মঙ্গলবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৪

২৩। তীর্থ ভ্রমণ ৮ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

      সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ    ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী লিখেছেন "ফাল্গুনী পৌর্ণমাসীতে শ্রীবৃন্দাবনে ফুলদোলের সময় কুম্ভের মেলা হয়। এই মেলা দ্বাদশ বছর অন্তর হয়। প্রথমে ফুলদোলে শ্রীবৃন্দাবন পরিক্রমের মেলা অন্তে হরিদ্বার গমন করে।"


যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় ১২৬১ সালের চৈত্র মাসে অর্থাৎ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চে বৃন্দাবন থেকে হরিদ্বারে কুম্ভ মেলায় স্নানের জন্য যাত্রা করলেন। ১৫ই চৈত্র ১২৬১ সালে তিনি হরিদ্বারে পৌঁছলেন এবং ২১ থেকে ৩০ চৈত্র কুম্ভ মেলা দর্শন করলেন। অর্থাৎ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে হরিদ্বারে মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি আরো বলেছেন দ্বাদশ কুম্ভের পর যে কুম্ভ হয় তাকে মহাকুম্ভ বলে। কুম্ভ বলার কারণ হলো এই যে বৃহস্পতি কুম্ভরাশিস্থ যে বছর হন, ওই কুম্ভরাশিস্থ বৃহস্পতিতে  মহাবিষুব সংক্রান্তির সঞ্চার যে সময় হয় সেই সময় হরিদ্বারে হর কি পৌরী ঘাটে স্নান হয়। উল্লেখ্য যে সেই সময় ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন বহাল ছিল।


হরিদ্বারের মহাকুম্ভ মেলাতে সেবার বহু দেশের মানুষের একত্র মিলন হয়েছে। প্রায় দেড় ক্রোর মানুষ এসেছে। চারদিকে তিন ক্রোশ পর্যন্ত মানুষের বসতি ও বাজার হয়েছে। স্থানাভাব এত হয়েছে যে সব মানুষ মাথা গোঁজার জায়গা পায়নি। পথ চলতে গেলে ঠেলাঠেলিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। কোম্পানি বাহাদুর এই বন্দোবস্ত করেছিলেন যে, যে পথে লোক একবার যাবে সে পথে আর সে ফিরতে পারবে না। এই বন্দোবস্ত দেখার জন্য স্থানে স্থানে রক্ষীরা লাঠি হাতে ঘুরছিল। গঙ্গার উপর দুটি নৌকার পুল হয়েছিল। একটি নীলপর্বতের সামনে, অপরটি হর কি পৌরী ঘাটের কাছে। একটি দিয়ে পশ্চিমপাড় থেকে পূর্বপাড় ও অপরটি দিয়ে পূর্বপাড় থেকে পশ্চিম পাড়ে যাওয়া যাবে।


মেলায় দোকানপাট অজস্র। মনোহারী দোকান, সাল-জামিয়ার-রেজাই-কম্বল ইত্যাদির দোকান, কাশ্মীর-অমৃতসর-লুধিয়ানা ইত্যাদির পশমিনার দোকান, পিতল-কাঁসা-তামা-লোহার দ্রব্যাদির দোকান, তুলসী-বিল্ব-পলার দোকান, শ্বেতপাথরের বাসন-আসবাবের দোকান, খেলনার দোকান প্রভৃতি। কাবুল-কান্দাহার-কাশ্মীর থেকে মোগল উটের পিঠে বোঝাই করে আনা আনার-আঙ্গুর-সেউ-বিহি-কিসমিস-বাদাম-পেস্তা প্রভৃতি মেওয়া, নানা রকম আচার, নানা জাতীয় মসলার পসরা, পান-তামাকের দোকান, মাটি-কাঠ-পিতল-কাঁসা-নারকেল-পাথর প্রভৃতির নানার বস্তু দিয়ে তৈরী হুঁকার দোকান। এক মাত্র পটল ছাড়া যাবতীয় রকম তরি তরকারির দোকান, কী নেই। আচারের দোকান শত শত ছিল। পাঞ্জাব, লাহোর ও দিল্লির আচারের দোকানে কত রকম যে জিনিসের আচার পাওয়া যেত তা বলার নয়। কয়েকটি অভিনব উপকরণ - আলু, করলা, পেঁপে, সজনে ফুল, সজনে ডাঁটা, বকফুল, ঝিঙে ফুল, বাসক ফুল, কুমড়ো ফুল, কচু, লাউ, কুমড়ো, তুঁত পাতা, আকন্দ পাতা, পদ্মডাঁটা, পদ্মমূল  প্রভৃতি। মোরব্বাওয়ালারা নানা রঙের নানা রকম মোরব্বা - আম, আমলকি, হরতকি, কিসমিস, লেবু ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে বসেছে। মিঠাইওয়ালা বা হালওয়াইরা লাহোর, লুধিয়ানা, অমৃতসর, দিল্লি, মিরাট, আগ্রা, মথুরা ইত্যাদি বিভিন্ন শহর ও গ্রাম থেকে এসেছে। মুগের, উরুদের, মেথির, বেসনের, মগধের, মতিচুরের লাড্ডু, অমৃতি, জিলাপি, রসবড়া, ক্ষুরমা, বরফি, পেড়া, গুজিয়া প্রভৃতি নানা মিঠাই বিক্রি হচ্ছে। গোয়ালারা ক্ষীর, দুধ, দই, রাবড়ি, মাখন, মালাই দিয়ে দোকান সাজিয়েছে। ভারওয়ালা অর্থাৎ ভুনাওয়ালারা খই, মুড়ি, চানা, মকাই, মটর, জোয়ার, বাজরা ইত্যাদির ভাজা নিয়ে বসেছে। তাদের বিক্রি খুব বেশি। দরিদ্র মানুষেরা এক পয়সার এইসব ভাজা কিনে খেয়ে পেট ভরিয়ে তারপর গঙ্গা জল পান করে নিচ্ছে। নানা জাতীয় উদ্ভিজ্জ ওষুধপত্র ও চন্দন, চামর ইত্যাদি পূজার দ্রব্যের দোকানও বসেছে। ডোমদের বানানো বাঁশের লাঠি, সাজি, টুকরির দোকান  বসেছে। অনেক তীর্থযাত্রী ঘটিতে গঙ্গাজল ভরে তার মুখ টিনের চাকতি দিয়ে আটকে গালা দিয়ে বন্ধ করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। তাই টিনের চাকতি আর গালাও বিক্রি হচ্ছে অনেক। মেলার বিভিন্ন স্থানে দোলা (নাগরদোলা) বসেছে। এক এক পয়সায় তিন তিন পাক খাওয়া যাচ্ছে।


মেলায় নানা জায়গা থেকে নানারূপ বেশ ধরে নানা চোর ও জুয়াচোর এসেছে। অন্যমনস্ক কাউকে পেলে তার জিনিসপত্র নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। জলের তলা দিয়ে এসে স্ত্রীর ধনী স্ত্রীলোকদের অলংকার পর্যন্ত চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানে স্থানে পুলিশ ঘুরছে। শত শত চোরকে ধরে চৌকিতে বন্দী করে রেখেছে। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের বড় কর্তাদের জন্য অস্থায়ী ছাউনি তৈরী হয়েছে মেলার জন্য। ঘাটের তদারকি করার জন্য হাতির ওপর আসীন পুলিশ আধিকারিকরা আছেন হর কি পৌরী ঘাটে। ঘাটে খুব ভিড়। বেশিক্ষণ কারো জলে থাকার বা দু-তিন ফুটের বেশি জলে যাওয়ার অনুমতি নেই। মেলা উপলক্ষে প্রায় দুই লক্ষ জন্তু (গরু, হাতি, ঘোড়া, উট) এসেছে। সর্বদা গ্রাম থেকে তাদের জন্য খাদ্যদ্রব্য আসছে।


কংখলে বিভিন্ন আখড়া আছে। সেখানে আখড়াধারি গোস্বামীরা বা মোহন্তরা শিষ্যদের সঙ্গে দরিদ্র অভূক্ত ব্যক্তিদেরও আহার করান। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সাধুরা কেউ এক পায়ে, কেউ ঊর্ধ্ববাহু হয়ে, কেউ লোহার কাঁটার উপর দাঁড়িয়ে, কেউ আগুনের উপর দাঁড়িয়ে আছেন কেউ মৌনি, কেউ শুধু ফলাহারি, কেউ গাঁজা-চরসে মগ্ন, কেউ ছাই মাখা। আখড়ার মোহন্তদের সঙ্গে আগে অস্ত্রধারী নাগা সৈন্য থাকতো। এই মোহন্তদের মধ্যে কে আগে স্নানের অধিকার পাবে এই নিয়ে পূর্বে বিবাদ হয়ে প্রাণ পর্যন্ত যেত। তাই সেই বার কোম্পানি বাহাদুর নিয়ম করেছেন যে কোনো অস্ত্র নিয়ে স্নানে যাওয়া যাবে না। কোম্পানির সৈন্যরা এইসব মোহন্তদের স্নানের সময় চার পাশে ঘিরে রইল। এছাড়া বাঁশ দিয়ে পথ ঘিরে এমন ব্যবস্থা করল যাতে পদস্পৃষ্ট হয়ে মানুষ মারা না যায়। একেক জন গোস্বামীর সঙ্গে চল্লিশটি উট, একশ ঘোড়া, বারটি সুসজ্জিত হাতি। আগে আগে বাদ্যধ্বনি করে হাজার শিষ্য, দুইশ পরমহংস, একশ দন্ডী ও নানা অভ্যাগত নিয়ে এক একজন গোস্বামীর শোভাযাত্রা। মোহান্তদের স্নান শেষ হলে অন্যান্য সন্ন্যাসীদের স্নান শুরু হল। তাঁদেরও রাজা ও ধনী শিষ্য আছেন। তাঁদের সঙ্গেও হাতি-ঘোড়া-উট আছে। তাঁদের স্নান সমাপ্ত হলে বিকানীরের রাজার স্নান হল। রাজার সঙ্গে তিরিশ হাজার লোক। ঐশ্বর্যের অসম্ভব প্রদর্শন ও অজস্র দানের মধ্যে দিয়ে বিকানীরের রাজার স্নান শেষ হলে অন্যান্য রাজাদের স্নান হল। রাত একটা পর্যন্ত স্নান সমানে চলেছিল সংক্রান্তির দিন। রাজপুরুষ অর্থাৎ কোম্পানির আধিকারিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে প্রাণহানির ঘটে নি। সর্দিগর্মি হয়ে অনেকে অসুস্থ হয়েছিল। তাদের সঙ্গেসঙ্গে সেই স্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার লোক ছিল এবং চিকিৎসার জন্যে ডাক্তারের ব্যবস্থা ছিল। সংক্রান্তির স্নানের পরেও মেলা আরো দিন সাতেক রইল। তারপর মেলার অস্থায়ী ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে মেলা ভঙ্গ করা হলো।

