সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪
৬৯। তিব্বত অভিযান ২ - শরৎ চন্দ্র দাস
৬৮। তিব্বত অভিযান ১ - শরৎ চন্দ্র দাস
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪
৬৭। কাশ্মীর-কুসুম ৩ - রাজেন্দ্রমোহন বসু
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
৬৬। কাশ্মীর-কুসুম ২ - রাজেন্দ্রমোহন বসু
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
৬৫। কাশ্মীর-কুসুম ১ - রাজেন্দ্রমোহন বসু
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
'কাশ্মীর কুসুম' বইটি রাজেন্দ্রমোহন বসুর লেখা। এটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে (জ্যৈষ্ঠ, ১২৮২ বঙ্গাব্দ)। (প্রকাশের সাল সম্পর্কে কিছু ছাপার ভুল আছে বলে মনে হয় কারণ ভ্রমণ কাল প্রকাশকালের পরে হতে পারে না)। রাজেন্দ্র মোহন বসু সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতে পারা যায় না। শুধু উৎসর্গে তিনি নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়, তৎকালীন কাশ্মীরের প্রধান বিচারপতি ও জুডিশিয়াল কমিশনারকে বইটি দিয়েছেন এবং বলেছেন যে তিনি তাঁর স্নেহধন্য। লেখা পড়তে গেলে জানা যায় যে তিনি ১৮৭৯ থেকে কর্মসূত্রে অনেকদিন কাশ্মীরে ছিলেন। কাশ্মীর কুসুম বইটির কিছু অংশ মধ্যস্থ পত্রিকায় এর আগে 'কাশ্মীরের বিবরণ' নামে প্রকাশিত হয়েছিল। কাশ্মীর কুসুম বইটির পুরো নাম 'কাশ্মীর কুসুম অর্থাৎ কাশ্মীরের বিবরণ'। এটিকে ভ্রমণ কাহিনী না বলে কাশ্মীর টুরিস্ট গাইড বলা চলে। কিন্তু যেহেতু লেখক ভূমিকায় বলেছেন যে তিনি কাশ্মীরের এই স্থানগুলি নিজে অবস্থান করেছেন বা ভ্রমণ করেছেন তাই এটিকে ভ্রমণ কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এই বইটিতে তিনি ডঃ ইন্সের 'কাশ্মীর হ্যান্ডবুক' এবং কাশ্মীরের দেওয়ান কৃপারামের ফার্সি 'গুলজারে কাশ্মীর' বই থেকে কিছু তথ্য ব্যবহার করেছেন বলে জানিয়েছেন।
বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যে এখানে যে কাশ্মীরের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেই অবিভক্ত ভারতের কাশ্মীরে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর বা আজাদ কাশ্মীরের প্রশ্ন উঠে না। কারণ পাকিস্তানের তখন জন্ম হতেই ৭০ বছরের বেশি বাকি। সেই কারণে এখানে কাশ্মীর অবিভক্ত। এই সময় কাশ্মীর স্বাধীন কাশ্মীরের রাজার শাসনাধীন। সেই সময় রণবীর সিং (শাসনকাল ১৮৫৬-১৮৮৫) ছিলেন কাশ্মীরের রাজা এবং তাঁর পিতা ছিলেন মহারাজা গোলাপ সিং (গুলাব সিং, শাসনকাল ১৮৪৬-১৮৫৬), যাঁর নাম এই বইয়ে কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে মূলত বর্তমান কাশ্মীরের ভ্রমণস্থান ও যাতায়াতের পথের যা যা বর্ণনা হয়েছে সেগুলি আলোচনা করা হবে। তৎকালীন কাশ্মীরের পশ্চিম সীমা হজারা ও রাওলপিন্ডি, পূর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য ৩৫০ মাইল। উত্তরে বালতি বা ইসকার্দু জেলা, কারাকোরাম পর্যন্ত বিস্তৃত।
