সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
---- সুমনা দাম
বাংলা ভাষায় চৈতন্য জীবনী সাহিত্যের মধ্যে প্রথম এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় সাহিত্যটি হল বৃন্দাবনদাস রচিত "চৈতন্য ভাগবত"। বৃন্দাবনদাস (১৫০৭-১৫৮৯) তাঁর গ্রন্থে শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রধান সহচর নিত্যানন্দ প্রভুর জীবনীও বর্ণনা করেছেন। নিত্যানন্দ প্রভু (১৪৭৪-১৫৪০) শ্রী চৈতন্যের (১৪৮৬-১৫৩৪) থেকে বয়সে বড় ছিলেন। শ্রীচৈতন্যের আগেই তিনি একা তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। তাই শ্রীচৈতন্যের ভ্রমণ নিয়ে আলোচনা করার আগে নিত্যানন্দের সেই ভ্রমণকাহিনী উপস্থাপন করা হল।
নিঃসন্দেহে তিনি পায়ে হেঁটে এই তীর্থ ভ্রমণ করেন। যেহেতু বহুদিন অতিক্রান্ত , তাই বহু স্থানে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে, বহু স্থানের নাম আমূল পরিবর্তিত হয়েছে, বেশ কিছু নদী বা খাল গতিপথ পাল্টেছে বা শুকিয়ে গেছে। তাই ওই গ্রন্থগুলিতে উল্লিখিত সব জায়গা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না, তবু আমি প্রধানতঃ গুগল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে বেশ কিছু জায়গা খুঁজে পেয়েছি, কিছু পাই নি, কিছু নিয়ে সন্দিহান থেকেছি। লেখার সময় ব্রাকেটের () মধ্যে আমি সেগুলি উল্লেখ করেছি। যেগুলি পাই নি, প্রশ্ন চিহ্ন (?) ব্যবহার করেছি।
গৌর নিতাই (ইসকন মন্দির, পানিহাটি)
যখন নিত্যানন্দের বয়স কুড়ি বছর তখন (আনুমানিক ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ) তিনি তীর্থ যাত্রা করেন। এর থেকে অনুমান করা যায় যে সেই সময় সংখ্যায় কম হলেও বাঙ্গালীদের মধ্যে তীর্থ ভ্রমণ প্রচলিত ছিল। তিনি বক্রেশ্বর (বীরভূমের সতীপীঠ), বৈদ্যনাথ ধাম, কাশী, প্রয়াগ, মথুরা, বৃন্দাবন পরপর ভ্রমণ করেন। গোকুলে তিনি নন্দের ঘরবসতি দর্শন করেন বলে লিখিত আছে। এরপর তিনি হস্তিনাপুর (বর্তমান উত্তরপ্রদেশে), তারপর দ্বারকা যান ও সমুদ্র স্নান করেন। কপিলের স্থান সিদ্ধপুরে যান (অধুনা গুজরাটের সিদ্ধপুর-এর কপিলমুনি আশ্রম) যান। তাঁর লেখায় ভ্রমণের স্থানগুলি বেশ কিছুটা এলোমেলো ভাবে সাজানো আছে। হয়তো স্থানগুলি সম্পর্কে কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অভাবে এটা ঘটতে পারে। বেশ কিছু স্থানের নাম এখন পরিবর্তিত হয়েছে। সেগুলি ব্র্যাকেটে দেওয়া হল। কিছু স্থানের বর্তমান অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। নিত্যানন্দ এরপর পরপর মৎস্য তীর্থ (বর্তমানে অজ্ঞাত), শিব কাঞ্চি (বর্তমান তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরম), বিষ্ণু কাঞ্চি (বর্তমান তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুর), বিন্দু সরোবর (সিদ্ধপুর গুজরাট), প্রভাস (গুজরাট), ত্রিতকূপ (অজ্ঞাত), মহাতীর্থ- ব্রহ্মতীর্থ-চক্রতীর্থ (উত্তরপ্রদেশের নৈমিষারণ্য), প্রতিশ্রোতা (অজ্ঞাত) হয়ে অযোধ্যা যান। অযোধ্যায় রাম জন্মভূমি দেখে তিনি কাঁদেন। গুহকচন্ডালের রাজ্য (অজ্ঞাত) দর্শন করেন। কৌশিক মুনির স্থান (অজ্ঞাত), পৌলস্ত আশ্রম (বর্তমানে নেপালে অবস্থিত), গোমতী, গন্ডক, শোন তীর্থ (নদীগুলি আজও বিদ্যমান কিন্তু তীর্থ আর নেই), মহেন্দ্র পর্বত চূড়া (অজ্ঞাত), সপ্ত গোদাবরী (অজ্ঞাত), বেণুতীর্থ (অজ্ঞাত), শ্রী পর্বত (সম্ভবতঃ অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈলম) দর্শন করেন।
তারপর তিনি দ্রাবিড়ে (দক্ষিণ ভারতে) গেলেন। বেঙ্কট নাথ (তিরুপতি মন্দির, অন্ধ্রপ্রদেশ), কাঞ্চি (কাঞ্চিপুরম তামিলনাডু), শ্রীরঙ্গনাথ (শ্রীরঙ্গম তামিলনাডু), ঋষভ পর্বত (সম্ভবতঃ বিন্ধ্য পর্বত), তাম্রপর্ণী (তামিলনাড়ুর নদী), মলয় পর্বতে (কেরালার মলয়াদ্রি ?) অবস্থিত অগস্ত্য আলয় (দণ্ডকরণ্য ?), বদ্রীকাশ্রম (অজ্ঞাত), নন্দীগ্রাম (অজ্ঞাত) হয়ে কন্যকানগরে যান। সেখানে দুর্গা দেবী দর্শন করেন। কবি কি কন্যাকুমারীর কথা বলছেন ? নাকি বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়ারার কনক দুর্গা মন্দিরে গেছিলেন? তারপর গেলেন দক্ষিণ সাগরে (ভারত মহাসাগর কি ?) তারপর শ্রীঅনন্তপুর (অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর), পঞ্চ অপ্সরা সরোবর(অজ্ঞাত), গোকর্ণাখ্য শিবমন্দির (কর্ণাটকের গোকর্ণ মন্দির), ধনুতীর্থ (তামিলনাড়ুর ধনুস্কোটি), রামেশ্বর (তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম), বিজয়নগর (কর্ণাটক), হয়ে নীলাচল (পুরী) আসেন। তারপর তিনি গঙ্গাসাগর হয়ে আবার মথুরাতে যান। সেখানে কিছুদিন থেকে নবদ্বীপ আসেন। এই ভ্রমণে নিত্যানন্দ প্রভুর কোনো সঙ্গী ছিল না।
বৃন্দাবনদাস এই গ্রন্থ নিত্যানন্দের ভ্রমণের বেশ কিছুদিন পরে লেখেন এবং শ্রুত কাহিনীর ওপর নির্ভর করে লেখেন। তাই তথ্যের কিছু বিকৃতি ঘটতেই পারে, কিন্তু সেই সময়ের তীর্থগুলি সম্পর্কে একটা ধারণা করা যেতে পারে তাঁর লেখা থেকে।
পরের পর্বে থাকবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভ্রমণকথা।
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!


