শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৫

৮১। স্বর্ণকুমারী দেবীর ভ্রমণ ১

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২) অন্যতম প্রথম বাঙালি মহিলা কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতকার। তিনি প্রথম বাঙালি মহিলা যিনি কোনো পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা সহোদরা। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর "ভারতী" নামের পত্রিকা প্রচলন করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে এই পত্রিকার সম্পাদক পদে স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচিত হন। তারপরে তিনি দুটি পর্যায়ে মোট ১৮ বছর ভারতী পত্রিকার সম্পাদনার কাজ করেছেন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্য অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯৬ সালে অনাথ ও বিধবাদের সাহায্যের জন্য তিনি "সখী সমিতি" স্থাপন করেছিলেন। তাঁর লেখা দীপনির্বাণ, ছিন্নমুকুল, হুগলির ইমামবাড়ি, ফুলের মালা প্রভৃতি উপন্যাস এবং অনেক কাব্যগ্রন্থ ও নাটক রয়েছে। তিনশোর বেশি গান তিনি রচনা করেছেন। তিনি জগৎতারিনী স্বর্ণপদক পেয়েছেন। 


স্বর্ণকুমারী দেবীর ভ্রমণ পর্বের প্রথম খবর পাওয়া যায় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কারোয়ার যাত্রায়। তিনি মেজদাদা আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মস্থল বোম্বাই প্রদেশের কারোয়ার গেছিলেন। সঙ্গী ছিলেন ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ,রবীন্দ্রনাথ, ভগ্নি সৌদামিনী। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায় এই ভ্রমণ সংক্রান্ত। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবীর নিজের কোন রচনা পাওয়া যায়নি। 


এরপর ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দেই স্বর্ণকুমারী দেবী বোলপুর যান সপরিবারে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী কাদম্বরী দেবীও তাঁর সঙ্গে যান। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবীর লেখা থেকে এই বোলপুর ভ্রমণ সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। 


১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী দার্জিলিং ভ্রমণে যান। সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর পত্নী মৃণালিনী দেবী, তাঁর শিশু কন্যা বেলা, ভগ্নি সৌদামিনী দেবী ও স্বর্ণকুমারী দেবীর দুই কন্যা ১৩৯৫-এর ভারতী পত্রিকায় বৈশাখ থেকে ভাদ্র ও কার্তিক সংখ্যায় দার্জিলিঙ পত্র নামে ধারাবাহিকভাবে এই লেখা প্রকাশিত হয়। প্রথমে তিনি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পড়ার মজলিস হত, সেটাই তিনি উপভোগ করতেন। লেফট্যানেন্ট গভর্নরের পুরনো বাড়ি ক্যাসেলটন হাউসে ছিলেন তাঁরা। সেই বাড়ির দক্ষিণে মল রোড, অবজারভেটরি হিল বলে একটা ৫০০ ফুট উঁচু পাহাড় বেষ্টন করে এই বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে। এই রাস্তার মতো সমতল সুখে বেড়ানোর জায়গা আর নেই। এখানে গাছপালার জঙ্গল নেই, কলকাতার রাস্তার মতো পথের ধারে এক একটি ফুলে ভরা গাছ। রাস্তার পশ্চিম ধারে অল্প খাড়াই ঢালু তৃণময় স্থানে ফার্ন আর গোলাপের ঝোপঝাড়। এই ঢালু স্থানের পর পশ্চিমে রাস্তার কিছু নীচে ইংরেজদের সুসজ্জিত দোকান। পাহাড়ের সবুজ গায়ে সাদা সুন্দর বাড়িগুলি স্তরে স্তরে উঠেছে। রোদ পড়ে কাঁচের মতো ঝলমল করে বাড়িগুলি। রাতে বাড়ির আলোগুলি নক্ষত্রের মতো পাহাড়ের গায়ে ফুটে থাকে। মল রোডের বিপরীত দিকটা , লেখিকা যাকে পার্ক বলেছেন, ইংরেজরা শহর হওয়ার আগে দার্জিলিং যেমন জঙ্গল ছিল তার কিছু কিছু চিহ্ন রেখে দিয়েছে। চওড়া রাস্তার দু'ধারে পুরনো জঙ্গল বজায় আছে। একদিন তিনি পার্কে যাওয়ার পথে রাস্তা ভুল করে অন্যত্র চলে গেছিলেন। 


দার্জিলিং-এর শোভা দার্জিলিং পৌঁছানোর পথের থেকে শুরু হয়েছে। জলপাইগুড়ির অল্প পরে শিলিগুড়ি, যেটি দার্জিলিং-এর উপত্যকা। সেখান থেকে পাহাড়ে রেলগাড়িতে উঠতে হয়। এই রেলগাড়ি কলকাতার ঘোড়ায় টানা ট্রামের থেকেও ছোট। গাড়ি চড়ে রাস্তার ধারে দুই পাশের গাছপালা অনায়াসে হাত দিয়ে ধরা যায়। 


সুস্থ হওয়ার পর লেখিকা সবসময়ই বাইরে ঘুরে দার্জিলিং এর মুক্ত দৃশ্য দেখতে চাইতেন। তাঁরা ২-৩ দিন ভিক্টোরিয়া ওয়াটার ফলস বা কাকঝোরা দেখতে গেছিলেন। তাঁরা অবজারভেটরি হিলের উপরে উঠেছিলেন। সেখান থেকে চারদিকে দৃশ্য দারুন দেখা যায়। তাছাড়া দুর্জয় লিং দেবতার অধিষ্ঠান সেখানে। অনেকে বলে দুর্জয় লিং বা লিঙ্গ থেকে দার্জিলিং শব্দ এসেছে। কিন্তু শরৎচন্দ্র দাস (দ্রষ্টব্য: তিব্বত অভিযান) যিনি তিব্বতে গেছিলেন তিনি বলেছেন দর্জিলিং তিব্বতি শব্দ। দরজি থেকে দার্জিলিং হয়েছে। দরজি কথার অর্থ বজ্র। তিব্বতি ভাষায় বজ্র শ্রেষ্ঠ অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ দার্জিলিং মানে শ্রেষ্ঠ স্থান। শরৎ চন্দ্র দাস বলেছেন বর্ধমানের রাজা এসে এখানে দুর্জয় লিং প্রতিষ্ঠা করেন। তার আগে এরকম কোন দেবতা এখানে ছিলেন না। কিন্তু লেখিকার মতে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষের পিতা (রামলোচন ঘোষ, যিনি পাথুরিয়াঘাটার প্রাচীন প্রাসাদ তৈরি করেন এবং যিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের দেওয়ান হয়েছিলেন) এখানে এসেছিলেন। পথঘাট তখন প্রায় ছিল না, তখনও তিনি দুর্জয় লিং দেখে গিয়েছিলেন। 


এরপর লেখিকা দার্জিলিং শহরের কিছু নীচে ভুটিয়াদের প্রধান আবাসস্থল ভুটিয়া বস্তিতে গোল গম্বুজাকৃতি মন্দির দেখলেন। এখানে একজন লামার স্মরণে তাঁর দাঁত ও নখ রাখা আছে। আর আছে এক গুম্ফা, যার বারান্দায় বড় বড় মন্ত্রচক্র আছে। চক্র যত ঘোরে, মন্ত্র তত ঘোরে ও তত পাপ ক্ষয় হয়। গুম্ফার মধ্যে মহাকাল ও মহাকালীর মূর্তি আছে। মন্দিরের আসল দেবতা হিসেবে একটি বুদ্ধ ও কালীর মূর্তি আছে। তৃতীয় প্রধান দেবতার নাম তাঁরা বারবার জিজ্ঞাসা করেও বুঝতে পারেননি। তিব্বতের মতো এখানকার বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের সঙ্গে মিশ্রিত। অহিংসা এখানে পরম ধর্ম নয়। লামাদের মদ মাংস নিষিদ্ধ নয়। এরপর তিনি দার্জিলিং-এর মেঘ রৌদ্রের খেলার কথা লিখেছেন। 


সিঞ্চল দার্জিলিং থেকে প্রায় দশ হাজার ফুট উঁচু। এখানে আগে সেনা নিবাস ছিল ইংরাজের। কিন্তু এখানকার শীত সেনারা সহ্য করতে না পারায় তাদের ব্যারাক জলাপাহাড়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। শত শত চিমনি ও ভাঙা দেওয়াল নিয়ে সিঞ্চল এখন শহরের ভগ্নাবশেষ মাত্র। টাইগার হিল সিঞ্চল থেকে ৫০০ ফুট উঁচু, এখান থেকে ধবলগিরির (মাউন্ট এভারেস্ট) কিছু অংশ দেখা যায়। টাইগার হিলের পথ অতি খারাপ, এখানে ডান্ডি উঠে না। ছোট সংকীর্ণ পথে অতি সাবধানে হেঁটে উঠতে হয়। চুড়ায় পৌঁছে অপূর্ব দৃশ্যে মন ভরে গেল। ধবলগিরির চূড়া সেদিন দেখা গেল না কারণ সেদিক মেঘে আচ্ছন্ন। কাঞ্চনজঙ্ঘা শ্রেণী বেশ ভাল দেখা গেল। 


লেখিকা ও সঙ্গীরা একদিন রঙ্গিতে গেছিলেন। রঙ্গিত সিকিমের একটি নদীর নাম। চারপাশের নামও নদীর নামের রঙ্গিত হয়েছে। এটি দার্জিলিং থেকে ১১ মাইল নীচে। নদীর ওপারে স্বাধীন সিকিম রাজ্য। ডান্ডিতে করে জঙ্গলময় পথে কাঞ্চনজঙ্গা দেখতে দেখতে তাঁরা পৌঁছলেন নদীর কাছে। এই নদীর জল সবুজ। পথে ফার্ন, বুনো ফুল, পরগাছা, বড় গাছ যত আছে তা দার্জিলিংয়ে নেই। ডান্ডি করে সেদিন সন্ধ্যায় তাঁরা মল রোড হয়ে বাসায় ফিরলেন। মল রোড তখন ইংরাজ স্ত্রী পুরুষে ভর্তি, ব্যান্ড বাজছে, চারদিক গমগম করছে। ইংরাজ সরকার যখন স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য বসতি প্রস্তুত করার জন্য সিকিমের রাজার থেকে করের বিনিময়ে এই স্থান গ্রহণ করেছিল তখন দার্জিলিং জঙ্গল এলাকা ছিল, বাংলা থেকে আসার পথঘাট কিছুই ছিল না। সম্প্রতি মেকলের তিব্বত মিশনে যাওয়ার পর সিকিমের রাজাকে এই কর দেওয়া ইংরেজ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে।

১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী গাজিপুরে যান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিছুদিন সস্ত্রীক সেখানে অবস্থান করেন। ১২৯৬-এ ভারতীতে "গাজিপুর পত্র" প্রকাশিত হয়। এখানে হাওড়া থেকে রেল যাত্রা সহ যাত্রাপথের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কৌতুক এবং আরো নানারকম সরস আলোচনা করেছেন লেখিকা। গাজিপুর থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি কাশী ঘুরে এসেছিলেন।

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী পুনা, সোলাপুর এইসব মহারাষ্ট্রের স্থান ভ্রমন করেন। এখানেও তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ম উপলক্ষে থাকতেন। ১২৯৮ সালে ভারতী পত্রিকায় তিনি এই ভ্রমণ সম্পর্কে লিখেছেন "পত্র" শিরোনামে। পুনা, সোলাপুরে চিত্রশালা, শিল্পপ্রদর্শনী দর্শন, ইংরাজদের ফ্যান্সি ড্রেস বল, ঘোড়দৌড়, বিভিন্ন ক্রীড়া প্রদর্শনী দেখা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন। এই সময় তিনি পান্ডারপুরআকোলকোট ঘুরে এসেছেন ট্রেনে। আকোলকোট স্টেশনে এসে সেখানকার রাজার পাঠানো গাড়িতে তাঁরা রাজপ্রাসাদে গেলেন। রানী অত্যন্ত রুচিশীলা, তিনি সুন্দর ভাবে গৃহসজ্জা করেছেন। রাজা নিজে তাঁদের রাজপ্রাসাদ, দূর্গ, বিচারালয়, স্কুল, রাজ বাজার, ভান্ডার গৃহ, মহামূল্য হস্তি সিংহাসন রাখার হাওদাখানা সব দেখালেন। এই রাজা ইংরেজের আনুকূল্যে রাজ্যাভিষিক্ত হয়েছেন এবং ইংরেজদের সন্তুষ্ট রাখতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন।

                       (চলছে)

সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫

৮০। আ ভিজিট টু ইউরোপ ২ - ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

            
            (আগের পর্বের পরে)

আগস্ট ১৮৮৬-তে লেখক সমুদ্রপথে স্কটল্যান্ড যাত্রা করলেন। টেমস নদী হয়ে  নর্থ সি হয়ে জাহাজ চলল। ক্রমে এডিনবরা শহরের লীথ বন্দর এল। এডিনবরা ছবির মত সুন্দর শহর। কাসেল পাহাড়, সলসবেরি পাহাড়, কার্লটন পাহাড় থেকে নীচের দৃশ্য অত্যন্ত মোহময়। এডিনবরায় প্রিন্সেস স্ট্রীট প্রিন্সেস স্ট্রীট গার্ডেন্স, সেন্ট জাইলজের গথিক ক্যাথিড্রাল, কাউন্টি স্কোয়ার এবং হলিরুডে মেরি কুইন অফ স্কটস ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দর্শনীয় জিনিস ও কক্ষ দেখলেন। স্যার ওয়াল্টার স্কট-এর মনুমেন্ট দেখলেন। 

পরদিন তিনি পার্থে গেলেন। লক (স্কটল্যান্ডে লেককে লক বলে) লেভেনের নীল জলে অপূর্ব পরিবেশে ট্রাউট মাছ শিকার করা দেখলেন। পার্থ থেকে পিটলর্কি নামক হাইল্যান্ডের একটি ছোট স্টেশনে পৌঁছলেন লেখক। সেখান থেকে কিলি-ক্রাঙ্কি গিরিপথ অতিক্রম করে ব্লেয়ার অ্যাটোলে গেলেন পায়ে হেঁটে। এই পথ বহু সংকীর্ণ গিরিপথ, গভীর গিরিখাত, নদী পার হয়ে যেতে হল। সেখান থেকে টিল্ট নদীর গিরিখাত দিয়ে ১৬ মাইল দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করলেন। দুপাশে পাহাড়ের গায়ে কার্পেটের মতো সবুজ গুল্ম, চমৎকার আবহাওয়া আর নদীর গর্জন সেই যাত্রাকে অতি মনোরম করে তুলেছিল। সন্ধ্যার সময় ডী নদীর সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে দেখলেন সেখানে নদী কি অসম্ভব সংকীর্ণ আর ভয়ংকর স্রোতস্বিনী হয়ে উঠে। এইখানে কবি বায়রন একবার প্রায় মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছিলেন। সেখানে হাইল্যান্ড কুটিরে থাকার সময় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বালককে দেখে দেশীয় বলে এক স্নেহ অনুভব করলেন লেখক। 


এবার লেখক ব্যালাটার অভিমুখে যাত্রা করলেন। প্রথমে সম্রাজ্ঞীর হাইল্যান্ড নিবাস ব্যালমোরাল দেখলেন। তারপর প্রিন্স অফ ওয়েলসের অ্যাবারগেলডি এস্টেট দেখলেন। তুষারাবৃত লকনেগার পর্বতশৃঙ্গ দেখলেন। এই অঞ্চলে অনেক খামারবাড়ি আছে। স্থানীয়রা লেখককে মাননীয় অতিথি জ্ঞানে হুইস্কি ও চা দিতে লাগল। এক স্থানে অনেক গৃহহীন নারী-পুরুষ ভবঘুরের দেখা পেলেন লেখক। এরা ঘুরে বেড়ায় আর ভিক্ষা করে খায়। 