লেখকের বর্ণনা অনুসারে কাশ্মীরে যাওয়ার পাঁচটি প্রধান পথ আছে।
এক) জম্মু ও বনহাল পথ অর্থাৎ আধুনিক কাশ্মীর রাজার পথ (বর্তমান প্রচলিত জম্মু, বানিহাল পাস পথ)।
দুই) ভিম্বর ও পীরপঞ্জাল পথ বা পুরনো বাদশাহী পথ (ভিম্বর এখন পাকিস্তান শাসিত আজাদ কাশ্মীরের বা পাকিস্থান অধিকৃত কাশ্মীরের স্থান)। অন্তত সুলতানি আমল থেকে এই রাস্তা ছিল।
তিন) ভিম্বর ও পুঞ্চ পথ।
চার) মরি পথ।
পাঁচ) আবোটাবাদ পথ অর্থাৎ পূর্বের আফগান শাসকদের পথ।
এই রাজপথগুলির মধ্যে শুধু প্রথম পথ দিয়ে কাশ্মীরে প্রবেশ করতে হলে রাজার আজ্ঞা দরকার। পথে যাতে অনায়াসে যানবাহন ও খাবার ইত্যাদি সহজে পাওয়া যায় তার জন্য কাশ্মীরের রাজা বা ইংরেজ গভর্মেন্টের মধ্যে একজনের পরোয়ানা সঙ্গে রাখা দরকার। কিন্তু কাশ্মীর থেকে বেরোনোর সময় রাজার স্বাক্ষরিত আদেশপত্র ছাড়া কেউ বাইরে যেতে পারবে না। সমস্ত পথেই আড্ডা অর্থাৎ অস্থায়ী থাকার জায়গা রয়েছে। সেখানে থাকার ঘর, ঘোড়া, খচ্চর, পালকি, বাহক সহজে পাওয়া যায়। খাদ্য দ্রব্যের দোকান সেখানে আছে। রাজার বিভিন্ন কর্মচারীরা দেখাশুনা করে যাতে যাত্রীদের কোনো রকম কষ্ট না হয়।
এক নম্বর পথ অর্থাৎ জম্বু ও বনহাল পথে লাহোর থেকে শ্রীনগর ২৭০ মাইল। এই পথে জম্মু থেকে শ্রীনগর ১১ দিনের পথ। লাহোর থেকে জম্বু প্রায় ১০০ মাইলের পথ। এই পথ দংশাল, কিরিমচী (কিরামচী), মীর, লান্দর, বিলাওত, রামবন (রামবান), রামসু, বনহাল (বানিহাল), বৈরনাগ (ভেরিনাগ), অনন্ত নাগ হয়ে শ্রীনগর হয়ে গেছে। রামবানে যেতে হলে চন্দ্রভাগা নদী পার হতে হয়। অবতরণ অতি ভয়ানক। মাঝে পথ অতি দুর্গম, প্রকৃত পথ নেই। অনন্ত নাগ থেকে সকলে নৌকা পথে শ্রীনগরে যায়, নাহলে স্থলপথে সেখান থেকে দুই দিন লাগে শ্রীনগর যেতে। কাশ্মীরের রাজা এই পথে যাতায়াত করেন।
দুই নম্বর অর্থাৎ ভিম্বর ও পীরপঞ্জাল পথে লাহোর থেকে শ্রীনগর ২৪৬ মাইল। ভিম্বর থেকে শ্রীনগর ১২ দিনের পর। ভিম্বর, সৈদাবাদ, নাওশেরা, চঙগস, রাজৌরী, থন্নামন্ডি, বরমগোলা, পৌশিয়ানা, আলিয়াবাদসরাই, হীরপুর, শোপিয়ান, রামু হয়ে শ্রীনগর। এই পথে চিত্রপানি নদী পঁচিশ বার পার হতে হয়। এই পথে সুন্দর সুন্দর জলপ্রপাত আছে। (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)।
তিন নম্বর ভিম্বর ও পুঞ্চ পথে ভিম্বর থেকে শ্রীনগর ১৪ দিনের পথ। ভিম্বর, থন্নামন্ডি, সুরন, পুঞ্চ, কেহুটা, আলিয়াবাদ, হাইদ্রাবাদ, উড়ি, নাওশেরা, বারমুলা (বারামুলা) হয়ে শ্রীনগর (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)। বারমুলা থেকে সবাই নৌকায় শ্রীনগর যায়, নাহলে স্থলপথে দুদিনের পথ।