                       (চলছে)

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২১ চৈত্র ১২৬১ (৪ এপ্রিল ১৮৫৫) থেকে ৩০ চৈত্র ১২৬১ (১৩ এপ্রিল ১৮৫৫)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ১২ আগস্ট, ২০২৪

২২। তীর্থ ভ্রমণ ৭ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

  সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)


বৃন্দাবনের ঝুলনযাত্রা দর্শন শেষে লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা চললেন হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে।


বৃন্দাবন থেকে মাঠগ্রাম (মান্ট), কোররি (?), খয়ের (খাইর), খুরজা  (খুর্জা), গোলচি (?), হাপর (হাপুর) হয়ে ষষ্ঠ দিনে মিরাট এসে পৌঁছলেন যাত্রীরা। এখানে কোম্পানি বাহাদুরের সেনা ছাউনি আছে। অন্তত ১৫০ জন বাঙালি আছে মিরাটে। এখানে একটি কালীবাড়ি আছে। লেখক এখানে বলেছেন যে সমস্ত জায়গায় কালীবাড়ি আছে সে সব জায়গায় তার খরচ বাঙালি বাবুরা মাসিক হারে নিয়মিত দেন। দুটি কারণে কালীবাড়ি তৈরী হয়। প্রথম কারণ, যেসব জায়গায় বাঙালিরা ভিক্ষা বা কাজের প্রয়োজনে বা দেশ ভ্রমনে আসেন, সেইসব জায়গায় তাদের থাকার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয় কালীবাড়ি। দ্বিতীয় কারণ, এইসব অঞ্চলে জীব হিংসাকে নীচু চোখে দেখা হয়। কারো মনে 'বৃথা মাংস ভক্ষণ করবো না' এই ভাব এলে তিনি দেবীর কাছে বলি দিয়ে মাংস খান। মিরাট খুব সুন্দর শহর। স্থানে স্থানে ভালো বাজার আছে। জজ, কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার প্রভৃতির কাছারি আছে। জেলখানা, ডাক্তারখানা, ইলেকট্রিক-টেলিগ্রাফ অফিস আছে। বাঙ্গালী, দেশোয়ালি, পাঞ্জাবি, ফিরিঙ্গি, মুসলমান সবাই দোকান করেছে বাজারে, সেখানে সকল দেশের দ্রব্য পাওয়া যায়। কাজিকাপুর (খোজ কি পুর) হয়ে তৃতীয় দিনের রুড়কি (রুরকি, হরিয়ানা) পৌঁছলেন। এটি নতুন শহর। কোম্পানি বাহাদুর এই স্থানের নাম দিয়েছেন নিউ কলকাতা। এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হয়েছে। এখানে লোহার দ্রব্যাদি তৈরির এক উন্নত মানের কারখানাও হয়েছে, সেখানে মূলত লোহার বোট তৈরি হচ্ছে। 




   বৃন্দাবন থেকে হরিদ্বার ( বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)



রুরকিতে এক নতুন ধরনের খুব মজবুত পুল তৈরি হয়েছে। এই পুল যে লহরের (খাল, আপার গ্যাঞ্জেস ক্যানাল) ওপর অবস্থিত তা ইংরেজ সরকার তৈরি করেছেন, হরিদ্বার থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত। এর ফলে জলপথে যাতায়াত, বাণিজ্য, যুদ্ধসংক্রান্ত দ্রব্য আনা নেওয়া, ফসলে জলসেচ ইত্যাদির সুবন্দোবস্ত হয়েছে। এতে রাজা-প্রজা দুয়েরই লাভ।


এরপর জলাপুর (?) হয়ে লেখক ও সঙ্গীরা হরিদ্বার পৌঁছলেন, বৃন্দাবন থেকে রওনা হওয়ার একাদশ দিনে। হরিদ্বার পৌঁছে হরপিড়ি ঘাটে (হর কি পৌরী ঘাট) তর্পণ করে থাকার ঘর খোঁজা হলো। কিন্তু আসন্ন কুম্ভ মেলায় প্রচুর যাত্রী-সমাগম উপলক্ষে ঘরের ভাড়া খুব বেশি। প্রতি ঘর পনেরো দিনে ১০০ টাকা করে ভাড়া। সেসব ঘর তেমন পরিচ্ছন্নও না। তাই তাঁরা গঙ্গার ধারে ঘাসের কুঁড়েঘর তৈরি করে থাকলেন। কুশবর্তের ঘাটে তীর্থশ্রাদ্ধ করলেন। সেখানে জলে অনেক মাছের জলকেলি দেখা হল। নৌকার পুলে গঙ্গা পার হয়ে আর নীলগঙ্গা নৌকায় পার হয়ে নীলপর্বতের নীচে এলেন। সেই পাহাড়ের উপর প্রায় তিন ক্রোশ উঠতে হয়। এই পর্বতের উত্তর দিকে এক নিবিড় বন আছে, তার মধ্যে অনেক সাধু যোগসাধন করছেন। কিন্তু তাঁদের দর্শন করতে যাওয়া খুব কঠিন। কারণ ওই বনে হাতি, বাঘ, ভাল্লুক, শুকর প্রভৃতি বন্য জন্তু আছে। নীল পর্বতের উপরে চন্ডীদেবীর মন্দির। দেবী দর্শন ও পূজা করে পূর্ব দিকের পাহাড়ে অর্ধ-ক্রোশ উঁচুতে অঞ্জনা দেবী দর্শন করে পাহাড়ের দক্ষিণ দিক থেকে নামার সময় নীলকন্ঠেশ্বর শিবসহ অনেক দেব দেবীর দর্শন করে গৌরী কুন্ডের কাছে আসা হলো। কুন্ডে জলস্পর্শ করলেন ও বড় বড় মাছেদের কুণ্ডের জলে খেলা দেখলেন তাঁরা। এরপর তাঁরা হর কি পৌরী থেকে পাহাড়ের ধারে ধারে এক ক্রোশ গিয়ে পাহাড়ের নীচে বিষকেশ্বর দর্শন করলেন। সেখানে অনেক বিষবৃক্ষ আছে। ওই স্থানে বহু সন্ন্যাসী থাকেন, তাই সর্বদা হরহর শব্দের মুখরিত। 


তিন ক্রোশ দূরে কঙ্খল তীর্থদর্শন, স্নান, তর্পণ করে দক্ষেশ্বর শিব দর্শন করলেন। এখানে দক্ষযজ্ঞ হয়েছিল। এর অর্ধ-ক্রোশ পশ্চিমে সতীকুন্ড, যেখানে সতী দেহত্যাগ করেছিলেন। কংখলে অনেক মোহন্তদের আখড়া আছে। এখানে অনেক বাগান, ময়দান আছে, কুম্ভ মেলা উপলক্ষে আগত রাজা জমিদার প্রভৃতি ধনী ব্যক্তিরা ছাউনি তৈরি করে আছেন। হর কি পৌরী ঘাট ছাড়া নীলধারা, ত্রিধারা, পঞ্চধারা, সপ্তধারা ভ্রমণ ও জলস্পর্শ করলেন সবাই। এছাড়া নগর ভ্রমণ এবং সাধুদের ভজন শ্রবণ করা হলো প্রতিদিন।

                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৫ চৈত্র ১২৬১ (১৯ মার্চ ১৮৫৫) থেকে ২০ চৈত্র ১২৬১ (৩ এপ্রিল ১৮৫৫)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০২৪

২১ | তীর্থ ভ্রমণ ৬ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

জয়পুর ত্যাগ করে বগড়ু (বগরু) নামের স্থানে পৌঁছলেন লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা। সেখানে রানীর এক বাগান আছে। তাতে রানী প্রতিষ্ঠিত শিব আছে, মিষ্টি জলের কুয়া আছে। সামনে রাজার সৈন্য ও ছটি কামান রয়েছে। সেখানে রাত্রি বাস। তারপর পাড়ু, বাঁদরিসুদরি (বান্দর সিন্দরি) পেরিয়ে এলো কৃষ্ণগড় (কিশানগড়)। এখানকার রাজা স্বাধীন। রাজধানী খুব সুন্দর। রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলার ব্যবস্থা খুব ভালো। সুন্দর বাগান, ধর্মশালা আছে। লেখকেরা রাজবাড়ী, কেল্লা ও শহরের সর্বত্র ঘুরে দেখলেন। পরবর্তী পথে পরল বাণ নদী (ওল্ড ক্যানাল?)। এই নদীতে সম্বর লবণ জন্মায়। তারপরে কাউড়ি পেরিয়ে বুড়া পুষ্কর এল। এটি একটি বড় কুণ্ড। কুণ্ডের চারপাশে পাকা ঘাট। পঞ্চম দিনে এলো ব্রহ্মপুষ্কর। 