ব্যালাটার থেকে রেলপথে তিনি অ্যাবারডিনে আসেন। এটি সমুদ্রের তীরে অবস্থিত একটি উন্নত শহর। এখানে হেরিং মাছ ধরা হয় বাণিজ্যিকভাবে। এছাড়া অয়েস্টার, চিংড়ি, কাঁকড়া প্রভৃতি পাওয়া যায়। এবার লেখক গেলেন কিলিন পিয়ারে। লক টে ছোট স্টিমারে পার হয়ে আসা সবুজ ঘাসে ঢাকা ঢালু তীর, উচ্চ ভূমিতে ঘন গাছের জঙ্গল, পাতা ঝরা গাছের হেমন্তকালীন হলুদ রঙের পাতা ও সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দেখে  রূপকথার জগতের দৃশ্য বলে লেখকের মনে হয়েছে। লক টে হ্রদে একটি ছোট দ্বীপ আছে, তাতে একটি প্রাচীন ক্যাসেলের ভগ্নাবশেষ আছে। এরপর ডালম্যালী হয়ে কিলচার্নে এলেন। রেলপথ অ হ্রদের পাশ দিয়ে কিছুদূর গেছে। আক-না-কুইট নামক স্থান থেকে লক এটিভহেড পর্যন্ত একটি ছোট স্টিমার যাতায়াত করে। এরপর কোনেল  ফেরী স্টেশন হয়ে লক নেলে এলেন। সেখান থেকে ফোর্ট উইলিয়াম ও বেন নেভিসের দৃশ্য অতি মনোরম। 


ওখানে কদিন কাটিয়ে তিনি গ্লাসগো গেলেন স্টিমারে। গ্লাসগো পৃথিবীর একটি বৃহত্তম শহর ও বাণিজ্য বন্দর। গ্লাসগোতে লেখক জর্জ স্কোয়ারে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির মূর্তি ও স্যার ওয়াল্টার স্কটের বৃহৎ মূর্তি, নিউ ইউনিভার্সিটি, মিউজিয়াম দেখলেন। লেখক এবার ঘোড়ার গাড়িতে ট্রোসাক্স অভিমুখে যাত্রা করলেন। এই পথ কিছুদূর পর্যন্ত লক ভেনাচারের পাশ দিয়ে গেছে। উপকূল ঘন অরণ্য বেষ্টিত, অনেক ছোট নদী গিয়ে হ্রদে পড়েছে। লক আক্রেকে পিছনে ফেলে তাঁরা ট্রোসাক্স গিরিসংকটে প্রবেশ করলেন। ডান পাশে বেন এলাম ও বাঁ পাশে বেন ডেনু নামের খাড়া পাহাড় ঘন অরণ্যে আবৃত। ট্রোসাক্সের অন্য প্রান্তে লক ক্যাট্রিল। পূর্বে এখানে এত সহজে আসা যেত না। খাড়া পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে গাছের ডালের সঙ্গে দড়ি বেঁধে তৈরি ল্যাডার বা মই পথ শুধুমাত্র ছিল। এখন ভালো রাস্তা হয়ে যাওয়ায় সহজে আসা যায়। একটি ছোট স্টিমারে হ্রদের ওপর পারে গেলেন তাঁরা। 


স্কটল্যান্ড থেকে ফিরে, ১৮৮৬ -এর অক্টোবরে তিনি অক্সফোর্ড যান। সেখানকার ক্রাইস্ট কলেজ, কুইন্স কলেজ, ম্যাকডোনাল কলেজ, সেখানকার ক্যাথিড্রাল, মিউজিয়াম, গ্রন্থাগার, মানমন্দির দেখেন। অক্সফোর্ডে যে হোটেলে ছিলেন সেটি সম্পূর্ণভাবে এক মহিলার পরিচালনাধীন। লেখক ইউরোপে মেয়েদের হোটেলে, দোকানে, পানশালায়, ডাকঘরে, কলকারখানায় দায়িত্বপূর্ণভাবে কাজ করতে এবং মধ্যরাত্রি পার হয়েও কাজ করতে দেখেছেন, যেটি সেই সময় ভারতে ভাবনার অতীত ছিল। 


ইংল্যান্ডের শেষ কয়দিন লেখক লন্ডন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের দর্শনীয় স্থান দেখে বেড়ালেন। দুবার পার্লামেন্টে গিয়ে অধিবেশন দেখলেন। ক্লক টাওয়ারে বিগ বেন ঘন্টা দেখলেন। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রাজাদের রাজ্যেভিষেক হয়। আবার রাজা রানীদের ও বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির সমাধি, স্মৃতিফলক এখানে রয়েছে। টাওয়ার অফ লন্ডন পরিদর্শন করলেন তিনি। এখানে অতীতে ইংল্যান্ডের রাজা বহির্শত্রুর আক্রমণের সময় নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে ইংল্যান্ডের ক্রাউন জুয়েল বিখ্যাত কোহিনুর রক্ষিত আছে। ইতিহাসখ্যাত অনেক ব্যক্তিকে এখানে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। রাজাদেশে অনেকের শিরশ্ছেদও এখানে করা হয়েছে। লেখক এক দিন সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে প্রার্থনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অন্যান্য যা যা তিনি দেখলেন তা হল জিওলজিক্যাল গার্ডেন, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড, ন্যাশনাল গ্যালারি, হ্যাম্পটন কোর্ট, এক্সচেঞ্জ, কেনসাল গ্রিন-এর সমাধিক্ষেত্র (এখানে দ্বারকানাথ ঠাকুরকে সমাহিত করা হয়েছে), মাদাম তুসোর মোমের মূর্তি প্রদর্শনী প্রভৃতি। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যে বহু বিচিত্র জিনিস আছে তা অনুশীলন করতে একটি জীবন কেটে যাওয়ার কথা বলেছেন লেখক। 


অবশেষে ১৩ ডিসেম্বর ১৮৮৬ ইংল্যান্ড ত্যাগ করে হল্যান্ডের রোটারডাম অভিমুখে যাত্রা করলেন লেখক। পরদিন নদীর উপর দিয়ে স্টিমারে যেতে যেতে দু'পাশে হল্যান্ডের প্রচুর উইন্ড মিল দেখতে পেলেন। হল্যান্ডের হার্লেম শহরে এলেন তাঁরা। এখানকার মিউজিয়াম দেখলেন। ডাচ উপনিবেশ ভুক্ত জাভা, সুমাত্রা, বোর্ণীও ফিলিপিন্স প্রভৃতি অঞ্চলে নানা দ্রব্য সেখানে রাখা আছে। এরপর লেখক গেলেন আর্মস্টারডাম। সেখানে জুওলজিক্যাল গার্ডেন, একুরিয়াম, মিউজিয়াম দেখলেন। উত্তর সাগরের খাল ও উত্তর হল্যান্ডের খাল জার্মান সমুদ্রের সঙ্গে আর্মস্টারডামকে যুক্ত করেছে। শহরটিও অনেক খাল দিয়ে ৯৫ টি দ্বীপে বিভক্ত ও পরস্পর ৩০০ টি সেতু দ্বারা যুক্ত। মাটি নরম তাই বহু কাঠ (পাইল) পুঁতে তার ওপর নগর নির্মিত হয়েছে। ১৪০০০টি পাইলের উপর দাঁড়িয়ে আছে রাজপ্রসাদটি। 


ফ্রান্সের প্যারিস পরবর্তী গন্তব্য। এই সুন্দরতম শহরটি রাস্তা, পার্ক, প্রাসাদ দিয়ে সুসজ্জিত। প্যারিসে লেখক জীববিজ্ঞানের মিউজিয়াম, ইডেন থিয়েটার, নিউ অপেরা দেখলেন। মাথায় পাগড়ি পড়ে থাকার জন্য লেখক খাতির পেতে থাকলেন। কিন্তু ইংরেজি ছাড়া ইউরোপীয় অন্য ভাষা না জানায় লেখক তাদের কথাবার্তা উপভোগ করতে পারলেন না। তিনি বুলভারে বেড়ালেন, সাঁঝে লিজেতে সদা স্ফূর্তিমান মানুষের ভিড় দেখলেন। ট্রিয়ফ দ ল এতোয়াল, নেপোলিয়নের বিজয় উপলক্ষে নির্মিত স্মৃতি তোরণ দেখলেন, ল্যুভর মিউজিয়াম দেখলেন, দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত নতরদাম ক্যাথিড্রাল দেখলেন। তাছাড়া লা শ্যাত শ্যাপেল, পাত্থিনান দেখলেন। 


প্যারিস থেকে গেলেন রাইন নদীর ধারে জার্মানির শহর কোলন বরফ পাতের মধ্যে। কাথিড্রল ও চার্চ দেখলেন। এখানে ওডিকোলন তৈরি হয়। রেলে এবার তিনি বার্লিন গেলেন ৩১শে ডিসেম্বর ১৮৮৬। জার্মানির রেল কামরাগুলিতে গরম রাখার জন্য ব্যবস্থা আছে। কামরার দেওয়ালে একটি ডায়াল সংযুক্ত আছে, তার হাতল ঘুরিয়ে কামরা বেশি গরম বা কম গরম করা যায়। বার্লিনে যে হোটেলে উঠলেন সেখানে বিদ্যুতের আলোর ব্যবস্থা আছে। রাত দিন তুষারপাত হচ্ছিল কিন্তু পাইপের সাহায্যে হোটেলে ৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট মাত্রা তাপ সর্বদা রক্ষিত হতো। 


বার্লিন থেকে লেখক অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। টেটশেন নামক স্থানে অস্ট্রিয়ার সীমান্ত এল। ভাষাগত সমস্যার জন্য বুঝতে না পেরে সেই ট্রেনেই বসে রইলেন তিনি। অনেক পরে টিকিট কালেক্টর এসে টিকিট পরীক্ষা করে চড়া হারে মাশুল চাইলেন কারণ এই রেল অন্য গন্তব্যে যাবে। লেখক অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তিনি না বুঝে এই ট্রেনে যাত্রা করছেন ও মাশুল দেবেন না। কিন্তু তারা কিছু তেমন বুঝলো না। একটি ছোট স্টেশনের রেল থামিয়ে লেখককে জোর করে নামিয়ে দিল এবং সঙ্গে মালপত্র লাইনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। গভীর রাতে চতুর্দিকে তুষারপাতের মধ্যে লেখক একা বোহেমিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে চরম অসহায় বোধ করতে লাগলেন। অবশেষে লেখক লাইন থেকে অতি কষ্টে মালপত্র সংগ্রহ করে স্টেশনে স্টেশন মাস্টারের কাছে পৌঁছালেন এবং তাকে আকার ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করলেন ভিয়েনা কিভাবে যাবেন। লোকটি খুব একটা সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক না হলেও টাকার বিনিময় একটি পোর্টার জোগাড় করে, পোর্টারকে কি সব বলে দিল। লেখকের জিনিস নিয়ে পোর্টার চলতে থাকল আর লেখক তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন। প্রথমে তুষার কয়েক ফুট গভীর হয়ে উঠল আর খুব পিছল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা একটা পাহাড়ে উঠতে থাকলেন। তিনি ভাবলেন পা পিছলে পড়লে বরফে গড়িয়ে নীচে পড়ে যাবেন। অনেকদূর গিয়ে একটি বড় নদীর ওপর একটা কাঠের সেতু পার হলেন। লোকটি লেখকের থেকে যে কটি রৌপ্য মুদ্রা ছিল তা নিয়ে গিয়ে বোধহয় টোল দিল। রাত্রি প্রায় তিনটের সময় একটা ছোট শহরে এসে পৌঁছলেন তাঁরা। বড়দিন উপলক্ষে আধা জাগ্রত সেই শহর। একটি বড় বাড়ির কাছে এসে লোকটি লেখকের থেকে অবশিষ্ট স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে ভাঙাতে চলে গেল। লেখক তখন অত্যন্ত ক্লান্ত ও নিদ্রাকাতর হয়ে আধখোলা একটা দরজায় হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। কিছুক্ষণ পরে একটি লোক তাঁর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুজনেই পড়ে গেলেন। লোকটি পড়ে গিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগল। লেখক ভাবলেন যদি লোকটি ঠান্ডায় মারা যায় তাই তিনি তাকে টেনে দেয়ালের কাছে এনে হেলান দিয়ে বসালেন। সে জ্ঞান ফিরে পেয়ে রাগে চিৎকার করে কি সব বলতে লাগল। এবার পোর্টার ফিরে এসে লেখককে নিয়ে আরো কিছু দূরে গিয়ে একটা হোটেলে পৌঁছাল। সেখানে বাকি রাত্রি হোটেলে কাটিয়ে সকালে ট্রেন ধরতে হবে এটুকু লেখক বুঝলেন পোর্টারের দেওয়া একটা কাগজে আউসসিগ ও ৯-১৮ লেখা দেখে। অর্থাৎ শহরটির নাম আউসসিগ এবং তাঁকে ৯ টা ১৮ তে ভিয়েনা যাওয়ার ট্রেন ধরতে হবে। পরদিন দেখা গেল যে লেখকের এই অনুমান সত্যি।  নিকটস্থ স্টেশন থেকে তিনি ভি যাওয়ার ট্রেন ধরতে পারলেন। প্রবল তুষার সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলল। মাঝে অসংখ্য ছোট পাহাড়, ঘন পাইন বন সহ গ্রামগুলি ছবির মতো দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে প্রাচীন ক্যাসেল দেখা যাচ্ছে। 


ভিয়েনা শহরটি প্যারিসের মতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও প্রাসাদোপম অট্টালিকাময়। তিনি সেখানে রাজপ্রাসাদ, মিউজিয়াম, গ্রন্থশালা দেখলেন। ২৭শে ডিসেম্বর ভিয়েনা ছেড়ে চললেন লেখক। রেলপথে অস্ট্রিয়ার আল্পসের মধ্যে দিয়ে পথ। 


রাতে এসে ইতালির ভেনিস পৌঁছলেন। ইতালির ভেনিসে গাইড রিফালটোতে একটি বাড়ি দেখিয়ে  শাইলক এই বাড়িতে টাকা রাখতো বলে পরিচয় দিল। লেখক পিয়াতসা অর্থাৎ স্কোয়ার অফ সেন্ট মার্ক দেখলেন। তিনি এবার ফ্লোরেন্স এলেন। ফ্লোরেন্স ফুলের শহর। এখানকার আশ্চর্য সুন্দর চিত্র, ভাস্কর্য, মূর্তি, রাফায়েল-মাইকেল অ্যাঞ্জেলো প্রমুখের  শিল্পকীর্তি দেখে মুগ্ধ হলেন। 


ফ্লোরেন্স থেকে তিনি রোমে এলেন ১৮৮৬ র ৩১ ডিসেম্বর। রোমে তিনি ভ্যাটিকান দেখতে পারেননি কারণ তখন ছুটি ছিল এবং অনুমতি সংগ্রহ করার মত সময় তাঁর ছিল না। রোমে তিনি কলোসিয়াম, ফ্ল্যাবিওন অ্যামফি-থিয়েটার দেখলেন। এরপর তিনি ভিসুভিয়াসের লাভা স্রোতে ঢাকা পরা পম্পেই দেখে নেপলস্ এলেন। নেপলস্-এ মিউজিয়াম, অ্যাকোরিয়াম, ভূগর্ভস্থ সমাধি, আর্ট গ্যালারি দেখলেন। 


নেপলস্ থেকে লেখক ব্রিন্দিসি চলে এলেন। সেখান থেকে জাহাজ তাঁকে আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছে দিল। অবশেষে ৩ জানুয়ারি, ১৮৮৭ সকালে ইউরোপ ত্যাগ করে সাধারণ ডাক পরিবহনের পথে তিনি দেশে ফিরে গেলেন, প্রায় নয় মাস ইউরোপে বাস করার পর।

রবিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৫

৭৯। আ ভিজিট টু ইউরোপ ১ - ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

 
"আ ভিজিট টু ইউরোপ"  ত্রৈলোক্যনাথ মুখার্জির (১৮৪৭-১৯১৯) ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এই বাঙালি সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কৌতুক রসের স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত। তাঁর লেখা বই "কঙ্কাবতী", "ভূত ও মানুষ", "ফোকলা দিগম্বর", "ডমরুচরিত" উল্লেখযোগ্য। তিনি শিক্ষকতা, পুলিশের চাকরি, বেঙ্গল গেজেটিয়ারে কেরানীর চাকরী, রাজস্ব বিভাগে চাকরী করেছেন। ১৮৮৬ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা তিনি এই বইটিতে লেখেন। ফিরে এসে তিনি কলকাতা মিউজিয়ামের সহকারী কিউরেটর হন। 

"আ ভিজিট টু ইউরোপ"-র প্রথম প্রকাশ ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে। বই হিসেবে প্রকাশের আগে "ইন্ডিয়ান নেশান" পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে তাঁর লেখা ধারাবাহিকভাবে দেড় বছর ধরে প্রকাশিত হয়েছিল। 