চার নম্বর বা মরি পথে লাহোর যাওয়া খুব অসুবিধাজনক। রাওলপিন্ডি থেকে ভালো পথ। মরি, দেউল, কোহালা, দন্না, ময়র, চিক্কর, হত্তি, চকোতি, উরি, নওশেরা, বারমুলা হয়ে শ্রীনগর ১৩৭ মাইল মরি থেকে (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)।
পাঁচ নম্বর পথ অর্থাৎ আবোটাবাদ পথ ১৫৫ মাইল। আবোটাবাদ, মানশেরা, ঘরী, মোজাফেরাবাদ, হতীয়ান, কন্ডা, কথাই, শাহাদরা, গিঙগল, বারমুলা হয়ে শ্রীনগর (এই পথের অধিকাংশ স্থান এখন আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত)।
কলকাতাবাসীদের পক্ষে বনহাল, পিরপঞ্জাল বা পুঞ্চ পথ নেওয়া দরকার। অন্য দুটি পথ অতি দূর্গম বলে পীরপঞ্জাল পথ নেওয়ায় ভালো। বনহাল পথে যেতে হলে মহারাজার বিশেষ আজ্ঞা আবশ্যক বটে কিন্তু বাঙ্গালীদের প্রতি কোন নিষেধ নেই।
{বর্তমানে ভারতের জন্য একমাত্র বানিহাল পথ ছাড়া সব পথ বন্ধ কারণ অন্য পথগুলিতে পাকিস্থান অধিকৃত কাশ্মীরের বা আজাদ কাশ্মীরের কিছু স্থান পড়ছে। এছাড়া শিমলা শহর থেকে পর্বতমালা ও শৈল শিখর দিয়ে দুটি পথ আছে কিন্তু পাঞ্জাব সরকারের বিশেষ অনুমতি না হলে কেউ তা ব্যবহার করতে পারে না। (বর্তমানে সিমলা থেকে লাদাখ হয়ে কাশ্মীরে প্রবেশ করা যায় কিন্তু তা অনেক সুউচ্চ গিরিপথ পেরিয়ে)}।
সমগ্র পথের প্রতি আড্ডাতে থাকার ভালো বাসগৃহ, চারপাই আর খাবার জন্য চাল, আটা, দুধ, ঘি, মাংস ইত্যাদি পাওয়া যায়। কিন্তু কাশ্মীর উপত্যকার সর্বত্র ভ্রমণের আনন্দ নিতে হলে তাঁবু, ক্যাম্পবেড, মসলা, ডাল, আলু, শীতবস্ত্র, ওয়াটার প্রুফ প্রভৃতি নেওয়া দরকার। যদিও সঙ্গে জিনিস কম হলে চলাচলে সুবিধা। পথে মুদ্রা সঙ্গে রাখতে হবে কারণ পাহাড়িরা নোট চোখে দেখেনি, তারা নোট নিতে চায় না। শ্রীনগরে মহারাজা পর্যটকদের জন্য অনেক বাংলো বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেগুলি ইংরেজ দ্বারা সর্বদা পূর্ণ থাকে। শহরে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলি খুব নোংরা। তাই নৌকায় (হাউস বোট) বাস করা শ্রেয়। এ ছাড়া তাঁবু খাটানোর জন্য উপযুক্ত জমি আছে।
এক আড্ডা থেকে অন্য আড্ডাতে যেতে যান ও বাহকের মূল্য যেরকম ধার্য আছে তা হল - অশ্ব - আট আনা, ভারবাহী খচ্চর - আট আনা, পালকি - চার আনা, পালকি বাহক - নয় আনা, ভারবাহক - চার আনা, পিঠঠু - বারো আনা (১ আনা=৬.২৫ পয়সা)। অশ্ববাহকেরা একটি আড্ডার বেশি যায় না। মজুরি পেয়েই তারা আবার স্বস্থানে ফিরে যায়। সুতরাং প্রতি আড্ডায় নতুন নতুন অশ্ব, বাহক প্রভৃতি নিয়োগ করতে হয়।
