নদীতে মেশে। নেকারের পাড়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় নগরী হাইডেলবার্গ। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় জার্মানির মধ্যে সর্বপ্রাচীন। চতুর্দশ শতাব্দীতে তৈরি এখানকার প্রাচীন ভগ্নপ্রায় দুর্গ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। রাইন নদী ধরে আরও এগোলে আসে স্পিরেস। তারপর স্ট্রাসবুর্গ, আলসেক, মেটস, লরাইন প্রভৃতি শহর। এগুলি অনেক যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস বহন করে চলেছে। 

রাইনল্যান্ড অর্থাৎ রাইন নদীর ধারের এই টুকরো টুকরো বেড়ানোর কথা দিয়েই শেষ হয় লেখক রমেশ চন্দ্র দত্তের ১৮৬৮ থেকে ১৮৭১ পর্যন্ত তিন বছর ইউরোপে বাস এবং পরবর্তী ১৮৮৬১৮৯৩ সালে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে তাঁর ভ্রমণকাহিনী। বইটি এত বেশি তথ্য নির্ভর যে পরবর্তীকালে ইউরোপের এই ব্লগে এই দেশগুলির অন্য লেখকদের ভ্রমণ কাহিনী যখন বর্ণিত হবে, তখন এটিকে ভিত্তি হিসেবে রেখে নতুন তথ্য যোগ করা হবে মাত্র। রমেশ চন্দ্র দত্ত মহাশয়-এর ইউরোপের ইতিহাস এবং স্থানগুলি সম্পর্কে এত বিশদ জ্ঞান থাকার কারণে তাঁর লেখা রচনা আজও বহু অংশে প্রাসঙ্গিক।

৬২। ইউরোপে তিন বছর ৮ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - ইতালি , ভ্যাটিকান সিটি।

রমেশ চন্দ্র দত্তের পরবর্তী দর্শনীয় স্থান ভ্যাটিকান সিটি। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ভ্যাটিকান সিটি রোম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক দেশ হিসেবে স্বীকৃত হয়। লেখক যখন ১৮৮৬ -তে সেখানে গেছেন তখন সেটি রোম। তাই তিনি এটিকে রোম বলে নথিবদ্ধ করেছেন। বর্তমানে ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত মধ্যযুগীয় রোমের সর্বোত্তম স্থাপত্য সেন্ট পিটার্স চার্চ। বিশালত্ব ও সৌন্দর্যে পৃথিবীতে অদ্বিতীয় সেই চার্চের প্রবেশপথে দুটি অর্ধচন্দ্রাকার শ্রেণীতে ২৮৪ টি স্তম্ভ রয়েছে। তার উপরে ১৯২ টি সন্তদের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। চার্চে সুউচ্চ মার্বেল স্তম্ভ, সোনার জলের কাজ করা ছাদ, মার্বেলের রাস্তা, পিলার, ব্রোঞ্জ-এর পিলার, ব্রোঞ্জ-এর আচ্ছাদন, বিশাল ডোম, চার্চের উচ্চতা সবমিলিয়ে অসম্ভব আভিজাত্য, জাঁকজমক যুক্ত পরিবেশ স্বপ্নের জগত তৈরি করেছে। সমস্ত স্থাপত্যের পরিমাপ এত নিখুঁত যে ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। এখানে পোপেদের সমাধি ও মূর্তি রয়েছে। মাইকেল এঞ্জেলোর তৈরি বেশ কিছু অসাধারণ মূর্তি আছে। চার্চের সর্বোচ্চ স্থানের উচ্চতা ৬০৭ ফুট। চার্চের বাইরের যে ৭৭ ফুট লম্বা ওবেলিক আছে তা অত্যন্ত প্রাচীন। এটি মিশর থেকে রোমে আনেন সম্রাট ক্যালীগুলা। 


সেন্ট পিটার চার্চ-এর কাছে রয়েছে পোপের প্রাসাদ, যা ১৮৭১ -এর আগে পৃথক সাম্রাজ্য ছিল এবং লেখকের ভ্রমণ কালে তা ইতালির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এই প্রাসাদে অনেক মূল্যবান চিত্রকলা আছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সিস্তিন চ্যাপেলের দেওয়াল জুড়ে মাইকেল এঞ্জেলোর লাস্ট জাজমেন্ট ছবিটি। এই প্রাসাদের পাশে ভ্যাটিকানের মিউজিয়াম অবস্থিত, যেখানে অনেক প্রাচীন ভাস্কর্য রয়েছে। যেমন মাইকেল এঞ্জেলোর অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার। 


রোম থেকে ২৬ মাইল দূরে ভেলেত্রি-তে এলেন লেখক। এটি প্রাচীন ভোলসি উপজাতির শহর। এখানে তাদের প্রাচীন দুর্গ রয়েছে। তারপর প্রাচীন শহর সেগ্নি হয়ে সেপ্রানো পেরিয়ে লেখক নেপলস্ পৌঁছলেন। নেপলস্ শহর অন্যান্য ইতালীয় শহরের তুলনায় অপরিষ্কার, রাস্তায় ভিখারীর উৎপাত আছে। রাজপ্রাসাদ, সেন্ট ফ্রান্সিসকো ডি পাওলো চার্চ, অ্যাকুরিয়াম দেখলেন। একটি ইলেকট্রিক ফিস লেখকের হাতে শক দিল লেখক যখন অ্যাকুরিয়ামে তার গায়ে হাত দিয়েছিলেন। 


ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি দেখার দীর্ঘকালের স্বপ্ন লেখকের এবার পূর্ণ হল। ২৮ ফ্রাঙ্কের বিনিময়ে একটি কোম্পানি ভিসুভিয়াসের ক্রেটারের কাছে নিয়ে যায়। ঘোড়ার গাড়ি শহর ছেড়ে আঁকাবাঁকা পথে পাহাড়ে উঠতে থাকল। ভিসুভিয়াস পর্বতের গায়ে সর্বত্রই লাভার শত সহস্র বছরের আস্তরণ নানা রকম নকশা তৈরি করেছে। পাহাড়ের উপর থেকে নেপলস্ শহরকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। একটা হোটেলে গাড়ি থেকে নেমে তাঁরা দুপুরের খাবার খেলেন। এরপর পাহাড়ের অংশ এত খাড়াই যে ঘোড়া উঠতে পারে না। সেখানে রেলের ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু এই রেল স্টিম বা ইলেকট্রিকের সাহায্যে চলে না। দড়ি ও পুলির সাহায্যে রেললাইন ধরে গাড়ি টেনে উপরে তোলা হয়। এভাবে প্রায় চূড়ায় পৌঁছনো হলো। তাপমাত্রা অনেক কমে গেছে উচ্চতার সঙ্গে। এরপরের অংশ হেঁটে উঠতে হলো। ক্রেটারের কিনারায় দাঁড়িয়ে লেখক দেখলেন নীচ থেকে সালফার মিশ্রিত সাদা ধোঁয়া সবেগে উপরে উঠে আসছে। সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াস থেকে ধোঁয়ার সঙ্গে মাঝে মাঝেই পাথরের টুকরো উৎক্ষেপিত হচ্ছে। নতুন লাভা গড়াতে দেখলেন তিনি ক্রেটার থেকে। এক টুকরো কাগজ ক্রেটারের মধ্যে ফেলতে তা নীচে না গিয়ে ধোঁয়ার চাপে বুলেটের মত তীব্র বেগে উপরে ফিরে এল। 


লেখকের এই সম্পূর্ণ ভ্রমণের মধ্যে সব থেকে বেশি দেখার ইচ্ছা ছিল আঠেরো 'শ বছর ধরে লাভার তলায় থাকা, মাটি খুড়ে পাওয়া পম্পেই। এই শহরের অবশেষ সেই সময়ের মানুষের রোজকার জীবনকে চোখের সামনে দেখা সুযোগ দেয়। সমস্ত প্রাচীন রোমান শহরের মতো পম্পেইতে ফোরাম রয়েছে। সেখানে নেপচুন, জুপিটার, ভেনাস, আইসিস, অগাস্টাস, মার্কারির সুন্দর মন্দির আছে। আছে বিচার সভা, কারাগার, থিয়েটার, আম্ফিথিয়েটার, স্নানাগার, দোকান বাজার, রুটি তৈরির কারখানা ইত্যাদি।হারকিউলানিয়াম গেট, ভেস্টাল কুমারীদের প্রাসাদ, সেসেরোস ভিলা সব দেখলেন লেখক। তবে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি খুব ছোট এবং জানলা নেই। ফলে আলো বাতাস পাওয়ার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। রাস্তাঘাট পাথরে বাঁধানো কিন্তু রাস্তা এমন প্রশস্ত নয়। জল নিকাশি ব্যবস্থা নেই। ঘরের মাপ তখন আশ্চর্যজনক ছোট ছিল এখনকার নিরিখে। সাধারণ মানের গৃহস্থালি দ্রব্য, যেমন - বাতি, তৈজসপত্র প্রভৃতি স্বল্প পরিমাণে এখানে রয়েছে। বেশিরভাগ নেপলসের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। সাধারণ বাড়ির দেওয়ালেও নিম্ন রুচির অশ্লীল ছবি দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ বর্তমানের শালীনতাবোধ ও পাপবোধ তখনকার মানুষের মনে সেভাবে ছিল না। 

ভিসুভিয়াসের পাদদেশে হারকিউলিয়াম আরেকটি শহর যা পম্পেই-এর মত অগ্নুৎপাতে ধ্বংস হয়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বর ৭৯ খ্রিস্টাব্দে। তবে এটি পম্পেই-র মতো লাভার ধুলোতে ঢাকা পড়েনি, গভীর লাভার স্তরে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েছিল। নতুন শহরটি পোর্টিসি, রেসিনা, টরে দি গিরেসো নামের নতুন শহরগুলি এই লাভার স্তরের উপর গড়ে উঠেছে। তাই পম্পেই-এর মত এখানে মাটি খুঁড়ে প্রাচীন সভ্যতা উদ্ধার সম্ভব নয়। বিশাল থিয়েটার হারকিউলানিয়মের একটা অংশ শুধু খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে। এটি সম্ভবত ১০০০০ মানুষের একসাথে বসে দেখার থিয়েটার ছিল। এছাড়া অল্প কিছু সাধারন ঘরবাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে যেগুলির গঠন পম্পেই-এর মতই। 