১৮৮৬ এর ১২ ই মার্চ "নেপাল" নামক জাহাজে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন লেখক। জাহাজ ছাড়ার পর ডেকে উপস্থিত থেকে সবাই দেখতে লাগল ভারত মহাসাগরের জল কেমন করে ধীরে ধীরে সবুজ রং হারিয়ে নীলে রূপান্তরিত হয়েছে। সূর্যের আলো মুছে গেল, দূরে লাইট হাউসের আলো আর দেখা গেল না। গাঢ় অন্ধকারে সমুদ্রের ফসফরাসের সাদা ফেনা ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। ক্রমে অপরিচিত ভারতীয়রা পরস্পরের মধ্যে আস্তে আস্তে পরিচিত হতে লাগল। যাত্রীবাহী জাহাজকে একটা প্রকাণ্ড ধনী গৃহের সঙ্গে তুলনা করেছেন লেখক। ডেকে যাত্রীরা ভ্রমণ, ব্যায়াম, দাবা খেলা প্রভৃতি করতে পারে। ধূমপান করার পৃথক ঘর আছে। সমুদ্রের দৃশ্য, উড়ন্ত মাছ প্রভৃতি দৃশ্য যখন একঘেয়ে হয়ে যায় তখন মানুষ এইভাবে সময় কাটায়। কখনো ডেকে পিয়ানো বাজিয়ে গান করা হয়। নীচে দুটি দীর্ঘ সারিতে কেবিন, প্রতি কেবিনে ২,৩ বা ৪ জন শোয়ার ব্যবস্থা আছে। ডাইনিং আছে খাওয়ায় জন্য আর সেলুন আছে অন্যান্য সময় বসা, লেখাপড়া করার জন্য। খাওয়ার সময় নির্দিষ্ট। আহার পুষ্টিকর। নিরামিষ, আমিষ দুই আছে। ইচ্ছা করলেই হিন্দু জাত বাঁচিয়ে আলাদা রান্না করে খেতে পারে। উনুন ও পাত্রের ব্যবস্থা জাহাজের কর্মীরা করে দেয়।
জাহাজে লাইব্রেরী থাকে। কখনো কখনো লেডিস রুমও থাকে। 

বোম্বাই ছাড়া ৬ দিন পর এডেন বন্দরের রুক্ষ পাহাড় দৃশ্যমান হল। কৃষ্ণকায় বালকরা সাঁতার কেটে পয়সা ভিক্ষা করতে এল। বণিকরা উট পাখির পালক আর ডিম বিক্রি করতে এল। এডেন শহরে নেমে লেখক দেখলেন এখানে ছোট কাটা গাছ ছাড়া কোন গাছই নেই। দুই মাইল দূরে অবস্থিত আরবের শহরে ছোটখাটো বাগান আছে কিন্তু সেখানেও বড় গাছ একটিও নেই। এখানে বৃষ্টি হয় বছরে মাত্র তিন চার ইঞ্চি। বহু পূর্বকাল থেকেই জল ধরে রাখার জন্য এখানে বাঁধ নির্মিত হয়েছে। আড়াই হাজার বছর পূর্বে মারেব বাঁধ সহ আরো পঞ্চাশটি জলাধার আছে, যার মধ্যে ১৩ টি তখন ব্যবহারযোগ্য ছিল। এই জলাধারগুলি থেকে জল লোকেদের কাছে প্রতি ১০০ গ্যালন এক টাকা হিসেবে বিক্রি করা হয়। ব্রিটিশ এখানে আসার পর বাণিজ্য, শান্তি ও সমৃদ্ধি বেড়েছে। এখানে অনেক কফি হাউস আছে, সেখানে আরব ও সোমালীয়রা দিন রাত কফি পান করছে। কফি এদেরই আবিষ্কার। ইয়েমেনের পাহাড়ে কফির জন্ম। পবিত্র কোরানে সুরা পান নিষিদ্ধ  হওয়ায় আরবরা কফিকে উত্তেজক পানীয় হিসেবে গ্রহণ করেছে। 


ভারতের রামায়ণের কাহিনী এডেন এক আশ্চর্য রূপে প্রচলিত। মোজাহির নামে এক ঐতিহাসিক লিখেছেন দশশির নামে দানবরাজ (রাবণ) যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দন্ড দিয়ে অপরাধীদের এডেনে পাঠাতেন। এখানে পাহাড়ের মধ্যে একটি কূপ আছে, তার ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষের সঙ্গে যোগাযোগের সুড়ঙ্গ আছে। দশশির দানব অযোধ্যা থেকে রাম হায়দারের স্ত্রীকে খাট সমেত চুরি করে আকাশপথে চলার সময় জেবেলসিয়া পাহাড়ের মাথায় বিশ্রাম করার জন্য বসেছিল। তখন সে রাম হায়দারের স্ত্রীকে বলে যে তাঁকে জিনে পরিণত করবে। এই নিয়ে তাঁদের বচসা হয় এবং এই সময় বানর-বেশী হনবীত নামক এক এফরীত তা শুনে এক রাতের মধ্যে উজ্জাইন বিক্রম নামক নগর থেকে সমুদ্রের নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করে জেবেলসিয়া পাহাড়ের মাথায় এসে দেখল একটা কাঁটা গাছের নীচে রাম হায়দারের স্ত্রী ঘুমাচ্ছেন। সে তাঁকে পিঠে তুলে সুড়ঙ্গ দিয়ে উজ্জায়িন বিক্রমে এসে রাম হায়দারের কাছে তাঁকে সমর্পণ করল। পরে রাম হায়দারের দুটি সন্তান হল লথ ও কুশ। লেখক বলেন প্রাচীনকালে ভারতবাসী ও আরবদের মধ্যে বাণিজ্যিক সংযোগ ছিল। ক্রমে রামায়ণ ও বিক্রমাদিত্যের গল্প মিলেমিশে একাকার হয়ে ভিন্ন রূপ নিয়েছে। তবে সেই সুড়ঙ্গ নাকি আজও বিদ্যমান আছে। 


এডেন ত্যাগ করে লেখক বাবেল মান্দেব প্রণালী ও লোহিত সাগরে সেভেন আপোসলস নামক সাতটি দ্বীপ পেরোলেন। অনেক শুশুকের (ডলফিন) আনন্দের খেলা প্রত্যক্ষ করলেন। অবশেষে তাঁরা সুয়েজ বন্দরে এলেন। ভারতীয় ডাক জাহাজ থেকে নেমে রেলে আলেকজান্দ্রিয়া চলে গেল। লেখকের জাহাজ সুয়েজ খালে প্রবেশ করল। এই খাল এশিয়া আর আফ্রিকাকে যুক্ত করেছে, লোহিত সাগর আর ভূমধ্যসাগরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আগে জাহাজকে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে যেতে হত, সুয়েজ খাল হওয়ায় কলকাতা ও লন্ডনের দূরত্ব সাড়ে তিন হাজার মাইল কমে গেছে। সুয়েজ খাল পেরোতে তাঁদের দুই দিন লাগল। পোর্ট সৈয়দ হয়ে তাঁরা ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করলেন। এরপর জাহাজ বৃটিশ অধিকারভুক্ত মাল্টা দ্বীপপুঞ্জের প্রধান শহর ভালেট্টা বন্দরে প্রবেশ করল। এখান থেকে সিসিলি দ্বীপের এটনার চূড়া দূর থেকে দেখা যায়। মাল্টা পাথরের দ্বীপ, এখানে চাষের যেটুকু জমি আছে তার মাটি নাকি সিসিলি দ্বীপ থেকে আনতে হয়েছে। এখানকার কমলালেবু খুব বিখ্যাত। 


এবার জাহাজ আফ্রিকার উপকূল হয়ে চলল একজন নিয়মিত যাত্রী তাঁকে ট্রিপোলি, টিউনিস, মরক্কো উপকূলের বিশেষ বিশেষ স্থান চিনিয়ে দিল। এরপর তাঁদের জাহাজ স্পেনের উপকূল বরাবর চলতে থাকল। স্পেনের পর্বত শ্রেণীর চূড়া দেখা গেল। এবার তাঁরা এলেন জিব্রাল্টার প্রণালী। এই প্রণালী ভূমধ্যসাগর আটলান্টিক সাগরকে সংযুক্ত করেছে। এই প্রণালীর দুপাশে দুটো পাহাড় যাদের প্রাচীনকালে পিলার্স সব হারকিউলিস বলা হত। রোমে জিব্রাল্টার প্রণালী পেরিয়ে আটলান্টিকে প্রবেশ করল। "নেপাল" জাহাজে আবহাওয়া ভালো থাকলেও পশ্চিম দিক থেকে বড় বড় ঢেউ এসে লাগাতে জাহাজ এক দিকে কাত হয়ে যাচ্ছিল, ডেকে হাঁটা অসম্ভব হয়েছিল, বিছানায় শুয়েও পড়ে যাওয়ার ভয় হচ্ছিল। পরে লেখক দেখলেন একটা তিমি  নাক দিয়ে ফোয়ারা ওড়াচ্ছিল। কয়েকটি হাঙর জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে অনেক দূর চলল। জাহাজ ইংল্যান্ডের দক্ষিণের প্লিমাথ বন্দরে পৌঁছাল। লন্ডন আর ২৪ ঘন্টার পথ। অবশেষে লেখক লন্ডনের নিকটস্থ আলবার্ট ডকে এসে পৌঁছলেন। আশৈশব লালিত স্বপ্নের ইংল্যান্ডে এসে লেখক ভাবাবেগে পূর্ণ হলেন। 

রেলে লন্ডন অভিমুখে রওনা হয়ে লিভারপুল স্ট্রীট স্টেশনে আসতে আধঘণ্টা লাগল। ব্লুমসবেরিতে "মিউজিয়াম" হোটেলে ঘোড়ার গাড়িতে যেতে যেতে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে পথ, বাড়ি, দোকান দেখে লেখক মুগ্ধ হলেন এবং ভারতীয়দের পরিছন্নতা বোধের অভাবের কথা ভেবে আফসোস করলেন। পরদিন থেকে তিনি প্রদর্শনীর কাজে যেতে থাকেন। ফাঁকে ফাঁকে ওয়েস্ট-মিনিস্টার ব্রিজ, হোয়াইট হল প্যালেস, অক্সফোর্ড স্ট্রীট দেখলেন। প্রিন্স অফ ওয়ালেস একদিন প্রদর্শনী দেখতে এলেন। লেখক তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেলেন। 


লন্ডনের অন্যতম বিস্ময় ভূগর্ভস্থ রেলওয়ে দেখলেন লেখক। এই রেলওয়ে ইনার সার্কেল ও আউটার সার্কেলে বিভক্ত। প্রথমটি ঘন বসতিপূর্ণ মধ্য লন্ডনে খিলান করা ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে যায়। স্টেশনগুলো বাইরে অবস্থিত। দুটি সার্কেলে ৪৮ টি স্টেশন, প্রতি তিন মিনিট অন্তর ট্রেন। বহু যাত্রী চলাচল করে। কর্মব্যস্ততার ছাপ স্পষ্ট কিন্তু ভারতীয় যাত্রীদের মতো চেঁচামেচি নেই। এখানে সবাই প্রকাশ্য স্থানে এমনকি বাড়িতেও চাপা স্বরে কথা বলে। স্টেশনগুলিতে, গাড়ির ভেতর, পথে ঘাটে সর্বত্র বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। সুড়ঙ্গ পথের রেলওয়ে ছাড়াও বহু সাবার্বান ও প্রাদেশিক রেলওয়ে লন্ডনের চারদিকে বর্তমান। এইসব রেলপথে স্কটল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ডোভার, ক্যালে প্রভৃতি স্থানে যাতায়াত করা যায়। শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ওমনিবাস চলাচল করে। ওমনিবাসগুলি ঘোড়ায় টানা। এছাড়া টেমস নদীতে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর স্টিম বোট পারাপার করে। রাস্তায় ঘোড়ায় টানা চার চাকার ক্যাব, দুচাকার হ্যান্ডসম চলে। পথচারীরা পথে ডান ধার দিয়ে আর যানবাহন বাঁ ধার দিয়ে নিয়ম মেনে চলে। 


৪ঠা মে, ১৮৮৬ ব্রিটিশ কলোনি সমূহের ও ভারতের প্রদর্শনীর উন্মোচন হল। যুবরাজ, রাজকুমারীরা প্রদর্শনী দেখতে এলেন। সম্রাজ্ঞীর তরফ থেকে এরপর একদিন স্পেশাল ট্রেনে লেখকদের নিয়ে প্যাডিংটন স্টেশন থেকে উইন্ডসর গিয়ে রাজকীয় বাহনে উইন্ডসর প্যালেসে নিয়ে গিয়ে ভোজ খাওয়ান হল। সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে একে একে সকলকে পরিচয় করে দেওয়া হল। উইন্ডসর ক্যাসেলের নানা চেম্বার, বিখ্যাত চিত্রগুলি ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স আলবার্ট-এর মেমোরিয়াল, চ্যাপেল, লং ওয়াক নামে তিন মাইল দীর্ঘ শ্রেষ্ঠ এভিনিউ প্রভৃতি লেখক দেখলেন। 


প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারীদের জন্য রিজ্মন্টে এক খামার দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল। ট্রেনে যেতে যেতে দু'ধারে ইংল্যান্ডের আরামদায়ক গ্রীষ্মকালীন সবুজ দৃশ্য দেখতে থাকলেন। লেখক একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে কেমব্রিজ যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অনুষ্ঠান সেনেট হাউসে হল। সেনেট হাউসটি খুব সুন্দর। রোমের জুপিটার মন্দিরের অনুকরণে তৈরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার দেখলেন। এখানে ৪ লক্ষ ৬ হাজারের ওপর গ্রন্থ আছে। কিংস কলেজ ও আরো কয়েকটি কলেজ দেখলেন। এরপর গ্রেট ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর প্রদর্শনীর সদস্যদের (লেখক সহ) নিমন্ত্রণ করে আতিথেয়তা দেখানোর জন্য যেন প্রতিযোগিতা শুরু করল। ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, বার্কেনহেড, ব্রিস্টল, বাথ, ওয়েলস্ এভাবে লেখক দেখলেন। ব্রিস্টলে রামমোহন রায়ের সমাধির সামনে নতজানু হয়ে লেখক শ্রদ্ধা জানালেন। বাথে উষ্ণপ্রস্রবণগুলিকে কেন্দ্র করে জনপ্রিয় স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে উঠেছে। স্থানগুলি এক এক করে লেখক দর্শন করলেন।    

                          (চলছে)
    

শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

৭৮। ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত ৩ - রসিককৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

           
               (আগের পর্বের পরে)

পুরীতে অবস্থিত অজস্র মন্দিরের বর্ণনা দিতে হলে আরেকটি পৃথক বই লেখা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন লেখক। বিশেষ কিছু মন্দিরের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। পুরী মহর্ষি মার্কন্ডেয়ের অবস্থানস্থল ছিল। এখন সেখানে মার্কেন্ডেশ্বর নামে শিব ও মার্কন্ড পুষ্করিণী নামক সরোবর আছে। পুরীতে সাতশো মঠ আছে। দেবসেবা ও ভোগদানের যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সম্পন্ন ব্যক্তিরা এই মঠগুলি নির্মাণ করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। মঠাধ্যক্ষদের বিলাসিতায় সেই অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে বলে লেখক জানিয়েছেন। পুরীর পশ্চিমাংশে লোকনাথ নামে এক স্বয়ংভূ শিবের মন্দির আছে। এই মহাদেব মন্দিরের মধ্যে গহ্বরে অবস্থিত। এই গহ্বর প্রায়ই জলে পূর্ণ থাকে, কেবল শিবরাত্রির সময় পান্ডারা অনেক চেষ্টায় জল নিকাশ করে মূর্তি বার করে। পুরীর বাসিন্দারা এই শিবের ওপর অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। পুরীর মন্দিরের প্রাঙ্গণের মধ্যে বিমলা দেবীর মন্দির অবস্থিত। যদিও জগন্নাথ মন্দিরে বৈষ্ণব মতে নিরামিষ ভোগ হয়, তিথিবিশেষে বিমলা মাতার মন্দিরে আমিষ ভোগও হয়ে থাকে। আবার জগন্নাথকে বিমলার ভৈরব বলে উল্লেখ করাও হয়ে থাকে। বিমলাদেবী ও জগন্নাথদেবের সামঞ্জস্য স্থাপন অতীব দুরুহ ব্যাপার। হরচন্ডী সহিতে অর্থাৎ পল্লীতে হরচন্ডী নামে এক দেবী আছেন। তাঁর পূজা ও বলিদান খুব ধুমধাম করে হয়। পুরীর সমুদ্রতীরে যেখানে যাত্রীগণকে স্নান করান হয় সেটিকে স্বর্গদ্বার বলে। এর অদূরে অনেকগুলি মঠ আছে, তার মধ্যে কবীর নানকের মঠ আছে। কিছু পশ্চিমাংশে শ্রীচৈতন্যের সমাধিস্থান (সেটি কি সত্যিই তখন ছিল উক্ত স্থানে?)। সমুদ্রকুল বালুকাময় কিন্তু এই বালিতেই মঠধারীরা নানা বৃক্ষ লাগিয়েছেন। সমুদ্রতীরে নানক, কবীর, দত্তাত্রেয়, শঙ্করাচার্য, তুলসীদাস, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ সকলেই শেষকাল যাপন করেছেন (কিন্তু বাস্তবে একমাত্র শ্রীচৈতন্যদেবেরই পুরীতে ভবলীলা শেষ হয়েছিল। অন্যান্যরা পুরীতে কিছুকাল কাটিয়েছেন বলে জানা যায়)। মহর্ষি দত্তাত্রেয়র আসন পুরীর স্বর্গদ্বারের বাম দিকে। শংকর স্বামীর (শঙ্করাচার্যের) মঠ সমুদ্র তীরে। এই মঠে অনেক প্রাচীন পুস্তক সংরক্ষিত আছে। এখানকার অধ্যক্ষ দামোদর তীর্থ স্বামী গভীর শাস্ত্রজ্ঞ। অন্যদিকে পুরীর পান্ডারা ধনী কিন্তু অশিক্ষিত। পুরী শহরটি আয়তনে দীর্ঘ। সাতটি সাই বা পল্লীতে বিভক্ত। বিভিন্ন পল্লীগুলিতে একটি বা দুটি বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয়। দশমীতে পুরীর সিংহ দরজার সামনে সারা শহরের প্রতিমা একত্র করে প্রদর্শন করা হয়, একে ভেট বলে। 