  জয়পুর থেকে আজমীর (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


এখানে শিব মন্দির ও অতিথি শালা আছে। লেখক লিখেছেন যে পুষ্কর তীর্থ সকল তীর্থের গুরু। এখানে তিনটি পুষ্কর আছে। বুড়া পুষ্কর, মধ্য পুষ্কর ও কনিষ্ঠ পুষ্কর। এই তিন পুষ্কর শিব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা  এই ত্রিদেবের যজ্ঞস্থান। বুড়া পুষ্কর শিবের, মধ্য পুরস্কার বিষ্ণুর ও কনিষ্ঠ পুরস্কার ব্রহ্মার যজ্ঞভূমি। এই কুন্ডের পরিক্রমণ করতে পাঁচ ক্রোশ পথ হাঁটতে হয়। কুন্ডের চারদিকে মন্দির ও বসতি। কুন্ডের জল সুনির্মল, তাতে শ্বেতপদ্ম ফুটে কুণ্ডের শোভাবর্ধন করছে। জলজন্তুর মধ্যে নানারকম মাছ, মকর (শুশুক), কুমীর প্রভৃতি আছে। পুষ্করের পান্ডারা বেদজ্ঞ, সৌম্য, যা দেওয়া হয় তাতেই তাঁরা সন্তুষ্ট। 


এখানে সাবিত্রী পাহাড় নামে তিন ক্রোশ উঁচু এক পাহাড় আছে। সাবিত্রী দেবীর মন্দির তার চূড়ায় অবস্থিত। মন্দিরে সরস্বতী মূর্তি আছে। এক ব্রাহ্মণ বাঙালি কন্যা বিধবা হয়ে প্রায় চল্লিশ বছর ওই সম্পূর্ণ নির্জন পাহাড়ে থেকে সাবিত্রীর তপস্যা করেন। রাতে পূজারীরাও পাহাড় থেকে নেমে আসেন, কিন্তু ওই তপস্বিনী একা থাকেন। পর্বতে নানা হিংস্র জন্তু আছে। পাহাড়ের উপরে পথের মধ্যভাগে এক উদাসীন (তাঁর বয়স একশ বছরের বেশি হবে) একা থেকে তপস্যা করেন।


পুষ্করে ১৫ টি ঘাট আছে। যথা চন্দ্রঘাট, বরাহঘাট (এখানে বরাহদেবের মূর্তি আছে), সাবিত্রীঘাট, রাজঘাট, ব্রহ্মাঘাট, সপ্তর্ষিঘাট প্রভৃতি। কুণ্ডের পশ্চিম দিকে ব্রহ্মার মন্দির, যে স্থানে তিনি যজ্ঞ করেছিলেন। মূর্তির বাম দিকে গায়ত্রী দেবীর মূর্তি। মন্দিরের দালানে নারদের একটি প্রতিমূর্তি আছে। ঘাটের কাছে অটমটেশ্বর শিব আছেন। সমভূমি থেকে আট হাত নীচে শিবের স্থান। পুষ্কর তীর্থের আদি দেব অটমটেশ্বর। প্রথমে এই শিব পূজা করে সকল দেব দর্শন ও পূজা করতে হয়। এইসব দুর্গম নির্জন তীর্থের কোন কোন স্থানে একাকী কিছু সন্ন্যাসী বা তপস্বী বাস করেন। পুষ্কর তীর্থের পরিক্রমা পঞ্চক্রোশী, পর্বতের ভিতর দিয়ে পথ। এর মধ্যে অনেক তীর্থ আছে। মরীচী, অঙ্গিরা, অত্রি, পুলস্ত প্রভৃতি মুনিদের কুটির আছে। আছে নাগ কুণ্ড, বামদেব কুণ্ড, ভৃগু কুণ্ড, কপিল কুণ্ড প্রভৃতি তীর্থস্থান। কপিল আশ্রম হয়ে পর্বতের গুহায় ঢুকে চারশ হাত ভিতরে গিয়ে কপিলেশ্বর শিব আছেন। অন্য এক গুহার মধ্যে বেশ কিছুটা সুড়ঙ্গে গমন করে নীলেশ্বর শিবের দর্শন করতে হয়। কিছুদিন পুষ্করে থেকে লেখক এবং তাঁর সহযাত্রীরা সমস্ত দেবদেবী, তীর্থস্থান দর্শন করে আজমীরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।


পুষ্কর থেকে আজমীর আট ক্রোশ পাহাড়ি পথ। আজমীর শহরে অনেক ধনী ব্যক্তি বসবাস করেন। সুন্দর সুন্দর শ্বেত পাথরের ভবন, খোদিত মূর্তি দ্বারা সজ্জিত। কিন্তু জল নিকাশি ব্যবস্থা নেই। যোধপুরের রাজা শাসন করেন এই স্থান। রাজার কেল্লা পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। শহরে নানা রকম জিনিসের দোকান আছে, তার মধ্যে শ্বেত পাথরের বাসন, দেবদেবীর মূর্তি, সিংহাসন, কৌচ, কেদারা ইত্যাদি খুব ভালো পাওয়া যায়। 


আজমীরে খাজা সাহেব বলে এক পীর আছেন, তাঁর বড়ই মাহাত্ম্য। হিন্দু মুসলমান সবাই তাঁর  দর্শনে যায়। এখানে লেখক তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। পূর্বে এখানে চন্দ্রনাথ নামে শিবের স্থান ছিল। একজন মুসলমান ভিস্তি জলসমেত তাঁর ভিস্তি একটি গাছের ওপর রেখে খাচ্ছিলেন। ফোঁটা ফোঁটা জল শিবের মাথায় পড়ছিল। সেই জল পেয়ে শিব সন্তুষ্ট হয়ে ভিস্তিকে বলেন যে তিনি তৃপ্ত হয়ে ভিস্তিকে বর দিতে চান। ভিস্তি তখন শিবের কাছে বর চান যে এই স্থানে শিবের যে নাম আছে তা অপ্রকাশিত হয়ে যেন তাঁর নাম প্রকাশিত হয়। শিব তাই বর দান করেন। শিবের স্থানের উপর মসজিদ, কবর হয় এবং তিনি খাজা সাহেব নামে খ্যাত হন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধরেরা বজায় রেখেছেন সেই ঐতিহ্য। ফকির প্রতিদিন শিবের পুজো ও খাজা সাহেবের শিরনি দুই দেন এখানে একসঙ্গে। এখানে মানত করলে তা পূর্ণ হয় বলে প্রচলিত আছে। দিল্লির বাদশা এই মসজিদ নানা রকম প্রস্তরে খোচিত করে স্তম্ভাদি নির্মাণ করিয়ে দিয়েছেন। সামনের নাটমন্দিরে নর্তকীরা, সর্বদা নৃত্য-গীত-বাদ্য করে। অতিথিশালায় অনেক ফকির বাস করেন।



আজমীর থেকে জয়পুর হয়ে মথুরা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)



আজমীর থেকে লেখকেরা আবার মথুরায় ফিরে চললেন। কৃষ্ণগড় (কিষানগড়), পরাসনি (পড়াসোলি গ্রাম), দুদুগ্রাম (দুদু), বগড়ু গ্রাম (বগরু), বড়েনা গ্রাম (?), বাউড়ি (?) হয়ে পঞ্চম দিনে তাঁরা জয়পুর পৌঁছলেন। আবার সব দেবদেবী দর্শন করে, নগর ভ্রমণ করে বেড়ালেন। রাজার বাগানে বাঘ, হরিণ, পুষ্করিণীতে জলচর পাখি দেখে আনন্দ পেলেন। এরপর ঘাট দরজা (ঘাট গেট, জয়পুর), মোহনপুরা (মোহনপুরা), দোশাগ্রাম (দোসা), সেকেন্দরা (সিকান্দ্রা), বেশোড়া (?), ছোকরাবার (?), গাগরাআনি (?), শোক (শোঙখ), সসা (শোনশা) হয়ে দশম দিনে মথুরা এলেন। 


এবার বৃন্দাবনে লেখক ঝুলন দর্শন করার সুযোগ পেলেন। বিভিন্ন মন্দির স্বর্ণ নির্মিত হিন্দোলা (দোলনা), ঝাড় লন্ঠন, বড় বড় আয়না, নানা রকম দ্রব্য দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা মেলাও হয়। ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনের ফুলদোলের সময় কুম্ভের মেলা হয় প্রতি বারো বছর অন্তর। ফুলদোলে বৃন্দাবন পরিক্রমার মেলা শেষে সবাই হরিদ্বারে যায়। এই সময় বৃন্দাবনে নানা দেশ থেকে বৈষ্ণব, সন্ন্যাসী, গোস্বামী, মোহন্ত, নাগা প্রমুখরা আসেন ও যমুনার চরে থাকেন। চতুর্দিক মুখরিত হয় পূজাপাঠ, গীতবাদ্যে।বৃন্দাবনে বারোটি আখড়া আছে। এই সময় আখড়াধারীরা আপন আপন গদি থেকে আসেন। তাঁদের সঙ্গে আসে হাতি, ঘোড়া, উট, নীলগাই, হরিণ, নীল বানর প্রভৃতি। আখড়ার মোহন্ত আখড়ার রুপার হাওদা দেওয়া, সোনা রুপার নিশান সম্বলিত হাতির উপরে চড়ে ঘোরেন। শ্বেত চামরের ব্যজন দিয়ে তাঁর সেবা করা হয়। সঙ্গে আসে সোনা রুপোর বল্লম হাতে তিন চার শত নাগারক্ষী। 

                      (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৪ আষাঢ় ১২৬১ (৮ জুন ১৮৫৪) থেকে ৪ চৈত্র ১২৬১ (১৮ মার্চ ১৮৫৪)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০২৪

২০। তীর্থ ভ্রমণ ৫ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


     সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                    (আগের পর্বের পরে)