লেখক সতর্ক করেছেন দুর্গম পথের অর্থ পার্বত্য দেশে যারা যায়নি তাঁরা বুঝবে না। কাশ্মীর যদি স্বর্গ হয় তো সেখানে যাওয়ার পথ স্বর্গের সিঁড়ির মতোই সুকঠিন। কাশ্মীরের পথ কোন কোনটি এত খাড়া যে উপরে ওঠার সময় ঝাপানে দড়ি বেঁধে টানতে ও অবতরণের সময় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিতে হয়। এইসব চড়াই ওঠার সময় আরোহী ও দর্শক দুয়েরই হৃদকম্প হতে থাকে। কোন কোন স্থানে প্রকৃত পথ নেই। কোন কোন স্থানে পাথর এত পিচ্ছিল যে পা রাখা কষ্টকর। যে যে জায়গায় পথ আছে সেখানে পথ দুই হাতের বেশি চওড়া না আর এত উঁচু যে নিচে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। শীতকালে এই পথগুলি বড় বরফে ঢেকে সম্পূর্ণ অগম্য হয়ে যায়। কিন্তু এইসব ভয়ংকর পথের সৌন্দর্য অপরিসীম। ফুলে-ফলে ভরা এই দুর্গম পথে কিন্তু ডাকাতি ও চুরির ভয় নেই কারণ মহারাজা গোলাপ সিং (শাসনকাল ১৮৪৬ থেকে ১৮৫৬) অত্যন্ত সুকঠিনভাবে শাসন করে গেছেন। ঝাপানে যাত্রা সম্পূর্ণ নিরাপদ নয় কারণ পথের দুর্গমতা ও বাহকের অসাবধানতায় পড়ে গেলে আরোহীর প্রাণ যেতে পারে। ঘোড়ায় যাত্রাও তেমন নিরাপদ নয়। বনহাল পথ ছাড়া অন্য পথগুলিতে ঘোড়া, উট যায়। মোঘল সম্রাটরা ও পীরপঞ্জাল পথ দিয়ে শত শত হাতি নিয়ে যেতেন সেই বর্ণনা বার্নিয়ার লিখে গেছেন। কিন্তু তার মধ্যে ভীষণ বিপদও ঘটত অনেক সময়ই। এছাড়া অনেকে পিঠঠু বা পিঠে উঠে যায়। বাহকের পিঠে একটি ছোট আসন বাঁধা থাকে তাতে হাত পা মুড়ে বসে যেতে হয়। স্থানীয় কাশ্মীরিরা কিন্তু এই দুর্গম পথে যাতায়াত করে সহজে। এমনকি এক নম্বর পথে মহারাজার ডাক জম্মু থেকে শ্রীনগর প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টায় পায়ে হেঁটে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে পৌঁছায়।
লেখক সতর্ক করেছেন কাশ্মীরে গিয়ে পর্যটকেরা যেন মনে রাখেন তাঁরা এক স্বাধীন রাজার দেশে এসেছেন। তাই মহারাজা, তাঁর আত্মীয়, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের সঙ্গে দেখা হলে যেন তাঁরা যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করেন। যেন সেখানকার সব নিয়ম-কানুন মেনে চলেন। গোপনে কোন দ্রব্য সরকারের মাশুল বাঁচিয়ে নিয়ে না আসেন এবং কোন কাশ্মীরিকে মহারাজের অনুমতি ছাড়া যেন কাশ্মীরের সীমা বাইরে না নিয়ে আসেন।
(চলছে)
৬৪। পালামৌ - সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ বইটির প্রথম সংস্করণ বৈশাখ, ১৩৫১ অর্থাৎ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। তার আগে পালামৌ শীর্ষক প্রবন্ধগুলি সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১৮৮১ ও ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে (১২৮৭ সালে সপ্তম বর্ষ বৎসরে, ১২৮৮ সালে অষ্টম বছরে এবং ১২৮৯ সালে নবম বছরের বিভিন্ন অংশে যথাক্রমে দুটি, তিনটি ও একটি প্রবন্ধ) প্রকাশিত হয়।