পুরীতে গ্রীষ্মের শেষ থেকে হেমন্তের প্রথম পর্যন্ত কাটিয়ে পুরী ত্যাগ করে বঙ্গোপসাগরের তীর ধরে দক্ষিণ দিকে রওনা দিলেন লেখক। দশ মাইল অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে হরচন্ডী দেবীর মন্দির দর্শন করলেন। প্রবাদ রামচন্দ্র বনবাস কালে এই মূর্তি স্থাপন করে পূজা করেন। এরপর দুই মাইল গিয়ে কাঁটাকুরিতে রাত্রিবাস। এখান থেকে চিল্কা হ্রদ শুরু। স্থানটিতে অতি সামান্য তিনটি মুদীর দোকান আছে মাত্র। চিল্কায় যাত্রীদের যাতায়াতের নৌকা এখান থেকে পাওয়া যায়। লেখক পরদিন নৌকায় চিল্কাযাত্রা করলেন। চিল্কার জল লবণাক্ত। লেখক পিপাসার্ত হয়ে নাবিকের কাছে জল চাইতে পাড়ে এক জায়গায় দুই ফুট গর্ত হাত দিয়ে খুঁড়ে লেখককে খেতে বলল এক যাত্রী। সেই জল মিষ্টি। নৌকা থেকে ডান পাড়ে জল দেখা যায় আর বাঁ দিকে বালুস্তর। জেলেরা জাল দিয়ে মাছ ধরছে, কোথাও তীরে মাছ শুকাচ্ছে রোদে দিয়ে। এক চড়ে এলেন তাঁরা। এই চড়টি দৈর্ঘ্যে প্রায় তিন মাইল। এটি পারিকুদ রাজ্যের রাজধানী। চড়ের মধ্যে রাজার বাড়ি, চারপাশে প্রজাদের বাস ও কৃষি জমি। রাজবাড়িতে দুদিন থেকে রাজার সঙ্গে আলাপে লেখক সুখী হলেন। তারপর চিল্কায় নৌকায় আবার চললেন উৎকল ও মাদ্রাজ বিভাগের সঙ্গমস্থলে। (তখন অন্ধ্রপ্রদেশ ছিল না। মাদ্রাজ হল বর্তমান তামিলনাড়ু)। চিল্কার বুক থেকেই তীরে পাহাড়ের শ্রেণী দেখা যায়। কূলে উঠলে মাদ্রাজ যাওয়ার গিরি সংকুল পথ দেখা যায়। এই গিরি সংকটের মধ্যে খালিকোট (খাল্লিকোট) নামক রাজ্যের রাজধানী। রাজবাড়িটি তিন দিন পর্বতের মধ্যে যেন আত্মরক্ষার্থে লুকিয়ে আছে। এই রাজ্যে শাসনব্যবস্থা ভালো নয়, রাজা অত্যাচারী। 


এরপর লেখক উৎকলের জঙ্গলমহল বা করদ রাজ্য ভ্রমণে গেলেন। পূর্বের গিরি সংকট থেকে যে রাজপথ উৎকলের জঙ্গলমহলের দিকে গেছে সেই পথে পূর্ব দিকে দশ মাইল গিয়ে বানপুর নামক স্থানে এলেন। এটি আগে রাজধানী ছিল, এখন শুধু পুরনো মন্দির দু-একটি আছে। সেখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে জঙ্গলের পথে ৬ মাইল গিয়ে একটি আউটপোস্ট পেলেন, যেটি নয়াগড়, খালিকোট ও খাস মহল এই তিন রাজ্যের সীমানা। এই পথে সন্ধ্যার পর কেউ চলাচল করে না, বাঘ ভাল্লুক এই পথে বিচরণ করে।। লেখক ওই আউটপোস্টে রাতে থাকলেন। হেড কনস্টেবল সতর্ক করলেন রাতে বাইরে যাওয়ার দরকার হলে কনস্টেবল ও পাইককে ডাকতে। তারা দুজন আগুন জ্বালান কাঠ সমেত সঙ্গে না গেলে বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়। পরদিন সকালে জঙ্গলের এক অধিবাসীর সঙ্গে জঙ্গলে প্রায় আট মাইল উত্তর-পশ্চিম দিকে গিয়ে রাতে একটি গ্রামে থেকে পরদিন দুই ক্রোশ যাওয়ার পর প্রায় দুই মাইল একটি পাহাড় পাড় হতে হল। সেই পাহাড় থেকে নামার পথ পিচ্ছিল ও বিপদজনক। তারপর পাঁচ মাইল পথ গিয়ে একটি গ্রামের ভগবত পাঠের ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করা হল। পরদিন যাত্রা করে দুপুরে নয়াগড়ের রাজধানীতে এলেন তাঁরা। সেখানকার তরুণ রাজার সঙ্গে আলাপ হল। রাজধানীর দুই পাশে দুই পর্বত। নয়াগড় থেকে এরপর লেখক গেলেন দশ মাইল দূরে খন্ডপাড়া।  এখানে একটি ক্ষুদ্র পর্বতের ওপর কন্টিলোতে নীলমাধবের মূর্তি রয়েছে। স্থানটি খুব মনোরম। মাঘী পূর্ণিমার দিন নীলমাধবের মন্দিরে একটি মেলা দেখলেন। প্রায় দশ হাজার যাত্রী সমাগমে মেলা বসে। মহানদীর অপর পাড়ে নৃসিংহপুর ও দশপালা রাজ্য। কন্টিলো থেকে লেখক দশপালা, রামচন্দ্রপুর, বোমরাজ্য, কন্দমাল প্রভৃতি রাজ্য দর্শন করলেন। কন্দমালে কন্দ বা খন্দ জাতির বাস। তারা কিছুদিন আগেও নরবলি দিত, ব্রিটিশ সেটি বন্ধ করেছে। এরপর হিন্দোল ও অঙ্গুল (আঙ্গুল) নামক রাজ্য ঘুরে এলেন। অঙ্গুলের কমলালেবু অত্যন্ত মিষ্টি। এই কমলালেবু কেউ চাষ করে না, বন্য প্রকৃতিতে এমনি জন্মায়, বন্য আদিবাসীরা এই ফল সংগ্রহ করে খায় ও বিক্রি করে। এরপর তাঁরা মহানদীতে নৌকা করে কন্টিলো থেকে কটকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন চার দিনের পথে। কটক থেকে স্টিমারে ভদ্রকে ও তারপর বালেশ্বর পৌঁছলেন। বালেশ্বর থেকে আবার তাঁরা ময়ূরভঞ্জে ফিরে যান প্রায় এক বছর পরে। 

লেখক এবার দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের অঙ্গীকার করে এই বইটি শেষ করেন কিন্তু আমরা জানতে পারি না সেইসব ভ্রমণ কাহিনী সত্যি লেখা হয়েছিল কিনা, প্রকাশিত হয়েছিল কিনা কারণ বইগুলো কোথাও পাওয়া যায়নি। অতএব যদিও লেখক বইয়ের সূচনায় বলেছিলেন যে এটি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামের বিভিন্ন জেলার বর্ণনা থাকবে কিন্তু শুধুমাত্র তৎকালীন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বর্ণনাতেই এই গ্রন্থটি শেষ হয়

৭৭। ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত ২ - রসিককৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

           
              (আগের পর্বের পরে)

ময়ূরভঞ্জ ব্রিটিশ সরকারের একটি করদ রাজ্য। ময়ূরভঞ্জে থাকাকালীন লেখক দেখলেন সপার্ষদ ব্রিটিশ কমিশনার সাহেবের আগমন উপলক্ষে রাজার করা ধুমধাম, আপ্যায়ন ও শিকারের আয়োজন। শেষে বৃটিশ কমিশনার ময়ূরভঞ্জের নাবালক রাজাকে তাঁর অভিভাবক ও প্রজাদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও জোর করে কটকে নিয়ে গেলেন ইংরেজি মতে শিক্ষাদানের জন্য। {মহারাজা শ্রী রামচন্দ্র ভঞ্জ দত্ত (১৮৭০ থেকে ১৯০২) হলেন এই নাবালক রাজা।} ময়ূরভঞ্জ একটি পর্বত ও জঙ্গলময় রাজ্য। প্রচলিত আছে ময়ূরভঞ্জ রাজ্য কীচকের (মহাভারতের বিরাট রাজার শ্যালক) শাসনাধীন ছিল। এখানে কিচকেশ্বরী নামে এক দেবীর মন্দির আছে (খিচিং-এ অবস্থিত মন্দির)। ময়ূরভঞ্জে পুরীর অনুকরণে এক জগন্নাথ মন্দির আছে। এখানে রথযাত্রা সমারোহে পালিত হয়। এই মন্দিরে একটি বটগাছ আছে যার পাতা গোকর্ণ অর্থাৎ গরুর কানের মত। তাই একে গোকর্ণ বট বলে। (হরি বলদেব জীউ বিজে নামে জগন্নাথ মন্দির, বারিপদা)। 


এরপর লেখক বালেশ্বরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বারিপদা থেকে দক্ষিণে ৩২ মাইল জঙ্গলময় রাস্তায় গিয়ে বুড়িবালাম নদী পায়ে হেঁটে পার হলেন। এই রাস্তায় ৮ থেকে ১০ মাইলের মধ্যে পানীয় জল পাওয়া যায় না। কটক রোড ধরে এক মাইল গেলে বালেশ্বর শহর এল। বালেশ্বর জেলার সীমানায় বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। কলকাতা থেকে জলযান যাত্রী ও বাণিজ্য দ্রব্য নিয়ে প্রতি আট ঘণ্টা অন্তর এখান থেকে যাতায়াত করে। এই জলপথে যাত্রীরা অল্প সময় যাতায়াত করে কিন্তু জলযানের কর্মচারীদের অভদ্রতার জন্য যাত্রীরা অনেক কষ্ট ভোগ করে। 


বালেশ্বর থেকে  চাঁদবালি নামক সমুদ্র-তীরস্থ বন্দরে (কিন্তু এটি বৈতরণী নদীর বন্দর) যাওয়ার প্রশস্ত রাজপথ আছে। পশ্চিমে একটি রাস্তা, রেবুনা (রেমুনা এখন বন্দর নয়) নামক বন্দরে গেছে। রেমুনায় ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির প্রসিদ্ধ। প্রবাদ আছে গোপীনাথ এক ব্রাহ্মণের থেকে ক্ষীর চুরি করে খেয়েছিলেন তাই তাঁকে সবাই ক্ষীর ভোগ দেয়। বালেশ্বর শহর থেকে একটি রাস্তা নীলগিরি নামক করদ রাজ্যে গেছে। এই রাজ্যের রাজধানী রাজনীলগিরি (এখন নীলাগিরি) বালেশ্বর থেকে মাত্র ৮ মাইল দূরে অবস্থিত। 


বালেশ্বর ত্যাগ করে দক্ষিণ দিকে কটক রোড ধরে ৪২ মাইল যাওয়ার পর লেখক ভদ্রক নামক স্থানে এলেন। সম্প্রতি ভদ্রক থেকে একটি ক্যানাল প্রস্তুত হয়েছে যা ব্রাহ্মণী ও বৈতরণী নদী হয়ে কটকের নীচে মহানদীতে মিলিত হয়েছে। ভদ্রকে কিছুদিন থেকে লেখক স্টিমারে উঠে সেই ক্যানাল দিয়ে কটক অভিমুখে রওনা দিলেন। এই খাল ছাড়াও চাঁদবালি বন্দর থেকে কটক পর্যন্ত আর একটি কৃত্রিম ক্যানেল তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট-এর হাতে, যদিও এই যাতায়াত ব্যবস্থা কষ্টকর স্টিমারের অব্যবস্থার জন্য। পথে এক বাঙালি পরিবারকে সাহায্য করার জন্য ব্রাহ্মণী ও বৈতরণী নদী পার হয়ে স্টিমার থেকে নেমে গরুর গাড়িতে নেউলপুর নামক স্থানের কাছে কোঙয়াপাল নামক স্থানে গেলেন লেখক। সেখান থেকে নয়াগ্রাম নামক স্থানে কিছু পুরা কীর্তি দর্শন করলেন। শুক্লেশ্বর নামক শিবের পুরাতন মন্দির (মহঙ্গা, উড়িষ্যা), রাজার কুলদেবী ভগবতী নামক ষড়ভুজা সিংহবাহিনী দেবীর মন্দির সেখানে রয়েছে। মানিকেশ্বর নামক জনৈক রাজা এই স্থানে রাজধানী নির্মাণ করেন এবং ওই মন্দিরগুলি স্থাপন করেন। মানিকেশ্বর শিবের মন্দির ভগ্নাবশেষে পরিণত। মূর্তি গহ্বরে প্রবেশ করেছে। গড়বেষ্টিত জঙ্গলময় পুরাতন রাজধানী চোখে পড়ে। সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন গৌড় থেকে তাড়িত হয়ে উৎকলে এসে নাকি মানিকেশ্বর গড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাকি সব কালের গর্ভে তলিয়ে গেছে শুধু দেবীর (মানিকেশ্বর মন্দির, মহঙ্গা) পূজা আজও হয়। 


সেখান থেকে গরুর গাড়িতে লেখক কটক রওনা দিলেন কটক রোড হয়ে। কটক শহর উৎকলের হিন্দু রাজাদের, মুঘল, পাঠান এবং মারাঠাদেরও শাসনাধীন ছিল। বিভিন্ন রাজাদের কালে এখানে বিভিন্ন স্থাপত্য নির্মিত হয়েছিল। শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে কাটযুড়ি নদীর পাড় মহারাষ্ট্রীয় শাসকরা পাথরে বাঁধিয়ে দিয়েছিল প্রায় দেড়শ বছর আগে। সেই পাথরের প্রাচীরের মধ্যে নানা দেব দেবীর মূর্তি খোদিত আছে। কটকে কটক চিন্তাই পুরাতন মন্দির (কটক চন্ডী মন্দির)। কটকে অনেক বাঙালি বাস করে। এই শহরের লোকেরা পাখি পুষতে ভালোবাসে, জমিদার মহাশয়ের বাড়িও পাখিতে পরিপূর্ণ। 


কদিন পরে লেখক পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বারো মাইল যাওয়ার পর বালিহন্তা নামক নদীর তীরে রাতে থাকলেন। তার পরদিন পুরী রোড ত্যাগ করে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে জঙ্গলময় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বেলায় ভুবনেশ্বর পৌঁছলেন পান্ডাদের সঙ্গে। ভুবনেশ্বর পৌঁছে অনেক সুদৃশ্য মন্দির দেখলেন। কিন্তু পান্ডা জানাল সেগুলো ভুবনেশ্বরের বিখ্যাত মন্দির নয়। বিন্দু সাগর নামক সরোবর দেখলেন কিন্তু তার জল খুব দূষিত হয়ে পড়েছে। তারপর ভুবনেশ্বর মন্দির দর্শন করলেন। সেই মন্দিরের সুদৃশ্য দেউল দেখে মুগ্ধ হলেন। শিব পুরাণে ভুবনেশ্বর নগরকে গুপ্তকাশি বলা হয়েছে। এখানে প্রতি ব্যক্তির বাড়িতে মন্দির আছে। ভুবনেশ্বরের রথযাত্রা বৈশাখ পূর্ণিমায় হয়।