অনধিক দুই সপ্তাহ মথুরায় থাকার পর এবার নতুন পথে নতুন সঙ্গীদের সঙ্গে যাত্রা শুরু হল। এবার লক্ষ্য জয়পুর ও পুষ্কর তীর্থ। শনশাগ্রাম (শোনশা, উত্তর প্রদেশ), শোঙ্ক (শোঙখ), কুম্ভীরা (কুমহের, রাজস্থান) হয়ে চললেন। কুম্ভীরাতে ভরতপুরের রাজার কেল্লা আছে। শহরে অনেক ধনীর বসবাস। দ্বারে দ্বারে রক্ষী দিয়ে শহর সুরক্ষিত। কেল্লার মধ্যে বড় বড় কামান আছে আর কেল্লা প্রাচীরে ঘেরা। বুরুজের ঘরে গুলি চালানোর ফোঁকর আছে। কুম্ভীরা ছেড়ে হেলেনাগ্রাম (হোলেনা, রাজস্থান)। সেখানে রানীর তলাব বা পুষ্করিণী আছে, চতুর্দিকে সান বাঁধানো ঘাট। মধ্যে মধ্যে বুরুজ আছে। তার উপরে ঘর, ধর্মশালা মহাবীরের স্থান, শিব মন্দির, বৈষ্ণব আখড়া, সব রয়েছে। এরপর মৌয়া (?), বিশড়া (বসরা,রাজস্থান), সেকেন্দরা (সিকান্দ্রা), মোহনপুরা (মোহনপুরা) হয়ে জয়পুর পৌঁছানো হল প্রায় ১২ দিনে। পথে নানা স্থানে পর্বত জঙ্গল আছে। পথ খুব খারাপ। তিন ক্রোশ অন্তর একটি করে গ্রাম মেলে।

 

মথুরা থেকে জয়পুর লেখক বর্ণিত পথে (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


জয়পুর শহরের রাস্তা চৌপাড়বন্দী অর্থাৎ পাশার ছকের আকারে চারিদিকে সমান চওড়া রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে সুন্দর সুন্দর শ্বেত পাথরের বাড়ি, তাতে নানা প্রকার দেব মূর্তি ও অন্যান্য মূর্তি খোদিত আছে। ওই বাড়িগুলি ধনী শেঠেদের বাসস্থান। বাড়ীর নিচের তলায় দোকান। এক একটি পট্টিতে শুধু এক এক শ্রেণীর দোকান থাকে। চুড়ি পট্টিতে প্রায় ২৫০ চুড়ির দোকান, জুতা পট্টিতে ৫০০ জুতার দোকান। এরকমভাবে কম্বল আসন, উলের বস্ত্র, অন্য দ্রব্য, হালওয়ার দোকান, মেওয়ার দোকান। পশমিনা, হীরা, পান্না, মোতির দোকান বা গদি দোতলার উপর। শহর চারপাশে পাথরের চার স্তরের প্রাচীর বেষ্টিত প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হয়ে চতুর্থ দ্বারে প্রবিষ্ট হয়ে রাজবাড়ীর কাছে যাওয়া যায়। সেখানে গোবিন্দজির মন্দিরও আছে, যা রক্ষা করছে পদাতিক সেনারা। গোবিন্দজির গোস্বামীকে খবর দিলে এক ছড়িবরদার একটি পাঁচ রঙের ঝড়ি হাতে করে এসে আগে আগে চলল, তাই কোন দ্বারে রক্ষীরা লেখকদের আটকালো না। শ্বেত পাথরে নির্মিত গোবিন্দজির মূর্তি রত্ন সিংহাসনে বিরাজিত ও রাজ পরিচ্ছদে সুসজ্জিত। মন্দিরে দিনে সাতবার ভোগ ও আরতি হয়। লেখকেরা দেব দর্শন ও আরতি দর্শন করলেন। গোবিন্দজির বাম ভাগে শ্রীমতিজির মূর্তি ও ডান ভাগে রাজকন্যার (রাজা সবাই জয় সিংহের কন্যা) পানের বাটা হাতে নিয়ে মূর্তি বিরাজিত আছে।


লেখক এখানে কয়েকটি কাহিনী বলেছেন - দিল্লির বাদশা আকবর বৃন্দাবনের গোবিন্দ, গোপীনাথ ও মদনমোহন মন্দির ভাঙ্গার আদেশ দেন (খুব সম্ভবত এই বাদশা আকবর না হয়ে আওরঙ্গজেব হবেন)। এই সংবাদ শুনেই জয়পুরের মহারাজ সওয়ায় জয়সিংহ বৃন্দাবনে গোস্বামীদের যত দেবমূর্তি ছিল সব জয়পুরে রাজধানীতে নিয়ে যান ও মন্দির স্থাপিত করেন। রাজকন্যা সর্বদা গোবিন্দজির মন্দিরে যেতেন যা অন্দরমহলের কাছে অবস্থিত ছিল। রাজকন্যার বিবাহকাল উপস্থিত হলে কন্যা বিবাহে অসম্মত হন এবং গোবিন্দজির শ্রীঅঙ্গে লিপ্ত হয়ে যান। এই কারণে তাঁর মূর্তি গোবিন্দজির ডানপাশে বিদ্যমান। জয়পুরে বৃন্দাবন ধামের সমস্ত দেবমূর্তি রয়ে গেছেন, কেবল মদনমোহনজির মূর্তি কড়োরির রাজা নিয়ে গেছেন ও সেই মূর্তি সেখানে আছেন। বৃন্দাবনে এইসব মন্দিরে প্রতিমূর্তি রয়েছে মাত্র। জয়পুরের রাজা গোবিন্দজির দেওয়ান হিসেবে রাজাকার্য পরিচালনা করেন। রাজ সিংহাসনে তিনি বসেন না। শহর থেকে ছয় ক্রোশ দূরে পাহাড়ের ওপর শিলাদেবীর মন্দির। এই দেবী পূর্বে মথুরাতে কংস রাজার রঙ্গস্থলে শিলারূপে ছিলেন। ওই শিলাতে কংস দেবকীর সন্তানদের আঁছড়ে বিনষ্ট করত। পূর্বে জয়পুরের এই মন্দির নরবলি হত। রাজা সওয়ায় জয়সিংহ নরবলি রদ করেছেন বলে নাকি দেবী রুষ্ঠ হয়ে বাম দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন।


সবাই রাজবাড়ী, গোপীনাথজির মন্দির ও অন্যান্য মন্দির দর্শন করলেন। কিছুদিন জয়পুরে বসবাস করে তারপর পুষ্করের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।


                        (চলছে)


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৭ আষাঢ় ১২৬১ (২১ জুন ১৮৫৪) থেকে ২৩ আষাঢ় ১২৬১ (৭ জুলাই ১৮৫৪)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০২৪

১৯। তীর্থ ভ্রমণ ৪ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                  -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

সেকেন্দ্রার থেকে বেউরগ্রাম(?), বিগরাই-এর বাজার সরাই (বিঘ্রাই, উত্তরপ্রদেশ) মিঠেপুর (মিঠেপুর), শকুয়াবাদ (শিকোহাবাদ), রাজার টাল (রাজা কা টাল), উশানী (ইন্দানী) হয়ে খাঁদানি (?) পৌঁছানো হলো পঞ্চম দিনে। সেখানে দুজন বৃন্দাবনের কুঞ্জবাসী লেখকদের সঙ্গী হলেন। লেখক শুনেছিলেন যে কাশীর কেশেল, প্রয়াগের প্রয়াগী আর বৃন্দাবনের কুঞ্জবাসী তিন সমান। তারা যাত্রীদের প্রায় ডাকাতি করে অর্থ হরণ করে। লেখক তাদের বললেন যে তাঁরা প্রথমে আগ্রা যাবেন। সঙ্গের টাকা শেষ, আগ্রায় গিয়ে টাকা সংগ্রহ করবেন, তারপর বৃন্দাবন যাবেন। বৃন্দাবনে কুঞ্জবাসীর কুঞ্জে থাকবেন না, বাড়ি ভাড়া করে থাকবেন। এই কথায় তারা বুঝল যে লেখকের কী অভিপ্রায়। তখন তারা বলল কুঞ্জবাসীর অর্থ লোভের কাহিনী মিথ্যা নয় কিন্তু তারা যে সেরকম নয় তা পরীক্ষা করে দেখুন লেখক। তাছাড়া তারা লেখকের জন্য অর্থের বন্দোবস্ত করে দেবেন। ফলে তারা লেখকের সঙ্গে চলল। 

খাঁদানি থেকে বৃন্দাবন, মথুরা যাওয়ার দুটি পথ। একটি পথ পশ্চিম দিকে ডাকের যাতায়াতের, আগ্রা হয়ে আর এক পথ বলদেব হয়ে। লেখকেরা বলদেব হয়ে গেলেন। বলদেবের দর্শন হলো। এখানকার পান্ডারা নিষ্ঠুর ও ভীষণ আকৃতির। মাখন মিছরি ভোগ দিয়ে দর্শন করে পুরি কচুরি প্রসাদ পেয়ে সেখানে রাত্রি বাস। ব্রহ্মাণ্ড ঘাট দর্শনে গেলেন পরদিন, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ মৃত্তিকা ভোজন করেছিলেন। লেখক বলেন সেখানকার মৃত্তিকা খেতে সুস্বাদু, ওই ঘাটে যমুনাতে স্নান তর্পণ করে গোকুল মহাবন পরিক্রমা করে শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি, সূতিকা গৃহ, ষষ্ঠী পূজার ঘর, দধি মন্থনের স্থান, পুতনাবধ স্থান, গেন্দ খেলার আঙিনা, বন্ধন। ধূলা়খেলার স্থান ইত্যাদি দেখলেন।



সিকান্দার রাও থেকে বৃন্দাবন (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)