নেপলসের মিউজিয়ামে পম্পেই ও হারকিউলিয়ামে পাওয়া জিনিসপত্র রাখা আছে। ব্রোঞ্জের তৈরি ছোট বড় নানা মূর্তি, প্রধানত দেব-দেবী রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিনটি হরিণ শিশুর মূর্তি, যাদের একটি ঘুমন্ত, অন্যটি নৃত্যরত ও তৃতীয়টি নেশাগ্রস্ত। তাছাড়া গৃহস্থালির বাসনপত্র, বাতি, ওজন, তুলা দণ্ড, কৃষি যন্ত্র, সূত্রধরের যন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র, অস্ত্রপোচারের যন্ত্র, বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতি রয়েছে। ধনীদের ব্যবহারের সোনা রুপার পাত্র, গয়না রয়েছে। সেই সময়ের খাদ্যশস্য, সবজি, ডিম, ফল প্রভৃতি দেখা যায়। সেই সুদুরের মানুষরা যখন তারা জানতো না হঠাৎ তাদের জীবন থেমে যাবে, তখন তারা এইসব খাদ্যদ্রব্য ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রহ করে রেখেছিল। 


এবার রোম হয়ে লেখক পিসাতে গেলেন অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হলেও আধুনিক পিসা খ্যাত তার হেলানো মিনারের জন্য। এই মিনার বেলফ্রী বা ঘন্টা ঘরে ক্যাথিড্রাল এর এক প্রান্তে অবস্থিত। আট তলা এই টাওয়ার ১৮০ ফুট উঁচু। এটি একদিকে এতটাই ঝুঁকে আছে যে মনে হয় পড়ে যাবে। ক্যাথিড্রালটি একাদশ শতকে তৈরি। বলা হয় এখানকার ব্রোঞ্জ বাতির দোলন দেখে গ্যালিলিও তাঁর পেন্ডুলামের তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। 


পিসা থেকে জেনোয়া আসার পরে ইতালির পর্বতমালা অ্যাপেনাইন ধীরে ধীরে সমুদ্রের কাছে পৌঁছায়। ট্রেন অসংখ্য টানেলের মধ্যে দিয়ে সেই পাহাড় পেরোয়। জেনোয়া অশ্বখুরের আকৃতিতে সমুদ্রের (লিগুরিয়ান সী) তীরে অবস্থিত। পাহাড় যেন এর তিন দিকে প্রাকৃতিক অ্যাম্ফিথিয়েটার তৈরি করেছে। এটি কলম্বাসের জন্মস্থান। এখানে তাঁর স্মৃতিসৌধ তথা মূর্তি আছে শ্বেত পাথরের তৈরি। জেনোয়ায় একাদশ শতাব্দীতে তৈরি  ইটালিয়ান রাজপুরুষদের তৈরি অনেক মধ্যযুগীয় প্রাসাদ আছে। তার মধ্যে এন্ডরিয়া ডোরিয়ার প্রাসাদ লেখক দেখেছিলেন। এই শহরের ক্যাম্পো সান্তো বা সমাধিস্থল অত্যন্ত সুন্দর ও দর্শনীয়।  


এবার তিনি গেলেন জেনোয়া থেকে টুরিন। পথে অ্যাপেনাইন পর্বত ও পিডমন্ট সমতলভূমির অপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল। টুরিন পিডমনটের রাজধানী, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়াও আধুনিক উন্নয়নের জন্য প্রসিদ্ধ। আধুনিকতায় একে প্যারিস, বার্লিন, ভিয়েনার সঙ্গে তুলনা করা চলে। উত্তর দক্ষিণ বিস্তৃত চওড়া সুন্দর রাস্তায় সাজানো শহরটি মনোরম। শহরের বড় বড় রাস্তা, স্কোয়ার, রেল স্টেশনে বৈদ্যুতিক আলো রয়েছে (ইউরোপের রাস্তা ইত্যাদিতে সেই সময় বিদ্যুৎ তেমন ছিল না। যদিও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের রাস্তায় প্রথম বৈদ্যুতিকরণ হয়েছিল)। এখানকার পালাজ্জো মাদাম বা লেডিস প্যালেস দর্শনীয়। ১৩ ডিসেম্বর টুরিন ত্যাগ করে রিভোলি হয়ে মাউন্টা সেনি টানেল দিয়ে আল্পস পর্বত পেরিয়ে তাঁরা মোডেন পৌঁছলেন। এটি সীমানা শহর। এখানে সঙ্গের জিনিসপত্র পরীক্ষা হল। পরদিন তাঁরা প্যারিসে পৌঁছলেন। 

                        (চলছে)

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...