পরদিন তাঁরা সাক্ষীগোপালে উপস্থিত হলেন। এই দেব মূর্তি কাঞ্চি রাজের সম্পত্তি। উৎকলের রাজা কাঞ্চি রাজকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাঁর অভীষ্ট দেব গোপাল ও গণেশ এনে সাক্ষীগোপাল ও পুরীতে প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে লেখক বৈশাখ মাসে উড়িষ্যাবাসীদের রাসলীলা দেখলেন। কয়েকটি মাটির মূর্তি একটি ঘরে স্থাপন করে একটি ম্যারাপ নারকেল পাতা দিয়ে ছেয়ে তার তলায় প্রায় মাসখানেক পর্যন্ত নাচতামাশা সহ এই পরব হল। কয়েকটি বালক নানা রকম সেজে উড়িষ্যার ভাষায় গান গাইল। সাক্ষী গোপালের সম্পর্কে সাক্ষ্য দান করার যে কাহিনি প্রচলিত আছে সে বিষয় লেখক বলেছেন যে তার কোন ভিত্তি নেই। 


এখান থেকে ৫ মাইল দূরে পুরী। সকালে পুরী রোডে যেতেই পাণ্ডারা বিরক্ত করতে লাগল। আঠারো নালা পেরিয়ে তিনি চন্দন তালাও এলেন, যেটি পুরীর বৃহত্তম সরোবর। নরেন্দ্র নামধারী এক ব্যক্তি এটি খনন করে দেন বলে এর নাম নরেন্দ্র পুষ্করিণী। এই জলাশয়ে জগন্নাথদেবের চন্দন যাত্রা হয়। সমগ্র বৈশাখ মাস চন্দন যাত্রার নির্দিষ্ট সময়। পুষ্করিনীর পাশে চন্দন যাত্রা উপলক্ষে নানা দোকান বসেছে। তৃতীয় প্রহরের পর পুরী থেকে মদন গোপাল জীউ এখানে আগমন করেন। 

পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের সামনে দিয়ে নির্গত হয়েছে পুরীর প্রধান রাজপথ। গুঞ্জবাটি পর্যন্ত এই রাস্তায় রথ চলে। রাস্তাটি প্রায় ১০০ ফুট চওড়া। এই রাস্তায় জগন্নাথদেবের মন্দির অভিমুখে গেলে বামদিকে উৎকল রাজের আবাস পড়ে। রাস্তার অপর পাড়ে দোকান ও পাণ্ডাদের ঘরবাড়ি। এক পান্ডার বাড়িতে রাত্রিবাস হল পুরীতে চন্দন যাত্রা দেখার পর। সেই পান্ডার সঙ্গে পরদিন শ্রীক্ষেত্র (পুরীর জগন্নাথ মন্দির) দর্শন ও প্রসাদ লাভ হল। পুরীর মহারাজের দেওয়ানের সঙ্গে এরপর দেখা করলেন লেখক। তিনি বাঙালি। এরপর প্রায় এক মাসকাল পুরীতে সেই দেওয়ানের বাড়িতে লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা সুখে শান্তিতে রইলেন। 


জগন্নাথ দেবের বাটির (মন্দিরের) পরিধি প্রায় ২ মাইল হবে, পাথরের প্রাচীরে ঘেরা চারদিকে চারটি তোরণ। পূর্ব তোরণকে সিংহদ্বার বলে। এই দ্বারের সামনে একটি প্রস্তরখন্ডের প্রায় ৩০ ফুট দীর্ঘ স্তম্ভ আছে। এই স্তম্ভটি আগে কোনারক মন্দিরের সামনে ছিল। কোনারক মন্দির ভেঙে যাওয়ার পর ওই স্তম্ভ এখানে এনে স্থাপিত হয়েছে। তোরণের সামনে প্রবেশের সময় এক জগন্নাথ মূর্তি খোদিত আছে, তাঁর নাম পতিতপাবন। যেসব জাতির মন্দিরে প্রবেশের অধিকার নেই তারা পতিতপাবন মূর্তি দর্শন করে। এই মূর্তি আগে ছিল না। পুরীর এক রাজা ঘটনাবশতঃ পতিত হয়ে মন্দিরে প্রবেশের অধিকার হারান। তখন রাজার দর্শনের জন্য এই পতিতপাবন মূর্তি স্থাপন করা হয়। সিংহদ্বার অতিক্রম করে ২২ সোপান পেরিয়ে দ্বিতীয় তোরণ আসে। এটি নতুন করে প্রস্তুত করেছেন একজন সন্ন্যাসী ভিক্ষা করে অর্থ সংগ্রহ করে। সিঁড়ির দুই পাশে ও উপরে তোরণের সামনে মিষ্টান্ন প্রসাদের বাজার। এই তোরণের দক্ষিণে একটি দ্বার আছে, তার মধ্যে অন্নের বাজার বসে, যার নাম আনন্দ বাজার। দ্বিতীয় তোরণের ভিতরে প্রথমে ভোগ মন্দির অবস্থিত। রাজার দেওয়া ভোগ মন্দিরের ভেতরে যায়। অন্য ভক্তদের প্রদত্ত ভোগ ঐ ভোগ-মন্দিরে উপস্থিত হয়। তারপর সুপ্রশস্ত নাট্যমন্দির (নাট মন্দির)। তারপর শ্রীমন্দির। মন্দিরের হর্ম্য সুউচ্চ কিন্তু ভুবনেশ্বরের মন্দিরের মতো শিল্পকলা এখানে নেই। কিছু অশ্লীল মূর্তি মন্দিরের মধ্যে রয়েছে, যা লজ্জাকর। তবে সম্ভবত এগুলি তান্ত্রিক উপাসনার অঙ্গ। শ্রীমন্দিরের চারপাশে নানা দেবদেবীর মন্দির উপস্থিত। 


জগন্নাথ দেবের মন্দিরের সমস্ত সেবা ও ভোগের জন্য প্রাত্যহিক আড়াইশো টাকার বেশি খরচ হয় বলে লেখক লিখেছেন। প্রতিদিন জগন্নাথ দেবের তিন প্রকার বেশ (পরিধান) হয়। বিভিন্ন তিথিতে বিভিন্ন বেশ হয়। রথযাত্রায় তিনটি নতুন রথ নির্মাণ করা হয়। একটি পুস্তকে লেখা নিয়ম অনুসারে রথ তৈরি হয়। কত দৈর্ঘ্য, প্রস্থ হবে, কবে রথ তৈরী শুরু ও শেষ হবে প্রভৃতি সেই পুস্তকে লেখা আছে। উৎকলের গড়জাত মহলের দশপালার রাজা রথের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের যোগান দেন। এর জন্য তিনি একটি মহল জায়গীর লাভ করেছেন। সেই জঙ্গলের কাঠ কাটিয়ে নদী তীরে পৌঁছে দেওয়া তাঁর দায়িত্ব। পুরী রাজার কর্মচারীরা সেই কাঠ নদীতে ভাসিয়ে পুরীতে নিয়ে আসে। পুরীর মন্দির থেকে গুঞ্জবাটিতে রথ পৌঁছতে পাঁচ ছয় দিন লাগে। এই সময় দেবতাদের মূর্তি রথেই থাকে। নয়দিনের মধ্যে গুঞ্জবাটিতে পৌঁছে, নবম দিনে রথ পুনরায় পুরীর মন্দিরে ফেরার জন্য যাত্রা করে।

                       (চলছে)

৭৬। ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত ১ - রসিককৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

         
          (আগের পর্বের পরে)

"ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত" বইটি ১২৯৪ বঙ্গাব্দে (১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে) প্রকাশিত হয়। বইটির শিরোনামে লেখা আছে - "ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত অর্থাৎ বাঙ্গালা, বেহার, উড়িষ্যা, আসাম প্রভৃতি প্রত্যেক জেলার সংক্ষেপ বিবরণ। রসিক কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সংগৃহীত, রচিত ও প্রকাশিত।" বইটির ভ্রমণকাল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ।

লেখক রসিককৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। উৎসর্গ পর্বে "উপহার" শিরোনামে তিনি শ্রীযুক্ত বনমালী রায়চৌধুরী তড়াসদি অধিপতি বাহাদুর সজ্জন প্রতিপালকেষু-কে "পরম কল্যাণীয়" সম্বোধনে লিখেছেন "বনমালী রায়চৌধুরী নবাবী আমলের পুরাতন জমিদার ও লেখকের কল্যাণকারী"। এই যাত্রাকালে তিনি বিভিন্ন জমিদার, রাজা ও রাজকর্মচারীদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। 

১২৯১ সালের হেমন্তের শুরুতে ছোটনাগপুর ও উৎকল ভ্রমণের উদ্দেশ্যে লেখক পথে বেরোলেন। লেখকের সঙ্গে কিছু সঙ্গী ছিল তা লেখা পড়ে বোঝা যায় কিন্তু লেখক কখনও তাদের নাম বা পরিচয় উল্লেখ করেন নি। কলকাতা থেকে বজবজ হয়ে হুগলি জেলার উলুবেড়িয়ার মহিষরেখায় আসেন। (তখন হাওড়ার নয়, হুগলি জেলার অন্তর্গত ছিল এই দুটি স্থান)। আলিপুর থেকে দশ মাইল বজবজ রোড এসে, বজবজ থেকে ৬ মাইল উলুবেড়িয়া রোড এবং উলুবেড়িয়া থেকে ক্রমাগত দক্ষিণ মুখে উড়িষ্যার কটক রোডে যাওয়া যায়। এই কটক রোড মেদিনীপুর ভেদ করে বালেশ্বর, কটক প্রভৃতি অতিক্রম করে পুরী পর্যন্ত গেছে। রূপনারায়ণের উত্তর পাড় হুগলি জেলার আর দক্ষিণ পাড় মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত। যে স্থানে রূপনারায়ণ পার হলেন, সেটিকে কোলার ঘাট (কোলাঘাট) বলে। কটক রোড ধরে তিনি হুগলি জেলা ছেড়ে নদী পার হয়ে মেদিনীপুর জেলায় এলেন। কোলার ঘাটে নদীর ওপর একটি চটি, আউটপোস্ট ও পোস্টঅফিস আছে। সেখান থেকে ১৬ মাইল পথ পেরিয়ে আসে কংসাবতী নদী। এই স্থানের নাম পাঁশকুড়া। এখানে বড় বাজার, পুলিশ স্টেশন, ক্যানাল জলকর আদায় অফিস, ইংরাজদের রেশম কুঠি আছে। এখানকার বাজারে দুধ, মাছ, সবজি খুব সস্তা। আরও ২৪ মাইল গেলে মেদিনীপুর, আবার কংসাবতী নদী পার হয়ে। এরপর আরও ১৮ মাইল পরে পাথরা নামক গ্রামে অনেকগুলি বাড়িঘর দেখা গেল। মেদিনীপুর জেলায় বিচারালয়, হাইস্কুল, মেদিনীপুর সংবাদপত্র ও প্রেস, মিশনারীদের প্রেস আছে। 

মেদিনীপুর থেকে কটক রোড যেমন পুরী গেছে, তেমন এই পথেরই শাখা সম্বলপুর ও মাদ্রাজ অবধি বিস্তৃত হয়েছে। এই রাস্তা জেলার সীমা পর্যন্ত গিয়ে সিংভূমের রাজপথের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আর রয়েছে উত্তর-পশ্চিমে রানীগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা, উত্তরে গড়বেতা, বগড়ী, রানীগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা। উত্তরে গড়বেতা হয়ে বাঁকুড়ার রাজপথে মিলিত হয়েছে আরেকটি রাস্তা। পাঁশকুড়ার পূর্ব দক্ষিণাংশে ১২ মাইল একটি শাখা গিয়ে তমলুকে পৌঁছেছে। আবার তমলুক থেকে আরেকটি শাখা ৩০ মাইল দক্ষিণে গিয়ে হিজলি কাঁথি উপবিভাগে পৌঁছেছে। সেই রাস্তাটি কাঁচা। পথে তেরপেকে ও কালিনগরের নদী নামের দুটি ছোট নদী পার হতে হয়। আবার মেদিনীপুর থেকে কটক রোডে কুড়ি মাইল গিয়ে বেলদা থেকে পূর্ব দক্ষিণে ২০ মাইল গেলে কাঁথি যাওয়া যায়। উত্তরে গড়বেতা ভেদ করে যে রাস্তা গেছে তাতে ১২ মাইল গেলে কেশপুর নামক স্থান আসে। সেখান থেকে পূর্বে যে শাখা বেরিয়েছে তাতে ৩২ মাইল গেলে ঘাটাল মহকুমা আসে। এই রাস্তা পুরনো কিন্তু বন্যার ভয়ে মজবুত করে তৈরি নয়। তারপর দক্ষিণে ২১ মাইল গেলে মেদিনীপুর জেলা শেষ হয়। সুবর্ণরেখা নদী মেদিনীপুর ও উড়িষ্যাকে পৃথক করেছে। এখানে সুবর্ণরেখার পারঘাটকে রাজঘাট বলে। বর্ষায় এই নদী ভয়াবহ রূপ নেয় তাই বাংলায় প্রবাদ আছে 'যদি গেলে সুবর্ণরেখা/ ঘুচল মা বাপের দেখা'। 


একটি ক্যানাল মেদিনীপুর পর্যন্ত কটক রোডের পাশে পাশে গেছে। এই জলপথে ছোট ছোট স্টিমার ও নৌকায় মানুষ ও পণ্যের আদান-প্রদান হয়। পথে দুই তিনটি নদী থাকা সত্ত্বেও এই খাল পথ উন্নত কৌশলে তৈরি হয়েছে বলে যাতায়াতে বাধা হয় না। নদীতে লকগেট তৈরি করে জল আটকানো ও জল ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করে এই মেদিনীপুর ক্যানালে নৌ চলাচল হয়। 

এরপর লেখক মেদিনীপুর জেলার প্রাকৃতিক অবস্থা, উৎপন্ন দ্রব্য, জাতিভিত্তিক জনগণ প্রভৃতি বিষয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন। মেদিনীপুর জেলায় অনেক প্রসিদ্ধ জমিদার আছেন, তাঁরা সকলে রাজা উপাধিধারী ও তাঁদের আবাসস্থলকে গড় বলা হয়। যেমন ময়না গড়, গড় পদুবাসান, মহিষাদলের গড়, নারায়নগড়, রামগড়, লালগড়। ময়নার গড়টি সুদৃশ্য পরিখা দ্বারা ঘেরা, স্থলভাগে বন আছে, তাতে ময়ূর হরিণ প্রভৃতি বিদ্যমান। তারপর একটি প্রশস্ত খাল পেরিয়ে রাজবাড়িতে যাওয়া যায়। নৌকায় চড়ে ছাড়া রাজবাড়ীতে যাওয়া যায় না। তমলুকের পূর্ব নাম তাম্রলিপ্ত ছিল। এই বন্দর দিয়ে পূর্বে বঙ্গদেশীয়রা সমুদ্র যাত্রা করত। এখন তমলুকের সেই সমৃদ্ধি নেই। তবে এখানে বর্গভীমা নামক মহাপীঠ ও শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মন্দির আছে। কাঁথির রাজার বাসস্থান নাজনা গড়। কাঁথির ৬ মাইল দূরত্বে গড় বাসুদেবপুর অবস্থিত। গোপগড়ে মহাভারত খ্যাত বিরাট রাজার গোশালা ছিল বলে প্রবাদ আছে। এখানে একটি স্বল্প উচ্চতার ধিপির ওপর একটি অট্টালিকা আছে। কিন্তু সেটি তত প্রাচীন নয়। বরং কাঁথির ৩ মাইল উত্তরে কাঁথির রাজাদের এলাকায় কয়েকটি প্রাচীন শিব মন্দির আছে, যেগুলি অতি প্রাচীন বলে মনে হয়। এরপর লেখক মেদিনীপুর জেলার শিক্ষার উন্নত অবস্থা ও বহুলাংশে মামলা করার প্রবণতা নিয়ে লিখেছেন। লেখক দেখেছেন যদিও মেদিনীপুর তখন বাংলার অন্তর্গত কিন্তু সেখানে উড়িষ্যার আমলের সন প্রচলিত। যেমন ভাদ্র মাসের শুক্ল দ্বাদশীর দিন থেকে সালের গণনা শুরু হয়। 