 পরদিন গোকুল মহাবন থেকে নতুন গোকুল গেলেন ও দর্শন করলেন। তারপর যমুনা পার হয়ে মথুরা পৌছলেন। সেখানে বিশ্রাম ঘাটে স্নান, মুকুট দর্শনাদি করে, মথুরা মন্ডল দর্শন করে তিন ক্রোশ গিয়ে শ্রী বৃন্দাবন ধামে প্রবেশ করে দর্শন করলেন গোবিন্দ, গোপীনাথ, মদন মোহন এই প্রধান তিন মন্দির।মথুরায় যমুনার তীরে অনেক ঘাট পাকা বাঁধানো আছে আর অনেক ঘাটে শিব স্থাপিত আছেন। প্রধান ঘাট চব্বিশটি তাছাড়াও ধনীদের বাঁধানো আরও অনেক ঘাট আছে। মথুরা নগরে উত্তরদ্বার জয় সিংহপুরী, দক্ষিণ দ্বার কোগ্রাম। 


নগরের মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ঘর রয়েছে। ছয় হাজার ঘর মুসলমান, বাকিরা হিন্দু। হিন্দুদের মধ্যে চৌবের সংখ্যা অধিক। যেসব যাত্রী মথুরা বৃন্দাবনে আসে চৌবেরা তাদের মথুরা পরিক্রমা স্নান দান শ্রাদ্ধ দর্শন করিয়ে জীবন যাপন করে। এরা লেখাপড়া করে না আর দিনে চার বেলা সিদ্ধি খায়। মথুরায় নানা দেশের (সুরাট, বোম্বাই, গুজরাট, জয়পুর, বিকানীর, মাড়োয়ার, দিল্লি প্রভৃতি) ধনী সেঠেদের বাস। 


দ্বারকাধীশের  মন্দিরের সম্পত্তির পরিমাণ অতুল। মনি মুক্তার গহনা, বস্ত্র, ঝুলনের হিন্দোলা প্রভৃতির অমূল্য সম্ভার। প্রতিদিন তিনবার নতুন পোশাকে শৃঙ্গার হয়। দেবালয়ে মানুষ প্রতিদিন উত্তম আহার পায়। নিকটে রয়েছে কংস টীলা যেখানে কংস রাজার কেল্লা ছিল। 


শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমিকে মধুপুরি বলে। তার চারিদিকে চার দ্বারে চার অনাদি শিব আছেন। পূর্বদ্বারে পিঁপুড়েশ্বর, দক্ষিণদ্বারে রঙ্গেশ্বর, পশ্চিমদ্বারে ভূতেশ্বর ও উত্তরদ্বারে গোকর্ণেশ্বর। পশ্চিম দ্বারে মহেশ্বরী দেবীর মহাপীঠ, এখানে ভগবতীর অঙ্গ পতন হয়েছিল। এখানে দর্শনীয় রয়েছে ধ্রুবটীলা, সপ্তর্ষিটীলা বলিটীলা, কংশটীলা, মহাবিদ্যা দেবী। রয়েছে বলদেব জিউয়ের মন্দির, সেখানে স্বর্ণরৌপ্যের বড় আধিক্য। বড় বড় ধনী শিষ্য। সাধারণ মানুষের দর্শন করা কঠিন। শহরের মধ্যে কুব্জানাথের মন্দির।তার কাছে রাধা গোবিন্দজীউর মন্দির, রাধাকান্তজীউর মন্দির। এইসব মন্দিরে ১৫ দিন ব্যাপী ঝুলন হয়। দ্বারকাধীশের মন্দিরে একমাস ধরে ঝুলন হয়। 


মথুরায় ২৫ টি ঘাট ও তীর্থ। মধ্যখানে বিশ্রান্ত ঘাট যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলদেব কংশকে বধ করে বসে বিশ্রাম করেছিলেন। তার উত্তরে ১২ টি ও দক্ষিণে ১২ টি ঘাট। অগ্রহায়ন মাসে শুক্লা দশমীতে ওই স্থানে কংসবধ লীলা অনুষ্ঠিত হয়। বিশাল মেলাও হয়।


মথুরায় স্থানে স্থানে বাজার আছে। হালওয়া পট্টি, কাপড়ের দোকান, গন্ধিদের দোকান, বিলাতি দ্রব্য সবই পাওয়া যায়। রাস্তার দুই পাশে উচু উঁচু বাড়ি, তার নিচে দোকান। একটি ভালো মসজিদ আছে, সেখানে মুসলমানেরা ঘটনা করে। এখানে কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার, সদর আমিন, সদর আলার কাছারী আছে। সৈন্য ও সৈনাধ্যক্ষদের ছাওনি আছে। বাঙ্গালীঘাটাতে বাঙালিদের বাস। সাহেব আছে জন পঁচিশ। মথুরায় কেউ দুঃখী বা অভাবী নয়। স্ত্রী লোকেরা শ্রীসম্পন্না। তারা ঘাগড়া কাঁচলি, উড়ানি পড়ে। চৌবের স্ত্রী লোকেরা শাড়ি, উড়ানি পরে। এত ভালো দই লেখক আর কোথায় দেখেননি। এ ছাড়া খাজা, প্যাড়া, কুমড়ার মিঠাই, খাস্তা কচুরি, মগধের লাড্ডুও ভালো পাওয়া যায়। পশম বা উলের কাপড়ের অনেক দোকান আছে। কাবুলিওয়ালাদের আনা আনার, বাদাম, পেস্তা ইত্যাদি পাওয়া যায়। বৃন্দাবন ধামে নানা দেশের ধনী ও সাধারণ মানুষের বাস। নানা দেবালয় স্থাপনা করে, দেব সেবা, সদাব্রত, ধর্মশালা, জলসত্র, দরিদ্র ভোজন, এমনকি বানর কচ্ছপ ময়ূর প্রভৃতি পশুপাখিদেরও খাদ্য বিতরণ প্রভৃতি চলেছে। নৃত্য গীত মহোৎসব শ্রীমৎ ভাগবত পাঠ প্রভৃতিও সর্বক্ষণ চলেছে। 


বৃন্দাবনের যমুনাতে দ্বাদশঘাট আছে, যথা কালিদহ, গোপাল ঘাট, আবির ঘাট, সিঙ্গার ঘাট প্রভৃতি। প্রতিটি ঘাটের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা কাহিনী যুক্ত। এছাড়া কেবার বন বা কেতকি বন, অটল বন, বিশ্রাম বাগ, রাধা বন, বংশী বট, গোপীশ্বর মহাদেব, পুলিন, নিধুবন, নিকুঞ্জ বন, লোটন বন প্রভৃতি অসংখ্য ধর্মীয় দর্শনীয় স্থান রয়েছে। লেখক একে একে সব দর্শন করেন। প্রতিটি স্থানের মাহাত্ম্য তিনি সংক্ষেপে সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন। 


এবার তিনি ব্রজভূমিতে চারিদেব অর্থাৎ বলদেব, হরদেব, কেশবদেব ও গোবিন্দদেব দর্শন করেন। এই স্থানগুলি বৃন্দাবন থেকে কিছু দূরে অবস্থিত। লেখক এখানে তাঁর দুএকটি নিরীক্ষণ জানিয়েছেন। যেমন - মন্দিরগুলিতে যে ব্যক্তি যে রকম ভেট দেয়, সেই অনুসারে দর্শনের সুবিধা, সেই প্রসাদ শিরবস্ত্র প্রভৃতি পায়। ভেট না পেলে বিশেষত বাঙ্গালীদের ক্ষেত্রে দর্শনে বিশেষ ব্যাঘাত করা হয় কিন্তু অন্য দেশীয়রা যা দেয় তাই গ্রহণ করা হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের শিষ্য সনাতন গোস্বামী মথুরায় সাধনভজন কালে দৈববাণীতে মদনমোহনজীউ-এর মূর্তি লাভ করেন। সেই মূর্তি কালক্রমে বর্তমান মদনমোহনজীউ-এর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত। শ্রীচৈতন্যদেব এখানে এসেছিলেন এবং সনাতন গোস্বামীর ভজনাগারে মহাপ্রভুর পদচিহ্ন বর্তমান আছে।

                   ( চলছে )

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৬১ (৩১ মে ১৮৫৪) থেকে ৬ আষাঢ় ১২৬১ (২০ জুন ১৮৫৪)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০২৪

১৮। তীর্থ ভ্রমণ ৩ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                  -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

কাশী ছাড়ার পর প্রথম মেড়ুয়াডিহিতে (মারুয়াডিহ, উত্তর প্রদেশ) রাত্রি বাস। তারপর তামেচাবাদ (তামাচাবাদ) হয়ে মহারাজগঞ্জ (মহারাজগঞ্জ), পরদিন গোপীগঞ্জে (গোপিগঞ্জ) স্থিতি। তারপর ক্রমে হাড়িয়া (হরিয়া), ঝুসীগ্রাম (ঝুসী) হয়ে  নৌকার পুলে গঙ্গা পার হয়ে এক ক্রোশ গিয়ে ত্রিধারা অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর নদীর ঘাট বেনীঘাটে রাত্রি বাস। এখানে যাত্রীদের প্রয়াগে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়াগীরা (প্রযাগের পান্ডা) উপস্থিত। প্রয়াগীরা অত্যন্ত লোভী, নির্দয়, নিষ্ঠুর। প্রথমে যাত্রী নেওয়ার সময় ভদ্র ব্যবহার করে কিন্ত পরে দুর্ব্যবহার করে। তাদের সৈন্য আছে (!) যাত্রীরা প্রয়াগতীর্থে পৌঁছে মুন্ডন ও উপবাস করলেন। 