পালামৌ বইতে লেখকের ভ্রমণকাল লেখক সুস্পষ্টভাবে কখনো বলেননি। তবে এই লেখায় লেখক বারবার বলেছেন যে এই ভ্রমণটি তিনি অনেক আগে করেছেন। তাঁর ভাই সাহিত্য -সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'সঞ্জীবনী সুধা' নামে তাঁর সম্পাদনায় যে বইটি ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে; সেখানে তিনি সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখেছেন। সেটি থেকে জানা যায় যে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম সঞ্জীবন চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর জন্ম হয় ১৭৫৬ শকের বৈশাখ মাসে অর্থাৎ ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৮১১ শকের বৈশাখ মাসে অর্থাৎ ১৮৮৯ এ। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন যে চাকরি জীবনের প্রথম দিকে সঞ্জীবচন্দ্র পালামৌ গেছিলেন। জীবনী মূলক প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বিশেষ সাল তারিখ উল্লেখ করেননি। তবুও তিনি লিখেছেন সঞ্জীবচন্দ্রের লেখা 'বেঙ্গল রায়তস' বইটি লেখায় খুশি হয়ে লেফট্যানেন্ট গভর্নর সাহেব তাঁকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদ উপহার দেন। তখন তিনি কৃষ্ণনগরে নিযুক্ত হন। দুই বছর সেখানে থাকার পরে সরকার গুরুতর কাজের ভার দিয়ে তাঁকে পালামৌ পাঠান। বেঙ্গল রায়তস বইটি ১৮৬৪ তে প্রকাশিত হয়।এর থেকে বোঝা যায় উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষে তিনি পালামৌতে গেছিলেন।
ঔপন্যাসিক প্রবন্ধকার এবং বঙ্গদর্শনের অন্যতম সম্পাদক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আরো কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। কন্ঠ মালা (উপন্যাস), মাধবীলতা (উপন্যাস, জাল প্রতাপচাঁদ (ঐতিহাসিক রচনা)। সঞ্জীবচন্দ্র ব্যক্তিগত জীবনে খুব অগোছালো ছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী হওয়া সত্বেও শিক্ষা লাভ তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পর্যন্ত পাওয়া সত্ত্বেও তিনি চাকরি রক্ষা করতে পারেননি। তেমনি লেখার হাত অত্যন্ত পাকা হওয়া সত্ত্বেও পালামৌ রচনাটি তাঁর স্বভাবসুলভ ভাবেই এলোমেলো। এই বইয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভ্রমণ বিষয়ক অংশ এখানে আলোচনা করা হলো।
যে সময় তাঁর পালামৌ যাওয়া ঠিক হয় তখন তিনি জানতেন না সেই স্থান কত দূরে, কোথায় অবস্থিত। তারপর ম্যাপ দেখে যাত্রাপথ ঠিক করেন। সেই সময় খুব কম মানুষই পালামৌতে গেছেন। রানীগঞ্জে ইংল্যান্ড ট্রানজিট কোম্পানির ডাকগাড়ি ভাড়া করে রাত্রি দেড় প্রহরের সময় হাজারীবাগের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তিনি। সকালে বরাকর নদীর পূর্বপাড়ে গাড়ি থামল। ছোট নদী সবাই হেঁটে পাড় হয়, গাড়িগুলি দিয়ে ঠেলে পার করানো হল। সেখানে তিনি প্রথম বন্য