এরপর লেখক মেদিনীপুরের পশ্চিমে সিংভূম যাওয়ার রাস্তায় চললেন কংসাবতী পার হয়ে। শেষে একটি ক্ষুদ্র নদী (পলপলা?) পায়ে হেঁটে পার হয়ে সিংভূমের মধ্যে প্রবেশ করলেন। এখানে পাকা রাস্তা নেই। এক ফুট গভীর ধুলোর মধ্যে দিয়ে পথ চলা। ধুলোর জন্য হাঁটতে না পেরে শেষে গরুর গাড়িতে চললেন তাঁরা। ১২ মাইল যাওয়ার পর একটি হাট দেখলেন। সেই গ্রামে একটি গৃহস্থ বাড়িতে আশ্রয় নিলেন, এছাড়া থাকার জন্য সেখানে কোন চটি নেই। পরদিন গরুর গাড়িতে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকলেন। মাঝে মাঝে জঙ্গলের মধ্যে এক একটা বসতি। সেখানে আশ্রয় পাওয়ার আশা নেই। সারাদিনে ১২ মাইল অতিক্রম করে নৃসিংহ গড় নামক স্থানে পৌঁছালেন। এখানে একসময় ধলভূমের রাজার শাসন ছিল। সেখানে একটি দোকানে লেখক রাত কাটিয়ে পরদিন আবার রওনা হলেন ও ৬ মাইল অতিক্রম করে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এলেন। এই নদীর বালুতে অতি অল্প পরিমাণে স্বর্ণ রেণু থাকে। সেজন্য এর পাড়ের অধিবাসীরা বালি থেকে স্বর্ণরেণু বেছে বের করে। কিন্তু সেই স্বর্ণের পরিমাণ এত কম যে বহু পরিশ্রমে কোন শ্রমিক চার-পাঁচ আনার বেশি দৈনিক উপার্জন করতে পারেনা। কোথা থেকে এই সোনা আসে সেই অনুসন্ধান এখনো করা যায়নি। সুবর্ণরেখার কূল অত্যন্ত মনোরম প্রকৃতির শোভাময়। কোথাও বিশাল শালবন, কোথাও নানা রকম বৃক্ষলতায় পথিকের আশ্রয়স্থল রচনা করেছে। কোথাও আবার বিস্তীর্ণ গিরি মালা। এখানে সুবর্ণরেখার পারঘাটের বাঁপাশে ধলেশ্বরী দেবীর (যাঁর অপর নাম রঙ্কিনী দেবী) মন্দির। ধলভূমের রাজার প্রতিষ্ঠিত দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয় শারদীয় মহাষ্টমীর দিন। তীরবিদ্ধ করে মহিষ বধ করে বলি দেওয়া হয়। নিকটে রাজবাড়ি। লেখক রাজার সঙ্গে দেখা করলেন ও কয়েকদিন তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করলেন। 


ধলভূম থেকে ৪২ মাইল জঙ্গলময় পথ অতিক্রম করলে সিংভূম জেলায় পৌঁছানো যায়। সেখান থেকে শতাধিক মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে রাঁচি। রাঁচি যাওয়ার আরেকটি পথ আছে। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের কর্ড লাইনে সীতারামপুর স্টেশনে গিয়ে সেখান থেকে বরাকর পর্যন্ত শাখা লাইনে বরাকরে নেমে প্রথমে মানভূম বা পুরুলিয়া জেলা পৌঁছে সেখান থেকে সিংভূম হয়ে রাঁচি যাওয়া যায়। রাঁচি বিভাগটি পর্বত ও জঙ্গলময়। পূর্বে এই বিভাগ উৎকল সম্রাটের শাসনাধীন ছিল। ব্রিটিশের অধীন হয়ে এখন পর্যন্ত বেবন্দোবস্ত অবস্থায় আছে। 

অন্যদিকে রাজঘাটে সুবর্ণরেখা পার হয়ে ৩২ মাইল অতিক্রম করলে বালেশ্বর জেলা আসে। বুড় ভলং (বুড়ী বালাম) নামক নদীর ধারে বালেশ্বর বন্দর ও জেলা অবস্থিত। বর্ষায় এই নদীতে প্রবল স্রোত কিন্তু গ্রীষ্মে পায়ে হেটে পার হওয়া যায়। মেদিনীপুর থেকে বালেশ্বর আসার কটক রোডই প্রধান রাস্তা। তাছাড়া মেদিনীপুর থেকে ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের মধ্যে দিয়ে বালেশ্বর যাওয়ার একটি পথ আছে। সেটি মেদিনীপুরের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে মহাপাল পর্যন্ত ২২ মাইল গিয়ে সেখানে সুবর্ণরেখা নদী পায়ে হেঁটে পার হয়ে ৬ মাইল গিয়ে গোপীবল্লভপুর নামক স্থানে (এটি মেদিনীপুরের শেষ সীমা) আসা যায়। এখানে পুলিশ থানা, পোস্ট অফিস আছে। এক সঙ্গতিপূর্ণ বৈষ্ণব বাড়িতে গোপীনাথ নামে কৃষ্ণের পাথরের মূর্তি স্থাপনা হয়েছে। তাঁদের বংশ গোঁসাই উপাধিধারী। গোপীবল্লভপুর থেকে ২৪ দক্ষিণ পশ্চিম অভিমুখে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে লেখক ময়ূরভঞ্জের রাজধানী বারী পোদা (বারিপদা) পৌঁছলেন।

                        (চলছে)

মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

৭৫। ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা - কৃষ্ণভামিনী দাস

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


"ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলা" নামক কৃষ্ণভামিনী দাস প্রণীত এই বইটি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত। গ্রন্থটিতে লেখিকার নাম গোপন রাখা হয়েছে। প্রকাশক সত্যপ্রকাশ সর্বাধিকারী বইয়ের মুখবন্ধে লেখিকাকে গ্রন্থকর্ত্রী বলে অভিহিত করেছেন। নিঃসন্দেহে লেখিকার ইচ্ছায় তাঁর নাম গোপন রাখা হয়েছে। তবে কী লেখিকার মনে বাঙালি মহিলার ইংল্যান্ডযাত্রার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংশয় বা নিন্দার ভয় ছিল? 


কৃষ্ণভামিনী দাস (১৮৬২-১৯১৯) বাঙালি লেখিকা ও নারীবাদী। মুর্শিদাবাদের জন্ম নিয়ে বিবাহ পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় আসেন। তাঁর স্বামী দেবেন্দ্রনাথ দাস ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন শিক্ষাগ্রহণের কারণে। কৃষ্ণভামিনী দাস স্বামীর সঙ্গে ১৮৮২ থেকে ১৮৮৯ ইংল্যান্ডে কাটিয়ে ভারতে ফেরেন। নারীশিক্ষা ও নারীর অধিকার নিয়ে তিনি অনেক লিখেছেন ভারতী, প্রবাসী, সাধনা পত্রিকায়। বর্তমান বইটিতেও তিনি নারীবাদী মন্তব্য করেছেন বারংবার। বইয়ের শুরুতে লেখিকা বলেছেন তিনি গ্রন্থকর্ত্রী নাম পাওয়ার জন্য বা নিজের বিদ্যাবুদ্ধি প্রকাশ করার জন্য এই বই লেখেন নি। অন্য দেশে অনেক নতুন জিনিস দেখে তাঁর মনে যে নতুন ভাবোদয় হয়েছে তার সহজ সরল প্রকাশ হল এই বই। ভারতীয় যেসব যুবক ইংল্যান্ডে আসতে আগ্রহী, তারা দুই একটি বিষয় এই বই থেকে জানতে পারে। পাঠিকাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে তাঁর মত যাদের ইংল্যান্ডের বিষয় জানতে আগ্রহ হয় তাদের পরিতৃপ্ত করার জন্য এই বই। তাঁর স্বামী এই বই পড়ে সংশোধন, পরিবর্তন করেছেন এবং এই বইয়ের শিক্ষা ও রাজনীতি বিষয়ে লেখায় যথেষ্ট সাহায্য করেছেন বলে লেখিকা জানিয়েছেন। বইটিতে লেখিকা বঙ্গনারীদের পরিস্থিতির সঙ্গে ইংল্যান্ডের নারীদের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। ইংল্যান্ডের সামাজিক রীতিনীতি, ধর্ম, উৎসব, শিক্ষা, রাজনীতি, মানুষের স্বভাব চরিত্র, অর্থনৈতিক শ্রেণীবিভাগ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন বিস্তৃতভাবে। কিন্তু সেগুলি ভ্রমণ বিষয়ক নয় বলে এই লেখায় সেগুলি অনেক অংশে বর্জন করা হয়েছে। 

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮২ ইংল্যান্ড যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাবরা (হাওড়া) স্টেশন থেকে বোম্বাইয়ের উদ্দেশ্যের রেলে (কলের গাড়িতে) স্বামীর সঙ্গে এই যাত্রারম্ভে তিনি মুখ খুলে রেখেছিলেন অর্থাৎ তিনি পর্দার আড়ালে ছিলেন না, তখনকার প্রচলিত রীতি না মেনে। স্বদেশ ও স্বজন বিয়োগের ব্যথায় তাঁর হৃদয় তখন পূর্ণ ছিল। হুগলি, বর্ধমান প্রভৃতি স্টেশন তাঁর পরিচিত কারণ আগে পিত্রালয়ে ঘোমটায় মুখ ঢেকে যাওয়ার সময় তিনি এসব জায়গার ওপর দিয়ে গেছেন। আজ মাথায় টুপি পড়ে তাঁকে কেউ চিনতে পারবে না। হয়তো মেম সাহেব ভাববে। 

পাটনা স্টেশন দেখে তিনি প্রাচীন পাটলিপুত্রের হত গৌরবের কথা ভাবলেন। মোগলসরাই স্টেশন দেখে কাশী দর্শনের ইচ্ছা জাগল। এলাহাবাদ স্টেশন দেখে তিনি ভাবলেন এই স্থান হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই কাছে পবিত্র। হিন্দুদের প্রয়াগ আর মুসলমানদের আল্লার নগর। এলাহাবাদের তিনি গাড়ি বদলিয়ে স্ত্রীলোকের গাড়িতে উঠলেন। সে কামরায় আর কোন স্ত্রী যাত্রী ছিল না। কামরায় একা সারারাত কাটিয়ে সকালে জব্বলপুর এল। এখানে আবার গাড়ি পাল্টাতে হল। কলকাতা থেকে এলাহাবাদ হয়ে দিল্লি এক রেলওয়ে কোম্পানির, এলাহাবাদ থেকে জব্বলপুর আর এক রেল কোম্পানির। অনেক ট্রেন সরাসরি কলকাতা থেকে বোম্বাই যায়, একবারও গাড়ি পাল্টাতে হয় না। কিন্তু তাঁরা সেরকম ট্রেন পাননি। জব্বলপুরে কয়েকদিন থেকে নর্মদা নদীর জলপ্রপাত, মার্বেল পাথরের পাহাড়, ভগ্নাবশেষ দেখার ইচ্ছা রইল। কিন্তু ২৯ শে সেপ্টেম্বর বোম্বাই থেকে ইংল্যান্ডের জাহাজ ছাড়বে বলে এখানে থাকা হল না। এরপর থেকে রেলের জানলা দিয়ে পাহাড় আর বনভূমি দেখা গেল দুই পাশে। রেলগাড়ি কখনো সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়েও গেল। 


পরদিন সকালে তাঁরা বোম্বাই স্টেশনে পৌঁছলেন। স্বামী তাঁকে একা রেখে হোটেল ঠিক করতে গেলে তাঁর কোনো অসুবিধা হল না কারণ বিদেশী পোশাক পরা নারীকে কেউ দেখার সাহসও পেল না। তাঁরা একটা বড় হোটেলে গেলেন। বোম্বাইয়ের রাস্তা কলকাতা থেকে অনেক পরিষ্কার। রাস্তার ধারে সান বাঁধানো চলা পথ (ফুটপাথ) আছে, যা একমাত্র কলকাতার চৌরঙ্গীতে আছে। এখানকার বাড়ি ইঁট ছাড়াও কাঠ ও পাথরের তৈরি। বাড়িগুলি ছয় সাত তলা উঁচু কিন্তু প্রতিতলার উচ্চতা কম। ছাদ স্লেট দিয়ে ঢাকা ও গড়ানো তাই সেখানে ওঠা যায় না। বড় রাস্তার দু'ধারে দোকানগুলি বেশিরভাগ পার্সিদের। 


নির্দিষ্ট দিনে একটা ছোট জাহাজে কিছুদূর গিয়ে বড় জাহাজে ওঠা হল। জাহাজে পার্সি, মুসলমান আর খ্রিস্টান দেখলেন কিন্তু কোনো হিন্দু দেখলেন না লেখিকা। ক্রমে বোম্বাই শহরের আলো দূরে মিলিয়ে গেল। মাঝে মাঝে শুধু লাইট হাউসের আলো দেখা যাচ্ছিল। লেখিকার জাহাজে সমুদ্র রোগ (সি সিকনেস) হয়নি। 


জাহাজের ডেকের ওপর ক্যাপ্টেনের ঘর ও রান্নাঘর আছে। নীচে ছোট ছোট কামরার কেবিন আর প্রথম শ্রেণীর লোকেদের খাওয়ার ও বসার জন্য একটা বড় সাজানো ঘর আছে সেলুন নামে। কেবিনগুলিতে দুটি, চারটি বা তার বেশি বিছানা আছে একটি ওপর আরেকটি করে। কেবিনের মধ্যে সমুদ্রের দিকে দেওয়ালে ছোট জানালা পোর্টহোল আছে। কোনো কোনো কেবিনে স্নান করার জায়গা আছে। জাহাজের এক প্রান্তে প্রথম শ্রেণী, অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণী ও নাবিকদের ঘর, মধ্যে ইঞ্জিনের ঘর। সমুদ্রের বিভিন্ন রূপ দেখতে দেখতে চললেন তিনি। রাতের আকাশে পরিচিত নক্ষত্রমন্ডলী দেখে আনন্দিত হলেন এত দূরে তাদের দেখা পেয়ে। 


এরপর এডেন এল। ছেলেদের সাঁতার কেটে পয়সা চাওয়া, স্থানীয় লোকের জিনিসপত্র বিক্রয় করতে আসা সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি তিনিও দেখলেন। লোহিত সাগরে লেখিকা উড়ন্ত মাছ দেখলেন। এরপর সুয়েজনগরে জাহাজ থামল। তাঁরা সুয়েজ থেকে রেলপথে আলেকজান্ত্রিয়া যাবেন ও সেখান থেকে জাহাজে করে ব্রিন্ডিসি যাবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু মিশরে এতদিন যুদ্ধ চলছিল বলে জাহাজ থেকে এখানে কাউকে নামতে দিল না। তাঁদের সুয়েজ খালের ভিতর দিয়ে জলপথে যেতে হবে। 


সেদিন রাতে তাঁরা সুয়েজ বন্দরে থাকলেন। সকালে চারপাশে দেখলেন অজস্র জাহাজ। সেইসব জাহাজের জাতি, কোম্পানি হিসেবে বিভিন্ন রকম নিশান। সুয়েজ খাল সরু, একটি বেশি জাহাজ পাশাপাশি যেতে পারে না। বেশি জোরেও যেতে পারে না, ধারের মাটি খসে পড়ার ভয়ে। খালের দু'ধারে মরুভূমি, দূরে দূরে দু'একটি ঘর। নৌকায় করে অনেক সময় ডিম মাছ ফল বিক্রি করতে আসে। অতি সুস্বাদু বেদানা আঙ্গুর আপেল প্রভৃতি খেলেন লেখিকা প্রথম এখানে। ইম্মা, পোর্টসেড হয়ে জাহাজ ৪৫ ক্রোশ দীর্ঘ সুয়েজ খাল হয়ে চলল। পোর্টসেডে তাঁরা ইতালি হয়ে ইংল্যান্ডে যাওয়ার আরেকটি জাহাজে উঠলেন। 


এরপর গ্রিসের নিকটবর্তী ছোট ছোট পাহাড় দেখা যেতে লাগল। একটানা সমুদ্রে থেকে বিরক্ত লেখিকা ভাবলেন আগে যখন ইংল্যান্ড যেতে দেড় বছর, ৯ মাস, ৬ মাস ও ৩ মাস লাগতো তখন তাদের কত কষ্টই না হতো। 