পরদিন ত্রিধারাতে স্নান তর্পণ, তীর্থশ্রাদ্ধ, ব্রাহ্মণ ভোজন, প্রয়াগ মাহাত্ম্য শ্রবণ করলেন। তারপরের দিন আবার ত্রিধারায় স্নান করে পঞ্চক্রোশী পরিক্রমণ, বেণীমাধব দর্শন, কেল্লার ভিতরে অক্ষয়বট দর্শন, সরস্বতী নদীর গুপ্ত ভাব দর্শন প্রভৃতি করলেন। সরস্বতী নদীর উপরে যমুনার পশ্চিম ধারে পাথরের তৈরি কেল্লা। কেল্লার মধ্যে বাড়িঘর। বড় বড় কামান বন্দুক তরবারিতে কেল্লা সুরক্ষিত। কেল্লায় এক ক্রোশ অন্তর  পদাতিকদের ছাউনি। শহরে বাজার, কাছারি, ডাক্তারখানা, ডাকঘর সব আছে। উত্তরে স্টিমার অফিস। এই প্রয়াগকে এলাহাবাদ বলে। শহরে ৫০ হাজার ঘর আছে। জল বাতাস খুব ভালো, শরীর ভালো থাকে।


এরপর লেখক তিতু বাগদি আর মহেন্দ্রনাথ মিত্র সহ বৃন্দাবন যাত্রা করলেন। বাকিরা দেশে ফিরে গেলেন। এরপর দুর্গাগঞ্জ , ইমামগঞ্জ, গোলামীপুর (গুলামীপুর), ভূধরের সরাই (?), চৌধুরী সরাই (চৌধুরী সরাই), কুঙরপুর (কুনওয়ারপুর), খাজুয়া (খাজুয়া) হয়ে ছয় দিনে কানপুর পৌঁছলেন। এখানে ইংরাজ সরকারের পদাতিক সৈন্যদের শিক্ষার স্থান রয়েছে। দুর্গ নির্মিত নেই, মাঠের মধ্যে ছাউনি। এখানে অনেক গোলাগুলি, বারুদের সংগ্রহ আছে। প্রহরীরা সতর্কভাবে পাহারা দেয়। বাদশাহী আমলের বড় বড় মজবুত সরাই আছে পথিকদের জন্য। প্রায় ৩০০ বাঙালি আছেন। এক কালীবাড়ি আছে, সেখানে অতিথিরা থাকতে পারেন। জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টরের কাছারি, দেওয়ানি ও ফৌজদারির কাছারি আছে।




কানপুর থেকে সেকেন্দা (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


কানপুরের উত্তর পূর্বে আট ক্রোশ দূরে বিঠোর (বিঠুর)। এটি বাল্মিকী মুনির তপোবন। সীতার বসবাস স্থান, লব কুশের জন্মস্থান। পুনা সেতারার বাজিরাও এর বাড়ি ও সৈন্য কিছু এখানে আছে। তার দত্তক পুত্রের পুত্র নানা সাহেব ওই পদাতিক সৈন্য নিয়ে এখানে থাকেন। 


এবার এলেন কান্যকুব্জ   (কনৌজ)। এখানে কনৌজের ব্রাহ্মণদের বাস স্থান। এখন থেকে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা গৌড়ে এসে কৌলিন্য প্রথার সূচনা করেছিল। এখানে অনেক প্রাচীন দেবালয়, প্রাচীন অট্টালিকা আছে ও অনেক পন্ডিত বেদজ্ঞ বসবাস করেন। 


এবার গঙ্গা পার হয়ে লক্ষ্ণৌ শহর, যা তখন নবাবের অধিকারে ছিল।সেখানকার মানুষ ধনী, মহাবলশালী, উগ্র স্বভাব এবং অল্প কথায় বিবাদ হলেও তরবারি চলে। ইংরাজ সরকারের তরফ থেকে একজন রেসিডেন্ট ও দুই দল সৈন্য আছে। নবাবের রাজ্য অধিক দূর নহে অথচ ৫২ রাজার সিংহাসন _ এই মন্তব্য করেছেন লেখক সকলেরই সৈন্য সমাবেশ আছে। এক হাজারের কম বন্দুকধারী কারো না। দশ হাজার পর্যন্ত অনেকেরই আছে। শহর প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। শহরে প্রবেশের সময় নবাবের দ্বারপাল নাম ধাম জিজ্ঞেস করে। অস্ত্রধারী ভিন্ন রাজ্যবাসীকে প্রবেশ করতে দেয় না। কোনো বিদেশি এই রাজ্যে এলে স্থানে স্থানে বলপূর্বক তার থেকে টাকা-পয়সা নেওয়া হয়, এমন অরাজগতা বিদ্যমান। নবাব দুর্গের মধ্যে সাত মহলায় বাস করেন। গোমতী নদীর তীরে এই শহর। মচ্ছিভবন নামে একটা বড় বাড়ি আছে, তার মধ্যে ফুল ফলের বাগান পুকুর আর থাকার ভালো ভালো ঘর আছে। মাটির নীচে নবাবদের গোরস্থান আর মৃত নবাবদের ধন দৌলত কোষাগার করে রাখা আছে। অনেক প্রহরী ও কামান আছে সেসব পাহারা দেওয়ার। নবাবদের অজস্র ধন-সম্পদ আছে। একজন বাঙালি জহুরী লেখককে জানালেন প্রতি বছর ক্রোর টাকার জহরত্ নবাবরা ক্রয় করেন। তাদের জুতোর উপরেও হিরে বসানো থাকে।


পরবর্তী গন্তব্য অযোধ্যা, শ্রীরামচন্দ্রের রাজধানী বন জঙ্গল হয়েছে। মধ্যে মধ্যে বসতি ও রাম সীতার মূর্তি আছে। রামনবমীতে মেলা হয়। পাঁচ ছয় হাজার বৈষ্ণব শ্রীরামের জন্মভূমি ও হনুমান গড়িতে আছে, সর্বদা ভজন সাধনে উম্মত্ত। বড় বড় হনুমান আছে কিন্তু তারা কারো ক্ষতি করে না। বরং স্তবস্তুতি করলে পথিককে পথ দেখানোর জন্য আগে আগে যায়। যেখানে রামচন্দ্রের জন্মভূমি সেই দ্বারে এক বৃহৎ হনুমান আছে তাকে কিছু খাদ্য দ্রব্য না দিলে পথ ছাড়ে না। যে স্থানে রাজ সিংহাসন ছিল সেখানে উচ্চ দ্বীপের ন্যায় হয়ে আছে। রাজধানী প্রায় দশ ক্রোশ পর্যন্ত ছিল। বাড়িঘরের চিহ্ন ইঁট পাথর তখনও ছিল।


গঙ্গা পার হয়ে মিথিলায় (নাকি সীতাপুর, উত্তর প্রদেশ?)। এর মধ্যে নৈমিষারণ্যে যান, যেখানে ৬০ সহস্র ঋষির তপোবন ছিল। নানা ফুলে সুশোভিত বন, নির্জন স্থান দেখে খুব আনন্দলাভ করলেন। এবার সেকেন্দ্রা (সিকান্দ্রা) উপস্থিত হলেন। সেখানে জেলার কাছারি, ডাকঘর, ডাক্তার-খানা আছে । এখানে এমন কাছারি দেখেন যেখানে মুসলমান মুন্সেফ আর ব্রাহ্মণ দারোগা। দোকান ঘরে থাকার ব্যবস্থা আছে। দোকানে পুরি, কচুরি, মিঠাই, প্যাঁড়া পাওয়া যায়। সেকেন্দ্রা থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হলো।

                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৪ চৈত্র ১২৬০ (৭ এপ্রিল ১৮৫৪) থেকে ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১২৬২ (৩০ মে ১৮৫৪)




প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

১৭। তীর্থ ভ্রমণ ২ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

      সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                    -------  সুমনা দাম


                   (আগের পর্বের পরে)

এবার নতুন সঙ্গীদের সঙ্গে কাশীর উদ্দেশ্যে গয়া থেকে পদব্রজে লেখক যদুনাথ সর্ববাধিকারী রওনা দিলেন। সঙ্গে কয়েকজন নারী থাকায় পালকি এবং মোষের গাড়িও ছিল। প্রথমে এলো যমুনা গ্রাম (যমুনানগর, বিহার)। এখানে কাশীর গঙ্গাপুত্র পান্ডা বা তার সহকারীরা তাঁদের ধরলেন। তারপর পঞ্চাননপুর (পঞ্চাননপুর, বিহার) হয়ে গো (?) এসে রাত্রি বাস। পরদিন পুনপুনা (পুনপুন, বিহার) গিয়ে রাত্রি বাস। পরদিন দাও নগর (দাউদ নগর, বিহার) হয়ে পড়োড়িতে পোখাড়া, বিহার)  রাত্রি বাস। এইসব স্থানে পথিকদের থাকার জায়গা আছে। পড়োড়ি থেকে আকড়ি (আকোড়িগোলা, বিহার)। সেখানে শোন নদী দেড় ক্রোশ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার চওড়া। সেখানে স্নান করে সরসরামে (সাসারাম) যান। 


সাসারাম পুরনো শহর, সেখানে বাদশাহী সরাইখানা আছে। শহরে নানা জাতির বাস। ডাকঘর, মুনসেফি, রেজিস্টারী কাছারি আছে। দুলিচা, গালিচা, সতরঞ্চের তাঁতিরা জিনিসপত্র নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। এখান থেকে বাড়িতে চিঠি দেওয়া হল। এখান থেকে শিবসাগর সরাই (শিবসাগর, বিহার)। সেখানে স্নান করে জাহানাবাদে গিয়ে (জাহানাবাদ, বিহার) থাকা হলো। জাহানাবাদ থেকে মোহনিয়া (মোহানিয়া, বিহার)। সেখানে সুন্দর পুস্করণী, শিব মন্দির রয়েছে। লোহা ও মনোহারী দ্রব্যের বাজার রয়েছে। উল ও সুতার দুলিচা, আসন বোনার কারিগরদের ঘর রয়েছে। তারা ফরমাস মেনে চার টাকা থেকে ষোলো টাকা গজ দরে উত্তম গালিচা বানাচ্ছে। এখান থেকে লেখকেরা এলেন কর্মনাশা নদী তীরে । এই নদীর জল স্পর্শ করার বিষয়ে শাস্ত্রে নিষেধ আছে। স্পর্শে সকল কর্ম নাশ হয়। আগে এই নদীতে পোল ছিল না। নীচু জাতের মানুষেরা পার করে দিত, তাতে মানুষের কষ্ট হতো। এখন কোম্পানি বাহাদুর এখানে পোল করে দিয়েছেন। এখানে বাজার, দোকান, অনেক বসতি আছে। তাঁরা এবার জগদীশের সরাই (?) নামক স্থানে গিয়ে থাকলেন। সেখান থেকে দুলাইপুর (দুলহিপুর, উত্তর প্রদেশ) গেলেন  সেখানে সরাই আছে। সরাইয়ে রাত্রি বাস। দুলাইপুর থেকে বারাণসী অর্থাৎ কাশী তিন ক্রোশ।