আদিবাসী নারীপুরুষ, বালকবালিকা দেখলেন। তাঁকে সাহেব বলে ডেকে পয়সা চাইতে লাগল বালকবালিকারা কারণ সম্ভবত তাদের ধারণা যারা গাড়ি চড়ে তারা সাহেব। বরাকর থেকে ছোট পাহাড় প্রথম দেখা গেল। কখনো পাহাড় না দেখা লেখক অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। বিকেলে গাড়ি পাহাড়ের কাছ দিয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি নেমে হেঁটে পাহাড়ের কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু অনেক হেঁটে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন ও বুঝলেন পাহাড়ের দূরত্ব স্থির করা বাঙালির পক্ষে বড় কঠিন। (রাধা নাথ শিকদার বাঙালি হয়েও ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করেন। এই খবর নিশ্চয়ই তাঁর জানা ছিল)।
পরদিন হাজারীবাগ পৌঁছে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়ি আহারাদি সেরে রাত্রি দেড়টার সময় ছোটনাগপুর যাত্রা করলেন পালকি চেপে। সেখান থেকে দু চার দিনে পালামৌ পৌছালেন। রাঁচি থেকে পালামৌ যাওয়ার সময় দূর থেকে পালামৌর পাহাড়কে মেঘ বলে মনে হচ্ছিল। ধীরে ধীরে পাহাড় ও তারপর জঙ্গল স্পষ্ট হল।
সেই পাহাড় ও জঙ্গল নিরবচ্ছিন্ন জঙ্গলের রাস্তায় কতগুলি কোল বালক গলায় ঘন্টা বাঁধা মোষেদের চড়াচ্ছিল। তাদের কৃষ্ণ ঠাকুরের মতো দেখতে। গলায় পুতির সাত নরী, তাতে ধুকধুকির বদলে একটা করে গোল আরসি। পরনে ধড়া, কানে বনফুল। তারা খেলা করছে, নাচ করছে। তারা খর্বাকৃতি, কৃষ্ণবর্ণ। তারা রূপবান না কুৎসিত সে বিচার লেখক অসমর্থ। তবে তিনি অনুভব করেছেন যে এই প্রকৃতির কোলে তারা বিশেষ রূপে সুন্দর। 'বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে' সেই প্রবাদপ্রতিম বাক্য এখানে লেখক লিখেছেন।
পরে পালামৌ পৌঁছে তিনি দেখলেন সেই নিরবচ্ছিন্ন জঙ্গলের মধ্যে নদী, গ্রাম সবই আছে। পাহাড়ের পর পাহাড় যেন সমুদ্রের অবিরত তরঙ্গ। সেই পাহাড়ে কোন শব্দ দীর্ঘস্থায়ী প্রতিধ্বনি তৈরি করে। প্রধানত কোলেদের বাস। দূরে দূরে তাদের গ্রাম ৩০-৩২ টি ঘর নিয়ে। সবকটি পাতার কুটির।
কোল নারীরা কটিদেশে একটি ক্ষুদ্র কাপড় মাত্র পরিধান করে, উর্ধাঙ্গ অনাবৃত। আভরণে পুতির সাত নরী হার, তাতে আরসি ঝুলছে। কানে ছোট ছোট বনফুল, মাথায় বড় বনফুল। নারী ও শিশু দল বেঁধে এসে লেখকের পালকি দেখে। কোলেদের মধ্যে বৃদ্ধার সংখ্যা অতি অল্প। অশিতিপর না হলে তারা বৃথা হয় না। অতিশয় পরিশ্রমী বলে হয়তো তারা চিরযৌবনা থাকে। পুরুষ জাতির মধ্যে লেখক জীবনী শক্তি কম দেখেছেন। কোলেরা নারী পুরুষ মদ্যপান করে কিন্তু কেউ মাতলামি করে না।