এবার তাঁরা ইটালির দক্ষিণ পূর্বকোণে ব্রিন্ডিসী নগরের দুই ক্রোশ দূরে এসে পৌঁছলেন। কিন্তু মিশর থেকে ওলাওঠা রোগ যাতে ইউরোপে না প্রবেশ করে তাই কোয়ারেন্টাইন হিসেবে তিনদিন কাউকে জাহাজ থেকে নামতে দিল না। অনেক সময় প্রায় একমাস এই কোয়ারেন্টাইন প্রক্রিয়ায় মানুষকে আটকে থাকতে হয়। 


তিনদিন পর জাহাজ ভেনিসের দিকে চলল, তখন লেখিকার জাহাজ আড্রিয়াটিক সাগরে ভাসমান। ভেনিসে নামার আগে আবার একদিন কোয়ারেন্টাইন ও ডাক্তারি পরীক্ষা হয়ে অনুমোদন পাওয়া গেল জাহাজ থেকে নামার। ১৮ই অক্টোবর তাঁরা ভেনিসে নামলেন। গন্ডোলায় করে ভেনিসের রেল স্টেশনে গেলেন ও জানলেন লন্ডন যাওয়ার ট্রেন রাত ১১ টায় ছাড়বে। তাঁরা তখন গন্ডোলায় শহর দেখলেন। শহরে যেমন রাস্তা থাকে এখানে তেমন খাল। বাড়ির দরজা থেকে নৌকায় উঠে কোথাও যেতে হয়। তাই কোন গাড়ি ঘোড়ার শব্দ নেই। অসংখ্য পোলের ওপর দিয়ে পার হয়ে শহর ঘোরা যায়, কিন্তু তাতে অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হয়। একটি বাগানে গিয়ে দেখলেন অনেক মহিলা বেড়াচ্ছে। তারা বেশ সুশ্রী, চোখ ও চুল কালো কিন্তু বর্ণ শুভ্র। এখানকার গরীব নারীরা মাথায় টুপির বদলে ঘোমটার মতো করে রুমাল বাঁধে। অনেকে উত্তর-পূর্ব ভারতীয়দের মতো জামা ও ঘাগরা পরে। অতি পূর্বে ভারতীয় ও রোমিওরা প্রায় একই সময় সভ্য হয়ে। দুই জাতিই পৌত্তলিক ছিল। অতীতের গৌরব হারিয়ে ইতালি নিজেদের মধ্যে বিবাদে রত ছিল। ইতালি শেষে মাৎসিনি, গ্যারিবোল্ডির সাহায্যে আবার স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু "ভারত শুধুই ঘুমায় রয়"। 


মিলান পৌছে রেলগাড়ি বদলে তাঁরা সুইজারল্যান্ডের দিকে চললেন ও অল্পক্ষণ পরেই পার্বত্য প্রদেশে এসে পরলেন। ক্রমে রেল অতি উচ্চ পর্বত ভেদ করে চলল সুড়ঙ্গ মারফত। তাঁরা আল্পস পর্বত অঞ্চলে এসে পৌঁছলেন। সেন্ট গথার্ড নামক শৃঙ্গ দেখলেন। সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড এলেন তাঁরা। পাঁচ ক্রোশ লম্বা সুড়ঙ্গটি পেরোতে রেলের প্রায় ২৫ মিনিট লাগল। সুইজারল্যান্ডের বাসল শহরে গাড়ি পাল্টিয়ে তাঁরা আবার চললেন। রাতে গাড়ি ফ্রান্সে প্রবেশ করল। সকালে দেখলেন ট্রেন সমতল ফ্রান্সের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে ফ্রান্সের কালি নগর তথা বন্দরে এলেন তাঁরা। শহরটি প্রাচীরে ঘেরা। ফ্রান্সের প্যারিস এবং নানা নগরী ভারতের দিল্লি, জয়পুরের মত প্রাচীর বেষ্টিত। কালে থেকে আবার জাহাজে উঠলেন তাঁরা। ডোভার প্রণালী পার হয়ে ইংল্যান্ডের ডোভারনগরে এসে পৌঁছলেন। সেখান থেকে রেলে সেই রাতে লন্ডন পৌঁছলেন (২০ অক্টোবর, ১৮৮২)। লন্ডনের চেয়ারিং ক্রস স্টেশনে নেমে দেখেন চারদিকে বৈদ্যুতিক আলোয় দিনের মতো আলোকিত হয়ে আছে। ২৪ দিন পরে একটি হোটেলে গিয়ে অবশেষে তাঁরা বিশ্রাম পেলেন। 


লন্ডন বিরাট নগরী। কলকাতার প্রায় চার গুণ বড়। এখানে ৪০ লক্ষ লোকের বাস। শহর ক্রমাগত বাড়ছে। লন্ডনের চারপাশে যেসব মাঠ ছিল সেখানে এখন ঘাসের পরিবর্তে রাশি রাশি বাড়ি দেখা যায়। লন্ডনকে বিজ্ঞাপন নগর, দোকানের নগর, ধনের নগর, নাট্যশালা নগর বলা যায়। টাকা না থাকলে লন্ডনে থেকে সুখ নেই। 

লন্ডন আটটি ভাগে বিভক্ত। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভাগে মধ্যবিত্ত লোকের বাস। এখানে সস্তায় ঘর ভাড়া (পেয়িং গেস্ট) পাওয়া যায় ল্যান্ডলেডির অধীনে। হোটেলের থেকে এই ঘর ভাড়ায় থাকলে অর্ধেক খরচ হয়। পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম প্রধানত ধনীদের বাস। এখানকার ঘর ভাড়া অনেক বেশি। এই ভাগেই রানী ও প্রিন্স অফ ওয়েলসের রাজপ্রাসাদ, পার্লামেন্ট, রাজকীয় কার্যালয় প্রভৃতি আছে। পূর্ব-মধ্য ও পশ্চিম-মধ্য ভাগ কাজের জায়গা। পশ্চিম-মধ্যভাগে নাট্যশালা স্কুল কলেজ কার্যালয় দোকান আছে। পূর্ব-মধ্য ভাগকে সিটি বলে। এখানে ব্যাংক, কারখানা, দোকান আছে। এই অংশটি কিছুটা অপরিষ্কার, জনবহুল ও গাড়িবহুল। পূর্বভাগ দরিদ্র শ্রেণীর লোকের বাস, এখানে অপরিষ্কার অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা। 


লন্ডনে অনেক পার্ক আছে। সবচেয়ে বড়টির নাম রিজেন্টস পার্ক। গ্রীষ্মকালে এখানে লোকে লোকারণ্য হয়। এই বাগানের ঝিলে নৌকা চালানো যায়, লন টেনিস ক্রিকেট খেলার জায়গা আছে, একটি ক্ষুদ্র চিড়িয়াখানাও আছে। 


প্রধানত নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারিতে লন্ডন ফগ বা  কুয়াশায় ঢাকা থাকে। পথ চলতে অসুবিধা হয়, নিঃশ্বাসের কষ্ট হয় আর মন বিষাদময় হয়ে থাকে। মনে হয় নরকুন্ডে বসবাস করতে হচ্ছে। এইসব দিনে লেখিকার লন্ডন থেকে দূরে পালাতে ইচ্ছা করত। শীতকালে স্নো বা বরফপাত হয়। 

রাস্তায় ব্রুহাম, বারুচ, ফিটন, ক্যাব, অমনিবাস প্রভৃতি গাড়ি (ঘোড়ার গাড়ি) চলে। খুব সাবধানে এত গাড়ির মধ্যে দিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। এদেশে পালকি গরুর গাড়ি নেই। রাস্তায় লোকের কথার থেকে গাড়ির আওয়াজ বেশি শোনা যায়। দোকানগুলি খুব আকর্ষণীয় ভাবে সাজানো। অক্সফোর্ড স্ট্রীট দিয়ে লন্ডনের পশ্চিম দিকে হাইড পার্ক আছে। এই পার্কগুলিতে নারী-পুরুষ উভয়ে স্বাধীনভাবে বেড়ায়, ঘোড়ায় চড়ে। কেনসিংটন গার্ডেনের ভিতর মহারানী ভিক্টোরিয়ার পরলোকগত স্বামী প্রিন্স আলবার্ট-এর প্রকাণ্ড মূর্তি রয়েছে। তার চারপাশে ইউরোপের বড় বড় কবি, গায়ক, পন্ডিত, বিজ্ঞানীদের মূর্তি দেয়ালের গায়ে খোদিত আছে। চার কোণে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার সূচক চারটি পাথরের বড় বড় মূর্তি আছে। এশিয়ার প্রতিমূর্তিটি হল একটি ভারতীয় নারী হাতির পিঠে ঘোমটা টেনে বসে আছে ও তার দুপাশে চীনা ও মুসলমান লোক দাঁড়িয়ে আছে। 


লন্ডনে বাড়িগুলোর মাটির নীচে ঘর থাকে, সেই অংশে রান্নাঘর, জিনিসপত্র রাখার ঘর থাকে। আর রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে। এমনকি টেমস নদীর তলা দিয়েও রেল চলে। এছাড়া আছে ট্রাম, যাতে ২৪ জন লোক ধরে। আর রয়েছে ওয়েবাস বা বাস, যা ট্রাম-এর থেকে ছোট ও ট্রামের মত রেলের উপর দিয়ে চলে না। রাস্তা দোকান সর্বত্র গ্যাসের আলো জ্বলে। দু একটা বিখ্যাত দোকান, নাট্যশালা, মিউজিয়াম, স্টেশনে বৈদ্যুতিক আলো দেখতে পাওয়া যায়। 


লন্ডনে ৮-১০ টি রাজপ্রাসাদ আছে। রানী ভিক্টোরিয়া যে প্রাসাদে বসবাস করেন তাকে বাকিংহাম প্যালেস বলে। এই প্রাসাদের অনতিদূরে বিশাল অট্টালিকা পার্লামেন্ট হাউস অবস্থিত। পার্লামেন্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় একটি প্রকান্ড ঘড়ি (বিগ বেন) আছে, যা রাতে আলো দেয়। এর বাজনা রাতে সমস্ত লন্ডন থেকে শোনা যায়। 

লন্ডনের দক্ষিণ দিকে তিন ক্রোশ দূরে ক্রিস্টাল প্যালেস অবস্থিত, যা ১৮৫৪ এ সর্বজাতীয় মেলার জন্য দেড় কোটি টাকা ব্যয় নির্মিত হয়েছিল। এর চারপাশে কৃত্রিম প্রস্রবণ ও জলপ্রপাতে সজ্জিত বিশাল উদ্যান আছে। কাঁচের তৈরি এই বাড়িটি রাতে আলোয় অপূর্ব দেখায়। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আনা অনেক অতি পুরনো ও আশ্চর্য দ্রব্য দেখতে পাওয়া যায়। এখানকার গ্রন্থাগার অসাধারণ। লন্ডনের প্রধান গির্জা সেন্ট পলস ক্যাথিড্রল খুব উঁচু। এর উপর থেকে লন্ডন শহর সুন্দর ভাবে দেখা যায়। ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে একটি প্রখ্যাত গির্জা তথা ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত ব্যক্তিদের কবর ও কীর্তিস্থল। 

লন্ডনে প্রায় ৩০ টি নাট্যশালা আছে। এক একটিতে তিন চার হাজার লোক ধরে। আর আছে বাদ্যশালা (কনসার্ট হল), গানবাড়ি (অপেরা)। মাদাম তুসোর মোমের মূর্তির প্রদর্শনীও খুব জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। লন্ডনে বিরাট বিরাট প্রাসাদসম হোটেল আছে আর আছে খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টে অপেক্ষাকৃত উচ্চমূল্যে রাঁধা খাবার পাওয়া যায়। বাড়িতে সুবিধা না হলে বা রাস্তা-চলতি সময়ে সেখানে খেয়ে নেওয়ার সুবিধা আছে। এছাড়া রয়েছে পানশালা বা পাবলিক হাউস, যাকে জিন প্যালেস বলা হয়। 

লন্ডনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা বাদ দিলে এখানে শেষ হয় কৃষ্ণভামিনী দাসের লন্ডন তথা ইংল্যান্ড ভ্রমণ কাহিনী।

সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫

৭৪| মিশরযাত্রী বাঙ্গালী - শ্যামলাল মিত্র

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



"মিশর যাত্রী বাঙালি"র লেখক শ্যামলাল মিত্র সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। বইটি প্রকাশিত হয় ১২৯১ সালের আশ্বিন মাসে অর্থাৎ ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে। আগে এই রচনাটি সঞ্জীবনী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে মিশর যুদ্ধে বাঙালি ভারত-সেনা শ্যামলাল মিত্রের অভিজ্ঞতার কথা এই বইতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এর আগে কোন বাঙালি এত দূর দেশে যুদ্ধে যায়নি। শুধু কাবুলে এর আগে কয়েকজন বাঙালি গেছিলেন কিন্তু তাঁরা কোন ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ করেননি। দ্বিতীয় কাবুল যুদ্ধে (১৮৭৮-১৮৮০) শ্যামলাল মিত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখান থেকে ফিরে দুই বছর বিশ্রাম নিয়ে ১৮৮২-র জুলাই মাসে আত্মীয় বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে তিনি মিশর যুদ্ধে যাত্রা করেন। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি বোম্বাই পৌঁছান। 


বোম্বাই অতি চমৎকার দেখতে শহর। সমুদ্রবেষ্টিত, ছোট ছোট সবুজ পাহাড় সম্বলিত এই শহরের সুউচ্চ প্রাসাদ ও সৌধ এখানকার প্রাচুর্যের প্রকাশ। সমস্ত রাস্তায় ট্রামওয়ে, গ্যাসের বাতি ও নল প্রবাহিত জলের ব্যবস্থা আছে। সুন্দর সুন্দর উদ্যান, বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, বাজার সবই রয়েছে এখানে। তার মধ্যে চারদিক থেকে সৈন্যসমাগমে, প্রচুর যুদ্ধসামগ্রী আয়োজনে, বন্দরে বন্দরে পতাকাশোভিত রণতরীর জন্য বোম্বাই শহরের শোভা আরো বর্ধিত হয়েছিল। অগাস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ,'বোম্বে প্রিন্সেস ডক' থেকে জাহাজে তিন মাসের উপযুক্ত খাদ্য সামগ্রী ও প্রয়োজনীয় বস্তু নিয়ে তাঁরা মিশর যাত্রা করেন। জাহাজে একজন বাঙালি কেরানি ছিলেন বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। প্রচুর সেনা, কর্মচারী, ডাক্তার ছাড়াও ৬৫টি অশ্ব ও ৩০০ টি অশ্বেতর (খচ্চর) জাহাজে ছিল। বিদায়কালে যে শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তা হৃদয়ভেদী। 


জাহাজে প্রধান কর্মচারী ও ডাক্তাররা সেলুনে; দ্বিতীয় শ্রেণী অর্থাৎ কেরানী, গোমস্তা প্রভৃতি কেবিনে; অন্যান্য সকলে ডেকে স্থান পেল। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যক্তিরা জাহাজের হোটেলে প্রতিদিন যথাক্রমে চার ও দুই টাকার বিনিময়ে খাদ্যপ্রস্তুতের দ্রব্য পেত। জাহাজ গভীর সমুদ্রে পৌঁছতেই প্রায় সকলে অসুস্থ হয়ে পড়ল। মাথাঘোরা আর বমির পীড়ায় প্রায় সাতদিন এরকম চলল। সমস্ত ভারতবাসীর রান্নার জন্য একটি মাত্র স্থান ও চার ঘন্টা মাত্র সময় নির্ধারিত ছিল। একটা উনুনে হিন্দু-মুসলমান পরপর রান্না করে যে যার স্থানে গিয়ে খাবার খেত। একদিন জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়েছিল কিন্তু তা ঈশ্বরের কৃপায় রক্ষা পায়। তারপরের দিন তাঁরা আদম (এডেন) পৌঁছলেন, জাহাজ বোম্বাই ছাড়ার আট দিন পর। 


আদম বন্দরে পৌঁছানোর আগে এক ঝাঁক উড়ুক্কু মাছ উড়ে যেতে দেখলেন। আদমকে ভারতের দ্বার বলা হয় কারণ ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপে আসতে হলে সর্বদা আদম হয়ে আসতে হয়। ইংরেজ সৈন্য এই স্থান সর্বদা সুরক্ষিত রেখেছে। এখানকার আদি অধিবাসীরা কৃষ্ণকায়, দীর্ঘ কোঁকড়া চুল, লাল চোখের অধিকারী, আরবি-ভাষী, অশিক্ষিত এবং ইংরেজদের দ্বারা প্রতিপালিত। কিছু স্থানীয় যুবক জাহাজের চারপাশে সাঁতার কাটতে থাকল, নাবিকরা পয়সা ছুড়ে দিলে তারা সাঁতার কেটে সেখানে পৌঁছে আশ্চর্য উপায়ে সব পয়সা উদ্ধার করে নিয়ে গেল। অপরাহ্নে আবার যাত্রা শুরু হল। জাহাজ এতক্ষণ আরব সাগরে ছিল, এবার লোহিত সাগরে চলতে থাকল। 