 
      গয়া থেকে কাশী (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে কাশী অবস্থিত। অত্যন্ত সুন্দর, সুবর্ণময় এই কাশীপুরী অতি মনোরম স্থান। দক্ষিণে অসি, উত্তরে বরুণা নদী। এখানে অনেক পারঘাট আছে। আনন্দ কানন, গৌরীপীঠ, মহাশ্মশান, উত্তর বাহিনী গঙ্গা, চক্রতীর্থ, মণিকর্ণিকার জন্য কাশী প্রসিদ্ধ। দশাশ্বমেধের শীতলা ঘাটে পার হয়ে ইতালি নিবাসী তারাচাঁদ দেবের বাড়িতে সকলের থাকা হল। সেই দিন তীর্থ উপবাস করে সন্ধ্যায় বিশ্বনাথের দর্শন ও রাতে অভিষেক ও আরতি দর্শন করা হল। সেই আরতি এতই চমৎকার যে দেখেছে সেই জানবে বলেছেন লেখক। 


পরদিন মনিকর্নিকায় স্নান, তর্পণ করে বিশ্বেশ্বর, অন্নপূর্ণাদর্শন, তীর্থ শ্রাদ্ধ করে ব্রাহ্মণ সধবা কুমারীদের ভোজন করানো হল। পরদিন দক্ষিণ মানসের উদ্যেশ্যে যাত্রা করে প্রথমে কেদার ঘাটে কেদারনাথ দর্শন করে, ক্রমে পঁচিশ দেবদেবী দর্শন ও পূজা করতে করতে তিল ভান্ডেশ্বরে দর্শনে দক্ষিণ মানস দর্শন সম্পন্ন হল। তারপরের দিন পশ্চিম মানস যাত্রা করে প্রথমে পাতালেশ্বর দর্শন, শঙ্খকর্ণ মহাদেব দর্শন করে বাইশ স্থানে দেবদেবী দর্শন করা হল। পরদিন মনিকর্ণিকা তে স্নান ও তর্পণ করে দক্ষিণ মানসের উদ্দেশ্যে যাত্রা। জ্ঞানব্যাপী হয়ে দক্ষিণ মানসের বাষট্টি স্থানে দেব-দেবী দর্শন ঢুন্ডি গনেশ, বিশ্বেশ্বর, অন্নপূর্ণা, কেদার, দুর্গাদেবী, শীতলাদেবীর পূজা দেওয়া হয়। তারপর দিন পঞ্চতীর্থে স্নানাদি করে গমন। প্রথমে অসি সঙ্গমে, শেষে মনিকর্ণিকাতে স্নান করে সমাপ্ত হল। অসি, দশাশ্বমেধ, বরুণা, পঞ্চগঙ্গা, মণিকর্ণিকা এই পাঁচস্থানে তর্পণ ও ব্রাহ্মণ ভোজন করানো হল। তারপর আরো পাঁচ দিন কাশীধাম দর্শন করা হল। 


আরো কিছুদিন কাশীধামে থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু গ্রীষ্ম বৃদ্ধি হয়ে বসন্ত আর ওলাওঠার প্রকোপে অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে দেখে তাঁরা এবার কাশী ত্যাগ করে প্রয়াগতীর্থ হয়ে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

                       ( চলছে)

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৭ চৈত্র ১২৬০ (১১ মার্চ ১৮৫৪) থেকে ২৩ চৈত্র ১২৬০ (৬ এপ্রিল ১৮৫৪)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০২৪

১৬। তীর্থ ভ্রমণ ১ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

     

 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                     ---- সুমনা দাম


তীর্থমঙ্গলের পরে বাংলা ভাষায় পাওয়া ভ্রমণ সাহিত্যটি গদ্যে লেখা এবং ডাইরি বা রোজনামচার আকারে লেখা। তীর্থ ভ্রমণের লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী (১৮০৫ -১৮৭১) এই ভ্রমণটি শুরু করেন ২৬০ সনের (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪  খ্রিস্টাব্দ) ১১ই ফাল্গুন তাঁর বর্তমান খানাকুলে অবস্থিত রাধানগরের বাড়ি থেকে। ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরেন ৯ ই অগ্রহায়ণ, ১২৬৪ সনে (২৪ ভেম্বর ১৮৫৭)। এই সময়ে ভারত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে ছিল। এই ভ্রমণটি ভারতের রেল পূর্ববর্তী কালের ভ্রমণ। ভারতীয় রেল ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বোম্বে থেকে থানে ও কল্যান অব্দি এবং হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত প্রথম শুরু হয়। দেশের অন্যান্য জায়গায় তখন কোনো রেলের সংযোগ ছিল না। তীর্থমঙ্গলের কবি বিজয়রাম, জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের যে সহায় সম্বল পেয়েছিলেন বর্তমান গ্রন্থের লেখকের সেরকম কিছু ছিল না। তিনি মূলতঃ পদব্রজে, নিজের চেষ্টায়, নিজের সামান্য অর্থে এই ভ্রমণ করেছেন। তিনি আত্মীয়-স্বজনকে শোনানোর জন্য নিজের দিনলিপি লিখেছিলেন, পরবর্তীকালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক নগেন্দ্র নাথ বসুর সম্পাদনায় তীর্থ ভ্রমণ নাম নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
 



  রাধানগর থেকে গয়া (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


লেখক তীর্থ ভ্রমণের পূর্বে অম্বল রোগে অত্যন্ত পীড়িত হয়েছিলেন। ভগ্ন স্বাস্থ্যের উদ্ধারের জন্য তিনি পশ্চিম দেশে যেতে অভিপ্রায় করেন। চিকিৎসকও তাকে পদব্রজে পশ্চিম বা উত্তর দেশে ভ্রমণের পরামর্শ দেন। তিনি প্রথমে বৃন্দাবন পর্যন্ত যেতে আগ্রহী ছিলেন। ভ্রমণের শুরুতে ৩০ টাকা সঙ্গে নিয়েছিলেন। বাড়ির অনেকেই তাঁকে এই ভ্রমণে যেতে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিল। তীর্থ ভ্রমণের পূর্বে ব্রাহ্মণ- কায়স্থ ভোজন, শ্রাদ্ধ, সংযম পালন করে তিনি খানাকুলের নিকটস্থ রাধাবল্লভপুরের ঈশ্বরচন্দ্র কওড়ি, নকুড়চন্দ্র বসু, রামধন সিংহ এবং মুটে হিসাবে বিশ্বনাথ তাঁতিকে নিয়ে রওনা হলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের দাদা গোরাচাঁদ কওড়ি এর তিন বছর আগে যাত্রী নিয়ে গয়া তীর্থে গেছিলেন। প্রথমদিকেই বিশ্বনাথ তাঁতি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। 
যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় রাধাবল্লভপুর থেকে জাহানাবাদের (বর্তমান আরামবাগ) অপর পাড়ে কালিপুর (দ্বারকেশ্বরের অপর পাড়ে) হয়ে গৌরহাটি (গৌরহাটি, খানাকুল) পৌঁছান। পরদিন কোতলপুর (কোতুলপুর, বাঁকুড়া) নামক সমৃদ্ধস্থানে থাকা হয়। কোতুলপুর থেকে বালসী (বালসী, বাঁকুড়া) গিয়ে লক্ষীনারায়ণশীলা দর্শন করা হয়। লেখক এই স্থানের আর্থ-সামাজিক নানা কথা লিখেছেন। তীর্থস্থানের পুরোহিতদের লোক ঠকানোর কথাও লিখেছেন। তারপর পাত্রসায়ের হয়ে সোনামুখী গ্রামে (বর্তমান সোনামুখী, বাঁকুড়া) যান বনের ভিতর দিয়ে। সেখানে তখন নানা হিংস্র জন্তু যেমন ভাল্লুক ছিল। বর্ধমান রাজার শ্রীমদ ভগবতদের বিখ্যাত কথক গদাধর শিরোমনির বাসস্থান এই সোনামুখী। তাঁর অর্থানুকুল্যে জঙ্গলের মধ্যে এই বসতি গড়ে উঠেছে। তাঁর গৃহে গোবর্ধন পর্বতের মন্দিরাকৃতি দেবালয় আছে। সোনামুখী থেকে বেরিয়ে ইচলার খাল (অধুনা লুপ্ত?)। তারও কিছু পরে দামোদর নদীর শ্রীরামপুর ঘাট (?)। আরো গেলে গোপালপুরের (বিষ্ণুপুরের নিকট) পাকা রাস্তা পাওয়া যায়। যে রাস্তা বর্ধমান থেকে দিল্লী পর্যন্ত যায় (বর্তমানে বর্ধমান-বিষ্ণুপুর রোড)। 