প্রতিদিন বিকেলে তিনি লাতেহার পাহাড়ে গিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখার জন্য দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করতেন। একটি পাহাড়কে তিনি ভালোবেসে কুমারী নাম দিয়েছিলেন। তার ছায়ায় বসে তিনি প্রতিদিন দূরে চারদিকে পাহাড়ের পরিখার মধ্যে ছোট্ট পৃথিবী দেখতেন। জঙ্গলের মধ্যে গ্রাম থেকে ধোঁয়া উঠত আর হয়তো মাদলের শব্দ ভেসে আসত। তাঁর সাদা তাঁবুটি যেন জঙ্গলের মধ্যে একলা কপোতের মতো দেখাত। এই ছিল লেখকের দুনিয়া।
একদিন তিনি দেখলেন একটি যুবক বীর দর্পে কয়েকটি স্ত্রীলোকের বারণ অগ্রাহ্য করে বাঘ মারতে যাচ্ছে কারণ বাঘ তার গরুকে মেরেছে। লেখক বন্দুক নিয়ে তার সঙ্গে গেলেন এবং দুজনে মিলে খুঁজে বার করলেন একটি গুহায় নিদ্রারত বাঘটিকে। বিশাল পাথর গড়িয়ে এনে তার আঘাতে যুবক সেই ঘুমন্ত বাঘকে মেরে নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করল।
একদিন চন্দ্রালোকিত রাতে আমন্ত্রিত হয়ে কোলেদের নৃত্য দেখে এলেন। লেখকের মনে হল তাদের গানের সুর যেন পাহাড়ের মূলে, পাহাড়ের বুকে গিয়ে লাগছে। সেই নাচের তালে যেন আকাশে চাঁদ হাঁসছে।
লেখক কোলেদের বিবাহ দেখলেন। এদের বিয়েতে কন্যাহরণ করতে হয় আর কোন মন্ত্র তন্ত্র লাগে না। কোলেদের কাছে বৃহত্তম উৎসব হলো বিয়ে। এই উপলক্ষে তারা ১০ থেকে ১৫ টাকা খরচ করে যা তাদের পক্ষে অত্যন্ত বেশি। সেই অর্থ জোগাড় করতে তারা মহাজনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে সারা জীবনের মতো।
পালামৌ-এর সম্পদ মহুয়া ফুল। মহুয়া ফুল (লেখকের ভাষায় মৌয়া) ঝরে পড়ে গাছের তলায় ছেয়ে থাকে, হাজার হাজার মাছি মৌমাছি গুনগুন করে সেখানে উড়ে বেড়ায়। সেই আওয়াজ বনময় কোলাহলের মত ছড়িয়ে পড়ে। কোলেরা এই ফুল খাবার হিসেবে ব্যবহার করে। শুকিয়ে রাখলে এই ফুল অনেক দিন থাকে। বর্ষাকালে দরিদ্র কোলেরা শুধু এই ফুল খেয়েই ২-৩ মাস কাটায়। তাছাড়া এই ফুলের তৈরি মদ এখানে ব্যবহার হয়।
এভাবেই ভ্রমণ কাহিনী শেষ হয় লেখকের। বাকিটুকু অজানাই থেকে যায় পাঠকের।
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪
৬৩। ইউরোপে তিন বছর ৯ রমেশ চন্দ্র দত্ত
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
৬২। ইউরোপে তিন বছর ৮ রমেশ চন্দ্র দত্ত
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
২। গোড়ার কথা
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ---- সুমনা দাম বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...
-
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ------- সুমনা দাম স্বর্ণকুমারী দেবী ( ১৮৫৫-১৯৩২ ) অন্যতম প্রথম বাঙা...
-
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ------- সুমনা দাম (আগের পর্বের পরে) আগস্...
-
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ------- সুমনা দাম "আ ভিজিট টু ইউরোপ" ত্রৈলোক্যনাথ মুখ...