আদম থেকে ছয় দিনের পথে সুয়েজ পৌঁছে তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার আদেশ এল। ছোট ছোট নৌকায় তীরে পৌঁছে তাঁরা সাত দিনের কুচকাওয়াজ পথে অর্থাৎ সাত দিন পায়ে হেঁটে বা অশ্বারোহণে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছালেন। ইসমালিয়া থেকে কাসাসিন ১২৯ মাইল রেলওয়ে দ্বারা যুক্ত। রেল লাইনের এক দিকে পানীয় জলের খাল বয়ে গেছে। অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি। এই মরুভূমি বিগত মিশর যুদ্ধের রঙ্গভূমি।


[প্রাচ্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে মিশর ইউরোপীয়দের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান ছিল। মিশরের শাসক মোহাম্মদ আলী পাশার (শাসন কাল ১৮০৫-১৮৪৮) সময় অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে মিশর একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রের পরিণত হয়। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে বৃটেন ভারতে বাণিজ্য বজায় রাখার জন্য এবং বিদেশের মাটিতে নির্মিত প্রথম ব্রিটিশ রেলপথ নির্মাণের জন্য উত্তর মিশরে তাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে ফ্রান্স ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে সংযুক্ত করার জন্য সুয়েজ খাল নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগ করে। ইসমাইল পাশার (শাসনকাল ১৮৬৩-১৮৭৯) নীতির কারণে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আর্থিক সংকট চূড়ান্ত হলে তিনি সুয়েজ খাল কোম্পানির মিশরের শেয়ার ব্রিটেনের কাছে বিক্রি করেন। ইউরোপীয় ও অটোমান শাসনের প্রতি অসন্তোষ ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে মিশরে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহের সূচনা করে। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী ১৮৮২ সালে দেশের আর্থিক স্বার্থ রক্ষার জন্য মিশর দখল করে, যা একটি যুদ্ধে পরিণত হয়। যুদ্ধে ব্রিটেন জয়লাভ করে। জাতীয়তাবাদী নেতা আহমেদ উরাবি (যাঁকে লেখক আরবি পাশা বলে লিখেছেন) সহ বিদ্রোহীরা ধৃত ও শ্রীলঙ্কায় নির্বাসিত হন। এরপর ব্রিটিশ তাওফিক পাশাকে (শাসন কাল ১৮৭৯-১৮৯২) মিশরের শাসনকর্তা বা খেদিভ হিসেবে রেখে একটি নামমাত্র সরকার গঠন করেন। যদিও মিশর অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ রইল কিন্ত প্রকৃতপক্ষে মিশর ব্রিটিশ সামরিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে চলে আসে]। 


মিশরের এই যুদ্ধের বিভিন্ন বর্ণনা যা লেখক লিখেছেন তা ভ্রমণ বিষয়ক না হওয়ায় বর্জিত হল। এরপর যুদ্ধের শেষে সৈন্যরা ফিরে যাচ্ছে। কোথাও বিজয়ী সেনা অবলা মিশরীয় নারীর উপর অত্যাচার করছে, কোথাও অর্থ লুঠ করছে, কোথাও ক্ষুধার্ত মিশরীয়রা দুর্বলের খাবার কেড়ে খাচ্ছে - এইসব বীভৎস দৃশ্যে মিশর ভর্তি। 


যুদ্ধের শেষে একা লেখক কাইরো ফিরছেন ঘোড়ায় চড়ে সশস্ত্র অবস্থায়। যুদ্ধে তিনি সঙ্গিদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। তিনদিন কিছু খেতে পান নি। ঘোড়াটিও খেতে না পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু কোন গ্রাম চোখে পড়ছে না। যখন লেখক প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন তখন দেখলেন ঘোড়া একটা সবুজ উপবনে প্রবেশ করেছে। ক্রমে একটি গ্রামে এসে পৌঁছলেন লেখক, যেটি যুদ্ধের ফলে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এবং প্রায় পরিত্যক্ত। একটি অসহায়া মিশরীয় মহিলাকে এক নরাধম শ্বেতকায় সৈন্যের হাত থেকে রক্ষা করলেন লেখক। নারীটি কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে লুকিয়ে থাকা একটি তরুণ লেখককে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রুটি, খেজুর, জল খেতে দিল। লেখককে তারাই পথের সন্ধান দিল। 


লেখক নিকটস্থ জাগ-আ-জিগ শহরের রেল স্টেশনে পৌঁছলেন। স্টেশনটি সুন্দর এবং তার সংলগ্ন একটি সুন্দর হোটেল আছে। সেখানে ইংরেজ কর্মচারীর সঙ্গে দেখা করে লেখক তাঁর সঙ্গীদের অবস্থান জানতে পারলেন। পরের দিন কাইরো যাওয়া ঠিক হল। পরদিন সকালে লেখক সেই রাজপুরুষের থেকে শহর দর্শনের পাস, ঘোড়া ও দুজন সঙ্গী নিয়ে জাগ-আ-জিগ শহর দর্শনে বেরোলেন। শহরটি সুন্দর কিন্তু যুদ্ধাবসানে শ্রীহীন। অধিকাংশ বাড়িতে লোকজন নেই, দোকান বাজার বন্ধ। শুধু দু একটি ফল বিক্রেতা রমণী ফলের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে ফল বিক্রি করছে। 


দ্বিপ্রহরে কাইরো যাওয়ার ট্রেন ছাড়ল। কাইরো পৌঁছাতে নয় ঘন্টা লাগল। এই সময় ট্রেন থেকে অনেক নতুন স্থান, সুন্দর উদ্যান, অপূর্ব ঘরবাড়ি এবং নীলনদের শোভা দেখলেন লেখক। নীলনদ এই দেশের মরুভূমিকে জল দিয়ে শস্যশ্যামলা একটি সাম্রাজ্যে পরিণত করেছে। কাইরো স্টেশন থেকে লেখক আবাসীয়া ছাওনিতে কোন মতে আশ্রয় পেলেন এবং সহযোদ্ধা এবং জাহাজের সহযাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হলেন। তারপর থেকে তিনি অফিসের কাজে নিযুক্ত হলেন আবাসীয়া রাজপ্রাসাদে জেনারেল সাহেবের বর্তমান আবাসস্থলে। এক মাসের বেশি কাইরো শহরে থাকার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ- র কাছে শহর ঘুরে দেখার প্রার্থনা জানাতে ভাগ্যক্রমে সেই প্রার্থনা মঞ্জুর হল। 


এর মধ্যে লেখক একদিন এক মিশরীয় সহকর্মীর বাড়িতে রাতে খাবারের জন্য নিমন্ত্রিত হন। বাড়িতে সুন্দর ইঁটের তৈরি দোতলা বাড়ি, সামনে সুন্দর বাগান, নানা ফুলে ভরা। বাড়ির ভেতরে পরিছন্নতা ও সুরুচির ছাপ সর্বত্র। খাবার ঘরে গৃহকর্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তিনি অতিথিদের অতিথিদের সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং তাঁদের যত্ন করে খাওয়ালেন। তারপর অন্য একটি কক্ষে তাঁরা গেলেন। সেখানে টেবিলে কারুকার্য করা ঢাকনা পাতা, তার উপর সোনালী রূপালী রঙের নানা পাত্রে নানা রকম ফল সাজান। এই ফলাহারকালে সকলের ব্যক্তিগত কথা আলোচনা করার সময় জানা গেল এই মিশরীয় ভদ্রলোক আসলে একজন বঙ্গ সন্তান। কিশোর বয়সে পিতামাতৃহীন হয়ে তিনি দেশ ভ্রমণে বের হন এবং দশ বছর যাবত দেশে ভ্রমণ করে বিদেশ যাওয়ার বাসনা হয় তাঁর। তখন একটি জাহাজে কাজ নিয়ে প্রথমে মক্কা ভ্রমণ করে তারপর মিশরে যান। পরে সেখানে মিশরীয় মহিলাকে বিবাহ করে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন। 


পরদিন সেই মিশরীয় তথা বাঙালির সঙ্গে লেখক নীলনদের তীরে পিরামিড দেখতে গেলেন। প্রথমে পিরামিড দেখে তিনি হতাশ হয়ে ভেবেছিলেন এ শুধু কতগুলি শুষ্ক পাথরের স্তুপ। কিন্তু আকাশস্পর্শী পিরামিডগুলোর মধ্যে প্রবেশ করে যা দেখলেন তা কখনো কোথাও দেখেননি, বর্ণনা করার ভাষাও তাঁর নেই বলেছেন তিনি। পিরামিড এত উন্নত প্রযুক্তি দ্বারা নির্মিত হয়েছে যে মনে হয় তা বিধাতা তৈরি করেছেন। ইংরেজরা বহু উন্নতি করেছে বিজ্ঞানে কিন্তু তাদের বর্তমান পূর্তকার্যের থেকে পিরামিড কোটি গুন উন্নত ও স্বতন্ত্র। প্রতিটি পাথর অন্য পাথরের সঙ্গে কোথায় যুক্ত হয়েছে কোনভাবেই বোঝা যায় না আর তাদের আলাদা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। 


কাইরো শহরে প্রশস্ত রাজপথের দুই পাশে দোতলা থেকে পাঁচতলা সুন্দর অট্টালিকা দেখলেন। কিন্তু সর্বত্র বিষাদের ছাপ। পথের ধারে পথিকদের খাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে পশুর মাথার আকৃতি দেওয়া অংশ স্তম্ভের ওপরে বসানো আছে। সেই মুখ এক দিকে ঘোরালে জল পড়ে, অন্যদিকে ঘোরালে জল বন্ধ হয়। একটি স্থানে মন্দিরের সামনে তিনি পানশালা দেখলেন। অন্যত্র রাজকীয় পণ্যশালা দেখলেন, যা একটি বিশাল প্রাসাদ এবং সেখানে অজস্র জিনিসপত্র ক্রয়বিক্রয়ের জন্য সাজানো রয়েছে। এরকম পণ্যশালা ভারতের কোন শহরে লেখক এর আগে দেখেননি। 


এরপর তিনি রাজপ্রাসাদ দেখতে গেলেন। প্রাসাদের সামনে উদ্যানে একদল সুন্দর যোদ্ধার বেশধারী মিশরীয় জয়বাদ্য বাজাচ্ছে। প্রাসাদের দরজায় মিশরীয় যোদ্ধা ও ইংরেজ সশস্ত্র সেনা পাহারা দিচ্ছে। লেখক দেখলেন মিশরের সাধারণ মানুষ যখন যুদ্ধের কারণে গভীর বিষাদের মগ্ন তখন রাজপ্রাসাদে আমত প্রমোদ আনন্দ লীলা চলছে ইংরেজদের সঙ্গে। মিশরের রাজা আজ বিজয়ী ইংরেজ সেনাপতিকে আমন্ত্রণ করেছেন, তাই এত ধুমধাম আয়োজন। লেখক ইংরেজের মোহিনী শক্তিতে অবাক হলেন আর মিশর রাজের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন। এরপর লেখক যুদ্ধে আহত, পীড়িত, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহীন যোদ্ধাদের দেখতে গেলেন। তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট চোখে দেখা যায় না। তবে দেখলেন কজন তুরস্ক দেশের মেয়ে নিজেরা অগ্রবর্তী হয়ে রোগীদের সেবার ভার তুলে নিয়েছেন। 


অবশেষে ১৮৮২ পয়লা অক্টোবর থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীকে ফেরত পাঠানোর কাজ শুরু হল। ভারতবাহিনী পদাতিক, অশ্বারোহী, তাছাড়া উট, খচ্চর, ঘোড়ার গাড়ি সব একের পর এক দাঁড়িয়ে আদেশ পাওয়া মাত্র বাজনার সঙ্গে কুচকাওয়াজ করে যাত্রা শুরু হল। এইভাবে সাত দিন কুচকাওয়াজে এই পথ অতিক্রম করা হল। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে এইভাবে তাঁরা কাইরো থেকে সুয়েজ যাত্রা করলেন। প্রতি রাতে ইংরেজরা তাঁবুতে শয়ন করল এবং ভালো খাবার পেল। ভারতীয় সৈন্যদের জন্য কোন ছাউনি ছিল না, খাবারের বন্দোবস্তও তেমন ছিল না। এমনকি মরুভূমিতে প্রচন্ড তাপে পানীয় জল পাওয়া দুষ্কর ছিল। এর উপর ছিল ইংরেজ ঊর্ধ্বতনদের অকথ্য অত্যাচার যার কিছু বর্ণনা লেখক তাঁর বইতে দিয়েছেন। সুয়েজ উপকূলে এসে বহু তাঁবু পরল। প্রথমে সাহেবরা জাহাজে চলে গেল, তারপর ধীরে ধীরে অন্যরা। কিন্তু লেখক কোন ভারতগামী জাহাজ যে স্থান পেলেন না। 


সুয়েজে প্রায় একমাস থাকার পর লেখক একটি জাহাজে স্থান পেলেন। সেনাবাহিনীর ইংরেজ ক্যাপ্টেনের অত্যাচারী মনোভাবের জন্য লেখক থাকার জায়গাও ভালো পেলেন না জাহাজে। খুব কষ্ট করে দিন কাটাতে লাগলেন। একদিন লোহিত সাগরে জাহাজ প্রচন্ড বজ্রবিদ্যুৎসহ তুফানে পড়ে কোনক্রমে রক্ষা পেল। কিন্তু এর দুদিন পর জাহাজ আরো বড় ঝড়ে পড়ল। ঢেউ এসে জাহাজের দোতলার ডেকে পড়ছিল। হঠাৎ একটি তরঙ্গ এসে লেখককে একেবারে নীচে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তিনি নীচের তলায় একটি ফলকের ওপর পড়লেন এবং তাঁর পা একটি খচ্চরের দুই পায়ের মধ্যে জড়িয়ে যাওয়ায় সমুদ্রে পড়লেন না। জ্ঞান হারিয়ে তিনি সেখানে পড়ে রইলেন আর তাঁর ওপর দিয়ে সমুদ্রের জলস্রোত বয়ে যেতে থাকল। কিছু পরে জ্ঞান হলে তিনি বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন ও কিছু লোকের সাহায্যে তিনি তাঁর শোয়ার জায়গায় এসে দেখলেন তাঁর প্রায় সমস্ত জিনিসপত্রই জলে ভেসে চলে গেছে। এমনকি তার পোশাক এবং প্রিয়জনদের জন্য কেনা তাঁর সব উপহার ভেসে গেছিল। শারীরিক ও মানসিক অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে এবং তার মধ্যে ইংরেজ প্রভুর নানা অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে তিনি অবশেষে বোম্বাই ফিরলেন। 


বোম্বাই থেকে তিনি এলাহাবাদে যান এবং সেখানে তাঁকে  কিছুকাল কাজ করতে হয়। তিন সপ্তাহ পর তিনি রাউলপিন্ডি যাওয়ার পাস পান। এরপর লেখক কলকাতায় গেলেন যা লেখক তাঁর জন্মভূমি বলে লিখেছেন। পনেরো দিন কলকাতায় কাটিয়ে রেলে পাঞ্জাব রওনা দিলেন তিনি। পথে কাশী, প্রয়াগ, কানপুর, আলীগড়, অমৃতসর, লাহোর প্রভৃতি স্থানে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে ১৮৮৩ -র শুরুতে রাউলপিন্ডি পৌঁছালেন তাঁর নিকটজনদের কাছে। ফেরার পথে জাহাজে তাঁর যে দুর্ঘটনা হয়েছিল তার ফলে তিনি অকর্মণ্য হয়ে যান ও পদচ্যুত হন। ইংরেজ গভর্মেন্ট তাঁর প্রতি নির্দয় ব্যবহার করে। 


পরিশেষে, লেখক ভারতবাসীদের দাসত্ব মনোভাব থেকে জেগে উঠে স্বাধীন কৃষি-বাণিজ্যের উন্নতি করে দেশের উন্নতি সাধন আর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ভাব জাগরিত করতে আহ্বান জানিয়েছেন।

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...