এই রাস্তার কিছু দূর অন্তর চটী বা পথিকদের রাত্রিবাসের স্থান। রাস্তার দুই ধারে দোকান। দোকানগুলি খোলার ঘর, পথিকদের থাকার স্থান বড় বড় ঘর। সকল ঘরের ভাড়া দিতে হয় না। হাঁড়ি, কাঠ বাবদ পয়সা দিতে হয়। চাল, ডাল ওই দোকান থেকে নিতে হয় আর তরকারি, মাছ, তেল, দুধ, দই বিক্রি করতে বিক্রেতা আসে। ধোপা, নাপিত ইত্যাদি সবই চটীতে পাওয়া যায়। ইঁদাড়া বা কুয়োতে পথিকের জন্য ভালো পানীয় জল আছে। পুলিশের চৌকি থানা আছে। এরপর এল অন্ডাল (পশ্চিম বর্ধমান)। অন্ডাল থেকে এক ক্রোশ দূরে মধুবন। খুব ঘন মহুয়া গাছের জঙ্গল। 
তারপর ফয়েদপুর, তারপর বোগড়া  (বর্তমান রানীগঞ্জ স্টেশন-এর কাছে)। এখানকার গোবিন্দ পন্ডিত ২৪ পরগনা জেলায় ডেপুটি কালেক্টর -এর কাজ করেন। পথিকদের সুবিধার্থে রাস্তার ধারে সুন্দর ফুল, ফলের বাগান, তার মধ্যে দশ বিঘা পুকুর ও জলসত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন গোবিন্দ পন্ডিত মহাশয়। বগোড়া থেকে নিয়ামতপুর (নেয়ামতপুর, পশ্চিম বর্ধমান) হয়ে যাত্রা করেন। এই পথে অশ্বারোহী প্রহরীরা পাহারা দেয় বলে নিরাপদ। 


এবার এলো এক লাল মাটির পাহাড়, মেটে সিঁদরে পাহাড়, যার পশ্চিমে বরাকর নদী। পূর্ব তীরে রাজা হরিশচন্দ্রের দুটি শিব মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের সামনে ও পেছনে পাথরের তৈরি গরু ও শুকরের মূর্তি। এই হরিশচন্দ্র পঞ্চকোট বংশের রাজা ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীতে। নিয়ামতপুর রাজা হরিশচন্দ্রের রাজধানী, গড় পঞ্চকোট থেকে কিছু দূরে অবস্থিত। বরাকর নদ পায়ে হেঁটে পার হয়ে পশ্চিম পাড়ে নৃসেচটী। সেখানে প্রায় ৪০ টি বড় ঘর আছে পথিকদের জন্য। এই চটী পার হয়ে চাস চটী (চাস,ঝাড়খন্ড)। তারপর গোবিন্দপুর-এর চটী (গোবিন্দপুর, ঝাড়খন্ড)। 


'এই চটি পর্যন্ত মগঘ রাজ্য। মৎস্য দেশ, বরাকর অবধি বিরাট রাজ্য। তাহার পর জরাসন্ধাধিকার মগধ' - এটি লেখক বলেছেন। তবে এই বক্তব্য মহাভারত অনুসরণে হলেও এটি সম্পূর্ণভাবে লেখকের মতবাদ। এখানকার মানুষ আধা হিন্দিভাষী আধা বাংলাভাষী। 
এবারে পাহাড়ি পথ গিয়ে রাজগঞ্জ (ঝাড়খন্ড)। এখানে সাহেবদের থাকার একটা বাংলো আছে। এরপর চড়াই উত্তরায় পেরিয়ে তোপচাঁচির চটী। জরাসন্ধের গড় এটি দেখেই সম্ভবত তাঁর মনে হয় মগধের জরাসন্ধের কথা।


লেখক  পরেশনাথ পাহাড় দেখেন এ পথে। সব থেকে বড় পাহাড়। সেই পাহাড় ফল ফুল লতা বৃক্ষ হিংস্র জন্তু পূর্ণ। পাহাড় চূড়ায় সরাবগি বণিকদের কুলদেবতা (জৈনদের সরাবগি অর্থাৎ শ্রাবক বলা হয় হত) অর্থাৎ জৈনদের তীর্থস্থান পরেশনাথের মন্দির আছে। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় পাহাড়ের নিচে মহুয়া বনে পরেশনাথের মেলা বসে। সেখানে আগরওয়ালা ধর্মশালা আছে। পাহাড়ের ওপরে পুস্করিণী ও পুষ্পদ্দান আছে। পরেশনাথ পাহাড়ের নিচে জরাসন্ধের কেল্লার পাশ দিয়ে ডুমরিচটী (ডুমরি, ঝাড়খন্ড)। চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত। সেখানে ঝরনার জলে স্নান করে থাকা হলো। তারপর বগোদরের চটী (বগোদর,ঝাড়খন্ড), বরকাট্টা চটী, আটকা চটী। এখানে চিঠি দেওয়ার ডাকঘর আছে। লেখক কলকাতায় পত্র দিলেন।


তারপর বরশোত (ঝাড়খন্ড), বরহি (ঝাড়খন্ড), চোপারন (চৌপারন) প্রভৃতি পার্বত্য চটী পেরিয়ে এল ভয়ানক জঙ্গলের ভেলুয়া (ভেলওয়া, ঝাড়খন্ড)। এখানে পর্বতে দস্যু আছে যারা পথিকদের আক্রমণ করে সব হরণ করে নেয়। এই পথে ঘোড়া বদল করার অশ্বশাল আছে। তারপর বারা চটী (বারা, ঝাড়খন্ড)। কুশলা নদী (?) পেরিয়ে বোধগয়া (বর্তমানে বিহার) এলেন। লেখক এখানে গয়াসুর বিষ্ণুর সঙ্গে যুদ্ধ করেন বলে লিখেছেন। এখানে ধর্মারণ্যে রাজার মন্দির আছে। (আলেকজান্ডার কানিংহাম, ডিরেক্টর জেনারেল, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ১৮৭৮ এর মহাবোধি মন্দির করেন। তার আগে বৌদ্ধ স্থাপত্য সব মাটির তলায় ছিল। তাই যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় এখানে বৌদ্ধ কোন ধর্ম স্থানের উল্লেখ করেননি)। লেখক বলেন যে বোধগয়াতে তখন এক মোহন্ত ছিলেন, অনেক রাজা তাঁর শিষ্য। তাঁদের দেওয়া ধন, ভূসম্পত্তি, বিশাল বাগান রয়েছে। যারা তীর্থ শ্রাদ্ধ করে আসে না তারা গয়া ধাম যাওয়ার আগে বোধগয়াতে শ্রাদ্ধ করে। গয়াল অর্থাৎ গয়ার পান্ডার লোকেরা এসে এখানে নিজের নিজের যাত্রী নিয়ে যায়। ব্রহ্মযোনি পাহাড়ে পৌঁছে বিষ্ণু মন্দিরের ধ্বজা দেখিয়ে সেতুয়ারা প্রতি ব্যক্তির থেকে এক টাকা করে নেয় ধ্বজা দক্ষিনা স্বরূপ। 


গয়াতে পৌঁছে ক্ষৌর কর্ম, ফল্গু নদীতে স্নান, তর্পণ, বিষ্ণুপদ দর্শন, গয়েশ্বরী দেবী দর্শন, অহল্যাবাই প্রতিষ্ঠিত মন্দির দর্শন এবং বিষ্ণুপদে পিন্ডদান করা হল। এখানে তিনি বিভিন্ন প্রকার শ্রাদ্ধ , গয়াক্ষেত্রের মহিমা, পিন্ডদানের বিভিন্ন বেদী (ষোল বেদী), অষ্টতীর্থ এসব বর্ণনা করেছেন। তারপর প্রেতশিলা, রামশিলা, রামগয়া, সীতাকুণ্ড, গয়া কুপ, ধৌতপদ, ভীমগয়ার কথা লিখেছেন। ফল্গু নদীতে জলে স্রোতের প্রকাশ নেই কিন্তু খনন করলে জল ওঠে। ওই জল সুপেয়। বালি খনন করলে যে জল পাওয়া যায় তার মধ্যে ছোট ছোট মাছ খেলা করতে দেখা যায় বলে লিখেছেন। গয়া ক্ষেত্রের বিষ্ণুমন্দিরে হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী প্রবেশ করতে পারে না বলে জানিয়েছেন। গয়ার পান্ডা সম্প্রদায় ও গয়ালদের ব্যাপারে বলেছেন যে তারা ধনী দুষ্কর্মা আর লোভী। গয়াতে পুত্রের পাঠানো টাকা দিয়ে দেনা শোধ করে কাশী যাত্রার চেষ্টায় রইলেন। শম্ভু কওড়ি ছাড়া বাকি দুই সঙ্গী স্বদেশে ফিরে গেলেন। 


গয়া শহরে তখন প্রায় দশ হাজার ঘর ছিল। মুসলমানরা শহরের বাইরে থাকতো। শহরের উত্তর দিকে সাহেবগঞ্জ। সেখানে বাজারে পিতল কাঁসার জিনিস, কম্বল, শতরঞ্চি, গালিচা, কাপড়, মনোহারী জিনিস, বাঁশের জিনিস, লাঠি, লোহার জিনিস, জুতা ইত্যাদির দোকান ছিল। তারপর কারাগার, যার প্রাচীর ছিল ১১ হাত উঁচু। ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সদর আলা, সদর আমিন, মুন্সেফ, জজদের কাছারি, ডাকঘর, আফিমের কুঠি (সেখান থেকে কোটি টাকার বেশি দাদনে আফিমের আমদানি হয়)। সরকারি ডাক্তার এক বাঙালি বাবু। তারপরে সেনা ছাউনি। শহরে পুলিশের প্রহরা ছিল। সব বাজারে পুরি, কচুরি, লাড্ডু, প্যাড়া ইত্যাদি পাওয়া যায়। গয়েশ্বরী পাহাড় থেকে আনা খুব ভালো পাথরের বাসন বিক্রি হয়।
                 
                     ( চলছে )
 
এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১১ ফাল্গুন ১২৬০ (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪) থেকে ৬ চৈত্র ১২৬০ (২০ মার্চ ১৮৫৪)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...